তিরু ওরফে সবে কৈশোর পেরোনো তিরুতমা চাকমা বাঁধভাসি পাহাড়ের অথই তলানিতে যে রাতভর বেপরোয়া ঘুরে বেড়াত তা হতে পারে এক বিচিত্র স্বপ্নঘোর। স্বপ্নঘোরাচ্ছন্ন তার জলবিহার যদি হয় রূঢ় বাস্তবকে অস্বীকার, তা হলে পাহাড়ের আদি বিদ্রোহী বলতে কি সে-ই? দীর্ঘদিন পর হেঁয়ালির মতো প্রশ্নটা যার মাথায় দুলে ওঠে, সে বিন্তি ওরফে বিনীতা চাকমা, যে পার্বত্য অঞ্চলের টালমাটাল বর্তমান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আলো-আঁধারিতে হাঁটবে বলে পথ খোঁজে-জলের তলানিতে নয়, রুক্ষ-খর ডাঙায়।
বিন্তির পথ খোঁজা তার একার নয়, বহুজনকে একসঙ্গে শামিল করতে নানা দুর্বিপাকের মধ্যেও তার পথচলা। কাজটা দুরূহ হলেও তার মন বলে অসম্ভব নয়। আর এসবের মধ্যে তার স্বপ্নে অলীক ইশারার মতো চকমকি ঠোকে কালপ্রবাহে হারিয়ে যাওয়া অনিন্দ্যসুন্দর এক পাহাড়ি জনপদ-কার্পাসমহল।
কিন্তু স্বপ্নে নয়, অতীতে নয়, তার হেঁটে চলা কঠিন বর্তমানে।
ওয়াসি আহমেদের জন্ম ১৯৫৪ সালে, সিলেট শহরের নাইওরপুলে। স্কুলের পাঠ বৃহত্তর সিলেটের নানা জায়গায়। পরবর্তী শিক্ষাজীবন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখালেখির শুরু। ছাত্রাবস্থায় প্রকাশিত কবিতা সংকলন ‘শবযাত্রী স্বজন’। কথাসাহিত্যে, বিশেষত গল্পে, মনোনিবেশ আশির দশকে। প্রথম গল্প সংকলন ‘ছায়াদণ্ডি ও অন্যান্য’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। পুস্তকাকারে প্রথম উপন্যাস ‘মেঘপাহাড়’ প্রকাশ পায় ২০০০ সালে। সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনসহ কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নানা অঙ্গনে। লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ দেশের প্রায় সব প্রধান সাহিত্য পুরস্কার।
এত সুলিখিত, এত সুখপাঠ্য! পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে ওয়াসি আহমেদ লিখেছেন, একে পাঠকের সৌভাগ্য ছাড়া আর কী বলি! বিষয়বস্তু মারাত্মক জটিল, তবু ওয়াসি আহমেদ কত সাবলীল। ‘কার্পাসমহল’ অবশ্যপাঠ্য এক উপন্যাস।
দুনিয়ার একটা মোক্ষম নিয়ম— ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। উত্তমর্ণ সুযোগ পেলেই অধমর্ণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। এই নিয়মের অন্যথা নেই। তা সে আমাদের সারে জাহাঁ সে আচ্ছা ভারতবর্ষই হোক, কিংবা সকল দেশের রানি বাংলাদেশ। একান্তচারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী দেখলেই আমাদের জমিদারি মেজাজ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কখনও আমরা তাদের যুগযুগান্তের বাসভূমি জঙ্গল থেকে উৎখাত করি (কারণ সেই জঙ্গলে খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়), অথবা তাদের বিস্তীর্ণ জনপদকে বিনা দ্বিধায় সদ্যনির্মিত বাঁধের জলে ডুবিয়ে দিই (জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে)। বাস্তুহারা, কর্মহারা, শিকড়হারা— সেই লাখো লাখো জনতার ভবিতব্য নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক হেনতান্ত্রিক তেনতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি ডাংগুলি খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যে-মুজিবুর রহমান নিজে উর্দুভাষী পাঠান হতে নারাজ ছিলেন, তিনি চাকমাদের উপদেশ দিয়েছিলেন: "তোমরা বাঙালি হয়ে যাও"। আমরা নিজেরাও ইন্টেলেকচুয়াল আলোচনায় সবিশেষ মত্ত হই: ঠিক কোন্ বিশেষণটি তাদের জন্য পলিটিক্যালি কারেক্ট হবে? আদিবাসী? উপজাতি? জনগোষ্ঠী? জনজাতি?
কাপ্তাই হ্রদের নাম শুনেছিলাম ইতস্তত। বাংলাদেশের জনপ্রিয় পর্যটন-গন্তব্য। সেই কাপ্তাই হ্রদের নিচে তলিয়ে যাওয়া জনপদ কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তুহারা মানুষদের কথা পড়তে গিয়ে আমার নিজের দেশের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। জাতীয়তাবাদের সেই একই অমানবিক মুখোশ। সেনাবাহিনীর সেই একই প্রভুসুলভ আচরণ। সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতিসত্তার নিচে চাপা পড়ে যাওয়া প্রান্তিক মানুষদের অবহেলিত আত্মপরিচয়। উপন্যাসটি পড়ার সময় আমার প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষার আধিপত্যকামী রূপটি দেখে মনে পড়ে গেছে বর্তমান ভারতের "হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান" স্লোগানটি। ওয়াসি আহমেদের এই উপন্যাসটি আরেকবার প্রমাণ করেছে, ধর্মপরিচয় হোক, জাতিপরিচয় হোক, কিংবা ভাষাপরিচয়, এসব তো মূলত জন্মসূত্রে পাওয়া আইডেন্টিটি কার্ডের বেশি কিছু নয়। কিন্তু এই আইডেন্টিটি কার্ডকে যখন আমরা পূতপবিত্র একমেবাদ্বিতীয়ম মানতে শুরু করি তখনই হয় মুশকিল। তখনই আমরা মানুষের খোলস ত্যাগ করে শ্বাপদ হতে শুরু করি।
"কার্পাসমহল" একটি পরিশ্রমলব্ধ উপন্যাস। কাপ্তাই হ্রদের নিচে ডুবে থাকা পুরোনো রাঙামাটি জেলার জীবন্ত বর্ণনা কিংবা পার্বত্য জনগোষ্ঠীর দুনিয়াদারির খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন লেখক। "কার্পাসমহল" একটি সাহসী উপন্যাসও বটে। আখ্যানের সাহসী চরিত্ররা তো আসলে লেখকের নিজের সাহসের প্রতিফলন। বুঝতে পেরেছি যে পাহাড়ের ইস্যুটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি স্পর্শকাতর ইস্যু (ঠিক আমার দেশের মতোই)। কিন্তু লেখক নিজের বক্তব্য প্রকাশে পেছপা হননি। ইদানিংকালে প্রকাশিত পরপর কয়েকটি উপন্যাসের দুর্বল প্লট এবং/অথবা বানোয়াট গদ্যের ক্লান্তিকর কারসাজি আর আঙ্গিকের "শৌখিন নিরীক্ষা" দেখে-দেখে হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলাম। ঋজু গদ্যে লেখা এই উপন্যাসের বস্তুনিষ্ঠ পরিবেশন আমার মনের ভেতরের জমে থাকা অনেক কুয়াশা কাটিয়ে দিয়েছে। বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে বইটি পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে আঞ্জুমান লায়লা নওশিন। তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
আরেকটা কথা বলে রাখি। আমি আমার ভালো না লাগা বইগুলো কাউকে না পড়তে উৎসাহ দেইনা। কারণ একেকজনের ইন্টারপ্রেট করার ক্ষমতা, চিন্তাশক্তি একেকরকম৷ তাই নিজে পায়ের পাতা না ভেজালে পানির অবস্থা বুঝবেন না-আমি এই নীতি মানি। ভালো লাগার বইয়ের ব্যাপারে আমি সবসময়ই বলি। ভালো লাগা বই গুলো নিয়ে আমি কথা বলতে ভালোও বাসি। এবার থেকে খারাপ লাগার গুলোও বলে যাবে। কারণগুলো অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে। তবে তাতে কিছু আসে যাবেনা। বেশিরভাগ নতুন লেখকদের বাংলা বইয়ে আমি কেমন যেনো শূন্যতা অনুভব করি। বই বেশি ভালো লেগেছে, লেখা আমাকে অন্য জগতে নিয়েছে, তেমন শূন্যতা না। কিছুই খুঁজে পেলাম না ধরনের শূন্যতা।
ভুক্তভোগীদের তুলে ধরেছেন, ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা তুলে ধরেছেন, এই বিষয়গুলো ভালো লেগেছে। কিন্তু লেখনী আমার পছন্দ হয়নি। খাপছাড়া ভাবে এগিয়েছে বলে মনে হয়েছে। এটা কী বর্তমান অতীতের মিল ঠিকঠাক করতে পারেননি বলে? নাকি আমার অনুসরণ করতে কষ্ট হলো বলে?
দুই ভিন্ন সময়, দুই ভিন্ন দেশ ও দুই ভিন্ন চরিত্রের জীবনগাথা পাশাপাশি চলতে চলতে মিলিত হয়েছে একই ফলাফলে। বাঁচতে, বাঁচাতে, টিকে থাকতে সব পরিচিত স্থল, স্মৃতি, শেকড় ফেলে মানুষ কীভাবে নতুন কোনো অচেনা অন্ধকারে ছুটে যায়—লেখক সেই অনিশ্চিত বাস্তবকে অসাধারণ ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন।
সমতলের মানুষ যেখানে বংশানুক্রমে বংশ বৃদ্ধি পায়, সেখানে পাহাড়ের মানুষকে বংশানুক্রমেই তাড়িত হতে হয়েছে, কখনো কাপ্তাই বাঁধের অমানবিক নির্মাণে, কখনো সেটেলারের আক্রমণে, কখনো প্রশাসনিক নিষ্ঠুরতায়, কখনো নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে, আবার কখনো তথাকথিত রঙিন মোড়কের কর্দমাক্ত চুক্তিতে।
লেখক পাহাড়ের দীর্ঘ সংগ্রামকে জীবন্ত করে তুলেছেন—বিন্তির প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে, শায়লার ভ্রমণ-অনুভবে, সিতারার অভিমানঘন কথোপকথনে, আর রিপনের সেই হৃদয়বিদারক উচ্চারণে— ‘’আমার পরিবারতো হাজার হাজার পরিবারের মতো কাপ্তাই লেকের ভিকটিম, এই লেকের তলানিতে আমার আদি ভিটামাটি, আর এই লেকের পানিতেই আমি ট্যুরিস্ট নিয়ে ঘুরি, ব্যাচ-পিকনিক করে, গান-বাজনাও এ নিয়ে আমার সমস্যা হয় না। আমাকেতো বাঁচতে হবে।কান্নাকাটি আর কত! কেন বার বার বলতে হবে কাপ্তাই বাঁধ আমাদের অশ্রুজল?’’
তিরুত্তমা চাকমার চরিত্র বিশেষভাবে স্পর্শ করেছে; শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তার অস্তিত্ব-লড়াই যেন পাহাড়ি জীবনের সার্বজনীন আখ্যান। তবে আমার ব্যক্তিগত প্রত্যাশা ছিল পরিমচানের স্বাবলম্বী যাত্রার পাশাপাশি সেই সময়ে সহায়হীন, দীন-দরিদ্র পাহাড়িদের জীবনবৃত্তান্ত কিছুটা আরও বিস্তৃতভাবে দেখার। বিশেষ করে যখন পরিমচান নৌকা ভাড়া করে দেশ ছাড়েননি, বরং অজানা আরেক পাহাড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন—সেই সময়ের অসহায় মানুষেরা কিভাবে ছিলেন, কোথায় ছিলেন তার আরও স্পষ্ট চিত্র পেলে পূর্ণতা পেত।
সবশেষে, কার্পাসমহল আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে—এই অজানা-অচেনা চিরসবুজ পাহাড���, তাকে ঘিরে নির্মিত রাজনীতি, তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, এবং পাহাড়বাসীর অবিরাম অনিশ্চয়তা নিয়ে। প্রশ্ন জাগে, এই অনিশ্চয়তার অবসান কি কখনো হবে? নাকি কল্পনা চাকমার মতো করেই বিন্তিও হারিয়ে যাবে মানুষের সৃষ্ট আরেক নির্মম বাস্তবতার অরণ্যে বা জলের গভীরে—যেখানে ইতিমধ্যেই ডুবে আছে হাজারো মানুষের ভিটে, ঘর, সম্পদ, পরিজন আর বনজ সম্পদ!