১৯৪৩ সালে জন্ম, ২০০১ সালে মৃত্যু। ইতিমধ্যে আড়াই দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো আলোচনায় আছেন আহমদ ছফা। জীবনাচরণে ও লেখাজোখায় আর দশজনের চেয়ে আলাদা। তাই তিনি বিশিষ্ট। ছফাকে নিয়ে একেকজনের একেক রকম অভিজ্ঞতা। চলার পথে অনেককে স্নেহ-প্রশ্রয় দিয়েছেন, সাহাঘ্যের হাত বাড়িয়েছেন। কাউকে এড়িয়ে গেছেন। আবার কাউকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি কারও চোখে দুর্মুখ, কারও চোখে প্রতিবাদী লেখক, আবার কারও চোখে মনীষী। তিনি না ছিলেন গৃহী, না ছিলেন বিবাগী, অথবা ছিলেন দুটোই। ব্যক্তি ছফার চেয়ে সাহিত্যের ছফাকে চেনেন বেশি মানুষ। তাঁরা তাঁকে খোঁজেন তাঁর কবিতায়, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে। তাঁর লেখায় আছে শব্দের ঝঙ্কার, আছে কৌতুক, বিদ্রূপ, এমনকি নিদারুণ কশাঘাত। এটি ছফার জীবনীগ্রন্থ নয়, নয় তাঁর সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন। এ বইয়ে তাঁকে স্মৃতি থেকে তুলে এনেছেন লেখক। এখানে ছফা দোষে-গুণে রক্ত-মাংসের একজন মানুষ। ছফার সঙ্গে এ বইয়ে উঠে এসেছে লেখকের নিজের বয়ানে ওই সময়ের আখ্যান।
জন্ম ১৯৫২, ঢাকায়। পড়াশোনা গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনে মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বিএলএফের সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দৈনিক গণকণ্ঠ-এ কাজ করেছেন প্রতিবেদক ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে। দক্ষিণ কোরিয়ার সুংকোংহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাস্টার্স ইন এনজিও স্টাডিজ’ কোর্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক। তাঁর লেখা ও সম্পাদনায় দেশ ও বিদেশ থেকে বেরিয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা অনেক বই।
অনেকগুলো "কাটপিস" উৎপাদনের পর মহিউদ্দিন আহমদ অবশেষে একটা বই "লিখলেন।" ব্যক্তিগত স্মৃতির আলোকে ছফার জীবন ও কৃতি আলোচনা করেছেন লেখক। এর সুবিধা অসুবিধা দুই-ই আছে। সুবিধা - অন্তরঙ্গ, অকপট হয়েছে লেখা। অসুবিধা - ছফার সার্বিক সত্তাকে ধারণ করা সম্ভব হয়নি গ্রন্থকারের পক্ষে, কিছু ক্ষেত্রে করেছেন ভুল মূল্যায়ন। ছফার অনেক ভালো গুণের পাশাপাশি খারাপ বৈশিষ্ট্যও ছিলো। তিনি যাকে পছন্দ করতেন না তাকে খুব বাজেভাবে উপস্থাপন করতেন নিজের লেখায় (উদাহরণ পড়ে কখনো বিস্মিত, কখনো ব্যথিত হতে হয়)।
ছফা তার সাহসের জন্য বিখ্যাত ও কুখ্যাত। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তিনি সরকারি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লেখালিখি করেছেন। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিবের উদ্দেশে নির্ভয়ে লিখেছেন,
"আশ্চর্য শক্তিমান পুরুষ আপনি, তুলনাবিহীন আপনার বাকচাতুরী, জাদুময় আপনার কণ্ঠধ্বনি। এই বাংলাদেশে যখন আপনার সুশাসনে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে-আর আপনার দলের লোকেরা সেই মৃত, অর্ধমৃত মানুষের হাড়গোড়, চর্বি-মাংস সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুদের কাছে বেচে দিয়ে অর্জিত সম্পদের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করবার পরিকল্পনা তৈরি করছে, তখনো আপনি বঙ্গবন্ধু থেকে যান। আপনি বাংলাদেশের মানুষের যদি বন্ধু হন, তাহলে তাদের শত্রু বলব কাকে?"
ছফাকে পীর বানানোর মানসিকতা আছে অনেকের (যার পুরোধা সলিমুল্লাহ খান)। সেখান থেকে বের হয়ে নির্মোহ আলোচনা করাটা এখন জরুরি, স্বস্তিকর।
(পাদটীকা : "গাভী বিত্তান্ত" বইয়ের প্রাথমিক নাম ছিলো "গরুচোদা ভিসি।" ঠাট্টা না, আসলেই। প্রকাশক অনুনয় বিনয় করে ছফাকে নাম পাল্টাতে রাজি করান।)
—“একাত্তরে যেসব সক্ষম তরুণ সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়নি, তারা অপরাধ করেছে।”
বইটিকে কোনো ভক্তিপুস্তক নয়,বরং এটি ছফার সঙ্গে বসবাস করা একজন লেখকের স্মৃতির দলিল বলা যায়। এখানে ছফা নায়ক নন, আবার খলনায়কও নন—তিনি রক্তমাংসের, দ্বন্দ্বময়, তীক্ষ্ণ ও আপসহীন এক মানুষ।
ছফার ভালোবাসা ছিল উজাড় করে দেওয়ার মতো, আর ঘৃণা ছিল নির্মম কলমে ছিন্নভিন্ন করার মতো। গাভী বিত্তান্ত*–এর পূর্বনামই তার প্রমাণ। মহিউদ্দীনের স্মৃতিচারণে ছফার রাজনৈতিক অবস্থান, সাহিত্যিক দায়বদ্ধতা এবং একগুঁয়ে জীবনদর্শনের আংশিক কিন্তু গভীর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
মানুষ ছফাকে অপছন্দ করতে পারে, তার অবস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ হতে পারে, কিন্তু সাহিত্যিক ছফাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। তার ভাষার ধার পাঠককে প্রতিরোধের ভেতর টেনে নেয়।
সংক্ষেপে, এটি ছফাকে বোঝার বই—ভালবাসার জন্য নয়, সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য।
বিচিত্র আচরণ, অসাধারণ লেখনী, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সবমিলিয়ে আহমেদ ছফা নামটা বেশ আলোচিত। এবার তাঁকে নিয়ে আস্ত একটা বই লিখে ফেললেন লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ।
বইটি মূলতঃ আহমেদ ছফাকে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ঘটেছে। সে সূত্রে বেশকিছু নতুন তথ্যও জানা হলো। এছাড়া লেখক বইয়ে আহমেদ ছফার বেশ কিছু সম্পাদকীয় লেখা সংযুক্ত করেছেন। লেখাগুলো পড়লে ছফার তৎকালীন সময়টাতে তাঁর ক্ষুরধার মেধার পরিচয় পাওয়া যায়।