Jump to ratings and reviews
Rate this book

জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি

Rate this book
মুক্তিযুদ্ধের পরে বলা চলে একরকম শূন্যতার মধ্যেই জন্ম নিয়েছে প্রতিবাদের অন্য এক ধরনের প্রবণতা, যার সংগঠিত রুপ হচ্ছে জাসদ নামের একটি রাজনৈতিক দল। সব মিলিয়ে বইটি হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী অস্থির সময়ের এক দলিল, যার অনেকটাই লেখা হয়েছে রক্তের অক্ষরে।

287 pages, Paperback

First published October 1, 2014

49 people are currently reading
553 people want to read

About the author

জন্ম ১৯৫২, ঢাকায়। পড়াশোনা গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনে মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বিএলএফের সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দৈনিক গণকণ্ঠ-এ কাজ করেছেন প্রতিবেদক ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে। দক্ষিণ কোরিয়ার সুংকোংহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাস্টার্স ইন এনজিও স্টাডিজ’ কোর্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক। তাঁর লেখা ও সম্পাদনায় দেশ ও বিদেশ থেকে বেরিয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা অনেক বই।

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
132 (36%)
4 stars
190 (52%)
3 stars
35 (9%)
2 stars
2 (<1%)
1 star
1 (<1%)
Displaying 1 - 30 of 59 reviews
Profile Image for Harun Ahmed.
1,662 reviews421 followers
March 7, 2025
৪.৫/৫

১.সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক দল জাসদ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ঝড় তুলেছিলো একটা সময়।জাসদের জন্ম হয়েছিলো বিপ্লব ঘটাতে,যুদ্ধ পরবর্তী অস্থিতিশীলতা,নেতৃত্বহীনতা,শোষণ ও অনাচার থেকে দেশকে মুক্ত করতে।ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে এ দলের ভূমিকা কখনো ইতিবাচক,কখনো ধ্বংসাত্মক।বিশেষত ১৯৭৫ এ শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্যদিয়ে যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে ও এদেশের ভাগ্য চিরদিনের মত পালটে যায়;সে সময়ে জাসদের নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ছিলো সুদূরপ্রসারী।সেইসময় তথাকথিত অনেক "বিপ্লব" ঘটে, যেগুলোতে জাসদ অন্যতম প্রধান ক্রীড়নকের ভূমিকায় থাকলেও এর সুফল ঘরে তুলতে পারেনি। বরং নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছে।এ বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের যথাযথ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ। জিয়াউর রহমান,আবু তাহের,খালেদ মোশাররফ,খোন্দকার মোশতাক,মেজর জলিলসহ প্রত্যেকে কী করেছেন,কেন করেছেন তার কারণও খোঁজা হয়েছে বইতে।"বিপ্লব" এর পরে কিছু বিপ্লবী কারাগারে গেছেন, কিছু বিপ্লবী গেছেন ক্ষমতায়,কিছু বিপ্লবী হতাশায় মুষড়ে পড়েছেন আর বেশিরভাগই ক্ষমতাবানদের সাথে হাত মিলিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন।এটাই সত্যি।শীর্ষেন্দুর ভাষায়,

"বিপ্লবের পথ কেবলি গার্হস্থ্যের দিকে বেঁকে যায়,
বনের সন্ন্যাসীরা ফিরে আসে ঘরে।"

২.যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী এ বইটি তাদের পাঠ করা উচিত।মহিউদ্দিন আহমদের গদ্য ঝরঝরে ও মেদহীন। বাংলাদেশের ষাট ও সত্তর দশকের রাজনীতি এমনিতেই রোমাঞ্চোপন্যাস এর চাইতেও বেশি নাটকীয় ,লেখকের সাবলীল গদ্যশৈলীর গুণে তা আরো স্বাদু হয়ে উঠেছে।ইতিহাস লিখতে গেলে লেখকের পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়,সেটা মাথায় রেখেও বলা যায় "জাসদের উত্থান পতন" অসাধারণ ইতিহাসগ্রন্থ।

(২২ জুন,২০২১)

আগের রিভিউগুলোয় এতো বেশি উচ্ছ্বাস যে নিজেরই পড়তে অস্বস্তি লাগে এখন। তাই উচ্ছ্বাসের পরিমাণ যথাসম্ভব কমানো হলো।

(৭.৩.২০২৫)
Profile Image for Aishu Rehman.
1,101 reviews1,079 followers
November 23, 2024
ইতিহাসের অলিগলি পেরোনোর মতো ইন্টারেস্টিং কিছু পাঠকজীবনে পাওয়া দুস্কর। আর আমি এই অলিগলিতে মাঝে মধ্যেই হারিয়ে যায়। 'জাসদ', যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সবচেয়ে আলোচিত নাম। সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে আমার বিস্তর অভিযোগ। শুধু মনে হতো 'পোলাটা যদি প্রত্যক্ষভাবে ঠিকমতো জাসদের হাল ধরত তাহলে ইতিহাস এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতটা অন্যরকম হতে পারতো'। আবার মুজিবের প্রতিও আমার একঝাঁক অভিযোগ। দিনশেষে প্রত্যেককেই আমার ভালো লাগে। মুগ্ধ হই দেশের প্রতি তাদের অসামান্য অবদান আর ত্যাগ নিয়ে। হয়তো দুজনেই ভুল ছিল আবার দুজনেই ঠিক ছিল। কর্ম ও চিন্তাভাবনার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও দেশের প্রতি ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না।

মহিউদ্দিন আহমদের লেখা নিয়ে আমার অভিযোগের যায়গা কম। তিনি একের পর এক বাংলার যুদ্ধপরবর্তী ও পূর্ববর্তী ইতিহাস নিয়ে যেভাবে কাজ করছেন এরকম আরো কিছু লেখক এগিয়ে আসলে বাংলার ইতিহাস নিয়ে আর আক্ষেপের যায়গা থাকতো না। এই বইটা পড়ার সাথে সাথে 'প্রতিনায়ক:সিরাজুল আলম খান' বইটা পাঠকের পড়া উচিত। ইতিহাস ভাবনাটা তাতে আরো পাকাপোক্ত হবে বলে মনে করি।
Profile Image for Soaibuzzaman.
30 reviews
April 11, 2019
আশির দশকের অস্থির সময়ের রাজনীতির একটি তথ্যবহুল বই অবশ্যই। এমন একটা সময় বইটা পড়ছি যখন দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সেই অস্থির সময়ের রাজনৈতিক অবস্থারই অনুরূপ। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহের কারণেরই বেশ কিছু বই পড়া হয়েছে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে। জাসদের ইতিহাস নিয়েও এর মধ্যে কিছু রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে বইটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তথ্যবহুল কিন্তু গবেষণাধর্মী নয়। লেখক খুব সতর্কতার সাথে নির্মোহ থাকার চেষ্টা করলেও নিজস্ব পছন্দ ও অপছন্দ থেকে বের হতে পারেননি। যেমন প্রথমাংশে কর্ণেল তাহেরকে লেখক তুলে ধরেছেন জাসদের খলনায়ক হিসেবে যেখানে দেখানো হয়েছে জাসদের ভরাডুবির পেছনে তাহের অনেকাংশে দায়ী। তাহেরের সিরাজ শিকদারের সাথে সর্বহারা পার্টিতে যুক্ত থাকা নিয়ে করেছেন সমালোচনা। অথচ সিরাজ শিকদারের সাথে তাঁর পথ আলাদা হয়ে গিয়েছিলো বহু আগেই। আবার ৭ই নভেম্ববের সিপাহী বিদ্রোহেই যে জাসদকে ডুবিয়ছে এমনটাও যুক্তি দিয়েছেন তিনি। আবার পরবর্তী অংশে দেখিয়েছেন তাহের ছিলো জিয়ার ষড়যন্ত্রের স্বীকার। আবার সিরাজুল আলম খানের অনেক প্রশ্নবিদ্ধতা এড়িয়ে গিয়েছেন অনেকটা যান্ত্রিকভাবে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে আলাপচারিতাকে তিনি লিপিবদ্ধ করতে লেখক যতটা সচেষ্ট ছিলেন, তার ভেতরের আসল সত্য উৎঘাটন করতে ততটা শ্রম দিয়েছেন বলে মনে হয়নি।

বইটি পড়ে সবচেয়ে বড় পাওনা সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে জানতে পারা। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ছাত্র রাজনীতি, নিউক্লিয়াস সেল, মতাদর্শের অমিলের কারণে ছাত্রলীগ ছেড়ে জাসদ গঠন সবই যেন সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে গিয়েছিল শীর্ষে। মুজিবের পরে তারই হওয়ার কথা ছিলো শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠতা ও একে অপরের উপর নির্ভরশীলতার কারণে কেউই নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। ইতিহাস পরাজিতদের মনে রাখে না। তাকেও রাখেনি।

সবকিছু মিলিয়ে বইটি ইতিহাসের নানা উপাদানে ভরপুর। ষাট ও সত্তর দশকের উথাল পাতাল দিনগুলো নিয়ে যেসব রাজনীতিমনস্ক মানুষের রয়েছে নিদারুন কৌতুহল তাদের অনেকটা খোরাক যোগাতে সক্ষম বইটি।
Profile Image for Sohan.
274 reviews74 followers
January 9, 2021
মহিউদ্দিন আহমেদ এর বেলা অবেলা (১৯৭২-১৯৭৫) পড়ার পর এই বইটা পড়ার এক প্রচন্ড তাগিদ অনুভব করেছিলাম।
সত্তরের দশকের বাংলাদেশে সবচাইতে আলোচিত ও সমালোচিত একটি রাজনৈতিক দল জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল)
খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি দল কি করে সমগ্র দেশে আওয়ামী লীগের মত একটি দলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে তা ভীষণ রকমের ভাবিয়ে তোলে।

সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াসের বিবর্তন থেকে শুরু করে জাসদের উত্থান ও পতনের এক সুসংগত বই এইটি।
Profile Image for Aadrita.
276 reviews229 followers
September 6, 2024
দু'শ বছরের ব্রিটিশ শাসন, সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তর হয়ে একাত্তরে দেশের জন্মের গল্পটা জেনেছিলাম আমরা সবাই। ইতিহাসের পাঠ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখানে এসে থেমে যায়। যুদ্ধপরবর্তী ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দেশের অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠার গল্পটা জানাও জরুরি, নতুন স্বাধীনতার সূচনালগ্নে এসে এর প্রয়োজন আরো বেশি। এই বইটা সেই পড়াশোনা শুরু করার মতো বেশ ভালো একটা স্টার্টিং পয়েন্ট।

সত্তরের দশকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় তোলা অস্তিত্ব ছিলো জাসদের, আর এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন ইতিহাসের বিখ্য���ত, রহস্যময়, বিতর্কিত ব্যাক্তিবর্গ। তাই স্বভাবতই জাসদের গল্প বলতে কথাপ্রসঙ্গে চলে আসে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতির এক বিস্তার��ত আলাপ।

বাহাত্তরে জাসদের উত্থান, তেহাত্তর-চুয়াত্তর জুড়ে বিস্তার ও অভ্যুত্থান, এরপর থেকেই সংকট ও পতনের ঘন্টা। তবে দলের শুরুটা জানতে লেখক আমাদের নিয়ে গেছেন আরো অতীতে৷ ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গনঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং পরবর্তীতে জাসদ গঠনে নেতৃত্ব রাখা ব্যাক্তিবর্গের এই সময়কালে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভূমিকা জানানোর মাধ্যমে এই বইয়ের শুরু৷

স্বাধীনতার লড়াই কখনো থেমে থাকে না, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর পরও শেষ হয়ে যায়নি। এরপর দেশ দেখেছে অনেক উত্থান-পতন, ভোগ-লুন্ঠন, দূর্নীতি-মোহ, পরিবর্তন, ক্ষমতায় আরোহনের লড়াই এবং অনেক অনেক রক্তক্ষরণ। একটা দেশের ভিত্তি দাড় করাতে, শাসনতন্ত্র গড়ে তুলতে দেশের উপর দিয়ে, মানুষের উপর দিয়ে বয়ে গেছে একের পর এক ঝড়। এমন অস্থির সময়ে যখন দেশের হাল ধরতে, স্বাধীনতার স্বপক্ষে রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামীলীগের বাইরে কিছুর অস্তিত্ব কল্পনা করা দায় হয়ে পড়েছিলো, তখনই প্রথাগত রাজনীতির বাইরে, ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদের বাইরে গিয়ে কতিপয় তরূন উদ্যমী নেতৃবৃন্দের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। জাসদের আলোচনা সমালোচনা করতে গিয়ে তাই এই বইতে উঠে এসেছে বাকশাল গঠন, সর্বহারা রাজনীতি, রক্ষীবাহিনী, দুর্ভিক্ষ, মুজিবহত্যা, সামরিক অভ্যুত্থানসহ অনেক বিষয়।

কথাপ্রসঙ্গে আলোচনায় এসেছেন সিরাজুল আলম খান, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং আওয়ামিলীগের ভিত্তি মজবুত করে দেওয়া অন্যতম ছাত্রনেতা, বিএলএফের অন্যতম অধিনায়ক এবং পরবর্তীতে জাসদের জনক। এসেছেন মেজর জলিল, যিনি সৈনিকজীবন ছেড়ে এসেছিলেন রাজনীতিতে। ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র কর্নেল তাহের এবং ৭ ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিদ্রোহে তার ভূমিকা, এবং তার হাত ধরে জাসদের সম্পৃক্ততা। উঠে এসেছে সিরাজ শিকদার ও সর্বহারা রাজনীতির কথা।

রাজনীতির পাঠ কখনোই পক্ষপাতমুক্ত না, এই বইও তার ব্যতিক্রম নয়৷ তবে লেখক যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন নিরপেক্ষ লেন্স দিয়ে ইতিহাসকে বর্ণনা করার। লেখনীও বেশ সহজ এবং সবার পাঠ উপযোগী। চমৎকার তথ্যবহুল এই বই নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জানতে সহায়ক।
Profile Image for Samsudduha Rifath.
426 reviews22 followers
August 7, 2024
যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বই এটা।
Profile Image for SH Sanowar.
118 reviews29 followers
November 9, 2022
বলা হয় ইতিহাসকে দেখতে হয় অনেকগুলো চোখ দিয়ে, অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে। নইলে ইতিহাসটা যেমন পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে তেমনি পাঠকের জ্ঞানে অনেকটাই ঘাটতি থেকে যায়। কিন্তু অধিকাংশ সময় তেমনটা হয় না।প্রায়সময়ই নিজের আদর্শ বা পূর্বতন চিন্তার প্রভাব থেকে যায় লেখক বা পাঠক উভয়ের ক্ষেত্রে। এই বইয়ের ক্ষেত্রে ও ব্যাপারটা খাটে। বইয়ের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় কর্ণেল তাহের; ১৫ ই আগস্টের অভ্যুত্থান নিয়ে তাহের সংশ্লিষ্ট ধোয়াশা। লেখক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম থেকেই কর্ণেল তাহেরকে খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করছেন। সর্বহারা পার্টি এবং জাসদ দুই দলের সাথেই যোগাযোগ রেখে আসছিল বলে অভিযোগ আনা হয় তাহেরের বিপক্ষে। আমার পূর্বতন ইতিহাস পাঠ বলে সর্বহারা পার্টির সাথে অনেক আগেই তাঁর সম্পর্ক ভাঙ্গনের কথা।লেখক প্রায়সময় নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু তুলে আনার চেষ্টা করলেও জাসদের প্রতি প্রবল ফেসিনেশন কোনভাবেই এড়াতে পারছিলেন না।

কিছু বিতর্কিত বিষয় থাকলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাস জানতে চাওয়া প্রত্যেকের এই বইটি পড়া উচিত।মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ঝরঝরে ও সুখপাঠ্য। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এমন রোমাঞ্চকর ও হতাশাব্যাঞ্জক ইতিহাস যেকোনো থ্রিলার বইকেও হার মানায়।
Profile Image for Faija Binte Haque.
6 reviews9 followers
August 19, 2021
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বামপন্থী রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সম্পর্কে ব্যক্তিগত আগ্রহ, একই সঙ্গে পারিপার্শ্বিক প্রভাব থেকে বইটি পড়া শুরু করেছিলাম।
বইয়ে বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহকে দুইটি অংশে ভাগ করলে একটা অংশে কেবল জাসদ দলটির গঠনের ইতিহাস, ভূমিকা, পটভূমি, উত্থান, বিস্তার, রূপান্তর, বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, বিপ্লব, পুনরুত্থান, ভাঙন থেকে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ, নির্ভরযোগ্য, প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে তথ্যনির্দেশ সংবলিত বর্ণনা রয়েছে। অন্য অংশে রয়েছে কেবল জাসদের ইতিহাসই নয়, বরং তৎকালীন অস্থির সময়ের সকল দলের সামগ্রিক ইতিহাস।
জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদের বড় ভূমিকা ছিলো সেই স্বাধীনতার আগে থেকেই। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে জাসদের কিছু অনস্বীকার্য অবদানের কথা উল্লেখ করতে গেলে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে রয়েছেঃ 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটির প্রথম ব্যবহার, 'জয় বাংলা' স্লোগানের প্রচলন, মানচিত্রখচিত পতাকা তৈরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ।
শুরু থেকেই জাসদ নিজেকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিলো। তাদের সামনে আইকন বা আদর্শ হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন সিমন বলিভার, সানডিনো ও ফিদেল কাস্ত্রো। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাঁরা উদাহরণ দিতেন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা ও সুভাষ বসুর। অন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সঙ্গে তাঁদের আরেকটি প্রধান পার্থক্য ছিলো, জাসদ তাদের প্রচারপত্রে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার কথা মাঝেমধ্যে বললেও মূলত তারা ছিলো জাতীয়তাবাদী।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কতিপয় কারণে দলটির আওয়ামী লীগের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি এবং অন্য বামদল-বিশেষত মাওবাদী সর্বহারা পার্টির সাথে মিলে বেশ তৎপর ছিলো দলটি। জাসদ রক্তপাতে নয়, বরং বিপ্লবে বিশ্বাসী হলেও তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর সাথে বারবার সংঘর্ষে উভয়পক্ষের প্রচুর লোক নিহত হয়।

সেই অস্থির সময়ের অবস্থা হুমায়ূন আহমেদের ইতিহাসনির্ভর এবং শেষ উপন্যাস 'দেয়াল' বইয়ে বর্ণিত হয়েছে যেভাবে:
"যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে ঠিকঠাক করে তুলতে সবাই সাহায্য করবে-এটাই আশা করা হয়, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে তখন অস্বাভাবিকের রাজত্ব। সব দল বর্ষার কই মাছের মতো উজিয়ে গেছে। মাঠে নেমেছে সর্বহারা দল। যেহেতু তারা সর্বহারা, তাদের আর কিছু হারাবার নেই৷ তারা নেমেছে শ্রেণীশত্রু ক্ষতমে। তাদের প্রধান শত্রু আওয়ামী লীগ।
সর্বহারাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেমেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তারা বাংলাদেশকে বদলে দেবে। বাংলাদেশ হবে সমাজতান্ত্রিক দেশ। বিশেষ ধরনের এই সমাজতন্ত্র কায়েম শ্রেণীশত্রু ক্ষতম দিয়ে শুরু করতে হয়। চলছে হত্যাকাণ্ড।"

লেখকের মতে বাহাত্তর সালটা ছিলো জাসদের উত্থানপর্ব, তেহাত্তর-চুয়াত্তর ভরা যৌবন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই দলটি সংকটে পড়ে। কেননা পরিপ্রেক্ষিত পাল্টে যায় পুরোপুরি। ছিয়াত্তর থেকে শুরু হয় ভাটার টান। একদিকে অস্তিত্বের সংকট, অন্যদিকে ভাঙনপর্ব।
এরপরও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বল্প সময়ে দেশের রাজনীতিতে যে বিশাল পটপরিবর্তন হয়, সেই অস্থির সময়ে তৎকালীন ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বড় নিয়ন্ত্রক ছিলো জাসদ। বিশেষত খন্দকার মোশতাকের আশি দিনের শাসনাবসানের পর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমত��� দখলের মাত্র আড়াই দিনের মাথায় জাসদ নেতা কর্নেল তাহেরের একক নেতৃত্বে পুনরায় অভ্যুত্থান হলে কর্নেল খালেদ মোশাররফের পতন হয়।
এরপর জিয়াউর রহমানের কৌশলে ক্ষমতাগ্রহণ, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কঠোরতম নীতি অবলম্বন, কূটকৌশলের শিকার জাসদের কর্নেল তাহেরের ফাঁসি, জাসদ নেতাদের ওপর চাপানো মিথ্যা মামলা, অবিচারিক বিচার জাসদের দ্রুত ভাঙনকে তরান্বিত করে।
বইটি না পড়লে জানতামই না বর্তমানে কোনো রকমে টিকে থাকা, অভ্যন্তরেও ভাঙনের শিকার দলটির অতীত এমন কল্পনাতীত গৌরবময়।
বইটির বিশেষত্ব হলো, এখানে কেবল জাসদের গল্পই বলা হয়নি, বরং জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির চমৎকার বিবরণী রয়েছে। একই সঙ্গে জাসদের দলীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিপ্লবী চিন্তাধারা, কার্যক্রমেরও তথ্যনির্ভর বর্ণনা রয়েছে।
Profile Image for Sanowar Hossain.
281 reviews25 followers
December 11, 2023
'প্রদীপ নিভে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে অল্প সময়ের জন্য সর্বোচ্চ উজ্জ্বল দেখায়।' এমনটা সবচেয়ে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তথা জাসদের সাথে। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই আওয়ামীলীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ভাঙন থেকে জাসদের জন্ম। সময়ের হিসাবে খুব অল্পই দলটি রাজনীতির মাঠে থাকতে পেরেছিল। কিন্তু এই অল্প সময়েই যতটুকু আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তা অভাবনীয়। মহিউদ্দিন আহমদের কলমে জাসদের ইতিহাস হয়ে উঠেছে জীবন্ত এবং করেছে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদের ইতিহাসকে ধারণ।

জাসদ সৃষ্টির বীজ নিহিত আছে ১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের ভেতরেই। তখন ছাত্রলীগের মূলধারার পাশাপাশি একতি বিপ্লবী ধারার সৃষ্টি হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সিরাজুল আলম খান। 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ' নামে সেলটি তৈরি হয় এবং কালের পরিক্রমায় জাসদে রূপান্তরিত হয়। ছাত্রলীগে তখন দুইটি ধারা বিদ্যমান ছিল। যাদের একটির নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি এবং অপর ধারাটির নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। সিরাজুল আলম খানের অনুগত কর্মীরা বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতার ধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। এই উপদলীয় কোন্দল যুদ্ধ পর্যন্ত খুব একটা প্রকট আকার ধারণ করেনি। যুদ্ধ শুরু হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভারতীয় সরকারের সাহায্যে বিএলএফ বাহিনীতে যোগদান করেন এবং প্রশিক্ষণ নেন। এই দলটিই মুজিববাহিনী নামে পরিচিতি পায়। যুদ্ধের সময় আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতা বিশেষ করে তাজউদ্দীন আহমদের সাথে মুজিববাহিনীর নেতা শেখ ফজলুল হক মণির সাথে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

যুদ্ধে জয়লাভের পর মুজিবনগর সরকার এবং বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরত আসেন। তখন সবার সামনে একটি প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, সরকার কীভাবে গঠিত হবে? সিরাজপন্থী ছাত্রলীগ এবং তাজউদ্দীন আহমদের ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রীত্ব নেবেন না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। অন্যদিকে আওয়ামীলীগ ব্যতীত অন্যান্য দলগুলো চাচ্ছিল যেহেতু যুদ্ধে তারাও অংশ নিয়েছিল; তাই সকল দলের সমন্বয়ে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন হোক। তবে বঙ্গবন্ধু সেদিকে মনোযোগ দেন নি। প্রথম সরকার গঠন করেই তিনি অনেকের বিরাগভাজনে পরিণত হলেন। নতুন সরকারের কর্মপদ্ধতি নিয়ে সিরাজুল আলম খান একটি তালিকা উত্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নিকট। তবে সেটি আশার আলো দেখেনি।

বাহাত্তরের মে মাসে ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। কলাভবনের বটতলায় ছাত্রলীগের একটি সভা হওয়ার কথা ছিল। সেই সভাতেই ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের দুই ধরনের স্লোগান সভার পরিস্থিতিতে উত্তপ্ত করে তোলে। এরপর চলে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের পালা। ছাত্রলীগ ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যায়। এদিকে ছাত্রলীগের ভাঙনের সুযোগে ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন একটি সদস্য পদ ছাড়া সব পদে নির্বাচিত হয়। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপই জুলাইতে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের ডাক দেয়। সিরাজ-রবপন্থী ছাত্রলীগের সম্মেলন ছিল পল্টনে এবং মণিপন্থী ছাত্রলীগের সম্মেলন ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সিরাজপন্থী ছাত্রলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় তারা আশা করেছিল যে বঙ্গবন্ধু পল্টনেই যাবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল বঙ্গবন্ধু ভাগ্নের দিকেই ঝুঁকে গিয়েছেন। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুকে 'মুজিব কাল্ট' পরিণত করা, ছয় দফা কর্মসূচিতে নেতাদের রাজি করানোতে লাঠি হাতে মহড়া দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর কাছের একজন মানুষ হিসেবে বরাবরই অগ্রগামী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তাহলে তাঁর রাজনীতি থেকে ছিটকে যাওয়ার কারণ কি মূলধারার রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে বামপন্থায় অগ্রাধিকার?

বাহাত্তরের অক্টোবরে ছাত্রলীগের সিরাজপন্থী গ্রুপ এবং আওয়ামীলীগের বাইরের আগ্রহী রাজনীতিবিদদের নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তথা জাসদ। জাসদ সৃষ্টির পূর্বে স্বাধীন বাংলাদেশে কার্যকর কোনো বিরোধী দল ছিল না। তাজউদ্দীন আহমদকে দলে টানার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। অথচ ক্রমশই তিনি আওয়ামীলীগের ভেতরেই একা হয়ে যাচ্ছিলেন। তেহাত্তরের সাধারণ নির্বাচনে জাসদ 'মশাল' প্রতীক নিয়ে তিনশো আসনেই প্রার্থী দেয়। দলের বয়স মাত্র চার মাস এবং দলের বেশিরভাগ প্রার্থী ছিলেন সদ্য ছাত্রজীবন শেষ করা। তবুও আশাবাদী ছিলেন তারা বেশকিছু আসন পাবেন। অথচ নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে জাসদের আসন সংখ্যা মাত্র তিনটি। বিরোধী দল না থাকলে সরকারের কর্মকাণ্ডের খুঁত কারা ধরিয়ে দেবে?

তেহাত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং ডাকসু নির্বাচনেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠ অফিসে হামলা চালানো হয় এবং জাসদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষগুলোতে ভাঙচুর চালানো হয়। চুয়াত্তরের মার্চে জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়ের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেখানে গোলাগুলিতে বেশ কিছু মানুষ হতাহত হয়। সেই ঘটনার পর হতেই জাসদ অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায় এবং গণবাহিনী সৃষ্টির প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। আটাত্তর সাল পর্যন্ত জাসদ গণবাহিনী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। মূলত জাসদের সশস্ত্র শাখা ছিল গণবাহিনী। রক্ষীবাহিনীর বিপরীতে গণবাহিনী আওয়ামীলীগের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। রক্ষীবাহিনী, গণবাহিনী, লাল বাহিনী নামে আরো অনেক বাহিনীই গ্রামাঞ্চলগুলোতে চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল। আইন শৃংখলা পরিস্থিতির বাজেভাবে অবনতি ঘটে।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে জাসদের মাঝেও এর স্রোত বয়ে যায়। জাসদের কাছে এটাকে প্রত্যাশিত মনে হয়েছিল তবে আক্রমণ যে সামরিক বাহিনী থেকে এভাবে আসবে সেটা ভাবতে পারেনি। এরপর ঘটনার সামনে আসেন কর্নেল তাহের। তিনি জাসদের পক্ষে সামরিক বাহিনীতে বিপ্লবের বীজমন্ত্র রোপণ করছিলেন । কিন্তু নভেম্বরের বিপ্লবের পর জাসদের হাত থেকে সব নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মেজর জিয়াউর রহমানের হাতে। তখনই জাসদ বুঝে গিয়েছিল তাদের বিপ্লবের কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়েছে। এরপর শুধু জাসদের ভাঙন। সামরিক শাসন, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি আবার সামরিক শাসনের ঘটনাপ্রবাহে জাসদ টিকে থাকতে পারেনি। অনেক নেতাকর্মী জার্মানি চলে গিয়েছিলেন আবার কেউ কেউ লিবিয়া গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। তবে সর্বশেষ তারা আর কোনো বিপ্লব সংগঠিত করতে পারেনি। টিমটিম করে ভাঙা টুকরোগুলো এখনো জ্বলছে জাসদ-বাসদ নামে।

একটি নতুন রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় অনেক সমস্যা থাকে। বিশেষ করে যুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট রাষ্ট্রগুলোতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন সরকারের কাজের মাধ্যমে তুলে ধরাটাই অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিধ্বস্ত দেশ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এতটাই প্রকট ছিল যে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়। স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার আশায় দেশকে স্বাধীন করতে মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিল কিন্তু দুর্নীতি যেন পিছু ছাড়েনি তাদের। একইসাথে স্বাভাবিক জীবনপযাপনও বিভিন্ন বাহিনীর কারণে বাধাগ্রস্থ হয় ।

নিরপেক্ষ ইতিহাস আদৌ পাওয়া সম্ভব? কাছাকাছি যাওয়া যায়। যিনি ইতিহাস লিখবেন তাঁর দায় থেকেই তিনি লিখবেন। তাঁর দৃষ্টিকোন থেকে লিখবেন। জাসদের সৃষ্টি ও তাদের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে লেখকের কিছুটা হলেও পক্ষপাত দেখা গিয়েছে। জাসদের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের অনেক কর্মকাণ্ডকেই বৈধ হিসেবে চিহ্নিত করলেও সেখানে প্রশ্নের জায়গা রয়েছে। জাসদের হঠাকারি অনেক সিদ্ধান্তই তাদের নিভে যাওয়ার জন্য দায়ী করা যায়। জাসদের নেতারা এসেছিলেন তরুণ বিদ্রোহী ছাত্রলীগ থেকে; তাছাড়া যারা আওয়ামীলীগে যোগদান করেনি অথচ একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন ছিল তারাও জাসদে যোগদান করে। ফলে জাসদের উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্থ হয়। জাসদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সিরাজুল আলম খানের নাম। কোনো পদে ছিলেন না কখনো, তবু তাঁর দিকে তাকালেই জাসদকে জানা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি কষ্ট বোধহয় উনিই পেয়েছিলেন। ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ শিষ্য ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তাহলে কি বড় প্রেম শুধু কাছেই আনে না, দূরেও ঠেলে দেয়?

হারিয়ে যাওয়া দীপশিখার ইতিহাস জানতে এই বইটি পাথেয় হতে পারে। বইটিকে একজন ইতিহাস পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেই অনেক কিছু স্পষ্ট হবে। জাসদের রাজনীতি এতটাই থ্রিলিং ছিল যে, বইটি পড়লে মনে চাইবে আমি কেন সেই সময়টাতে ছিলাম না! জাসদের ধারাবাহিক ইতিহাসের দুনিয়ায় পাঠককে স্বাগতম। হ্যাপি রিডিং।
Profile Image for Nazrul Islam.
Author 8 books228 followers
August 5, 2018
এমন সময় বইটা শেষ করলাম যখন দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খুবই করুণ। বইটা পড়ার পর মনে হচ্ছে যেই সময় নিয়া বইটি লিখা ইতিহাসের সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় আর বর্তমান সময়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। বর্তমানে ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তিই ঘটছে।

এক কথায় বলতে হয় এই বইটি একটা "বোমা" । পুরাই নিখিল বোমা।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি ।রাজনীতির প্রেক্ষাপট আর জাসদের উত্থান পতন নিয়ে বইটি লেখা। বইটিতে মোটামোটি র্নিমোহভাবে ইতিহাস বর্ননা করার চেষ্টা করলেও কিঞ্চিৎ সিরাজুল আলম খানের সাপোর্ট এসেই গিয়েছে।তা স্বত্বেও এই বইটা ইতিহাস পিপাসুদের অবশ্য পাঠ্য।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায় অদূরভবিষ্যতে ইতিহাসের রেফারেন্স টানতে এই বইটি ব্যবহার হবে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে বিস্তারিত জানলাম এই বই থেকে। আগে উনার নাম শুনলেও ডিটেইলস জানতাম না। স্বাধীনতা যুদ্ধে উনার অবদান, নিউক্লিয়াস সেল আর পর্বরতিতে মতাদর্শের অমিলের কারণে ছাত্রলীগ ছেড়ে জাসদ গঠন । বঙ্গবন্ধুর পরে ইনারই দেশের দ্বিতীয় সেরা রাজনীতিক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইতিহাস পরাজিতদের মনে রাখে না। তাঁদের ত্যাগের কথা মনে রাখে না। তাই সিরাজুল আল খানের কথাও সবাই ভুলে গেছে।
এসেছে কর্ণেল তাহের প্রসঙ্গ। জিয়া আর তাহেরের অভ্যথান। জিয়ার বিট্রেয়াল। ক্ষমতায় বসা ।আর শেষে জাসদের পতন।
সবকিছু মিলিয়ে দারুণ একটা বই পড়লাম।

Profile Image for লোচন.
207 reviews56 followers
April 15, 2021
হাসানুল হক ইনুর একটা সাক্ষাৎকার দেখার পর থেকে জাসদের গণবাহিনী নিয়ে জানবার ইচ্ছে ছিল। মহিউদ্দীন সাহেবের বই সেই ইচ্ছে পূরণে অনেকটাই সফল।

বাংলাদেশে বিপ্লব করার উদ্দেশ্যে মূলধারার রাজনীতিকে ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া একমাত্র দল জাসদের ইতিহাস— বৈচিত্র্যময়। আমি একই সময়ে ‘রক্ষীবাহিনীর ইতিহাস’ আর শাফায়াত জামিলের বইটা পড়ছিলাম আসলে; তিনের সমন্বয়ে নিরপেক্ষ একটা চিত্র পয়দা হয়েছে করোটির ভেতর, এইটুকুই পাওনা। লেখক জাসদ, এবং সম্পূরকভাবে বাংলাদেশের বামদলগুলোকে নিয়ে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন মনে হল, তার এই কথাটা যেমন:
‘জাসদকে কেউ বলতো ‘জারজ সন্তানের দল’, কেউ বলত ‘ভারতের সেকেন্ড ডিফেন্স লাইন’। দলটির সমালোচনা হিসেবে সম্ভবত সবচেয়ে শোভন মন্তব্যগুলো ছিল ‘উগ্র’, ‘হঠকারি’ ও ‘বিভ্রান্ত’। এ দেশের বাম রাজনীতির দুর্ভাগ্য হলো, দলগুলো ‘শ্রেণিশত্রু’র বিরুদ্ধে যতটা না সোচ্চার, তারচেয়ে বেশি নির্মম অন্য বাম দলের প্রতি। এদের আরেকটি প্রবণতা হলো, নিজ দলকে একমাত্র খাঁটি বিপ্লবী দল হিসেবে জাহির করা এবং অন্য সব দলকে কুচক্রি, ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাসঘাতক ও দেশি-বিদেশি শক্তির এজেন্ট হিসেবে চিত্রিত করা।’

খাঁটি কথা। তাছাড়া ছোট ছোট ডিটেইলস আনন্দ দিয়েছে, জাদুকর জুয়েল আইচ (কোডনেম কমরেড জাহিদ) যে সিরাজ শিকদারের আন্ডারে সর্বহারা পার্টিতে ছিলেন, এটা নতুন করে জানলাম। পুলিশ সুপার মাহবুব ও সিরাজ শিকদারের ব্যাপারটা ছিল দুঃখজনক। তারপর জিয়ার এই দাবিটা:
‘ছিয়াত্তরের জুলাই মাসের শেষের দিকে আওয়ামি লীগের ১৪ জন প্রতিনিধি মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি সায়েমের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানও উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার একপর্যায়ে জিয়াউর রহমান উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘হু ইজ আ বেটার আওয়ামী লীগার দ্যান মি? আই হ্যাভ ট্রান্সমিটেড দ্য ডিরেক্টিভস অফ বঙ্গবন্ধু ফ্রম চিটাগাং রেডিও স্টেশন।’

ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব জিনিস ইন্টারেস্টিং ছিল। এখন মনে হচ্ছে ইনুর লেখা জাসদের ওপরে কোন বই থাকলে জিনিসটা চমৎকার হতো। দুঃখের ব্যাপার, উনি লেখেন নাই তেমন কিছু।

বই ভালো। তিন তারা।
Profile Image for Md Azmir Fakir.
189 reviews17 followers
Read
October 17, 2022
কেউ বলছেন তথ্যগুলো কাল্পনিক কিন্তু লেখক বলছেন যথাযথ তথ্যসূত্র ব্যাবহার করেছেন, বইয়ের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশটি হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জাসদের কর্ণেল তাহেরের মূল্যায়ন। কর্ণেল তাহের শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ কবর দেয়ার পরিবর্তে সাগরে ভাসিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল বলে মন্তব্য করেছিলেন বলে বইটিতে দাবি করা হয়।
মহিউদ্দিন আহমেদ তার লেখার একটি জায়গায় বলেন , তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ‘ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া।’ (পৃষ্ঠা- ১৭৯)
বইতে দাবি করা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের পর গণবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি লিফলেটও প্রচার করা হয়। লিফলেটের শিরোনাম ছিল, ‘খুনি মুজিব খুন হয়েছে—অত্যাচারীর পতন অনিবার্য ।
লেখক বলেন- ইতিহাস কোন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ নয়, বরং এটা হয়ে ওঠতে পারে ‘প্যানডোরার বাক্স’। এর ডালা খুললে এমন সব সত্য বেরিয়ে আসে, যার মুখোমুখি হতে চাই না আমরা অনেকে । সত্য গল্পের চেয়ে রোমাঞ্চকর- মার্ক টোয়েনের এই বিখ্যাত উক্তিটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক হওয়ায় লেখক বইটিতে তুলে ধরেছেন সত্তরের দশকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা ও জাসদের উত্থানের সময় । লেখক দলটিকে উল্লেখ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের উপজাত ফসল হিসেবে এবং একই সঙ্গে দ্রোহের চরমতম প্রতীক হিসেবে । এই বইয়ে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে দলটির উত্থান,বিস্তার ও ভেসে যাওয়ার কাহিনী, যা উপন্যাস কেও হার মানায় ।
Profile Image for Md Shariful Islam.
258 reviews84 followers
May 8, 2020
'মুক্তিযুক্ত ও তৎপরবর্তীকালের ঘটনাবলী'র একটা নতুন ধরনের বয়ান। অবশ্য তেমন পড়া না থাকায় নিরপেক্ষতা নিয়ে মন্তব্য করতে পারছি না...
Profile Image for Rasel Khan.
170 reviews8 followers
June 16, 2023
জাসদের রাজনীতি শুরু হয় হুট করে। দলের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আস্থাবাজন। মতের অমিল থেকে তাদের মাঝে সৃষ্ট দূরত্ব থেকেই জাসদের উত্থান।

শুরুর দিকে জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠে দলটি। কিন্তু একটা সময়ে নিজেদের হঠকারী কিছু সিদ্ধান্ত তাদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলে। সব সরকারই তাদের পাশে চাইলেও কোনো সরকারেরই আপন হতে পারেনি তারা। জিয়া সরকারের সময়ে একেবারেই কোনঠাসা হয়ে পড়ে জাসদ৷ পরবর্তীতে আর ঘুরে দাড়াতে পারেনি তারা৷

সর্বশেষ ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে থাকলেও বর্তমানে তাদের নাম গন্ধ নেই বললেই চলে। সর্বোচ্চ নেতাদের হঠাৎ চুপসে যাওয়া দলটি বর্তমান পজন্মের কাছে যেন অপরিচিত হয়ে উঠছে৷ জাসদের উত্থান পতনের এই সময়ের ইতিহাস গুলোই বইয়ের পাতায় তুলে এনেছেন লেখক।
Profile Image for Sourav Anando.
132 reviews6 followers
November 16, 2024
বাংলাদেশের ইতিহাসের রাজনৈতিক একটা পাঠ নিলাম । অনেক কিছু জানার ছিলো , অনেক কিছু জানলাম আবার অনেক কিছুর উত্তর পেলাম না। ইতিহাসের মূল্যায়ন সরলরৈখিক না , তাই যে যেভাবে চায় সেভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারে। যেকোনো ব্যাখ্যা নিজের মত করে ভেবে নিলেই হলো।

জাসদ এর পাশাপাশি অনেকের পরিচয় ই নতুন করে পেলাম। ৪/৫
Profile Image for Nasif Anwar.
14 reviews4 followers
June 14, 2018
অস্থিরতার সময়ের আরেকটা ভাল বই অবশ্যই।

সতর্কতার সাথে নির্মোহ থাকার চেষ্টা করলেও, লেখক তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের বাইরে খুব বের হতে পারেননি। ৭৫' এ সিরাজুল আলম খানের প্রশ্নবিদ্ধ অনেক ভূমিকা লেখক দু-এক লাইনে সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।
টাইমলাইনের ওলট-পালটে অনেক জায়গায় খেই হারিয়ে যায়।
এর বাইরে দুর্দান্ত জিনিস। ইতিহাস-রাজনীতিবিমুখ এই প্রজন্মের জন্য ফিকশানাল স্টাইলে লেখা ভাল ইতিহাসের বই খুব দরকার। লেখক এখানে অবশ্যই কৃতিত্ব পাবেন।

Truths are stranger than fiction.
Profile Image for Parvez Alam.
306 reviews12 followers
July 29, 2020
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে হলে এই বইয়ের বিকল্প নাই এবং যথেষ্ট নিরপেক্ষ এবং তথ্যবহুল।
Profile Image for প্রিয়াক্ষী ঘোষ.
362 reviews34 followers
April 16, 2023
২০১৪ সালে প্রকাশিত লেখকের প্রথম রাজনৈতিক বই 'জাসদের উত্থান-পতন, অস্থির সময়ের রাজনীতি' বইটি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
বইটিতে মহিউদ্দিন আহমদ ১৯৭০-এর দশকে জাসদের জন্ম থেকে শুরু করে প্রতিটি পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন। তুলে ধরেছেন নানান দিক।

১৯৭০ সালের ৭ই জুন পল্টনে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ হলো। সেখানেই প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা শেখ মুজিবের হাতে তুলে দেওয়া হয়। যা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেব প্রদর্শন করা হয়।

১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকাতে আসেন।

দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত সময়ে শেখ মুজিব ছিলেন পুরো বাংলার নেতা, সাধারণ মানুষের নেতা,
যাঁর নেতৃত্বে দেশ পেলো স্বাধীনতার স্বাদ। কিন্তু যুূ্দ্ধ পরবর্তী সময়ে এসে দেখা গেছে শেখ মুজিব শুধুই আওয়ামী লীগ এর নেতা।

শেখ মুজিবের ছিলো চার নীতি--- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ।
তবে এটাকে মুজিববাদ বললেও তাঁর কোন আপত্তি ছিলো না।

এর পর থেকে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের দুটি পরিচয় তৈরি হলো।
সিরাজপন্থীদের "রব গ্রুপ " আর অন্য দের " মুজিববাদী গ্রুপ"।

এর পর থেকে নানান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা ঘটতে থাকে।

১৯৭২ সালের ৩১ শে অক্টোবর সকালে এক সভায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।

সেই সভাতে উপস্থিত ছিলেনঃ
সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ, মেজর জলিল, আ স ম রব, মনিরুল ইসলাম, শাহজাহান সিরাজ সহ আরও অনেকে।

সাত সদস্যের এক আহ্বায়ক কমিটি তৈরি করা হয় এই সভাতে। জলিল ও রব যুগ্ম আহ্বায়ক মনোনীত হন।

সেই থেকে পথ চলা জাসদ এর। এ চলাটা নিষ্কণ্টক ছিলো না মোটেই।

তবে জাসদ এর যাত্রা শুরু হয় মূলত ১৯৬২ সাল থেকে। তবে না আওয়ামী লীগ এর মধ্যে থেকেই। এটাকে "নিউক্লিয়াস" যাত্রা বলা হয়ে থাকে।
যার প্রকাশ ঘটে ১৯৭২ সালে এসে।

জাসদের পরিপূর্ণ বিস্তার বা জনসাধারনের সামনে মূলত ১৯৭৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে।

নতুন দল হিসেবে গণমানুষের সমর্থন পায় জাসদ। অনেকেই এই জনপ্রিয়তাকে হিংসা করতে থাকেন।

জাসদ নিজেকে বিপ্লবের "সহায়ক শক্তি " বলে দাবি করত। তাদের উপলব্ধি হলো মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একটি শ্রেনী সংগঠন গড়ে তোলা।
এবং সেই উদ্দেশ্যেই তারা এগিয়ে চললো।

তবে দেশের ভিন্ন এলাকা থেকে জাসদ কর্মীদের কে হত্যা বা গুম করে দিতে লাগলেন সরকারি পুলিশ বাহিনীর লোকেরা। এর স্বীকার হলেন অনেক সাধারণ নিরপরাধ মানুষ।

আবার ১৯৭৬ সালের ৩১ শে অক্টোবর জাসদের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়
এভাবে শুরু হয় জাসদের ভাঙ্গন।
তবে ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে জাসদ ছিলো চতুর্থ বৃহত্তর দল।

সত্তরের দশকে জাসদ একটি আলোচিত ও সমালোচিত রাজনৈতিক দল।
জাসদ প্রথাগত রাজনীতির বাইরে পা বাড়িয়েই পড়লো বিপত্তিতে।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তি সময়ে জাসদ ছিলো একটা প্রবনতা।
অন্যদের মুক্তিযুদ্ধ ১৬ ডিসেম্বর শেষ হলেও জাসদ এটাকে তাদের মত করে যৌক্তিক পরিনতির দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো।

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান তৈরি হলো। সকল জনতা এটার পক্ষে রইলো। মুসলিম লীগ এটাকে নিজেদের ক্ষমতার আধার ও লুণ্ঠনের ক্ষেত্র মনে করলো। ফলে তা তছনছ হয়ে গেলো ১৯৫৪ সালে।

আওয়ামর লীগ ও একই ভুল করলো। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর এ দলটি নতুন দেশের হাল ধরলো এবং মনে করলো দেশটা শুধু তাদের।
আবারও ঘটলো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। জন্মনিলো জাসদ।

১৯৭২ সালটা ছিলো জাসদের উত্থানপর্ব।
১৯৭৩-৭৪ সাল ছিলো বিস্তারের সময়।
১৯৭৫ সালের হত্যাকান্ডের ফলে দলটি সংকটে পরে।
১৯৭৬ সালে শুরু হয় দলটির ভাটার টান। একদিকে অস্তিত্বের সংকট, অন্যদিকে ভাঙনপর্ব।
Profile Image for Priyanto (প্রিয়ান্ত).
27 reviews25 followers
August 1, 2022
জাসদ যেই পটভূমিতে জন্ম নিয়েছিলো, আর বাহাত্তর থেকে পচাত্তর অব্দি যেইসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তাতে দলটির জার্নি কে নিসন্দেহে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বলা যায়। দলটির উথান, বিস্তার আর পতন—সবটুকুন পিরিয়ডই বেশ বিতর্কিত আর হতাশামাখা।
.
লেখকের লেখার হাত বেশ ভালো, তেমন কোনো জটিল শব্দাবলীর সমাবেশ ছাড়াই, ঘটনাগুলোর পরম্পরা ক্রমানুসারে বর্ণনা করে গিয়েছেন, নিরপেক্ষ ভাইব রাখার চেষ্টা ছিলো যথাসাধ্য, সেটাও ধারণা করি। আমার মনেহয়, হাতেখড়ি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে নলেজ গেদারিংয়ে, এই রাইটারের বইগুলোর কম্বিনেশন একটা গুড রেকমেন্ডেশন।
.
যতটুকুন আশার পারদ নিয়ে জাসদের জন্ম আর স্বপ্নমাখা বিপ্লবের কথা তারা জানাতো, সময়ের ধারাবাহিকতায় তাঁদের এরূপ অবস্থায় পৌছানোর পেছনে দায়ী কি বা কারা ছিলো—প্র��্নটা অনেক বড়ো। বড়ো এই কোশ্চেনটির এ্যান্সারে, একটা নোট হিসেবে কাজ করবে বইটি।


~অগাস্ট ১, ২০২২।
Profile Image for Imtiaz Hyder.
16 reviews
September 30, 2023
জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি
মহিউদ্দিন আহমদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যে রাজনৈতিক দলটি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেটি হচ্ছে জাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। এই বইয়ে প্রথমে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি, জাসদের গঠন, উত্থান, পরবর্তীতে তার অবস্থান জৌলুসহীন হয়ে যাওয়া এগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৬২ সাল থেকেই ছাত্রলীগের মধ্যে একটি 'নিউক্লিয়াস' গড়ে ওঠে, যার কেন্দ্রে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। যাদের লক্ষ্যই ছিল সশস্ত্র প্রক্রিয়ায় দেশ স্বাধীন করা।
১৯৭০ এর নির্বাচন এবং ইয়াহিয়া খানের টালবাহানা, গণহত্যা একটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিল। মার্চ মাসে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে ইয়াহিয়া খানের বৈঠক চলে৷ ২২ মার্চের পর শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ইয়াহিয়া খানের আর বৈঠক হয়নি। ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগের একটি দল ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠক হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংশোধনী প্রস্তাব দেয়া হয়, দেশের নাম হবে 'কনফেডারেশন অব পাকিস্তান'। (পৃ ৪১)
এরপর ২৫ মার্চের সামরিক অভিযান ও গণহত্যা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং গ্রেপ্তার হন। (পৃ ৪৩)
এরপর তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রিত্বে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের সাথে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের দ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্য। মুক্তিবাহিনীর সমান্তরালে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ (শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক) বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট, বিএলএফ গঠন করেন, যা পরবর্তীতে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিতি পায়।
স্বাধীনতার পরে ছাত্রলীগের মধ্যে দুইটি ধারাকে কেন্দ্র করে ভাঙন স্পষ্ট হয়ে পড়ে৷ একটি ছিল সিরাজুল আলম খানের সমাজতান্ত্রিক ধারা, আরেকটি মুজিববাদী ধারা। ২১-২৩ জুলাই ১৯৭২ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিভক্তি হয়ে পড়ে এবং সমাজতন্ত্রপন্থী ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে এই ধারাটিই জাসদ গঠন করেন। ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয় এবং ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২ পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি হন মেজর (অব) জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের তখন যে পপুলারিটি ছিল তাতে তাদের এমনিতেও জেতার কথা৷ কিন্তু তার পরেও সেই নির্বাচন প্রভাবমুক্ত ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চারটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর মধ্যে একটি ছিল ভোলায়। সেখানে জাসদের শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন ডা. আজহারউদ্দিন৷ মনোনয়নপত্র জমার দিন তাঁকে অপহরণ করা হয়, শেখ মুজিব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতেন ওই আসন৷ এরকম আওয়ামী লীগের আরো ৬ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। (পৃ ৯৮)। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের বিশ্লেষণ এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তিনি ৭২ এ বঙ্গবন্ধুর সাথে এক সাক্ষাতে জওহরলাল নেহেরুর উদাহরণ টেনে অপজিশন পার্টির রাজনীতি করার সুযোগ দানের প্রশ্ন তোলেন৷ জবাবে মুজিব বলেন, অপজিশন ৫ টার বেশি সিট পাবে না। অধ্যাপক রাজ্জাক অপজিশনের জন্য ১০০ আসন ছেড়ে দেয়ার কথা বললে শেখ মুজিব হাসলেন৷ এ প্রসঙ্গে জনাব রাজ্জাক বলেন, ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাবার পারলেন না। (পৃ ১০১)
আওয়ামী লীগের সাথে ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টির জোট তৈরি হয়৷ দেশের এহেন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাসদ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে৷ দেশে কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগের শাসনে জাসদ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তবে জাসদের এই উত্থান মেনে নেওয়ার মতো উদারতা আওয়ামী লীগের ছিল না। ১৯৭৩ এর ৩ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচন হয়। মুজিববাদী ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন একত্রে নির্বাচন করে৷ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়, কিন্তু গণনার সময় যখন দেখা যায় জাসদ ছাত্রলীগ জেতার কাছাকাছি তখন ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়। শেখ কামালের নেতৃত্বে এ কাজ করা হয়। (পৃ ১০৬) এখানেই শেষ নয়, বিভিন্ন হলে জাসদ ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের কক্ষগুলোর তালা ভেঙে লুটপাট করা হয়। পুলিশ গণকণ্ঠ অফিসে হামলা চালায় এবং সাংবাদিক-কর্মচারীদের বিতাড়িত করে দেয়। মাস খানেক পরে টিপু সুলতান রোড়ের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে গণকণ্ঠ ফের চালু হয়, তবে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায়। (পৃ ১০৭)
জাসদের রাজনীতিতে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ। এদিন তাদের সমাবেশের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করে তারা। পুলিশ গুলি চালায়, সরকারি প্রেসনোটে বলা হয় ৩ জন মারা গেছে। মাঈনউদ্দিন খান বাদল তাঁর বাবা আহমদউল্লাহ খানের (পুলিশের তৎকালীন তেজগাঁও অঞ্চলের ডিএসপি) কাছে শুনেছিলেন, রক্ষীবাহিনী ৪০-৫০ টি লাশ ট্রাকে করে নিয়ে গেছে। (পৃ ১১১) ঐদিন রাতে পুলিশ গণকণ্ঠ অফিসে হামলা চালায় এবং সম্পাদক আল মাহমুদকে গ্রেপ্তার করে। বাসভবন ঘেরাওয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে নেতৃবৃন্দ বিভক্ত হয়ে পড়েন। এ ঘটনার পর বিভিন্ন স্থানে জাসদের 'সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড' গঠন করতে থাকে। বিপ্লবী গণবাহিনীর কর্মকাণ্ডও এই ঘটনার পরপরই শুরু হয়। এরপর তারা 'শ্রেণিশত্রু' খতম করতে নামে। অনেক জোতদার, শাসক দলের এমপি এ সময়ে তাদের হাতে খুন হয়।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনী আইন পাস হয়। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার বিলোপ করে রাষ্ট্রপতির শাসন কায়েম হয়৷ ২৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একটিমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। বাকশালে যোগদান করার জন্য সর্বস্তরে হিড়িক পড়ে যায়।
এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এর অন্যতম কুশীলব বজলুল হুদা বলেন, তাঁর দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া যেন তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা দেন। হত্যার ব্যাপারটা তিনি জানতেন না। অপারেশনে কার কী ভূমিকা তা রশিদ-ফারুক ঠিক করে দেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তারা আর কোনো সাক্ষী রাখতে চায়নি, তাই সবাইকে হত্যা করা হয়। (পৃ ১৭৪) এরপর খোন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হন।
৩রা নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয় এবং জিয়াউর রহমান নিজ বাসভবনে অন্তরীণ হন। ৪ নভেম্বর খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন খোন্দকার মোশতাক। ৬ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের পরামর্শমতো বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হলেও তাঁর বেডরুমের টেলিফোন লাইনটি সচল ছিল। তিনি কর্নেল তাহেরের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন। ৩ নভেম্বরের পর থেকে খালেদ মোশাররফ ভারতের দালাল— এই প্রচার চলতে থাকে সেনানিবাসগুলোতে। এতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন কর্নেল তাহের। জাসদ, বিপ্লবী গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষে প্রচারপত্র বিলি হতে থাকে সেনানিবাসগুলোতে, খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করার কথা বলা হয়। কর্নেল তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে সৈনিকদের বিদ্রোহ করতে বলেন। জিয়ার অনুগামী সৈনিকরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে ধাবমান হতে থাকে। ৭ নভেম্বর সৈনিকদের অভ্যুত্থান হয়, জিয়াউর রহমান মুক্ত হন। খালেদ মোশাররফ নিহত হন।
কর্নেল তাহের জিয়ার নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। জিয়ার মুক্তির পর তাঁকে নিয়ে রেডিও স্টেশনে ঘোষণা দিতে নিয়ে যেতো চান তাহের, কিন্তু জিয়া বেকে বসেন। তিনি সেনানিবাসে বসেই ঘোষণা রেকর্ড করেন, পরে তা রেডিওতে প্রচার করা হয়। (পৃ ১৯৬) ঢাকা নগর গণবাহিনীর উদ্যোগে একটি সমাবেশে জিয়া ও তাহেরের উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল। জিয়া সেনানিবাস ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান।( পৃ ১৯৭) জিয়াকে নিয়ে করা কর্নেল তাহের এবং জাসদের করা পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এরপর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। জাসদের অনেক নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ এর ২১ জুন জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ৩৩ জনের বিরুদ্ধে বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়। মামলার শিরোনাম ছিল — 'রাষ্ট্র বনাম মেজর জলিল ও অন্যান্য'। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন কর্নেল তাহের, মেজর জলিল, আ স ম রব, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ। ১৭ জুলাই রায় দেওয়া হল। কর্নেল তাহের, মেজর জলিল, আবু ইউসুফকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। মেজর জলিল ও আবু ইউসুফের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২১ জুলাই কর্নেল তাহের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মেজর জলিল কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁকে পিজিতে ভর্তি করা হয়৷ জিয়াউর রহমান শাহ আজিজুর রহমানকে সাথে নিয়ে তাঁকে দেখতে গেলে জলিল জিয়াকে প্রশ্ন করেন, হোয়াই ডিড ইয় হ্যাং তাহের? কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিয়া বলেন, তাঁর উপর প্রেশার ছিল। সবাই এটাই চেয়েছিল। (পৃ ২৩৯)
৭ ই নভেম্বরের ব্যর্থ বিপ্লবের প্রভাব জাসদ আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ স্বাধীনতার পরপরই যে দলের সূচনা এবং যারা জনপ্রিয় হয়েছিল, চার বছরের ব্যবধানে তারা জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে শুরু করে৷ অনেক জায়গায় তারা জনগণের কাছে ধাওয়াও খায়।
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যগত কারণে বিচারপতি সায়েম পদত্যাগ করেন এবং জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। জিয়া রাজনৈতিক কর্মসূচি পুনরায় শুরু করার আশ্বাস দেন এবং একে একে দলগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ১৯৭৭ এর ১৭ এপ্রিল জিয়া রাজনৈতিক দলবিধি বাতিল করেন। ১৯৭৮ এর ১ মে থেকে রাজনৈতিক সভা সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়। নিজের শাসনকে বৈধ করার অভিপ্রায়ে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে একটি গণভোট আয়োজন করা হয়, জিয়ার পক্ষে ৯৮.৯ শতাংশ হ্যাঁ ভোট পড়ে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে নিজেই নিজেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেন। এর আগে এ অঞ্চলে এরকম ঘটনা একবারই ঘটেছিল, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালে নিজেকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। (পৃ ২৩৬)
জিয়াউর রহমান নিজস্ব রাজনৈতিক হল গঠনের উদ্যোগ নেন। তিনি জাসদ, আওয়ামী লীগ, ইসলামপন্থী সবার সাথেই আলোচনা চালিয়ে যান। তিনি প্রথমে একটি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠনের ইচ্ছা পোষণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ এর নির্বাচনে বিএনপি ১৯০ টি, আওয়ামী লীগ ৩৯ টি আসন লাভ করে। জাসদ ৮ টি আসন লাভ করে।
জাসদ নেতৃবৃন্দ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তাদের বন্দি নেতাদের মুক্তির জন্য আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৮০ সালের ২৪ মার্চ মেজর জলিল মুক্তি পান। আ স ম রব প্যারোলে জার্মানি চলে যান, পরে তার প্যারোল বাতিল করে মুক্তি দেয়া হয়। তিনি ১৯৮০ সালের ১৭ মে ঢাকা আসেন। সিরাজুল আলম খান ১৯৮০ সালের ১ মে মুক্তি পান। ১৯৮১ সালের ৯ মে সিরাজুল আলম খানের সাথে জিয়াউর রহমানের বৈঠক হয়। দীর্ঘক্ষণ তাঁরা বিভিন্ন বিভিন্ন বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়৷ সেটিই ছিল তাঁদের প্রথম এবং শেষ বৈঠক। ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থান জিয়াউর রহমান নিহত হন।
৭ ই নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ধাক্কা জাসদ সামলে উঠতে পারেনি৷ নিজেদের ব্যর্থতা, নেতৃবৃন্দের কারাগারে যাওয়া, নিজেদের প্রতি বিশ্বাসের অভাব দলের মধ্যে ভাঙন প্রক্রিয়া শুরু করে। জাসদের অনেক নেতৃবৃন্দ জেল থেকে মুক্তির পর পশ্চিম জার্মানি যাওয়া শুরু করেন, তখন পশ্চিম জার্মানি যেতে ভিসা লাগত না। অনেক কর্মী ফিলিস্তিনে গিয়ে পিএলওর সাথে সংগ্রামে এবং প্রশিক্ষণে অংশ নেন। লিবিয়ার গাদ্দাফির সাথে জাসদ নেতৃবৃন্দের সুসম্পর্ক তৈরি হয়, গাদ্দাফির কাছ থেকে তারা ডোনেশনও পাওয়া শুরু করে। কিন্তু নেতৃবৃন্দের মধ্যে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়, ফলে লিবিয়া ডোনেশন বন্ধ করে দেয়। ডোনেশন মূলত আসত মেজর জলিলের হাত ধরে, তাঁর উপর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। লেখকের মতে জলিল ছিলেন সহজ-সরল মানুষ। তিনি হিরোইজমে আচ্ছন্ন ছিলেন। (পৃ ২৫৬) নিজের প্রতি অভিযোগের জবাবে মেজর জলিল অভিযোগকারীদের নীতি নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁদের সত্যিকার চেহারা উন্মোচন করার চেষ্টা করেন প্রশ্নবাণে। তিনি লিখিত বক্তব্যে বলেন," মাননীয় বিচারকমণ্ডলী, আজ আপনাদের রায় দিতে হবে আমাদের রাজনীতি বিদেশের ব্যাংকে টাকা রাখা অনুমোদন করে কি না? যখন তখন বিদেশে যাওয়া, বিশেষত, ভারতে যাওয়া অনুমোদন করে কি না? চাঁদার অর্থ দিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন সমর্থন করে কি না?" (পৃ ২৫৯) জলিলের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তিনি নিজেই ১৯৮৩ সালে পদত্যাগ করেন এবং 'জাতীয় মুক্তি আন্দোলন' নামে নতুর দল গঠনের ঘোষণা দেন। ১৯৮৪ সালে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাসদ আবার ভাঙে৷ ১৯৮৫ সালে শাজাহান সিরাজ আরেকটি জাসদ গঠন করেন, অন্যেরা এরশাদবিরোধী অবস্থান বজায় রাখেন। ১৯৮৬ এবং ৮৮ এর নির্বাচনে জাসদের দুইটি ধারাই অংশ নেয়৷ ১৯৯১ সালে জাসদ (সিরাজ) থেকে একমাত্র শাজাহান সিরাজ জয়ী হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর আ স ম রব আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন৷ ১৯৯৭ সালে জাসদ একীভূত হয়, ২০০১ এর নির্বাচনের পর তা আবার ভেঙে যায়। আ স ম রব আলাদা হয়ে যান। দলের মূল ধারাটি হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগের শরিক। ২০০৮ এর নির্বাচনে জাসদ ৩ টি আসন লাভ করে৷ আ স ম রবের নেতৃত্বের জাসদ এখন জেএসডি নামে পরিচিত। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাসদ ৫ টি আসন লাভ করে। আ স ম রবের জেএসডি নির্বাচন বর্জন করে। (পৃ ২৬৩)

এই বইতে জাসদের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ই���িহাস, তৎক��লীন রাজনৈতিক পরস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কীভাবে একটি নতুন রাজনৈতিক দল দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় এবং ভুল কৌশলের কারণে জনবিচ্ছিন্ন এবং ভাঙনের সম্মুখীন হয় তা আলোচনা করা হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্রের আগমন ঘটেছে। নন ফিকশন আমার তেমন পড়া হয় না। এই বইয়ের লেখাগুলা সহজ৷ তাছাড়া বইটিতে ঘটনাপ্রবাহ সিরিয়ালি লেখা হয়েছে। অনেক অজানা জিনিস সম্পর্কে জানতে পেরেছি। জাসদের রাজনীতির উত্থান, বিকাশ, পতন বিশ্লেষণ করা হয়েছে বিভিন্ন রেফারেন্স দিয়ে। দেশের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী থাকলে পড়তে পারেন।
18 reviews3 followers
October 4, 2019
তথ্যবহুল বই। লেখক যথাসম্ভব বেশি তথ্য সন্নিবেশ করার চেষ্টা করেছেন। সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশ যে টালমাটাল সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল সেই সময়টার সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ, এবং সত্যিকার অর্থে এমন কিছু করার চেষ্টাও হয়েছে খুব সীমিত। ইতিহাসভিত্তিক রচনার যে প্রধান মানদন্ড-নিরপেক্ষতা, সেটাও লেখক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বজায় রাখতে পেরেছেন। তবে বইটি আরো সুপাঠ্য হতে পারত, যদিও ইতিহাসভিত্তিক বই সুপাঠ্য হওয়ার আশা করাটা আমার মতে বোকামি।
Profile Image for Alimur Razi Rana.
95 reviews5 followers
July 26, 2018
বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুর । এটা শুধু বিজয়ীদেরকেই মনে রাখে, পরাজিতদের ত্যাগ, কষ্ট , চেষ্টার কোন দাম থাকে না ।

বইটা সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলব, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে হলে এই বইয়ের বিকল্প নাই ।
Profile Image for Rajin.
35 reviews2 followers
December 26, 2024
আমার মতামত : এক কথায় এই বইটা একটা জেমস।আমার হাতে এত সময় নেই এই বইয়ের সামারি বিস্তারিত লেখা।একজন লিখেছিলেন তারই লেখা আমি এটাচ করে দিয়েছি।কারো জানার আগ্রহ থাকলে পড়তে পারেন।তবে বেশ দীর্ঘ লেখা।ধৈর্য্য ধরে পইড়েন।

কে এই সিরাজুল আলম খান? দেশভাগের নেপথ্য কারিগর
________________________________

এক কথায় বললে, সিরাজুল আলম খান না থাকলে শেখ মুজিব কোনদিন বঙ্গবন্ধু হতে পারতেন না এবং পাকিস্তানও ভাঙতো না। ১৯৬৬ সাল থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে হওয়া যাবতীয় ঘটনার মূল কারিগর ছিল এই সিরাজ।

১৯৬২ সালে অত্যন্ত মেধাবী এবং উচ্চ বিলাসী ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান যুগান্তর দল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন গুপ্ত সংগঠন নিউক্লিয়াস। সাথে সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ছাত্রলীগের আরো দুইজন প্রভাবশালী নেতা আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ। এরপরে সাথে যুক্ত হোন আবুল কালাম আজাদ। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে নতুন ধারার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। নিউক্লিয়াস পরে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস, বিএলএফ, জয় বাংলা বাহিনী, মুজিব বাহিনী; অবস্থা বুঝে নানা নাম ধারন করে।

সিরাজুল আলম খান গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তবে নানান দর্শনের দিকে উনার ঝোক ছিল প্রবল। তিনি কার্ল মার্ক্স এবং হেগেলের কমিউনিজম আর্দশ দ্বারা প্রভাবিত হোন। তবে সিরাজুল আলম খান প্রথাগত বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি নিজের অবস্থান সম্পর্কে বলেছিলেন, ইউরোপের দার্শনিকরা ইউরোপের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে যে তত্ত্ব দিয়েছেন তা বাংলাদেশে চলবে না। হেগেলের তত্ত্বকে তিনি নিজের মত করে সংযোজন, সংশোধন এবং বিয়োজন করে একটি সংকর তত্ত্ব তৈরি করেন। (পরবর্তী এর নাম দেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র)।

এই সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বেঁচে আছেন। দেশ আলাদা করার কথা কারো কল্পনায়ও ছিল না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আব্দুল্লাহ আবু সায়িদ উনার বই সংগঠন এবং বাঙালীতে লিখেছেন ১৯৬৮/৬৯ সালেও কেউ দেশ ভাগের কথা ভাবেনি। সিরাজুল আলম খান নিজেও বলেছেন ৭১ সালের আগে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া এমনকি আওয়ামী লীগেরও আর কেউ স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেনি।

নিউক্লিয়াসের সদস্য হওয়া ছিল বেশ কঠিন। উগ্রবাদী হিন্দু দল যুগান্তর থেকে অনুপ্রাণিত নিউক্লিয়াসের সদস্য হওয়া শর্তও ছিল যুগান্তরের মতই—

১। আঙুল কেটে রক্ত দিয়ে শপথ নিতে হতো দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিগত অর্জন, পদ, পদবি সুযোগ বা সুবিধার পেছনে ছুটবে না।

২। বিয়ে করবে না। আবুল কালাম আজাদ বিয়ে করায় তাকে নিউক্লিয়াস থেকে বহিষ্কার করা হয়।

৩। মাঝরাতে রেল লাইন ধরে সাত-আট মাইল হাঁটা ও ফিরে আসা।

৪। টানা কয়েক রাত জেগে থাকা।

৫। কম খাওয়া এবং পানি ছাড়া কিছুই না খেয়ে ২/৩ দিন থাকা।

৬। মা/বাবা বা পরিবারের কারো সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না।

মূলত ছাত্রলীগ থেকেই নিউক্লিয়াসে রিক্রুট করা হতো। আব্দুর রাজ্জাকের কাজ ছিল রিক্রুটিং, কাজী আরেফ ছাত্রলীগে নিউক্লিয়াসের সমার্থক মতাদর্শ ছড়াতেন আর সিরাজুল আলম খান সদস্যদের তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ দিতেন।

ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বগুনের কারনে ছাত্রলীগে সিরাজুল আলম খান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন৷ তাই রিক্রুটে কোন সমস্যা ছিল না। তখন ছাত্রলীগে দুইটা গ্রুপ ছিল, এক গ্রুপের নেতা সিরাজুল আলম খান অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল শেখ ফজলুল হক মণি। তবে মেধার লড়াইয়ে হেরে যায় শেখ মণি গ্রুপ। শেখ মণির গ্রুপের যাবতীয় প্রচেষ্টা ছিল কিভাবে কেন্দ্রের বড় বড় পদে অনুসারীদের ঢোকানো যায় আর সিরাজের গ্রুপ কলেজ এবং জেলা পর্যায়ের কাজে বেশি গুরুত্ব দিতো। এতে যা হয় তা হল কিছুদিনের মধ্যে সিরাজ গ্রুপ ছাত্রলীগে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। প্রায় সকল মূল পদে সিরাজ গ্রুপ থেকেই আসে৷ এর একমাত্র ব্যতিক্রম আল মুজাহিদী। তিনিই সেই সময়ে ছাত্রলীগে সিরাজ বলয়ের বাইরের একমাত্র কেন্দ্রীয় সভাপতি৷ বলা বাহুল্য আগে ১৯৭২ সালের আগে ছাত্রলীগে আওয়ামী লীগের কোন প্রভাব ছিল না। ছাত্রলীগ একটা স্বাধীন সংগঠন ছিল।

ধীরে ধীরে সারা দেশে ছাত্রলীগের মূল পদগুলো নিউক্লিয়াসের সদস্যরা দখল করে। তবে নিউক্লিয়াসের সদস্যরা এই মূল ৩ জন এবং একই ব্যাচের কয়েকজন জন ছাড়া আর কাউকে চিনতো না।

তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরে নিউক্লিয়াস সদস্যরা সামরিক প্রশিক্ষণও নিতেন। ভারত নিউক্লিয়াস সদস্যদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিতো। ১৯৭০ সাল নাগান নিউক্লিয়াসের ৭০০০ সদস্য সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহন করে। এরা ছিল সার্বক্ষনিক কর্মী৷ স্বাধীনতার জন্য তারা যেকোন কিছু করতে প্রস্তুত ছিলো।

ভারতের সাথে কিভাবে সম্পর্ক হয়, কিভাবে প্রশিক্ষণ নিতো বা কিভাবে অস্ত্র আসতো এ ব্যাপারে নিউক্লিয়াসের নেতারা কখনোই মুখ খোলেনি। কোলকাতার কেজিবি এজেন্ট ইউরি ব্রেভচিক আমেরিকা পালিয়ে যাবার পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কোলকাতা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বই পাঠাতো সোভিয়েত ইউনিয়ন, এই বইয়ের বক্সে মূলত থাকতো অস্ত্র। এই অস্ত্র নিউক্লিয়াসকে পাঠানো হতো কিনা সেটা আমরা জানি না। তবে দুইজন ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জন সুতার এবং কালিদাস বৈদ্য। এরমধ্যে কালিদাস বৈদ্য শেখ মুজিবুর রহমানের এবং ভারতের যোগাযোগেরও মূল ব্যক্তি ছিলেন।

এসময় নিউক্লিয়াসের সদস্যরা নানান অপকর্মের জরিয়ে পরে৷ কিন্তু তার নাম হতো ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগে নিয়ন্ত্রণ নেবার পরে নিউক্লিয়াসের থিংক ট্যাংক স্বাধী���তার নেতৃত্ব দেবার জন্য একজন নেতা খুঁজতে থাকে। প্রথমে তারা মওলানা ভাসানীর সাথে যোগাযোগ করে। তখন চীনের সাথে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং এই সম্পর্ক স্থাপনে ভাসানী বড় ভূমিকা পালন করে। তারা বুঝতে পারে ভাসানী আগ্রহী না।

এরপর নিউক্লিয়াস আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানের সাথে যোগাযোগ করে। আতাউর রহমান খান অত্যন্ত চৌকস নেতা ছিলেন। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করার একটা স্বভাবজাত ক্ষমতা ছিল খান আতাউর রহমানের। কিন্তু উনার সাথে কথা বলে সিরাজ নিশ্চিত হয় আতাউর রহমান পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থক, একই সাথে কম্যুনিজমের বিরোধী। এই প্রসঙ্গে সিরাজ বলেন আতাউর রহমানের পেছনে তার বহু সময় অপচয় হয়েছে।

#
ইতিমধ্যে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেন। নিউক্লিয়াস নড়েচড়ে বসে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে বুঝতে পারে শেখ মুজিবুর রহমানও একই রাস্তায় আছে। ছয় দফা কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন তৈরি হয়। শেখ মুজিবুর রহমান বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পরে দলের মধ্যেই। এই সময় নিউক্লিয়াসের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বাত্নক সহায়তা করে। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে লাহোরে যাবার আগে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম কমিটির একটা সভা ডাকেন। নিউক্লিয়াস আগে খবর পেয়ে যায় তাজ উদ্দিন ছাড়া প্রেসিডিয়াম কমিটির আর তেমন কারো সায় নেই। কমিটির সভা শুরু হলে সিরাজুল আলম খান তার একদন ক্যাডার সাথে করে অস্ত্র নিয়ে সভাকক্ষের বাইরে মহড়া শুরু করে। অস্ত্রের মহড়া দেখে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম কমিটির সদস্যরা দমে যায়, বিরোধিতা করার সাহস পায় না৷

নিউক্লিয়াস ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছয় দফা আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই নিউক্লিয়াসের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের তথা দেশের সবচেয়ে বড় নেতায় পরিনত করে। সিরাজুল আলম খান শেখ মুজিবুর রহমানকে একটু ইশারা দেন নিউক্লিয়াসের ব্যাপারে। তবে তার ভাষ্য মতেই শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে নিউক্লিয়াসের অবস্থা এবং মূল পরিকল্পনা কখনোই পরিষ্কার করেন নি ১৯৬৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত।

ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিকদের মাঝেও নিউক্লিয়াস প্রভাব বিস্তার করে। সিরাজুল আলম খান শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলে। ১৯৬৬ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত সকল আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সমাজ এতে সহায়তা করে শ্রমিক সংগঠনগুলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মূল চার নেতা শাহজাহান সিরাজ, আ.স.ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখনসহ অনান্য প্রভাবশালী নেতা সবাই ছিল নিউক্লিয়াসের সদস্য। সকল আন্দোলন হতো নিউক্লিয়াসের থিংক ট্যাংকের প্রসক্রিপশন মতে।

১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের সময় প্রথম শেখ মুজিবুর রহমানকে নিউক্লিয়াস সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। শেখ মুজিবুর রহমান শেখ ফজলুল হক মণি এবং তোফায়েল আহমেদকে তাদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে বলে। এরপর আসে নির্বাচন। নিউক্লিয়াস অত্যান্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহন করে। কেন্দ্র দখল এবং জাল ভোট দেবার ঘটনা পাকিস্তানে এর আগের কোন নির্বাচনে হয়নি। নিউক্লিয়াস এই জাল ভোট দেবার ব্যাপারটা শুরু করে। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের তখনো ভোট দেবার বয়স হয়নি, তিনি কিছু বছর আগে একটা টকশোতে ৭০ সালের নির্বাচনে জাল ভোট দেবার গল্প বলেন (গর্বের সাথে)। তাদের কাজে অভাবনীয় ফলাফল পায় আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজকে বলেছিলো তিনিও চিন্তা করতে পারেন নাই এমন জয়ের কথা।

শেখ মুজিব মনে করতো সে নিউক্লিয়াসকে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে সিরাজ ভাবতো তারা শেখ মুজিবকে ব্যবহার করছে।

১৯৭০ সালে নিউক্লিয়াস তাদের অন্যতম প্রভাবশালী "জয় বাংলা" শ্লোগানের সূচনা করে। আওয়ামী লীগের সবাই এই শ্লোগানের বিরোধিতা করে। তবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচ্ছন্ন সমর্থন এবং ছাত্রলীগের শক্তির সামনে তাদের বিরোধিতা টেকে না।

এরপর তারা পতাকা বানায়। সবুজ হল পূর্ব বাংলা আর লাল হল কমিউনিজমের প্রতীক। (অনেক জ্ঞানী বলেন পতাকার লাল হল শহীদদের প্রতীক। তারা আসলে জানেন না এই পতাকা বানানো হয় যুদ্ধ শুরু হবার অনেক আগেই)।

পতাকা বানানো ছাড়াও পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত নির্ধারন, স্বাধীনতার ইশতেহার বানানো সবই হয় নিউক্লিয়াসের পরিকল্পনা অনুসারে। তাজ উদ্দিন আহমেদ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই এসবের বিরোধিতা করে। তবে নিউক্লিয়াসের সাথে তাজ উদ্দিন আহমেদের সু-সম্পর্কও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সিরাজুল আলম খান বলেন,

❝ বুদ্ধিজীবীরা '৭১-এর মার্চের আগের দিনও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে পেলেন না।

শুধু বুদ্ধিজীবীরাই নন, সে সময়ের আওয়ামী লীগসহ ছােটো-বড়ো কোনাে রাজনৈতিক দলই মার্চ মাসের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে সমর্থন করেনি। এমনকি তাদের রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যেও স্বাধীনতা বিষয়টি আনতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবস্থানটি ছিলাে একেবারেই ভিন্ন। '৬৯-এ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভের পরই বঙ্গবন্ধুকে 'নিউক্লিয়াস' ও ‘বিএলএফ' সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তখন থেকে তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে শুধু আপােষহীনই ছিলেন না, নিউক্লিয়াস' ও বিএলএফ' এর কর্মকাণ্ড সমর্থন করতেন এবং যে কোনাে পদক্ষেপে উৎসাহ যােগাতেন।

এখানে স্পষ্টভাবে বলা প্রয়ােজন যে, আওয়ামী লীগ দলগতভাবে স্বাধীনতাকে সমর্থন করেনি। এমনকি ১৯৬৯-এর আগে বঙ্গবন্ধুও "নিউক্লিয়াস' ও 'বিএলএফ'-এর কর্ম- তৎপরতা সম্পর্কে জানতেন না। জাতীয় স্লোগান 'জয় বাংলা প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ বিরােধিতা করলেও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও অবস্থান এবং "নিউক্লিয়াস-বিএলএফ'-এর প্রচণ্ড চাপ ও সাংগঠনিক ক্ষমতার বলে “জয় বাংলা স্লোগানকে তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়। ❞

১৯৭০ সালের শেষের দিকে নিউক্লিয়াস কিছুটা প্রকাশ্যে আসে বাংলাদেশের লিবারেশন ফ্রন্ট- বিএলএফ এবং জয় বাংলা বাহিনী নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করে।

১৯৭১ সালের শুরু থেকেই নিউক্লিয়াস সহিংস আন্দোলন শুরু করে। উদ্দেশ্য যেন কোন ভাবেই সমঝোতা না হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা আসলে তারা, ভুট্টোকে জবাই করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো ধরনের শ্লোগান দেয়। পতাকায় আগুন ধরানো, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহের ছবিতে আগুন ধরানো, বিহারিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করতে থাকে।

মার্চের শুরুর দিকে এটা চরমে চলে যায়। খুলনা, চট্রগ্রাম, ময়মনসিংহসহ সারা দেশে বিহারিদের উপর হত্যাযজ্ঞ চলে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে এর ভয়াবহতা ছিল সবচেয়ে বেশি। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, সৈয়দপুরে হাজার হাজার বিহারিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

বাঙালিদের প্রিয় সাংবাদিক এন্থনি মাসকোরেনহাস সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে লিখেছিলেন,

❝ Thousands of families of unfortunate Muslims, many of them refugees from Bihar were mercilessly wiped out. Women were raped or had their breasts torn out... Children did not escape the horror: the lucky ones were killed with their parents.... The real toll have been as may high as 100,000. ❞

২৩ মার্চ, পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিক দিবসে পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে, তাদের প্রস্তাবিত পতাকা উড়িয়ে, 'জয়বাংলা বাহিনীর চার প্লাটুন মার্চ পাস্টের মাধ্যমে পতাকাকে অভিবাদন জানায় এবং পতাকা উত্তোলনের সময় ৭ মিমি রাইফেলের গুলির আওয়াজে পতাকাকে স্বাগত জানানাে হয়। পরে জয়বাংলা বাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে গিয়ে তার হাতে পতাকা তুলে ��েয়। শেখ মুজিবুর রহমানের গাড়ি ও বাসভবনে পতাকা উত্তোলন করা হয়।

এরপর ২৫ মার্চের রহস্যময় রাত। কেন শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে সেচ্ছায় বন্দী হোন, এর উত্তর কোন ঐতিহাসিক দিতে পারেনি। এর আগে অখন্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন এটা শেখ মুজিবুর রহমান এমনটা হয়তো কখনো চিন্তাই করেননি। এই সুযোগ সামনে আসার পরে তার চিন্তাভাবনা সব পাল্টে যায়? এর কোন উত্তর আসলে নেই। তবে এই সেচ্ছা বন্দীর ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের দুই হাত তাজ উদ্দিন আহমেদ এবং নিউক্লিয়াস নেতারা কেউই কিছু জানতো না৷ এরপর নিউক্লিয়াস নেতারা ভারতে চলে যায়। এদিকে নিউক্লিয়াসকে কিছুই না জানিয়ে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে বসে তাজ উদ্দিন আহমেদ। এতে তার উপর চরম ক্ষুব্ধ হয় নিউক্লিয়াস। সুচারু রুপে আন্দোলনের নাটাই ঘোরানো নিউক্লিয়াসের হাত থেকে হঠাৎ নাটাই সরে যায়।

মুক্তিবাহিনীতে যোগ না দিয়ে নিউক্লিয়াসের নেতারা নিজেদের পূর্ব প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়ে গঠন করে "মুজিব বাহিনী"। ভারত জেনারেল সুজত সিং উবানকে দ্বায়িত্ব দেন মুজিব বাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে। মুজিব বাহিনী মুক্তি বাহিনীর চেয়ে উন্নত অস্ত্র এবং রশদ পেতো। মুজিব বাহিনী চারটা সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধ শুরু করে, তাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলো সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ। মুজিব বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৪০,০০০

এখানে নিউক্লিয়াসের একটা ছন্দ পতন হয়। মুজিব বাহিনীর চেয়ে মুক্তি বাহিনী আকারে বড় এবং সেনাবাহিনীর সদস্য দিয়ে গঠিত ছিলো। আর তাজ উদ্দিন আহমেদের সাথে নিউক্লিয়াসের বিরোধ। তাই এ সময়ে নিউক্লিয়াসের প্রভাব অতটা ছিল না।

এই নিউক্লিয়াসের মুজিব বাহিনী নিয়ে আরেকটা বড় আলোচনা ১৪ ডিসেম্বর রাতের ঘটনা নিয়ে৷ এই সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে৷ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আত্নসমর্পণ নিয়ে দর কষাকষি চলছে৷ পাকিস্তানপন্থী লোকজন পালাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানের প্রতি প্রকাশ্যে আনুগত্যের প্রকাশকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের হত্যা করা হয়৷ অনেকেরই সন্দেহের তীর নিউক্লিয়াসের দিকে। কারন তাদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বড় বাঁধা হত এই বুদ্ধিজীবীরা।

একাত্তরের এত দ্রুত পরিসমাপ্তিও সিরাজের পরিকল্পনার বাইরে ছিলো। তারা দীর্ঘ মেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

#
যুদ্ধের পরে ক্ষমতার ভাগাভাগি, সরকারের প্রকৃতি নিয়ে সিরাজের সাথে মুজিবের বিরোধ বাঁধে। সিরাজ চেয়েছিলো, শেখ মুজিব 'জাতির পিতা'। তিনি দল এবং সরকারের প্রধান হবেন না। বাইরে থেকে তিনি নির্দেশনা দেবেন, নৈতিক শক্তি জোগাবেন। দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে এ বিষয়ে সিরাজ পয়েন্ট আকারে দফাওয়ারি কিছু সুপারিশ তৈরি করে।

তবে শেখ মুজিব এগুলো প্রত্যাখ্যান করে নিজের মত দেশ চালাতে থাকেন।

শ্রমিক লীগ এবং ছাত্রলীগ তখনো সিরাজের প্রভাবিত। মণির কিছু অনুসারী ছাত্রলীগে ছিল তবে সেটা খুব বেশি না। রাজনীতিতে মণি নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করার জন্য নিজের শ্বশুড়কে কৃষক লীগের প্রেসিডেন্ট করে কমিটি দেন। জবাবে সিরাজও পাল্টা কমিটি দেন। মুজিবের ভাগ্নে এর বাইরে মণির তেমন কোন যোগ্যতা ছিল না। ছাত্রলীগে সিরাজ এবং মণির অনুসারি দুইভাগ হয়ে যায়।

শেখ মুজিব সিরাজের গ্রুপ পাশে রেখে মণির গ্রুপের সম্মেলনে অংশ নেন। এবং এর মাধ্যমে অনুষ্ঠানিকভাবে শেখ মুজিবের সাথে সিরাজের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছেদ হয়।

৭২ সালের অক্টোবরে সিরাজ তার অনুসারীদের নিয়ে গঠন করেন নতুন দল জাসদ। ছাত্রলীগে সিরাজের অনুসারীরা তাদের দলের নাম দেয় জাসদ ছাত্রলীগ।

খুবই অল্প সময়ের মধ্যে জাসদ তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বুদ্ধিজীবী মহলেও জাসদের বেশ শক্তিশালী সমর্থক তৈরি হয়। জনপ্রিয় তরুন বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফাও জাসদের থিংক ট্যাংকের অংশ ছিলো। জাসদের মোট তিনটা শাখা ছিল— রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক(গণবাহিনী)। জাসদ ছাত্রলীগও ছাত্রদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। জাসদ ছাত্রলীগকে ঠেকাতে ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ এক হয়ে যায়। তারপরেও ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগ পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয়, ফল ঘোষণার আগে লীগ হামলা করে ব্যালট ছিনতাই করে এবং ফলাফল বানচাল করে দেয়।

এরপর জাসদ এবং লীগ মুখোমুখি হয়ে যায়। জেলগুলো ভরে যায় জাসদের নেতা-কর্মীতে। লীগ, রক্ষী বাহিনীর অত্যাচারের জবাবে শুরু হয় গণবাহিনীর লাল সন্ত্রাস— থানা লুট, ব্যাংক লুট, ডাকাতি— রক্ষী বাহিনীর সাথে পাল্লা দিয়ে এহেন কোন অপকর্ম নাই যে গণবাহিনী করে নাই।

মজার ব্যাপার হল লীগ এবং জাসদ মুখোমুখি হলেও শেখ মুজিবের সাথে সিরাজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুটই ছিলো। গণবাহিনীর সদস্যদের প্রতি সিরাজের কঠোর নির্দেশ ছিল কোনভাবেই শেখ পরিবারের সংশ্লিষ্ট কারো ক্ষতি করা যাবে না। আবার রক্ষী বাহিনীর প্রতিও শেখ মুজিবের নির্দেশনা ছিল সিরাজের যেন কোন ক্ষতি না হয়। তবে এরপরও পনের আগস্টের ঘটনায় জাসদ সমর্থন দেয়। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বরের বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের ঘটনা প্রবাহে ভুল সিদ্ধান্তে জাসদ জনপ্রিয়তা হারায়।

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক সফলতার মধ্যদিয়ে জাসদ রাজনীতিতে আরো অজনপ্রিয় এবং অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। সিরাজুল আলম খান রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে নিভৃত জীবনযাপন শুরু করেন। নিউক্লিয়াস করার সময় একটা নিয়ম ছিল দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সদস্যরা কেউ বিয়ে করতে পারবে না। সিরাজ দেশ ভাগের পরেও বিয়ে করেননি।

একাত্তরের যুদ্ধে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কারনে অংশ নিয়েছে, কেউ অপ্রস্তুত অবস্থায়, বাধ্য হয়ে, প্রতিশোধ নিতে, কোন উপায় না পেয়ে ইত্যাদি। তবে জাসদের কর্মীদের সেই ১৯৬২ সাল থেকেই পরিকল্পনা ছিল দেশভাগের। তাদের মানসিক এবং সামরিক প্রস্তুতি ছিল পর্যাপ্ত, তারা জানতো কেন এই যুদ্ধ। একমাত্র শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দিন ছাড়া আওয়ামী লীগের কোন নেতা একাত্তর সালের মার্চ পর্যন্তও দেশভাগের কথা চিন্তা করে নাই। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে ছাত্রলীগের বিপ্লবী অংশ (তথা নিউক্লিয়াস তথা জাসদ) একাত্তরের চেতনার মূল উত্তরাধিকার।

অতি অল্প সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ধস৷ রাজনীতির ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। জাসদের উত্থান-পতন রাজনীতির ইতিহাসে একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। সিরাজুল আলম খানও একটা অদ্ভুত চরিত্র। সফল হয়েও ট্রাজেডির শিকার হয়েছেন। ইতিহাসের মহানয়াক হতে পারতেন তিনি তবে হয়ে গেছেন একটা ফুটনোট....

বিস্তারিত পড়াশোনাঃ

1. আওয়ামী লীগঃ উত্থান পর্ব- মহিউদ্দিন আহমেদ
2. জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি- মহিউদ্দিন আহমেদ
3. তাজ উদ্দিন আহমেদঃ নেতা এবং পিতা- শারমিন আহমেদ
4. স্বাধীনতা, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ- সিরাজুল আলম খান
5. আমি সিরাজুল আলম খানঃ একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য- শামসুদ্দিন পেয়ারা
6. সিরাজুল আলম খান এবং স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস- মহিউদ্দিন আহমেদ
7. মুক্তিযুদ্ধে এক যুবকের কাহিনী- নীতিশ হালদার।
8. আওয়ামী লীগঃ যুদ্ধ দিনের কথা- মহিউদ্দিন আহমেদ
৯. বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তায় সিরাজুল আলম খান এবং স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস- কামাল উদ্দিন আহমেদ
১০. প্রতিনায়ক- মহিউদ্দিন আহমেদ
১১. Fifty years of Bangladesh- Prof. Taj Hashmi
১২. সিরাজুল আলম খান: নির্বাচিত রাজনৈতিক রচনাবলী- মো. সাখাওয়াত হোসেন
১৩. মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী : ইতিহাসের পুনর্পাঠ— আলতাফ পারভেজ

@Mir Salman Samil
Profile Image for Salman Sakib Jishan.
274 reviews158 followers
February 28, 2023
'বিপ্লব হলো এক বিশাল পেটুক, গোগ্রাসে গিলে খায় মানুষকে এবং তার চরিত্রও। দুঃসাহসী মানুষকে নিয়ে যায় সর্বনাশের দিকে এবং ভীরুকে করে বরবাদ।'
(লিও ট্রটস্কির 'মাই লাইফ' গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)

রূপকথার গল্পের একটা রেসিপি আছে। এলুম, দেখলুম, হালুম, জয় করলুম তারপর সুখে শান্তিতে বসবাস করলুম। ৭১ এ যে স্বপ্নের মতো একটা দেশ পেলাম, তা এক রূপকথাই। সমস্যা হলো সুখে শান্তিতে বসবাসের পরের গল্পটা কখনো কেউ বলেনা। অথচ আগ্রহ কিন্তু ওখানটাতেই, এরপরে কি?

'জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি'-বইটিতে লেখক মহিউদ্দিন আহমদ এদেশের ইতিহাসের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সময়ের কথা বলেছেন। এই 'অস্থির সময়' বা 'ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ' সময় বলতে ঠিক কোন সময়টার কথা বলা হচ্ছে বোঝাটা জরুরী। ১৯৭১ পরবর্তী সময়টা, যখন একটা নতুন দেশের জন্ম হয়েছে, ক্ষমতা, ভোগ, দুর্নীতির এক নিদারুন ছড়াছড়ি চারপাশে। একটা দেশ কিভাবে দাঁড়াবে, সেই নীতিনির্ধারণী বা নীতিনির্ধারক হবার চরম অরাজকতা। যেই স্বপ্নে, যে কাল্টে বিশ্বাসে একটা দেশ এলো, সেই একই নির্ভরতায় অনাস্থা, আশাহীনতা, ক্ষুব্ধতা। এরকম একটি সময়, যখন আওয়ামিলীগ ছাড়া আর কেউ নেই (!) শাসনতন্ত্রের হাল ধরার, সেই সময় একদম সকল প্রথাগত রীতিনীতির বাইরে বিকাশ ঘটে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর। এক নতুন মতবাদ, নতুন প্রেরণা। উদ্যমী হাজারো নবীন, সবুজ, তরুণদের নিয়ে আধমরাদের ঘাঁ মেরে বাঁচানোর প্রয়াস।
"...এদের বিপরীতে জাসদ নতুন তত্ত্ব হাজির করে। জাসদের বিশ্লেষণ ছিল, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র হচ্ছে ধনতান্ত্রিক, যদিও এই ধনতন্ত্র অনুন্নত পর্যায়ে রয়ে গেছে। যেহেতু রাজনৈতিক ক্ষমতা বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিদের হাতে, তাই বিপ্লবী শক্তির আশু লক্ষ্য হওয়া উচিত রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শক্তিকে হটিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা।"

সত্তরের দশকে জাসদ ছিল সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত দল। বাহাত্তর সাল ছিল জাসদের উত্থানপর্ব। তেহাত্তর-চুয়াত্তরে ভরা যৌবন। এরপর ৭৫ থেকে সংকট আর ভাঙন। শেখ মুজিবের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র সিরাজুল আলম খান, যিনি ইতিহাসের একজন অনন্য রাজনৈতিক চরিত্র, তাঁর হাতে জন্ম নেয়া জাসদের পরিণতি আসে পচাত্তরের ৭ই নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থান পর। ইতিহাসের অন্যতম মিস্টেরিয়াস চরিত্র কর্নেল তাহের এর মাধ্যমে।
এই বইটি যতটুকু না জাসদের গল্প বলে, তারচেয়ে বেশি বলে ইতিহাসের এই সময়ের ক্ষমতার নানান হাতবদল আর অরাজকতার অজানা কিছু গল্প। এতে উঠে এসেছে সর্বহারা দল, রক্ষীবাহিনী, ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড, সামরিক অভ্যুত্থান, ক্ষমতার পালাবদল সহ আরও অনেক কিছু। যেমন সিরাজুল আলম খানের মত একজন নেতার গল্প এর আগে আমি আসলেও জানতাম না তেমন। ওই ছিঁটেফোঁটা এখান ওখান থেকে শোনা। অথচ এই বিশেষ ব্যক্তি আর এই দলের প্রভাবকের ভূমিকাই আওয়ামিলীগ এর মতো বিরাট দলের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।

রাজনীতির পাঠ কঠিন। ইতিহাস তারচেয়ে কঠিন। কিন্তু সবচাইতে কঠিন পক্ষপাতদুষ্ট থেকে এই দেশের সত্যিকার রাজনৈতিক ইতিহাস বলা। মহিউদ্দিন আহমেদ বর্তমান সময়ের বেশ জনপ্রিয় রাজনৈতিক লেখক। আমাকে অনেকেই সাজেস্ট করেছিলেন তাঁর লেখা পড়তে চাইলে আগে যেনো এটা দিয়ে শুরু করি। কেননা এই বইতে তিনি চেষ্টা করেছেন বেশ সহজ ভাষায়, পক্ষপাত না করে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে। কিন্তু এরপরও আমার মনে হয়েছে আমার এই সময় সংক্রান্ত যেসকল বই পড়া হয়েছে সেসবের বক্তব্যের সাথে এখানের কিছু বক্তব্য কনফ্লিক্ট করে। সময়টাও আসলে এতো ধোঁয়াশাময়, কার বক্তব্যই সঠিক বিশ্বাস করা কঠিন। তাছাড়া, লেখক তথ্যসূত্রে বেশ কিছু ব্যক্তিবর্গের আলাপচারিতেকে সূত্র ধরেছেন। এক্ষেত্রেও আমার মনে হয়েছে সকল পক্ষের বক্তব্য বা নিরিক্ষা অতটা সুস্পষ্ট নয়। তবে অন্যান্য বেশিরভাগ বই থেকে এই বইটি বেশ তথ্যবহুল ও সাম্যাবস্থায় থেকেছে আমি বলবো। বেশ বেশ সাহসী বই।

মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এই এখনকার অবস্থা না, এর মাঝে এসেছেন নানান কুশিলব। অনেক মোড় পেরিয়ে আজকের এই দেশ। আমি সবসময়ই এই দেশের রাজনীতি নিয়ে বিরক্ত এবং কনফিউজড। কারণ মাঝের গল্পটা আমার জানা নাই। সেকারণেই কিছুটা জানার চেষ্টা করছি।
জন্মের ইতিহাস জানলাম নাহয়, বড় হবার গল্পটাও তো জানা প্রয়োজন, নাকি?

৪.৩*
Profile Image for Munem Shahriar Borno.
202 reviews11 followers
November 24, 2023
জাসদের উত্থান বলতে গেলে বাহাত্তর ও তার পরবর্তী ৫-৬ বছরে দেশে রাজনীতির হালচাল, ক্ষমতার ব্যবহার/অপব্যবহার, সামরিক বাহিনীর বিভাজন ও একের পর এক অভ্যুত্থান, এসব নিয়ে আলোচনা অটোমেটিক্যালি চলে আসে।

বইয়ের শুরুতে আওয়ামীলীগ এর বিভাজন, তার কারন, আর সেখান থেকেই জাসদের উত্থানের ব্যপারে "যৌক্তিক" আলোচনাই হয়েছে বলে আমি মনে করি। সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে যারা জানতে আগ্রহী তারা এখানে তার রাজনৈতিক পথ/ধারা সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা পেতে পারেন। আজকের যে জাসদকে আমরা চিনি সেই জাসদ একসময় এতটা বিপ্লবী, সশস্ত্র, শক্তিশালী ছিল যে তা এ বইটি পড়ার আগ পর্যন্তও আমার ধারণা ছিল না (টু বি অনেস্ট)। বিশেষ করে যারা জাসদ বলতে টিভিতে মেননের চেহারা দেখতে দেখতে ক্লান্ত তাদের জন্য এটা মাস্ট রিড! পঁচাত্তরের ঘটনার বিশদ বিবরণ না পাওয়া গেলেও এখানে পঁচাত্তর পরবর্তী ঘটনাগুলো বিভিন্ন রেফারেন্স এর মাধ্যমে একের পর এক বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা হয়েছে যেটা এই বই এর সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, মহান মুক্তিযুদ্ধের তিন শক্তিশালী জেড ফোর্স (জিয়াউর রহমান), এস ফোর্স (শফিউল্লাহ) ও কে ফোর্স (খালেদ মোরাশরর), এর মধ্যকার অন্তঃকোন্দল, বিভাজন ও ক্ষমতার প্রলোভনই পঁচাত্তর এর পর একের পর এক অভ্যুত্থানে রুপ নেয়। ১৯৭১ পর্যন্ত আওয়ামিলীগের বাইরে সবচেয়ে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী দল ছিল ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি। তারা বাহাত্তরে প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকা নিতে পারতো। কিন্তু তারা সহযোগী হয়ে আওয়ামী লীগকে একতরফা রাজনীতি করার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছিল। আর ঠিক তখনই জাসদ তার "পিউর বাম" নীতি অনুসরণ করে আর বনে যায় জাতীয় শত্রু। দলের মধ্যকার মত বিরোধ, চেইন অব কমান্ড এর অভাব, ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব সরকারের সাথে বিরোধী মনভাব, যার ফলশ্রুতিতে দমন-নিপীড়ণ এর ছোবল, কিছু সশস্ত্র সংগ্রাম এর অনর্থক ও ভুল সিদ্ধান্ত, আর প্রত্যেকটা বড় বড় ঘটনার সাথে নিজেদের জড়ানোয় জাসদ অনু-পরমাণুতে ভাঙতে ভাঙতে শেষ ইলেক্ট্রণটিও আর ধরে রাখতে পারে না। দলের ভাঙণ, তার মধ্যে আবার ভাঙণ। ৯১ এর আগেই অনেক উঁচু পর্যায়ের জাসদ কর্মী ও সংগঠক জিয়া আর এরশাদ এর সরকারে যুক্ত হলেও সবথেকে বড় ভাঙন টা লক্ষ্য করা যায় ৯১ এ, যখন গণতান্ত্রিক শাসন পুণরায় ফিরে আসে আর জাসদের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গ ও সংগঠকগণ দলে দলে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ এর রাজনীতিতে সরাসরি অংশ নেয়। লেখকের বিশ্লেষণে, "জাসদের রাজনীতি যাঁরা শুরু করেছিলেন, নিয়ন্ত্রণটা শেষ পর্যন্ত তাঁদের হাতে আর থাকেনি।"

পুরো বই জুড়ে ৩টি চরিত্র সব জায়গায় কমন। সিরাজুল আলম খান, মেজর জলিল ও কর্ণেল তাহের। বইটা শেষ করার পর প্রত্যেকটি ঘটনায় তাঁদের ভূমিকা আপনাকে আর একবার ভাবাবে।

যে বিষয়টা ভালো লাগেনি:
লেখক জাসদের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, তো স্বাভাবিকভাবেই তার ���াপ কিছুটা পাওয়া যাবে বই জুড়ে। বইয়ের পুরো অংশেই লেখকের নিজের সংযোজনের থেকে তার বুক রেফারেন্স বা তার নেয়া সাক্ষাৎকারগুলোই বেশি পাতা দখল করে আছে, যেটা আমি ভালো দিকই বলবো। তবে যখনই এমন মনে হয়েছে জাসদ একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিলো বা কাজ করলো তখন আশা করতাম এর পরের প্যারায় তার ব্যাখ্যা থাকবে। কিন্তু লেখক 'দুঃখজনক', 'ভুলবসত', 'কেন্দ্রীয় নেতার অনানুমতিতে', এসব বলে সুকৌশলে তা এড়িয়ে গেছেন।

বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লেখকের অবতারণা করা কিছু প্রশ্ন আমিও রেখে গেলাম:
"এত প্রাণ যে ঝরে গেল, তার কি কোন দরকার ছিল? নাকি এটা ছিল অনিবার্য?"
"যদি জাসদের জন্মই না হতো তাহলে কি হতো??"
Profile Image for Nazmush  Shakib.
35 reviews8 followers
November 10, 2019
রাজনীতি আর ইতিহাস সচেতন পাঠকদের জন্য অবশ্য পাঠ্য। ইতিহাসের একজন সক্রিয় সাক্ষী হিসেবে লেখক অনেকটাই নির্মোহভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অত্যন্তু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের চমৎকার বিশ্লেষণধর্মী বর্ণনা দিয়েছেন।এটা একটা গবেষণাধর্মী বই। কিন্তু লেখকের চমৎকার লেখনীর জন্য আগ্রহী পাঠকের এক মূহুর্তের জন্যও বিরক্ত হওয়ার উপায় নেই। অসংখ্য রেফারেন্স আর ইতিহাসের সেই অধ্যায়টুকুর অনেক কুশীলবের কাছ থেকে লেখকের নিজের নেয়া সাক্ষাৎকার এই বইটাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।

বলা হয় ইতিহাসকে দেখতে হয় অনেকগুলো চোখ দিয়ে, অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে। নইলে ইতিহাসটা যেমন পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে তেমনি পাঠকের জ্ঞানে অনেকটাই ঘাটতি থেকে যায়। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে মাতৃভূমির সঠিক ইতিহাস জানাটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পরে। আর এই বইটা সেই দায়িত্ব পূরণে অনেকটাই সাহায্য করবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখকের জন্য শুভকামনা এত চমৎকার এইটা বই উপহার দেয়ার জন্য।
Profile Image for Tanvir Rahman.
9 reviews2 followers
September 4, 2023
লেখকের এটা আমার পড়া তিন নম্বর বই । সম্ভবত এখন পর্যন্ত আমার পড়া লেখকের সেরা কাজ এটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি আর নব্বইয়ের আগে গণতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক, জনসম্পৃক্ত হোক আর না হোক সব কর্মকাণ্ডেই জাসদ আসবে । সব রীতি আর সরকার বিরোধিতা, এবং নিজের কোন আন্দোলনের ফসল নিজের ঘরে না তুলতে পারার এক সুন্দর ইতিহাস এই বইয়ে পাওয়া যায় । নিজের করা পটপরিবর্তনের ফসল নিজের ঘরে না তুলতে পারার আরেক উদাহরণ সম্ভবত এর ‘নেতা’ সিরাজুল আলম খানের সাথেও যায় । তাকে নিয়ে লেখকের লেখা বই আমার পড়ার পরবর্তী ধাপ ।

বইটিতে মনগড়া কথা আসেনি তেমন, লেখকের নিজস্ব মতামত অবশ্যই ছিল কিন্তু সেটাও প্রমাণের ভিত্তিতেই । জাসদ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ । বইটি সেকারণেই শুধু পড়া যেতে পারে ।

লেখার আর দালিলিক প্রমাণাদিকে আমলে নিলে বইটা অবশ্যপাঠ্য । আমি অনেকদিন কোন বইকে সব নম্বর দিয়ে রেটিং দেইনি । এই বইটা তাই একটা আশ্চর্য ব্যতিক্রম ।

৫/৫
Profile Image for Munem Ahmed.
23 reviews
January 15, 2022
গ্রন্থের নামঃ জাসদের উত্থান-পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি
লেখকঃ মহিউদ্দিন আহমদ
মুদ্রিত মূল্যঃ ৫৫০ টাকা

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন, তারা হয়ত হাসানুল হক ইনু কিংবা তাঁর রাজনৈতিক দল জাসদ এর নাম শুনে থাকবেন। এই বইটি সেই জাসদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন তথ্য এবং ঘটনা নিয়ে রচনা করা হয়েছে।
বইটি শুরু হয় স্বাধীনতাপূর্ব সময় ৬০ এর দশক থেকে এবং সমাপ্ত হয় ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন এ। অর্থাৎ দলটির গঠনের পটভূমি থেকে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত। যেহেতু বইটি স্বাধীনতা পূর্বের সময় থেকে আরম্ভ হয় তাই বইটিতে সে সময়ের(যুদ্ধ পূর্ব) রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সাধারণ মানুষের জীবনের বর্ণনা ফুটে উঠেছে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও খুঁটিনাটি তথ্যও এই বইটিতে বিদ্যমান। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের কাছেই এই বইটির মূল আকর্ষণীয় অংশটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর শাসনামল, সে সময়ের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের চালচিত্র এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের বিষয়েও এখানে অনেক তথ্য উঠে এসেছে। এরই সাথে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর জাসদের অবথান ও পরিস্থিতি, দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া এবং বঙ্গভবনের ঘটে যাওয়ার নানা ঘটনার বর্ণনাও রয়েছে। বইটির দ্বিতীয় আকর্ষণীয় অংশটি হলো ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জেনারেল খালেদ মোশারফ (বীর উত্তম) এর অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান ( যা 'সিপাহি বিপ্লব' নামে পরিচিত) অর্থাৎ জেনারেল জিয়ার ক্ষমতায় আসা, জিয়া ও তাহেরের মধ্যকার সম্পর্ক এবং জিয়ার শাসনামল। তাছাড়াও এরশাদের শাসনের সময়ের অনেক তথ্য এবং সে সময়ের জাসদের অবস্থা কেমন ছিল ও এরশাদ পতন আন্দোলনে জাসদের ভূমিকা সম্পর্কেও জানা যায়।
বইটি আমার কাছে খুবই তথ্যপূর্ণ, চিত্তাকর্ষক এবং রোমাঞ্চকর মনে হয়েছে। সত্য যে কল্পনার চাইতেও রোমাঞ্চকর এবং ইতিহাস যে রোমাঞ্চকর হতে পারে, তার একটি বড় প্রমাণ এই গ্রন্থটি। বইটি পড়ে আমার কাছে সিরাজুল আলম খানকে খুবই রহস্যময় ব্যক্তি মনে হয়েছে। লেখককে এই বইটি রচনা করার জন্য বিভিন্ন স্থান হতে বিভিন্ন ব্যক্তি, গ্রন্থ ও অন্যান্য উৎস হতে সঠিক, নির্ভুল ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বের করে আনার জন্য খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে আর তারই সাথে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়েছে। বইটি বিভিন্ন রাজনৈতিক গবেষনার ক্ষেত্রে এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানার জন্য ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। তাই লেখকের পরিশ্রম ও সময় বৃথা যায়নি। যাদের ভবিষ্যতে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছা আছে তারা বইটি পড়তে পারে। অনেক কিছু শিখতে ও জানতে পারবেন।
Profile Image for Kazi.
159 reviews21 followers
May 4, 2020
ছাত্রলীগের জাতীয়তাবাদী অংশটা( যারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী) থেকে কিভাবে নানা ঘাত প্রতিঘাতে মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে জাসদ গঠিত হলো যা খুব অল্প সময়ে হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, এই যাত্রাটা বেশ ভালোভাবে উঠে এসেছে এখানে। জাসদের সাথে সর্বহারা পার্টির যোগাযোগের বিষয়টা ব্যক্তিগতভাবে চমকপ্রদ লেগেছে। জাসদের উত্তাল সময়ের সাথী অসংখ্য তরুণের স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস পড়া একটু কষ্টকর ছিল অবশ্য। "ক্রাচের কর্নেল" পড়ে তাহেরকে নিয়ে তীব্র রোমান্টিকতায় ভোগা তরুণদের এই বইটা অবশ্যপাঠ্য, রূঢ় বাস্তবের স্বাদ পাবার জন্য।
Displaying 1 - 30 of 59 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.