আমি কোন প্রথাগত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ছিলাম না। এখনো নই। আমি মূলত একজন কাটখোট্টা বিজ্ঞান লেখক। যারা আমায় চেনে এই পরিচয়ই হয়তো কিছুটা চেনে। তবে কাঠখোট্টা বিজ্ঞানের লেখা লিখলেও রবীন্দ্রনাথকে একদম জানিনা তা তো নয়। তবে সে জানাটাও বিজ্ঞানের মাধ্যমেই। তাঁর শেষ বয়সে লেখা ‘বিশ্বপরিচয়’ নামের প্রিয় বইটা তো সেই ছোটবেলাতেই পড়া হয়ে গিয়েছিল, তারপর ‘বড় হয়ে’ বিজ্ঞানের নানা বিষয় আশয় নিয়ে পত্র-পত্রিকা এবং ব্লগে লিখতে গিয়েই রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কার করা আমার। ততদিনে কেবল বিশ্বপরিচয়ের সাথেই পরিচয় ঘটেনি, পাশাপাশি জানা হয়েছে বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে বন্ধুত্বের কথা, জেনে ফেলেছি আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীর সাথে বাস্তবতা, দর্শন এবং প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সুরের মূর্ছনা নিয়ে কী ভীষণ নিগূঢ় আলোচনা করেছিলেন কবি। এগুলো নিয়ে আমার কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ এখানে ওখানে প্রকাশিতও হয়েছে ততদিনে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ আমি কখনো লিখব তা মাথায়ই ছিলো না কখনো।
কিন্তু এ দৃশ্যপট পালটে গেল এ বছরের (২০১৪) সালের জুন মাসে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণের সময়। সে ভ্রমণের অংশ হিসেবে আর্জেন্টিনা এবং পেরুতে সপ্তাহ খানেক থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এক ফাঁকে ঢু মেরেছিলাম আর্জেন্টিনার ‘রবি-তীর্থে’ অর্থাৎ, রবিঠাকুরের আর্জেন্টিনীয় বান্ধবী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাড়ি ‘ভিলা ওকাম্পো’তে। আমার মেয়েকে নিয়ে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছিলাম সে বাড়িতে। বার হাজারের ওপর বইপত্র, নানা পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র এবং ভিক্টোরিয়ার প্রকাশিত পত্রিকার পুরনো সংখ্যা এবং সে বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে আপ্যায়িত মনীষীদের ছবি সম্বলিত সেই বাড়ি দর্শনের অভিজ্ঞতাটা অনেকটা তীর্থস্থান ভ্রমণের সাথে তুলনীয় ছিল যেন।
‘ভিলা ওকাম্পো’তে প্রবেশের আগে অনেকের মতো আমিও ভাবতাম ওকাম্পো বোধ হয় কেবল রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য অনুরাগীদের মধ্যে অন্যতম একজন নারী ছিলেন। হয়তো একটু আধটু সাহিত্য রসিক, এবং সাহিত্য অনুরক্ত নারী ছাড়া তিনি তেমন কিছু নন। এছাড়া ওকাম্পোর বলার মতো পরিচয়ই বা আছে কী? কিন্তু সে ধারণা আমূল বদলে গেল আর্জেন্টিনা ভ্রমণ শেষ করে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথির সন্ধান আমি পেলাম, যার আলোকে ওকাম্পোকে জানার চেষ্টা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে জানলাম, দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্য সংস্কৃতিতে আধুনিকতা আনয়ন এবং নারীবাদ প্রতিষ্ঠায় ওকাম্পোর কতখানি অবদান ছিল। পাশাপাশি তিনি ছিলেন ভীষণ এক উদ্যমী নারী। তিনি ‘সুর’ নামে একটি পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ত্রিশের দশকে, এবং এর ডাকসাইটে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। বুয়েনোস আইরেস থেকে স্প্যানিশ ভাষায় ছাপানো এ পত্রিকাটি কেবল আর্জেন্টিনায় নয়, সারা দক্ষিণ আমেরিকাতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তরের দশকের তাল-মাতাল সময়গুলোতে। হর্হে লুইস বর্হেস, মার্সেল প্রুস্ত, টমাস মান, টি এস এলিয়ট, হেনরি মিলার, জ্যাক মারিত্যাঁ, পল ক্লোদেল, অল্ডাস হাক্সলি, সিমোন ওয়াইল, লিউইস মামফোর্ড, আঁদ্রে জিদ, মার্টিন হাইডেগার, এজরা পাউন্ড সহ সারা পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকেরা সে পত্রিকায় লিখতেন। এই পত্রিকার মাধ্যমেই ভার্জিনিয়া উলফের নারীবাদী লেখার সাথে দক্ষিণ আমেরিকার পাঠক-পাঠিকাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ওকাম্পো। পত্রিকা প্রকাশ ছাড়াও সাহিত্য এবং সামাজিক অঙ্গনে তাঁর অবদানের খোঁজ পেলাম ব্যাপক পরিসরে। ভিলা ওকাম্পোর লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলাম- রবীন্দ্রনাথ, কাইজারলিঙ, ভার্জিনিয়া উলফের মত প্রথিতযশা মানুষদের নিয়ে তিনি বই প্রকাশ করেছেন। অনুবাদ করেছেন কাম্যু, টি ই লরেন্স, ফকনার, ডিলান টমাস, গ্রাহাম গ্রিন সহ অনেকের কাজ। অসংখ্য পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন সারা জীবনে। ১৯৬৭ সালে বিশ্বভারতী থেকে তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে আর্জেন্টাইন একাডেমি অব লেটার্স’ এর সভানেত্রী (Alberdi Chair) নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এত শত পুরস্কারের ভিড়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত এবং উদ্বেলিত করেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সম্মাননাটি। আমি খুঁজে দেখলাম, ওকাম্পোর আগে বিগত ৩৩০ বছরে মাত্র দশজন নারী এই সম্মাননা লাভ করতে পেরেছিলেন।
তবে পুরস্কার নয়, সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে আসলো তার নারীবাদী এবং মানবতাবাদী ভূমিকাটি। বিশেষত নারীদের অধিকারের উপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছিলেন, যেগুলো ছিল তখনকার সময়ের তুলনায় যথেষ্ট সাহসী। সে সমস্ত লেখায় তিনি নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেছেন, নারীর ভোটাধিকারের কথা বলেছেন, নারীর যৌন স্বাধীনতার কথা বলেছেন, বিয়ে এবং পরিবার নিয়ে সনাতন ধারণার বাইরে গিয়ে লিখেছেন, নারীদের উপর পুরুষদের ধর্ষণের প্রতিবাদ করেছেন, এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণ, একক মাতৃত্ব,গর্ভপাতের অধিকার নিয়েও কথা বলেছেন (‘নারী: তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’ শিরোনামের তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখার অনুবাদ এই বইয়ের পরিশিষ্টে সন্নিবেশিত হয়েছে)। ১৯৩৬ সালে তিনি আর্জেন্টিনা মহিলা সমিতি স্থাপন করেছিলেন, সে সময় পি.ই.এন-এরও সহ-সভানেত্রী ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি আর্জেন্টিনায় নাৎসি অনুপ্রবেশ বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে নিয়ে ‘একশন আর্জেন্টিনা’ (Acción Argentina) গঠন করেছিলেন। এ করতে গিয়ে সামরিক জান্তার রোষানলে পড়েছিলেন তিনি তখন। বিশেষত পেরন সরকারের (১৯৪৬-১৯৫৫) আমলে তাঁকে নানাভাবে হেনস্থা করা হয়েছিল। গ্রেফতার করা হয়েছিল রাষ্ট্রবিরোধী মুক্তমত প্রচার এবং প্রকাশের অভিযোগে। সেসময় জহরলাল নেহেরু, ওয়ালদো ফ্রাঙ্ক, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল সহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ওকাম্পোর অসংখ্য বন্ধুবান্ধবদের প্রচেষ্টা এবং দাবীর মুখে ছাব্বিশ দিনের মাথায় সরকার ওকাম্পোকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ওকাম্পো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সহমর্মী বান্ধব ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী গণহত্যার প্রতিবাদে ওকাম্পো প্রতিবাদলিপি দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন সরকারের কাছে। এ নতুন নতুন তথ্যগুলো আমাকে আনন্দিত এবং গর্বিত করেছে।
আর্জেন্টিনা ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে আমি বাংলাদেশের জনপ্রিয় অনলাইন পত্রিকা বিডিআর্টসের জন্য একটি লেখা লিখেছিলাম – ‘ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন’ শিরোনামে। আমার ভিলা ওকাম্পো ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া নতুন সব তথ্যের আলোকে নতুনভাবে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর সম্পর্ককে বুঝবার প্রয়াস ছিল সে লেখায়। আমি লেখাটিতে দেখিয়েছিলাম ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথ কেবল ‘প্লেটোনিক ধরণের’ রোমান্টিক সম্পর্কে জড়াননি, কিংবা ‘বিজয়ার করকমলে’ লিখে ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেই তাঁর আর্জেন্টিনা অধ্যায় শেষ করে দেননি, বরং পূরবী পরবর্তী বহু কবিতা, গল্প এবং উপন্যাসে ওকাম্পোর উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। ওকাম্পোর প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের অনেক বিখ্যাত চিত্রকর্মেও। শুধু তাই নয়, আমি লেখাটিতে কিছু উপকরণ হাজির করেছিলাম, যার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় যে, ওকাম্পোর সংশ্রব রবীন্দ্রনাথের প্রথাগত নারীভাবনা শেষ বয়সে এসে কিছুটা হলেও পাল্টাতে সাহায্য করেছিল। লেখাটির শেষদিকে এসে আমি আধুনিক বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট থেকে রবীন্দ্রজীবনে নারী এবং প্রেমকে বিশ্লেষণ করেছিলাম, যা এর আগে কেউ করেছিলেন বলে আমার জানা নেই। লেখাটি ছিল বেশ দীর্ঘ। আমি ভেবেছিলাম এ ধরণের একঘেয়ে নিরস লেখা পড়তে পড়তে হয়তো পাঠকদের ক্লান্তি চলে আসবে। কিন্তু পাঠকদের কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, তাতে মনে হয় সেরকম কিছু হয়নি। বরং, যে কোন কারণেই হোক, লেখাটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। অনেক পাঠক সে লেখায় মন্তব্য করে লেখাটিকে পূর্ণাঙ্গ বইয়ে রূপ দিতে অনুরোধ করেন। আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করব বিডিআর্টসের সম্পাদক রাজু আলাউদ্দিনের কথা। বিডিনিউজ পত্রিকায় আমার পাঠানো প্রবন্ধটি পড়ে সেটিকে আরও কিছুটা বিবর্ধিত করার পরামর্শ দিয়ে পরবর্তীতে একটি বই প্রকাশের কথা বলেছিলেন। এবং সেটি তিনি বলেছিলেন প্রবন্ধটি পত্রিকায় প্রকাশের পূর্বেই। শুধু তাই নয়, আমাকে চাপ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর মধ্যকার সারাজীবনে প্রেরিত পত্রাবলীর অনুবাদ করিয়ে নিলেন। কেবল তাঁর কারণেই ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের মধ্যকার পঞ্চাশটি হাতে লেখা চিঠির অনুবাদ এই গ্রন্থের শেষে সন্নিবেশিত হতে পেরেছে। এখানেই শেষ নয়, বইয়ের পাণ্ডুলিপি হয়ে যাবার পর তিনি পুরো পাণ্ডুলিপিটি পড়ে একটা চমৎকার মুখবন্ধ লিখে আমাকে অসীম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন তিনি।
রাজু আলাউদ্দিন ছাড়াও আরো দু’জনের কথা আমার আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হবে। একজন হলেন বন্ধু রাজর্ষি দেবনাথ। তিনি আটলান্টা থাকাকালীন সময়ে আমার পাণ্ডুলিপিটি মন দিয়ে পড়েছেন এবং বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সংশোধনীর পরামর্শ দিয়েছেন। বস্তুত প্রাথমিক প্রুফ-রিডিং এর কাজটুকু হয়ে গিয়েছিল ‘বানান-বিশারদ’ রাজর্ষি থাকার কারণেই।
আর অন্যজন আমার স্ত্রী বন্যা আহমেদ। আমার লেখালিখির সবচেয়ে বড় সমালোচক সে। পাশাপাশি সবচেয়ে বড় প্রেরণাদাতাও। অফিসের ব্যস্ততা, কাজ কর্ম আর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বইটার ব্যাপারে যখন উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলাম, তখন বন্যা আমাকে নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় পরিশিষ্টে সন্নিবেশিত ওকাম্পোর ‘নারী: তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’ শিরোনামের লেখাটার পুরোটা অনুবাদে সাহায্য করেছে নিজের সমস্ত কাজকর্ম শিকেয় তুলে রেখে। বন্যা না থাকলে বইটা আদৌ বের হতো কিনা আমি একেবারেই নিশ্চিত নই।
আর আছেন অবসর প্রকাশনীর সর্বেসর্বা আলমগীর রহমান। এই আলমগীর ভাইকে আমি ভীষণ ভয় পাই। উনি একসময় আমার ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ এবং আমার স্ত্রী বন্যার ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বই দুটো প্রকাশ করেছিলেন। সে প্রায় সাত আট বছর আগের কথা। এর পর থেকে বই প্রকাশের জন্য উনার দ্বারস্থ হয়ে উঠা হয়নি। আমার বরাবরই মনে হত, আমার লেখা টেখা উনি বিশেষ পছন্দ করেন না। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে এবার বিডিনিউজে আমার লেখাটি প্রকাশের পর তিনি এ নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, এই পাণ্ডুলিপি যেন তাকে ছাড়া আর কাউকে যেন না দেয়া হয়, দিলে ‘ছিল্লা কাইট্টা’... বলে মহা ভয় দেখিয়েছেন। সেই ভয়ে যার পর নাই ভীত হয়ে পাণ্ডুলিপি তার হাতেই তুলে দিলাম। তবে কানে কানে বলে রাখি বাজারে একটা কথা প্রচলিত আছে যে আলমগীর ভাই নাকি নারকোলের মত। উনার কেবল বাইরের খোলসটাই শক্ত, ভিতরটা নাকি একদম নরম। তবে অনেকেই ভিতরের খবর পায় না। আমি পেয়েছি কিনা বলতে পারব না, তবে বুঝতে পেরেছি তিনি ভাল বই প্রকাশের ব্যাপারে কেবল আন্তরিকই নন, সেই সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রফেশনাল এবং সবচেয়ে ভাল প্রকাশক - উনার কাজের সাথে যারা পরিচিত তাঁরাই বলতে পারবেন। বইটি অবসরের কাছে তুলে দিতে পেরে গর্বিত এবং আনন্দিত বোধ করছি।
বিডিআর্টসে প্রকাশের কিছুদিন পর মুক্তমনা ব্লগেও আরেকটু বিবর্ধিত আকারে লেখাটি প্রকাশ করেছিলাম – ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’ শিরোনামে। বইটির জন্য এ শিরোনামটিই যুক্তিযুক্ত মনে হওয়ায় সেটাই রেখে দিলাম। নতুন শিরোনাম খোঁজার যন্ত্রণা থেকে অন্তত বাঁচা গেল! বইটি পাঠকদের ভাল লাগলে আনন্দিত বোধ করব।
বিক্তেরিয়া [ইংরেজি উচ্চারণে ভিক্টোরিয়া] ওকাম্পোর (১৮৯০-১৯৭৯) মৃত্যুর সাড়ে তিন মাস পরে এক স্মরণসভায় হোর্হে লুইস বোর্হেস, স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি জানি বিক্তোরিয়া ওকাম্পো ইউরোপের বিচিত্র সংস্কৃতিকে অনুভব করতেন। রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে, দর্শনের মাধ্যমে, কিপলিং-এর মাধ্যমে তিনি ভারতকেও অনুভব করেছিলেন। অর্থাৎ প্রাচ্যকে অনুভব করেছিলেন।” (“Yo se que Victoria Ocampo sentia las viversas culturas de Europa. Sintio tambien, a traves de la filosofia, atraves de Kipling, sintio tambien a la India, es decir sintio al Oriente.” -Borges en sur: 1931-1980, Jorge luis Borges, Emece, Buenes Aires 1999 P-329)
বিক্তোরিয়া ওকাম্পো - যিনি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বিজয়া’ হিসেবেই আমাদের কাছে সর্বাধিক পরিচিত - লাতিন আমেরিকার সেই গায়ক পাখি যার আতিথ্যপূর্ণ ও রুচি-স্নিগ্ধ স্বরগুচ্ছের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন সমকালের শীর্ষ ব্যক্তিদের অনেকেই : হোসে অর্তেগা ই গাসেৎ, হেরমান কাইজারলিং, ইগর স্ত্রাভিনস্কি, অলডাস হাক্সলি, আঁদ্রো মালরো, গ্রাহাম গ্রিন, এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সংস্কৃতির নানান ক্ষেত্রের এইসব নক্ষত্রের আলো ও উত্তাপে তার আত্মা ছিলো উজ্জীবিত। ইউরোপের প্রধান তিনটি ভাষা আয়ত্তে থাকার কারণে সেখানকার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তার যাতায়াত ছিলো অবাধ। অন্যদিকে, প্রাচ্য সম্পর্কে তার উৎসুক্য ছিলো এতটাই গভীর যে তার অদৃশ্য তৃষ্ণার তোরে ভাষার বাধাও প্লাবিত হয়ে গেছে। তাই প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করতে গিয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। (“Mas que leerlo, habia llorado sobre el” - Autobiografia, Vol-iv, Victoria Ocampo, sur, Buenos Aires, 1982, p-18.) প্রতীচ্যের দান্তে, বোদলেয়ার, ভার্জিনিয়া উলফে তিনি পেয়েছিলেন ক্ষুধার্ত আত্মার জন্য অমেয় ভোজ, তেমনি রবীন্দ্রনাথেও তিনি পেয়েছিলেন অনুরূপ আয়োজন। তার একটি ডানা যদি হয়ে থাকে প্রতীচ্য, তবে অন্যটি প্রাচ্য। যদিও এই প্রাচ্যকে তিনি অনুভব করেছিলেন মূলত গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই।
১৯২৪ সালে ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ ছিল একেবারেই আকস্মিক, কিন্তু উভয়ের জীবনেই এই সাক্ষাতের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী ও গভীর। কেন সুদূর প্রসারী ও গভীর সেটার ব্যাখ্যা দেয়ার আগে আরেকটু বিশদভাবে জানা দরকার ওকাম্পোর জীবনের পরম্পরাটুকু।
যে সময়ে ও সমাজে এবং যে দেশে ও সংস্কৃতিতে, এমনকি যে মহাদেশে ওকাম্পোর আবির্ভাব তা প্রথা, কুসংস্কার ও নারীবিরোধী বিশ্বাসে ছিলো পশ্চাৎপদ। ওকাম্পোর কর্মজীবনের সূচনায় যে একেবারে কোথায়ও কোনো প্রথাদ্রোহী স্ফুলিঙ্গ ছিলো না তা নয়, তবে তা সহস্র শিখায় জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় ছিল। ‘Sur’ আর তার নিজস্ব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি সেই সহস্র শিখার উত্তাপ ও আলোকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লাতিন আমেরিকার মতো এক বিশাল ভূখণ্ডে।
রবীন্দ্রনাথের মতই ওকাম্পোও ছিলেন বনেদী পরিবার থেকে আসা। দুজনেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেই গড়ে উঠেছিলো সংস্কৃতি ও শিক্ষাদীক্ষার এক অবারিত পরিমণ্ডল। বহু-সংস্কৃতির উদার আপ্যায়নে ওকাম্পো কেবল নিজেকেই নয়, চেয়েছিলেন সে ভোজ সভায় তার জাতির সবাইকে শামিল করতে। বোর্হেস অন্যত্র যে বলেছিলেন “তিনি নিজের দেশ এবং নিজের মহাদেশকে শিক্ষিত করেছেন।” (Ella educo a su pais y a su continente) - তা মোটেই বাড়িয়ে বলেন নি।
নারীর অধিকার ও নারীর ভূমিকা নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি বিশুদ্ধ সাহিত্যিক প্রেরণা থেকে ওকাম্পো লিখেছেন দান্তে ও ভার্জিনিয়া উলফকে নিয়ে। অনুবাদ করেছেন আববেয়ার ক্যামু, গ্রাহাম গ্রিন, ডি এইচ লরেন্স, ডিলান টমাস প্রমুখ। নিজে লিখেই কেবল দায়িত্ব পালন করেননি, এমনকি তরুণ লেখকদের নতুন ভাবনা ও সৃষ্টির ধাত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ‘সুর’ নামক অসাধারণ এক পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। এই পত্রিকাটি কেবল লাতিন আমেরিকারই নয়, হয়ে উঠেছিল বিশ্বের অন্যান্য ভাষার বহু লেখকের জন্যই এক মিলনমঞ্চ। বিভিন্ন সময় এ পত্রিকায় লিখেছেন হোর্হে লুইস বোর্হেস, আদোল্ফো বিয়ই কাসারেস, হোসে বিয়াংকো, ওয়াল্ডো ফ্রাংক, আল্ফন্সো রেইয়েস, টমাস মান, টি এস এলিয়ট, আঁদ্রে মালরো, হেনরি মিলার, অক্তাবিও পাস, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের মতো লেখকরা, যাদের কেউ কেউ সম্মানিত হয়েছেন নোবেল পুরস্কারে। বহুকাল পরে, অক্তাবিও পাস ‘সুর’ পত্রিকার সাংস্কৃতিক ভূমিকার গুরুত্ব স্মরণ করতে গিয়ে বলেছিলেন “‘সুর’ কেবল একটি পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠানই নয়, এ হচ্ছে আত্মার এক ঐতিহ্য...(বিক্তোরিয়া) যা করেছেন তা আমেরিকায় আগে আর কেউই করেননি।”( Sur no es sólo una revista o una institución: es una tradición del espíritu... [Victoria] ha hecho lo que nadie antes había hecho en América) চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রবহমান এই পত্রিকাটি কেবল আর্হেন্তিনাতেই নয়, বরং গোটা লাতিন আমেরিকাতেই ছিলো লেখক ও পাঠকদের আত্মার নবজাগরণের এক অনন্য হেঁসেল। ‘সুর’-এর উদয়াস্ত পর্যন্ত লাতিন আমেরিকাতে বহু সাহিত্যিক আন্দোলন এবং সেসবকে কেন্দ্র করে বহু পত্রপত্রিকা বের হয়েছে বটে, কিন্তু কোনটিই সাহিত্যিক আন্দোলনের তকমা বিহীন ‘সুর’-এর মূর্ছনায় উচ্চাঙ্গের গৌরব অর্জন করতে পারেনি। এমনকি, আজকে আমরা বুম-থেকে-উৎসারিত লাতিন আমেরিকার যেসব লেখকদের বিশ্বব্যাপী পরিচিত হতে দেখছি তাদের প্রায় সবাই ‘সুর’-এরই পালকপুত্র। বিশ্ববোধের প্রাথমিক পাঠ এবং বৈশ্বিক রুচির সাহিত্যিক মনোগঠন তারা অনেকটাই পেয়েছিলেন ‘সুর’ থেকে।
সৃষ্টিশীল লেখার পাশাপাশি রুচি গঠনের লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ যে সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালন করেছিলেন - বহু দূরে একই আত্মার প্রতিধ্বনি হিসেবে - ওকাম্পো তার সংস্কৃতিতে প্রায় অনুরূপ ভূমিকাই পালন করেছিলেন। একটু আগেই বলেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোর সাক্ষাৎ আকস্মিক হলেও তার ফলাফল উভয়ের জীবনেই ছিলো সুদূরপ্রসারী ও সুগভীর। মাত্রা যাই হোকনা কেন, উভয়েই যে পরস্পরকে প্রভাবিত করেছিলেন তা তাঁদের পরবর্তী কর্মকাণ্ড ও রচনা অনুসরণ করলেই লক্ষ্য করা যাবে।
১৯২৪ সালেই যদিও দেখা কিন্তু, ওকাম্পো নিজেই জানিয়েছেন “রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে ১৯১৪ সাল থেকেই প্রোথিত হয়ে আছেন” (Tagore estaba instalado en mi vida desde 1914” - Autobiografia, Vol-iv, Victoria Ocampo, sur, Buenos Aires, 1982, p-17) এবং আরেকটু এগিয়ে তিনি এও বলেছিলেন যে “আমার পক্ষে তো এটা জীবনেরই সবচেয়ে বড় ঘটনা” (শঙ্খ ঘোষ, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ: ৩৫), তবে ঘটনাটাকে কেবল নিজের জীবনেই বড় করে রাখেননি, এই ঘটনার ফলাফলকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্র-চর্চার মাধ্যমে এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্পানঞলভাষী পাঠকদেরকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে।
আমার বিবেচনায়, উত্তরে হোসে বাস্কন্সেলোসের পর দক্ষিণে ওকাম্পোই হচ্ছেন সেই বিদুষী রবীন্দ্র-ভোক্তা যিনি লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্র-বিস্তারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রশতবার্ষিকী যে আর্হেন্তিনায় বিশাল জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হতে পেরেছিল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, তারও পেছনে ছিলেন ওকাম্পোই। এমনকি, ডাকটিকিটও বেরিয়েছিল সেখান থেকে। তারই সম্পাদনায় ‘সুর’ পত্রিকা এ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের উপর একটি বিশেষ সংখ্যাও বের করেছিলো, যাতে লিখেছেন হোর্হে লুইস বোর্হেসসহ প্রথম সারির বহু লেখক। কিন্তু যদি বলা হয় রবীন্দ্রনাথেও ওকাম্পোর প্রভাব কম নয়, তা আমাদের কাছে আজ অবিশ্বাস্য শুনালেও রবীন্দ্রনাথের বুয়েনোস আইরেস ভ্রমণ-পরবর্তী ভাবনা, রচনা ও চিঠিপত্রগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখবো যে রবীন্দ্রনাথ তার নারীবিষয়ক ভাবনাকে অনেকটাই বদলে নিয়েছিলেন। আজ যদি এই দাবী করা হয় যে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের আঁতুড়ঘর ওকাম্পোর আতিথ্যপূর্ণ বুয়েনোস আইরেসেই তা কি বাড়িয়ে বলা হবে? এই জন্মের পেছনে যত আকস্মিকতাই থাকুক না কেন, আমরা কখনোই এই নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি না যে প্রায় অগ্রাহ্য করার মতো ঘটনা ও পরিস্থিতিও কখনো কখনো বড় সব ঘটনার পেছনে অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ই কি আমাদের চোখ কানকে জাগ্রত রাখতে শেখায়নি এই ব্যাপারে যে আমরা যাকে ‘সামান্য’ বলে মনে করি তা আসলে ‘সামান্য’ নয় মোটেই? আর রবীন্দ্রনাথ নিজে যেমন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সমালোচকদের কাছেও পূরবী তার শেষ দিককার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে নানা কারণেই ভাবনা ও কাব্যবোধের সেই উচ্চতম সূচক যেখানে তিনি বহু বছরের ব্যবধানে আবারও পৌঁছুতে পেরেছিলেন। এই পৌঁছানো যে সম্ভব হয়েছিল তার পেছনে ওকাম্পোর ভালোবাসাই ছিল মূল প্রেরণা।
ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এত সব কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বলার কারণ অভিজিৎ রায়ের এই বইটির বিশেষত্বকে যত দূর সম্ভব স্পষ্টভাবে বুঝবার আকাংক্ষা থেকে। পরস্পরের মানসিক ও মননশীল সম্পর্কটিকে যে বিস্তার থেকে অভিজিৎ ধরার চেষ্টা করেছেন তা বাংলা ভাষায় এর আগে কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। যদিও রবীন্দ্রনাথের জীবনে যেমন, তেমনি ওকাম্পোর জীবনেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা আমরা কম বেশি কবি শঙ্খ ঘোষ ও কেতকী কুশারী ভাইসনের মাধ্যমে জানি। কিন্তু বিজ্ঞান-লেখক অভিজিৎ রায় আগের অনেক তথ্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গ্রন্থে হাজির করেছেন। ফলে গ্রন্থটি তথ্যের দিক থেকে প্রতিধ্বনি হলেও, নতুন বিশ্লেষণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগের ধারণাগুলোকে যুক্তির আলোকে খণ্ডন করার কারণে ভিন্ন স্বাদের পরিচয় নিয়ে এসেছে। ওকাম্পোর সাথে সম্পর্কের সূত্রে রবীন্দ্রনাথের নারীবিষয়ক ধারণার যে পরিবর্তনগুলো আমরা তার চিঠিপত্রে, প্রবন্ধে ও সৃষ্টিশীল অন্যান্য রচনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি, অভিজিৎ সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিলেন যে ছোটরাও বড়দেরকে প্রভাবিত করতে পারেন। অভিজিতের এই গ্রন্থের আরও একটি বড় দিক হচ্ছে এর ‘পরিশিষ্ট’ নামক অংশটি। নামে ‘পরিশিষ্ট’ হলেও এটি এই গ্রন্থের অনুপম বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। ‘নারী: তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’ নামক ওকাম্পোর প্রবন্ধ এবং রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোর ৫০টি চিঠির বাংলা তর্জমার মাধ্যমে পাঠক আবিষ্কার করবেন ভিন্ন দুই সংস্কৃতি ও ভাষার এমন এক যুগলকে যারা এর আগে সম্ভ্রমের কুয়াশায় মোড়ানো ছিলেন বলে আমরা ভালোভাবে কখনো খেয়াল করিনি। অভিজিৎ এই কুয়াশার পর্দা সরিয়ে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোকে যে স্বচ্ছতায় হাজির করেছেন তা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখার মতো। স্বভাবে গবেষণাধর্মী হলেও এই গ্রন্থের মূল প্রাণ তার আখ্যানসুলভ বুনন ও বিজ্ঞানধর্মী যুক্তিবোধের পরম্পরা। অভিজিৎ প্রায় স্বভাব-বিরুদ্ধ এই দুই প্রবণতাকে পুরোপুরি বশে রেখে যে অসামান্য নমুনা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তা মুগ্ধ করার মতো। অভিজিৎকে প্রাণখোলা অভিনন্দন এবং কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদেরকে এমন গ্রন্থের পাঠক হওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য।
রাজু আলাউদ্দিন সম্পাদক, বিডি আর্টস (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম) কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক ‘দক্ষিণে সূর্যোদয় : লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্রচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক
[Dr. Avijit Roy is a Bangladeshi-American blogger, published author, and prominent defender of the free thought movement in Bangladesh. He is an engineer by profession, but well-known for his writings in his self-founded site, Mukto-Mona—an Internet congregation of freethinkers, rationalists, skeptics, atheists, and humanists of mainly Bengali and South Asian descent. As an advocate of atheism, science, and metaphysical naturalism, he has published eight Bangla books, and many of his articles have been published in magazines and journals. His last two books, Obisshahser Dorshon (The Philosophy of Disbelief) and Biswasher Virus (The Virus of Faith), have been critically well-received and are popular Bengali books on science, skepticism, and rationalism. }
লেখক হবার কোন বাসনা ছিলো তা নয়। কিন্তু ছোট্ট একটা স্বপ্ন হয়তো ছিলো একটা মনের গহীনে। স্বপ্নটা পালটে দেবার। সেই পালটে দেবার স্বপ্ন থেকেই ২০০১ সালের দিকে একদিন সমমনা কয়েকজন লেখকদের নিয়ে তৈরি করে ফেললাম মুক্তমনা সাইট (www.mukto-mona.com)। এর পর থেকেই সাইটটির বিস্তৃতি বেড়েছে। এখন বাঙালি বিজ্ঞানকর্মী, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদীদের কাছে মুক্তমনা একটি বিশ্বস্ত নাম। ২০০৭ সালে মুক্তবুদ্ধি, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্যক অবদান রাখার প্রেক্ষিতে তার মুক্তমনা সাইট অর্জন করেছে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক।
শখের বশে টুকিটাকি লেখা লিখছিলাম ইন্টারনেটে, ম্যাগাজিনে আর দৈনিক পত্র-পত্রিকায়। পছন্দের বিষয় প্রথম থেকেই ছিলো আধুনিক বিজ্ঞান এবং দর্শন। আমার সেসময়ের চিন্তাভাবনার গ্রন্থিত রূপ ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫)। এরপর একে একে অনেকগুলো বইই বের হয়েছে। তার মধ্যে, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭, পুনর্মুদ্রণ ২০০৮), স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮), সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০,পুনর্মুদ্রণ ২০১৩), অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১, দ্বিতীয় প্রকাশ: ২০১২, তৃতীয় প্রকাশ: ২০১৪), বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২), ভালবাসা কারে কয় (২০১২),এবং শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪: প্রকাশিতব্য)। পাঠকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে, বইগুলো পাঠকদের ভাল লেগেছে। অনেকেই বইগুলোকে ‘ব্যতিক্রমী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, কেউবা আবার আগ বাড়িয়ে বলেছেন ‘মাইল ফলক’। তা যে ফলকই হোক না কেন, আমি এই বইগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখে একটি ব্যাপার বুঝতে পারি যে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী ও সাধারণ মানুষেরা বিজ্ঞান বিমুখ নয় মোটেই, নয় দর্শনের প্রতি অনাগ্রহীও। ভাল বই তাদের আগ্রহ তৈরি করতে পারে পুরোমাত্রায়।
পেশায় প্রকৌশলী। পড়াশুনা করেছি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট), পি.এইচ.ডি করেছি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে (এন.ইউ.এস)। বর্তমানে আমেরিকায় কম্পিউটার প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত । অবসর সময় কাটে বই পড়ে, লেখালিখি করে, গান শুনে, জীবনসঙ্গিনী বন্যার নিয়মিত বকা খেয়ে, আর নিঃসীম আঁধারে আলোকিত স্বপ্ন দেখে - ‘মানুষ জাগবে তবেই কাটবে অন্ধকারের ঘোর’...
এই বইয়ের সব থেকে যে বিষয়টা সব থেকে আকর্ষণীয় লেগেছে আমার, তা হল কবি দুনিয়ার তাবত বিষয় নিয়ে মাতামাতি করলেও নারীকে ঘরের ভেতরে দেখতেই পছন্দ করতেন, হুমায়ুন আজাদ 'নারী' গ্রন্থে এক কথায় ধুয়ে দিয়েছিলেন এ জন্য কবিকে! কবির সেই ভাবনা থেকে বের হয়ে আসার পেছনে ওকাম্পোর যে বড় হাত ছিল অভিজিৎ রায় এই বইয়ে নিঁখুতভাবে বর্ণনা করেছেন। ।
এক কথায় অসাধারণ একটা বই। শুধু ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে শেষ বয়সের প্রেমই নয়, সমসাময়িক সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক হালচাল, রবীন্দ্রনাথের প্রেমের সাইকোলজি, তাঁদের চিঠিপত্রের অনুবাদ, বিভিন্ন সময়ের ফটোগ্রাফ, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় ওকাম্পোর প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ছায়া- একদম এ টু জেড লিখে গিয়েছেন লেখক।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রসঙ্গ উঠলে অবধারিত ভাবে “আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী” গানটার কথা মনে আসবে। অনেকের মতোই আমারও জানা ছিল না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানটা তাঁর প্রিয় বিদেশিনী ভিক্টোরিয়ার (রবীন্দ্রনাথের কাছে যিনি ছিলেন ‘বিজয়া’) জন্য লিখেন নি। অবশেষে রবীন্দ্রনাথ এই গানটার ইংরেজি অনুবাদ ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন বটে। তবে তা অনেক পরে, গানটা লেখার ত্রিশ বছর পরে। তাই গানটা ভিক্টোরিয়ার জন্য না লিখে থাকলেও এই গানের উপযুক্ত পাত্রী যে তাঁর বিজয়াই ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সে সন্দেহের অবকাশ রাখেন নি।
রবীন্দ্রনাথ বোধহয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মতো কারো জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তাই গানটা তাঁর মনে এসেছিল। অনেক বছর পরে সেই চিরচেনা বিদেশিনীর দেখা পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে চিরচেনা হ’লেও কয়েকজন রবীন্দ্রগবেষক ছাড়া কেউই এই বিদেশিনীকে তেমন চেনেন না। এই চেনানোর কাজটা অভিজিৎ রায় করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাঁর লেখা “ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে” বইটাতে।
আর্জেন্টিনার বিদূষী এই নারী ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত। শুধু যে একজন বড় মাপের সাহিত্যরসিক ছিলেন তাই নয়, নিজগুণেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছিলেন এক অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁরও ছিল এক বর্ণাঢ্য, সমৃদ্ধ এবং কর্মময় জীবন। ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন তাঁর আতিথ্য বুয়েনোস আয়ার্সে। ঘটনা গড়িয়েছেও অনেক। দুই বিশাল ব্যক্তিত্বের সম্মিলনে, কথোপকথনে, চিঠিপত্রে, একের ওপরে অন্যের প্রভাবে, একের প্রতি অন্যের আকর্ষণে, মানবিক রোমান্টিকতায়, ঘটনার পরম্পরা জন্ম দিয়েছে এক না লেখা উপন্যাসের পটভূমির। অভিজিৎ রায় যেন সেই না লেখা উপন্যাসটিই লিখেছেন।
“ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে” জমজমাট একটা উপন্যাসের মতোই। কিন্তু তা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং চিন্তা করার মতো বেশ কিছু তত্ত্বের সমাহারে সমৃদ্ধ এই বই। শুধু ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকেই নয়, পাঠকেরা রবীন্দ্রনাথকেও নূতন করে চিনতে পারবেন এই অসাধারণ এবং স্বতন্ত্র ধারার বইটা থেকে। রবীন্দ্রনাথের গানে-কবিতায় প্রেম আর ভক্তি ঘুরে ফিরে আসে, প্রায়শই একাকার হয়ে। কেমন যেন একটা অস্পষ্টতা আর হেঁয়ালিতে ভরা তার প্রেম-ভক্তিমূলক রচনাগুলো। ‘প্লেটোনিক’ প্রেম না নিছক সাদামাটা প্রেম - কোনদিকে তাঁর পক্ষপাতিত্ব, এ নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রেখে দেন তাঁর পাঠকদের – মনে হয় ইচ্ছে করেই। নিজের জীবনে তিনিও যে একজন প্রেমিক পুরুষ ছিলেন তাঁর রচনায় এই পরিচয়টা প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে অনেকটাই। তবে তাঁর প্রেমিকারাও যে অশরীরী মানবী ছিলেন না, ছিলেন আশেপাশেই, চেনা-পরিচিত গণ্ডীর মধ্যেই, অভিজিৎ রায়ের এই বইয়ে তা আর প্রচ্ছন্ন থাকে নি।
গবেষণাসমৃদ্ধ এই বইটা পড়ার পরে রবীন্দ্রমানস সম্পর্কে একটা বেশ পরিচ্ছন্ন ধারণা জন্মাবে পাঠকের মনে। রবি-বিদেশিনীকে খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকেও নূতন করে খুঁজে পাই আমরা “ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে” বইটাতে। অভিজিৎ যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন এবং পাঠককে দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন সেটিই এই বইটাকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
দৃষ্টিভঙ্গিটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘গুরুদেব’ নামে পরিচিত হ’লেও রবীন্দ্রনাথ দেবতা নন – রক্ত-মাংসের মানুষ। তাই রবীন্দ্রনাথের ওপরে লেখা আর পাঁচটা বইয়ের মতো গদগদ ভক্তি নিয়ে অভিজিৎ লিখেন নি। মোহমুক্ত এই রচনা – বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ। ঠিক সাহিত্য সমালোচনা নয়, রবীন্দ্রনাথের জীবনের একটা পর্যায় এবং প্রাসঙ্গিক ভাবে কয়েকটা দিক এই বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। আর তা অভিজিৎ তুলে এনেছেন একজন বিজ্ঞান-গবেষকের দক্ষতায়। বিশ্লেষণের যৌক্তিক পদ্ধতি এবং পর্যায়ক্রমিক উপস্থাপনা এই সুলিখিত বইটার সাহিত্যগুণ কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ করে নি, বরং এই পদ্ধতি এবং উপস্থাপনাই বইটাকে ভিন্ন এক মাত্রা দিয়েছে, করে তুলেছে স্বতন্ত্র। সাহিত্য এবং শিল্পের আলোচনাও এতে আছে - এবং খুব গভীরভাবেই আছে। রবীন্দ্রসাহিত্যে উৎসাহী, রবীন্দ্রজীবনে আগ্রহী, রবীন্দ্রমানসে উৎসুক – সবার কাছেই এই বই সমাদৃত হবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
অধ্যাপক ইরতিশাদ আহমদ ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি,ইউএসএ; ‘আমার চোখে একাত্তর’ গ্রন্থের লেখক। মায়ামি, ফ্লোরিডা। ************************
প্রিয় অভিজিৎ তোমার এই এতবড় লেখাটি এত সহজে এবং এত দ্রুত পড়ে ফেলতে পারব ভাবিনি। অসাসধারণ লেখা একটি। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লেখালেখি তো নেহাৎ কম হয়নি। তথাপি আমি মনে করি তোমার লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজনা হিসেবে পরিগণিত হবে সুধীমহলে। ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক তথ্য জানলাম রবীন্দ্রনাথের ওপর যা আমার একেবারেই জানা ছিল না। বিশেষ করে রবিঠাকুরের ওপর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রভাব তাঁর নারীবিষয়ক চিন্তাধারার জগতে আমূল পরবর্তনের হাওয়া বইয়ে দিতে। তোমাকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন থাকল এত বিশাল একটি কাজ করে ফেলার জন্যে।
অধ্যাপক মীজান রহমান ডিস্টিংগুইশড রিসার্চ প্রোফেসর, গণিত বিভাগ, কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় ‘শূন্য’, ‘লাল নদী’, ‘অনন্যা আমার দেশ’ সহ বিবিধ গ্রন্থের লেখক অটোয়া, ক্যানাডা
************************
অভিজিৎ, তোমার লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে ওঠা গেলো। এক কথায় অসামান্য ও অনবদ্য লেখা। ধন্য তোমার অধ্যবসায় ও অভিনিবেশ। আমার টুপিখোলা অভিনন্দন রইলো তোমার মাস্টারপিস লেখাটির জন্য।
আলম খোরশেদ প্রকৌশলী এবং সাহিত্যিক ‘লাতিন-দ্বাদশী’, ‘ভাবনাগুচ্ছ হেনরি মিলার’, ‘ন্যুয়র্ক নিসর্গ’ সহ বিবিধ গ্রন্থের লেখক। বিশদ বাঙলা, চট্টগ্রাম
************************
এমন পরিশ্রমী লেখা [“ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন”] বাংলায় সচরাচর দেখি না। আরো অবাক হচ্ছি কারণ সাহিত্য সেভাবে আপনার গবেষণার ক্ষেত্র নয়, তবুও আপনি রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুরাগের কারণে এ লেখার জন্য প্রচণ্ড শ্রম দিয়ে গেছেন। লেখার শেষে ৭০টি টীকা আছে - এ থেকে বোঝা যায় আপনার বলার কথা ফুরায়নি। আপনি চাইলে সেখান থেকে আরো তথ্য যোগ করে মূল লেখাটিকে আরো বড় করে তুলতে পারেন।
আপনি তো বাকী সব সাহিত্য-গবেষকদের জন্য কাজকর্ম কঠিন করে দিলেন অভিজিৎ।
প্রিয় অভিজিৎ, লেখাটি শেষ করলাম। লেখাটির [“ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন”] নাম সার্থক। সব মিলিয়ে খুব ভাল লাগল। অনেক নতুন খবর জানলাম।
সাদ কামালী রবীন্দ্র গবেষক এবং সাহিত্যিক ‘রবীন্দ্রনাথের বিবাহভাবনা’, ‘লীলাবতি’, ‘গল্পবোধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ সহ বিবিধ গ্রন্থের লেখক ক্যানাডা।
************************ “তোমার মত কারও ছোঁয়া বৃক্ষ যদি পায় বৃক্ষ তবে সবুজ হয়ে যায়”। (~সৈয়দ হক)
অভিজিৎ রায়ের হাতের ছোঁয়ায়ও যে কোন আলোচনা পাঠকপ্রিয়তা পায় । এর সাক্ষ্য “ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন”-এ রয়েছে। মুক্ত-মনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের একটি যৌথ লেখার পর এ লেখাটি ভিন্নর্বাতা দেয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তার মনোভাবের মুগ্ধতার কথা বলে।
গীতা দাস লেখক এবং ব্লগার, নারী অধিকারকর্মী ‘তখন ও এখন – সামাজিক রূপান্তরের রেখাচিত্র’ গ্রন্থের লেখক [বিডিআর্টসে প্রকাশিত লেখার প্রতিক্রিয়া মন্তব্য হিসেবে]
************************ মানবতার গভীর পরিচয় মানুষের সৃষ্টির মাঝে, তা সেই সৃষ্টি বিজ্ঞানেই হোক, কাব্যকলায় হোক, কিংবা নতুনভাবে কোন ভূখণ্ডকে দেখার মাঝে হোক। সেই কবে থেকে শুনে এসেছি বিষুবরেখার নিচে সুদূর আর্জেন্টিনার এক কবির কথা, মোহনীয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কথা, রবীন্দ্রনাথের সাথে ওনার সখ্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গানে, চিত্রকর্মে ওনার প্রভাবের কথা। অনেকেই লিখেছেন তাঁদের দুজনের বন্ধুত্বের কথা, হয়তো অঘোষিত হৃদয়ানুভূতির কথা। কিন্তু সেই সম্পর্কের বিস্তার এমনই অসীম যে তার মাঝে যেন অনেক আবিষ্কারের রসদ সব সময়ই মজুদ। সেই রসদকে তিল তিল করে অভিজিৎ রায় তুলে এনেছেন ইতিহাসের এক গভীর মৌচাক-কুয়ো থেকে, আমাদেরকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ওকাম্পোর প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথকে। অভিজিৎ রায়ের লেখনী বাংলাদেশ তথা বাঙালি মানসে নতুন চিন্তা প্রবর্তনে অগ্রবর্তী ও সাহসী, তাঁর প্রতিটি বইয়ের বিষয়ই সেই সাক্ষর বহন করে, এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই মানুষ রবীন্দ্রনাথকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে লেখক নিজেকে বিরত রাখেন নি, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে নারী প্রভাব ও তাঁর নারী চেতনার বিবর্তনকে পাঠকের কাছে আবরণ ছাড়াই উপস্থাপিত করেছেন। অনেক পাঠকের কাছে এই উপস্থাপনা হবে অভিনব, কিন্তু মানুষ রবীন্দ্রনাথকে বুঝে নিতে সেটি আমাদের সাহায্য করবে। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছিলেন, আমায় পরশ ক’রে প্রাণ সুধায় ভ’রে তুমি যাও যে সরে।" শিল্পী যত বড় প্রতিভারই আধার হোন না কেন, কালোত্তীর্ণ সৃষ্টির জন্য তিনি অনুপ্রেরণার দাস। অভিজিৎ রায়ের এই লেখায় আমরা দেখি ওকাম্পো কেমন করে রবীন্দ্র হৃদয়কে পরশ করেছিলেন, হয়েছিলেন তাঁর muse, তাঁর বিজয়া। এই বইটির শেষে লেখক অতি যত্ন সহকারে ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথের পরস্পরকে লেখা পঞ্চাশটি চিঠির অনুবাদ করেছেন। এক বিশাল সময় জুড়ে পৃথিবীর দুই প্রান্ত থেকে লেখা মহাসাগর পার হয়ে দুটি খুবই সংবেদী হৃদয়ের আখ্যান এই চিঠিগুলি। পাঠককে মানবতার গভীর পরিচয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার জন্য এই চিঠিগুলি যেন পথপ্রদর্শক। আমার বিশ্বাস বিশ্বের বিশাল অঙ্গনে রবীন্দ্রনাথকে নতুন ভাবে দেখবার জন্য, তার ভাষা, ভাব, চিত্রকর্ম বোঝার জন্য, সর্বোপরি মানুষ রবি ঠাকুরের অনুপ্রেরণার উৎসগুলি বোঝার জন্য অভিজিৎ রায়ের এই গবেষণালব্ধ কাজ - যা কিনা একই সাথে সহজপাঠ্য ও সুগভীর - একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ড. দীপেন ভট্টাচার্য অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ রিভারসাইড কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া ‘দিতার ঘড়ি’ গ্রন্থের লেখক।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী
রবীন্দ্রনাথের এই গানের বিদেশিনী কে? কেউ কেউ ধারনা করেন যে, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ই এই গানে উল্লেখিত বিদেশিনী। কিন্তু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই বিদেশিনী, রবি-বিদেশিনী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো নয়। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র সাথে দেখা হওয়ার অনেক আগেই রচিত হয়েছিল এই গানটি। “মূল গানটি কবি রচনা করেছিলেন শিলাইদহে বহুদিন আগে – সেই ১৮৯৫ সালে”। আর ওকাম্পোর সাথে কবির দেখা হয়েছিল ১৯২৪ সালের অক্টোবর কিংবা নভেম্বর এর দিকে। রবীন্দ্রনাথ কবে মিরালরিওর বাসাটায় উঠেছিলেন সেটার সঠিক তারিখ নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। কিন্তু “এ বিখ্যাত গানটির ইংরেজি অনুবাদ ওকাম্পোর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রবিঠাকুর, আর্জেন্টিনা আসার কয়েক দিনের মধ্যেই”। “গানটি রচনা করার ত্রিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ হয়তো ওকাম্পোর মধ্যেই আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর পরম আরাধ্য সত্যিকার ‘বিদেশিনী’ কে”। সেই ১৯২৪ সালে দানা মেলা রবি-ওকাম্পো’র “অশ্রুত অনেক গুঞ্জনকেই” বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন অভিজিৎ রায় ২০১৫ সালে এসে, তাঁর “ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে” বইটিতে।
গবেষণাধর্মী বই লেখা অনেকটা কঠিন বলতে হয়। সঠিক তথ্য আর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা না থাকলে সেই গবেষণার কুঁড়ি দেখার আশা ছেড়ে দিতে হয়। আর সেটা যদি আজ থেকে ৬০/৭০ বছরেরও আগেকার কোন মানব-মানবীর মধ্যেকার রহস্যময় সম্পর্কের হয় যার খুবই নির্ভরযোগ্য এবং নিরপেক্ষ তথ্যের ভান্ডারটা যথেষ্ট নয় তাহলে ব্যাপারটা আরো একটু বেশি কষ্টসাধ্য এবং গোলমেলে হয়ে যায়। এই অসীম ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের কজটিই বেছে নিয়েছিলেন অভিজিৎ রায় যার সুফল হিসেবে আমরা পেয়েছি “ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে” বইটি। বইটির লেখা সম্পর্কে প্রথমেই কিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। এই বইটিতেও অভিজিৎ রায়ের লেখার ধরণ বরাবরের মত প্রাঞ্জল ও সাবলিল। যে জায়গায় যে তথ্যটা দরকার সেই জায়গায় ঠিক সেই তথ্যটি ব্যবহার করেছেন। মাঝে মাঝে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক তথ্য দিয়েছেন যা তথ্যের সত্যতাকে অনেকাংশে নির্ভরযোগ্যতা দিয়েছে। অভিজিৎ রায় অসাধারণ মাপের বিজ্ঞানমনস্ক লেখক তো বটেই সাথে একজন পরিপক্ব সাহিত্যিকও বটে। বিজ্ঞান ও সাহিত্য উনার হাতে সমানভাবেই প্রসূত হয়। একটার আধিক্যে অপরটার সংশয়ে পড়তে হয় না।
এখন আসা যাক বইটির মূল প্রস্তাবনায়। বইটি মূলত পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত- ১। প্রথম অধ্যায়ঃ বিজয়ার করকমলে ২। দ্বিতীয় অধ্যায়ঃপূরবীঃ কিছু অশ্রুত গুঞ্জন ৩। তৃতীয় অধ্যায়ঃ চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ ৪। চতুর্থ অধ্যায়ঃ রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনা এবং ওকাম্পো-প্রভাব ৫। পঞ্চম অধ্যায়ঃ রবীন্দ্র-জীবনে নারীঃ একটি বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীয় অনুসন্ধান
বিজয়ার করকমলে অংশে ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ের সূত্রপাত। “১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শত বছর বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যাবার জন্য জাহাজে উঠলেও মাঝপথে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনায় অবস্থান করতে হয় তাঁকে” এবং তখনই পরিচয় হয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে। পরে পেরু ভ্রমণ বাদ দিয়ে তিনি প্রায় দুই মাসের মত বুয়েনোস আইরেস থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সান ইসিদ্রোতে মিরালরিওর একটি বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নিবিড় পরিচর্যায় এবং পর্যবেক্ষণে। যে বাসাটিতে উনি ছিলেন “এক ইউরোপনিবাসী দম্পতির ব্যক্তিগত বাড়ি হিসেবেই এটি পরিচিত এখন”। তবে মিরালরিও নামের এ বাড়িটির কয়েক ব্লক পরেই একটি বাড়ি আছে, সেটাই আজ পরিচিত ‘ওকাম্পোর বাড়ি’ হিসেবে; নাম ‘ভিলা ওকাম্পো’।
অনেকেই ধারনা করেন যে “পূরবী” কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতাই ওকাম্পোকে নিয়ে রচিত কিন্তু তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে এখন “পূরবী” নামে যে কাব্যগ্রন্থটি পরিচিত তার অন্তর্গত ১৬টি কবিতার সময়কালঃ ১৯১৭-১৯২৩। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাগুলোতে ওকাম্পো প্রভাব নেই সেটা বলাও সমীচীন হবে না বরঞ্চ “পূরবী” কাব্যগ্রন্থের শেষের দিকে সংযোজিত কবিতাগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে ওকাম্পো প্রভাব আছে। “১৯২৪ সালের ৬ নভেম্বর প্রবে���ের পর থেকে লেখা ২৬টি কবিতার সাথে আর্জেন্টিনীয় যোগসূত্র আছে বল অনুমিত হয়”। এই পূরবী কাব্যগ্রন্থেরই উৎসর্গপত্রে কবিগুরু লিখেছিলেন- “বিজয়ার করকমলে”। এই বিজয়া-ই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথের দেয়া নাম। লেখকের মতে- “যতদিন এই প্লাতা নদীর জল বইবে, যতদিন পূরবী কাব্যগ্রন্থ টিকে থাকবে, ততদিন মর্মর সুরে বইবে রবিঠাকুর আর তাঁর প্রেয়সী ওকাম্পোর রোমান্টিক অভিসারের অশ্রুত কলকাকলি”। “পূরবীঃ কিছু অশ্রুত গুঞ্জন” অংশে লেখক “অশ্রুত গুঞ্জনগুলোকে” নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন। নিত্যপ্রিয় ঘোষ এর মতে “রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রেমের কবিতাগুলো একমাত্র ওকাম্পো-অনুপ্রাণিত, সেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়- রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীকে তাহলে অত্যন্ত সংকীর্ণ করে ফেলা হয়”।
তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম- “চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ”। রবীন্দ্রনাথ শুধু কবিতা-গান-উপন্যাস-প্রবন্ধই লেখেননি চিত্রকলাতে ছিল তাঁর অসামান্য খ্যাতি। কিন্তু এই খ্যাতির পেছনে ওকাম্পোর সাহায্য এবং অনুপ্রেরনার কথা অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর জন্য সহায় খোঁজে পাচ্ছিলেন না তখন ওকাম্পো এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর সহায়তায় ১৯৩০ সালের মে মাসে প্যারিসের পিগ্যালে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের প্রথম সফল প্রদর্শনী হয়। তার পর “জুন মাসে বার্মিংহ্যাম, ইন্ডিয়া সোসাইটি, লন্ডনে। জুলাই মাসে বার্লিন, জেনেভায়। সেপ্টেম্বর মাসে মস্কোয়, অক্টোবরে আমেরিকার বোস্টনে এবং ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়ায়”। রবীন্দ্র গবেষকদের মতে ওকাম্পোর অনুপ্রেরণাতেই রবীন্দ্রনাথ পুরুদস্তুর ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন। তবে ওকাম্পোর সাথে দেখা হওয়ার আগে থেকেই রবীন্দ্র চিত্রকর্মের নথিপত্রও পাওয়া গেছে। অনেক গবেষকরা রবীন্দ্রনাথের আঁকা অনেক নারী অবয়বে ওকাম্পোর প্রতিচ্ছবি পেয়েছেন। তবে স্বীকার করলে ভুল হবে না যে, রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকলায় আগ্রহী করে তোলায় ওকাম্পোর বড় প্রভাব ছিল। বইটির মূল রচনা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে হলেও লেখক আনুষঙ্গিকভাবে টেনে এনেছেন চিত্রকলাকে। তেমনি রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনাকেও টেনে এনেছেন চতুর্থ অধ্যায়ে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এই বিষয়ের অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও বিষয়টি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকও বটে। এই অংশে রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, ওকাম্পোর সাথে পরিচয়ের আগের রবীন্দ্রনাথ আর পরের রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনায় বিরাট ফারাক রয়েছে। অনেকটা বলা যায় স্রোতের অনুকূল আর প্রতিকূল।
এই বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান অংশ হচ্ছে পঞ্চম অধ্যায় যার শিরোনাম- “রবীন্দ্র-জীবনে নারীঃ একটি বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীয় অনুসন্ধান”। এই অংশে লেখক বিবর্তন ও মনোবিজ্ঞানের ভাষা দিয়ে রবিঠাকুর আর ওকাম্পোর মধ্যেকার “প্লেটোনিক সম্পর্ক” কে (রবীন্দ্র গবেষকদের ভাষায়) খন্ডন করেছেন সুচারুভাবে। ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি ওকাম্পোর ভালোবাসা যে অস্বাভাবিক কিছু নয় বরঞ্চ একে অপরের নিবিড় সাহচর্য তথা ভালোবাসা আকাঙ্ক্ষা করাটাই যে স্বাভাবিক ছিল সেটা লেখক গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেছেন। এই অংশটি এই বইয়ের এক আসামান্য সংযোজন নিঃসন্দেহে যা রবীন্দ্র-গবেষণায় এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে।
তার বাইরেও বইটিতে আরো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে- ভূমিকা, লেখকের জবানবন্দি আর পরিশিষ্ট। রাজু আলাউদ্দিন এর লেখা ভূমিকাটিও চমৎকার হয়েছে। বলতে হয় অভিজিৎ রায়ের বইটির সাথে মানানসই। পরিশিষ্ট অংশ তিনটি ভাগে বিভক্ত- নারীঃ তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ, পত্রাবলী ও পাঠকের অভিমত। ‘নারীঃ তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’ প্রবন্ধটি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র ‘La mujer, sus derechos y sus responsabilidades’ প্রবন্ধটির তর্জমা। পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্ত ‘পত্রাবলী’ অংশটি এই বইয়ের গুরুত্ব অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। অভিজিৎ রায়ের বাংলায় তর্জমা করা রবিঠাকুর ও ওকাম্পোর মধ্যে আদানপ্রদানকৃত মোট পঞ্চাশটি চিঠি সংযোজিত হয়েছে ‘পত্রাবলী’ অংশে, যা রবিঠাকুর আর ওকাম্পোর মধ্যেকার রহস্যময় জগতের প্রবেশদ্বার অনেকখানি উন্মোচিত করেছে।
“বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে যে প্রেয়সী পেতেছে আসন চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া কানে কানে তাহারি ভাষণ।” ওকাম্পোর সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রবীন্দনাথের মনে এটাই বেশি করে বেজেছে বোধহয়। রবীন্দ্রনাথ স্প্যানিশ জানতেন না, ইংরেজিটাও সেভাবে না। তারপরও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে তার চিঠিগুলো পড়ে মনে হয়, তিনি যথার্র্থই বলেছেন: “ভাষা যার ছিলো নাকো, অাঁখি যার কয়েছিলো কথা, জাগায়ে রাখিবে চিরদিন সকরুণ তাহারই বারতা।” অভিজিৎ রায়ের গবেষণার জায়গা রবীন্দ্রনাথ না হলেও তিনি চমৎকারভাবে লিখেছেন এক অনবদ্য ‘উপন্যাস’। প্রচুর পড়াশোনা অার গবেষণালব্ধ জ্ঞানে বইটি হয়েছে সমৃদ্ধ। যেন মাস্টার পিস। দুই মহাদেশের দুটো মানুষের প্লেটোনিক প্রেম নাকি সাদামাটা প্রেম তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। কিন্তু রবি ঠাকুরের ভক্ত হয়েও গদগদ না করে রক্তমাংসের রবীন্দ্রনাথ আর ওকাম্পোর প্রতি এমন মোহ বর্জন করে লেখা কটা বাঙালি লেখকের পক্ষে সম্ভব হতো জানি না। অভিজিৎ ওকাম্পোর বাড়ির নানা আলোকচিত্র তুলে ধরেছেন। হয়তো আ ের্জন্টিনা কখনো যাওয়া হবে না ওকাম্পোর বাড়ি দেখতে। কিন্তু ড. অভিজিৎ এর এমন চমৎকার বিবরণীতে ওই সময়কালে আমি প্লাতার বহমানতা ঠিকই টের পেয়েছিলাম। লেখক আবারো ধন্যবাদ পাবেন, প্রতিটি জিনিসের তথ্যসূত্র এভাবে উল্লেখ করার জন্য। কোনভাবেই যেন মনে প্রশ্ন না থাকে। বা আরো বেশি জানা যায়। এই পরিশ্রম অভিজিৎ-এর সার্থক। মহাকাল তাঁকে কেড়ে না নিলে আরো দারুণ সব লেখা আশা করতে পারতাম।