স্বকৃত নোমান (Swakrito Noman) ১৯৮০ সালের ৮ নভেম্বর ফেনীর পরশুরাম উপজেলার সীমান্তবর্তী বিলোনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞানার্জন ও লেখালেখিকে জীবনের প্রধান কাজ বলে মনে করেন। স্বভাবে অন্তর্মুখী, আবেগপ্রবন, যুক্তিবাদী ও প্রকৃতিমনস্ক। প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে রাজনটী, বেগানা, হীরকডানা, কালকেউটের সুখ, শেষ জাহাজের আদমেরা উল্লেখযোগ্য। গল্পগ্রন্থের মধ্যে নিশিরঙ্গিনী, বালিহাঁসের ডাক। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার ২০১১, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার ২০১৫, শ্রীপুর সাহিত্য পুরস্কার ২০১৫, এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।
একটা মিথ থেকে অনুপ্রাণিত উপন্যাসের কাহিনী। কাহিনীর ব্যাপারে কোন অনুযোগ নেই। চমৎকার। তবে অষ্টাদশ বা উনবিংশ শতকের যে সময়ের পটভূমিতে এই উপন্যাস, পড়তে গিয়ে কেন জানি না মনে হলো উপন্যাসের প্রথম অংশে সেই সময়টাকে যতটুকু অনুভব করা গেছে পরবর্তী অংশে যেন ততটা যায়নি। এমন হতে পারে দ্বিতীয় অংশে এসে মনোযোগ হারিয়েছি। দ্বিতীয় অংশ বলতে যেখানে এসে লেখক বলে বসলেন এখন শুরু হতে যাচ্ছে গুলনাহারের আসল গল্প সেখানটা থেকে বুঝাতে চাইছি।
পড়ে শেষ করলাম স্বকৃত নোমানের লেখা উপন্যাস রাজনটী । এ বছর বইমেলার সময় কেনা হয়েছিল কিন্তু পড়ব পড়ব করে আর পড়াই হয়ে ওঠেনি। উপন্যাসটি মূলত আমাদের লোকপুরাণের একজন বাইজীকে নিয়ে। সেই বাইজী এই উপন্যাসের মূল চরিত্র গুলনাহার। গুলনাহার মূলত একজন হতভাগ্য নারী যার মা তাকে বেঁচে দেয় দুর্ভিক্ষের সময়। তার ভাগ্য তার সাথে এমন পরিহাস করে যে সে দ্বিতীয়বারের মতো বিক্রি হয় একজন বাইজীর কোঠাতে। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে রাজনটী।গুলনাহার যখন তাঁর সৌন্দর্য, নৃত্য এবং গানের জন্য পুরো রাজ্যে বিখ্যাত, যখন সে রাজ্যের মাইনেধারী রাজনটী,তখন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন গুলনাহার এক অপমানে হতাশ হয়ে উদয়চলকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং অজানা উদ্দেশ্য নতুন যাত্রা শুরু করে। সেই যাত্রায় সে সিদ্ধান্ত নেয় তার জন্মভূমিতে ফিরে আসার। গুলনাহার ফিরে আসে তার জন্মভূমি হরিদশ্ব গ্রামে। গ্রামে ফিরে এসে সে দেখে তার পৈতৃক বাড়ি বেদখল হয়ে গেছে। সৌভাগ্যবশত সেই গ্রামের কেউ তার অতীত কথা অর্থাৎ তার বাঈজীবৃত্তির কথা জানত না। নিজের পুরনো জীবনকে পাপের বলেই মনে করত সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে নির্মাণ করেছে একটি মসজিদ হরিদশ্ব গ্রামের প্রথম পাকা মসজিদ। কিন্তু এখানে এমন একটা প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে লেখক গুলনাহার এর নটী পরিচয় মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন সেটা মানবমনের জটিল ভাবনা এবং কুটিলতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ ।কাদের মৌলবী, যার কাছে নিজের পূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরেছিল গুলনাহার, যার কথা শুনেই গুলনাহার মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়, সেই কাদের মৌলবীই এক ভরা জুম্মায় সকলের সামনে গুলনাহার এর সর্বনাশ করে বসে শুধু মাত্র নিজেকে জাহির করার জন্য, নিজের অস্তিত্ব সংকটের মনস্তত্ত্ব থেকে এই কান্ড করে বসে সে। অতঃপর যার টাকায় নির্মিত হল এই মসজিদ, সেই মসজিদ দাঁড়িয়ে গেল তার বিরুদ্ধে সমাজ দাঁড়িয়ে গেল তার বিরুদ্ধে । এত বছর ধরে করার সকল কাজের ইতিহাস ধামাচাপা পড়ে গেল পুরনো এক ইতিহাসে।
এই উপন্যাস জুড়ে পাঠককে যেটা সবথেকে বেশি আক্রষ্ট করবে সেটা হচ্ছে লেখকের লেখার ধরণ। । লেখকের শক্তিশালী লেখনীতে গুলনাহারের উদয়াচল থেকে হরিদশ্বের যাত্রা, হরিদশ্ব গ্রামের খুঁটিনাটি, সুধাবতীর মোহনা সবকিছু যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে পাঠকের সামনে। উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে ইতিহাস, গ্রাম্য রাজনীতি, গ্রামীণ জটিল মানুষের হিংসা-পরশ্রীকাতরতা, মানুষের সরলতা,পুরাণ, গ্রাম্য পরিবেশ, গ্রামীণ মুসলিম সংস্কৃতি, সামাজিক চিত্র সহ আরো অনেক কিছু। উপন্যাসের প্রথমার্ধ খুবই সুন্দর ছিল ,শেষের অংশে একটু তাড়াহুড়ো করে শেষ করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে । সর্বোপরি একটি সুখপাঠ্য বই ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। যদি আরও বড় পরিসরে লেখা হতো তাহলে মনে হয় আরো বেশি তৃপ্তি পেতাম।
গুলনাহার, একজন নটী, রাজনটী যার জীবনের গল্প নিয়ে সাজানো এই উপন্যাস। ছোটবেলায় যেই গ্রামে কেটেছিলো শৈশব, যেখানে তার বাবা গাইতো পালাগান, সেখান থেকেই দুর্ভিক্ষের সময় তার মা তাকে বিক্রি করে দেয় সোবানালির কাছে। সোবানালির কাছ থেকে আবারো বিক্রি হয়ে সাবেরি বাই এর বাইজি কোঠায় গিয়ে সে শেখে গান, নাচ। মহারাজের নটী হয়েও তার জীবনে শান্তি এলো না। নানান ঘটনায় অপমানিত নাহার চলে এলো সেখান থেকে। বুকে আশা, ফিরে যাবে নিজের হরিদশ্ব গ্রামে। উপন্যাসটির চরিত্র, প্লট, গল্পের এগিয়ে চলা, সমাজের নানান অসঙ্গতি, গ্রামের কোন্দল, ধর্ম রাজনীতি, মানুষের মানসিকতা সবকিছুই বইটিতে খুব সুন্দর ভাবে উঠে এসেছে। বইটির প্রথম অংশটিতে লেখক খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন গ্রামের প্রাকৃতিক বর্ণনা, গুলনাহারের শৈশবের অনেক রকম গল্প, সেই সময়কার একটি উৎসব ঘিরে মানুষের উত্তেজনা, আনন্দ অনেক কিছুই এসেছে বইটিতে। পরের দিকে বইটি একটুখানি নিরানন্দ মনে হতে পারে অনেক পাঠকেরই। তবে আমার সব মিলিয়ে ভালো লেগেছে। লেখক এর বই আমি আগেও পড়েছি।তবে উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে লেখকের লেখার স্টাইল খুবই সুন্দর। শুধু মনে হয়েছে বইটিতে ঘটনাগুলো খুব দ্রুত গুলো এগিয়ে গিয়েছে। আরেকটু ধীর স্থির ভাবে একটু বিস্তৃত করে যদি বইটি লেখা হত হয়তো আমার আরো অনেক ভালো লাগতো।
গুলনাহার, হতভাগ্য এক নারী। ক্ষুধার জালায় মা বেঁচে দেয় তাকে নিঃসন্তান সুবানালির কাছে। বছর পাঁচেক পরে সুবানালি বেঁচে দেয় সাবেরি বাই এর কাছে। ধীরে ধীরে গুলনাহার হয়ে ওঠে রাজনটী।
যখন গুলনাহার তার খ্যাতির চরমে তখন রাজার এক অপমানে সব ছেড়ে ছুড়ে নিজের সেই ছেড়ে আসা গ্রামের পানে ছুটে চলে। সমাজের পঙ্কিলতা থেকে উঠে যখন বাঁচতে চায় সাধারণ মানুষ হিসেবে, তখন সমাজ কি তাকে ছেড়ে দেবে?
প্রায় দুশো বছর আগের একটা সময় কে লেখক বেছে নিয়েছেন তার কাহিনীর পটভূমি হিসেবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ধীরে ধীরে জেঁকে বসে উপমহাদেশে। ওরকম একটা সময়কে দারুন ভাবে ফুটিয়ে তোলায় লেখক অনেকটা সফল। অনেকটা বলছি কারণ শেষের দিকে এসে ওই ভাবটা আর ছিল না। তবে প্রথম অর্ধেক পড়ে মনে হচ্ছিল মনে হয় আরেকটা "প্রদোষে প্রাকৃতজন" হতে যাচ্ছে বুঝি।
শেষের দিকে একটু দুর্বল হয়ে না পড়লে উপন্যাসটা ভয়ঙ্কর হতে পারতো। ভয়ঙ্কর না হলেও ভালো হয়নি বললে পাপ হবে নির্ঘাৎ।
গ্রাম, পরগণা, জমিদারি, রাজ পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, মোল্লা, পীর, শরিয়ত, মারফত, জোতদার - সবকিছু অল্পের ভেতরে লেখক ঠেসে দিয়েছন। এমনটাই মনে হলো কোন কোন জায়গায়। আরও বড় পরিধিতে লিখলে চমৎকার হতো। রাজনটী গুলনাহারের নিজস্ব ভুবন, চিন্তাধারা, লড়াই, দ্বন্দ্ব, আরও গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখা যেত। সে রকম স্কোপ ছিল, সম্ভাবনাও। অবশ্য দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় লেখক নিজেই বলেছেন, উপন্যাসের যে জায়গাগুলো তার কাছে ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছে, সে জায়গাগুলো তিনি ইচ্ছে করেই পুনর্লিখন করেন নি। তিনি চেয়েছেন তার উপন্যাস থেকে উপন্যাসে তার লেখার যে বিবর্তন, তা যেন পাঠক নিজেই বিচার করে। সহজ কথা নয়। বইয়ের ভূমিকায় যেখানে আগ্রহ উদ্দীপক কথাই বেশি থাকার কথা, সেখানে এমন স্বীকারোক্তি বিরল। তারপরেও, বেশ ছিমছাম একটা উপন্যাস। ভালো লাগার মতোই।