১৯৭১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে নাজিম মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ সময় সেনানিবাসে পরিণত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বন্দীর জীবন কাটিয়েছেন। রাজশাহী ও ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের বাঙালি দালালদের মাঝে পরিবেষ্টিত সে জীবনের স্মৃতিচারণ এ বইটিতে উঠে এসেছে।
ছোটো বই, এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম। নিজের কাপুরুষতার কথা লিখতে গেলে সাহস লাগে। নাজিম মাহমুদের এই স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি সাহসী ও সরস। হয়তো সব কথা তিনি খুলে বলেননি, কিন্তু যা বলেছেন, তা পাঠককে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট। মুক্তিযুদ্ধ কী অকল্পনীয় স্নায়ুনাশী এক সময়, তা অন্তরীণের চোখ দিয়ে না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক গোলাম মুরশিদের 'যখন পলাতক' বইটি পড়ে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীর চোখ দিয়ে শরণার্থী বুদ্ধিজীবীদের একাত্তরের খানিকটার আঁচ পেয়েছিলাম, নাজিম মাহমুদের এ বইটি পড়ে দেখলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্দী হয়ে পড়া মানুষদের জীবনের এক চিলতে। লেখকের বর্ণনাশৈলী অনবদ্য।
সালটা ১৯৭১, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা নাজিম মাহমুদ সপরিবারে আটকে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় এক মুক্ত ক্যান্টনমেন্ট। আর রাজশাহীর বাঙালি ভিসি ড. সাজ্জাদ হোসায়েন পাকবাহিনীর একনিষ্ঠ খাদেম এবং সহকারী খাদেম হলো অবাঙালি অধ্যাপক, কর্মকর্তারা। রক্ত পিশাচ পাকিস্তানি বাহিনী এবং এদের এদেশীয় এজেন্টদের করতলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। হলগুলো আর্মির ব্যারাক, প্রভোস্টের বাসভবন অফিসারের জলসাঘর এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হলো জল্লাদের আস্তানা। যেখানে হারিয়ে গেছে অসংখ্য বাঙালি। সেই দুঃসময়ে স্মৃতিচারণ করেছেন নাজিম মাহমুদ। মাত্র ৯৬ পাতার বই। অথচ বইয়ের প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা কতটা শক্তিশালী তা হয়তো লেখক নিজেই জানেন না।
সংগ্রামের বছর নিয়ে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে লিখেছেন, লিখবেন। কিন্তু নাজিম মাহমুদের মতো ক'জন পারবেন স্বীকার করতে যে তারা স্রেফ মানুষ হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিমুহূর্তে শির নত করেছেন হানাদারদের সামনে।
আমার পড়া অন্যতম সেরা মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা হতে যাচ্ছে 'যখন ক্রীতদাস:স্মৃতি '৭১'।
অসাধারণ। যুদ্ধকালীন আর্মি ক্যাম্প আর বধ্যভুমিতে পরিণত হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মানুষের দমবন্ধ দিনগুলোর সহজ স্মৃতিচারণ, যেখানে আছে মুজিবর রহমান দেবদাসের মত পাগলাটে সাহসী লোকের গল্প, আছে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারিদের চার ক্যাটাগরিতে লিস্ট বানিয়ে মিলিটারির হাতে তুলে দেয়া তাবেদার ভাইস চ্যান্সেলর, কিন্তু সবথেকে বেশি আছে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব আর গ্লানি। এর মধ্যেই উঠে এসেছে স্বদেশ নিয়ে লেখকের চিন্তা, যা যুদ্ধের তেতাল্লিস বছর আর বই প্রকাশের চব্বিশ বছর পরেও এখনো প্রাসঙ্গিক।
বিপিএল এর এই সংস্করণটি চমৎকার। অনেকদিন পর বাংলাদেশের কোন বই হাতে নিয়েই মন ভরে উঠল।
শৌর্যের কথা সবাই ফলাও করে বলে, গ্লানির কথা অকপটে বলতে পারে কজন? আক্ষরিক অর্থেই এক নিঃশ্বাসে পড়ার মতো একটা বই। একটা ব্যাপারেই শুধু খচখচানি, শেষটা মনে হয় একটু চট করেই হয়ে গেল
প্রাণের ভেতর স্বাধীনতার আকাঙ্খা নিয়ে মিলিটারি অধ্যুষিত এলাকায় আটকে পড়া মানুষেরা যে কী অনিশ্চয়তার মাঝে প্রতিটি দিন পার করেছেন, এখন এতদিন পর স্বাধীন দেশে বসে কল্পনা করাও অসম্ভব।