What do you think?
Rate this book


165 pages, Hardcover
First published August 1, 1964

বেচারী আজাহের! কত মাঠের কঠিন বুক সে লাঙলের আঘাতে ফাড়িয়া চৌচির করিয়াছে—কত দৌড়ের গরুকে সে হেলে-লাঠির আঘাতে বশে আনিয়াছে। কত দেশে-বিদেশে সে পৈড়াত বেচিয়া কত বড় বড় লোকের সঙ্গে কথা কহিয়াছে, কিন্তু যে তাহার সারা জীবনের সঙ্গী হইয়া তাহার ঘর করিতে আসিল, তাহার সঙ্গে কথা কহিতে আজাহেরের সাহসই কুলাইয়া উঠিতেছে না, কি করিয়া সে কথা আরম্ভ করে—কোন্ কথা সে আগে বলে কিছুই তাহার মনে আসিতেছে না।
অনেক বড় হইতে তাহারা চাহে না। মাথা গুঁজিবার মত দু’খানা ঘর, লাঙল চালাইবার মত কয়েক বিঘা জমি আর পেট ভরিয়া আহার ;—এরি স্বপ্ন লইয়া তাহারা কত চিন্তা করে, কত পরামর্শ করে, কত ফন্দি-ফিকির আওড়ায়।
তাহার পরিবারে যেমন তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে তেমনি এই গরু দুইটি। এদের সঙ্গে সে কথা কহিতে পারিত। এই বোবার ভাষাও সে হয়ত কিছু বুঝিতে পারিত। তার সকল সুখের সঙ্গে সকল দুঃখের সঙ্গে সমসুখী সমদুখী হইয়া ইহারা তাহার স্বল্প পরিসর জীবনটিতে জড়াইয়াছিল।
“খোদা তায়ালা জাল্লা জালালুহু পাক পরওয়ারদেগার কোরান শরিফমে ফরমাইছে, ” এই পর্যন্ত বলিতেই গাঁয়ের এক বৃদ্ধ লোক আহা–হা করিয়া কাঁদিয়া উঠিল,
“কিন্তুক মোড়ল সা’ব ! আল্লার দোজগের জ্বালা কি দুনিয়ার দোজগের চায়াও বিষম? আমার পুলা–ম্যায়ারা কুনুদিন বাতের দুঃখু পায় নাই। কাইল তারা যখন বাত বাত কইরা কানবি, আমি খাড়ায়া খাড়ায়া তাই হুনব, আল্লার দোজগে কি ইয়ার চায়াও দুষ্কু?”
পাক ভারতে মুসলিম রাজত্ব শেষ হইবার পর একদল মাওলানা এদেশ হইতে ইংরেজ তাড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। সহায়-সম্পদহীন যুদ্ধ-বিদ্যায় অনভিজ্ঞ সেই মুসলিম দল শুধুমাত্র ধর্মের জোরে সে যুগের ইংরেজ-রাজের অত্যাধুনিক অস্ত্র-সজ্জার সামনে টিকিয়া দাঁড়াইতে পারিল না। খাঁচায় আবদ্ধ সিংহ যেমন লৌহ-প্রাচীর ভাঙিতে না পারিয়া আপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়িয়া খাইতে চাহে, সেইরূপ এই যোদ্ধার দল নানা সংগ্রামে পরাজিত হইয়া হৃত-সর্বস্ব হইয়া ক্ষোভে দুঃখে আপন সমাজ দেহে আক্রমণ চালাইতে লাগিল। স্বাধীন থাকিতে যে মুসলিম সমাজ দেশের চিত্র-কলায় ও সঙ্গীত-কলায় যুগান্তর আনয়ন করিয়াছিল, আজ তাহারাই ঘোষণা করিলেন গান গাওয়া হারাম—বাদ্য বাজানো হারাম, মানুষ ও জীব-জন্তুর ছবি অঙ্কন করা হারাম।
মাস্ষ্টারের নির্দেশ মত রান্না করা হাঁড়ীর পিছনে লাউপাতা ঘসিয়া তাহাতে পানি মিশাইয়া তাহারা কালি তৈরী করিয়াছে। তাহা দোয়াতে ভরিয়া সেই দোয়াতের মুখে রশি বাঁধিয়া হাতে করিয়া ঝুলাইয়া লইয়া তাহারা স্কুলে চলিয়াছে। খাগড়া-বন হইতে লাল রঙের খাগড়া বাছিয়া তাহা দিয়া কলম তৈয়ার করিয়াছে। আর কলা পাতা কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া লইয়াছে। তাহার উপরে মাষ্টার মহাশয় ক, খ প্রভৃতি বর্ণমালা লোহার কাঠি দিয়া লিখিয়া দিবেন। তাহারা উহার উপরে হাত ঘুরাইয়া বর্ণমালা লেখা শিক্ষা করিবে।
আগে হাঁটাপথে স্কুলে যাতায়াত করিতে হইত। তাহাতে স্কুলে পৌঁছিতে তাহাদের এত ঘন্টা লাগিল। এখন ধান খেতের পাশ দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাও দাড়া দিয়া নৌকা চালাইতে হয়। তাই দেড় ঘন্টার আগে তাহারা স্কুলে পৌঁছিতে পারে না। যেদিন বৃষ্টি হয় একজন বসিয়া বুকের তলায় বই-পত্রগুলিকে কোন রকমে বৃষ্টির হাত হইতে রক্ষা করে। কিন্তু তিনজনেই ভিজিয়া কাকের ছাও হইয়া যায়। সেই ভিজা জামা কাপড় শুদ্ধই তাহারা স্কুলে যায়। স্কুলে যাইয়া গায়ের জামা খুলিয়া শুখাইতে দেয়। পরনের ভিজা কাপড় পরনেই থাকে।
“আমাগো গান কেউ পোছেও না। দিনি দিনি বাপু কাল বদলায়া যাইত্যাছে। এহন এসব গান কেউ হুনবার চায় না। ওই যে থিয়েটার না কি কয়, নাচনাআলীরা যে সব গান গায় লোকে হেই রহম গান হুনবার চায়। তা হে গান ত আমার জানা নাই।”
এ যেন মায়ের পিঠা বানানোর নাট্যভিনয় ! মাকে এই পিঠা বানাইতে তাহারা কতবার দেখিয়াছে, দেখিয়া দেখিয়া তবুও তৃপ্তি হয় না। শীতের দিনে মা শেষ রাতে উঠিয়া ভাপা–পিঠা বানায়। ছেলে–মেয়ে দুইটি মায়ের সঙ্গে উঠিয়া কতবার তাকে ভাপা–পিঠা বানাইতে দেখিয়াছে।
দিনে দিনে হায়রে ভাল দিন চইলা যায়। বিহানের শিশির ধারা দুপুরে শুখায়। বারো জঙ্গ করে মর্দ্দ কিতাবে খবর, তের জঙ্গ লেখা যায়রে টঙ্গির শহর।