हिंदी : कृश्न चन्दर Urdu Profile:کرشن چندر Krishan Chander was an Urdu and Hindi writer of short stories and novels. He also worked on English.
He was a prolific writer, penning over 20 novels, 30 collections of short stories and scores of radio plays in Urdu, and later, after partition of the country, took to writing in Hindi as well.
He also wrote screen-plays for Bollywood movies to supplement his meagre income as an author of satirical stories. Krishan Chander's novels (including the classic : Ek Gadhe Ki Sarguzasht, trans. Autobiography of a Donkey) have been translated into over 16 Indian languages and some foreign languages, including English.
His short story "Annadata" (trans: The Giver of Grain – an obsequious appellation used by Indian peasants for their feudal land-owners), was made into the film Dharti Ke Lal (1946) by Khwaja Ahmad Abbas – which led to his being offered work regularly as a screenwriter by Bollywood, including such populist hits as Mamta (1966) and Sharafat (1970). He wrote his film scripts in Urdu
হিউমারের ঠাসা অপূর্ব একখানা বই! ভার্চুয়াল জগতে হালকা চালের মিম হাহা রিয়্যাক্ট আর শেয়ার দিয়ে আমরা সবাই প্রচুর আমোদ পেয়ে থাকি। এই বইয়ের কাছে কোথায় লাগে সেইসব মিম! সমাজের অসংগতি আর হিপোক্রেসি ঠাট্টার ছলে একেবারে চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কৃষণ চন্দর বাবু। উর্দু ভাষার লেখক তিনি। এমন চমৎকার সেন্স অফ হিউমার বাংলা সাহিত্যে পেয়েছিলাম বনফুলের লেখায়। বিবেকের গালে কষে চপেটাঘাত করে একেবারে!
‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ - মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায় সমাজের হতদরিদ্রদের যন্ত্রণার প্রতি স্রষ্টার অবজ্ঞা দেখেই হয়ত উক্তিটি করেছিলেন।
কৃষ্ণ চন্দর "ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ " বইতে ভগবানকে ভদ্রপল্লীর বাইরে বস্তিতে নিয়ে এসেছেন। ভগবান এক পূত পবিত্র বাচ্চা ছেলের সন্ধানে মর্তে আসেন , যাকে কোন পাপ স্পর্শ করেনি। যে সৃষ্টির আদিতে বানানো পূণ্যবান শিশুদের প্রতিনিধি। এই উদ্দেশ্যে ভগবান তার মানব সংগী তথা লেখককে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বোম্বের রাস্তায়। কিন্তু বারবার মানুষের কাছ থেকে ভগবান লাঞ্চনা, আঘাত আর ধোঁকা ছাড়া কিছুই পেল না। নিজের সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টির এহেন অবস্থা দেখে ভগবান যেন নিজেই অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যান। কিন্তু যে ভগবানের উপরই আমরা ভরসা রাখি তার এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়লে কি চলে। তিনি তার খোঁজ চালিয়ে যান আর প্রতিবার মানবসমাজের আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটা আবিষ্কার করেন।
বইটাতে শ্লেষ আর বিদ্রুপের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে কীভাবে আমাদের সমাজ গোড়াতেই পচে যাচ্ছে ।
বেশ মজা পেয়েছি। মুম্বাইয়ের বস্তির এক লোকের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে আসে ভগবান। তার সাথে মুম্বাইয়ের রাস্তায় বের হয় মানুষ দেখার অভিযানে। বিচিত্র সব মানুষের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা হয় ওদের। কিছুটা ডার্ক কমেডি, মুম্বাইয়ের বস্তির জীবনযাত্রা আর সামান্য দর্শন রয়েছে বইটাতে।
ভগবান স্বয়ং মুম্বাই শহরে ল্যান্ড করলেন। মর্ত্যে আগমনের হেতু শিশুদের সাথে পরিচিত হওয়া। ভগবান কিন্তু তার অর্থকরী প্রদান আর মনোবাঞ্ছা পূরণের সুপার পাওয়ার নিয়ে আসেন নি।
ভগবান নিজেও শিশুরূপী হয়ে এক মানুষসঙ্গী জুটিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন শিশুর খোঁজে।
হ্যা,পেলেন বটে। ভগবান প্রেরিত নিষ্পাপ শিশুরা মর্তে মদ বেচে, নারী সাপ্লাই দেয়, দাদাগিরি করে। স্বয়ং শিশুরূপী ভগবান এদের পাল্লায় পড়ে মার খান, হতাশ হন।প্রেমে পড়েন নায়িকার, শুড়িখানায় "নাস্তিক " ভগবানকে মার লাগায় লোকে, আরো কত কি!
দারুণ বই।বিশেষত, শেষটা। আর কৃষণ চন্দরের সেন্স অব হিউমার তো সর্বজনবিদিত।
এর আগে কৃষণ চন্দরের একটা বই ই আমার পড়া ছিল, 'আমি গাধা বলছি'। ভালো তো লেগেছিলোই বটে, আমি তাঁর সেন্স অব হিউমারেরও ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে বইটায় লেখকের বা তার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়নি। এই বইটার (ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ) শুরুতে তার বন্ধু/সহকর্মী/সহমর্মী, খাজা আহমদ আব্বাস এর লেখা 'আমার বন্ধু কৃষণ চন্দর' নামে সুদীর্ঘ ৮ পৃষ্ঠার একটা নিবন্ধ পড়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ! এতো বড় মাপের একজন লেখক অথচ আমি তাঁর কিছুই পড়িনি!
আমার ভাগ্নে যে আমাকে সুযোগ পেলেই বলে, "মামা তুমি অনেক বড় একটা নুউব", আজ নিজেকে আমার তাই ই মনে হচ্ছিলো। ভেবেছিলাম লেখাটার (৮ পৃষ্ঠার ভূমিকার) ৫-৬ লাইনে সারমর্ম লিখবো কিন্তু সেটাতেও আমি অপারগ। একেকটা লাইন কৃষন চন্দর এর এক একটা চরিত্র প্রকাশ করে। তবে আমি একটা জায়গায় কিছুটা স্যাটিস্ফাইড - তা হলো, আমি তাঁর একটা লেখা পড়েই লেখককে যেমনটা কল্পনা করেছিলাম তার অনেকটাই মিলে যাচ্ছিলো খাজা আহমদ আব্বাস এর বর্ণনার সাথে। পাঠক হিসেবে যেটা আমার কাছে একটা এচিভমেন্ট এর থেকে কম কিছু নয় (একটা লজ্জা পাওয়ার ইমোজি হবে)। নাহ! ভাগ্নে যতই বলুক আমি এতোটাও 'নুউব' না।
এবার আসি বইটার কথায়। কৃষণ চন্দরের অন্যান্য বই এর মত 'দাদর পুলকে বাচ্চে' বইটাও হিন্দি, উর্দু আর সোভিয়েট সংস্করণ বের হয়েছিলো। তার দশ বছর পর মোস্তফা হারুন এটি বাংলায় অনুবাদ করার উদ্যোগ নেন, আর উদ্যোগটি যথেষ্ট সফল আমি বলবো। এর থেকে ভালো অনুবাদ আর কি হয় আমার জানা নেই।
এবার আসি বইয়ের ভেতরকার কথায়ঃ- ভাবুন তো! কি করবেন যদি স্বয়ং ঈশ্বর আপনার সামনে চলে আসে? কী কী বলবেন, কী কী দেখাতে চাইবেন, কী কী অভিযোগ করবেন, আর কী কী চাইবেন? এমনই একবার ভগবান/ঈশ্বর নেমে এসেছিলেন বোম্বের বস্তির এক অশিক্ষিত অকম্মার ঘরে। ঘুরে বেড়িয়েছেন তার সাথে, দেখেছেন তার সৃষ্টি কিভাবে আছে এই পৃথিবীতে। এ এক অসাধারণ জার্নি! এক বসায় বললে ভুল হবে, এখন মনে তো হচ্ছে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেছি বইটা! মার্ক মাই ওয়ার্ড, এটা পড়তে ধরে অর্ধেক ফেলে উঠতে পারবেন না আপনি। যেমন কৃষণ চন্দর এর হিউমর, তেমনি মাখনের মতো অনুবাদ। ইদানীং ভগবানের পৃথিবী ভ্রমণ নিয়ে যদিও অনেক সিনেমা-নাটক হয়েছে বলিউড-টলিউডে, তবে এ গল্পটা ইউনিক। আর ১৯৬৮ সালে বা তার আগে এমন কাজ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
"একটা খেয়ালের জন্যেই তো মানুষকে কাঠের সাথে বেঁধে আগুন দিয়ে পোড়ায়, গভীর কবর খনন করে দেহটাকে পুঁতে দেয়, রেশমী দড়ি লাগিয়ে প্রাণবায়ু নির্গত করে, ক্রুশে বিদ্ধ করে মারে। কিন্তু তারপরও খেয়ালের শেষ নেই।" - কৃষাণ চন্দর
একদিন আচমকা গল্পকথকের কাছে স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে নেমে আসে ভগবান। গল্পকথক যারপরনাই বিরক্ত হয়। এমনিতেই এই বোম্বাই শহরে গল্পকথকের একবেলা খাবার জুটাতেই দম ফুরোবার অবস্থা। তার মধ্যে আবার উটকো ঝামেলা হিসেবে এসেছে এই ভগবান। তাও কিনা আবার এমন এক ছেলের সন্ধানে যার মধ্যে ন্যূনত্ব কোন খারাপ কিছুর অস্তিত্ব নেই। এমন ছেলে কি আবার এই পুরা ধরাধামে আছে নাকি বাপু - এমনটাই ভাবতে ভাবতে ক্ষুধা চরমে উঠে গল্পকথকের।
ভগবানকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে তাই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছেলের সন্ধানে। প্রথমেই চলে যায় এক মন্দিরে, যেখানের গাঁজার ধোঁয়া আর গন্ধে ভগবানের বমি চলে আসে। তাই, ঘুরে চলে আসে এক পুলের গোড়ায়। বেশভূষ��� বদলে দুজনে শিশুর রূপ নেয় অর্থ উপার্জনের আশায়। একজনের টুকরিতে জামরুল আর অন্যজনের কাছে বাচ্চাদের বই। কিন্তু বিক্রি যে করবে তার জন্যে তো লাইন ধরে বসতে হবে? সেই লাইন ধরে বসতে গেলেও টাকা দিতে হয় জায়গার ইজারা হিসেবে। ভগবানের দুনিয়ায় এমন অন্যায় কাজ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে স্বয়ং ভগবানেরই নাক-মুখই থেঁতলে দেয় এলাকার দাদা। এভাবেই গল্প এগিয়ে চলে ভগবানের দুনিয়ায় ভগবানকেই নাস্তানাবুদ হতে দেখে।
"অন্তঃকরণ বা হৃদয় বলতে ভগবানের কিছু নেই। এমনকি দেবতাদেরও হৃদয় দেয়া হয়নি। হৃদয় কেবল মানব জাতিকে দেয়া হয়েছে। কেননা, মানুষ জাতের পক্ষেই পাপাচার করা সম্ভব।" - কৃষাণ চন্দর
১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে রাজস্থানের ভরতপুরে কৃষাণ চন্দরের জন্ম। যদিও তাদের পরিবারের গোড়াপত্তন হয়েছিল পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে। পাকিস্তান থেকে চলে আসার পর থেকে হিন্দীতেই লেখালেখি করেছেন আমৃত্যু। ২০ টি উপন্যাস এবং ৩০ টি ছোটগল্পের সংকলনের রচয়িতা কৃষাণ চন্দরের মৃত্যুকালীন বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।
কৃষাণ চন্দরের এই গল্পটি অনুবাদ করেছেন মোস্তফা হারুণ উত্তরণ প্রকাশনীর ব্যানারে। অনুবাদ যথেষ্ট প্রাঞ্জল আর সাবলীল। তবে হ্যাঁ কিছু কিছু জায়গা খানিকটা অকাট্য বলে মনে হয়েছে আর কি। তবে সত্যিই অনুবাদ প্রশংসার দাবীদার। বেশ ভালোই সাবলীল ছিল যার জন্যে এক বসাতেই পড়া সম্ভব হয়েছে।
"কখনো কখনো পাপী লোকেদেরকেও এক আধবার স্বর্গে জায়গা দেয়া উচিত। পক্ষান্তরে, ভাল লোকেদেরকেও নরকের শাস্তি ভোগ করতে দিও। প্রত্যেক লোকেরই এটা জানা উচিত - সে কি হারিয়েছে। যে পাপে ক্ষমা নেই এবং যে পুণ্যে বেদনা নেই, তার মাহাত্ম্য কোথায়?" - কৃষাণ চন্দর
ভগবানের সাহায্য নিয়ে কৃষাণ চন্দর তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অদেখা রূপ চিত্রিত করেছেন এই গল্পে। গল্পটা হাস্যরস সমৃদ্ধ হলেও কৃষাণ চন্দরের চিন্তাধারা তার লেখার ধারের তীর্যকতা টের পাবেন ক্ষণে ক্ষণে। কৃষাণ চন্দর যে কতটা মজার ছলে বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তৎকালীনই নয় বরং এখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটেও এই গল্প দারুণ প্রতীকী। ভগবানের এই দুনিয়ায় রাজত্ব করে মানবেরা। সেই রাজ্যে স্বয়ং ভগবানও যেন অসহায়, নিরীহ আর দুস্থদের কাতারে। এই রাজ্যে টিকতে হলে লাগে তোষামোদ আর অর্থকড়ি। নয়তো এই রাজ্যে স্বয়ং ভগবানও লাথি খেয়ে ভাগাড়ে পড়ে থাকবার জোগাড়।
সত্যিকার অর্থেই যদি ধরণীর বুকে ভগবান নেমে আসে তবে তার বান্দাদের অত্যাচার দেখে মূর্ছা যাবারই কথা। এমনই দারুণ একটা স্যাটায়ার ধর্মী গল্প হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে কিচ্ছুক্ষণ। ভগবানের নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনাগুলো আপনাকে একই সঙ্গে হাসাবে আর ভাবনার গভীরে হারিয়ে যেতে সাহায্যও করবে। যারা মৌলিক সাহিত্য পড়তে ভালোবাসেন তাদের জন্য মাস্ট রিড একটা বই হবে এটা।
আরো কিছু ভালো লাগা উক্তি: "চোখের জলে যদি এই সমাজ বদলে যেতো পারতো তাহলে প্রতি ভোরে শিশিরের অশ্রু দুর্বা ঘাসে ঘুমিয়ে থাকতো না।" - কৃষাণ চন্দর
"এই জগতের কেউ ভগবানকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে না। তাতে কিছু না কিছু স্বার্থ থাকেই। যার যে বস্তুর অভাব, সেটুকু পাবার জন্যে তোমার কাছে ধর্ণা দেয়। আর যার সবকিছুই আছে সে নিজের জন্য এই জগতেই স্বর্গ তৈরি করে আর পরকালে নিজের জায়গা নেয়ার জন্য ভগবানের কাছে আসে। লক্ষ লক্ষ টাকা কালোবাজারি করে একটা মসজিদ বা মন্দির বানিয়ে ভগবানকে খুশী করা ঘুষ নয় তো কি? এরা ভগবানের পূজা করে না, নিজেদের ইপ্সিত বস্তুর পূজা করে। নিজেদের ভয়ের পূজা করে।" - কৃষাণ চন্দর
কৃৃষণ চন্দরের বিখ্যাত উপন্যাস "দাদর পুলকে বাচ্চে" বা "ভগবানের সাথে কিছুক্ষন" ! ভগবান নেমে এসেছেন মুম্বাই এর এক বস্তিতে এক দরিদ্র ব্যাক্তির বাসায়,কিছুদিন মর্ত্যের শিশু দেখবেন বলে । তার চোখে মুম্বাই , বস্তি , মানুষ এসব ..... বেশ সুন্দর বই , হিউমার এর সাথে সারকাজম মিলিয়ে .... বেশ ! :)
'ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ - পদ্মা নদীর মাঝি
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঐতিহাসিক উপন্যাস হচ্ছে "পদ্মা নদীর মাঝি"। বইটি লিখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এক প্রকার ইতিহাস সৃষ্টি করে গিয়েছেন। উপরের উক্তিটি এই উপন্যাস থেকে নেয়া। মুলত ঈশ্বরের অবজ্ঞা বা দরিদ্রদের অসহায়ত্বে ঈশ্বরের নিরব অবস্থানকে নির্দেশ করে এই উক্তি করা হয়েছে। ঈশ্বরের কাছে ধনী গরিব যদি সমান হতো তবে গরিব কেন অসহায়ের মত জীবন পার করে যাবে৷ এটাই মুলত বলা হয়েছে৷ তবে আজকে ঈশ্বরের অবস্থান বা তিনি আছেন এসব নিয়ে আলোচনা করব না। আজকের আলোচনা অন্য একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে, যদি ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ, এই মর্ত্যে মানে পৃথিবীতে আসেন কিছু সময়ের জন্য তখন কেমন হবে বিষয়টি।
প্রথমত বলে নিচ্ছি, এখানে ধর্মীয় আলোচনা বা ধর্ম কে ছোট করে কিছু বলা হচ্ছে না। তাই একটু সহনশীলতা আশা করছি। হঠাৎ করেই এক দিন ঈশ্বর পৃথিবীতে আসলেন৷ তার আসার একটি কারণ রয়েছে৷ সেই কারণ হচ্ছে পবিত্র-পুন্য একটি শিশু খুজে বের করা।
ঈশ্বর এসেই সামনে পেয়েছেন আমাদের গল্পের কথককে। এমনিতেই এই বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে গল্পকথকের একবেলা খাবার জুটাতেই দম ফুরোবার অবস্থা। তার মধ্যে আবার উটকো ঝামেলা হিসেবে এসেছে এই ঈশ্বর বা ভগবান। তাও কিনা আবার এমন এক ছেলের সন্ধানে যার মধ্যে ন্যূনতম কোন খারাপ কিছুর অস্তিত্ব নেই। যার মধ্যে অন্ধকার নেই। যার ভেতর সাদা শুভ্র এবং স্বচ্ছ। সততা ও সত্যের প্রতিক যে, তাকেই খুজে বের করতে হবে। এসব শুনতে শুনতে আমাদের গল্পকথক কিছুটা বিরক্ত, কারণ ক্ষুধা তার পেটে চরম এই সময়ে এসব তার ভাল লাগছে না।
ক্ষুধা থাকলেও আমাদের কথকের মাঝে মায়া অনেক বেশি। তাই ভগবান কে সাহায্যের জন্য সে বেরিয়ে পরে ভগবানকে নিয়ে পবিত্র শিশুর খোজে। প্রথমেই তারা চলে যায় এক মন্দিরে, সেখানে গিয়ে ভগবান নিজের আরতি দেখতে গিয়ে দেখে গাজ ও ধোয়ার গন্ধ, বমি চলে আসে তার। এরপর তারা চলে যায় এক পুল বা ব্রিজে, সেখানে ছোট ফুটপাতে দোকান বসাতে চায় তারা। জামরুল ও বই বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। কারণ সেখানে বসতে হলে টাকা দিতে হবে, স্বাধীন দেশে টাকা দিতে হবে এই কথা বলার পর ভগবান ও কথকের উপর কিল ঘুষির বন্যা বয়ে চলে।
এভাবেই পৃথিবীতে ভগবান বা ঈশ্চরের খোজ যাত্রা শুরু হয়। তিনি কি শেষ পর্যন্ত তার খোজ শেষ করতে পেরেছিলেন। তিনি কি পেয়েছিলেন সেই শ্বেত শুভ্র সাদা স্বচ্ছ সৎ পবিত্র শিশু? আজ আলোচনা করছি বিখ্যাত ঐতিহাসিক কৃষণ চন্দর এর লেখা "দাদর পুলকে বাচ্চে" এর অনুবাদ "ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ"। বইটি অনুবাদ করেছেন মোস্তফা হারুণ। "একটা খেয়ালের জন্যেই তো মানুষকে কাঠের সাথে বেঁধে আগুন দিয়ে পোড়ায়, গভীর কবর খনন করে দেহটাকে পুঁতে দেয়, রেশমী দড়ি লাগিয়ে প্রাণবায়ু নির্গত করে, ক্রুশে বিদ্ধ করে মারে। কিন্তু তারপরও খেয়ালের শেষ নেই।"
মৃত্যু হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় সত্য। কিন্তু এই সত্য সবাই যেন এড়িয়ে চলে। মৃত্যুর পর কিছু আছে বলে মনে হয় না। সবার কাছেই এই জীবন ই শেষ ও শুরু। যে যেভাবেই দেখুক মৃত্যু কিন্তু সত্য। কেউ পুরিয়ে, কেউ কবরে কেউ বা ক্রুশে অথবা রেশমী দড়িতে, ���ব জায়গার সত্য হচ্ছে মৃত্যু। এই মৃত্যু মানুষের অমোঘ সত্য, এড়াবার কোন সুযোগ নেই।
"কখনো কখনো পাপী লোকেদেরকেও এক আধবার স্বর্গে জায়গা দেয়া উচিত। পক্ষান্তরে, ভাল লোকেদেরকেও নরকের শাস্তি ভোগ করতে দিও। প্রত্যেক লোকেরই এটা জানা উচিত - সে কি হারিয়েছে। যে পাপে ক্ষমা নেই এবং যে পুণ্যে বেদনা নেই, তার মাহাত্ম্য কোথায়?"
আসলে এই বইটিতে কৃষণ চন্দর ততকালীন সমাজ ব্যবস্থার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে যুগে যুগে বইটি সকল সমাজ ব্যবস্থার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। কারণ যুগের পরিবর্তন হলেও সমাজের কোন পরিবর্তন হয়নি। সমাজ ���কই জায়গাতে রয়েছে।
গল্পটা হাস্যরস সমৃদ্ধ হলেও কৃষাণ চন্দরের চিন্তাধারা তার লেখার ধারের তীর্যকতা টের পাবেন ক্ষণে ক্ষণে। কৃষাণ চন্দর যে কতটা মজার ছলে বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তৎকালীনই নয় বরং এখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটেও এই গল্প দারুণ প্রতীকী। ভগবানের এই দুনিয়ায় রাজত্ব করে মানুষেরা। সেই রাজ্যে স্বয়ং ভগবানও যেন অসহায়, নিরীহ আর দুস্থদের কাতারে। এই রাজ্যে টিকতে হলে লাগে তোষামোদ আর অর্থকড়ি। নয়তো এই রাজ্যে স্বয়ং ভগবানও লাথি খেয়ে ভাগাড়ে পড়ে থাকবার জোগাড়।
মজার হলে হলেও বাস্তবতা যেন আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন কৃষণ চন্দর। সত্যি যদি কোন দিন ভগবান চলেই আসেন তবে তিনি মুর্ছা যাবেন এটা নিশ্চিত। মানুষ মানুষের সাথেই যে আচরণ করে থাকে তাতে ভগবানও ছাড় পাবেন না এটা নিশ্চিত। গল্পের এক জায়গাতে নয় কয়েক জায়গাতেই ভগবানকে লেখক যেভাবে নাস্তানাবুদ করেছেন তাতে ভগবান নিজেই বলেছেন, "এরা তো ভগবান কে মানুষ বানিয়ে ছেড়ে দেবে"।
"এই জগতের কেউ ভগবানকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে না। তাতে কিছু না কিছু স্বার্থ থাকেই। যার যে বস্তুর অভাব, সেটুকু পাবার জন্যে তোমার কাছে ধর্ণা দেয়। আর যার সবকিছুই আছে সে নিজের জন্য এই জগতেই স্বর্গ তৈরি করে আর পরকালে নিজের জায়গা নেয়ার জন্য ভগবানের কাছে আসে। লক্ষ লক্ষ টাকা কালোবাজারি করে একটা মসজিদ বা মন্দির বানিয়ে ভগবানকে খুশী করা ঘুষ নয় তো কি? এরা ভগবানের পূজা করে না, নিজেদের ইপ্সিত বস্তুর পূজা করে। নিজেদের ভয়ের পূজা করে।"
হ্যা, এটাই সত্য। ভগবান, ঈশ্বর বা আল্লাহ সবাই কিন্তু তার স্বার্থের জন্য ধর্ণা দেয়। সবার স্বার্থ উদ্ধার হলেই আবার কেটে পরে। এভাবেই জীবনচক্র আবর্তিত হয়।
যুগে যুগে মানুষ আছে, থাকবে। ভগবান, ঈশ্বর বা আল্লাহ আছেন থাকবেন। তবে মানুষের মানবিকতা, মনুষত্ত্ব, মায়া, মমতা, আবেগ, অনুভূতি গুলো যেন আরও মানবিক হয় মানুষের জন্য মানুষ হয় সেটাই দেখার বিষয়।
"লোকেরা বলাবলি করছিল, এ সব মিথ্যে। না ভগবান কোনদিন আমার কাছে এসেছিল, না আমি তাকে কোনদিন দেখেছি ।বোম্বের অলিগলিতে আমাকে নিয়ে যে ঘুরে বেড়িয়েছে, সে ভগবান নয়।এসবই আজগুবি বানোয়াট কাহিনী ।আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনামাত্র।অবশ্য জবাবে আমি কোন কিছু হলফ করে বলতে পারিনে ।তবে এটুকু আপনাদের খেদমতে নিবেদন করে বলতে পারি, আসলে আমি ভগবানকে দেখেছি ।সত্যিই দেখেছি, সম্ভবত আপনিও তাকে দেখে থাকবেন, কিন্তু চিনতে পারেননি ।"
বই-ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ লেখক -কৃষণ চন্দর অনুবাদক -মোস্তাফা হারুণ প্রকাশনা -উত্তরণ
●লেখকের এই বিখ্যাত উপন্যাসের মূল নাম ছিল 'দাদর পুলকে বাচ্চে'।
উপন্যাসের মূল চরিত্র এক যুবকের ।সে দাদর পুলের উপকণ্ঠের এক অন্ধকার ঝুপড়িতে অনাহারে দিন কাটাত ।তার কাছে ভগবান আসে পৃথিবীর শিশুদের দেখার জন্য ।তারা দুজন বোম্বে শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থানে ঘুরে বেড়ায় শিশুদের অবস্থা দেখার জন্য ।কিন্তু শহরের শিশুরা জীবন সংগ্রামের টিকে থাকার লড়াইয়ে সদা ব্যস্ত ।তারা ক্ষুধা নিবারণের জন্য সকল প্রকার হীন ও জঘন্যতম কাজগুলোকে বেছে নিয়েছে ।ভগবান ও যুবকটিকে বিভিন্ন বয়সের ছদ্মবেশে ক্ষুধার জ্বালা মেটাবার জন্য বিভিন্ন কাজ করতে দেখা যায় ।এসব কাজ করতে কখনো কখনো তাদের কিল-ঘুষিও খেতে হয়।শেষে তারা ভিক্ষুকদলের হাতে পড়ে যায় ।পরিণতি হিসেবে ভগবানের দুচোখ অন্ধ করে দেওয়া হয় ভিক্ষা করানোর জন্য ।
ভালোলাগা ••• □নিজেরা প্রাণ দিতে পার না।অবশ্য ভগবানের নামে অন্যের প্রাণ সংহার করতে পার। □কিন্তু চোখের জলে যদি এই সমাজ বদলে যেতে পারতো তাহলে প্রতি ভোরে শিশিরের অশ্রু দুর্বা ঘাসে ঘুমিয়ে থাকতো না। □একটি শবদেহের চাইতে রহস্যজনক বস্তু এ ধরাধামে নাই। □অন্তঃকরণ বা হৃদয় বলে তো আমার কিছু নেই।আমি এমন কি দেবতাদেরকেও হৃদয় দিইনি ।হৃদয় শুধু আমি মানব জাতিকে দিয়েছি ।কারণ মানুষ জাতের পক্ষে পাপাচার করা সম্ভব ।
কৃষণ চন্দরের বই মানেই ব্যঙ্গাত্মক লেখার মাধ্যমে সমাজের নানান অসঙ্গতি চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেখিয়ে দেওয়া৷ তাঁর বইগুলোর কলেবর ছোট হওয়ার কারণে এক বসায় পড়ে শেষ করা যায়। কিন্তু এই অল্প কলেবরের মধ্যেই সমাজে বিদ্যমান প্রত্যেকটা বৈষম্যকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেন তিনি।
তেমনই একটা বই হলো 'ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ'। এই বইটা একদিকে যেমন সুখপাঠ্য তেমনি অপরদিকে পাঠকের চিন্তাভাবনার দিকে কয়েকটা প্রশ্নও ছুড়ে দেয়। . . বইয়ের কাহিনী নিয়ে যদি বলি, ভগবান স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে এসেছেন মুম্বাই ঘুরে দেখার জন্য। উদ্দেশ্য মুম্বাই শহরের নিষ্পাপ শিশুদের সাথে পরিচিত হওয়া। যেহেতু শিশুদের সাথে পরিচিত হতে বেশি কিছুর দরকার পরে না, তাই তিনি সাথে করে তেমন একটা টাকা-পয়সাও আনেননি, আবার নিজের যা শক্তি ছিল, সব স্বর্গলোকেই ফেলে এসেছেন। মর্ত্যে এসেই ভগবানের সাথে আমাদের কথকের দেখা। ভগবান এমন বিনা নোটিশে মর্ত্যে চলে আসায় কথক যারপরনাই বিরক্ত। এমনিই মুম্বাই শহরে পা ফেলা যায় না, তার উপর আবার কোত্থেকে এই উটকো ঝামেলা চলে আসলো! কিন্তু ভগবানের অনুরোধ কি আর ফেলে দেওয়া যায়? তো আর কী করার, ভগবান আর তার মানব বন্ধু, দুইজন মিলে দুই শিশুর রূপ নিয়ে মুম্বাই ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
দুনিয়ার কূটকাচালির সাথে অনভ্যস্ত ভগবান এখানে এসে বেশ বিপাকেই পড়লেন৷ যাকেই ভালো মনে করছেন, কিছুক্ষণ পর সেই তাঁকে ঠকিয়ে যাচ্ছে, লাঞ্চিত করে যাচ্ছে। কোথায় নিষ্পাপ কিছু শিশু দেখার জন্য এসেছিলেন, কিন্তু এসে দেখলেন এখানকার শিশুরা চাঁদাবাজি করে, মদ সাপ্লাই দেয়, আবার কাউকে খুন করতেও পিছপা হয় না৷
এইজন্যই বোধহয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।" . . মুম্বাই শহর ঘুরে ঘুরে ভগবান সমাজের যেই দৈন্যদশা ও বিভিন্ন অসংগতি দেখলেন, তা শুধু তৎকালীনই নয় বরং এখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটেও এই গল্প দারুণ প্রতীকী। যুগের পরিবর্তন হলেও সমাজের কোন পরিবর্তন হয়নি। সমাজ একই জায়গাতে রয়েছে। নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির এমন শোচনীয় অবস্থা দেখে ভগবান নিজেই অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যান।
গল্পটায় ডার্ক কমেডি প্রকট, একটু পর পর কথকের মাধ্যমে কৃষণ চন্দর ভগবানের দিকে নিজের তীর্যক মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিলেন। বইটাতে শ্লেষ ���র বিদ্রুপের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে দুনিয়ার এমনই বেহাল দশা যে ভগবানকেও মানুষের লাথি খেতে হয়। এখানে টিকতে হলে ভগবানের করুণা নয়, প্রয়োজন অর্থকড়ি আর চাটুকারিতা। ভগবানের নাকানিচুবানি খাওয়ার ঘটনাগুলো আপনাকে একই সঙ্গে হাসাবে আর ভাবনার গভীরেও নিয়ে যাবে।
বইয়ের একটা প্যারা একদম মনে দাগ কাটার মতো, "এই জগতের কেউ ভগবানকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে না। তাতে কিছু না কিছু স্বার্থ থাকেই। যার যে বস্তুর অভাব, সেটুকু পাবার জন্যে তোমার কাছে ধর্ণা দেয়। আর যার সবকিছুই আছে সে নিজের জন্য এই জগতেই স্বর্গ তৈরি করে আর পরকালে নিজের জায়গা নেয়ার জন্য ভগবানের কাছে আসে। লক্ষ লক্ষ টাকা কালোবাজারি করে একটা মসজিদ বা মন্দির বানিয়ে ভগবানকে খুশী করা ঘুষ নয় তো কি? এরা ভগবানের পূজা করে না, নিজেদের ইপ্সিত বস্তুর পূজা করে। নিজেদের ভয়ের পূজা করে।"
দুঃখজনক হলেও, এইটাই সত্যি৷ সৃষ্টিকর্তার কাছে আমরা কেবল প্রয়োজনের সময়ই ধর্ণা দিই৷ স্বার্থ উদ্ধার হলেই আমরা আবার কেটে পড়ি।
কিন্তু ভগবান যেই উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে এসেছিলেন, একটা শ্বেত শুভ্র পবিত্র শিশুর খোঁজে, তা কি শেষ পর্যন্ত পেয়েছিলেন?
বোম্বের উদ্দাম, দ্রুতলয়ের জীবন বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে যখন স্বয়ং ভগবান নেমে আসেন কথকের কুঁড়েঘরে। উদ্দেশ্য, শহরের শিশুদের পরিদর্শন। কোমলমতি শিশুদের কাছে তিনি আশা করেছিলেন স্বভাবসুলভ ছোঁয়াচে ভালবাসা। কিন্তু, খোদ ভগবানও বুঝে গেলেন জীবনের নির্মম দুর্বিষহতা ঐশ্বরিক শুভ্রতাকেও ছাপিয়ে যায়। ক্ষুধায় জর্জরিত পথশিশুটির কাছে দু মুঠো অন্নদাতা ভগবানের চেয়েও বড়। হোক না সে পেশাদার খুনে, মাদক ব্যবসায়ী কিংবা বেশ্যার দালাল। মাথার ওপরে নগ্ন রাতের আকাশ, পেটেতে ক্ষুধা আর ঘরেতে অভাব, এসব সমীকরণের উত্তর মেলাতে অপর পাশে প্রয়োজন অর্থের। তা সে যেকোনো মূল্যেই হোক, নিষ্পাপ দেবদূতের মত চেহারার আড়ালে মদের ব্যবসা করে কিংবা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিকলাঙ্গতা বেছে নিয়ে ভিক্ষে করে।
কৃষণ চন্দরের এই উপন্যাসে উঠে আসে ধ্বংসপ্রায় সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতা, ধর্মের নামে সৃষ্টিকর্তার প্রতিকৃতিকে পুঁজি করে চলে আসা ব্যবসা আর মানুষের প্রতি মানুষের কারণবিহীন বিদ্বেষ, ক্ষোভ আর ঘৃণা। ভগবান চরিত্রের প্রশ্নে বিদ্ধ হয় মানবজীবনের নানাবিধ তাৎপর্যবাহী আঙ্গিক। আমরা কী আদৌ নিঃস্বার্থভাবে সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে পারি নাকি সবকিছুই লেনদেনসাপেক্ষ? মনোহরের ওপেন টু ক্লোজ লটারি নাহোক দিনশেষে নটাকা ফেরত নচেৎ এক টাকা গচ্চায় সুরাহা হয়। এই দীর্ঘ জীবনের ওপেন টু ক্লোজে আমরা আদৌ কি কিছু পাই? নাকি বরং কিছু হারাই? এসব প্রশ্নের আদৌ কোনো উত্তর মেলে কি?
উত্তর না মিললেও মেলে লেখকের কৈফিয়ৎ, "তোমার মত সংবেদনশীল, উদার আর নিষ্পাপ মন আর দেখিনি। কিন্তু চোখের জলে যদি এই সমাজ বদলে যেতে পারতো তাহলে প্রতি ভোরে শিশিরের অশ্রু দুর্বা ঘাসে ঘুমিয়ে থাকতো না।"
অদ্ভুত এই উপাখ্যানকে নিদারুণ দক্ষতার সাথে উপস্থাপনের জন্য লেখকের তারিফ করতেই হয়। সহজ সরল ঘটনাপ্রবাহকে ঠাস বুনন শব্দের জালে গড়ে তুলেছেন। ছোট ছোট বাক্য, সাবলীল শব্দচয়ন এবং আকর্ষণীয় লেখনশৈলী, স্বচ্ছন্দভাবে পাতার পর পাতা উলটে পড়ে যাওয়া যায়, এমন। লেখক বর্ণনার ক্ষেত্রে একটু বেশিই আঁটসাঁট, মূল ঘটনা তুলে ধরাতেই তার আগ্রহ বেশি। পরিশেষে, উপন্যাসটি সুখপাঠ্য, পড়ে চিন্তাভাবনার খোরাক পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
জিম ক্যারি অভিনীত ‘ব্রুস অলমাইটি’ কিংবা সালমানের করা ‘গড তুসি গ্রেট হো’— চমৎকার একটি কাহিনী। সেইখানে তাদেরকে গড, একদিনের জন্য গড বানাইয়া দেয়। তবে, তারও অনেককাল আগে লেখা কৃষণ চন্দরের এই বইয়ে গড আসে ব্যস্ততম শহর বোম্বেতে। ঘুরতে আসে। মানুষ দেখতে আসে। লেখকের সাথে সময় কাঁটায়। লেখক গল্পে অনাথ ছিল আরকি। সেই হিসেবে এক অনাথের সাথে এসে দেখা করে। থাকে।
ছেলেটা তারে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। বিভিন্ন এডভেঞ্চার করে।
মারাত্মক হিউমারে ঠাসা একখানা বই৷ পড়ে বেশ মজা যেমন পাওয়া গেছে তেমনি এই সমাজের রোজকার অসংগতি উঠে এসেছে। উঠে এসেছে মানুষের ভেতরকার জমানো কথাবার্তা।
যারা স্যাটায়ার পছন্দ করেন, তাদের জন্য মাস্ট রিড। হ্যাপি রিডিং।
লোকেদের কাছে তুমি একজন আই.সি.এস বা মিনিস্টারের চাইতে বেশী কিছু নও। এরা তোমাকে পূজা করে থোড়াই, তারা নিজেদের ঈপ্সিত বস্তুর পূজা করে। নিজেদের ভয়ের পূজা করে।
অনেক দিন পর "কৃষণ চন্দর" পড়লাম। পুরনো মুগ্ধতা আরেক বার ছুঁয়ে গেল। ভাবি, এমন কঠিন, নির্জলা সত্য বলে যাওয়ার সাহস হয় ক'জনের? কৃষণ চন্দর পারতেন,তাঁর প্রতিটি লেখা এমন ক্ষুরধার, এতটা বাস্তব ঘেঁষা টানা পড়তে বেগ পেতে হয়। প্রতিটা বাক্য,প্রতিটা কথা ভাবনার দুয়ারে কষাঘাত করে!
দুনিয়া আসলে এমনই,যেমনটা কৃষণ দেখিয়েছেন তাঁর প্রতিটি শব্দে, অক্ষরে...
এক বসায় পড়ে ফেলার মতন বই। কৃষণ চন্দর বরাবরই চমকপ্রদ, আর এই বইটিতে সারকাজম, ডার্ক হিউমার যা প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতারই কৌতুক সব কেমন জলের মতো সহজ করে বলে দিলেন লেখক! সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, আজ থেকে কমপক্ষে ৫০ বছর আগে লেখা হলেও, এখনো যদি ভগবান মর্ত্যে নেমে আসেন ঠিক এই এক্সপেরিয়েন্সটাই তাকে পেতে হবে।
কৃষাণ চন্দর এর প্রথম লেখা পড়ি "পেশোয়ার এক্সপ্রেস"। হতবম্ব হয়ে পড়েছিলাম শেষ করে। হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা উভয় দিক থেকে এমন করুন ভাবে মনে হয় আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। এরপর পড়ি "আমি গাধা বলছি"। দুর্দান্ত হিউমার ভরা দারুন একটা স্যাটায়ার। প্রথম লেখায় কাঁদিয়েছে, পরেরটায় হাসিয়ে মেরেছে।
কৃষাণ চন্দর এর "দাদর পুলকে বাচ্চে" বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন মোস্তফা হারুন "ভগবানের সাথে কিছুক্ষন" নামে। অন্তরজালের কল্যানে হাতে এসে গেল, বিনা দ্বিধায় পড়া শুরু। আবার হিউমার, স্যারকাজম। ভগবান কে মর্তে নামিয়ে এনে নাকানি চুবানি খাইয়ে ছেড়েছে একেবারে।
কাহিনী সংক্ষেপ অনেকটা এমন- ভগবান মুম্বাইতে এসেছে মনুষ্য বেশে মর্ত্যলোকের শিশুদের হাল হাকিকত নিজের চোখে দেখবেন বলে। দেখছেন আর অসহায় হয়ে পড়ছেন। দারিদ্র আর অপরাধ শিশুদের যে মর্ত্যলোকেই নরকের স্বাদ পাইয়ে দিচ্ছে। দেখতে পান বিনা স্বার্থে এই পোড়া পৃথিবীতে কেউ কারও জন্য কিছু করেনা, এমনকি ভগবানের প্রার্থনাও না। উপন্যাসের শেষে শিশুর অবয়ব ধারন করা ভগবানের চোখ তুলে তাকে ভিক্ষা করতে বসিয়ে দিতেও ছাড়েননি লেখক।
মানব সভ্যতার বর্তমান পরিনতি নিয়ে বিদ্রুপ, ব্যাঙ্গ ও হাস্যরসাত্বক বাস্তবতা খুবই সুন্দরভাবে উপস্থাপিত। ঈশ্বর যদি কখনো রসাতলে গমন হেতু এই মর্তলোকে আসেন, তবে এই বইটিতে বর্ণিত নির্মমতা ছাড়া আশাজনক কোন কিছু পাবেন বলে মনে হয় না। একসময়ের ভীত পুজারীর আতংকিত উপাসনার উপাস্য এখন স্বার্থবাদীদের হাতের খেলনায় পরিনত হয়ে গেছেন।
দূর্দান্ত ব্যঙ্গরচনা। মুম্বাই শহরে ভগবানের পরিক্রমার প্রতিটি মুহূর্তে সমাজের দৈন্যদশা, বিভিন্ন অসংগতি হাস্যরসের সাথে সফলভাবে তুলে ধরেছেন। ভক্তরা কোন স্বার্থ ছাড়া ভগবানের গান গায়না, চুরি-বাটপারী, খন খারাপী, দুর্নীতি,পাপাচারে জীর্ণ পৃথিবী। স্বয়ং ভগবানকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। এসব দেখে ভগবানের হতাশা হাহাকার প্রকারান্তরে যেন আমাদেরই দীর্ঘশ্বাস। সে পরিপূর্ণ মানুষটির খোজ ভগবান কখনোই পাননি।
পুরো বইয়ের আসল অংশ শেষ কটি লাইনে। আহা! কী সুন্দর করে কৃষাণ চন্দর একদম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন—আমরা এই নরকের পৃথিবীতে ভগবানকেও বেচতে পারি, যেভাবে বেচি ছোট্ট শিশুদের। শেষ লাইনটুকুর জন্যই রেটিং ৪ কিংবা ৫ ও দেওয়া যায়। শেষ লাইনের আগ পর্যন্ত রেটিং ২ থেকে ৩ ছিল।
This entire review has been hidden because of spoilers.