পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরী-কালাবদর এবং শত জলধারায় বহমান অজস্র নদী, খালবিল, অফুরান শস্যক্ষেত্র, নানা বর্ণময় পাখি-ফুল- বৃক্ষলতা—এই সব মিলিয়ে সেদিনের পূর্ববাংলা ছিল নিসর্গের এক মায়াময় ভূখন্ড। বাতাসে বাতাসে তখন জারি-সারি-ভাটিয়ালির সুর। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তখন বড়ই মধুর, আবিলতায় ভরে যায় নি। হিন্দু-মুসলমান, দুই সম্প্রদায় ছিল পরস্পরের পাশাপাশি। তাদের মধ্যে অনেক সময় মতান্তরও নিশ্চয়ই ঘটেছে, মনান্তরও। কিন্তু ছিল না তীব্র বিদ্বেষ। এই পটভূমিতে বিনু নামে এক বালকের বড় হয়ে ওঠা। আবহমান কালের শান্তস্নিগ্ধ রমণীয় পূর্ববাংলা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকেই উত্তাল হয়ে উঠতে শুরু করে। এদেশে যুদ্ধ হয় নি; কিন্তু আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সৈন্যে ছেয়ে গেল চারিদিক। তাদের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ল নানা ধরনের বিষ। এল কালোবাজারি, মজুতদারি, মানুষের তৈরি কৃত্রিম খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, মূল্যবোধের চরম বিনাশ, লক্ষ লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যু। যুদ্ধশেষে ইংরেজরা দু'শো বছরের ভারতীয় উপনিবেশ ছেড়ে চলে যাবে। তার আগেই আরম্ভ হল দাঙ্গা। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এতকালের সম্পর্ক লহমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শুধুই ঘৃণা, অবিশ্বাস এবং চরম শত্রুতা। বিষবাষ্পে ছেয়ে গেল দশ দিগন্ত। দাঙ্গায় খুন হল হাজার হাজার মানুষ, লুট হল অসংখ্য তরুণী। পুড়ে ছাই হল নগর-বন্দর, শত সহস্র জনপদ । তখন শুধুই হত্যা, রক্তপাত, ধর্ষণ। ভারত নামে এই দেশটি, বিশেষ করে পূর্ববাংলা যেন আদিম বর্বর যুগে ফিরে গেছে। দাঙ্গার পরে পরেই দেশভাগ। বিনুর প্রিয় নারী ঝিনুক ধর্ষিত হয়েছে। প্রায়-অপ্রকৃতিস্থ ঝিনুককে নিয়ে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর সঙ্গে এপারে চলে আসে বিনু। পশ্চিমবঙ্গও তখন উথালপাতাল। একদিকে জাতির জীবনে মহাসংকট, অন্যদিকে ঝিনুককে নিয়ে বিনুর ব্যক্তিজীবনে নানা অভিঘাত। এইসব নিয়ে ‘কেয়াপাতার নৌকো’ বিশাল পরিসরে শুধু মহাকাব্যিক উপন্যাসই নয়, বাঙালি জাতির চরম দুঃসময়ের এক মহামূল্যবান ইতিহাসও।
Prafulla Roy was a Bengali author, lived in West Bengal, India. He received Bankim Puraskar and Sahitya Akademi Award for his literary contribution in Bengali.
দেশভাগ নিয়ে কোন উপন্যাস পড়লেই এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় মনটা ছেয়ে যায় আমার। তাড়াতে পারি না সেই অনুভূতিকে অনেকক্ষণ। প্রফুল্ল রায়ের কেয়াপাতার নৌকোতে দেশভাগ সেভাবে ধরা পড়েনি অনেকেই বলেন। কিন্তু আমার কাছে ভীষণ হৃদয় নিংড়ানো রূপেই ধরা দিয়েছে এই বইটিতে দেশভাগ, তার পূর্বাপর সামাজিক পরিবর্তন।
প্রথমে রাজদিয়া তথা পূর্ব বাংলার অপরূপ রূপ, মানুষের সারল্য, একটা জমজমাট পরিবার, অসংখ্য দানধ্যান, পূজো পার্বণ, প্রেম, পূর্ব বাংলার নদী-নালা, শাপলা শালুক, ধানক্ষেত, শরৎ, বর্ষা, শীত, আকাশ ইত্যাদির অনুপম বর্ণনার মাধ্যমে একটা আশ্চর্য আনন্দরাজ্য গড়ে তুলেছেন লেখক। খুব ধীরলয়ে গড়ে তোলা উপন্যাসটিতে এই আনন্দ রাজ্য এবং প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র গঠনে অনেক সময় দিয়েছেন লেখক। পরবর্তীতে খুব ধীরে ধীরে সেই রাজ্যটির পতন দেখিয়েছেন, যা সংবেদশীল পাঠক হৃদয়ে তীব্র আঘাত হানে৷
অবনীমোহন এবং তাঁর স্ত্রী সুরমা, তাঁদের তিন ছেলে মেয়ে সুনীতি-সুধা-বিনু এই পরিবারটির ছুটি কাটানো উপলক্ষ্যে রাজদিয়া সুরমার মামাবাড়ি বেড়াতে আসা দিয়ে উপন্যাসের শুরু। পূর্ববঙ্গের রূপের ছটায় চোখ ঝলসে যায় যেন! সুরমার মামা হেমনাথ এবং মামী স্নেহলতা অত্যন্ত আদরে এই পরিবারকে বুকে টেনে নেন। স্থানীয় সমাজে হেমনাথ এবং স্নেহলতার প্রতিপত্তি খুবই বেশি। তাঁরা তাঁদের হৃদয়ের সমস্ত শুভবোধ সমাজে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সবসময়।
আরেক আশ্চর্য চরিত্র লারমোর সাহেব ওরফে লালমোহন বাবু। আইরিশ মানুষটি এ দেশকে ভালোবেসে গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে বিনে পয়সায় চিকিৎসার জন্য ছুটে বেড়ান। বিনুরা পা রাখতেই উৎসব রাজদিয়ায়। বাড়ির কামলা যুগল হয়ে ওঠে বিনুর ছায়াসঙ্গী। অসুস্থ সুরমাও রঙ ফিরে পান নিজের। সমস্ত আকাশে যেন উৎসবের আতশবাজি। রাজদিয়ায় যেন কেবলই সুখ।
কিন্তু সর্বনাশা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে বদলে দেবে সব এমন করে কে জানত?
বিশ্বযুদ্ধের তাড়নায় কলকাতা থেকে এসে জুটে ড্যাঞ্চিবাবুরা, জিনিসপত্রের দাম যায় এক লাফে বেড়ে। চাল আক্রা, দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। মানুষের আসল রূপ খুব প্রকটভাবে উন্মোচিত হতে থাকে তখন। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বিনু কৈশোরের নিষিদ্ধ জগতে পা রাখে। যুগল বিয়ে করে চলে যায় শ্বশুরবাড়ি, চিরদিনের মতো।
একে একে চেনা মুখগুলো বদলে যেতে থাকে, হারিয়ে যেতে থাকে। দেশভাগের পর আরো অচেনা হতে থাকে লোকজন। যে মজিদ মিয়া অবনীমোহনকে বিনা পয়সায় জমি দিয়ে দিতে চেয়েছিল, যে মজিদ মিয়া বিনুকে রাস্তায় সিগারেট খেতে দেখে নিজ হাতে শাসন করেছিল নির্দ্বিধায়-- সেই মজিদ মিয়ার কাছেও বিনুদের হিন্দু পরিচয়টাই বড় হয়ে ওঠে।
বড় কষ্টের সে সময়গুলো। এমনকি এত বছর পর একজন পাঠক হিসেবেও চোখে জল এনে দেয়। মানুষের জিনগত স্বার্থপরতা ভাবায় তখন, ভাবায় ঝিনুকের মতো কারো কারো জীবনে নেমে আসা সমস্ত দুর্ভোগের কথা, যে দুর্ভোগ এর যেন কোন শেষ নেই। ভাবায় অবনীমোহনের বদলে যাওয়া, হেমনলিনীর নিষ্ঠুর আচরণ, বিনু আর ঝিনুকের সম্পর্কের দোদুল্যমানতা। আবার উজ্জীবিত করে হেমনাথের আশা, যুগলের রুখে দাঁড়িয়ে ভিন মাটিতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার অ্যাডভেঞ্চার, উদারতা।
হেমনাথের মতো মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা মানুষদের সাথে একাত্ম বোধ করলেও একইভাবে বিষণ্ণতা ছুঁয়ে যায় প্রায়ই। টু নেশন থিওরি বা দ্বিজাতিতত্ত্বের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি আজো দাঁত-নখ খিঁচোয় মাঝে মাঝেই। তার মধ্যেই আশেপাশেই দেখি আফজল হোসেন বা নাসের আলীর মতো মানুষ যারা সত্যিকার অর্থেই মানুষ, যাদের কাছে জাতি-ধর্মের চেয়ে মানুষ পরিচয়টাই বড়, আশাবাদী হই, বেঁচে থাকার অবলম্বন তো আশাই।
বই: কেয়াপাতার নৌকো লেখক: প্রফুল্ল রায় ধরন: ঐতিহাসিক-সামাজিক উপন্যাস প্রকাশন: করুণা প্রকাশনী
এই না হলে মহাকব্যিক উপন্যাস! ভালবাসা, সুখ, দুঃখ, ইতিহাস সব কিছু মিলিয়ে রচয়িত উপন্যাসটি পড়ে 'পরান ডা এক্কেরে জুড়াইয়া গেলো'। এরকম 'জীবন্ত' বই অনেকদিন পড়া হয়নি। যদি জিজ্ঞেস করা হয় সবচেয়ে ভাল লেগেছে উপন্যাসের কোনদিক টি, তাহলে বলবো হেমনাথ মিত্রের সাথে তার নাতি নাতনী, পরিবার বর্গের যে অকৃত্তিম স্নেহ-মমতার চিত্র উপন্যাসে ফুটে উঠেছে তার থেকে বেশি নির্জলা রস আর কোন উপন্যাস/বই থেকেই কোনদিন আস্বাদন করতে পেরেছি বলে মনে পড়েনা। বারবার মনে হচ্ছিলো আমিই উপন্যাসের বিনু। আর হেমনাথ মিত্র, তার স্ত্রী স্নেহলতা এরা আমার ই আপন দাদু-দিদা। বাবার চাকুরিসুবাদে গ্রাম থেকে দূর জেলায় থাকা হতো বিধায় শুধু পূজোর সময় ই মামা বাড়ি যাওয়া হতো। সেই হিসেবে বিনু আর আমার শৈশবের অভিজ্ঞতা প্রায়শয় সমাপতিত হচ্ছিলো। উপন্যাসের প্রথম পর্ব একরকম নস্টালজিয়ায় ভুগতে ভুগতেই শেষ করেছি। লেখকের ভাষ্যমতে, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় এর কথায় দেশভাগ ও তৎকালীন দাঙ্গার ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে লেখক 'কেয়াপাতার নৌকা' নামের এই ঐতিহাসিক উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। কিন্তু আদতে মূল উপন্যাসে দেশভাগ সম্পর্কিত রাজনৈতিক ইতিহাস ও দুই বাংলায় এর সামগ্রিক প্রভাব প্রবল ভাবে দেখা যায়নি। বরং মূল উপন্যাসে রাজদিয়ার সামাজিক জীবন ও আরো স্পেসিফিক্যালি বিনয়কুমার বসু ও তার আশেপাশের মানুষদের দেশভাগের আগের আর পরের জীবনচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পকিস্তান) এর আপামর সাধারন জনগোষ্ঠীর জীবনাবস্থারই এক জীবন্ত চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন লেখক। সেই হিসেবে এটিকে একটি পুরোদস্তুর সামাজিক উপন্যাস ও বলা যায়। উপন্যাসটি তিনটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের রচনাকাল ১৯৬৮-১৯৬৯। ২০০১-২০০২ সালে, প্রায় ৩২ বছর পর তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হয়। কিন্ডলে উপন্যাস শুরু করার আগে জানতাম না যে এটি এত বিশালাকার।কিন্তু প্রথম চাপ্টারের পরই 'Flow' তে চলে গিয়েছিলাম। ৬০০+ পাতার উপন্যাস পড়তে মোটামুটি ১২ ঘন্টার মতো সময় লেগেছে দুইদিনে। কিন্তু বিন্দুমাত্র ক্লান্তি আসেনি(যা আমার মতো একজন অনিয়িমিত পাঠকের জন্য সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। তুলনা হিসেবে উল্লেখ্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়' পড়তে মোটামুটি দুই সপ্তাহ লেগে গিয়েছিলো। যথেষ্ট ভাল ও ইনফরমেটিভ বই হওয়া স্বত্তেও তেমন সুখপাঠ্য মনে হয়নি সেটি)। আবার ভুল সংস্করণ ডাউনলোড করায় দ্বিতীয় পর্বের পরেই দেখলাম বই শেষ হয়ে গেলো। ভাগ্য ভালো বইয়ের শুরুর 'প্রসঙ্গত' পার্ট পড়ে নিয়েছিলাম। নয়তো জানতেই পারতামনা তৃতীয় পর্ব ও আছে। সেখান থেকেই জানতে পারলাম লেখকের এই বইয়ের আরো দুই তিনটি খন্ড ভিন্ন নামে লেখার ইচ্ছার কথা। ইন্টারনেটের কল্যাণে জানতে পারলাম পরবর্তী সিক্যোয়েল এর সেই দুই বই যথাক্রমে 'শতধারায় বয়ে যায়" আর 'উত্তাল সময়ের ইতিকথা'। দুটোই খুব শীঘ্রই পড়ে ফেলার মনোবাসনা আছে, বাকিটা ভবিতব্য।
দেশভাগের উপর লেখা মহাকাব্যিক উপন্যাস। যদিও দেশভাগের যন্ত্রণা সম্পূর্নভাবে ফুটে উঠে নি, যেমনটা আমরা দেখেছি অতীনের 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে' তে। তবে পড়তে মন্দ লাগে নি। বিশেষ করে বর্���নাভঙ্গি ভালো লেগেছে । পরের দুই খন্ড পড়ে দেখার ইচ্ছা থাকল।
কলকাতা থেকে বিনু তার বাবা,মা,দুই বোন নিয়ে বেড়াতে এলো রাজদিয়া নামক পূর্ববঙ্গের ছোট্ট এক গ্রামে। বিনুরা এর আগে কখনো পূর্ববঙ্গ দেখেনি। এখানকার পরিবেশ আসতেই তাদের সামনে মুগ্ধতার ডালি সাজিয়ে বসে। হেমনাথের মতো প্রভাব সৃষ্টিকারী একজন দাতার নাতি,নাতনি,মেয়ে,মেয়েজামাই হিসেবে এখানে সবাই তাদের খুব শ্রদ্ধা করে,ভালোবেসে ফেলে। শুধু হিংসা করে একটা মানুষ,তার নাম ঝিনুক। ছোট্ট একটি মেয়ে যার মা তাকে ফেলে চলে গেছে। ঝিনুক কিছুতেই তার দাদুর ভালোবাসার ভাগ বিনুর সাথে করবে না।
কলকাতার তুলনায় রাজদিয়ায় সবকিছুই সস্তা। টাকায় ছয় সাতটা বড় বড় ইলিশ মাছ,অতি সামান্য পয়সায় শাকসবজি দেখে বিস্মিত হন বিনুর বাবা অবনীমোহন। এছাড়াও রাজদিয়ার অসামান্য সুন্দর প্রকৃতি,পুকুরঘাট,নৌকা,মাছ,শাপলা,মুত্রাবেত,জলশাচি বনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বিনুর বাবা মুগ্ধ হয়ে ঠিক করলেন এখানেই থেকে যাবেন। মেয়েদের জীবনে প্রেম এলো,বিনুর জীবনে ঝুমা এলো,ঝিনুক অবিরাম চেষ্টা করে যেতে লাগলো তাদের আলাদা করতে।
এরমধ্যে এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময় যার প্রভাব পড়লো কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায়। রাজদিয়ার শান্ত শ্যামল প্রকৃতির কোলজুড়ে প্রবাসী সন্তানেরা ফিরে এলো।
ডাক্তার ডেভিড লারমোররের ওপর এসব কিছুরই প্রভাব পড়ে না। তিনি জনসেবা ছাড়া কিছুই বোঝেন না,গ্রামের মানুষদের ওষুধের পেছনে খরচ করেন প্রচুর টাকা। লারমোর মানুষটি বিদেশী,সেই যৌবনে ভারতবর্ষে এসে আর ফিরে যাননি,এখন পুরোদস্তুর বাঙালি।
এরপর আসে ১৯৪৭ সাল। দেশভাগের প্রভাব পড়ে রাজদিয়াতেও। সেনাবাহিনী এসে ঘাঁটি গাড়ে। মদের দোকান চালু হয় হেমনাথের কঠিন আপত্তি সত্ত্বেও। চালের অভাব, কেরোসিনের অভাব, কাপড়ের অভাব। হেমনাথ আর তার স্ত্রী স্নেহলতা নিজেদের সাধ্যমত দরিদ্র মানুষের খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করে যান,তাদের দুয়ার থেকে না খেয়ে কেউ কখনো ফেরে না। চালু হয় দুইটা লঙ্গরখানাও। কিন্তু এত মানুষের পেটের খিদার সামনে তা অতি নগন্য। চুরি হতে শুরু করে ফসলের মাঠের কাঁচা ধানও। দরিদ্র মানুষের জন্য সে এক অতি ভয়ংকর সময়।
দেশভাগের পর চাল বা পোশাকের সমস্যা মিটলেও শুরু হয় দাঙ্গা। হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা। যেসব মুসলিম হিন্দু এই গ্রামে মিলেমিশে একসময় একসাথে ভাত পর্যন্ত খেয়েছে তারাই একে অপরের শত্রু হয়ে ওঠে। ভাঙ্গচুর শুরু হয়,হেমনাথের কাছে বারবার চিঠি আসে এলাকা ছেড়ে চলে যাবার। বিনু,ঝিনুক পাড়ি দেয় অজানা পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে।
কেয়াপাতার নৌকো উপন্যাসে সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান,কলকাতার অবস্থার বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারনা তো পাবেনই,আরো পাবেন অনেক কিছু। পাবেন প্রকৃতির সৌন্দর্য,পাবেন অসহায় এক মেয়ের জীবনযুদ্ধ,পাবেন তৎকালীন যেকোনো উত্তাল সময়ে উদ্বাস্তুদের হাল অবস্থা,তাদের দারিদ্র্যতা,তাদের লড়াই।
কেয়াপাতার নৌকো এই ট্রিলজির প্রথম খন্ড। এরপরের দুই খন্ড উত্তাল সময়ের ইতিকথা ও শতধারায় বয়ে যায় একসাথে কিনলেই ভালো করবেন। কেননা আমি না বুঝে শুধু প্রথম খন্ড কিনে এখন পরের অংশ পড়ার জন্য ছটফট করছি।
যারা বিশ্বযুদ্ধ,ইংরেজ শাসন,দেশভাগ,যুদ্ধের সময়কার দাঙ্গা, সাধারণ মানুষের অবস্থা ইত্যাদি নির্ভর উপন্যাস পছন্দ করেন তাদের জন্য এইটা মাস্টরিড একটা ট্রিলজি।
কাহিনীর শুরু ১৯৪০ সালে কলকাতানিবাসী অবনীমোহন স্ত্রী পুত্র কন্যাদের নিয়ে পুজোর ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন মামাশ্বশুর বাড়ি। অবনীবাবু এই প্রথমবার পা রাখলেন পূর্ববঙ্গের মাটিতে। বর্ষাকাল চারদিকে ধৈ ধৈ পানি। দুচোখ ভরে দেখেন তিনি বাংলার সৌন্দর্য আর এই বাংলার মায়াময় মানুষদের। কলকাতার ব্যবসা বাদ দিয়ে পরিবার নিয়ে স্থায়ী নিবাস গড়েন এই বাংলার সোনা ছড়ানো গায়ে।
এরপর আসে ১৯৪৭ সাল। কিছু মানুষ হয়ে উঠে পশুরসমান। খুনোখুনিতে রাঙা হয়ে উঠে দুই দেশের মাটি। লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে মানবেতর জীবন কাটায়। এর মাঝেই কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে সুন্দর করে বাঁচবার। তারা পা বাড়ায় জীবনের পথে। চমৎকার একখানা বই। ৬০০+ পৃষ্ঠার বই হলেও একটানে পড়ে ফেলা যায়।
পূর্ববঙ্গের আকাশ, বাতাস, জল, খাবার, পালাপার্বণ উৎসব, প্রকৃতির কি সুন্দর বর্ণনা উঠে এসেছে বইটাতে। আহা!
(রিপিটেশন কিছুটা বিরক্ত লেগেছে। এটা না থাকলে সম্ভবত বইটির কলেবর ৬০/৭০ পৃষ্ঠা কম হতো।)
দেশভাগের সময়টার উপর কেন যেন আলাদা একটা টান আছেক্স আর এইজন্যেই এই সময়কালের বই পেলেই পড়ে ফেলার চেষ্টা করি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে ঘুরতে এই বইটার সন্ধান পেয়েছিলাম বেশ আগেই, সেদিন হঠাৎ পুঁথিকায় এই বইটার খবর পেয়ে গেলাম। পড়া শুরুও করে দিলাম তাই চট করে।
গল্প যদিও দেশভাগের সমসাময়িক, তবুও সেই সময়কার রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার কিছুই নেই এই বইয়ে। সে সময়কার পূর্ব বাংলার পরিবেশ নিয়ে কথাবার্তা আছে শুধু। সেই কথাবার্তা এতই সরল আর মায়াকাড়া, যে পড়তে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না। সবচেয়ে ভালো লাগলো বোধহয় বারো বছরের এক ছেলের চোখ দিয়ে পুরো গল্পটা লেখায়- এজন্যেই বোধহয় স্বচ্ছ সরল এক গল্প, কিশোর বয়সের চোখে দেখা।
তবে এই যে সামাজিক একটা গল্প যেখানে সময় সুযোগ পেলেই কেবল কাছাকাছি বয়সের ছেলেমেয়েদের দেখা হলেই একসাথে জুড়ে দেয়ার প্রচেষ্টা, সেটা অতটা ভালো লাগেনি। এরকম গল্পের জন্যই বোধহয় সমবয়সী ছেলেমেয়েরা একে অন্যকে স্রেফ বন্ধু ভাবতে পারে না। দোষ অবশ্য নেই তাতে তেমন, তবুও বোধহয় ভালো লাগতো, যদি দুই একটা নির্মল বন্ধুত্বের দেখা পেতাম। এই বিষয়টা যদিও একেবারে আমার ব্যক্তিগত পছন্দ, এতে বইয়ের গল্পের একটুকুও ক্ষতি হয়নি।
খুব সুখপাঠ্য বই, শুধু ঐ সামান্য খুঁতখুঁতানিটুকুর জন্যই এক তারা কেটে রাখা।
খুব মর্মস্পর্শী লেখা। অবর্ণনীয় দুঃখ ও ইতিহাসের ক্ষত যা মানুষকে ও তার আগামী প্রজন্মকে তাড়িত করে। শেষ যেভাবে হল - cliffhangerএ - হয় পরবর্তী খন্ডগুলি পড়তে হবে না হলে open ending ধরে নিয়ে নিজের মত তার সঙ্গে সমঝোতা করে নিতে হবে - খানিকটা জীবনের মতই।
কেয়াপাতার নৌকো, শতধারায় বয়ে যায়, উত্তাল সময়ের ইতিহাস। এই তিনটি উপন্যাসকে ট্রিলজি বলা হয়ে থাকে। "কেয়াপাতার নৌকো" উপন্য���সটি তিনটি খন্ড নিয়ে রচিত। এ উপন্যাসটি ১৯৬৮--৬৯ সালে ধারাবাহিক ভাবে " অমৃত" পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়।
বিনয়কুমার বসু, ডাক নাম বিনু। বাবা অবনীমোহন বসু, মা সুরমা, দুই দিদি সুধা, সুনীতি থাকে কলকাতাতে। ১৯৪০ সাল, অক্টোবর মাস। বাংলা ১৩৪৭ সন, আশ্বিন মাস। স্টিমারে করে তারা যাচ্ছেন মায়ের মামা বাড়ীতে। সুরমা বিয়ের পর এই প্রথম তারা তার মামা বাড়ীতে যাচ্ছে। সুরমার মামা শ্রী হেমনাথ মিত্র, শহর রাজদিয়া, থানা মুন্সিগঞ্জ, জেলা ঢাকা।
কলকাতা থেকে বিনুরা পুজার ছুটিতে এসেছে রাজদিয়াতে, ছুটি শেষ হবে ভাইফোটার পর। লম্বা এই সময়টা তারা এখানেই থাকবে। যেহেতু তারা জন্ম থেকেই কলকাতাতে বড় হয়েছে তাই এই পূর্ব বাংলাতে এসে সব কিছুই তাদের অবাক করে দিছে। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার মানুষের সরলতা আর আতিথ্যয়তা তাদের বেশী মুগ্ধ করে। এক সময় নিবুর বাবা সিদ্ধান্ত নেয় তিনি কলকাতার নিজের ব্যবসা গুছিয়ে পূর্ব বাংলার এই রাজদিয়াতে এসে স্থায়ি ভাবেই থাকবেন।এবং করলেনও তাই।
আর ঠিক এই সময়টাতে একটু একটু করে যুদ্ধের সংবাদটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিছুদিন পরেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধ। ডাকের মাধ্যমে খবরের কাগজ আনার ব্যবস্থা করেন হেমনাথ। সেখান থেকে পুরা দেশের টুকরো টুকরো খবর জানতে পারে। সেই সময়টাতে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান। দেশে তখন শোকের ছায়া। যখন যুদ্ধ শুরু হলো একে একে কলকাতা থেকে সবাই গ্রামের বাড়ীতে ফিরো আসলো। সবার মনে একটা আতঙ্ক তৈরি হলো কলকাতাতে যে কোন সময় বোমা পড়তে পারে।
নদ- নদী, পাখি- ফুল, অফুরন্ত শস্যক্ষেত্র --- এসব মিলিয়ে সেদিনের পূর্ববাংলা ছিল নিসর্গের এক মায়াময় ভূখন্ড। বাতাসে বাতাসে জারি-সারি-ভাটিয়সলির সুর। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক তখন বড়ই মধুর। হিন্দু- মুসলমান দুই সম্প্রদায় ছিল পরস্পর পাশাপাশি। এই পটভুমিতে বিনু নামের এক বালকের বড় হয়ে ওঠা। শান্তস্নিগ্ধ পূর্ববাংলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সময় থেকেই উত্তাল হয়ে উঠতে শুরু করে। এদেশে যুদ্ধ হয়নি কিন্তু আমেরিকা এবং ব্রিটিশ সৈন্যে ছেয়ে গেছে চারিদিক। তাদের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়েছে নানা ধরনের বিষ। এলো কালোবাজারি, মজুতদারি, মানুষের তৈরি কৃত্রিম খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, মূল্যবোধের চরম বিনাশ, লক্ষ লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যু।
যুদ্ধশেষে ইংরেজরা দু'শো বছরের ভারতী উপনিবেশ ছেড়ে চলে যাবে। তার আগেই আরম্ভ হল দাঙ্গা। হিন্দু- মুসলমানের মধ্যে এত কালের সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। তখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শুধুই ঘৃনা, অবিশ্বাস এবং চরম শত্রুতা। দাঙ্গায় খুন হলো হাজার হাজার মানুষ, লুট হলো অসংখ্য তরুনী, পড়ে ছই হলো নগর - বন্দর- জনপদ।চারদিকে তখন শুধুই হত্যা, রক্তপাত, ধর্ষণ। ভারত নামের দেশটাতে, বিশেষ করে পূর্ব বাংলা যেন আদিম বর্বর যুগে ফিরে গেছে।
দাঙ্গার পরে পরেই দেশভাগ।১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭সাল। খন্ডিত দেশের উপর দিয়ে স্বাধীনতার রথ এলো ঘর্ঘরিয়ে। বিনুর সবচেয়ে কাছের মানুষ ঝিনুক ধর্ষিত হয়েছে। প্রায় - অপ্রকৃতিস্থ ঝিনুককে নিয়ে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর সাথে কলকাতাতে চলে যায় বিনু। পশ্চিমবাংলাও তখন উথাল পাতাল। একদিকে জাতির জীবনে মহা সাংকট অন্য দিকে ঝিনুককে নিয়ে নিয়ে বিনুর ব্যক্তিগত জীবনে নানা অভিঘাত। এসব নিয়েই" কেয়াপাতার নৌকো" বিশাল পরিসরে এক উপন্যাস। বাঙ্গালি জাতির চরম দুঃসময়ের এক মহা মূল্যবান ইতিহাস নিঃসন্দেহে। এখানে লেখক কাহিনীর মাধ্যমে সেই সময়টাকে চরম ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
অনেক শুনেছি বইটা খুব ভালো কিন্তু ঠিক কতটা ভালো তা বইটা না পড়লে কোন ভাবেই বলে বোঝানো যাবে না।
বইটির মূল কাহিনী ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের সময় কে কেন্দ্র করে। মূলত পাকিস্তান থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ভারতে চলে যাওয়ার কাহিনী বইটিতে উঠে এসেছে। উপন্যাসটি একটু বড় হলেও পড়তে খারাপ লাগবে না, এর ভাষা বেশ প্রাণবন্ত । চরিত্র গুলোও চমৎকার ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া বইটি পড়লে ঐ সময়ের ইতিহাস সম্বন্ধে ভালো ধারণা পাওয়া যায়।
অসাধারণ, মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়েছি বিশাল কলেবরের এই উপন্যাস! অখন্ড ভারত বর্ষের, সুজলা, সুফলা গ্রামে আসে ছোট্ট এক ছেলে তার চোখ দিয়ে দেশ ভাগ থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার অপার সৌন্দর্য ঠিকরে বের হয়েছে বইয়ের প্রতিটি পাতায়, পাতায়!
যুদ্ধ মানুষের দুটি দিক খুব তীব্র ভাবে প্রকাশ করে এক আতি দানবীয় আর অতিমানবিক, ট্রেন টু পাকিস্তান পড়ার পর এক অনুভূতি হয়েছিলো কিভাবে সম্ভব, একদল মানুষ কিভাবে তার মতই আর একদল মানুষের জীবন ছিনিয়ে নেয়ার জন্য ক্ষতি করার জন্য উদগ্রীব হয়, সেই একই অনুভূতি হয়েছে শেষ অংশে এসে।
🍂"এক অসীম শোক, অসহায়ত্ব আর সংশয় নিয়ে মধ্য রাত্রে উপন্যাস টা শেষ হয়ে গেলো।
রাত বারো'টা বেজে তিন মিনিট। ভিতর টা ঘামে ভিজে উঠেছে। শোক, সন্তাপ আর বেদনা। ভিতরটা ঝাঁ ঝাঁ করছে! কি এক ভীষণ অচেনা দুর্বলতা দিয়ে কেউ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে বুকের চোরাগলি। শ্বাসকষ্ট!! বই টা এমন ভাবে শেষ না হলেও পারতো.....!! সোহম গাঙ্গুলী...... সাইনিং অফ!!!! শুভরাত্রি। আজ রাতে আর ঘুম আসবে না...."
গতকাল রাতে নিজের ডায়রির পাতায় এটুকু লিখে ঘুমাতে গিয়েছিলাম।
মনে আছে সেদিন বৃষ্টি পড়ছিলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম সমস্ত আকাশ মেঘে ঢাকা। সেখান থেকে অনবরত অবিরল ধারায় জলের ফোঁটা নেমে আসছে। বুঝলাম আজ আর পড়ায় মন বসবে না। কলেজ ছুটি। তাড়াহুড়ো নেই। বইটা লাইব্রেরী থেকে এনেছিলাম। আর খুব অদ্ভুত ভাবে তার ঠিক পরদিনই প্রফুল্ল রায় চলে গেলেন। অবশেষে "কেয়া পাতার নৌকো" খুলে বসলাম। তারপর ভেসে গেলাম.....
গত সাতটা দিন আমার কেটেছে এই বইয়ের সাথে। এক অসম্ভব ঘোরের মধ্যে আমার সেই পথ চলা.......
🍂 মনে আছে বছর দুয়েক আগে কালকূটের "কোথায় পাবো তারে" যখন পড়েছিলাম, তখন এক বুক দরিয়া নিয়ে ভেসে গিয়েছিলাম। আর এবার ভাসলাম পদ্মা- মেঘনা- ধলেশ্বরী তে।
পূর্ববঙ্গের রমণীয় রাজদিয়া কে কেন্দ্র করে এ কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। ভরা আশ্বিন মাস। নীলাকাশ। তার মধ্যে হালকা পালকের মতো মেঘ সমগ্র চরাচর জুড়ে ভেসে চলেছে। সামনের বাগান পেরিয়ে গেলেই পুকুর। তারপর জলে নিমজ্জিত আবিস্তৃত ধানক্ষেত। এখানে বর্ষার পর থেকেই মাঠে জল জমে থাকে। তখন আর নদী, পুকুর, মাঠ কিছুই আলাদা করে চেনা যায় না। কার্ত্তিক মাসের পর থেকে জলে ভাটার টান ধরতে শুরু করে। এ হলো গিয়ে জলের দেশ। যাতায়াতের অবলম্বন একমাত্র নৌকো। দুরে দুরে আশে পাশের গ্রাম গুলো একাকী বন্দিনীর মতো শামুখের মতো মাথা টুকু তুলে অথৈ জলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। জায়গায় জায়গায় পদ্মবন, শাপলা বন, কচুরিপানা। তার ওপরে জেগে থাকা কাউফলের গাছ, দুরে নলখাগড়ার ঝোঁপ, মূত্রাঝোঁপ। তার ওপর সারাদিন অসংখ্য পাখির গান গেয়ে চলা......!
পুজোর ছুটিতে অবনীমোহন তার রুগ্ন স্ত্রী সুরমা আর ছেলে মেয়ে সুধা-সুনীতি আর বিনু কে নিয়ে পাড়ি দেন তার মামাশ্বশুড়ের বাড়িতে। তারপর থেকেই বিশাল জল-বাংলার ব��কে এক অচেনা অজানা ছোট্টো গ্রাম কে ঘিরে শুরু হয়ে যায় এই কাহিনীর বুনন। কাহিনী যতোই এগোয়, সময়ের সাথে সাথে জল বাংলার সাথে পরিচিতি ততই বাড়তে থাকে। ভরা আশ্বিন, বিজন হেমন্ত, প্রসন্না বর্ষা কে বুকে নিয়ে জল-বাংলা চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেকেই বলে থাকে "কেয়া পাতার নৌকো" তে দেশভাগের বর্ণনা খুব কম, তাই কোনোভাবেই এই উপন্যাস দেশভাগের ওপর রচিত আকর দলিল নয়। সেসব বিষয় অনেক পরের, আমি কেবল বলি জল-বাংলার আকর্ষণীয় রমনীয় রূপ কে জানবার জন্যই এ বই আপনার একবার হলেও পড়া প্রয়োজন।
🍂 শরৎচন্দ্রের "শ্রীকান্ত" উপন্যাস আমি তখন পড়েছিলাম, যখন আমি আমার কৈশোরে পা রাখিনি। তারপর থেকে বহুকাল সে বই আমার প্রিয় উপন্যাস ছিলো। সেই কম বয়সের আবেগে ইন্দ্রনাথ তখন আমার কাছে এক রঙিন চরিত্র। শ্রীকান্ত নয়, বরং ইন্দ্রনাথই আমায় বাধ্য করেছিলো শ্রীকান্ত উপন্যাসের পাঠ এগিয়ে নিয়ে যেতে। ঠিক তেমন ���ই "কেয়া পাতার নৌকো" - উপন্যাসে এসে আমি পেলাম যুগল কে। জল-বাংলার অসীম রহস্য, পদ্মা - মেঘনা - ধলেশ্বরীর জলের নীচের সমস্ত গোপন রহস্য যার জানা, তার কাছে কত মাছ ধরার কৌশল, সুন্দি কাউঠ্যা কিভাবে মারতে হয়.... সবকিছু যার হাতে মুঠোয়! সে চোখ বেঁধে দিলেও ভরা কুয়াশায় কিংবা হেমন্তের সন্ধ্যেয় সাত মাইল দূরের সুজনগঞ্জের হাটে গিয়ে ঠিক ঠিক নৌকা বেয়ে উঠতে পারে! বিনু মুগ্ধ হয়ে দেখে! জল বাংলার কত নাম না জানা ফুল-ফল, কত নাম না জানা পাখির ডাক, কত নৌকোর নামের সঙ্গে যে তার পরিচিতি ঘটে! একমাল্লাই, দো মাল্লাই, কোষা, মহাজনী আরও কত কি! জল-বাংলার যাবতীয় শেখার ভাঁড়ার যেন সে উপুর করে দেয় বিনুর ওপর। কাহিনীর এক জায়গায় এসে যুগল নিজেই স্বীকার করেছে যে সে জল ছাড়া বাঁচবে না। কেবল সেই তাড়নায় সে একসময় রাজদিয়া ছেড়ে ভাটির দ্যাশে পাড়ি দেয়.... দেশভাগ হওয়ার পর এপার বাংলায় এসেও কলকাতার কাছাকাছি জায়গা পাওয়া সত্ত্বেও দূরে মুকুন্দপুরে উঠে আসে কেবল সেখানে বিল আছে বলে!!
শুধু কি যুগল, কাহিনী এগোনোর সাথে সাথে প্রবল ব্যাক্তিত্বময় সেই প্রৌঢ় হেমনাথ, তার স্ত্রী স্নেহময়ী স্নেহলতা যার দুয়ার থেকে কেউ কোনোদিন দু মুঠো অন্ন না খেয়ে ফিরে যায়নি, ঝিনুক, ভবতোষ, রামকেশব, অধর সাহা, নিত্য দাস, মজিদ মিঞা, শিশির, ত্রৈলোক্যনাথ, আনন্দ, হিরণ, ঝুমা, আশু দত্ত, আরও কত মানুষ যে উপন্যাসের মধ্যে এসে মিশে গেছে সময়ের সাথে সাথে....! অবিরল মানুষ আর মানুষের মধ্যেকার সম্প্রীতি দেখতে দেখতে যাওয়া। নাহলে কেনোই বা মজিদ মিঞা অবনীমোহনের কলকাতা ছেড়ে রাজদিয়ায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তাকে চাষবাস করার জন্য তিরিশ কানি জমি বিনামূল্যে দিয়ে দিতে চায়? কামারপাড়া, কুমোরপাড়া, যুগীপাড়া, কমলাঘাটের হাট, সুজনগঞ্জের হাট এসব কে ঘিরে কাহিনী যতোই এগিয়েছে, সময়ের সাথে সাথে বড়ো হয়ে এসেছে..... বিনু। তার সাথেই চলেছে বিনুকে ঘিরে ঝুমা কিংবা ঝিনুকের মধ্যে টানাটানি, আনন্দ-সুনীতি অথবা হিরণ-সুধার ভালোবাসা।
🍂 তারপর তো কেবলই ভাঙন!! সব রমণীয় রূপ, সব ভালোবাসা, সব টানাপোড়েন অতিক্রম করে যুদ্ধ আসে। কোনো এক হেমন্তে সুরমা'র ঘোর জ্বর আসে। অবনীমোহন কে ডেকে বিজন সন্ধ্যেয় সে জানায়, "আমি আর এ বিছানা ছেড়ে উঠবো না, মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও!"। সুনীতি-সুধার বিয়ে হয়ে যায়! তার কিছুদিন পরেই হঠাৎ এক ভোরে সুরমা জল বাংলার মায়া ত্যাগ করে অনন্তের উদ্দেশ্যে মিশে যায়। পড়ে থাকে কেবল একটুকু ছাই! স্ত্রীর মৃত্যুর পর অবনীমোহন, যুদ্ধের কনট্যাক্টরি নিয়ে বার্মা চলে যান। সুনীতি তার শ্বশুরবাড়ি কলকাতায়। যুগল তো আগেই গিয়েছিলো! এমনকি হেমনাথের সাধের হিরণও একদিন রাজদিয়া কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে, যুদ্ধের বড়ো অফিসার হওয়ার জন্য সুধা কে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি দেয়।
যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু কেউ ফিরে আসে না.... তারপর একসময় এসে পরে দেশভাগ। দ্বিতীয় পর্বের মধ্যভাগ থেকে এসে উপন্যাস নিদারুণ রঙ বদলায়। চেনা মানুষ দের অচেনা মানুষে বদলে যাওয়া, যেখানে ছিলো সম্প্রীতি, সেখানে জায়গা করে নেয় নিরঙ্কুশ ঘৃণা। যে হেমনাথের কথা রাজদিয়ায় কেউ ফেলতে পারতো না, তার কথা অমান্য করে আমেরিকান টমি আর নিগ্রো সৈন্য দের জন্য গড়ে ওঠে মদের দোকান। কালোবাজারি, মেয়ে পাচারে ছেয়ে যায় পুরো দেশ। কালো পয়সার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে নেমে আসা মন্দা। চারিদিকে হাহাকার, অভাব, সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণা। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, চোখের সামনে ফসল কেটে নেওয়া, যুবতী মেয়েদের লুন্ঠন। সে এক উত্তাল সময়!!
🍂 মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পদ্মা নদীর মাঝি" যখন পড়েছিলাম, তখন হোসেন শাহ কে দেখে আমার বড়ো রহস্যময় মানুষ বলে মনে হয়েছিলো। সমস্ত অবমাননা, সমস্ত অপমান, কথা চালাচালি কোনো কিছুকে ভ্রূক্ষেপ না করে সে আপন মনে নিতান্ত অকারণে তার স্বপ্নের দ্বীপ তৈরী করে চলেছে। উপন্যাসের শেষে এসে মনে হয়েছিলো, "ঈশ্বরও তো তাই!!"। তার কোনো কাজেরই কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। -- " ভাঙিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে../নির্জনে প্রভু নির্জনে" -- "কেয়া পাতার নৌকো"য় এসে.... তেমন আমি পেয়েছি লালমোহন কে। ভদ্রলোকের আসল নাম লালমোর, আয়ারল্যান্ডের অনাথ অধিবাসী সেই তিনি যুবক বয়সে এই জল-বাংলায় এসেছিলেন খ্রিস্টান ধর্ম প্রিচ করতে, তারপর এদেশের জল হাওয়া কে ভালোবেসে কাটিয়ে দিয়েছেন দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ টা বছর। প্রিচ করাও একসময় ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি, হেমনাথ বলেছিলেন, " তুমি তো ডাক্তার!! এদেশের মানুষের বড়ো অভাব, বিনা চিকিৎসায় তারা মারা যায়, তাদের সেবা করো, তার চেয়ে বড়ো ধর্ম নেই!" -- সেই থেকে শুরু হলো তার মানব সাধনা, দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে তিনি নিজের খেয়াল না রেখে অপরের খেয়াল রেখেছেন, বিনা পয়সায় চিকিৎসা করবার জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন, পাড়ি দিয়েছেন পদ্মা - মেঘনা - ধলেশ্বরী তে। কিন্তু যেদিন দাঙ্গায় এক নিরপরাধ মানুষ কে রক্ষা করতে গিয়ে হানাদার রা বললো, "পথ থেকে সরে যাও সাহেব, তুমি তো অবাঙালি, এ দেশের তুমি তো কেউ নয়" -- তিনি সহ্য করতে পারলেন না। হানাদার দের হাতে সড়কির বাড়ি খেয়ে মাথায় ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। তারপর সেই যে তিনি বিছানায় পড়লেন আর উঠলেন না, মৃত্যু অবধি তীব্র জ্বরের মধ্যে বলে গেলেন, "হেমনাথ, ওরা বলেছে আমি নাকি এদেশের কেউ নই!!"
🍂 মনে পড়ে সেই জন্মদুখিনী মেয়েটার কথা যে নিজের মৃত্যুশয্যায় থাকা মা কে ঢাকায় দেখতে গিয়ে রায়ট থেকে ফিরে এলো বিধ্বস্ত হয়ে! তখন তার পরিচয় সে কেবল ধর্ষিতা। ছেলেবেলা থেকে সে ঘরে দেখে আসছে তার মা-বাবার মধ্যে মিল নেই। মা একরত্তি নিজের গর্ভের মেয়েটাকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন নিজের প্রেমিকের সাথে। তারপর'ই বাবা ভবতোষ এসে তাকে দিয়ে যায় হেমনাথ দের বাড়ি। সেখানেই সে বিনুর পাশাপাশি মানুষ হয়। উপন্যাসের প্রথম থেকে সে বিনুকে হিংসা করে গেছে ক্রমাগত। মুড়ি টা, গুড় টা, চিড়ে টা, দুধ টা, মাছের বড়ো পিস টা এমনকি আদরের হেমনাথের ভাগ নিয়েও সে বিনুর সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। খুব ভোরে হেমনাথ সূর্যপ্রণাম করতে বিনুকে ডেকে নিয়ে গেলে সে মুখ গুঁজে মাটিতে পড়ে থেকেছে তীব্র অভিমানে। হেমনাথ একসময় নিজেই ঝিনুকের প্রতি বলেছে, "হিংসের জ্বালা কত!!"। এমনকি ঝুমা যখন এসে কোনো আশ্বিনের নিভৃত দুপুরে বিনুকে নিয়ে নৌকো করে মাঝ জলে কাউফল পাড়তে গেছে, সে একাকী নিশ্চুপ হয়ে পুকুর পাড়ে বসে থেকেছে। দুপুরে স্কুল ছুটির পর বিনু যেন ঝুমাদের বাড়ি তার সাথে দেখা করতে না যায়, তার মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দশমীর রাতে যুগলের সাথে সুজনগঞ্জের হাটে রাত জেগে যাত্রা দেখতে গেলে সেখানেও সে বিনু আর ঝুমার আগে আগে গিয়ে নৌকায় উঠে বসেছে। বিনুকে নিয়ে সে ঝুমার সাথে এক অসম সংগ্রামে নেমেছে। তীব্র হিংসায় ভিতর থেকে জ্বলে পুড়ে গেছে, কান্নাকাটি করেছে, ভয় দেখিয়েছে। কাহিনীর এক পর্বে গিয়ে ঝিনুকের প্রতি বিরক্তই হয়েছি হয়তো!!..... সমগ্র কাহিনী জুড়ে ঝিনুক- বিনু - ঝুমার এক ত্রিকোণ অস্তিত্বের সংগ্রাম। ঝুমার প্রতি বিনুর অসীম আকর্ষণ, আরেকদিকে ঝিনুকের প্রতি তখর মমত্ববোধ, এই দুইয়ের মধ্যে টাল মাটাল পায়ে উপন্যাস এগিয়ে চলেছে।
🍂 কিন্তু যে রাতে সুরমা মারা গেলো, মিশে গেলো রাজদিয়ার জল হাওয়া মাটিতে, ভাসতে ভাসতে নিজের অস্তিত্বের সবটুকু মিলিয়ে দিলো পদ্মায়, সে রাতে পুরো রাজদিয়া ভেঙে পড়লেও আসে নি কেবল ঝুমা। বিনুর মায়ের মৃত্যুতে ঝিনুক যেখানে কেঁদে ভাসিয়েছে, ঝুমা সেখানে নিরাসক্ত, সে জানিয়েছে... এসব তার ভালো লাগে না!! উপন্যাসের এ জায়গা থেকে এসেই জানি না কেনো, ঝিনুকের প্রতি আমার পাঠক হিসেবে অসীম মমত্ব এবং ঝুমার প্রতি ঘৃণা বাড়তে থাকে!!
রায��টের ঘটনার পর থেকেই ঝিনুকের জীবন বদলে যায়। স্নেহলতা কে সে কেঁদে বলে, "আমার যে আর কিছুই নেই!" মোমের পুতুলের মতো মেয়েটা তখন শীর্ণ, জীর্ণ, বিধ্বস্ত, তাকে যেন খেয়ে রেখে গেছে অসংখ্য কিছু ঘৃণ্য জীব। তার বাবা ভবতোষ রায়াটেই মারা যায়, দিন পনেরো পর কোনো খোঁজ খবর না আসায় ঢাকা পুলিশের সাহায্য নিয়ে গিয়ে হেমনাথ তাকে রক্ষা করে! তারপর থেকেই তার ভয়, শঙ্কা.... বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, সারাক্ষণ একটা ঘরের কোণায় সে নিজেকে বন্দী রাখতো, অবিরল কান্না আর যন্ত্রণা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এরমধ্যে রাজদিয়া আবারও উত্তপ্ত হতে শুরু করে! ঝিনুক স্নেহলতা কে জানায় যে সে এখানে থাকলে মরে যাবে!! হেমনাথ কোনো উপায়ন্তর না দেখে ঝিনুকের পূর্ব জীবনের স্মৃতি মুছে দিতে বিনুর সাথে ঝিনুক কে কলকাতায় পাঠানোর উদ্যোগ নেয়।
কিন্তু সে এক উত্তাল সময়। পথে পথে হানাদার দের বাধা, উদ্বাস্তু সমস্যা, ঘৃণা, নৃশংসতা, সরকারের অসহযোগিতা... এসবকে মাথায় নিয়ে ঝিনুক কে নিজের বুকের মধ্যে আগলে রেখে সে তারপাশায় পাড়ি দেয়। পথে হানাদার রা তাদের আক্রমণ করে। নৌকা চুরি হয়ে যায়। পাড়ে আশ্রয় নিলে সেখানেও মুসলিম রা তাদের আক্রমণ করে! তখন চারিদিকে দেশ ছাড়ার ঢল। আফজল খান নামের এক সহৃদয়বান মুসলমানের সাহায্য নিয়ে তারা অবশেষে তারপাশা পৌঁছে যায়। সেখান থেকে স্টিমারে গোয়ালন্দ, সেখান থেকে ট্রেনে শিয়লদহ। এই যাত্রা পথের বিবরণী যতই পড়েছি, গায়ে কাঁটা দিয়ে গেছে, আরও নতুন নতুন চরিত্র আর তাদের জীবনের কাহিনী এসে যুক্ত হয়েছে উপন্যাসে। অধর ভুঁইমালী, ভুবন দাস, হরিন্দ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ দের উচ্চপদস্থ চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিশাল জল-বাংলার এক অনামা গ্রামে মানবসম্পদ গড়ার কাজে নেমে পড়া প্রবীন মাস্টারমশাই রামরতন গাঙ্গুলি পর্যন্ত, কারোর ঠাঁই হয়নি সেই হিংসার বাংলায়। পাকিস্তানি চেকিং, ভিড়, হিংসা, রক্ত, স্বেদ পেরিয়ে কেবল রামরতনের মৃতদেহ টুকুই ভারতে এসে পৌঁছলো, কান্নায় ভেঙে পড়া তার স্ত্রী র কন্ঠস্বর শোনা গেলো অমৃত বাণীর মতো, "তার দেহ এলো এপার বাংলায়, কিন্তু তার প্রাণ টুকু তিনি ছেড়ে রেখে এলেন ওপার বাংলায়"।
কলকাতায় এসেও মা বাবা হারা জন্ম দুখিনী ঝিনুকের ঠাঁই হলো না কোথাও। বিনুর বড়দি সুনীতির শ্বাশুড়ী তাকে অচ্ছুত করে রাখলেন আলাদা একটি ঘরে। বুঝিয়ে দিলেন একজন ধর্ষিতা মেয়েকে কখনো গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কলকাতায় আসার পর থেকে নতুন করে ঝিনুক - বিনু - ঝুমার অস্তিত্বের সংগ্রামের সূচনা। ঝুমা ধর্ষিতা ঝিনুকের প্রতি আন্তরিক নয়। বিনু যে মেয়েটাকে সুদুর রাজদিয়া থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বুকে জড়িয়ে কলকাতা নিয়ে এলো, সে এখানে এসেও শান্তি পেলো না। বড়দি সুনীতির বাড়ি ছেড়ে ছোড়দি সুধার বাড়ি তে গিয়ে উঠলে সাময়িক স্বস্তি পেলেও, সুধার কাকাশ্বশুড় অথবা হিরণের জ্যেঠীমা বাড়ি ফিরে এলে কেউই ঝিনুক কে বাড়িতে গ্রহণ করে নিতে স্বীকার করবেন না। এমনকি কাহিনীর শেষে যে অবনীমোহনের ভরসায় ছিলো বিনু, সেও জানায় ঝিনুক কে গভর্নমেন্টের স্টে তে দিয়ে আসতে।
🍂 আমার বারবার এই বিশাল মহাকাব্যিক উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, শেষে এসে আমি এতখানি দুঃখ পেলাম কেনো। দেশভাগের ওপর, যন্ত্রণার ওপর এর আগেও তো আমি অসংখ্য উপন্যাস পড়েছি। এর আগে কখনো আমার এতখানি অস্বস্তি হয় নি। বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বুঝলাম, এ মহাকাব্যিক উপন্যাসে প্রফুল্ল রায় যে সবচেয়ে অসামান্য কাজটি করেছেন, তা হলো অসামান্য বিনির্মাণ। যে কারণে সুরমার মৃত্যু, লারমোরের মৃত্যু, যুগলের ছেড়ে যাওয়া, হিরণের ছেড়ে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনা কি নিখুঁত ভাবে ছুঁয়ে গেছে আমায়!! সবাই দেশ ছাড়লেন, কেবল হেমনাথ ছাড়লেন না। তিনি বললেন, "এ দেশে যদি মরতেও হয়, তবুও মরবো! কিন্তু পূর্বপুরুষের ভিটে ত্যাগ করবো না"। তিনি আশাবাদী যে ভাষা আন্দোলন কে ঘিরে হিন্দু-মুসলমান রা আবারও হাতে হাত মিলিয়ে লড়বে, উত্থান হবে নব জাগরণ বাদের। বড়ো জানতে ইচ্ছে হয়, কেমন আছেন সেই হেমনাথ রা? তাদের অলিখিত পরিণতি কি হয়েছিলো?
🍂 এক অসীম যন্ত্রণা, অসহ্য অপমান, অবমাননা আর লাঞ্ছনা কে বুকে নিয়ে কাহিনীর শেষে ঝিনুক হারিয়ে যায়। হেমন্তের রাত্রিতে বিনু পাগলের মতো খুঁজে বেড়ায় ঝিনুক কে। মহানগরীর বুকে পাতলা সরের মতো কুয়াশা জমে আসে, দুরে গাড়ির আওয়াজ, কসবার সারি সারি আলো, মানুষের কোলাহল সব নিস্তেজ হয়ে আসে....... ক্রমশ!!
🍂 পড়ুন, "কেয়া পাতার নৌকো" অবশ্যই পড়ুন। এ বই আপনার কাছে সারাজীবন থেকে যেতে পারে জন্মদুখিনী ঝিনুকের মতো এক অসহ্য উত্তাল সময়ের যন্ত্রণা নিয়ে...!
গ্রাম বাংলার জীবন নিয়ে যা উপন্যাস পড়েছি , তার মধ্যে সেরা এখনও পর্যন্ত (পথের পাঁচালী বাদ দিয়ে বললাম অবশ্য)| গ্রাম বাংলার জীবনে আলোকপাতে যুগল , হেমনাথ , স্নেহলতা চরিত্র খুব ভালোভাবে সৃজিত| তবে বিনু-ঝিনুকের বন্ধুত্ব উপরি পাওনা| আর লারমোরের চরিত্রটি ব্যতিক্রমী চরিত্র হিসাবে খুবই আকর্ষণীয়|
প্রফুল্ল রায় স্বনামে ধন্য , তাই লেখার বাঁধন নিয়ে বলতে যাওয়া ধৃষ্টতা | যদিও তুলনা করার অর্থ হয় না , তবু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা অন্যান্য বেস্টসেলারের চেয়ে তার চরিত্র বিন্যাস আমার বেশি আকর্ষণীয় লেগেছে |
I am just spellbound after reading the book! The author has described everything in such a beautiful way that while reading the book I was feeling as if I was living that moment along with the characters of the book! It is an excellent book in which the life of people in East Bengal prior to Partition has been described vividly.It also describes the atrocities faced by people after the Partition of British India. It is a must read for everyone!
বইটির প্লট মূলত ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের সময়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। হিন্দু মুসলিমদের নানা অভিজ্ঞতা লেখক এখানে তুলে ধরেছেন। বইটি একটু বড় হলেও এর প্রাণবন্ত লেখকশৈলির জন্য খারাপ লাগবে না। ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞানের ঝুড়িতে উপাদেয় কিছু তোলা হলো।
যেসব বাংলা বইয়ের পরিচয় দিতে গেলে শুধু নামটাই উল্লেখ করা যথেষ্ট , ' কেয়াপাতার নৌকা ' নিঃসন্দেহে সেগুলোর মধ্যে একটা । দেশভাগ , উদ্বাস্তু নিয়ে লেখা ফিকশনের কথা ভাবলেও এর নাম প্রথমেই মনে আসে ।
উনিশ’শ চল্লিশ সালের অক্টোবর মাসের এক ভোরে রাজদিয়ার ঘাটে একটা কলকাতা-ফেরত স্টিমার এসে দাঁড়ায় । আর সেখানেই স্টিমার থেকে নেমে আসে গল্পের সূচনা ।
এরপর তো চরিত্র আর চরিত্র , কাহিনী আর নতুন নতুন মোড় । অস্থিরচিত্ত অবনীমোহন , রুগ্ন সুরমা , মহান এবং প্রবল ব্যক্তিত্বময় হেমনাথ , সার্থকনামা স্নেহলতা , পরহিত-প্রাণ লারমোর , সরল যুগল , সুধা-সুনীতি , আনন্দ-হিরণ , রুমা-ঝুমা , পাখি... আপন বৈশিষ্ট্যে প্রত্যকেই উজ্জ্বল ।
আর আছে নতুন পৃথিবীকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে যাওয়া বিনু , আছে বাবা-মায়ের অসুখী দাম্পত্যের শিকার ঝিনুক । উপন্যাসের কাহিনীর বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে যাদের বয়সও বেড়ে ওঠে , কৈশোর ঢেকে যায় যৌবনের ছটায় । নতুন পৃথিবী , নতুন অনুভূতি ভরিয়ে তোলে তাদের জীবন । ভালবাসা , ঈর্ষা , জটিলতা — সবই থাকে । আর থাকে এক মায়া । দিনের শেষে সব মন-কষাকষি , মতানৈক্য মিটে যাওয়ার মৃদু আশ্বাস । বিনুর জলে পড়ে যাওয়া , দুর্গাপূজায় রাজদিয়াতে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য জেগে ওঠা , যুগলের প্রেমের ধুমধাম বিয়েতে রূপান্তরিত হওয়া , হিরণের পরীক্ষায় ভাল ফল করা , আনন্দের মিথ্যে বাহাদুরি বৃথা আস্ফালনে পরিণত হওয়া , সুধা-সুনীতির খুনসুটি... একের পর এক অম্ল-মধুর ঘটনার ঘনঘটায় তরতরিয়ে কোলাজে এগিয়ে যায় কাহিনী ।
এরপর আচমকা এক কালো সময়ের কালো অভিশাপে শান্ত , নিস্তরঙ্গ রাজদিয়াতেও এসে পড়ে দেশভাগের করাল দংশন । সাম্প্রদায়িকতা প্রবল হয়ে ওঠে , চিরচেনা মানুষদের মধুর সম্পর্ক বিষিয়ে ওঠে অব্যক্ত ঘৃণায় । সামাজিক অবক্ষয়ের সমস্ত লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে তামাম পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে — হামলা , ধর্ষণ , লুটপাট , অত্যাচার , আক্রমণ... এবং অবশেষে সাত-পুরুষের ভিটে , আজীবনের যাবতীয় সঞ্চয় ফেলে দলে দলে হিন্দুর পলায়ন ।
তিন পর্বে বিস্তৃত এই সুবিশাল উপন্যাসে প্রফুল্ল রায় ধরেছেন একটা গোটা সময়ের রূপান্তরকে । তাই সুখী ওপার বাংলার গল্প পড়ার সময় যেমন এক অনাস্বাদিত আনন্দে মনটা ভরে ওঠে ; তেমনই বুকের খাঁচায় পাখির মতো মৃত্যুভয়কে ভরে ভারতে এসে পৌঁছানো এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্রোতে ভেসে যাওয়ার বিবরণ পড়তে পড়তে বুকটা ভারী হয়ে ওঠে ।
কোথায় সেই জল টলটলে মেঘনা-পদ্মা-ধলেশ্বরী , কোথায় তাদের গর্ভে সাঁতরে বেড়ানো ভাগনা-টাটকিনি-চাপিলা মাছের দল , কোথায় কোষা-মহাজনী-বাইজা নৌকার সারি , পদ্মা-শাপলা-মূত্রার ফুলে ভরা লতা , ঝোপ-জঙ্গলে ফলে থাকা সুস্বাদু কাউ-বরই-ভেউয়ার ফল ! কোথায় সেই হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়িহীন সমাজ , ব্রাহ্মণ-জেলে-কুমোর মিলেমিশে একসঙ্গে বসবাস ! এক স্বপ্নের বাগান যেন ছারখার হয়ে যায় কদরর্য কূটনৈতিক ঝড়ে ।
সংলাপ-প্রধান এই উপন্যাসে আছে এক দুরন্ত গতি । পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার শেষ হয়ে যায় নিমেষে । বাহুল্যবর্জিত , সোজা-সরল গদ্য আর মরমি লেখনীর গুণে যেন সহজেই স্পর্শ করা যায় মূল কাহিনীকে । আর এর চরিত্রচিত্রণ তো যে কোনও নতুন ঔপন্যাসিকের কাছে শিক্ষণীয় ।
পড়তে পড়তে আনন্দ হয় , বিষাদ জাগে ; আক্ষেপও হয় — এমন হওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল ? ঝিনুকের অসীম যন্ত্রণা , বিনুর দ্বিধা-দোলাচল , যুগলের স্বপ্ন , হেমনলিনীর সংকীর্ণতা , অবনীমোহনের বিশাল রূপান্তর — নাড়িয়ে দিয়ে যায় যেন ভিতর থেকে । অনুভব হয় — সত্যিই তো , কী জানতাম আমরা ? দেশভাগের দরুণ উৎপন্ন হওয়া কষ্টের মূল যে কোন গভীরে প্রোথিত — সেটা কতটুকু বুঝতাম ?
উপন্যাসের শেষেই আছে পরের খন্ড ' শতধারায় বয়ে যায় ' -এর ইঙ্গিত । সে আলোচনা পরে কোনওসময় ।
তবে মূল্য বিচার করলে কিন্তু বইয়ের প্রোডাকশন আরও ভাল হতে পারত । বিশেষ করে পৃষ্ঠা , প্রচ্ছদ এবং বাঁধাই । কিছু জায়গায় ছাপা অস্পষ্ট , ' উ-কার ' আর ' ঊ-কার ' অদৃশ্য , কোলন ( : ) আর বিসর্গ ( ঃ ) গুলিয়ে গেছে । এরকম একটি ক্লাসিক গোত্রের উপন্যাসে এগুলো না হওয়াই বোধহয় উচিৎ ছিল ।
আর উপন্যাসের কথা নতুন করে কী বলব ? সে তো একটা অজানা পথের জার্নি — সুখী থেকে অসুখী , অসুখী থেকে আর্ত , আর্ত থেকে উদ্বাস্তু হওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিশদ বিবরণ । ফিকশনের আদলে ধরে রাখা এক জ্বলন্ত সময়ের দলিল ।
বইটি শেষ করার সময় যেমন , ' ঝিনুক কোথায় গেল ? ' — এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য মনটা আকুলি-বিকুলি করে ওঠে ; তেমনই সেই স্নিগ্ধ রাজদিয়ার ( এখন হয়ত আরশিনগর-ই ) কথা ভেবে বুকটা হু-হু করে ওঠে । যদি আবার ফিরে আসত ওরকম গ্রাম , ওরকম ভেদাভেদহীন সমাজ , সরল মানুষের দল !
বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় , কোনও এক নদীর ওপারে অমন জায়গা হয়ত সত্যিই আছে । শুধু সেই নদী পেরোতে গেলে যে কেয়াপাতার নৌকাটা দরকার হয় — সেটাই হারিয়ে গেছে ।
প্রফুল্ল রায় নামটির সাথে আমরা খুবই ভালোভাবে পরিচিত। ওনার লেখা 'কেয়া পাতার নৌকো' বইটির কথা ছোটবেলা থেকে বহুবার শুনেছি, তবু নানা কারণে এতদিন পড়ে ওঠা হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের সময়ের ইতিহাস ভালো ভাবে পড়তে, ও সেই সময়ের সামাজিক চিত্র বিস্তরভাবে জানতে খুঁজছিলাম কিছু বই। তখন অনেকেই এই বইটির নাম উল্লেখ করেন। বইটি পড়ার পর বুঝতে পারলাম এতদিন একটি অমূল্য রত্ন থেকে বঞ্চিত ছিলাম। এবার ভণিতা না করে আসল কথায় আসা যাক।
'কেয়া পাতার নৌকো' ১৯৪০ সালের পটভূমিকায় শুরু। উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে দুটি চরিত্র - বিনু ও ঝিনুক। তাদের ঘিরে রয়েছে তাদের পরিবার ও ঢাকা জেলার রাজদিয়ার গ্রামবাসী। এই উপন্যাস তিনটি পর্বে বিভক্ত। গ্রাম বাংলার মোহময়ী রূপ কি সুন্দরভাবে যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বইয়ের পাতায় তা ব্যাখ্যাতিত।
প্রথম পর্বে মুগ্ধ হয়ে সেই রূপ শুষে নিয়ে 'প্রফুল্ল' করেছি চিত্ত ও মন। বিনুর পরিবার কলকাতা থেকে ঘুরতে আসে রাজদিয়ায়। সেখানে একে একে আমাদের সাথে আলাপ হয় হেমদাদুর, লালমোর সাহেবের সাথে। ছোট্ট বিনুর সাথে পরিচয় হয় ছোট্ট ঝিনুকের। আলাপ হয় সারা রাজদিয়াবাসীর সাথে। রাজদিয়া যেন একটি গ্রাম নয়, বিরাট আকারের একটি যৌথ পরিবার। এখনে এসে বিনুর বাবা মনস্থির করেন কলকাতা ছেড়ে এখনেই বসবাস করবেন।
দ্বিতীয় পর্বে সামাজিক চিত্র আসতে আসতে বদলাতে থাকে। বিশ্বযুদ্ধ কিভাবে গ্রামবাংলাকে বিদ্ধ করে তা দেখানো হয়েছে। বিনুদের বড় হওয়া, সাথে যুদ্ধের আবহাওয়া, দুর্ভিক্ষ, তারপর দেশের স্বাধীনতা।
তৃতীয় পর্ব অত্যন্ত মর্মান্তিক। দেশভাগ, রায়ট, এক ধর্মের মানুষের প্রতি অন্য ধর্মের মানুষের লাঞ্চছনা, অত্যাচার, কেমন যেন বদলে দেয় পরিস্থিতি। সোনার বাংলা তখন হয়ে ওঠে রক্তিম। দলে দলে হিন্দুরা কি নিদারুণ কষ্ট করে পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে উৎখাতিত হয়ে তখন পাড়ি দিচ্ছে পশ্চিম বাংলায়। একদা যাদের ছিল কানি কানি চাষের জমি, এখন তারা বাস্তুহারা হয়ে, হয়ে গেছে রিফিউজি। যাদের বাড়িতে অতিথি এলে কোনদিন খালিপেটে ফিরতেন না, তারা আজ দুমুঠো খাবারের জন্য রিফিউজি ক্যাম্প কিংবা স্টেশন চত্তরে লাইন দিয়ে থাকে। দেশভাগের পর ঢাকায় মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়ে ঝিনুক চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়। তাকে জীবিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনা গেলেও মানসিকভাবে সে একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তাই বিনু তার প্রিয় নারীকে নিয়ে যাত্রা করে কলকাতার উদ্দেশ্যে। সেই যাত্রায় পদে পদে যে কত বিপদ, কত মৃত্যুর হাতছানি, তা সব উপেক্ষা করে ঝিনুককে নিয়ে এসে পৌছয় কলকাতায়। এই যাত্রা যেন বিনুকে সাবালক করে তোলে, আমাদের কাছে সে হয়ে ওঠে বিনয়। কিন্তু তাও বোধহয় বিনয়ের জীবনশিক্ষার কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছিল, আর তাই তার হিসেবে অল্পবিস্তর গড়মিল হয়ে গিয়েছিল। অজানা অচেনা মানুষের কাছে যে সবসময় বিপদের সম্ভাবনা থাকবে সেটাও যেমন ঠিক নয়, তেমনি নিজের আত্মীয়পরিজনদেরও সবসময় কাছে টানার প্রয়াস থাকবে সেটাও তেমন বেঠিক। আর এই হিসেবের ভুলের জন্য পালটে যায় বিনু ও ঝিনুকের জীবন।
পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনসংগ্রাম এত স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা খুবই মর্মস্পর্শী ও মর্মভেদী। শেষে এইটুকু বলতে পারি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা এই উপন্যাসের চরিত্রগুলি কাল্পনিক হয়েও তাদের প্রত্যেকের জীবনের বিভিন্ন টানাপড়েন চোখে জল এনে দেয়। বইটি পড়��ে পড়তে এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে তার রেশ এখনও কাটেনি। এবং কাটাতেও চাইনি। শুধুমাত্র আর একটি কথা বলে শেষ করতে চাই, বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা, দেশভাগ বা পার্টিশন বাদ দিয়ে সোনার গ্রামবাংলার নির্মল রূপ জানার জন্য বাঙালি হয়ে একবার অন্তত এই বইটি পড়া দরকার।
প্রফুল্ল রায় কেয়াপাতার নৌকো-র (প্রথম খণ্ড) ভূমিকায় জানিয়েছিলেন, পঞ্চাশ সালে উদ্বাস্তু হয়ে চলে এসেছিলেন। দেশবিভাগের বেদনা ‘আমার স্মৃতি এবং অনুভূতিকে তখনও তীব্রভাবে বিদ্ধ করে চলেছে।’ ‘কেয়াপাতার নৌকা’ উপন্যাসের কাহিনির সূচনা উনিশশো চল্লিশের অক্টোবর। বারো বছরের বিনুর চোখ দিয়ে সময়কে দেখা এখান থেকেই শুরু হয়ে যায়। পার্টিশন তখনও অনেক দূরে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলা তখন অব্যাহত, তার ধাক্কা ভারতবর্ষে বিশেষ করে পূর্ববাংলার গ্রামগুলিতেও ক্রমাগত লাগছে। এর থেকেই আসবে মহামন্বন্তর, তার পরে যুদ্ধ-শেষ, দাঙ্গা, দেশবিভাগ। বারো বছরের বিনু বাবা অবনীমোহনের সঙ্গে যেদিন রাজদিয়ার স্টিমার ঘাটে নেমেছিল সেদিন তাদের ঘিরে শুধু রাজনাথের পরিবারই নয়, সমস্ত রাজদিয়াতেই যেন উৎসবের সূচনা হয়েছিল। আর বাইশ বছরের বিনুকে ‘রাতের অন্ধকারে, নিঃশব্দে সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে হচ্ছে। নিরানন্দ নিরুৎসাহ এই বিদায় বিনুর বুক অসীম বিষাদে ভরে যেতে লাগল।’ এই দশ বছরে রাজদিয়ার পরিবর্তন আসলে গোটা পূর্ববাংলার গ্রামসমাজের পরিবর্তন। রাজদিয়ার দাঙ্গা, হেমনাথের সামাজিক আধিপত্যের অবসান, সবকিছুই ইতিহাসের দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। প্রফুল্ল রায়ের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি রাজদিয়া বা হেমনাথের পরিসরের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দেশত্যাগের কারণ ও বেদনাটির যথার্থ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ‘কেয়াপাতার নৌকা’ নামটি প্রতীকী। কেয়াপাতা যেমন দুর্বল ও অস্থায়ী, তেমনি উদ্বাস্তুদের জীবনও অনিশ্চিত ও সংগ্রামমুখর। লেখক দেশভাগের ফলে ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের কষ্ট, তাদের দারিদ্র্য, নতুন জীবনে টিকে থাকার লড়াই এবং পরিবর্তিত সমাজে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টাকে অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটিতে দেশভাগ-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শরণার্থী সমস্যা এবং নতুন রাষ্ট্রে পরিচিত-অপরিচিত দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে যে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছিল, তা চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে। এই উপন্যাস শুধুমাত্র একটি গল্প নয়, এটি একটি সময়ের দলিলও বটে।
হ্যারি পটার’ এর বইগুলো একটানা পড়ে ফেললে বইগুলোর মধ্যে একটা ক্রমান্বয়িক টোনাল শিফট লক্ষ্য করা যায়। হ্যারি যত বড় হতে থাকে তত বইয়ের বিষয়বস্তু, লেখনী গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হতে থাকে। সেই একইরকম টোনাল শিফট আছে প্রফুল্ল রায়ের, ‘কেয়াপাতার নৌকো’ উপন্যাসে। অবিভক্ত পূর্ব-বাংলার রুপ-প্রাচূর্য্য, গন্ধ, মানুষে-মানুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ ভোর দিয়ে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে উপন্যাসটি দেশভাগের কালরাতের দিকে এগিয়ে যায়।
লেখক প্রফুল্ল রায়ের নিজের শৈশব-কৈশোরের বড় অংশ কেটেছে পূর্ব-বাংলায়। তিনি সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে, ‘যখন যা মনে পড়ে’ নামে অত্যন্ত সুখপাঠ্য এক বইও লিখেছেন। সেই বইখানা আগে পড়া থাকায় কেয়াপাতার নৌকো উপন্যাসটিতে বিনুর ছেলেবেলাতে যে লেখক নিজের হারানো সময়কে তুলে এনেছেন তা বেশ বুঝতে পেরেছি। তবে ‘যখন যা মনে পড়ে’ বইটা যে হ্যাপি নোটে শেষ হয়েছিল উপন্যাসে সেরকম ঘটেনি, এই উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব থেকে একদম শেষ পর্যন্ত মানুষের সীমাহীন দূর্দশা, শেকড় হারিয়ে উদ্বাস্তু বনে যাওয়া ‘রিফিউজি’ দের পায়ের তলায় একটুখানি মাটি খোঁজার সংগ্রাম উঠে এসেছে।
দেশভাগ এই উপন্যাসে আছে বেশ প্রবল ভাবেই আছে তবে কিনা কোথাও কোথাও একেবারেই নেই। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিংবদন্তী উপন্যাস ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’ তে যেমন পুরো উপন্যাস জুড়েই দেশভাগ, আমরা-তোমরা’র একটা চাপা গন্ধ পাওয়া যায় এই উপন্যাসে সেটা নেই। অবশ্য লেখার ধরণে দুই লেখকের ভিন্নতা অনেক। তবুও, যেহেতু মোটা দাগে দুটো বইয়ের বিষয়বস্তু প্রায় একই রকম তাই পাঠকের মনে তুলনা এসেই যায়। দেশভাগ, পূর্ব-বাংলার বর্ণনা, মানবিক সম্পর্কের স্বরূপ অন্বেষণ সবকিছু যদি বাদও দেই তবুও শুধুমাত্র ভাষার জোরেই ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’ অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। তবে, ‘কেয়াপাতার নৌকো’ পড়ে হতাশ হইনি। খুবই চমৎকার, সাবলীল লেখনী প্রফুল্ল রায়ের। বিশালাকার বই হলেও মাখনসম লেখার কারণে একটানে পড়ে ফেলা যায়।
সাহিত্যিক গবেষক নন। তবু কখনও কখনও মনে প্রশ্ন জাগে, এমন কীকরে হল? সমাজের ভাঙন, চল্লিশের দশকের বিভীষিকা, দেশভাগ। পূর্ববঙ্গের রাজদীয়ার প্রেক্ষিতে প্রফুল্ল রায়ও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন।
বইটা ত্রুটিপূর্ণ নয়। সুধা-সুনীতি পরস্পরের মধ্যে সম্ভাব্য প্রেমিক ছাড়া কিছু নিয়ে আলোচনা করে না। ছোটবেলার কৈশোরের বিস্ময় যে মনযোগ, যে বিস্ময় নিয়ে লেখাটা শুরু, সেই একই মনযোগ লেখার পরের দিকের অংশে নেই।
কিন্তু যা আছে, বিনুর চোখে যা রূপ, যা সুন্দর, যা টান। জলের দেশ, হাওরের দেশের যা সুন্দর বিবরণ, যা নিপুণ প্রাণের টান, তাই বা কম কী?
দেশভাগ নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম। তবে প্রথমদিকে মনে হচ্ছে ঘটনা একটু বেশি বর্ণিত হয়েছে। তা তাই হোক এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় তাই তো পাঁচ সেটার দিলাম। অবনী মোহন চরিত্রের উপর বিরক্ত, নিজের পুত্র সন্তানের উপর অবিচার,নিজে ব্যবসায় লস দিয়ে বাড়িটি বিক্রি করে সাধুর শিষ্য হবেন আর ছেলেটাকে গৃহহীন করে দিয়ে যাবেন। বাহ্। আদর্শ জনক। আর ঝিনুকের সাথে যা হয়েছে এটা দেশভাগকালীন বেদনাদায়ক সাধারণ ঘটনা
A beautiful picture of village life in East Bengal before the partition and during the partition days. It is quite different from that of West Bengal but somewhere it connects to all Bengalis. The description of foods is just too awesome. The book ended a bit suddenly for me but that maybe because it has a sequel.