১৯২৬ সালে সাইকেলে পৃথিবী পর্যটনে বেরিয়েছিলেন বিমল মুখার্জি (১৯০৩-১৯৮৭)। এর আগেই ১৯২১-১৯২৬ সালে সাইকেলে ভারত ভ্রমণ শেষ করেছেন। নামমাত্র অর্থ এবং অজানা জগতের প্রবল আকর্ষণ সম্বল করে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন বিমল মুখার্জি। আরব,ইরান,সিরিয়া,তুরস্ক,ব্রিটেন,আইসল্যান্ড,নরওয়ে,সুইডেন,ফিনল্যান্ড,রাশিয়া,গ্রীস,ইজিপ্ট,সুদান,ইতালি,সুইজারল্যান্ড,ফ্রান্স,ডেনমার্ক,জার্মানী,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,কলম্বিয়া,ইকুয়েডর,পেরু,হাওয়াই দ্বীপ,জাপান,চীন,হংকং,ভিয়েতনাম,থাইল্যান্ড,মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ ঘুরে ভারতে ফিরে আসেন ১৯৩৭ সালে। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ভূ-পর্যটনের বিপুল ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা বিমল মুখার্জি লিপিবদ্ধ করেছেন এই বইয়ে। লেখকের পুত্র সিদ্ধার্থ দাস মুখার্জি এবং পুত্রবধু অনুরাধা মুখার্জি জানিয়েছেন, এই বইটির যে অল্পসংখ্যক কপি ছাপা হয়েছিল তা সম্পূ্র্ণ নিঃশেষিত। এখন আর পাওয়া যায় না। এঁদের সাগ্রহ সন্মতিতে 'দুচাকার দুনিয়া' ১৯৯৫-৯৬ এ ধারাবাহিকভাবে ভ্রমন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নামমাত্র সম্পাদিত ও কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে। ভ্রমন-অনুরাগী, অভিযানপ্রিয়, দূরাসক্ত বাঙ্গালীর জন্য বিমল মুখার্জির সাইকেলে দুঃসাহসিক বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা পরিবেশন করতে পেরে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। বইটিকে এককথায় বাঙ্গালীর জাতীয় সম্পদ বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।
Bimal Mukherjee (Bengali: বিমল মুখার্জী / বিমল মুখোপাধ্যায়) (1903–1996) was the first Indian globe trotter who travelled the entire world on a bicycle from the year 1926 to 1937. He wrote the book Du Chakay Duniya (দু'চাকায় দুনিয়া) about his experiences.
The world voyage started on bicycle from Town Hall, Calcutta on December 12, 1926 and halted at Chandannagar for the first night.
He and his three friends had crossed the Bohemian Alps in bicycles wearing flannel shirts and no woolen clothing in the month of December. They had kept warm by cycling vigorously and alternated keeping one hand in their pockets to prevent frostbite. When asked how they did the amazing feat. He had replied, "We are carrying the sun rays from India!".
পৃথিবী ভ্রমণে তো অনেকেই বের হয়। এখন যেমন প্লেনে চড়ে আয়েশ করে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার সুবিধা আছে, শতবর্ষ আগে তা সম্ভব ছিলো না। যাত্রীরা স্বভাবতই ছিলেন দুঃসাহসী। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে তারা দুর্গম গিরি কান্তার মরু পাড়ি দিতেন। বিমল মুখার্জি সাইকেলে চেপে বিশ্বভ্রমণে বের হন ১৯২৬ সালে, সঙ্গে ছিলেন আরো তিনজন। কিন্তু সেই ভ্রমণ সমাপ্ত করেন তিনি একা, ১৯৩৭ সালে। শুরুতেই "অবিশ্বাস্য " বিশেষণটা প্রয়োগ করলাম কারণ বিমল শুধু অকুতোভয় ছিলেন না। তিনি যেখানে গিয়েছেন সেখানকার ভাষা শিখেছেন, অনেক জায়গায় দীর্ঘদিন বাস করেছেন, তাদের সংস্কৃতি আয়ত্ত করেছেন। এ যেন এক জীবনের মধ্যে অনেক জীবন, এক মানুষের মধ্যে অনেক মানুষ। সাইকেলে যাত্রা করায় তার পরিশ্রম ছিলো দ্বিগুণ। মরুভূমি, পাহাড়, বরফাবৃত বিস্তীর্ণ এলাকা লেখককে সীমাহীন ধৈর্য ও কষ্টের সাথে পাড়ি দিতে হয়েছে। আফ্রিকায় তাকে এমনকি সিংহের সাথেও লড়াই করতে হয়েছে রাস্তা পার হওয়ার জন্য! বেঁচে যে ছিলেন সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। (তখনকার অনেক মানুষই একরোখা প্রকৃতির ছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। যা করবে বলে একবার স্থির করেছে তা যে কোনো মূল্যে করতেই হবে - মনোভাবটা এমন।) লেখক মাছ ধরা জাহাজের নাবিক থেকে শুরু করে কৃষক, ফটোগ্রাফার, ব্যাংকার-ও হয়েছেন ভ্রমণের টাকা জোগাড় ও নতুনত্বের স্বাদ নেওয়ার জন্য। সেই অস্থির সময়ে পথে সাক্ষাৎ পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, হিটলার, মুসোলিনিসহ অনেক বিখ্যাত ও কুখ্যাত মানুষের। প্রায় পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্রও তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। লেখকের গদ্যভাষায় খুব একটা মাধুর্য নেই। কিন্তু ভণিতাহীনতা, সততা ও বর্ণিল ঘটনার গুণে তার লেখা টানা পড়ে ফেলা যায়। এ বইটা অবশ্যপাঠ্য।
“মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ হাতে আছে অচেনা এক শহরের ম্যাপ, ব্যাগ ঝুলিয়েছি কাঁধে, নামব রাজপথে চারিদিকে ঝলমলে রোদ কেটে যাবে আঁধারেরই ছায়া-অবরোধ...”
▪️▪️▪️
বছর শেষ করলাম চমৎকার একটা বই দিয়ে। বাঙালি সাহসী– এই কথা প্রমাণের জন্য ভারতবর্ষের চার যুবক ঠিক করল, তারা সাইকেলে চেপে বিশ্ব ভ্রমণে বের হবে। যদিও শেষপর্যন্ত চতুর্ভুজ দলটি টেকেনি। লেখক একাই তার মনের কথা শুনে এগিয়ে গিয়েছিলেন; আর লেখকের এই দুর্গম পথচলা পড়তে পড়তে ব্যাকগ্ৰাউন্ড মিউজিকে আমার মাথায় বেজে যাচ্ছিল ওই গানটি। লেখকের ক্ষেত্রে 'শহরের' জায়গায় 'পৃথিবী' হবে কেবল!
বিশ্বাস করা দায় যে, আজ হতে ৯৯ বছর আগের একটি যুবক এতটা সংকল্পবদ্ধ, অমিত তেজী হয়ে শুধু সাইকেলে ভর করে কঠিন কঠিন সব পথ, পর্বত পাড়ি দিয়েছেন, ভাষা শিখেছেন, নাচ শিখেছেন, সব সংস্কৃতি জানার-বোঝার চেষ্টা করেছেন, নানাভাবে আয়ের পথ করে নিয়েছেন। যেখানে যে কাজ পেয়েছেন, আনন্দের সাথে করেছেন। কী চ্যালেঞ্জিং জীবনটাই না তিনি কাটিয়েছেন এক যুগে!
লেখকের রচনার আড়ম্বরহীন ভাষা অনেকটাই পুষিয়ে দিয়েছেন তার অকপট সরল সব বর্ণনা দিয়ে। এজন্য পড়তে খুবই আনন্দ হয়। কিন্তু একটা জায়গায় এসে খট করে চোখে খারাপ লাগল। লেখক কায়রোতে গিয়ে সেই দেশের সভ্যতা, কৃষ্টি, দর্শনীয় স্থান, নারী-পুরুষ ইত্যাদি বলতে বলতে এক জায়গায় বলেছেন, '...মেয়েরা ভূতের মতো বোরখা পরে দোকান বাজার করছে। বোরখা আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। মনে হয় পুরুষের নারীর প্রতি কী অমানুষিক দুর্ব্যবহার। তারা চায় বলেই তো মেয়েরা পর্দার আড়ালে থাকে। ...' আরো কিছু লেখা ছিল। আমি বলতে চাইছি না, লেখক কেন মুসলিমদের পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে। আমি অবাক হয়েছি এটা ভেবে, লেখক যখন ইউরোপের দেশের নারী-পুরুষের অবাধ সম্পর্ক দেখেছেন, তাদের পোশাক দেখেছেন, তখন তা তার কাছে স্বাভাবিক লাগল। আবার উপজাতিদের কথা যখন বলেছেন–তারা উর্ধাঙ্গে কোনো কাপড় রাখেন না, তাও সবার কাছে স্বাভাবিক। তাহলে কায়রোতে বোরখা দেখলে তা তার কাছে ভূতের মতো লাগবে কেন? সে দেশের রীতিই হয়তো তাই। এটাও কি অন্যান্য দেশের মতো স্বাভাবিক চোখে দেখার কথা ছিল না?
যাই হোক, প্রতিক্রিয়া দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। বইটা অবশ্যই তালিকায় রাখার মতো। ১৯২৬-১৯৩৭ সময়কালে পৃথিবী কেমন ছিল, তার অনেকটাই প্রত্যক্ষ দলিল হিসেবে এই বই.. একসময়ের সবুজ পৃথিবী।
১৯২৬ সালে বিমলবাবু কলকাতা থেকে সাইকেল নিয়ে পৃথিবী ভ্রমনে বের হোন। পুরা দুনিয়া চক্কর দিয়ে একযুগ পরে দেশে ফিরে আসেন। কোথায় কীভাবে কোন পথে গেলেন, কী ঝামেলা হলো, সেখানে কি কি দেখলেন, কোথায় থাকলেন, সেখানকার লোকজন, সেখানে গিয়ে কি কি কাজকাম করে পয়সা জমালেন, কত কত বন্ধু বানালেন.... এই সকলতা নিয়েই লিখেছেন এই বই।
ত্রিশের দশকে এক বাঙ্গালিপুঙ্গব আর্সেনালের হয়ে অনুশীলন করেছিলেন, ভাবা যায়? লন্ডনের ক্লাবের হয়ে তাঁর সেই কীর্তির গ্যালারি থেকে সাক্ষী ছিলেন আরেক বাঙালি। ননী সিকদার নামের সেই ফুটবলার এখন হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতিতে।
ঠিক ওই সময় জার্মানির রাজপথ সরগরম করে রেখেছিলেন সরু গোঁফের এক ভদ্রলোক। আগুনঝরা বক্তৃতায় জার্মানদের রক্তে তুলেছিলেন জাতীয়তাবাদের নাচন। কে জানত, সেই আগুন একদিন লেলিহান শিখা হয়ে পুরো বিশ্বকে গ্রাস করবে?
বিমল মুখার্জির দুচাকায় দুনিয়া পড়তে পড়তে এরকম কত রোমাঞ্চ ছুঁয়ে গেল! ঘরকুনো হিসেবে বাঙালির দুর্নামটা আজকের কথা নয়। একসময় কালাপানি পার হওয়াটাকেই জাত চলে যাওয়া হিসেবে দেখা হতো। আর ওই যুগে বাঙালির বিশ্বভ্রমণ তো অভাবনীয় বললেও কম বলা হয়। ত্রিশের দশকে সেই অবিশ্বাস্য কাজটাই করেছিলেন বিমল মুখার্জি। তিন বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন বিশ্বভ্রমণে। সম্বল শুধু দুই চাকার সাইকেল।
ফিলিয়াস ফগ আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বাস্তবে সেই কাজটা শতগুণ কঠিন। বিমল তো সেটা হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছিলেন। মরুঝড়ে আরব মরভূমিতে মরতে বসেছিলেন, আল্পসের ওপর দেখেছেন তুষারঝড়। উত্তাল আটলান্টিকে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করেছেন, হিমশীতল গ্রীনল্যান্ডে গিয়ে থেকেছেন এস্কিমোদের বাড়িতে। পানির অভাবে, প্রচণ্ড গরমে বা ঠাণ্ডায় বেশ কয়েকবারই জীবন সংশয় হতে বসেছিল। কীভাবে কীভাবে যেন বেঁচে গেছেন প্রতিবারই।
কিছু বই রসোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে বর্ণনাগুণে। আর কিছু বই হয়ে ওঠে শুধু বিষয়বস্তুর জন্য। দুচাকায় দুনিয়া বইটা সুলিখিত নয়। অনেক জায়গাতেই বর্ণনা জোলো, কখনো কখনও একঘেয়ে। বিমল মুখার্জি দুনিয়াটা ঘুরে দেখেছেন মন ভরে। কিন্তু প্রায় সময়ই মনে হয়েছে অনেক কিছুই সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন। হৃদয়ঘটিত ব্যাপারের কিছু ইঙ্গিত ছিল, কিন্তু সেসবও খানিকটা আভাস দিয়ে বাকিটা রেখে দিয়েছেন উহ্যই। শুরুর দিকে যেরকম একটা রোমাঞ্চের ছোঁয়া ছিল, শেষদিকে এসেও সেটা অনেকটাই থিতিয়ে পড়েছে।
তারপরও দুচাকায় দুনিয়া শুধু তো বই না, একটা ঐতিহাসিক দলিল। ভ্রমণপ্রি��় বাঙ্গালির জন্য অবশ্যপাঠ্যও বটে।
আমার সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলীর "দেশে বিদেশে"র হাত ধরে। ভ্রমণ কাহিনী, সাথে বিদেশ বিভূঁইয়ের বৃত্তান্ত। সেই থেকেই এই ঘরানার লেখা অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে বেশি টানে আমাকে। কাছের মানুষ মাত্রই জানে আমার সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি আছে ভ্রমণগদ্য। তো হারুন ভাই যখন বিশাল স্তুতি গেয়ে এই বইটা সংগ্রহে নিতে বললেন, দ্বিতীয় চিন্তা করি নাই।
মুজতবা আলী সাহেব যে সময় দেশে বিদেশে, চাচা কাহিনী ও জলে ডাঙার মতো সেরা সেরা সৃষ্টিকর্মের রসদ যোগাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় আরেকজন ভেতো বাঙ্গালী, বিমল মুখোপাধ্যায় ঠিক করলেন সারা বিশ্ব ভ্রমণ করতে হবে। চার বন্ধুতে বেরিয়ে পড়লেন সাইকেলের পিঠে।
আক্ষরিক অর্থেই সারা পৃথিবী ঘুরলেন। মরুর দেশে গায়ে পোকা ধরলো, তীব্র তুষারে আবার সেই পোকা মরল। আরব শেখের সাথে ভূরিভোজ করলেন, আবার অভুক্ত থেকে পার করলেন রাতের পর রাত। চলতি পথে নতুন দেশে গিয়ে নতুন ভাষা শিখলেন, নতুন নতুন বন্ধুত্ব পাতালেন। অর্থাভাবে বিচিত্র সব কাজ করলেন - বক্তৃতা, ফটোগ্রাফি; হলেন রাখাল, নাবিক, জেলে, ব্যাংকার। নর্ডিক সাগরে মাছধরা নৌকায় যেমন বেগার খাটলেন, ডেনমার্কে তেমনি শিখলেন উড়োজাহাজ চালানো, কাটালেন রাজপুত্তুরের মতো স্বপ্নের জীবন। তবে কারো বাঁধনে না জড়িয়ে সংকল্পে অবিচল থেকে শেষ করলেন বিশ্বভ্রমণ।
আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের কাহিনী (১৯২৬-১৯৩৭)। একদম মেদহীন অল্প কথায় বর্ণনা, তবে খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন, যেন পাঠকমাত্রই সবকিছু চোখের সামনে দেখতে পাবে। এত্ত তথ্য, চিন্তা আর দর্শন আছে এরি মাঝে, সেটা না পড়লে বোঝা যাবে না। একই সাথে এটি সারা পৃথিবীর ঐ সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক তথা ইতিহাসের দলিল। অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকায় এই বইটি রেখে একটুও আশাহত হবেন না।
"ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনের সুন্দর একটা অধ্যায়ের সূচনার সাক্ষী এই বইটি"
১৯২৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর; নামমাত্র অর্থ আর অজানা জগতের প্রবল আকর্ষণকে সম্বল করে সাইকেল নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন বিমল মুখার্জি। পিছনে ফেলে গেলেন সুহৃদদের কান্না, আর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মাকে। সাথে তিন বন্ধু - অশোক মুখার্জি, আনন্দ মুখার্জি আর মণীন্দ্র ঘোষ। বাঙ্গালীর ঘরকুনো অপবাদ ঘুচানোর তাগিদ নিজেদের চওড়া কাঁধে সওয়ার করে চার তরুণ ঘর ছাড়লেন সাইকেলে চড়ে বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। তারপর মহাকালের বিশাল ভাণ্ডার থেকে অতিক্রান্ত হয়েছে একযুগ সময়; ভোলগা, রাইন, নীল নদ দিয়ে কতটা পানি গড়িয়েছে সে হিসেব না রেখে বিমলরা শুধু এদেরকে অতিক্রম করে গেছেন। শুধু নদ নদী অতিক্রম করলে কি আর পাত্তা পাবেন?! তাই অতিক্রম করেছেন আল্পস, আন্দিজ পর্বতমালা, পার হয়েছেন থর, সাহারা, গোবি মরুভূমি; এগিয়ে গিয়েছেন প্রশান্ত, আটলান্টিকের বুক চিরে। ১৯৩৭ সালে ঘরে ফেরার আগে সাথের তিনজনকে রেখে এসেছেন এখানে সেখানে যেখানে সুবিধাজনক জায়গা পেয়েছেন আর বিমল হয়ে এসেছেন বিশ্বজয়ী, অতিক্রম করে এসেছেন সবগুলো মহাদেশ আর নিজের যৌবনের সবটুকু সময়।
১৯২৬ শে শুরু করে ১৯৩৭ এ এসে ভ্রমণ শেষ করার দীর্ঘ ৫০ বছর পর বিমল মুখার্জি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন তার অবিস্মরণীয় সেই ভ্রমণের আদ্যোপান্ত। প্রতি সপ্তাহে মাকে একটা করে চিঠি লিখতেন। স্মৃতি থেকে তুলে আনা রসদ আর চিঠির সহায়তায় বই লেখার পিছনে উৎসাহ ছিল বিমলের মায়ের। আর সেই উৎসাহেই বাংলা সাহিত্য পেলো এক অসাধারণ ভ্রমণ কাহিনী।
ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে কিছু বলতে গেলে লেখক কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কিভাবে গিয়েছেন সেটা না বলে অন্য কিছু বলার সুযোগ কম। একটু বড় হয়ে যাওয়া এই রিভিউতে এসেও আমাকে তাই বলতে হয়েছে, যদিও শেষ করে মনে হয়েছে যে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে বিমল মুখার্জি গিয়েছেন তার একাংশও আমি বর্ণনা করতে পারিনি। কোথায় গিয়েছেন আর কি করেছেন সেটা যেহেতু বলার চেষ্টা করেছি কাজেই এই রিভিউকে কেউ স্পয়লারের দোষে দুষ্ট বলতে চাইলে অনায়াসে বলতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের অবস্থানও স্পয়লার বিপক্ষে, স্পয়লারকে ভয় পেলে আপনার আর সামনে না পড়াই উত্তম।
ঘর ছেড়ে বের হয়ে বিমলরা কলকাতা থেকে করাচী এসে পৌঁছান ভারতের বুক চিরে, মাঝ বরাবর পথ দিয়ে। ঘরের পাশের স্থান বলেই হয়ত এই সব জায়গার বিস্তারিত বর্ণনায় বিমল যাননি। করাচী পৌঁছাতে সিন্ধু নদ পার হন রেল ব্রিজের উপর দিয়ে, ভাগ্যটা যে ভালো ছিল সেটা না বলে উপায় নেই! সে সময় যদি ব্রিজে ট্রেন চলে আসত তাহলেই বিশ্ব ভ্রমণের সেখানেই ইতি টেনে চার তরুণের সিন্ধু নদ দিয়ে কিভাবে পানি বয়ে যায় সেটা পর্যবেক্ষণ করতে হত। মূলত করাচী থেকেই শুরু হয় তাদের সত্যিকারের ভ্রমণ। ডেক প্যাসেঞ্জার হিসেবে জাহাজ পরিষ্কার করার কাজ নিয়ে চড়ে বসেন বসরা যাবার এক জাহাজে; পাড়ি দেন ওমান সাগর, পার্সিয়ান সাগর।
বসরা থেকে বাগদাদে রওয়ানা হন মরুভূমির উপর দিয়ে, রাত কাটান মরুর খোলা বুকে দিগন্ত বিস্তীর্ণ তারকারাজিকে ছাদ বানিয়ে আর বেদুঈন তস্করদের পাশে নিয়ে। মরুভূমিতেই আক্রান্ত হন ফুড পয়েজনিংয়ের, ৮/১০ বছরের পুরাতন টিনের সার্ডিন ফিস খেয়ে মারা যেতে যেতে কোনক্রমে সে যাত্রা টিকে যান। তারা যেমন টিকে যান, তেমনি তাদের গায়েও টিকে গিয়ে আবাস গড়ে তোলে মরুভূমির এক ধরণের পোকা, যার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র সমাধান জামা পুড়িয়ে ফেলা। এই পোকা গায়ে নিয়েই একসময় তারা সিরিয়া পৌঁছান আর আক্রান্ত হন অন্য এক পোকার আক্রমণের। পায়ের চামড়া ফুটো করে এই পোকা এক দিক দিয়ে প্রবেশ করে আরেকদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়, একমাত্র চিকিৎসা - পায়ের হাঁটু পর্যন্ত ভেড়ার পুরনো চর্বি মাখিয়ে পায়ে দড়ি বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা।
সিরিয়াতে এসে আতিথ্য গ্রহণ করেন আরব শেখদের কাছে, সিরিয়া পাড় হয়ে তুরস্কে গিয়ে করেন হাজতবাস। রুমির আনাতোলিয়া পার হয়ে বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি পার হবার সময় অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন সেমিনার আয়োজন করে শুনিয়েছেন তাদের ভ্রমণ কাহিনী। সাইকেল কাঁধে করে আল্পস পাহাড় অতিক্রম করতে গিয়ে পড়েছেন তুষার ঝড়ে। তবে আল্পসের হিমশীতল শীতলতায় এসে একটা লাভ হয়েছে - মরুভূমির ১৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইটে যে পোকাগুলো তাদের শরীরে বাসা বেঁধেছিল আল্পসের -৩০ ডিগ্রীতে এসে সেগুলো অকাল মৃত্যু বরণ করে বঞ্চিত হয় বিশ্ব ভ্রমণের আনন্দ থেকে। আল্পস পার হয়ে জার্মানিতে এসে তারা কিছুদিন বিশ্রাম নেন, অর্থ উপার্জন করেন জার্মান রেডিওতে ভ্রমণ কাহিনী বলে। জার্মানি এসে একদিন ঘুরতে ঘুরতে দেখা পান এক অষ্ট্রিয়বাসী ইন্টেরিয়র ডিজাইনার এবং রঙ মিস্ত্রির যে কিনা লোকজন জড়ো করে ভাষণ দিয়ে জনমত গড়ে তুলছে ইহুদীদের বিরুদ্ধে। সেই অষ্ট্রিয়বাসীর নাম হিটলার (১৯২৭)। জার্মানি থাকাকালীন সময় অর্থের জোগানের জন্য কিছুদিন বিমল কে কাজ করতে হয় বরফ পরিষ্কার করার ঝাড়ুদার হিসেবে।
মণীন্দ্রকে জার্মানিতে রেখে হল্যান্ড হয়ে একসময় তারা ইংল্যান্ড আসেন আর ইংল্যান্ড থেকে বিশ্ব ভ্রমণকে ইস্তফা জানিয়ে পাকাপাকিভাবে বসবাস করার জন্য অশোক ও আনন্দ চলে যান ব্রাজিল। এখান থেকে বিমলের ভ্রমণ শুরু হয় একা, সম্পূর্ণ একা…
সঙ্গী সাথী��ের হারিয়ে সাথে সাথেই বিমল তার একেক যাত্রা শুরু করেননি, কিছুদিন ব্যাঙ্কের চাকরী করেছেন, একি সাথে ব্যাঙ্কিংয়ের উপর পড়াশোনা। এরই মাঝে মরুভূমির বালি ঠেলে সাইকেল চালানোর খেসারত দিতে হয় দু পায়ে গ্রোয়েনের অপারেশন করে ৬ মাসের জন্য বিছানায় পড়ে থেকে। একটু সুস্থ হয়ে উঠতে না উঠতেই আবারো দুর্ঘটনা, এবার আর সাইকেলে না একেবারে ট্রেনে। এক্সিডেন্টের ১০ মিনিট আগে এক মহিলা বিমলের সাথে আসন পরিবর্তন করেন, দশ মিনিট পরের এক্সিডেন্টে স্ট্রেচারে করে সেই মহিলাকে নিয়ে যাওয়া হয় মর্গে; বিমলকে হাসপাতালে।
ইংল্যান্ড থেকে ওয়েলস হয়ে হেরিং মাছ ধরার নৌকায় চড়ে আসেন আয়ারল্যান্ড, এরপর স্কটল্যান্ড হয়ে মাছ ধরার জাহাজে কাজ নিয়ে চলে আসেন আইসল্যান্ড, শুরু হয় তার ভ্রমণের রোমাঞ্চকর এক অধ্যায়ের। আইসল্যান্ডের তীব্র শীতে বরফ কেটে চলা জাহাজে ছয় মাস কাজ করেন মাছ ধরা জেলে হিসেবে, বরফ শীতল আবহাওয়ায় বিক্ষুব্ধ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে কাটানো এই ছয়মাস অভিজ্ঞতা আর অর্জনের দিক দিয়ে ডাঙ্গায় কাটানো ছ’বছরের চাইতেও বেশি মূল্যবান। আইসল্যান্ডের মাছ ধরার জাহাজ থেকেই স্প্যানিশ জাহাজে চেপে চলে আসেন গ্রিনল্যান্ড। এসে কাজ নেন ২৫০০/৩০০০ ফুট বরফের নিচে ক্রিয়োলাইট খনির শ্রমিক হিসেবে। থাকেন ইগলুতে, শিকার করেন শ্বেত ভল্লুক।
এরপর স্ক্যানডেনেভিয়ান নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ঘুরে আসেন রাশিয়ায়; সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের কুচকাওয়াজে। ইউক্রেন, গ্রীস, মিশর, সুদান হয়ে পাড়ি দেন সাহারা মরুভূমি, করেন মাষাই উপজাতিদের সাথে বসবাস, সিংহ শিকার। তানজানিয়া হয়ে ভিক্টোরিয়া ফলস যাবার পথ তার পথ আগলে রাখে সিংহের দল, তিন দিন অবস্থান করেও যখন দেখেন সিংহ পথ ছাড়তে রাজি নয় তখন ভিক্টোরিয়া ফলস দেখার ইচ্ছা ত্যাগ করে মিশর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া হয়ে চলে আসেন ইতালি। আর কি ভাগ্য, তার আসার অপেক্ষাতেই যেন ভিসুভিয়াস অপেক্ষা করে ছিল, বিমল আসলেন আর সে অগ্ন্যুৎপাত শুরু করল।
জার্মানি থাকাকালীন যেমন তার সুযোগ হয়ে উঠেছিল হিটলারকে জনসমাবেশ করতে দেখার, ইতালিতে এসে তেমনি পেয়ে যান মুসোলিনীর জনসভা। ইতালি থেকে আল্পসের সুড়ঙ্গ দিয়ে চলে আসেন সুইজারল্যান্ড, ততদিনে পার্টিতে নাচার কলাকৌশল রপ্ত করে নিয়েছিলেন, আর এবারে হাতেখড়ি হল নাচের মঞ্চে মারামারির।
সুইজারল্যান্ডের পুলিশের দেশ না ছাড়ার মৌখিক নিষেধাজ্ঞা পেয়ে সময় কাটাতে সঙ্গী যোগাড় করে চলে যান বরফের পাহাড় জয় করতে। পূর্বের কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও জয় করে ফেলেন ভেতার হর্ণ, শ্রেক হর্ণ, এঙ্গেল হর্ণ। অবিশ্বাস্যে আমার মতো যাদের চোখ কপালে উঠে গেছে তারা চাইলে ভেতার হর্ণের লগবুকে জয়ী মাউন্টেনিয়ারদের তালিকায় খুঁজে দেখতে পারেন বিমল মুখার্জির নাম আছে কিনা?
এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে থিতু হয়েছেন ডেনমার্কে এসে। পালক বাবা-মা, গরু, ছাগল, হাস, মুরগীর খামার, প্রিয় ঘোড়া প্রিন্স, প্লেন, ইয়ট নিয়ে গড়ে তোলা রাজত্বে অবস্থান করেন প্রায় দুই বছর, তারপর আবার সেই দেশ ভ্রমণের নেশা রক্তে নাচন শুরু করলে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে পাড়ি জমান আমেরিকার দিকে। আটলান্টিক পাড়ি দিতে গিয়ে পড়েন বিক্ষুব্ধ ঝড়ের কবলে, কোনরকমে প্রাণটাকে হাতে নিয়ে হাচড়ে পাঁচরে আমেরিকা গিয়ে পৌঁছান। কানাডা, মেক্সিকো, কিউবা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ হয়ে ঘুরে বেড়ান দক্ষিণ আমেরিকার পুরোটা, পাড় হন আন্দিজ পর্বতমালা। পেরুতে প্রবেশের আগে দিতে হয় পাগলের সার্টিফিকেট, বংশে কোন পাগল থাকলে পেরুতে তখনকার সময়ে প্রবেশ নিষেধ ছিল। এই জায়গায় এসে মনে হয়েছে লেখক তাড়াহুড়ো করেছেন। ইউরোপের বর্ণনায় বইয়ের ৭০% দখল করে ফেলার পর তার হয়তো মনে হয়েছে বই বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, অল্প কিছু লাইন দিয়ে একেকটা দেশের বর্ণনা করেই অল্প কিছু পাতা লিখেই লেখক দক্ষিণ আমেরিকা থেকে জাহাজে চড়ে জাপান চলে এসেছেন। জাপান এসে লেখকের মনে হল অনেক তো ঘুরে এবার বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি, আর তো দেরী করা যায় না, চিন, হংকং, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা হয়ে হুট করেই মনে হল লেখক যেন কলকাতাতে চলে আসলেন।
দীর্ঘ ১২ বছরের এই ভ্রমণে বিমল মুখার্জি অর্থ উপার্জনের জন্য ফটোগ্রাফার, নাবিক, জেলে, পাইলট, ঝাড়ুদার, শিক্ষক, খামারের কর্মচারী সহ অসংখ্য পেশায় কাজ করেছেন। বাধ্য হয়ে শিখেছেন আরবি, জার্মান, রুশ, ফ্রেঞ্চ, ড্যানিশ ভাষা। বাক্য, শব্দের গঠন আর বর্ণনা গুনে হয়তো এই ভ্রমণ কাহিনী অবিস্মরণীয় নয়, তবে বিষয়বস্তুর কারণেই বিমল মুখার্জির এই বই ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বেদুঈনের সাথে বসবাস, আরব শেখের আতিথেয়তা, আল্পস পর্বতমালা অতিক্রম, আইসল্যান্ডের মাছ শিকার, গ্রিনল্যান্ডে বসবাস, সুইজারল্যান্ডে পর্বত শিখরে উঠার সংগ্রাম, ডেনমার্কের খামার জীবন, আটলান্টিকের বিক্ষুব্ধ জলরাশি অতিক্রম বা আন্দিজের রুক্ষতাকে জয় করার প্রতিটি ঘটনাকেই চাইলে লেখক আলাদা আলাদা বই হিসেবে প্রকাশ করতে পারতেন।
এই দীর্ঘ ভ্রমণের মাঝে বিমল বরফ পাহাড়ের আইসিকল বেয়ে এক চূড়া থেকে আরেক চূড়ায় গমন করেছেন, দেখেছেন পর্বতের চূড়া থেকে সূর্যাস্তের অপার্থিব সৌন্দর্য, আরক্তিম অগ্নিবর্ণের প্লাবনে ভেসে যাওয়া অন্তরীক্ষ, সুনীল মহাসমুদ্রের দানবিক উল্লাসে মেতে উঠা, সবুজ বনভূমির হয়ে উঠা নিষ্ঠুর নির্জন। উপভোগ করেছেন বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠের হাস্যোজ্জল দোলা, অবারিত প্রান্তরের অসীমতা, শান্ত সরোবরের স্থিরতা, ব্যস্ত জনপদের উল্লাস। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছেন মরুভূমির রুক্ষতায়, আল্পসের কাঠিন্যে, আইসল্যান্ডের শীতলতায়, গ্রিনল্যান্ডের একাকীত্বে, আফ্রিকার দুর্গম বনভূমিতে গোপনে লুকিয়ে থাকতে। এতো দুর্দান্ত, রোমাঞ্চকর, বিপদসংকুল আর প্রাণবন্ত জীবন বিমল মুখার্জি এক জীবনেই কাটিয়ে গিয়েছেন। এক জীবনে বৈচিত্র্যময় বহু জীবন পার করা বিমল মুখার্জিকে তাই শুধুই ঈর্ষা।
বিমল মুখার্জির দুচাকায় দুনিয়া বইখানা পড়ার জন্য হাতে নিয়েছিলাম সেই সেপ্টেম্বরে কিন্তু শেষ করা হয়নি। আস্তে ধীরে দু-চার পাতা পড়ে পড়ে শেষ হলো এই নভেম্বরে। এর মাঝে পড়া হয়ে গিয়েছে ষোলখানা বই। ব্যাপারটা এমন না যে বইয়ের লেখনীতে গতি নেই কিংবা পড়তে বিরক্তির উদ্রেক হচ্ছে। কিন্তু তাও কেন জানি বইটা পড়া আগাচ্ছিলো না।
১৯২৬ সালে বিমল মুখার্জির সাইকেল চালিয়ে পুরো দুনিয়া ঘুরে দেখার আখ্যান মলাটবন্দী হয়েছে এই বইয়ে। ভারত থেকে আরব, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, ব্রিটেন, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, রাশিয়া, গ্রিস, ইজিপ্ট, সুদান, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, হাওয়াই দ্বীপ, জাপান, চীন, হংকং, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙাপুর ঘুরে ভারতে ফিরে আসেন প্রায় ১১ বছর পর ১৯৩৭ সালে। নাম কামান প্রথম ভারতীয় ভূ-পর্যটক হিসাবে।
বইয়ের লেখনীশৈলী এক কথায় সরল এবং চমৎকার। পড়তে পড়তেই চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম বিমলের ভ্রমণ। বইখানা নেহায়েত শুধু ভ্রমন কাহিনী নয়; বইটি শেখায় স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথ তথা নিজের উপর বিশ্বাস রেখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
আত্মজীবনীমূলক বইপ্রেমী কিংবা ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য মাস্ট রিড একটা বই নিঃসন্দেহে বিমল মুখার্জির দুচাকায় দুনিয়া।
কখনো কখনো লেখক যা বলতে চান তার সাথে সাথে যা বলতে চান নি সেটিও বড় প্রকট হয়ে উঠে। প্রথম ভারতীয় ভূপর্যটক বিমল মুখার্জি দীর্ঘ ১১ বছর ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের ৪৬ টি দেশ (যুগোস্লাভিয়া বাদে বর্তমান মানচিত্রে)। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত সাইকেল ও পায়ে হেঁটে এইসব দেশ ভ্রমণ করেন। নিজের ভ্রমণকথা লিপিবদ্ধ করেছেন 'দুচাকায় দুনিয়া' গ্রন্থে। অথচ পুরো ভ্রমণকাহিনী জুড়ে ওনার ভারতীয় বাঙালি ব্রাউন রঙ ও চেহারার জন্য মাত্র দু'টি স্থানে বিব্রত অবস্থায় পড়বার ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
একটি ঘটনা ঘটে সুইৎজারল্যাণ্ডে যেখানে একজন ব্রিটিশ নাগরিক বিমল মুখার্জির সাথে নৃত্যরত অবস্থায় বন্ধু হানিকে ধাক্কা মারে এবং গায়ে থুতু ছিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। হানির অপরাধ ছিল একজন ভারতীর ব্রাউন লোকের সাথে ইউরোপিয়ান রমনী হওয়া সত্ত্বেও হৃদ্যতা দেখানো এবং নাচ করা।
অন্য ঘটনাটি ঘটে সিঙ্গাপুরে। ওখানকার একটি ক্লাব ছিল শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত। প্রবেশ করে চাইলে নেপালি দরোয়ান উপযুক্ত আচরণ করে নি।
ভ্রমণ বর্ণনার পাশাপাশি প্রচুর আড্ডা, আথিতেয়তা, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা, সাহায্যের গল্প আছে পুরো বইটি জুড়ে। কিন্তু বর্ণবৈষম্য কিংবা অন্যায্য আচরণের ঘটনা পুরো বইজুড়ে এসেছিল মাত্র এই দু'টি। আমার বিশ্বাস লেখক এমন অনেক ঘটনা ভ্রমণবৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে এড়িয়ে গেছেন। সব ঘটনা লিখলে হয়তো বইটির আকার আরও এক-দেড়শ পৃষ্ঠা দীর্ঘ হতো।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা প্রথম ভূপর্যটক হিসেবে লেখক ইচ্ছে করেই হয়তো এসব নিয়ে বেশি বলতে চান নি। মরুভূমির তীব্র রুক্ষ রূপ, বরফ দেশের প্রচণ্ড কষ্টসহিষ্ণুতা, সমুদ্রের উত্তাল ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা, গ্লেসিয়ার পাহাড়ে বিপদজনক অভিযাত্রা কোন কিছু বর্ণনায় লেখক কার্পণ্য করেন নি। কিন্তু লেখক সম্ভবত চান নি ভবিষ্যতের ভারতীয় ভূপর্যটকরা মানুষের প্রতি আস্থা হারাক। কারণ অচেনা দেশ, গ্রাম, পথে মানুষই মানুষের একমাত্র আশ্রয়।
লেখক ও ভূপর্যটক বিমল মুখার্জি বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক মানচিত্রে যেসব দেশ ভ্রমণ করেছেন তার একটা তালিকা আমি ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি। এখানে একটি সমস্যা হল, লেখক কখন কিংবা কোন সালে কোন দেশ ভ্রমণ করছেন সেটার উল্লেখ করেন নি। কোথাও কোথাও ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন মাত্র। তবুও আমি চেষ্টা করে লেখক কোন দেশ থেকে কোন দেশ গেছেন সেই ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে সাজাতে। সময়ের সাথে সাথে সীমান্ত পরিবর্তনের সাথে সাথে দু একটি বর্তমান রাষ্ট্র বাদ যেতে পারে। অন্য রাষ্টের অধীন দ্বীপগুলো এখানে অনুপস্থিত থাকবে।
১. পাকিস্তানঃ ব্রিট্রিশ ভারতের অংশ। ২. ইরাকঃ সাইকোস-পিকোতে চুক্তি অনুযায়ী তখন ইরাক অটোমান শাসন থেকে ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্ভুক্ত। ৩. সিরিয়াঃ সাইকোস-পিকোতে চুক্তি অনুযায়ী তখন ইরাক অটোমান শাসন থেকে ফরাসি কলোনির (ফ্রেন্স লিজিয়ন) অন্তর্ভুক্ত। ৪. তুরস্কঃ কামাল পাশা আর্তাতুকের শাসনামল। ৫. বুলগেরিয়া। ৬. যুগোস্লাভিয়াঃ পূর্ব ইউরোপের এই ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীরসংযুক্ত রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব ছিল ১৯১৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে সাতটি রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করেছে। সেগুলো যথাক্রমেঃ স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, মন্টেনেগ্রো, সার্বিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া এবং কাসাভা। ৭. হাঙ্গেরি। ৮. অষ্ট্রিয়া। ৯. জার্মানিঃ হিটলার তখন উদীয়মান জার্মান নেতা। লেখকের সাথে সাক্ষাতের উল্লেখ আছে। ১০. হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস)। ১১. ইংল্যান্ডঃ এখানে লেখক দীর্ঘ একটা সময় কাটান। এখানে ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে লেখকের। পরের বছর সাক্ষাৎ পান মাহাত্ম্য গান্ধীর। ১২. আয়ারল্যান্ড। ১৩. স্কটল্যান্ড। ১৪. আইসল্যান্ড। ১৫. গ্রীনল্যাণ্ড। ১৬. নরওয়ে। ১৭. সুইডেন। ১৮. ফিনল্যান্ড। ১৯. ইউক্রেনঃ তখন সোভিয়েত রাশিয়া অংশ। ২০. রাশিয়াঃ সোভিয়েত ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন লেখক। ২১. গ্রীস। ২২. মিশর। ২৩. সুদানঃ তখন অখণ্ড ছিল৷ দক্ষিণ সুদানের কথা আলাদা করে উল্লেখ করলাম না। ২৪. কেনিয়া। ২৫. লিবিয়া। ২৬. ইতালিঃ ফ্যাসিবাদী দলের প্রধান বেনিতো মুসোলিনি তখন ক্ষমতায়। ২৭. সুইৎজারল্যাণ্ড। ২৮. ফ্রান্স। ২৯. স্পেন। ৩০. ডেনমার্কঃ সম্ভবত বইটির সুন্দরতম অংশ আকসেল পরিবারের সঙ্গে এখানে। আলসারের সমস্যার জন্য লেখক এখানে ভ্রমণের দীর্ঘতর একটা সময় কাটান। আকসেল দম্পতি লেখককে সন্তানতুল্য ভালোবাসা দিয়েছিলেন। অনেককিছুর সাথে প্লেন অবধি উপহার দিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন লেখক ওখানে থিতু হন। ৩১. আমেরিকা। ৩২. মেক্সিকো। ৩৩. কিউবা। ৩৪. পানামা। ৩৫. কলম্বিয়া। ৩৬. ইকুয়েডর। ৩৭. পেরু। ৩৮. জাপান। ৩৯. চীনঃ শাসক চিয়াং কাইসেকের বিরুদ্ধে মাও জে দঙ তখন চীনের চাষীদের নিয়ে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ৪০. ইন্দোচীন (ভিয়েতনাম)। ৪১. কম্বোডিয়াঃ তখনো ইন্দোচীনের অংশ। ৪২. থাইল্যান্ড। ৪৩. মালয়েশিয়া। ৪৪. সিঙ্গাপুর ৪৫. ইন্দোনেশিয়া। ৪৬. শ্রীলঙ্কা।
ভারত ভূপর্যটক নিজের দেশ বিধায় এই তালিকায় আর যুক্ত করলাম না। আশা করি, পাঠকদের বিশেষ করে ভ্রমণপিয়াসী পাঠকদের বইটি ভাল লাগবে। মিলিয়ে দেখতে পারবেন এসব দেশের একাল ও সেকাল।
১৯২৬ সালে বিমল মুখার্জি আরও কয়েকজনকে নিয়ে সাইকেলযোগে বিশ্বভ্রমণে বের হোন। লেখকের মুন্সিয়ানায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে সে সময়টা। এ সময় তিনি দুর্গম মরু থেকে শুরু করে তুষারঝরা এলাকা অতিক্রম করেছেন। বেদুইনের তাঁবু থেকে শুরু করে এস্কিমোর ইগলুতেও রাত কাটিয়েছেন। সে সময়টার নামকরা বেশ কয়েকজন মানুষের সাথেও তাঁর দেখা হয়েছে। তিনি সরাসরি হিটলার, মুসোলিনির ভাষণ শুনেছেন। হিটলারের সাথে তো সরাসরি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎ করেছেন আইরিশ জাতির প্রাণপুরুষ ডি ভ্যালেরার সাথে। এছাড়াও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল ফিনিশ অলিম্পিক প্রতিযোগী পাভো নুরমির সাথে। তিনি যে পরিমাণ কষ্ট সহ্য করেছেন এ ভ্রমণ করতে তা এখনকার সময়ে ভাবতেই অবাক লাগে। নিঃসন্দেহে সুখপাঠ্য একটা বই।
আমার প্রিয় বন্ধু আমাকে ���ার নিজের বইটি উপহার দিয়েছিল। এই বই একটি মনের সাবলীল আনন্দের মতো। লেখক কত ঘুরেছেন সাইকেলে, কত মানুষের সাথে দেখা, কত রীতিনীতি, কত অনুভূতি। এই বই অবশ্যই পড়া উচিত। তবে বন্ধুকে বই ফেরত দিতে হচ্ছেনা, এব্যাপারে বেশ আনন্দ পেয়েছি।
জীবনানন্দের উনিশশো চৌত্রিশের কবিতাটির কয়েকটা পংক্তি আমার অত্যন্ত পছন্দের৷ গভীরভাবে অচল না হলেও, মাঝে মাঝে একটু জিরিয়ে নেয়া নতুন উদ্যমে নতুন কিছু শুরু করার প্রেরণা যোগায়। তাই থেমে নিজের মনের খোরাক মেটানোর সামগ্রী জোগাতে আমি আরো একটা স্থির জিনিস, বই পড়তে বসি৷ অদ্ভুতভাবে আমার প্রিয় জনরার অন্যতম হচ্ছে ভ্রমণকাহিনী। অচল হয়ে বসে থেকে অত্যাশ্চর্য সচলতার কাহিনীগুলো আমার হুট করে না বের হতে পারা সত্তাকে এক ধরনের স্বস্তি দেয়। অন্তত আমি বইয়ের মাধ্যমেই পৃথিবীটা একটুখানি চেখে দেখি। বিমল মুখার্জির দুচাকায় দুনিয়া বইটার নাম শুনেই প্রবল আগ্রহ অনুভব করি কারণ গ্লোব ট্রটাররা কী করেন তা জানার আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিলেন সোনার কেল্লার মন্দার বোস। একে বাঙালি, তায় সাইকেলে চেপে গোটা পৃথিবী ভ্রমণ তাও সেই ১৯২৬ সালে! এটা কী মুখের কথা। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং ১৯২৬-১৯৩৭ এর পৃথিবী এবং মানুষের কথা জানার আগ্রহ না হওয়ার কোন কারণ নেই। প্রতিষ্ঠিত কোন লেখক না হলেও নিজের অভিজ্ঞতা এত সাবলীলভাবে ব্যক্ত করেছেন তিনি যে বইটা হাতে নিলে রাখা যায় না। সাইকেলে ভারতবর্ষ ঘুরে দেখার পর চার বন্ধু ঠিক করলেন সাইকেলে চেপেই পৃথিবী দেখবেন৷ যেমন কথা তেমন কাজ। চার বন্ধু পকেট প্রায় শূন্য নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। প্রথমে করাচিতে। মরুভূমির জীবন অতি কষ্টের, স্নান না করে থাকায়, গরমে গায়ে পোকা। এইসব নিয়েই কষ্ট করে হলেও নিজেদের সংকল্প ছাড়েন নি। একে একে পরিচিত হয়েছেন নানা কিসিমের মানুষের সাথে, আরব বেদুইনদের সাথে। ঘুরে বেড়িয়েছেন একের পর এক দেশ৷ এক পর্যায়ে আলাদা হয়ে যেতে হয়েছে চার ভূপর্যটককে। পকেট শূন্য হলেও জেদ ছাড়েননি বিমল মুখার্জি৷ জীবিকা অর্জনের জন্য কখনও ফটোগ্রাফার, কখনও পাইলট, কখনও শিক্ষক, কখনও করেছেন জাহাজে কাজ। যা পেয়েছেন, খেয়েছেন৷ কত অপূর্ব হৃদয় এর সন্ধান পেয়েছেন, আতিথেয়তা পেয়েছেন৷ নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হয়েছে। এত আগে ভিসার কড়াকড়ি ছিল না, সেটা একটা সুবিধা। আরো অদ্ভুত ব্যাপার, লেখককে খুব বেশি বর্ণবৈষম্যের শিকারও হতে হয়নি৷ নানান অসামান্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে মুক্ত হয়েছেন নানান সংস্কার থেকে৷ একমাত্র অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি সব দেশেই গেছেন, যা দেখেছেন তার প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন, ইতিহাস বয়ান করেছেন সংক্ষেপে৷ লেখকের মা তাঁকে বই লিখতে প্রেরণা জুগিয়েছেন৷ দীর্ঘ বারো বছর ধরে পাঠানো সমস্ত চিঠি জমিয়ে রেখে ধরে রেখেছেন সময়টাকে। যেটা ব্যবহার করে লেখক ভ্রমণ শেষ করার প্রায় ৫০ বছর পর সৃষ্টি করেছেন এই অনবদ্য অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রচনা। ভালো লেগেছে একজন মানুষের নিজস্ব স্বপ্ন পূরণের গল্প, শত কষ্ট আর প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও৷ বাংলা সাহিত্যেও বইটা একটি অমূল্য সংযোজন।
১৯২৬ সালে বিমল মুখার্জী নামের এক সাহসী মানুষ একদিন ঠিক করলেন সাইকেল চালিয়ে পুরো দুনিয়া ঘুরে দেখবেন। না আছে ইন্টারনেট, না আছে মোবাইল, না আছে স্পন্সর। নামমাত্র অর্থ আর অজানা জগতের প্রবল আকর্ষণ সম্বল করে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। আরব, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, ব্রিটেন, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, রাশিয়া, গ্রিস, ইজিপ্ট, সুদান, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, হাওয়াই দ্বীপ, জাপান, চীন, হংকং, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ ঘুরে ভারতে ফিরে আসলেন ১৯৩৭ সালে। আমার তো দেশগুলার নাম বলতে গিয়েই হাঁপানী উঠে যাচ্ছে। আর এই ব্যাক্তি এগুলো ঘুরে আসলেন, তাও আবার সাইকেলে চড়ে। প্রথম ভারতীয় হিসাবে ভূ-পর্যটনের বিপুল ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা বিমল মুখার্জী লিপিবদ্ধ করেছেন এই বইয়ে।
বইটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো, আমি নিজেই যেনো তার পিছনে একটা সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোথাও মানুষ তাকে খাওয়াচ্ছে, কোথাও তাড়িয়ে দিচ্ছে, কোথাও গরমে অতিষ্ঠ, আবার কোথাও ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শুধু বিমলবাবু না। তার সাথে আমিও এইসবের প্রত্যক্ষদর্শী।
এই বইয়ের সবচাইতে ভালো দিক হচ্ছে, লেখাটা খুবই সরল। সাহিত্যিক কোনো জটিলতা নাই, একদম আপন করে নেয়া যায়। প্রত্যেকটা লাইন যেনো একটা কল্পনার দুনিয়া খুলে দেয়।
সবচেয়ে বড় কথা, এই বইটা শুধু বিদেশ দেখা শেখায়নি। শিখিয়েছে, স্বপ্ন দেখা আর তার বাস্তবে রূপ দেয়াটা।
সবমিলিয়ে, চমৎকার একটা বই। পড়ে ফেলুন। আপনিও 'অসাধারণ' বলতে বাধ্য হবেন। তো কি বলেন? হয়ে যাক বিশ্বভ্রমণ?
এই বইটা ছোটবেলার সেই প্রিয় খাবারটার মতো যেটা লুকিয়ে রেখে একটু একটু করে খেতাম। যেন দ্রুত শেষ না হয়ে যায়। প্রায় শতবছর পূর্বে একজন বাঙালি শুধু একটা সাইকেলের ভরসায় পৃথিবী ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। এটা আজকের দিনে চিন্তা করাও কেমন অকল্পনীয় মনে হয়। অথচ বিমলবাবু তা করে দেখিয়েছেন। আর এই সাইকেলে পৃথিবী ভ্রমণে বিমল বাবুর সময় লেগেছে প্রায় এক যুগ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে শুরু করে অসহনীয় গরমের মরুর দেশ, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ আর সেসব দেশের কৃষ্টি, কালচার সহ বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার বৃত্তান্ত ও তুলে এনেছেন লেখক। বেশ উপভোগ্য আর চমকপ্রদ বইটা।
১৯২৬-১৯৩৭,প্রায় ১ যুগে সাইকেলে বিশ্বভ্রমণের এক সুনিপুণ কর্মকার এবং -১ম ভারতীয় ভূপর্যটক।
“দুচাকায় দুনিয়া” বইটি শুধু একটি ভ্রমণ কাহিনী নয়, বরং তা জীবনের এক গভীর অভিজ্ঞতার নিরীক্ষণ। এই বইয়ের মাধ্যমে, লেখক বিশ্বভ্রমণের মাধুর্য ও অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন, যেখানে তিনি শুধু ভূগোলের সীমা অতিক্রম করেননি, বরং সময়, ইতিহাস, সমাজ এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি তার অভিজ্ঞতাও সন্নিবেশিত হয়েছে। লেখক তার সাইকেল যাত্রার মাধ্যমে পৃথিবীর নানা দেশ, সংস্কৃতি, মানুষ এবং তাদের ভাবনা-চিন্তার অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরেছেন।
বইটির পটভূমিতে লেখকের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ভ্রমণ নয়, বরং গভীরভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ করা। ভ্রমণ থেকে যে দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তা-ভাবনা জন্ম নিয়েছে, তা বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠায় প্রতিফলিত হয়েছে।
বইটির অন্যতম বিশেষত্ব হলো লেখকের বিভিন্ন মহৎ ব্যক্তিত্বদের সাথে সাক্ষাৎ। লেখক যে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজের ভাবনা এবং বিশ্ব ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হয়েছে। তিনি জার্মানির হিটলারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখানে মানবাধিকারের উপর হিটলারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনাও করেন। এছাড়াও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং উদয়শঙ্করের মতো ভারতীয় সাংস্কৃতিক জগতের গুরুর সাথে লেখকের সাক্ষাৎ ঘটে। সাহিত্য, সংগীত, মানবতাবাদ, এবং সংস্কৃতির প্রতি তার গভীর ভালোবাসা এবং চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে বিমল মুখার্জি যা আলোচনা করেছেন, তা পাঠককে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের কর্ম ও দর্শন বুঝতে সাহায্য করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘এ বিশ্বে যেসব মানুষ মানুষের উপকারে আসে, তারা কখনও একা আসে না—তাদের সাথে আসে মানবতা, সংস্কৃতি এবং শুভেচ্ছা।’ বিমল মুখার্জি, রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যের গভীরতা অনুভব করে তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে তুলে ধরেছেন যে, ভ্রমণ কেবল স্থানান্তরের বিষয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং মানবিক সমঝোতার মাধ্যম। লেখকের ভাষা সহজ, গভীর এবং সাহিত্যিক, যা পাঠককে চিন্তার গভীরে ডুবিয়ে দেয়। লেখক কোনো প্রকার একতরফা কিংবা সহজভাবেই ঘটনা তুলে ধরেননি। প্রতিটি দেশের ইতিহাস, সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সংস্কৃতির গভীরতায় তিনি প্রবেশ করেছেন।
সবশে���ে, *"দুচাকায় দুনিয়া"* বইটি শুধুমাত্র একটি ভ্রমণ কাহিনী নয়, এটি একটি মানবিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক অনুসন্ধান। লেখক তার ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জীবন, সামাজিক বাস্তবতা, এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। এটি একটি মস্তিষ্ক ও মনকে সজাগ করে তোলার অভিজ্ঞতা, যেখানে ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি এবং মানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা রয়েছে।
বাঙ্গালি যে ভীতু ঘরকুনো জাতি না এবং পরের প্রজন্ম কে অভিযানকেন্দ্রিক করার উদ্দেশ্যে ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৩৭ প্রায় একযুগ দুচাকায় ভর দিয়ে চারজন অভিযাত্রিক দুনিয়া ভ্রমণ করেছেন । পড়তে পড়তে হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই সময়ে।কখোনো ভারতবরষের রাজাদের শিকার, বাসরার মরুভূমিতে অনন্তকাল, মেসোপটেমিয়া , হারুন আল রশিদের বাগদাদ , ফরাসী শাসনভুক্ত সিরিয়া ; আবার কখনো বুল্গেরিয়ার তুষারপাত, হাঙ্গেরীর শীতের রাতে চাষীর ঘরে পাদ্রির রবীন্দ্র সাহিত্য তরজমা ইত্যাদি । রবির ভাষায় জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,. চিত্ত ভাবনাহীন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'বন্দী বীর' কবিতায় লিখেছিলেন, 'জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।' অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভূপর্যটক বিমল মুখার্জি ঠিক জীবন-মরণকে পায়ে ঠেলে একটি সাইকেল,দু'পা আর তিনসঙ্গীকে নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ফিরেছেন একযুগ বাদে। "দুচাকায় দুনিয়া" ভ্রমণের রোমাঞ্চকর কীর্তি নিয়েই 'প্রথম' ভারতীয় ভূপর্যটক বিমল মুখার্জির ৩২৪ পাতার এই বই। 'বাঙালি ঘরকুনো' এ বদনামের ভাগিদার বেশিরভাগ বাঙালি।কিন্তু যাঁরা ব্যতিক্রম, তাঁরা 'পায়ের তলায় সর্ষে' নিয়ে জন্মেছেন। এঁদের ই দলভুক্ত বিমল মুখার্জি। ১৯২৬ সালে কলকাতা থেকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে রওনা হলেন অজানার পথে। ভ্রমণসঙ্গী আরও তিনজন থাকলেও তাঁদের কথা বিশেষ একটা লিখেন নি। মূলত,বিমল মুখার্জি তার নিজের ভ্রমণকাহিনীই বিশদ বর্ণনা করেন। ভারত পেরিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত দারুণ ছিল পর্যটকদলের অভিজ্ঞতা। যেখানেই যাচ্ছেন মোটামুটি হৈ চৈ পড়ে যাচ্ছে। রাজগজারা পর্যন্ত তোয়াজ করতে থাকে। কিন্তু যখন পৃথিবীর পথে নামলেন অর্থাৎ ভারতবর্ষ পেরিয়ে সিরিয়ার বসরাতে নামলেন। তখন শুরু হল আসল ভ্রমণ। গেল শতকের বিশের দশকে সিরিয়া ছিল ফ্রান্সের কবলে। আসলে, পয়লা মহাযুদ্ধে তুরস্কের পতনে সিরিয়াসহ অনেক অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে যায় তুরস্কের। সেই এলাকাগুলো যুদ্ধেজয়ী মিত্রপক্ষ ভাগ করে নেয়। বসরাতে নেমে অনেক বাঙালির জাত ভাইয়ের সাথে মোলাকাত হয়। কিন্তু তারা বেশিরভাগই মানবেতর জীবনযাপন করছিল বলে উল্লেখ করেছেন বিমল মুখার্জি। 'পিকচার আভি বাকী হ্যায় মেরে দোস্ত ' - একথার সুর টেনে বিমল মুখার্জি নিয়ে গেলেন বেদুইনের দেশে।সাইকেলে মরুভূমি পার হতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলেন কত ধানে, কত চাল। আহ! মরু পার হবার সেই রোমহর্ষক বয়ান পড়তে গিয়ে ' ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুয়িন' - এই বেদুইন হওয়ার ভূত মাথা থেকে পালিয়ে আরব মরুভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে! দিনে ১৩৫-১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপ দিয়ে চলছেন সূর্য্যিমামা, আর রাতে পড়ছে তীব্র ঠান্ডা। তারওপরে আছে বেদুইন ডাকাতদলের পাল্লায় পড়ায় শঙ্কা। মোটামুটি শোচনীয় অবস্থা। একইসাথে লেখক স্মরণ করেছেন, বেদুইনদের জীবনযাপনের কথা,তাদের কষ্টের কথা আর এক শেখের সাথে বন্ধুত্বের স্মৃতি। সিরিয়ায় তখন ফরাসিদের উপনিবেশ। তবে লেখক বিস্মিত হয়ে এও দেখেছেন ফরাসি আর সিরিয়দের মাঝে সম্পর্কটা ঠিক যেন প্রভু-ভৃত্যের নয়। অথচ ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষে অন্যরকম দেখেছেন। নিজেরা ফরাসি সেনাদের টহলদলের ছাউনিতে কাটিয়েছেন। ভীষণ যত্নআত্তি পেয়েছেন। সিরিয়ার সাথে লাগোয়া সীমান্ত তুরস্কের। কামাল পাশার তুরস্কে নব নব বিধান আরোপ করছেন, জাতীয়তাবোধ জাগাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বভাবতই তুরস্কের শত্রুরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে আগত পর্যটকদলকে ভালোভাবে নেয়নি তুর্কি সীমান্তরক্ষী বাহিনী। তুরস্ক পেরিয়ে পূর্ব ইউরোপে প্রবেশ করলেন বিমল মুখার্জি ও তার সঙ্গীরা। বুলগেরিয়া সীমান্তে ছাড়পত্র পেলেন প্রবেশের। অর্থাভাবে খাবার জোটাতে পারছেন না। মুসকিল আসান হল। কিন্তু কীভাবে? এভাবে- 'আমাদের অর্থাভাবে খাবার জোগাড় করার সঙ্কট খানিকটা মিটত পাকা বড় বড় আঙুর খেয়ে। রাস্তার দুধারে যত ইচ্ছা খাও কেউ কিছু বলবে না। ' বুলগেরিয়া পেরিয়ে যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি। সাইকেল চালিয়ে, এদিক-সেদিক তাকিয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল দিন।হঠাৎ হালকা পেঁজা তুলার মতো তুষার আবিষ্কার করলেন।বেশ ফুর্তি লাগছিল মনে।ছন্দপতন হল। বিমল মুখার্জির মুখে- 'বাস্তবিক যখন বরফের মধ্যে চলতে আরম্ভ করলাম তখন সাইকেল নিয়ে চরম দুর্দশা শুরু হল। সাইকেলশুদ্ধ কেবলই আছাড় গেলাম, রাস্তা যেহেতু খুব পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে। অবশেষে আমরা হেঁটে চলতে লাগলাম।ক্রমে ক্রমে হাঁটাও অসম্ভব হয়ে উঠল। ' সেই তুষারপাতের মধ্যেই চলতে হয়েছে।থামতে পারেন নি তুষার গলে যখন বরফের কাঁদা জমেছে তখনও। এক বাড়িতে আশ্রয় নিতে গেলেন আশ্রয়দাতার স্ত্রী এলেন ঝাড়ু নিয়ে। আরেক চাষী অবশ্য সমাদর করে নিজ বাড়িতে নিয়ে গেল। সেই বাড়িতে খুব যত্ন।গৃহকর্ত্রী ভারতবর্ষের কথা শুনেছেন। জানেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথাও। এরকম অনেকবার হয়েছে লোকে ভারতবর্ষের নাম শুনেছে। আর নাম শুনেছে রবীন্দ্রনাথের। তাঁর কবিতাও নিজ ভাষায় অনূদিত হওয়ার কারণে অনেকেই বেশ খাতির করেছে কবিগুরুর দেশের লোক বলে।দুষ্টলোকে বলবে, সবই নোবেলের মহিমা! অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানি এলেন।পকেট অনেকটা গড়ের মাঠ।রেডিওতে জার্মান ভাষায় বেসুরে গলায় রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করে টুপাইস পকেটে এল।শহর ঘুরতে বেরুলেন।হঠাৎ- ' আমি ঘুরতে ঘুরতে মস্ত এক বিয়ার হাউসের সামনে পৌছেছি, একদল লোক পিছুপিছু আসছিল। আমাকে একরকম ভিড়ের ঠেলায় বিয়ার গার্ডেনের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল। সেখানে একজন অস্ট্রিয়াবাসী লেকচার দিচ্ছিল। শুনলাম তার নাম হিটলার।.... একজন নেতা হবার ইচ্ছায় জার্মানির ও জার্মানদের গুণগান গাইছে।... আরো শুনলাম যে, যুদ্ধে হারার জন্য নাকি ইহুদিরা দায়ী। তারা শত্রুরা করে মিত্রপক্ষের হাতে জার্মানদের হার ঘটিয়েছে।তাদের উৎখাত করতে হবে। সবাই খুব তারিফ করছে সেই বক্তৃতার। ' দেশ থেকে টাকা পাঠাবার কথা ছিল।সে কথা কেউই মনে রাখেনি। একরকম রিক্তহাতে তো ভ্রমণ চলে না। সঙ্গীরা আলাদা হয়ে গেলেন।কিন্তু বিমল মুখার্জি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।এই প্রত্যয়ের জোরেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন জগৎ।জীবিকার তাড়নায় ফটোগ্রাফি শিখেছেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে খাস ইংরেজজাতকে খুঁজে পেয়েছেন ভিন্নভাবে।অপরকে শোষণ,নিপীড়ন চালায় যে জাত, সেই জাতই নিজ দেশে জাতপাত মানে না। ভারতবাসীকে ভৃত্য মনে করেনা - এমন ধারণা পেয়েছেন। বন্ধু নৃত্যশিল্পী উদয়শংকরের সাক্ষাৎ পেয়েছেন।আবার রওনা দিয়েছেন বিশ্বভ্রমণে। আইসল্যান্ডে এস্কিমোদের বাড়ি ইগলুতে থেকেছেন। খনিতে কাজ করে পয়সা কামিয়েছেন। মাছ ধরার জাহাজে দিবারাত্রি খেটেছেন। তবুও দেশভ্রমণের ভূত ছাড়তে পারেন নি।ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ডের নৈস্বর্গিক পরিবেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে, দুঃখবোধ করেছেন স্বদেশের দুর্দশার কথা ভেবে। ' যস্মিন দেশে যদাচার'- রীতি মেনেছেন অক্ষরে অক্ষরে। তাই ফিনল্যান্ডে দিগম্বর হয়ে সাউনাবাথ নিতে আপত্তি করেন নি। ধনবান হেক্কাট পরিবারের একজন সদস্যের মতো তাদের ডেইরিফার্মে কাজ করেছেন,বিমানচালনা শিখে রীতিমত প্যাসেঞ্জার ঘুরিয়ে টাকা জোগাড় করেছেন। একই বিমল মুখার্জি রাশিয়া সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের কমিউনিজমের মহাযজ্ঞ দেখেছেন মুগ্ধ নয়নে।ধনী-নির্ধনের বিভেদ রুশদেশে ঘুছে গেছে বলে প্রশংসা করেছেন। আবার এও লক্ষ্য করেছেন- ' নিজেকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য রুশ অসংখ্য ট্যাংক তৈরি করছে।আমি অল্পদিন রাশিয়াতে থেকেছি,কিন্তু আমার চোখে এটি স্পষ্ট রাশিয়াকে যে আক্রমণ করবে সে ভুল করবে।' নিজের এই পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টির পরিচয় অনেকবার বিমল মুখার্জি দিয়েছেন। ইতালিতে গিয়ে সাবেক এই রোমান সাম্রাজ্য ঘুরে ঘুরে দেখেছেন।বুঝতে পেরেছেন ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির শাসনব্যবস্থা,শোষণবিধি।লক্ষ করেছেন স্বৈরাচার মুসোলিনি চারদিকে শৃঙ্খলা বিধানে ব্যস্ত। সারাদেশই যেন এক সেনানিবাস। আবার জাপানে গিয়ে বুঝলেন এঁরা দুনিয়ার সবচে' ভদ্র জাতি,সবাই বিনয়ী, পরিশ্রমী।কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তো আমাদের ভিন্নতথ্য দেয়।যুদ্ধের তোড়জোড় লক্ষ করেছিলেন বিমল মুখার্জি।তাই লিখেছেন, ' জাপানে সর্বত্র জাহাজ তৈরি করছে পুরোদমে।যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। লোকেদের সঙ্গে আলোচনা করেছি যে জাপানিরা তো বৌদ্ধ,তবে যুদ্ধ ও হিংসার মনোবৃত্তি কেন।বেশিরভাগ লোক উত্তর দিত যে তারা যুদ্ধ বিগ্রহ চায় না শান্তিতে থাকাই তাদের উদ্দেশ্য। একথাও স্বীকার করত যে আর্মি এখন গভর্নমেন্টের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তাদের খুশিমতো অনেককিছু হচ্ছে তাতে জনগণের সমর্থন থাক,আর নাই থাক।' ডাচদের উপনিবেশ সাবেক ইন্দোনেশিয়া, চীন আর শ্রীলংকা হয়ে দীর্ঘ বারো বছর পর বাড়ি ফিরলেন বিমল মুখার্জি। এই বই বিমল মুখার্জি লিখেছেন তার ভ্রমণ শেষ করার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর। এতো সময় পরে খুঁটিনাটি মনে রেখে কীভাবে লিখলেন তা পরিষ্কার করেন নি লেখক।এখানেই আস্থার অভাব তৈরির সুযোগ করে দেন বিমল মুখার্জি। তিনি জাতলিখিয়ে নন, তাই লেখার হাত নিয়ে আলোচনা বরং থাকুক। আর যেখানেই গিয়েছেন কিছু গৎবাঁধা ঘটনার বর্ণনা তা নিয়ে লিখেছেন। একেবারে বিশেষ কিছু যাঁরা খুঁজবেন 'প্রথম' ভারতীয় ভূপর্যটক বিমল মুখার্জি তাঁদের বেশি একটা খুশি করতে পারবেন বলে মনে হয় নি।যেখানেই গিয়েছেন সেখানকার সবই দেখেছেন লেখক। তবুও সেই দেখার মাঝে গভীরতার অভাব পাঠক হিসেবে আমার চোখ এড়ায় নি। এবং তাতে অখুশি যে খানিকটা হইনি তা অস্বীকার করছি না। তবুও এমন হাত-পা সম্বল করে পৃথিবী ভ্রমণে যে বঙ্গসন্তান বেরিয়ে পড়েছিলেন তার জীবনকথা নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর।
এখনকার যুগে ভ্রমণ অনেক সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার কারণে যেকেউ যেকোনো সময় ভ্রমণে যেতে।কিন্তু সালটা যদি হয় ১৯২০-১৯৩০ তখন না ছিল ভালো রাস্তা না ছিল প্লেন তখন কয়জন পৃথিবী ভ্রমণে যেতে চাইতেন?আর আদোও পুরো পৃথিবী ভ্রমন করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।তখনকার কথা চিন্তা করলে পৃথিবী ভ্রমন মোটামুটি অসম্ভব ই বলা চলে।কিন্তু সে অসম্ভব কে করি দেখিয়েছেন আপনার আমার মতো একজন বাঙালি বিমল মুখার্জি। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি সাইকেলে চড়ে ভ্রমণ করেছেন।
১৯২১-১৯২৩ সালে সাইকেলে ভারত ভ্রমণ শেষে তার ইচ্ছা হয় পৃথিবী ভ্রমণের। যেই কথা সেই কাজ ১৯২৬ সালে তারা চার জন বন্ধু বের হয়ে পড়েন পৃথিবী ভ্রমণের উদ্দেশ্য। কিন্তু তিনি ছাড়া কেউ শেষ পর্যন্ত তাদের উদ্দেশ্যে সফল হতে পারেননি। ভ্রমণের জন্য দরকার টাকা অনেকে তাদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউ শেষ পর্যন্ত সাহায্য করেননি তিনি নিজেই নিজের উপায় বের করে নিয়েছেন।মরুভূমির গরম থেকে আইসল্যান্ডের ঠান্ডা সবকিছুই তিনি অনুভব করেছেন।তার পৃথিবী ভ্রমণে সময় লেগেছিল ১১ বছর।
এই দীর্ঘ সময়ে কি দারুন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনি অতিবাহিত করছেন বই না পড়লে সেটা জানা হতো না।উপার্জনের জন্য কত ধরনের কাজ করেছেন তিনি কখনো ফটোগ্রাফার, কখনো নাবিক,কখনো পাইলট আরও কত কি।রবিন্দ্রনাথ থেকে হিটলার কত ব্যক্তিদের সাথে তার দেখা হয়েছে।সেকি দারুণ অভিজ্ঞতা।
বইটা পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল দারুন। জানি না কখনো পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারবো কিনা কিন্তু লেখকের সাথে আমি কল্পনায় ভ্রমণ করে ফেলেছি।
বিশ্ব ভ্রমণের দারুণ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে এখনই পড়ে ফেলুন "দুচাকার দুনিয়া"।
বাঙালি নেহাতই ভীতু, কুনো এবং ঘরমুখো এই বদনাম ঘোচাবার জন্য ১৯২৬ সালে বিমল, অশোক, আনন্দ ও মনীন্দ্র নামে চার বাঙালি যুবক পৃথিবী ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তাদের বাহন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন কলকাতার টাউন হল থেকে। ইন্টারনেট বিহীন যুগে জীবনের পরোয়া না করে পরিবার পরিজন ছেড়ে পাড়ি জমানো চারটি কথা নয়। পথে বিমল মুখার্জির বাকি তিন বন্ধু কিছু দেশ ভ্রমণ করে হাল ছেড়ে দিলেও তিনি একাই তার ভ্রমণ চালু রাখেন। একে একে ভ্রমণ করেন এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার নানান দেশ। টাকার জন্য কখনো কাজ করেছেন জেলে নৌকায় নাবিক হিসাবে, কখনো ফটোগ্রাফার হিসাবে, কখনো বক্তৃতা দিয়ে কিংবা ডেইরি ফার্মে কাজ করে। প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন সময় শিখেছেন আরবি, ফরাসি, স্প্যানিশ সহ বিভিন্ন ভাষা। প্রায় এক যুগ ধরে তিনি ভ্রমণ করতে থাকেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
বাংলা সাহিত্যে অনেক বিখ্যাত ভ্রমন সম্বন্ধীয় বই রয়েছে তবে এই বইটির নাম তেমনভাবে আলোচনা হয়না। লেখক তার ভ্রমণ শেষ করার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ১৯৮৬ সালে বইটি লেখেন তার মায়ের কথা রাখতে। ততদিনে লেখকের নাম মানুষ প্রায় ভুলে গিয়েছে। তাই হয়তো বইটি তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। পরে আউট অফ প্রিন্ট হয়ে যায়। এর বেশ পরে ১৯৯৫-১৯৯৬ তে আবার নতুন করে প্রকাশিত হতে থাকে একটি ম্যাগাজিনে।
ভ্রমণ কাহিনী পড়তে আমার বেশ ভালো লাগে। বিমল মুখার্জির লেখার মান খুব ভালো। একটি লাইন ও পড়তে বিরক্ত লাগে নি। দুচাকায় দুনিয়া বইটি বাংলা সাহিত্যে অন্যতম সেরা ভ্রমণ গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি পাবে বলে আশা করি। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বইটি শেষ করলাম।
কী সুন্দর একটা বই! ভ্রমণকাহিনি আগে থেকেই পছন্দ। তখন ১৯২৬ সাল। অপরীসীম সাহস ও তুমুল ইচ্ছাকে পুঁজি করে কলকাতা থেকে বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে কয়েকজন যুবক। তারপর কত দেশ, কত চড়াই-উতরাই, কত অজানা, কত ছাড়াছাড়ি, কত মায়ার বাঁধন। হিটলারের সাথে বিমল মুখার্জির দেখা হওয়ার পার্ট টাও বেশ লেগেছে। তারপর দীর্ঘ সময়ের অবসানে শেষের দিকে যেন মনে হচ্ছিল লেখকের সাথে সাথে আমিও হৃদয়ে একটা টান অনুভব করছি।
আর বিমল মুখার্জি। এই অসীম সাহসী বাঙালি লোকটি যে কীরকম ব্যক্তিত্বপূর্ণ ছিলেন তা বইটি পড়তে পড়তে বুঝাই যায়।
বইটি বন্ধুর হলের টেবিলে দেখেছিলাম অনেক দিন আগে। এর আগে আমি জানতাম ই না বিমল মুখার্জির নাম । এ ও জানতাম না যে চারজন বাঙালির একটি দল চারটি সাইকেল আর অল্প কিছু সম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো দুনিয়াটা দেখবে বলে। সেই ১৯২৬ সালে। কি ভীষণ রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় ভরপুর সে ভ্রমণ! আমার এই সক্ষমতায় সে বর্ননা কুলোবে না। বইটি পড়তে মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে আসলেই এতোসব কিছু ঘটেছিলো তাদের সে যাত্রায়! এ তো সিনেমাকেও হার মানায়! যেন এক অবাস্তবের ডানায় ভর করে অবিশ্বাস্য কাজ কর্ম করে বেড়াচ্ছেন বিমল মুখার্জি সাথে তার তিন বন্ধু! আমার জীবনে পড়া শ্রেষ্ঠ ভ্রমণকাহিনী এটি।