আত্মজীবনী ব্যক্তিজীবনের স্মৃতিচারণ হলেও ভাস্কর, বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী’র আত্মজীবনী যেন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাসের প্রামান্য দলিল। ১৯৭১ এর দুঃসহ স্মৃতি আর সম্ভ্রম হারানোর যন্ত্রণা ভুলেছেন স্বাধীনতা অর্জনের সুখ স্মৃতিতে।
তাঁর লেখনীতে যেমন উঠে এসেছে একাত্তরের লোমহর্ষক নির্যাতনের কথা, তেমনি উজ্জ্বল ভাবে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা। রাজনৈতিক পালা-বদলে উপেক্ষিতা বীরাঙ্গনাদের মতোই নিভূতচারী ছিলেন দীর্ঘকাল। তারপর একদিন প্রকাশিত হলো একাত্তরের সেই দুঃসহ স্মৃতিগাঁথা। ভাস্কর্যশিল্পী হিসেবে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী’র খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
রাষ্ট্রদ্রোহি, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আজো সংগ্রামী এই মহীয়সী।
Ferdousi Priyabhashini (ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী) is a Bangladeshi sculptor. She was the first one to publicly announce herself as Birangona, a term coined by Sheikh Mujibur Rahman for the rape victims of the Liberation War of Bangladesh in 1971. The government of Bangladesh awarded her Independence Day Award in 2010.
নান্দনিকতার ছোঁয়ায় শুকনো কালো কালিতে তিনি এঁকে রেখেছেন তাঁর নিজের কলঙ্কিত জীবন। কত সহজ করে লিখেছেন পাথরের মতো কঠিন, ভারী, নির্মম সত্যগুলোকে। ইচ্ছে করলে তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে যুদ্ধকালের ঘটনায় মহান করে তুলতে পারতেন, তা তিনি করেননি। তাঁর বইয়ের প্রতিটি পাতায় লেপ্টে আছে একজন সংগ্রামী নারীর আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধ।
তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি একজন বীরাঙ্গনা। এখানেই তিনি একজন স্বার্থক লেখক, পাঠ কালে পাঠক যখন অশ্রু সিক্ত হয়ে পড়ছেন, তিনি তখন পাঠকদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন আশা, ভালোবাসার গল্পে। তিনি হারেননি। তাঁরা হারেন না। তাঁরা বেঁচে থাকেন। তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের মানচিত্রে, লাল-সবুজ পতাকায়।
সবাই ভেবে বসেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর স্ট্রাগল বোধহয় ৭১ থেকেই শুরু, তা নয়। খুব ছোট বেলা থেকেই তাকে স্ট্রাগল করতে হয়েছে। পড়াশুনা করতে স্ট্রাগল করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আগেই বিবাহিত জীবনে স্ট্রাগল করতে হয়েছে। এত স্ট্রাগলের মাঝে সবসময় আত্মমর্যাদায় তিনি বলিয়ান ছিলেন। নিজেকে ভালবেসেছেন, নিজের ইচ্ছাকে ভালবেসেছেন। ভালবেসেন স্বাধীনতাকে। হোক সে দেশের। হোক তা নিজের। এই বইয়ের কনটেন্ট, যেখানে এই শক্তিশালী জীবনটি খানিকটা ধরা পড়েছে, তা রিভিউ এর সাধ্য আমার নাই।
তবে প্রকাশনার কাজকে রিভিউ করতে পারি। ভাল পাতায়, ভাল বাইন্ডিংয়ে করা, টাকা অংকে বেশ দামি বইখানা মুদ্রণ প্রমাদে ভরপুর। কম করে ১০০ জায়গায় তো হবেই। এমনকি মুদ্রণ প্রমাদ জায়গা করে নিয়েছে ফ্ল্যাপেও। একখানা চ্যাপ্টারও দুইবার ছাপিয়ে দেয়া হল। একই ফর্মা যে দুবার পেস্টিং হয়ে যায় মাঝে মাঝে তেমন ভুল নয়। একবার ৩০ থেকে ৩২ পাতায় একবার ১৮৮ থেকে ১৯০ পাতায় এই চ্যাপ্টার। বইখানা আমার নিজের সম্পত্তি হলে এগুলো সব মার্ক করে বইটা প্রকাশকে পাঠিয়ে দিয়ে বলতাম, ভাই/বোন, এই বইতে এত মুদ্রণ প্রমাদ থাকা উচিত না। (এক তারা কেটে রাখার কারণ এটাই।)
যাই হোক, বইখানা যেহেতু আমার না, কিছু জিনিস টুকে রাখা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু টুকে রাখার বদলে রিডিং প্রগ্রেস ব্যবহার করে অনেকগুলো স্ট্যাটাস আপডেট করেছি। গুডরিডস বন্ধুদের নিউজফিড ভরিয়ে ফেলার জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি। এই রিভিউটিই এইখানে ক্লিক করে দেখলে রিডিং প্রগ্রেস হেডিং নিচে বইটির বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ দেখতে পাবেন। বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের ঘটনা। বইটি যেহেতু আত্মজীবনী, তাই এই অংশগুলো মুক্তিযুদ্ধের নানা বিতর্কের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী...আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে।
নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটি বই। একটা মেয়ের শিশু থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত যত ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব, লেখিকা সেগুলো খুব জলজ্যান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বই পড়তে পড়তে যতই এগুচ্ছিলাম, বুকের ভিতরে একটা গুমোট অনুভূতি জমছিল। যখন বীরাঙ্গনা প্রসঙ্গটি আসলো, তখন যেন আর পারছিলাম না এগুতে। মনে হচ্ছিল, না হয় নাই বা জানলাম। সবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কদাকার সবগুলো দিক সম্পর্কে জানতে হবে, এই বলে তো কোন কথা নেই। কিন্তু তারপরও শেষ করলাম এক নিঃশ্বাসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মহিলাদের উপর করা নির্যাতন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখায় পড়েছি। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আর্মি ক্যাম্পে রেখে যে নির্যাতন হত, সেইটুকুই জানতাম। কিন্তু লেখিকা একটা প্রেক্ষাপট তুলে ধরলেন যে ঐ ভয়াবহ বিভীষিকাময় মুহূর্তে নিজেকে বাঁচানোর জন্য একজন নারী কি অসহায়ত্বের মধ্যে পড়ে যুদ্ধের সেই নয়টি মাস পার করেছেন। এরকম না জানি কত হাজার হাজার নারী এই অবস্থায় তখন ছিল।
ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী আমাদের সবার জন্য চলার পথে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। নিজের কথা বলতে পারি যে, আপাতত এই ধরণের বই নিয়ে বসবো না, যা অনেক ট্রমাটাইজড করে দেয়। স্রষ্টা মানুষের এই পর্যায়ের দুঃখ দেখার ক্ষমতা এখনও দেন নাই।
বইটির রেটিং ফাইভ স্টার দিতাম। কিন্তু প্রুফ রিডিং এ বেশ কিছু অসংলগ্নতা ও ভুল তথ্য দেখা গিয়েছে বিধায় ফোর স্টার দিলাম। আশা করি পরবর্তী মুদ্রণে এই বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
প্রায় একটানে পড়ে শেষ করলাম ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর আত্মজৈবনিক উপন্যাস “নিন্দিত নন্দন”। শব্দশৈলী থেকে ২০১৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ১৯১ পৃষ্ঠার এই বইটি পড়তে পড়তে চোখের পানি আটকে রাখা মুশকিল। একটি “নারী” তার সামাজিক অবস্থান যে পর্যায়েরই হোক না কেন, ভুল-ভ্রান্তি, আবেগ-অনুভূতির কী মূল্যই না তাকে জীবনভর পরিশোধ করে যেতে হয়। তবুও তিনি কিছু জায়গায় সৌভাগ্যবতী, ছেলেমেয়েদের ভালবাসা পেয়েছেন, বিয়ার ভাইয়ের মতো স্বামীকে পাশে পেয়েছেন, নিজের যোগ্যতায় ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন, বহুজন কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেছেন তার মত পরিস্থিতিতে।
“আমাদের খন্ডকালীন সঙ্গীত শিক্ষক কিউ।এস।ইসলাম বেশ আন্তরিক ছিলেন। তাঁর শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি খুব ভালো গাইতেন। দেখতে ভালো ছিলেন না, তবে বয়সে তরুণ, বাচনে চৌকষ। এক পর্যায়ে খালাদের কারণে-অকারণে শাসন আমার শৈশবকে ঝালাপালা করে ছাড়ল – উপায়ন্তর না দেখে গানের শিক্ষক কিউ।এস।ইসলামকে বিয়ে করলাম মাত্র এক বছর প্রণয় শেষে। খুবই ভালোবাসলাম ওকে। প্রথম প্রেম একটি কিশোর জীবনে! সত্যি ভালোলাগার ব্যাপার। ভুল খুঁজে বের করার মন ছিল না। কিন্তু কুমারী জীবনের মুহূর্তগুলো যেন দ্রুতই সরে সরে যাচ্ছিল।“
“সন্ধ্যার পরে সিরাজ (আমার স্বামী) আমাকে ছাদে ডেকে নিলেন। সেদিন আকাশে পূর্ণ চাঁদ। জ্যোৎস্নার রুপোলি আলোতে সারা প্রকৃতি স্নাত। আমি যেন সেই আলোর সমুদ্রে স্নিগ্ধ সাগরিকা। প্রাণে গভীর স্পন্দন। মনে হলো এমন রুচিবান সংস্কৃতিমনা স্বামী, তিনি চাঁদের আলোয় গান গেয়ে আমাকে বরণ করে নেবেন। যেন শকুন্তলার রাজা দুস্মন্ত আজ আমার এতদিনের শৈশব-কৈশোরের যত কষ্ট যত ক্ষোভ সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে আমার জীবন পূর্ণতা দেবেন।
উনি সতীনাথ মূখার্জির গান শোনালেন। ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না .........অপূর্ব দরদ দিয়ে গানটি গাইলেন। আমি মগ্ন হয়ে শুনতে শুনতে হঠাৎ দেখি ঝলমলে রুপোলি কাগজে মোড়ানো প্যাকেট থেকে একটি কাপড়ের তৈরী জিনিস বার করলেন মুহুর্তেই বুঝতে পারলাম এটি একটি বোরকা, যে বসন সমগ্র নারী সমাজকে অবনত করেছে। এ বসন জীবনকে কিছুই দেয় না শুধুমাত্র কুসংস্কার ছাড়া, ফতোয়ার সবক ব্যতীত অন্য কিছু নয়। বোরকা ফ্যাশনের পোষাক হতে পারে কিন্তু ধর্মের পোষাক নয়। ধর্ম অন্তরে।“
“সিরাজ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হলেন, আমি স্কুলে চাকরী করতে শুরু করি। সামান্য বেতনে চাকরী করে, স্বামীকে পড়াশোনার সম্পূর্ন দায়ভার নিয়ে বিশাল সংগ্রামের পদক্ষেপ নিলাম। ৬০ টাকা বেতনে দুই শিফটে ১২০ টাকা এর ফাঁকে দুটি টিউশন��� শেষ করতাম। জীবন ঘন্টা মাপের যন্ত্র, যে সংগ্রামে শুধু শ্রমই ছিল না কেবল কলঙ্ক, দুর্নাম, দারিদ্র্যের, স্বামীর অকারণ শাসন, সন্দেহ, দুর্ব্যবহার কোনকিছুরই কমতি ছিল না। সিরাজ যেহেতু আমার উপরে নির্ভরশীল সে কারণে তাঁর অন্যায়, হীনমন্য ব্যবহারগুলো আমি দাঁত চেপে সহ্য করে নিয়েছিলাম। কারণ মানবিক বিষয়টি বড় করে দেখতাম। তাঁর কাছে বিবাহিত জীবনের কোনো দাবিই যেন রাখতাম না।“
এরপর তার জীবনে “বিয়ার ভাই” এর আবির্ভাব। নানা ঘাত প্রতিঘাত। বিয়ার ভাইয়ের সাথে প্রেমের আমেজ পুরো বইটিকে তরতর করে পড়তে অনেক পাঠককে নিশ্চয় টেনে রেখেছে। সেই কিশোরী বয়স থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন শুধু সংসার টেনে রাখতে। পড়ছি আর ভাবছি, কতো যুদ্ধ করলে তবে এমন একজন মহীয়সী হওয়া যায়। যুদ্ধদিনের কথা আমি আর নাই লিখলাম, পড়ে নিবেন তার নিজের কথায়। স্যালুট ম্যাম, জীবন্ত কিংবদন্তী আপনি।
মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়ে শেষ করলাম! এই অসীম ব্যক্তিত্ব সম্পন্না মানুষটির সান্নিধ্যেই ছিলাম এতক্ষণ মনে হচ্ছে।সবার চেয়ে আলাদা সবার চেয়ে উপরের আসনে বসে জীবনকে যাপন করে চলে গেলেন প্রকৃত এই যোদ্ধা। শ্রদ্ধা,ভালবাসা...
একটা পর্যায়ে গিয়ে খুবই অসংলগ্ন লেগেছে। মনে হয়েছে নিজের চেনা বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের ফিরিস্তি দিচ্ছেন। কাহিনীর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি বা চাননি যার কারণে পাঠক হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
একাত্তরের দিনলিপি নয় বরং একজন বাঙালি নারীর তৎকালীন (স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তীকালের) সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্ট্রাগলের কড়চা হিসেবে বইটিকে ধরা যায়। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী জীবনভর নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। যার ফলে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। "বিয়ার ভাই" পরবর্তীতে শুধু "বিয়ার" নিয়ে লেখা তাঁর বক্তব্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্ষাপ ছাড়া লেগেছে। হয়তোবা, ভালোবাসার পুরুষ প্রতিকূল পরিবেশে তাঁকে একা ফেলে যাওয়ার অভিমানে এরূপ মিশ্র বক্তব্যের সঞ্চার।
>সহজ এবং চমৎকার গতিময় ভাষায় বর্ণীত সীমাহীন কষ্টের স্মৃতি। সব বাংলাদেশীর জন্য অবশ্যপাঠ্য এই বই। আমরা সেই সময় তাঁকে ফিরিয়ে দিতে পারবনা, কিন্তু চলুন বইটা পড়ে তাঁর কষ্ট কিছুটা আমারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেই।সবাইকে অনুরোধ করবো বইটা পড়তে।