সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিকর্মের যে দিকটা নিয়ে চিরকাল সব থেকে বেশি আলোচনা হয়ে থাকে সেটা তাঁর সিনেমা। তুলনায় একজন আর্টিস্ট হিসেবেও যে তিনি কত বড় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন সে বিষয়ে জানার চেষ্টা হয়েছে খুবই কম। অথচ বই বা পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ইলাস্ট্রেশন, ক্যালিগ্রাফি, এমনকী নিজের সিনেমার প্রয়োজনে আঁকা পোস্টার, টাইটেল কার্ড, লোগো ইত্যাদি অজস্র ডিজাইন সংক্রান্ত কাজ যে তাঁর সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রীতিমতো আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এইসব কাজের মূল আর্টওয়ার্ক তো দূরের কথা বহু ক্ষেত্রে ছাপা কপিও বর্তমানে দুর্লভ। তারই মধ্যে বিভিন্ন বইপত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সত্যজিতের গ্রাফিক্স শিল্পের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নিদর্শনকে বেছে নিয়ে এই বইয়ে সাজানো হয়েছে চারটি পর্বে। সেই সঙ্গে একের পর এক বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে এদের পটভূমি ও গুণগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে। সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত বই-এর প্রচ্ছদ, সন্দেশের ইলাস্ট্রেশন, এক্ষণ-এর লেটারিং কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী সিনেমার প্রেস অ্যাড কোন অর্থে আশ্চর্য ব্যতিক্রমী এক সৃজনশীলতার ফসল তা এই আলোচনা থেকেই পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শুধু পঞ্জি ও প্রশস্তি নয়, শিল্পীর চোখে চিত্রী সত্যজিতের এই অন্য পরিচয় বাংলা প্রকাশনায় অনন্য, বলাই যায়।
একটা মানুষ কিভাবে এত প্রতিভাবান হয়? কেন এতটা প্রতিভাবান হয়? এমনকি তাঁর প্রতিভার যে দিকটা তেমন একটা সেলিব্রেটেড নয়, সেদিকটা সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারার পর কেন নিজের বুদ্ধি, সৃজনশীলতা এসবকে একটা পিঁপড়ার সমান বলে হয়। একই মানুষ, সেই একই মস্তিষ্ক দিয়ে কিভাবে পারে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু সৃষ্টি করতে??
সেই ফেলুদা বা শঙ্কুর কত চেনা সব প্রচ্ছদ, কত চেনা ইলাস্ট্রেশন! কিন্তু এর মাঝে কতকিছু সূক্ষ্ম চিন্তা যা কোনও দিন বুঝেও উঠতে পারিনি, আর কেউ কেউ চিন্তাভাবনা করে এতসব এঁকেও ফেলেন। এখন আবার এগুলো সব রিভিশন দিতে হবে... :(। শুধু ফেলুদা বা শঙ্কুই কেন, কত চেনা-অচেনা বইয়ের কত প্রচ্ছদ-ইলাস্ট্রেশন। সব কিছুতে এত প্রতিভা, এত যত্ন, এত সূক্ষ্ম এবং গভীর চিন্তা ভাবনা। অক্ষরশিল্প চ্যাপ্টারটা পড়তে গিয়ে তো মনেই হয়েছে লোকটাকে যদি মেরে ফেলা যেত! শুধু বইয়ের জন্যে নয়, বিজ্ঞাপন এবং নিজের চলচ্চিত্রের জন্যও প্রচুর ছবি এঁকেছেন এবং ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কাজ করেছেন প্রচুর এবং আবারো সেই সব কিছুতেই নতুনত্ব, খোলনলচে পাল্টে ফেলার উৎসব।
উপরের সব কথাই সত্যজিৎকে নিয়ে, এখন সত্যজিৎ ছাড়া কিছুই ভাবতে ইচ্ছা করছে না। তবুও বইটি নিয়ে একটা কথা না বললেই নয়। লেখক বেশ যত্ন নিয়ে অনেকদিন ধরে বইটি লিখেছেন, কাজের যত্ন চোখে পড়ার মত। তবুও লেখার মাঝে মাঝে ইংরেজি বা বাংলা ফন্টে লেখা ইংরেজি শব্দগুলো অনেকসময় অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। বইটি গ্লসি পেপারে ছাপানো, দিনের আলোয় পড়লে চোখের জন্য কিছুটা অস্বস্তিকর, আলো রিফ্লেক্ট করে। এছাড়াও পেজ সেট আপ আরও ভাল হতে পারতো। অন্য কোনও বই হলে পেজ সেটআপের ছোটখাটো সমস্যা হয়তো চোখ এড়িয়ে যেত, কিন্তু বইতে যখন প্রকাশনার কাজে সত্যজিতের প্রতিভা এবং যত্নের কথা পড়ছি তখন ব্যাপারটা আর দৃষ্টি এড়ায় না।
আপনার শৈশব-কৈশর যদি সত্যজিৎ রঙিন করে থাকেন, তাহলে বইটা না পড়া আপনার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সত্যজিৎ রঙিন না করলেও ক্ষতি নাই। আপনি যদি ছবি নিয়ে আগ্রহী হন, তাহলেও বইটি আপনাকে আনন্দ দিবে। যদি প্রকাশনা শিল্প নিয়ে আগ্রহী হন তবে তো বইখানা অবশ্যপাঠ্য। আর যদি এর মাঝে কিছু নাও হন, তবুও বইখানা আপনাকে হতাশ করবে না, নিশ্চিত থাকতে পারেন। অফুরান সৃষ্টির উৎসব কাউকে হতাশ করে না।
শুরুতে দুটো হিন্টস দিই। ক) ইহা হয় একটি গাঁট খসানো পুস্তক (মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫০০ টাকার মতো)। খ) এবং ইহা একটি লোভনীয় লেভেলের ভোজ্য, মানে প্রচ্ছদ-বাঁধাই-অঙ্গসজ্জা সব মিলিয়ে এতো চমৎকার প্যাকেজ, কেটেকুটে খেয়ে ফেলার ইচ্ছে হতে পারে। বাকিটা আপনাদের বিবেচনা। ;)
সত্যজিৎ রায় লোকটা যে নামেও সইত্যজিৎ ছিলো, আর কামেও, সে তো জানেন। লোকটা বাড়াবাড়ি লম্বু ছিলো, আবার বাড়াবাড়ি প্রতিভাবান-ও। এ বই সত্যজিতের তূলনামূলক কম আলোচিত দিক আঁকাআঁকির বয়ান, দেবাশীষ দেবের কলমে। তিনিও আঁকিয়ে অবশ্য, পড়েছেন কমার্শিয়াল আর্ট নিয়ে। সন্দেশ পত্রিকায় ইলাস্ট্রেশন করার বরাতে দুজনের ছিলো ব্যক্তিগত পরিচয়ও। ৯২তে সত্যজিতের মৃত্যুর পর থেকে প্রচ্ছদ আঁকার জগত, বিশেষত গ্রাফিক্স ডিজাইনে তাঁর অবদান নিয়ে দেবাশীষ লিখতে শুরু করেন। বহু শ্রমসাধ্য বইটি পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রথম প্রকাশিত হয় আনন্দ থেকে, ২০১৪'র নভেম্বরে।
শান্তিনিকেতনের কলাভবনে পড়ার পাট চুকিয়ে ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে সত্যজিৎ রায়ের কর্মজীবনের শুরুটা জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে, বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি.জে.কিমারে। পরবর্তীতে সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত বিভূতিভূষণের 'আম আঁটির ভেঁপুর প্রচ্ছদ করতে গিয়ে রায় মহাশয়ের মাথায় আসে পথের পাঁচালী নিয়ে ছবি বানানোর কথা। ১৯৫৫তে মুক্তি পাওয়া সে ছবির অভাবনীয় সাফল্য আর খ্যাতি সত্যজিৎকে সরিয়ে নিয়ে যায় বিজ্ঞাপনের দুনিয়া থেকে। বছর ছয়েকের মাথায় সন্দেশ পুনঃপ্রকাশের ভার নিয়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন লেখালেখি আর সম্পাদনাতেও। পেশাদার আর্টিস্ট হিসেবে পরিচয় চাপা পড়ে যাওয়ার সুত্রপাত অনেকটা তখন থেকেই।
'রঙ তুলির সত্যজিৎ' সেই ছাইচাপা দিকের উন্মোচনের চেষ্টা, একের পর এক আর্ন্তজাতিক মানের শৈল্পিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা হিসেবে বিখ্যাত এই শিল্পীর করা অজস্র পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ, অঙ্গসজ্জা, লোগো, ক্যালিগ্রাফি, সিনেমার পোস্টারের বিশ্লেষণ, যেগুলোও শিল্পমান বিচারে কম আন্তর্জাতিক নয়। কী অদ্ভুত তাঁর আঁকা বা করা একেকটা কাজ! নিখুঁতের চাইতেও বেশি নিখুঁত, কিন্তু বাহুল্যবর্জিত। একটা বাড়তি আঁচড় নেই, যা আছে তাই-ই মাথা ঘুরিয়ে এবং ঘুলিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট! জিম করবেটের ম্যানইটারস অফ কুমায়ূনের অনুবাদ 'কূমায়ুনের মানুষখেকো'র প্রচ্ছদ করেছিলেন ১৯৫৩তে। হলুদ আর কালো, এ দুটো রঙ শুধু। বই পুরো মেলে ধরলে মনে হবে বাঘের শরীরে দুটো গুলির ফুটো। সামনের ছোটটা, যেটা দিয়ে গুলি ঢুকেছে, তাতে বই আর লেখকের নাম লেখা। কীভাবে যে মাথায় খেলতো লোকটার এইসব আইডিয়া!
ফেলুদা,স্বয়ং প্রফেসর শঙ্কু এ দুটো চরিত্র আমাদের মতো পাঠকদের সামনে এতো জীবন্ত হয়ে ওঠা লেখকের কলম না, তুলির-ও কৃতিত্ব! প্রচ্ছদ বা অলঙ্করণের পরিপাট্যের জোরে 'সোনার কেল্লা'র জয়সলমীরের ঝকমকে রোদ বা 'টিনটোরেটোর যীশু'তে হংকঙের রাস্তায় দাঁড়ানো ঐ ত্রিমূর্তি একদম জ্যান্ত হয়ে ভাসে না চোখের সামনে? শুধু নিজের লেখাই নয়, সিগনেট প্রেস থেকে পুনঃপ্রকাশিত সুকুমার রায়ের 'পাগলা দাশু' বা অবন ঠাকুরের 'শ্রেষ্ঠ অবনীন্দ্রনাথ নালক। বুড়ো আংলা। রাজকাহিনী। শকুন্তলা। ক্ষীরের পুতুল 'র সব অলঙ্করণ তো সত্যজিতের-ই করা। সেসব ছবির রঙচঙে সংযুক্তি এ বইয়ের সবচাইতে বড় আকর্ষণ। মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ইচ্ছেকৃত বা অনিচ্ছেকৃতভাবে সুকুমার রায়ের আঁকার ধরনে সত্যজিৎ কতোটা প্রভাবিত ছিলেন!
দুর্দান্ত ফিগার ড্রয়িং, কিন্তু খুঁতহীনতার দেমাগে গেরামভারি বা জড়োসড়ো নয়। কেমন খুশিখুশি আর মজাদার একেকটা সন্দেশের প্রচ্ছদ! আনকোরা সব ডিজাইনে হাজারটা ফর্মে করা টাইপোগ্রাফি, পিক্টোগ্রাফি বা নিছক নিজের সাক্ষর। সবকিছু নিয়েই অসংখ্য এক্সপেরিমেন্ট আর চোখ ধাঁধানো তার ফলাফলগুলো। কী চমৎকার জীবনানন্দ দাশের 'রূপসী বাংলা' আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'অর্কেস্ট্রা' বইয়ের প্রচ্ছদের লেটারিংগুলো! কিংবা মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে'র প্রচ্ছদ। একটা-ই মানুষ, অথচ কী কঠিন দখল অনেককিছুর ওপর!
মজা লেগেছে পথের পাঁচালীর জন্য সবগুলো দৃশ্য স্কেচ করে, সে খেরো খাতা হাতে প্রযোজকদের দরজায় ঘোরার গল্প পড়ে। পরবর্তীতে দুয়ারে ধর্ণা�� প্রয়োজন আর কখনো না পড়লেও, দৃশ্য আঁকার অভ্যাসটা ছিলোই। আর নিজের চলচিত্রের মোটিফ, টাইটেল কার্ড, পোস্টার সব তো করতেন-ই। 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' মুভ���টার পোস্টারটা দেখলে কী মনে হবে জানেন? ঠিক যেন...
থাক থাক, আর কতো স্পয়লার দেবো? বরং কিনে পড়ুন বইটা। এ জিনিস সংগ্রহে রাখা উচিত, থাকা উচিত। বিশেষত আঁকাআঁকিতে একদা আগ্রহী বা চির আগ্রহী হলে তো বটেই। :)
"যে জিনিসটা ছেলেবয়স থেকে বেশ ভালোই পারতাম সেটা হল ছবি আঁকা।"
ইন্টারনেটের গলিঘুজিতে মাঝে মাঝে একটা লিস্ট দেখা যায় : পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষ যাঁরা মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিলেন ('ড্রপ-আউটস')। এইসব লিস্টে দুজনের নাম কখনই দেখা যায়না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়। প্রথমজন পড়াশুনা ছেড়েছিলেন বিরক্ত হয়ে। দ্বিতীয়জন বাধ্য হয়ে। সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের আত্মকথায় দেখতে পাই, জীবনে কখনও মায়ের কথা অমান্য করেননি তিনি। মায়ের প্রবল ইচ্ছেতেই শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হয়েছিলেন চিত্রশিল্প শেখার উদ্দেশ্যে (অথচ তার আগে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন ইকোনোমিক্সে অনার্স নিয়ে)।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুকুমার রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যদিও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের (পরবর্তীকালে বিনোদবিহারীকে নিয়ে বিখ্যাত ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন— "The Inner Eye")। শান্তিনিকেতনের পাঠ কিন্তু শেষ করতে পারেননি তিনি। জীবিকার তাগিদে চার বছরের কোর্স আড়াই বছরে ছেড়ে দিয়ে, শান্তিনিকেতনের নিবিড় প্রকৃতি-সন্নিহিত স্তিমিত জীবন ত্যাগ করে, সারাজীবনের মতো প্রবেশ করলেন কলকাতার প্রবল নাগরিক জঙ্গলে। কিন্তু শান্তিনিকেতনের শিল্পশিক্ষার আঁচড়টি তাঁর মননে সযত্নে ধারণ করে রেখেছিলেন আমৃত্যু।
অতিরিক্ত প্রতিভাধর মানুষদের কিছু কিছু প্রতিভার কথা তুলনামূলক আড়ালে রয়ে যায়। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি দুর্দান্ত আতশবাজি বানাতে পারতেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দারুন বেহালা বাজাতে পারতেন। স্বামী বিবেকানন্দ অসাধারণ রান্না করতে পারতেন। রিচার্ড ফাইনম্যান খুব ভালো বোঙ্গো বাজাতে পারতেন। সত্যজিতের সিনেমা-নির্মাতা পরিচয়ের আড়ালে রয়ে গেছে তাঁর অলংকরণ পারদর্শিতার ব্যাপারটা। এমনকি লেখক সত্যজিৎও ইলাস্ট্রেটর সত্যজিতের চেয়ে অধিক আলোচিত। শিল্পী সত্যজিৎকে নিয়ে কিছু কিছু প্রবন্ধ লেখা হয়েছে বটে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বই একটাও ছিল না। দেবাশীষ দেব সেই অভাব পূরণ করেছেন।
দেবাশীষ দেব নিজে একজন স্বনামধন্য ইলাস্ট্রেটর। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ভীষণ জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলো দেবাশীষবাবুর অলংকরণ। দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করলেও তাঁর শিক্ষানবিশি শুরু হয়েছিল সত্যজিৎ-সম্পাদিত 'সন্দেশ' পত্রিকায় ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে। সত্যজিৎ রায়কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি, এবং নিজে একজন অলংকরণশিল্পী হওয়ার সুবাদে সত্যজিতের চিত্রশিল্পী সত্তাটিকে তিনি বিশেষ নজরে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ এবং দীর্ঘকালীন চিন্তার ফসল হলো এই অসামান্য বইটি। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে : "যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এই বইটির জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন, তাঁদের জন্য"। আমি নিজে এই অপেক্ষাকারীদের একজন। প্রকাশ হওয়ার তিনদিনের মধ্যে হস্তগত করেছিলাম বইটিকে।
বাকি সবকিছুর কথা বাদ দিলাম। শুধু 'সন্দেশ' পত্রিকার প্রচ্ছদগুলো দেখেই আমি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। তিন অক্ষরের 'সন্দেশ' শব্দটিকে নিয়ে সত্যজিৎ যেন ছেলেখেলা করেছেন। কতো বিচিত্র টাইপোগ্রাফিতে ধরতে চেয়েছেন পত্রিকার এই অর্থবহুল নামটিকে। প্রচ্ছদগুলোর কতো বর্ণময় বৈচিত্র্য। কল্পনার কী অবাধ বিচরণ! (প্রায় একই কথা বলা যায় "এক্ষণ" পত্রিকার প্রচ্ছদগুলোর ব্যাপারেও)। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কমার্শিয়াল ডিজাইনার। সেই সংস্থার ম্যানেজার দিলীপকুমার গুপ্ত পরবর্তীকালে 'সিগনেট প্রেস' নামের বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং সত্যজিতের সামনে খুলে যায় ইলাস্ট্রেশন এবং প্রচ্ছদ নির্মাণের অত্যাশ্চর্য দুনিয়া। সিগনেট প্রেস থেকেই বেরিয়েছিল 'আম আঁটির ভেঁপু' ('পথের পাঁচালী'-র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ)। এই বইটির প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ করার সময়ই সত্যজিতের মাথায় আসে একটি সিনেমার আইডিয়া, যা কিনা বদলে দেবে তাঁর নিজের জীবন এবং ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসকে।
জীবনে যে কাজেই হাত দিয়েছেন, ছকবাঁধা একঘেঁয়েমিকে অতিক্রম করে নিজস্ব অভিনব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সত্যজিৎ। ছবি আঁকাও ব্যতিক্রম নয়। কোনো একটি গল্প কিংবা উপন্যাসের সঙ্গে অলংকরণের ব্যাপারটি আগে ছিল নিছকই একটা ফাঁকা জায়গা ভরানোর অভিপ্রায়। বেশিরভাগ সময়ে অলংকরণশিল্পীর নামটুকুও উল্লেখ করা থাকতো না। প্রচ্ছদশিল্পীর নাম তো এখনও বহু সময় উল্লেখিত থাকেনা। এমন একটি পেশাদারী অবজ্ঞার পরিবেশে কাজ করতেন শিল্পীরা। নিজের অলংকরণ-কৌশলেই প্রচলিত প্রথাটিকে এক ধাক্কায় পাল্টে দিলেন সত্যজিৎ। প্রকাশকরা এই নবাগত শিল্পীর নামটিকে উপেক্ষা করতে পারলেন না। এমনকি অনেক সময় দেখা গেলো, বইয়ের চেয়েও বইটির প্রচ্ছদশিল্পীর খ্যাতি বেশি ছড়িয়ে পড়েছে! বইয়ের বিজ্ঞাপনে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা থাকতো প্রচ্ছদশিল্পীর নাম— এমন বিস্ময়কর কাণ্ড বাংলা প্রকাশনা জগতে কেউ কখনও দ্যাখেনি!
অলংকরণ তো শুধুমাত্র একটি বই কিংবা একটি রচনার সৌন্দর্যবৃদ্ধির উপায় নয়। একটি গল্পের সঙ্গে একই পৃষ্ঠায় মুদ্রিত একটি অলংকরণ যেন গল্পটির অন্যতম একটি চরিত্র। গল্পটির অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুকে আরো গভীরতা দ্যায় সেই অলংকরণ। কিন্তু তার জন্যে চিত্রশিল্পীর তরফে বুদ্ধিদীপ্ততার প্রয়োজন। খেয়াল গায়কের সঙ্গে যদি আনাড়ি তবলাবাদক সঙ্গত করে, তাহলে সেই গানের রসহানি ঘটে। কিন্তু যোগ্য সঙ্গতকারীর সহায়তা পেলে গায়কের পরিবেশনা অন্য মাত্রা পায়। সত্যজিৎ তাঁর অলংকরণের মাধ্যমে এই বুদ্ধিদীপ্ত সহায়তা করেছেন অগুনতি গল্প উপন্যাস কিংবা বইয়ের প্রচ্ছদে। তাঁর নিজের লেখাপত্রে তো বটেই, প্রচুর অখ্যাত লেখক আছেন যাঁদের রচনা উৎরে গেছে স্রেফ সত্যজিতের অলংকরণের অসামান্য শিল্পগুণে।
ছবি আঁকার এই তুলনামূলক অনালোচিত ক্ষেত্রটিতেও কী না করেছেন সত্যজিৎ! বিজ্ঞাপনের লে-আউট এঁকেছেন, বই এবং পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন, গল্প উপন্যাসের ইলাস্ট্রেশন করেছেন, ক্যালিগ্রাফি বা হরফ চর্চা করেছেন, নিজস্ব ইংরিজি ফন্ট তৈরি করেছেন, সিনেমার পোস্টার ডিজাইন করেছেন, সিনেমার সেট ডিজাইন করেছেন, এমনকি লোগো ডিজাইন করেছেন (কলকাতার বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহ 'নন্দন' কিংবা ভারতের 'সাহিত্য আকাদেমি' সংস্থার লোগো কিংবা বিখ্যাত ভারতীয় প্রকাশন সংস্থা 'রূপা পাবলিকেশনস'-এর লোগো কিংবা 'দেশ' পত্রিকার সুপরিচিত লোগোটিও তিনি তৈরি করেছেন)। 'জয় বাবা ফেলুনাথ' সিনেমাতে একটি বিখ্যাত দৃশ্য আছে। মগনলাল মেঘরাজের ডেরায় বেচারা লালমোহনবাবুর সঙ্গে ছুরি দিয়ে বিপজ্জনক খেলা দেখানোর দৃশ্যটি। এই দৃশ্যে লালমোহনবাবু একটি চিত্রপটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেই ভয়ানক চিত্রপটটিও সত্যজিতের স্বহস্ত-অঙ্কিত!
এই বিচিত্র মানুষটির কর্মকাণ্ড দুই মলাটে আঁটিয়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। তবু পরম অধ্যবসায়ের সঙ্গে, শ্রদ্ধার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে এবং তন্নিষ্ঠ গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সত্যজিতের শিল্পীসত্তার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন দেবাশীষ দেব। ��মন একটি কাজের জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়! ঠিক যেমন সত্যজিৎ রায় মানুষটির প্রতি আমার অপার মুগ্ধতার পরিমাপের জন্য কোনো মাপকাঠির দৈর্ঘ্যই যথেষ্ট লম্বা নয়!
দেবাশীষ দেবের অলংকরণের মুগ্ধ রসার্থী আমি। তিনি লিখেছেন আমার দূরগুরু সত্যজিৎ রায়ের আঁকা নিয়ে, তাই হাতে পাওয়ামাত্র পড়ে শেষ করলাম বইটা।
এমন বই আগে একটাই পড়েছি, মাইকেল বিয়ারুটের 'How to'। পার্থক্যটা বড় যদিও, সেখানে আলেখক বিয়ারুট আলোচনা করেছেন নিজের আলেখন নিয়ে। দেবাশীষ দেবের আলোকসম্পাতে সত্যজিতের আঁকা দেখে নতুন করে মুগ্ধ হলাম।
বইটাকে ৪ তারা দিতাম, কিন্তু হতাশ হয়েছি বাংলা ভাষার প্রতি দেব সাহেবের অযত্ন দেখে। আঁকার পেছনে সত্যজিৎ রায়ের আশ্চর্য সূক্ষ্ম সব চিন্তার কথা লেখক আমাদের জানিয়েছেন নিতান্ত চলতি ইংরেজিজর্জর পিজিন বাংলায় (আংলা ভাষা বললেও ভুল হয় না), টুকিটাকি বানান ভুলের কথা বাদই দিলাম। নন্দলাল বসুর 'শিল্প চর্চা' (কানাই সামন্তের সম্পাদনায়) যারা পড়েছেন, তারা জানেন, অঙ্কনশিল্প নিয়ে কী সাবলীল বাংলায় বইটি লেখা। মনে মনে তেমনই একটা কিছুর আশা ছিলো, কিন্তু হোঁচট খেয়েছি। আঁকিয়ে দেবাশীষ দেবের জন্যে অঞ্জলি ভরে মুগ্ধ কৃতজ্ঞতা জানালেও লিখিয়ে দেবাশীষ দেবের সামনে এসে কৃপণ হলাম।
তুমি সত্যজিতের ভক্ত হও আর নাই হও, আমার মত ছবি-পাগলা হলে এ বই পড়া তোমার জন্য ফরজ।
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় থাকা ছবিই যথেষ্ট ভালো লাগার জন্য কিন্তু একজন শিল্পী যখন অন্য একজন শিল্পীর কাজের মূল্যায়ন করেন যেটা আমজনতার পক্ষে করা সম্ভব না সেটা পড়া যে কত ইন্ট্রেসটিং এ বইটা পড়লে সেটা বোঝা যায়। লেখকের খাঁটনির কথাটা বলি। সত্যজিতের মৃত্যুর পর থেকেই এমন একটা বই লেখার চিন্তা তাঁর, এজন্য ম্যাটেরিয়াল সংগ্রহ করছিল, ২০০৭ সালে প্রথম একটা প্রবন্ধ প্রকাশ এবং ২০১৪ 'র নভেম্বারে বই আকারে প্রকাশ। এতগুলো বছরের পরিশ্রম একেবারে স্বার্থক।
সত্যজিৎ তাঁর শিল্পী জীবনে এঁকেছেন অসংখ্য প্রচ্ছদ, অলংকরণ, ক্যালিগ্রাফি, টাইটেল কার্ড, পোস্টার, লোগো এবং অনেক কিছু। তাঁর চিন্তাশক্তি দেখলেই অবাক হয়ে যাই। এমনিতে তো তাঁর এসব কাজ দেখে এসেছি কিন্তু এতো সুক্ষ্মতা তো চোখে পড়েনি। গুগাবাবা মুভিতে যে হাইরোগ্লিফিক আছে এবং তা দিয়ে যে একটা message দিচ্ছে তা তো খেয়ালই করিনি। এরকম কত কিছু ইন্ট্রেসটিং বিষয় যে চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।
একটা বিষয়, চাঁদের পাহাড় বইটার প্রচ্ছদ সত্যজিতের করা। লেখকের চোখে এড়িয়ে গেল কেন? মানে বলতে চাচ্ছি, এত সহজলভ্য একটা বাদ গেল।
সত্যজিৎ অ্যাম্বিগ্রাম নিয়ে কিছু করল না কেন? অবশ্য আমি এ পর্যন্ত কোন বইয়েই দেখিনি। কিন্তু সে তো সত্যজিৎ।
বইটা মাত্র ৩০০+ পৃষ্ঠার হলেও গ্লসি paper এর কারণে বেশ ভারি। ধরলেই কেমন জানি ভাব আসে। ছবিতে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু প্রচ্ছদে থাকা বই আর লেখকের নাম কিন্তু ছোঁয়া যায়। দারুণ।
এই বইটা পড়তে গিয়ে আবার নতুন করে সত্যজিৎ বাবুর প্রতিভার প্রেমে পড়লাম! এতো চমৎকার একটা বই!
"Don't judge a book by its cover" প্রবাদটা সত্যি হলেও কাভারের প্রতি আমার আলাদা একটা দুর্বলতা আছে। এমনও অনেকবার হয়েছে কোনো বই পড়েছি কেবল লোভনীয় কাভারের মোহে পড়ে। অনেক সময় লোভ সামলাতে না পেরে বই কিনতেও দ্বিধা বোধ করিনি। এতোদিন ধরে কেবল চোখকে যা আরাম দেয় তাকে ভালো প্রচ্ছদ ভেবে এসেছি। অথচ একটা প্রচ্ছদ সৃষ্টি করতে গিয়ে একজন প্রচ্ছদশিল্পীকে যতটা ক্রিয়েটিভ হতে হয়, যতটা সময় আর শ্রম দিতে হয় তা কোনো অংশেই লেখকের চাইতে কম না। বরং একটা স্বাস্থ্যবান কিংবা ক্ষীণকায় বইয়ের মূল সুরকে মাত্র এক পাতায় রং তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটা আরও চ্যালেঞ্জিং! আর সত্যজিৎ রায় কি সাবলীলভাবে প্রচ্ছদ সৃষ্টির কাজ করে গেছেন! সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত সবকটা বইয়ের প্রচ্ছদ হাতে নিয়ে দেখার লোভ সামলানো যাচ্ছেনা! শুধু কি প্রচ্ছদ! প্রফেসর শঙ্কু আর ফেলুদার চরিত্র ইভোলিউশন কেবল অক্ষরের বর্ণনায় নয়, চিত্রকল্পের মাঝেও তা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ। দেবাশীষ দেব নিজে শিল্পী বলে তাঁর চোখে এসব পরিবর্তন স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে। সন্দেশ পত্রিকার ম্যাজিক্যাল একেকটা প্রচ্ছদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলে পাপ হবে! ভীষণ প্রাণবন্ত, মায়াময় আর মজাদার একেকটা প্রচ্ছদ!
কেবল প্রচ্ছদ সৃষ্টিতে নয়, ইলাস্ট্রেটর হিসেবেও সত্যজিৎ এর জুড়ি মেলা ভার। তার আঁকা ইলাস্ট্রেশনে সুকুমারের ছড়া হয়ে উঠেছে সজীব আর ছটফটে। ক্ষীরের পুতুল আঁকতে গিয়ে বজায় রেখেছেন লোকশিল্পের মেজাজ। থ্রি-ডাইমেনশনাল রঙীন ছবি আঁকাতেও প্রতিভার অভাব ঘটেনি৷ এছাড়া পিক্টোগ্রাফ, মোটিফ আর পোর্ট্রেইট সৃষ্টিতেও তাঁর সহজাত ভঙ্গিমা চোখে পড়ে। নিজের নামের রকমারি সই দেখলে মুগ্ধ বনে যেতে হয়। অক্ষরশিল্প নিয়েও তিনি বেশ খেলা করেছেন।অক্ষরশিল্প দিয়ে করা অসংখ্য প্রচ্ছদে বইয়ের মূলভাব খুব সহজেই তুলে এনেছেন তিনি। আধুনিক লেটারিং-এ করা প্রচ্ছদ ইন্দ্রাণী, কেবল কলমের নিবের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে আঁকা ভীষণ সাদাসিধে প্রচ্ছদ রূপসী বাংলা, সরু লাইনে আনইভেন ভাব এনে এলোমেলো ঢেউয়ের মতো সুরছন্দ বোঝাতে আঁকা প্রচ্ছদ অর্কেস্ট্রা, শুঁরওলা প্রানীর মতো পিক্টোগ্রাম ইচিংকা দেখলে মনে হবে- বাহ! এতো সহজ! অথচ এতো সাবলীল ভঙ্গিমায় কতজন পারে বইয়ের মূল সুরকে ফুটিয়ে তুলতে! এমনকি সিনেমার পোস্টার তৈরী করার সময়ও মাথায় রেখেছেন কিভাবে মুভির মূলভাবকে ফুটিয়ে তুলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শককে আকৃষ্ট করা যায়। বলা চলে এতে তিনি সফলতার দর্শন পেয়েছেন। লেখক দেবাশীষ দেব প্রতিটা সৃষ্টির পেছনে থাকা আইডিয়া, খুঁটিনাটি বিষয়াদি রীতিমতো গবেষণা করে বের করেছেন। বোঝায় যাচ্ছে অনেক শ্রম দিয়েছেন এই বই লিখতে গিয়ে। তবে কিনা একটা বিষয় না বলে পারছিনা। বইয়ের পেইজ সেট-আপ চেষ্টা করলে সম্ভবত আরেকটু ইম্প্রুভ করা যেতো। এমনও অনেকবার হয়েছে, কোনো একটা ছবির বর্ণনা পড়ছি অথচ ঐ পাতায় সেই নির্দিষ্ট ছবি নেই, বরং পরের পাতা উল্টিয়ে ঐ ছবি খুঁজে বের করতে হয়েছে।
বহু প্রতিভার অধিকারী সত্যজিৎ রায়ের আঁকিয়ে দিকটা সবচাইতে কম আলোচিত। অথচ এই কম আলোচিত প্রতিভার ভারে আমার রীতিমতো মাথা ঘুরছে! একটা মানুষের এতো প্রতিভা থাকা কিভাবে সম্ভব!
যাদের আঁকিবুঁকি নিয়ে খানিকটা হলেও আগ্রহ আছে তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি বই।
এ বইটা পড়া শেষে প্রথমে সবার মাথায় মনেহয় এই প্রশ্নটাই অাসে, একটা মানুষ কিভাবে এত প্রতিভাবান হয়? মানে সবকিছুতে- বইয়ের কভার থেকে শুরু করে ইলাস্ট্রেশন, ক্যালিগ্রাফি, পিক্টোগ্রাফি, টাইটেল কার্ড, লোগো, নিজ���র সিনেমার পোস্টার বানানো থেকে সিনেমা বানানো পর্যন্ত। এমনকি গুগাবাবা মুভিতে হাইরোগ্লিফিও করতে দেখা যায়।মুভি দেখার সময়তো মনেই হয়নি ঐটা একটা হাইরোগ্লিফিক ম্যাসেজ ছিল!
ফেলুদা অার শঙ্কুর ইলাস্ট্রেশন গুলো দেখেতো অাবার বইই পড়তে ইচ্ছে করতেসে। অার 'কাঞ্চনজঙ্গা' মুভির পোস্টার টা অনেক সুন্দর! সত্যজিৎ রায়ের ভক্তদের জন্য সংগ্রহে রাখার মত দারুণ একটা বই।
বইটার উৎসর্গ পাতায় লেখা রয়েছে "যারা দীর্ঘদিন ধরে এই বইটির জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন তাদের জন্য"। বইটার ব্যাপারে জেনেছিই অল্প কয়েকদিন এবং তার মাঝেই পড়ার সুযোগও ঘটে গেছে। নিঃসন্দেহে আহ্লাদ করবার মত একখানা বই ! সত্যজিতের এত চমৎকার সব ইলাস্ট্রেশন, বইয়ের প্রচ্ছদ, পিক্টোগ্রাফি, ক্যালিগ্রাফি, মুভি পোস্টার, টাইটেল কার্ড, স্কেচে ভরা বইখানা সত্যিই লোভনীয়!
তবে প্রথম দিকের চ্যাপ্টারগুলো খুবেকটা স্যাটিস্ফাইং লাগে নি কেন যেন ~ শেষের দুটো চ্যাপ্টার সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে।
লেখক দেবাশীষ দেব সত্যজিতের গ্রাফিক্যাল ওয়ার্ক গুলো নিয়ে এই যে কম্পাইলেশন টা করলেন সেটা সত্যিই অসাধারণ। কিন্তু জায়গায় জায়গায় সত্যজিতের কিছু মামুলি স্কেচ, সাধারণ মানের কাজগুলো নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে পর মুহূর্তেই নিজের কমেন্টগুলো আবার রিভার্ট করে নিয়েছেন। হ্যাঁ নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ চমৎকার একজন গুণী মানুষ কিন্তু তাই বলে তার কাজের সমালোচনা করতে গিয়ে একটু বেশি সন্ত্রস্ত মনে হল লেখক কে। কোন দরকার ছিল না ব্যাপারটার !
বইটি প্রায় মাস দেড়েক আগে কিনেছি, কিন্তু পড়ছিলাম না। কারণ একটাই, এমন অসাধারণ বইটি তো পড়লেই শেষ! জানা হয়ে যাবে কী আছে ভেতরে, ফলে আর নতুন থাকবে না বইটা। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। কিছু বই আসলে চিরনতুন। এটা ঠিক তেমনি একটি বই। দেবাশীষ দেবের অনুসন্ধিৎসা, গবেষণা, ব্যাখার তুলনা মেলা ভার। বইটিতে চারটি অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন সত্যজিৎ এর প্রচ্ছদ, অক্ষরশিল্প, ইলাস্ট্রেশন এবং সিনেমার নেপথ্যের কাজগুলো। প্রায় প্রতিটি ঝকঝকে পাতায় তিনি সংযুক্ত করেছেন সত্যজিৎ এর সৃষ্টি আর ব্যাখ্যা করে গেছেন এর পেছনের ভাবনা। নতুনভাবে, এক সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিক থেকে প্রিয় মানুষ সত্যজিৎকে চিনতে পেরে তাই অসম্ভব খুশি লাগছে৷ ভাবতে ভালো লাগছে, সত্যজিৎ এর কাজের সাথে আমি পরিচিত এবং এটা কতটা সৌভাগ্যের বিষয় তা পুনরায় অনুধাবন করতে পেরে। সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে যতবার যতভাবে জেনেছি, ঋদ্ধ হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি৷ একজন মানুষ কতভাবে নিজের প্রতিভার স্ফূরণ ঘটিয়েছেন ভেবে অবাক না হয়ে পারিনা। তাঁর প্রতিটা পেন্সিল বা কলমের আঁচড়ের পেছনে ছিল গভীর ভাবনা। একটা কাজও তিনি না ভেবে করতেন না। অতি অল্প সীমার মধ্যে গেঁথে দিতেন এমন নকশা, যা গভীর অনুশীলন এবং প্রজ্ঞা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব না৷ প্রতিটি প্রচ্ছদ ছিল আলাদা, রঙ এর ব্যবহার কিংবা সাদাকালো প্রচ্ছদ, দুইটাতেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। কত কত অসাধারণ প্রচ্ছদ যে বেরিয়েছে তাঁর মাথা থেকে! এই বইটি না পড়লে তো জানতামই না, কারণ সেই বইগুলো তো চোখে দেখার সৌভাগ্য হত না কখনো। তাঁর ইলাস্ট্রেশনগুলো কিছু কিছু দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, বইগুলোতে। এক তুলির টানে নায়কের সেই আধুনিকার কথা, সানগ্লাস মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করা কিংবা স্রেফ দুটো আলাদা পার্টে প্রতিদ্বন্দ্বী লেখা! নিবের মোটা, চিকন আঁচড় নানাভাবে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে তাঁর অক্ষরশিল্পে৷ কেবল ছবিই হয়ে থাকেনি সেগুলো। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে যেমন এক্সপ্রেশন এর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছে, তেমনি কয়েকটি রেখার টান দিয়ে গোটা বইয়ের মূলভাব বুঝিয়ে দেয়ার অসাধারণ এ ক্ষমতাকে খাটো করে দেখার কোনই উপায় নেই। কেবল ছবি আঁকা দিয়েই সত্যজিৎ বিখ্যাত হতে পারতেন। গুগাবাবাতে অনবদ্য চিত্র ব্যবহার করে স্যাটায়ার বোঝানো কিংবা সাদাকালোতেই ম্যাকাও পাখির রঙের অনুভূতির সৃষ্টি করা, এ এক সত্যজিৎ ছাড়া সম্ভব হত না। কূমায়ুনের মানুষখেকো বাঘের তাঁর করা প্রচ্ছদের বইটি আমার কাছে আছে৷ আমি কখনো বুঝিইনি যে এটা বাঘছালের উপর একটা গুলি ঢোকা এবং বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা! আসলে সত্যজিৎকে বোঝা আমাদের পক্ষে এত সহজ নয়। তাঁর প্রতিটা আচরণ, প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা দাগের পেছনে যে ভাবনা ছিল তা বুঝতে আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের আরো বহু বছর, বহু গবেষণার দরকার। লেখককে কৃতজ্ঞতা তিনি এত প্রাঞ্জল ভাষায় বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে আরো অনেক বেশি আগ্রহী করে দিলেন সত্যজিৎকে জানতে। একটা মূল্যবান সংগ্রহ এবং পাঠ নিঃসন্দেহে।
অবশেষে পড়া শেষ হলো দেবাশীষ দেবের লেখা 'রঙ তুলির সত্যজিৎ'। আকাশচুম্বী আশা নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম। পড়া শেষে এখন মনে হচ্ছে আকাশ পর্যন্ত না হলেও অনেক উঁচু একটা বিল্ডিংয়ের ছাদ পর্যন্ত ওঠা গেছে। সত্যজিৎময় এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় সত্যজিৎ এর বহুমুখী (কতগুলি যে মুখ বাপরে বাপ!) প্রতিভার অজস্র দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেক সত্যজিৎ ভক্তের জন্য নিঃসন্দেহে একটি দারুন এবং অনেক অর্থেই বেশ দামি সংগ্রহ। এতদিনের অতিপরিচিত রচয়িতা এবং চলচ্চিত্রকার সত্যজিতের সাধারণভাবে স্বল্পপরিচিত দিক, অর্থাৎ শিল্পী সত্যজিৎ সম্পর্কে (বিশেষ করে 'কমার্শিয়াল আর্টিস্ট' হিসেবে) অনেক কিছু জানা গেছে। প্রথম তিন অধ্যায়ে তাই চমকের শেষ নেই। প্রচ্ছদশিল্পী সত্যজিৎ, অলঙ্কারিক সত্যজিৎ এবং অক্ষরশিল্পী সত্যজিৎ। তিনটি ক্ষেত্রেই বুদ্ধি, গভীরতা, উদ্ভাবন আর নিখাদ শ্রমের মনমুগ্ধকর মিশেল।
তবে... তবে একটা আছে। যে কারণে শেষ পর্যন্ত ঠিক আকাশে ওড়া গেল না। লেখনীর যেন আরও যত্ন নেওয়া যেত। আনন্দ পাবলিশার মনে হয় বইয়ের বিষয়বস্তু দেখেই খুশিতে চৌদ্দ টুকরা হয়ে আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। কিংবা মাস দশেক আগে পড়লে আমাকেও হয়তো ছোট-বড় 'উষ্টা'গুলি খেতে হতো না। বানান আর স্পেসের সমস্যাগুলি কিঞ্চিত হৃদয়বিদারক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার জন্য। উপসংহারটাও একটু যেন বেখাপ্পা। যাক সেটুকু নেহাতই ব্যক্তিগত ঝক্কি বলে ধরে নিয়েছি। লেখককে অবশ্য একটা বিশেষ কারণে ধন্যবাদ দেব। বই জুড়ে যে অন্ধ ভক্তের মত শুধু প্রশংসাই করে গেছেন তা না, জায়গায় জায়গায় অল্পবিস্তর সমালোচনাও করেছেন। সেটুকু জরুরি ছিল নিঃসন্দেহে।
দেবাশীষ বাবুর এর সাথে প্রথম পরিচয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর কিশোর উপন্যাস পড়ার মাধ্যামে। উনি যে একজন গুনী শিল্পি এবং দক্ষ ইলাষ্ট্রেটর তা বলাই বাহুল্য।রং তুলির সত্যজিৎ বই টির প্রতি এক বিশেষ প্রত্যাশা ছিল আর যেহ��তু পুরো যজ্ঞটাই সত্যজিৎ কে ঘিরে তাই উন্মাদনা এক অন্যমাত্রা নিয়েছিলো এবং দেবাশীষ বাবুর অসামান্য বিশ্লেষণ গুনের দরুন প্রতি টি ইলাষ্ট্রেশন ও তার তাৎপর্য সহজেই মগজাবেশিত হয়েছে। দেবাশীষ বাবুর জন্য রইল প্রানভরা অভিনন্দন, সত্যজিৎ কে নতুন ভাবে চেনানোর জন্য।
সত্যজিৎ রায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তো ছিলেনি, কিন্তু সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় উনার কল্পনা শক্তি।যা তিনি এক অন্য স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই কল্পনা শক্তি এবং অঙ্কন শৈলী কে সমন্বয়ে যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন তিনি , তারি কিছু নিদর্শন সযত্নে ব্যাক্ত আছে রং তুলির সত্যজিৎ এ। বইটির কোন সমালোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই, তবে বইটির ছবি এবং তার বিশ্লেষণ অনেক ক্ষেত্রেই sync না হওয়ায় বারবার পাতা উল্টিয়ে সঠিক ইলাষ্ট্রেশন খুঁজতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।
সবশেষে রিফাত কে জানাই ধন্যবাদ বইটির সম্বন্ধে আলোকপাত করার জন্য। :) B-)
তিনি যে চিত্রকর তা আজও সাধারণ মানুষের কাছে যথেষ্ট অজ্ঞাত।অথচ চিত্রকর সত্যজিৎকে না জেনে শুধু চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎকে জানা তাঁকে সম্পূর্ণ জানা নয়। উক্তিটি এমন একজনের, প্রতিভায় যিনি সত্যজিৎ সরণির বাসিন্দা।তিনি পূর্ণেন্দু পত্রী। কবি,চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, চিত্রপরিচালক এমন বহু প্রতিভার অধিকারী শ্রী পত্রী ১৯৬০ সালে এমন মন্তব্য করলেও ২০২০ তে এসেও আমরা কি বলতে পারি চিত্রকর সত্যজিৎ নিয়ে চর্চা যথেষ্ট হয়েছে?
আমার নিজের অভিজ্ঞতা বড়ই তিক্ত। এক অঙ্কন শিক্ষার বোর্ডের প্রশ্ন ছিলো, প্রিয় শিল্পী কে ও কেন? আমার বোন উত্তর দেয় সত্যজিৎ রায়। পরীক্ষক কিছু বলার আগেই বোনের শিক্ষিকা বলে বসেন সত্যজিৎ রায় শিল্পী নন। বিষয়টায় আমার আক্কেল গুড়ুম। শিক্ষিকার সঙ্গে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা ও তিক্ততা শেষে জানতে পারি ওনাদের আঁকা শিক্ষার বোর্ডের সিলেবাসে সত্যজিৎ-এর নাম শিল্পী হিসাবে নেই৷ একটা বোর্ড।তার অনুমোদিত কত কত শিক্ষালয়। প্রতিটি শিক্ষালয়ে কত কত ছেলে মেয়ে আঁকা শিখছে। সত্যজিতের শিল্পী সত্ত্বাকে চিনবে না তারা? আশ্চর্য!
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করলাম, কারণ, এতেই বোঝা যায় আমাদের সত্যজিৎ চর্চার দৈন্য। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি যেমন রোগ লক্ষণ দেখে প্রেসক্রিপশন দেন, এক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশন হলো শিল্পী দেবাশীষ দেবের অসামান্য গবেষণা গ্রন্থ ' রং তুলির সত্যজিৎ '। আনন্দ পাবলিশার্স-এর সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত ৩২২ পাতার বইটি দেখে মনে হবে ৫০০ পাতার বই। পুরু এবং চকচকে ( গ্লসি ) পাতায় ঝকঝকে ছাপা, মূল্য ১২৫০/-।
দাম বেশি মনে হচ্ছে? আমারও হয়েছিলো। তবে গ্যারেন্টি দিয়ে বলতে পারি, কোন সত্যজিৎ প্রেমী বা অনুসন্ধানী বইটি উলটে পালটে দেখলেই অনুভব করবেন এমন বেশি কিছু দাম নয়।
বাঁধাই, প্রচ্ছদ, ছাপা। সবেতেই গ্রেড এ। পাতায় পাতায় রঙিন/ সাদাকালো ছবি।সবই সত্যজিতের আঁকা। মশাই এ যে কালেক্টরস আইটেম!
সত্যজিতের আঁকার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেবাশীষ বাবু বইটিকে মূলতঃ চার ভাগে ভাগ করেছেন। ১)প্রচ্ছদ ২)অলংকরণ ৩)অক্ষরশিল্প ও ৪)সিনেমার নেপথ্যে।
প্রথম প্রচ্ছদ আঁকা ১৯৪০ সালে। উনিশ বছরের সত্যজিৎ কলাভবনের প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন। বাবার ' পাগলা দাশু' বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন। সেই প্রচ্ছদ জোগাড় করে তা মুদ্রিত করেই দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেননি দেবাশীষ বাবু। করেছেন তার বিশ্লেষণ। কেমন? বই থেকেই তুলে দিচ্ছি। "... প্রচ্ছদ ছিল সাদা বর্ডার এর মাঝখানে একটা চৌখুপি জমি যার ওপর দিকে লাল রঙে বইয়ের নাম লেখা। একেবারে ক্লোজ-আপ এ রয়েছে দাশুর মুখ আর দূরে দেখা যায় তার বন্ধুরা উৎসাহ নিয়ে সম্পূর্ণ খালি বাক্সটা খুলছে। ওদের এই বোকা বনে যাওয়ার মুহূর্তে দাশু পাঠকের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ মটকে ' দেখেছ কী রকম দিলাম' গোছের একটা মুখভঙ্গি করছে। ফলে তার সঙ্গে পাঠকের এখানে দারুন একটা কমিউনিকেশন তৈরি হয়ে যাচ্ছে-- পাঠকও যেন এই তামাশাটা দাশুর সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে। পরিকল্পনাটা চমৎকার-- সেই সঙ্গে সরু লাইনে আঁকা দাশুর নাক, চোখ মুখের মধ্যেও হিউমারটাকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সত্যজিৎ। কে বলবে এটা তাঁর প্রথম কাজ।..."
এইভাবে একের পর এক প্রচ্ছদ ধরে অধ্যায়টিতে আলোচনা করে গেছেন দেবাশীষ দেব।প্রফেসর শঙ্কুর প্রচ্ছদের বিবর্তন কী ভাবে তাঁর চরিত্রের বিবর্তনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।ফেলুদার বইগুলির ক্ষেত্রে ইলাস্ট্রেশনধর্মী পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন এবং কীভাবে তা বইয়ের পাতায় ধৈর্য ধরে শুনিয়েছেন শ্রী দেব।এই বই না পড়লে জানতেই পারতাম না যে সিগনেট প্রেস প্রকাশিত সত্যজিৎ কৃত ' বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থের সেই অসাধারণ প্রচ্ছদ দেখে অত্যন্ত হতাশ হয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ স্বয়ং।
এবার আসি অলংকরণের কথায়। সরাসরি লেখককেই উদ্ধৃত করি,"...সত্যজিতের করা প্রথম ইলাস্ট্রেশন ছাপা হয় ১৯৪২ সালে মৌচাক পত্রিকায় কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ' অ্যাটাচি কেস গল্পের সঙ্গে। চলন্ত ট্রেনের কামরায় একটা জালিয়াত দলের পাণ্ডা ও তার তিন সাগরেদ মিলে একজন নিরীহ যাত্রীকে ঠকাবে---এই নিয়ে এক সরস গল্প।সত্যজিৎও তাঁর আঁকায় প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে কমিকাল ভাব এনেছেন এবং বুদ্ধি করে দৃশ্যটিকে সামান্য টপ অ্যাঙ্গেল থেকে দেখিয়ে প্রত্যেকের হাবভাব আর পোশাকের ডিটেলগুলোকে বেশ স্পষ্ট করে তুলেছেন।..."
এরপরে পাতায় পাতায় চমক নয়,চমকের বাবা। আনফিনিশড ড্রয়িং দিয়ে কীভাবে 'খাই খাই ' এর জন্য পেজ লে আউটে অভিনবত্ব এনেছেন সুকুমার নন্দন, ব্যাখ্যা করেছেন দেবাশীষ তেমনই অবন ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল -এর ইলাস্ট্রেশনে বঙ্গীয় লোকশিল্পের মেজাজ যে ধরে রাখা হয়েছে ---তাও তুলে ধরেছেন।
আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে ফেলু কাহিনির ইলাস্ট্রেশন স্টাইল একটার থেকে অন্যটা বেশ পৃথক। কেন এই পার্থক্য আলোচনা করেছেন দেবাশীষ।তিনি যেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় অধ্যাপক। কেন সোনার কেল্লায় সাদা কালোর কনট্রাস্ট, কেন রয়্যাল বেঙ্গল রহস্যতে সরু নিবের আঁচড় সে রহস্যের সমাধান ফেলুদা সুলভ ভঙ্গিতে করেছেন তিনি।
প্রচ্ছদ আর অলংকরণের পাশাপাশি সত্যজিতের অক্ষর শিল্প বা ক্যালিগ্রাফি নিয়েও বিশদ আলোচনা রয়েছে বইটিতে। তুলির টানে অল্প কথায় বিপুল এক দুনিয়া যেন বা খুলে দিয়েছিলেন সুপ্রভা তনয়। একটার থেকে আরেকটি পৃথক। বাংলা পুঁথির আদলে লেখা অচিন্ত্যকুমারের ' পিরম পুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ 'র প্রচ্ছদ হোক আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তর ' অর্কেস্ট্রা'র সরু লাইনের ঢেউ লাইনিং, ঐতিহ্যবাহী দেশ পত্রিকার লেটারিং থেকে শুরু করে ফিল্ম কমপ্লেক্স নন্দনের লোগো--- বাংলা অক্ষর শিল্পে নিঃশব্দ বিপ্লব কী ভাবে এনে দিয়েছিলেন ভারতরতন সত্যজিৎ, এই অধ্যায়ের ছত্রে ছত্রে তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ।
শেষ অধ্যায় হলো সিনেমার নেপথ্যে।পঞ্চাশ পাতারও বেশি জায়গা জুড়ে দেবাশীষ আলোচনা করেছেন সিনেমার দৃশ্যায়নের জন্য, চরিত্রায়নের জন্য, কস্টিউম আর প্রপস সাজাতে সত্যজিতের অসামান্য স্কেচ। খেরোর খাতায় রঙিন প্যাস্টেল দিয়ে আঁকা বেশ কিছু ছবির প্রসঙ্গ তুলে আক্ষেপ করেছেন লেখক, কেন যে এই স্টাইলে কয়েকটা শঙ্কু কাহিনির ইলাস্ট্রেশন করলেন না স্রষ্টা স্বয়ং।
সিনেমার পোস্টার,হোর্ডিং, হাউস ডেকোরেশন,বিজ্ঞাপন সবকিছুরই ��তুন ধারা তৈরি করেন সত্যজিৎ। দেবাশীষ বাবুর বই সেই জয়যাত্রার ধারাবিবরনী।
সত্যজিৎ রায়ের শিল্পপ্রতিভার সঠিক মূল্যায়নের জন্য এ বই আকর গ্রন্থ। এক দু দিনে নয়, এর পাঠ প্রয়োজন নিরন্তর, ধীরে ধীরে। তবেই এই সুবিশাল গবেষণার রস আস্বাদন করা যাবে।
রং তুলির সত্যজিৎ-এর কথা প্রথম শুনেছিলাম ২০১৭-এর শুরুতে। যেহেতু সত্যজিৎ রায় নামটা শুনলেই আমি মুগ্ধতা এবং আনন্দের ঠ্যালায় প্রায় আধমরা হয়ে যাই, সেহেতু এই বইয়ের প্রচ্ছদ এবং থিম দেখে-শুনে আমি মোটামুটি পাগল হয়ে গেলাম এটা সংগ্রহ করার জন্য। কপাল! এমন এক বই! ঢাকায় কোত্থাও পেলাম না (ঢাকায় তখনও বাতিঘরের যাত্রা শুরু হয় নি)। চট্টগ্রাম বাতিঘরে খোঁজ নিলাম। তাদের ওখানে ছিল, কিন্ত আনাবার কোন উপায় করা হয়ে উঠলো না। পরে যখন আনাবার সুযোগ হল, ততদিনে তাদের সব কপি শেষ। পরবর্তীতে পার্ক স্ট্রীটে পর্যন্ত এই বইয়ের জন্য খোঁজ লাগিয়েছিলাম। সেখানেও নাকি কপি শেষ, নতুনভাবে প্রিন্টিং-এর কাজ চলছে! কি আর! এক বুক কষ্ট নিয়ে বসে রইলাম। তারপরই ঢাকায় এলো বাতিঘর, এলো বইয়ের নতুন নতুন কপি। আর আমি মহা আনন্দে বই নিয়ে বাসায় ফিরলাম! বই খুলেই যখন লেখা দেখলাম, “যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এই বইটির জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন তাঁদের জন্য”-তখন আরও খুশি হয়ে গেলাম। এই বই তো আমার জন্যই!লেখালেখি কিংবা সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের ডেডিকেশনের কথা আমরা সবাই কম বেশি জানি। কিন্তু এই বইয়ে সত্যজিতের একদম আলাদা একটা ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন লেখক। রং তুলির জগতে যে সত্যজিৎ বাস করতেন, তাঁর কথাই বলা হয়েছে এই বইয়ে। সত্যজিতের বই পড়লে তাঁর আঁকা ছবির সাথে পরিচয় থাকাটা স্বাভাবিক। ফেলুদা কিংবা প্রোফেসর শঙ্কু, সব ছবিই তাঁর নিজের হাতে আঁকা। আর সেসবগুলো ছবিই তিনি কতটুকু চিন্তা-ভাবনা করে, গল্পের সাথে মিল রেখে এঁকেছিলেন, তার একটা সামগ্রিক রূপ পাওয়া যায় এই বইয়ে। মানুষ প্রতিভাবান হয় জানতাম। কিন্তু তাই বলে এতো!সে যুগে ফটোশপ বা ইলাস্ট্রেটর-এর চল ছিল না। কিন্তু শুধুমাত্র কালি-কলম, রঙ-তুলি ব্যবহার করে সত্যজিৎ যা সৃষ্টি করতেন, তা এযুগের সবকিছুকে হার মানায়। এখনকার বইয়ে তো প্রচ্ছদ বলে কিছু নেই-ই বলা চলে। অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদেরই মূল গল্পের সাথে কোন মিল থাকে না। অথচ সত্যজিৎ তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ কিংবা সিনেমার পোষ্টার, সবকিছুর মধ্যে ভেতরের কাহিনীর একটা ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করতেন। সিনেমার জন্য আবার তিনি আলাদা আঁকার খাতা মেইন্টেন করতেন। একটা দৃশ্যের চিত্রায়ন কিরকম হতে পারে বা কস্টিউম কিরকম হবে, তা তিনি আগে এঁকে নিতেন। এতে কাজ করতে অনেক সুবিধা হতো আর সবার জন্য।যাক, আরও অনেক বিশ্লেষণ আছে বইয়ে। লিখতে গেলে অনেক কিছু লিখতে হবে! লেখক যে এখানে শুধু সত্যজিতের কাজের প্রশংসাই করেছেন, তা কিন্তু নয়। যথেষ্ট সমালোচনাও রয়েছে বইয়ে। সব মিলিয়ে আমার মতো একজন সত্যজিৎপ্রেমী এবং আঁকিবুঁকিপ্রেমী পাঠকের আছে এই বই এক বিরাট আনন্দের খোরাক ছিল। বইটা সত্যজিতের প্রতি আমার ভালোবাসাকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করলো আর কি! 😊
এরকম দুর্দান্ত বই খুব কম হয়। শুরু থেকে রয়বাবুর চিন্তা, ভাবনা, কাজ করার পদ্ধতি, তাঁর আঁকা, নিজের কাজকে ভালোবাসা, কি নেই এই বইতে। যেকোনো বইপ্রেমী মানুষের কাছে এ এক সম্পদ।
This book is a valuable encyclopedia of all the work Satyajit Ray has done as a graphic artist divided into four broad sections - cover art, illustrations, typography and film related. The entire collection comes with commentary from the author (who is a renowned illustrator and artist himself), giving it an excellent context and flow.
সত্যজিৎ রায় নামটি নিলেই বেশিরভাগ মানুষের মাথায় তার সিনেমা এবং তার সাহিত্যকর্মের কথাই আসে। কিন্তু একজন গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে যে তাঁর বহু দিনের অসংখ্য অসামান্য কাজ, সেইগুলো নিয়ে খুবই কম আলোচনা হয়। বহু গুণের অধিকারী এই মহান শিল্পীর শিল্পবোধ এবং শিল্পকর্মকে আরোও গভীরভাবে জানতে চাইলে তাঁর করা ইলাস্ট্রেশন, সিনেমার পোস্টার, টাইটেল কার্ড, লোগো, ক্যালিগ্রাফির কাজগুলো সম্পর্কে না জানলেই নয়। সেই কাজগুলো নিয়েই দেবাশীষ দেব তাঁর 'রং তুলির সত্যজিৎ' বইটি রচনা করেছেন। বইটির কথা প্রথম জানতে পারি চলচ্চিত্র নির্মাতা সৌকর্য ঘোষালের একটি সাক্ষাৎকার থেকে। সত্যজিৎ রায়ের ডিজাইন নিয়ে এমন একটি বই আছে জেনেই প্রচণ্ড আগ্রহ জন্মে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে কিছুদিন আগে হাতে পাই বইটি। শেষ কবে কোনো বই হাতে পেয়ে এতো খুশি হয়েছিলাম মনে নেই। সেই আনন্দ আরো অনেকগুণ বেড়েছে বইটি পড়তে পড়তে। ডিজাইনার হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের সব ধরণের উল্লেখযোগ্য কাজগুলো নিয়ে এই সচিত্র বইটিতে চমৎকার আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। লেখক নিজেও একজন স্বনামধন্য শিল্পী হওয়ায় খুব সুন্দর করে উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ করেছেন সত্যজিতের কাজগুলো। ডিজাইনার হিসেবে সত্যজিতের পথ চলা, তাঁর অনুপ্রেরণা, দক্ষতা, নিজস্বতা, চিন্তা-ভাবনা সবকিছু নিয়েই চমৎকার ভাবে লিখা হয়েছে বইটিতে। সত্যজিতের ডিজাইন নিয়ে এমন বিশদ কাজ আরও হয়েছে বলে আমার জানা নাই। বইটি শেষ করে একটা কথাই মাথায় এসেছে, 'মহারাজা, তোমারে সেলাম'। একজন মানুষ কিভাবে পারে এক সাথে এতোগুলো শিল্পমাধ্যমে এমনভাবে প্রতিভার সাক্ষর রেখে যেতে! কি দুর্দান্ত তাঁর করা বইয়ের ও ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ, অলংকরণ, বিজ্ঞাপনের ডিজাইন, সিনেমার পোস্টার, ক্যালিগ্রাফি, লোগোগুলো! সেইসব ডিজাইনের পেছনের পরিকল্পনা, সুক্ষ চিন্তা ও দক্ষতা অসাধারণ। সত্যজিৎ রায়ের শিল্পকর্মের পরিধি ও তাঁর শিল্পপ্রতিভাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে এই অসাধারণ বইটি পাঠ করা জরুরী।
লেখকের অনেকাংশে অহেতুক বকবকানি কে উহ্য ধরে নিলে বইটাকে রীতিমত একটা হীরার টুকরা বলা যায়! এক সত্যজিতের গুনের মহাসমুদ্রের মাঝে শুধু এই বইটাকেও একটা পাতিসমুদ্র বলে চালিয়ে দেয়া সম্ভব৷ প্রত্যেকটা ইলাস্ট্রেশন, প্রত্যেকটা টাইপোগ্রাফি, প্রত্যেকটা পোস্টার যেন একটা আরেকটাকে ছাপিয়ে যাবার জন্য উঠে পরে লেগেছে। তবে সবচে অবাক করা এবং লক্ষ্য করার মত বিষয় এই যে সত্যজিৎ যেই ঢঙেই আঁক কষেছেন না কেন, তা হোক ক্যালিগ্রাফ��� কি পাশ্চাত্য ঢঙে, তার সব আঁকার মধ্যেই একটা দেশীয় নাড়ির টান পাওয়া যায়! রঙিন বা সাদাকালো যাই হোক না কেন তাতে রঙ, টেক্সচার, আলোছায়া বা ডিটেলের কারনে ছাপার কাগজ ছাপিয়ে ছবি যেন জীবন্ত হয়ে উঠতে চায়! ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় ধরে রিভিউ লিখতে গেলে এ রিভিউ শেষ হবে না। তবে কখনো ইচ্ছে হলে এই বই নিয়ে একটা বড় সড় লেখা দাড় করানো যেতে পারে।
তবে বই পড়া শেষে একটা ছোটখাট দুঃখবোধ সৃষ্টি হয়। সত্যজিতের বিভিন্ন বই নিয়ে পরবর্তিতে নানা কমিক্স, ইলাস্ট্রেশন হয়েছে। সবগুলোই অত্যন্ত নিরস প্রাণহীন মনে হয় যেন আমার কাছে। এত এত রঙের ব্যবহার তবুও যেন সত্যজিতের সাদাকালো ইলাস্ট্রেশনের ধার দিয়েও যায় না। এর বাইরেও আমাদের দেশের এবং পাশের দেশের নতুন সব কমিক আকিয়েদের আঁকা নিয়েও আমার কিছুটা দুঃখবোধ কাজ করে। এত ভালো ভালো সব আঁকিয়ে, কিন্তু সবার আঁকায় পাশ্চাত্য প্রভাব অনেক বেশি। সত্যজিতের মতন নাড়ির টানটা যেন আর খুব একটা কারো আঁকায় পাওয়া যায় না।
"রং তুলির সত্যজিৎ" - হাতে নিতেই মন ভাল হয়ে যাবার মত একটা বই। মনকাড়া প্রচ্ছদ সাজানো সত্যজিতের আঁকা বিভিন্ন ছবি, বইয়ের প্রচ্ছদ, সিনেমার পোস্টার, স্কেচ এসব নিয়ে করা কোলাজ দিয়ে। আর পাতা উল্টোলেই ঝকঝকে প্রিন্টে ছাপা রঙিন সব ছবি। আর সেই ছবি তো আঁকা স্বয়ং সত্যজিতেরই -আর কী চাই!
বেশ অনেকটা সময় নিয়ে পড়া শেষ করেছি। সত্যি কথা বলতে কী, বইটা পড়ার আগে সত্যজিৎ রায়কে জানতাম চলচ্চিত্রকার এবং লেখক হিসেবে। তাঁর চিত্রকর সত্ত্বা সম্পর্কে ধারণা ছিল টুকটাক - বইয়ের ইলাস্ট্রেশনে, ফেলুদা, শঙ্কু বা অন্যান্য গল্পগুলোতে আঁকা ছবি - এটুকুই। কিন্তু তিনি যে এতবড় মাপের চিত্রশিল্পী সেকথা জানা ছিল না মোটেই। বইটা সত্যজিতকে নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে, পড়তে পড়তে আবিষ্কার করেছি অন্য এক সত্যজিতকে। "রং তুলির সত্যজিৎ" বারবার উল্টে পাল্টে দেখার পর তাই একটা কথাই বলার থাকে -