Sunil Gangopadhyay (Bengali: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) was a famous Indian poet and novelist. Born in Faridpur, Bangladesh, Gangopadhyay obtained his Master's degree in Bengali from the University of Calcutta, In 1953 he started a Bengali poetry magazine Krittibas. Later he wrote for many different publications.
Ganguly created the Bengali fictional character Kakababu and wrote a series of novels on this character which became significant in Indian children's literature. He received Sahitya Academy award in 1985 for his novel Those Days (সেই সময়). Gangopadhyay used the pen names Nil Lohit, Sanatan Pathak, and Nil Upadhyay.
Works: Author of well over 200 books, Sunil was a prolific writer who has excelled in different genres but declares poetry to be his "first love". His Nikhilesh and Neera series of poems (some of which have been translated as For You, Neera and Murmur in the Woods) have been extremely popular.
As in poetry, Sunil was known for his unique style in prose. His first novel was Atmaprakash (আত্মপ্রকাশ) and it was also the first writing from a new comer in literature published in the prestigious magazine- Desh (1965).The novel had inspiration from ' On the road' by Jack Kerouac. His historical fiction Sei Somoy (translated into English by Aruna Chakravorty as Those Days) received the Indian Sahitya Academy award in 1985. Shei Somoy continues to be a best seller more than two decade after its first publication. The same is true for Prothom Alo (প্রথম আলো, also translated recently by Aruna Chakravorty as First Light), another best selling historical fiction and Purbo-Paschim (পূর্ব-পশ্চিম, translated as East-West) a raw depiction of the partition and its aftermath seen through the eyes of three generations of Bengalis in West Bengal, Bangladesh and elsewhere. He is also the winner of the Bankim Puraskar (1982), and the Ananda Puraskar (twice, in 1972 and 1989).
Sunil wrote in many other genres including travelogues, children's fiction, short stories, features, and essays. Though he wrote all types of children's fiction, one character created by him that stands out above the rest, was Kakababu, the crippled adventurer, accompanied by his Teenager nephew Santu, and his friend Jojo. Since 1974, Sunil Gangopadhyay wrote over 35 novels of this wildly popular series.
Death: Sunil Gangopadhyay died at 2:05 AM on 23 October 2012 at his South Kolkata residence, following a heart attack. He was suffering from prostate cancer for some time and went to Mumbai for treatment. Gangopadhyay's body was cremated on 25 October at Keoratola crematorium, Kolkata.
Awards & Honours: He was honored with Ananda Award (1972, 1979) and Sahitya Academy Award (1984).
এই সেই সময় যখন কলকাতার বাবু সমাজ সুরা, নারী ও বুলবুলী-বিলাসে মগ্ন, যখন ঘুণে ধরা সমাজের নব্য শিক্ষিত যুবকেরা প্রাণপণে ইংরেজ অনুকরণে মত্ত, চারিদিকে খ্রিষ্টান ধর্মের জয়জয়কার।
এদিকে গ্রাম নিঃস্ব করে প্রাজাদের স্কন্ধ্রে খাজনা নামক অনায্য বোঝা চাপিয়ে সেই অর্থে চলছে সংস্কৃতি চর্চা, সমাজ আর ধর্ম সংস্কার।
এই গল্প আমার গল্প।
আমার অতীতের গল্প।
আর কার?
নবীনকুমার সিংহের গল্প। তা বেড়ে উঠার গল্প। তার আশে পাশের সমাজের গল্প।
গল্পটা গঙ্গানারায়ণের।
বিধুশেখর বাবুর।
রাইমোহনও আছে এই গল্পে।
বিম্ববতী নামে এক মমতাময়ী মায়ের গল্পে। যে সহস্র কষাঘাত সহ্য করে গিয়েছেন নিজের সংসারের জন্য।
সময় বড়ই অদ্ভুদ।
আর সুনীল বাবুর ‘সেই সময়’ আরো এক কাঠি সরেস।
গল্পে থ্রিল চান?
হয়তো পাবেন না
কিন্তু বিস্ময়ে বাক্যহারা হতে চাচ্ছেন?
সব রথীমহারথী দের জীবন্ত দেখতে চান দুই মলাটে বসে থাকা কালো হরফের মাঝে?
তবে হাতে তুলে নিন সেই সময়।
কেন বললাম ?
মাইকেল মধুসূদন দত্ত কে চেনেন কি ভাবে?
জানেন তার অতীত?
উত্তর খুজে পাবেন সেই সময়ের পাতায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর!
বাংলা গদ্যের জনক হিসেবেই চেনেন! আর সমাজ সংস্কারক হিসেবে তার অবদান কতখানি?
কতটুকু ধারণা আছে আপনার?
নীলদর্পনের নাম শুনেছেন?
শুনেছেন দীন বন্ধু মিত্রের কথা?
বলুন তো সিপাহী বিদ্রোহ এর প্রথম সূতিকাগার কাকে বলা হয়?
কে প্রথম সাহেবদের মুখে বন্দুক তাক করে?
এমন অনেক জানা না জানা স্বর্ণাক্ষরে রচিত সময়ের সাক্ষী ‘সেই সময়’।
বইটিতে লেখক তার সুনিপুণ লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন ১৮৪০-১৮৭০ এর সময়ে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাবলী।
ঐতিহাসিক ঘটনার এত সাবলীল বর্ণনাও হতে পারে তা এই বই না পড়লে জানা সম্ভব হত না।
উত্থান-পতন, জন্ম-মৃত্য নিয়ে আমাদের চারপাশ।
জীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। আর ১৮ শতকের জীবনযাত্রা ছিল আরো বৈচিত্র্যময়।
সেই বৈচিত্র্যময়তাকে উপজীব্য করেই সুনীল বাবুর ‘ সেই সময়’ এগিয়ে গিয়েছে সেই সময়ের বাঁকে বাঁকে
কিছু কিছু বই আছে যা না পড়া থাকলে নিজেকে পাঠক বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে।
কিছু কিছু বই থাকে যাতে বুঁদ হয়ে যেতে সময় লাগে না এক মুহর্তও । আবার বইটি শেষ করার পর ঘোর লেগে থাকে নিজের আশে পাশের পুরোটা জুড়ে।
নিজেকে ওই দুই মলাটের মাঝে সুপ্ত এক চরিত্র হিসেবে কল্পনা করতে।
নিজেকে মাঝে মাঝে নবীনকুমার, কখনো বা গঙ্গানারায়ণ কখনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধুর মাঝে হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে সময়ের অন্তরালে সেই সময়ের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে।
বইয়ের মাঝে গন্ধ পাওয়া যায় জানেন?
সেদো মাটির গন্ধ। বৃষ্টির ঘ্রাণ।
নদীর তীরের দখিনা বাতাস।
কিংবা সহধর্মিণীর সদ্য স্নান শেষে ভেজা চুলের গন্ধ
সেই রমনীর চপলতা, ঝংকার তোলা হাসি।
কিংবা ভোর রাতে (নাহ থাক বাচ্চাকাচ্চা আছে অফ যাই 😜)
বুঁদ হওয়ার মানে খুঁজে পেলাম সেই সময় পড়ে।
হারিয়ে গিয়েছি নবীনকুমারের সাথে।
পথের সাথী হিসেবে নিয়তি জুটিয়েছে সরোজ কে নবীনের সাথে। কিন্তু পড়ার সময় মনে হয়েছে এই কিশোরী টা আমারই সহধর্মিণী 😍
বইটির প্রত্যেকটি দৃশ্যপট কে লেখক এমন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যে প্রত্যেক লাইন এর বর্ণনা নিজের চোখের সামনে ফুটে উঠেছে আমার নিজের চোখের সামনে।
সেই সময় এমন একটি উপন্যাস যেখানে নির্দিষ্ট কোনো চরিত্র কে হাইলাইট করে এগুনো অসম্ভব। প্রত্যেক চরিত্রে সমান গুরুত্ব আপনাকে দিতেই হবে।
এই প্রথম এত্ত বড় বই শেষ করলাম (৭০০+)
এই প্রথম বারের মত কিছু অনুভুতি দাগ কেটে গেল।
বিস্ময়ে হতভম্ব হলাম প্রথম বার।
মাঝে মাঝে কখন যে চোখ ভিজে উঠেছে কখন বুঝতে পারিনি।
জীবনে প্রথম বার মনে হল বইটি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল :/
চতুর্দশ শতকে ইউরোপে ঘটা রেনেসাঁসের মতো আমাদের এই বৃহত্তর বাংলায়ও একসময় রেনেসাঁস ঘটেছিল। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ প্রভৃতি প্রথার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হচ্ছিল, বিধবা বিবাহকে বরণ করে নেওয়া হচ্ছিল, নারী শিক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছিল, প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসকে প্রশ্ন করে নতুন বিশ্বাসের জন্ম হচ্ছিল, সুরা-নারী-পূজার বৃত্ত ভেঙ্গে মানুষ সমাজ সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছিল, নতুন কাব্য-নাটক-উপন্যাসের সৃষ্টি হচ্ছিল আবার নিজেদের ‘দেশ' ধারণার জন্সও হচ্ছিল তখন। ভুলোমনা জাতি হিসেবে খুব সহজেই আমরা সেসব ইতিহাসকে ভুলতে বসেছি, সেই প্রেক্ষাপটে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাজির তাঁর ‘ সময় ট্রিলজি' নিয়ে যেখানে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে তিনি নিজের কালিতে ইতিহাসের আলোকে নতুনভাবে সৃষ্টি করেছেন আর সাথে যোগ করেছেন নিজের কল্পনাপ্রসূত কিছু চরিত্র যারা ইতিহাস আর ফিকশনকে এক সুতায় গেঁথেছে।
লেখকের বয়ান মতে, বইয়ের প্রধান চরিত্র ‘ সময়' আর এর শারীরিক রূপ নবীনকুমার। অর্থাৎ লেখক নবীনকুমার চরিত্রটার মাধ্যমে সময়কে ধরতে চেয়েছেন, আর সেই সময়টা হলো বাংলার রেনেসাঁসের সময় তথা ১৮৪০-১৮৮০ সাল। অর্থাৎ ‘ সেই সময় ‘ হলো নবীনকুমার চরিত্রটার মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসের সেই সময়টাকে ধরার একটা চেষ্টা যখন বাংলার সমাজে একটা পরিকল্পিত বাঁক পরিবর্তন ঘটছিল।
বইয়ের চরিত্রগুলোকে সহজেই দুইটা ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে রয়েছে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো আর অন্যভাগে লেখকের সৃষ্ট চরিত্রগুলো। ঐতিহাসিক চরিত্রের মধ্যে বইয়ে উঠে এসেছে রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কেশব চন্দ্র সেন, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, রাধাকান্ত দেব, প্যারীচাঁদ মিত্র, দীনবন্ধু মিত্র, হরিশ মুখার্জি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রানী রাসমণি প্রমুখ। প্রায় প্রতিটা চরিত্রের বিকাশ, সমাজ সংস্কারে ভূমিকা বইয়ের প্রধান আলোচ্য বিষয়। একদিকে এসব চরিত্র কিভাবে সমাজে নতুন দিক উন্মোচন করলেন তা যেমন উঠে এসেছে তেমনি উঠে এসেছে বিরুদ্ধ মতের সাথে যুদ্ধের কথা। সতীদাহ, বহুবিবাহ, নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ, নতুন ধর্মমত, প্রথম উপন্যাস-নাটক, নতুন ছন্দ, দেশের মানুষের জন্য সংবাতপত্র এঁদের এসব ভূমিকার কথা বলা হয়েছে পুরো বই জুড়ে। সাথে তিন সাহেব ডেভিড হেয়ার, পাদরি ল্যাং আর জন বিটনের ( বেথুন) এদেশের জন্য একাত্মতার কথাও উঠে এসেছে। দুইটা সংঘের কথা না বললেই নয় যা সেই সময়কে নতুন সময় বানিয়েছিল তারা হলো ইয়াং বেঙ্গল গোষ্ঠী এবং ব্রাহ্ম সমাজ। সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে ভেঙ্গে আলোকপ্রাপ্ত নতুন পথ সৃষ্টিতে তারাই ভূমিকা রেখেছে সব চেয়ে বেশি। একদিকে যেমন মধুসূদনের বন্ধু গৌরের প্রতি আলাদা টান, বাঙালি থেকে ইংরেজ হয়ে আবার বাঙ্গালি হওয়া, ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রায় একার সংগ্রাম, ঠাকুর বাড়ির বংশ ইতিহাস, ব্রাহ্ম সমাজের উৎপত্তি ও ভাঙ্গন এসব জানা যায় ঠিক তেমনি সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা, নারীর অবস্খান, নীল চাষের অত্যাচার, জমিদারি প্রথার স্বরূপ, সিপাহি বিপ্লবের ইতিহাস, উঁচুতলার মানুষের জীবনযাপন, নিচুতলার মানুষের সংগ্রা��� এসবও উঠে আসে।
দ্বিতীয় ভাগ তথা লেখকের সৃষ্ট চরিত্রগুলোও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। নবীনকুমার, গঙ্গানারায়ণ, বিধুশেখর, রামকমল, থাকোমনি, হীরা বুলবুল, কমলা সুন্দরি, চন্দ্রনাথ, কুসুমকুমারী, রাইমোহন, বিম্ববতী, বিন্দুবাসিনী প্রমুখ চরিত্রের রয়েছে নিজস্ব জীবনবোধ, জীবনের উত্থান-পতন, সমকাল সাপেক্ষ যুগের প্রভাব। সেখানে যেমন রয়েছে বালিকা বয়েসে বিধবা হওয়ার পর একা থাকার কথা, সমাজের চাপে বারবনিতা হয়ে যাওয়া, স্বামীর পর অপরাধ মুখ বুঝে সহ্য করা আবার রয়েছে নতুনভাবে শুরু করে সুখী হওয়া, বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বামীকে খুন করার আখ্যান। প্রতিটা চরিত্রে মুগ্ধ করার মতো কিছু আছে, কেউ বারবনিতা হয়ে বিধবা বেশ গ্রহণ করে, কেউ দালাল হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয় মোসাহেবি করে, কেউ জেদের বশে করে অসম্ভব সব কাজ আবার কেউ নিজের কাছে সৎ থাকতে সংসার ছেড়ে দূরে চলে যায়। গঙ্গানারায়ণ -বিন্দুবাসিনী আর নবীনকুমার-কুসুমকুমারী প্রেম বা গভীর আকর্ষণ মুগ্ধ করে বিশেষভাবে। কিছু কিছু চরিত্র এত আপন মনে হয়েছিল যে তাদের পরিণতি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল যেমন বিন্দুবাসিনী বা নবীনকুমার।
লেখকের প্রধান সহায়ক গ্রন্থ ‘ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' এবং অন্যতম সহায়ক গ্রন্থ যেমন ডিরোজিও বা ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনী আগে পড়া থাকায় তৎকালীন ইতিহাস বেশ ভালোই জানা ছিল। কিন্তু যেসব তো কাটখোট্টা ইতিহাস, সেই ইতিহাসকে নবীনকুমারদের সাহায্যে জীবন্ত করে তোলাই লেখকের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। ছোট ছোট ফ্রন্টের ৭০০+ পৃষ্ঠার দীর্ঘ বইটা পড়তে অনেক সময়ই লাগল কিন্তু এ কয়দিন যেন নবীনকুমারদের সাথে আমিও সেই সময়ে অবস্থান করছিলাম, সমাজের অসঙ্গতিগুলো নিজ চোখে দেখছিলাম, তা দূর করতে আন্দোলনে শরিক হচ্ছিলাম, কখনো সফলতার আনন্দে ভাসছিলাম আবার কখনো ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়ছিলাম। তো বইটা যেখানে শেষ হলো তথা ঈশ্বরচন্দ্র, মাইকেলদের দিন শেষ হচ্ছিল আর বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথদের দিন শুরু হচ্ছিল তারপরের ইতিহাস জানতে লেখকের ট্রিলজির পরের দুইটা বই পড়তে আর দেরি করা যাচ্ছে না, অচীরেই শুরু করব বাকি দুইটা।
এ এক আশ্চর্য্য উপন্যাস। এক ভীষণ দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা যাকে নিয়ে অনেক, অনেক কথা বলতে হয়। তবুও সেসব মুলতুবি থাক আপাতত। যত কথা বলবার, আজ নয়, সব পরে হবে খন। দেখা হবে আবার, অপর প্রান্তে, দ্বিতীয় ভাগের শেষে।
কদিন ধরে পড়াশোনার ফাঁকফোকরে যে বইটির ভাজে আঙুল রাখার সুযোগ ঘটছে, সেটা হলো সেইসময়৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন এই বইতে তিনি ভারতীয় রেনেসাঁস নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে চান। এটির প্রথম খন্ড আর পরবর্তী বই প্রথমআলো পড়ে একটি কথাই বলা যায় তার রচনা সম্পর্কে, সুনীল বড় কৃতজ্ঞতাবোধসম্পন্ন লেখক।
জনপ্রিয় সকল লেখকই একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে কাজ করেন, না হলে জনপ্রিয় হলেন কী করে? সে হিসেবে সুনীল ব্যক্তিগত ভাবে নাস্তিক হলেও তার রচনা মুখপত্র হিসেবে কাজ করেছে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের। রেনেসাঁস বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সুরে বলাই যায় এটি জনগণের সব শ্রেণীর সম্মিলনে সংঘটিত হয়নি৷ বরং ইংরেজতোষক ধনী জমিদারশ্রেণী, যাদের উদ্ভব হয়েছিল প্রথমত ইংরেজের সহকারী ব্যবসায়ী হিসেবে ও পরবর্তীতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে হঠাৎ জমিদার বনে গিয়ে, তাদের কল্যাণে ও সর্বাত্মক চেষ্টায় এটি মানুষের মুখে রেনেসাঁস হিসেবে চালু করা হয়েছে। আদতে তা কেবল একটি সুবিধাভোগী শ্রেনীর নিরাপত্তা-কবচ বৈ আর কিছু নয়।
যাকে আমরা ভারতীয় রেনেসাঁসের প্রতীকরূপে দেখি সেই নৃত্যকলা, গান, সাহিত্য মূলত ছিল ইংরেজী শিক্ষিত এই বাঙালীশ্রেণীর বিলাসব্যসনের একটি অংশ। সুনীল গাঙ্গুলী যদিও পূর্ববঙ্গের রায়তশ্রেণীর অন্তর্গত মানুষ, তবু সেইসময় ও প্রথমআলোয় তিনি বন্দনা করেছেন এই জমিদারদেরই, যাদের বিলাস ব্যাসনের যোগান দিয়েছেন এই সুনীলদেরই কোন পূর্বপুরুষ। নৃত্য, গান, নাটক, চিত্রকলা ইত্যাদী বাদ দিলে সেইসময় ও প্রথমআলো যে আরেকটি অনুষঙ্গ নিয়ে গড়ে উঠেছে সেটি হলো ধর্ম। বঙ্কিমচন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠাই অনেকটা এইসব উপন্যাসের জনপ্রিয়তার কারণ। ওপার বাংলায় দেবজ্ঞানে পূজ্য এইসব ব্যক্তিবর্গের কীর্তিকলাপকে উপজীব্য করে লিখিত এসব রচনা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নিজেদের আয়না হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাই তাদের কেউ যখন বলেন সুনীলের সমস্ত লেখা তিনি পবিত্রজ্ঞানে শিথানে রাখেন তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই৷ কিন্তু এপারবাংলায় এর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বোঝাটি একটু জটিল।
বিভাগপূর্ববর্তী শিক্ষিত বাঙালীমাত্রই কোলকাতার শিক্ষা-সাহিত্যে প্রভাবিত। শিক্ষিত জমিদার শ্রেণীর রচিত ভাষা, সাহিত্যকেই সেকালের বাঙালী নিজেদের বলে পরিচয় দিয়েছে। বিভাগ পরবর্তী সময়ে খুব ভাল একটি সম্ভাবনা ছিল ঢাকা বাংলাভাষার আরেকটি কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হবে। কিন্তু বাঙালী শিক্ষিত সমাজ ততদিনে যে আরেকটি মোহে আটকে গিয়েছে সেটি হলো কমিউনিস্ট পার্টি। প্রধানত শিক্ষিত হিন্দুদের নেতৃত্বে পরিচালিত এইসব বামপন্থী সংগঠনের চিন্তাভাবনার কেন্দ্র যথারীতি কোলকাতা, সেইসূত্রে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, ঈশ্বরচন্দ্র ইত্যাদী। যার ফলে দেশবিভাগ যে একটি বিপুল সম্ভাবনা তৈরী করেছিল, মুসলিম বাঙালিদের আলাদা একটি সাহিত্যবোধ তৈরী করা তা কয়েকটি দশকের জন্য পিছু হটল। ফররুখ, জসীমউদ্দিন প্রমুখের মাধ্যমে যে পূর্ববঙ্গীয় ভাষাও সাহিত্যচর্চা তৈরী হচ্ছিল তা আর ধরে রাখা যায়নি৷ বরং বামপন্থী সাহিত্যের ধ্বজাধারী প্রতিষ্ঠান যথা, ছায়ানট, শিল্পকলা একাডেমী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ইত্যাদীর মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গীয় চেতনার রোশনাই আরেকটু দীর্ঘ হয়েছে কেবল৷
এপার বাংলার সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে নামেই, তা সর্বান্তকরণে হয়ে উঠতে চেয়েছে পশ্চিমবঙ্গীয়। যেন বামুনের টিকি না থাকলেও ধার করে আ��া ফুল বেলপাতা সামনে ধরা আছে। তাই তো সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশের চরিত্ররা যতটা সহজে প্রতিদিন সান্ধ্যআহ্নিক করতে পারে, মূর্তির সামনে উবু হতে পারে হুমায়ুন-আনিস-সাবেরের চরিত্ররা ততটা সহজে টুপি পরে মসজিদে যেতে কিংবা ওড়না পরে কোরআন হাতে নিতে পারে না। এদেশের পাঠকের মন-মগজে এখনো সেই জমিদারের ষষ্ঠী আঁকা রয়েছে। যাদের কেন্দ্র কোলকাতা, গুরু রবীন্দ্রনাথ আর সংস্কৃতি মানে কুচানো ধুতি পরে গালে আল্পনা আঁকা। তাদের কাছে সেইসময় প্রথমআলো প্রিয় উপন্যাস হবে তাতে আর আশ্চর্য কী!
‘সেই সময়’ একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস যার পটভূমি ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ সাল।মাইকেল মধুসূদন,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেক বিখ্যাত চরিত্র এই উপন্যাসের মাধ্যমে আবার জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে।ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কলকাতা এই উপন্যাসের পটভূমিকা । সেই সময়ের সামাজিক সমস্যা,বাবু কালচার,বাল্যবিবাহ ও বিধবাদের করুন অবস্থা সবই উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।গল্পের নায়ক নবীনকুমার যার জন্ম দিয়ে উপন্যাসের শুরু তাকে কেন্দ্র করেই পুরো উপন্যাসের আবর্তন। ইতিহাসের মত বোরিং একটা জিনিস এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন সুনীলের মত আর কেউ পারবে বলে মনে হয় না। সুনীলের নিরপেক্ষ কলমের হাত থেকে কোন চরিত্রই ছাড় পায় নি,শুধুমাত্র বিদ্যাসাগরই নিজের সম্মান রাখতে পেরেছেন।কিছু চরিত্রের হঠাৎ মৃত্যু উপন্যাসের গভীরতা আরও বাড়িয়েছে।লেখক একটা সাসপেন্স রেখেছেন নবীনকুমারের চরিত্র নিয়ে,সেটার জন্য বইটা পড়ে দেখতে হবে। বড় উপন্যাস পড়ার সময় বারবার পৃষ্ঠার দিকে চোখ যায়;কখন শেষ হবে?কিন্তু ৭০৯ পৃষ্ঠার এই বই আপনাকে এমন মোহে আবদ্ধ করে রাখবে,সময় বা পৃষ্ঠা কিছুই খেয়ালে থাকবে না,যেটা যেকোনো বইয়ের জন্য একটা ভাল দিক।বাংলার ইতিহাস নিয়ে জানতে চাইলে এর চেয়ে ভাল,সুন্দর ও সহজ বই দ্বিতীয়টি নেই।
সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়। চলুন একটু টাইম ট্রাভেল করে ঘুরে অাসি বহিয়া যাওয়া সময়ে। কল্পনা করুন ইতিহাসের পাতায় অাপনি এক ছোট্ট শিশু। ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন দেড়শ বছর অাগের সময়ে।
কি কল্পনা শক্তিকে জাগ্রত করতে অসুবিধে হচ্ছে?কোন ব্যাপার না। সুনীল বাবুর "সেই সময়" বইখানা খুলে বসুন। তারপর বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকুন অার ঘুরে বেড়ান ইতিহাসের পাতায়।
কোন সময়ের ইতিহাস? ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ সালের বাংলায়।
মনে করুন অাপনি এক ছোট্ট শিশু অার নাম নবীন কুমার। সময়কে ধরণ করে এগিয়ে চলেছেন অার অাপনার চোখের সম্মুখে ঘটে চলেছে নানা উত্থান পতন। বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন অার বাংলার রথি মহারথীরা ছুটে চলছে অাপনার সামনে। এ যেন এক বিস্ময়!
কি দেখবেন অাপনি? দেখবেন চোখের সম্মুখে ছুটে বেড়াচ্ছেন প্রিন্স দ্বারকানাথ। হেয়ার সাহেব ভারতের শিক্ষা প্রসারে অার বিদ্যাসাগর মহাশয় ব্যস্ত সংস্কার সংস্করণে। অার রামমোহন রায় অাছেন অাপন ভূবনে। এখানেই শেষ নয় অারো অাছে! মধুসূদন দত্ত মাইকেল হয়ে উঠার বিরাট ইতিহাস দেখবেন অাপনি। সেই সাথে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ ফ্রীতে দেখে নেওয়াটা অাপনার উপরি কামায়। অাপনার চোখের সম্মুখে ঘটছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার অার বাঙ্গালি বাবুদের বেলাল্লাপনা। নানা উপজীব্য ঘটনা নিয়ে সময়ের মৃত্যুর সাথে ছুটে চলেছেন অাপনি।
বাংলার উত্থান পতন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতার উপর দাড়িয়ে অাছে"সেই সময়"। সময়ের চাকায় অবগাহন করতে চাইলে চলুন ঘুরে অাসি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময়ের পাতায়।
বইটি নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষমতা আমার মত ক্ষুদ্র পাঠকের নেই। আমি অবাক হয়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পাঠকের মন নিয়ে খেলা করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে। তিনি মুহূর্তের মধ্যেই লেখনী দিয়ে পাঠককে শান্ত ভাব থেকে উগ্র ভাবে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে আবার ফেলে দিতে পারেন। বস্তুত মনে হয়েছে মহাগাঁথা পড়ছি। এত বিশিষ্ট মানুষকে নিয়ে বিশাল লেখা পড়েও মনে খেদ থেকে যায় যে সবার সব কাহিনী তো জানা হলো না। ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ে লাভ এই যে ইতিহাসের চরিত্রগুলিকে আপন মনে হয়। আর সাধারণত মূল তথ্যগুলো কখনোই ঔপন্যাসিকেরা বানিয়ে লেখেন না। তাই এগুলো প্রত্যেকেরই পড়া উচিত।
এই উপন্যাসে আমার মধ্যে দাগ কেটেছে বিধুশেখর চরিত্রটি। এই মানুষটির প্রতি একই সাথে ঘৃণা, শ্রদ্ধাবোধ দুটোই জেগেছে। তবে সব শেষে সেই অমোঘ বানীই সত্য,
বই খুলে লেখকের সৃষ্ট চরিত্র,পটভূমির মধ্যে ডুব দিতেই সাক্ষী হতে হয় সংস্কার-কুসংস্কারের,কর্ম-অপকর্মের,বিপ্লবের।পৃষ্ঠা উল্টালে সাক্ষী হতে হবে মধুসূদন দত্ত থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মের।ঋণী হতে হবে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো আরো অনেক শোনা-না শোনা নামের কাছে।"নারীবাদী" খেতাব নিয়ে একবিংশ শতাব্দীর এই লড়াই ফিকে হয় যেতে থাকে সেই সময়ের পাতায় পাতায়।অজস্র প্রশ্ন নিয়ে প্রথম খন্ডটি বন্ধ করে বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডটি খোলার কৌতুহল আটকে রাখা কষ্টকর বটে!
সেই সময় পড়লে যে কত কিছু অজানা তথ্য জানা যায় তার ইয়ত্তা নেই। এই ৮০ পাতার মধ্যে কত কিছু না জানলাম। মধুসূদন দত্তের যৌবনকাল , তাঁর সুরার আসক্তি, তাঁর সমকামী আচরণ, হেয়ার সাহেবের উদারতা, তৎকালীন কলকাতার সমাজ, ঠাকুর বংশের আদি কথা , কেন তাঁদের পিরালী বা কুশারী বামুন বলা হয়, কিভাবে তাঁরা ঠাকুর হলেন। সেই সময় যেন আমাদের এক লহমায় আমাদের সেই সময়কার কলকাতায় নিয়ে যায় যেই কলকাতার কথা আমাদের সব বাঙালির আত্মপরিচয়ের দলিল।
তুলনাহীন। গল্প, সময়, ইতিহাসকে দুই মলাটে এত এত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। ঘোর লাগা একটা বই। অসাধারণ। এরকম একটা বই একজন লেখককে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায় নিঃসন্দেহে।
No historian captured and summarized the renaissance period as brilliantly as Mr. Sunil Ganguly. Very well researched and an exquisite example of magic realism.
সে এক অদ্ভূত সময়। এ যেন জমিদার, রাজা-প্রজা, ইংরেজ সাহেব সকল চরিত্রের ঊনবিংশ শতাব্দীর এক বিরাট সময়লীলার ক্ষুদ্র উপাখ্যান।
কতকের সাথে নব্য পরিচয় ঘটে আবার কতকের পুরনো পরিচয় নতুনভাবে ঘাঁটি বাঁধে মনে।
মধুসূদনের ইংরেজি সাহিত্যের নেশা কিংবা বিদ্যাসাগরের বাংলা গদ্য রচনার সূচনালগ্ন, প্রভাবশালী পিতা দ্বারকানাথের সাথে ব��রাহ্ম ধর্ম প্রতিষ্ঠায় 'অগ্রজন তুল্য' পুত্র দেবেন্দ্রনাথের জীবনাদর্শের ভিন্নতা, সাত-আট বছরের বালিকার সহিত ষাটের ঘরে পদার্পিত মানী বংশের 'সুপুত্র' এর বিবাহ এবং বালিকা বয়সেই বিধবাবেশ বরণ তো সেকালের সহজাত দৃষ্টান্ত। সতীদাহ সবে মাত্র উঠল বৈকি!
সুশীল ইংরেজ জাতির সুহৃদ হেয়ার সাহেবের বিয়োগব্যথা তৎকালীন ভারতবর্ষের মানুষকে যেমন ছুঁয়েছে, ঠিক এত শতাব্দী পরেও তা আমাকে অশ্রুসিক্ত করল। আর বেথুন সাহেবের নারী শিক্ষার জন্যে প্রথম বেথুন স্কুল ও কলেজ এতকাল পরেও ঠাঁই দাঁড়িয়ে কলকাতায়।
এত এত চরিত্রের এত এত বৈচিত্র্য জীবনের এত এত কাহিনীর মাঝেও মনের সুপ্ত ইচ্ছা ছিল গঙ্গা ও বিন্দু মিলিত হোক এক বিন্দুতে। তবে বালিকা বিধবা বিন্দুর জন্যে এক শব্দে তা তো 'পাপ'।
একদিকে সুরা পান, নারী, নৃত্য, বিলাসিতার উন্মত্ততা আবার অন্যদিকে পোড়াগৃহ, পোড়া-ফসল সর্বোপরি পোড়াকপালের কাহিনীও জুড়ে আছে সেই সময়ে। নবচিন্তাধারা বিকাশের প্রথমকালও তো এই। এ সময়ে এসে সেই সময় দেখলাম যেন চক্ষু সম্মুখে। অদ্ভুত বড়ই অদ্ভুত!
সেই সময় লেখক : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স। 'সেই সময় ' সুনীল রচিত টাইম ট্রিলজির অন্যতম। বইটি হাতে নিয়েছিলাম ফেব্রুয়ারিতে। ৭০৩ পৃষ্ঠার বইটি বিভিন্ন ব্যস্ততায় টানা পড়তে পারছিলাম না।তবু ঘটনাগুলো আমাকে বার বার আকৃষ্ট করেছে বইটি পড়ে শেষ করবার জন্য। অনেকেই বইটিকে সুনীলের মাস্টার পিস এর একটি দাবি করেন। তা সত্যিই বটে। এক রচনায় এত গুলো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন,দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র আরো কত গুনীজন। এই রচনায় বিধবা বিবাহের প্রয়োজনীয়তা খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে কিছু বিধবা চরিত্রের দূর্দশাপূর্ণ বর্ণনা উপস্থাপন করে। নবীনকুমার সিংহ এর চরিত্রের আড়ালে লেখক বোধকরি কালীপ্রসন্ন সিংহকে ইঙ্গিত করেছেন।যদিও লেখক ভূমিকাতে তা অস্বীকার করেছেন।তবে বিস্তারিত বর্ণনায় তা বিলক্ষণ প্রতীয়মান।
বইটি এক সমুদ্রসম মনে হলেও তাতে মুক্তোর অভাব নেই। ১৯ শতাব্দীর তৎকালীন বাংলার মানুষদের জীবনযাপন, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনাকাল, সিপাহি বিদ্রোহসহ অনেক ঘটনার প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। সর্বোপরি লেখক সুনিপুণ হাতে একের পর এক থ্রিলার উপহার দিয়েছেন পাঠকদের, সেই সঙ্গে রসবোধ পছন্দনীয় পাঠকের জন্য জীবনরসের সমাগমও রয়েছে বইটিতে। চোখের জলও বিসর্জন দিতে হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। যেমন ডেভিড হেয়ার, বিন্দুবাসীনী, নবীনকুমারের মৃত্যু। ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তিকে মুখ্য করে লেখা 'সেই সময়' বইয়ের সাথে আমার যাত্রা সুখময় ছিলো। ❤️
এই বই না উপন্যাস না বাস্তব না ইতিহাস। ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত সময়ের যত প্রমান পত্র পত্রিকা বই পুস্তকে পাওয়া যায় লেখক নিজস্ব কবিতার মধ্যে সেসব তথ্য মিশিয়ে ঐতিহাসিক চরিত্রের পাশাপাশি নিজের বানানো কিছু চরিত্র মিশিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি চ্যাপ্টার মায়াময়। ক্লাইমেক্সে ভরপুর। এত যত্ন নিয়ে লেখা উপন্যাস আমি কম পড়েছি। প্রতিটি চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। মুল চরিত্র নবীন কুমার, গঙ্গা চরণ এর পাশাপাশি রাইমোহন, চন্দ্রনাথ এরাও অনেক স্পেস পেয়েছে। ঐ সময়ের সমাজ অভাব বাবুদের বাবুগিরি বেশ্যালয় গমন সহ অনেক তথ্য উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। মাত্র ত্রিশ বছর ব্যাপ্তির লেখায় ৭০২ পৃষ্ঠার উপন্যাসে ঐ সময়ের কে আসেনি! মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দিনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো অনেকে। সব মিলিয়ে মানুষের প্রতি ভালবাসার দেশের প্রতি ভালবাসার অকাতরে সব বিলিয়ে দেয়ার এই গল্প শেষে আপনাকে কাঁদাবে। বিয়োগাত্মক উপন্যাস পড়ার আগে মন খারাপের প্রস্তুতি নিয়েই এই বই শুরু করুন। আমি প্রায় এক বছর ধরে এই বই শেষ করলাম।
ঐতিহাসিক জনরা বেশ প্রিয়। সুনীলের লেখনীতে যেনো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে উনিশ শতকের বাংলার দিনপঞ্জি। একে একে পর্দায় হাজির হয়েছেন তৎকালীন সময়ের রথী-মহারথীরা৷ প্রথম খন্ড শেষ করলাম এক প্রকার ঘোর নিয়ে। এখন দ্বিতীয় খন্ডে পড়ার অপেক্ষা।
❝নীচে মা গঙ্গা, মাথার উপরে আকাশে রয়েচেন দেবতারা, সবাইকে বলে গেলুম, যদি পরজন্ম থাকে, তবে পরজন্মে যেন তোকে আমি পাই। এ জন্মে আমার সব নষ্ট হয়ে গেল রে! সব নষ্ট হয়ে গেল! আমায় কেউ কিচু দিলে না।❞
বেঙ্গল নবযুগ বা বেঙ্গল রেনেসাঁস এর জীবিত রুপ যেখানে কখনও আড্ডা মারা যাচ্ছে ডিরোজিওর শিষ্যদের সাথে, খোশগল্পে মেতে উঠা যাচ্ছে আমাদের মধু দা'র ( মধুসূদন দত্ত) সাথে আবার কখনও নীলকরদের অত্যাচারে পালিয়ে বেড়ানো যাচ্ছে বনে জঙ্গলে,আবার বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের স্তম্ভ'দের সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে কোনো বিধবা বিবাহে। চমৎকার, চমৎকার, চমৎকার।
সেই সময় নিয়ে ধ্যান ধারণাই পাল্টে দিলো "সেই সময়" । জানি না সব ঘটনা ঘটেছিল কি না । কিন্তু মানতে ইচ্ছে করে । আর গল্প বলার যে দক্ষতা মহাশয় দেখিয়েছেন সে এক কথায় অনবদ্য । প্রতিটি পাঠককে পাড়ার জন্য অনুরোধ করবো ।
এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে প্রথম পর্ব শেষ হইলো। সুনীল তার অসাধারণ লেখনীর জাদুতে ঐতিহাসিক চরিত্র আর সময়ের প্রয়োজনে গড়ে উঠা চরিত্রদের এক ঐতিহাসিক মিলন ঘটিয়েছেন।