মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে অনালোচিত অংশে আলো ফেলেছেন লেখক এ গ্রন্থে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। কিন্তু কোথাও covert operation- এর শুরু এবং কোথায় যুদ্ধের শেষ সে হাদিস সযত্নে আড়াল হয়েছিল এতোদিন। একাত্তরের যুদ্ধের শুরু যে কেবল ২৬ মার্চ নয় এবং এ যুদ্ধ যে ১৬ ডিসেম্বর শেষও হয়নি তারই নির্মোহ উপস্থাপন ঘটেছে এখানে। বহুল আলোচিত ‘বিজয়’-এর পরও বাংলাদেশ বাহাত্তর থেকে কীভাবে এবং কেন আরেক দফা যুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির যোগসূত্র কী- তাঁর ফলই বা কী দাঁড়াল, সেটাই এখানে খতিয়ে দেখা হয়েছে। বাংলাদেশের রক্তাক্ত প্রথম পাঁচ বছরের পুরোদস্তুর এক পুনর্পাঠ এটা। বিপুল তথ্যরাজিতে যেখানে উঠে এসেছে সমাজতান্ত্রিক উচ্ছ্বাসের আড়ালে সমাজতন্ত্র বিলীন হওয়ার এক দক্ষিণ এশিয় আখ্যান। ‘আনসার বিদ্রোহ’ ও ‘কারা বিদ্রোহ’-এর পর আলতাফ পারভেজ আবারও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ‘কাউন্টার রিপোর্ট’ নিয়ে হাজির হয়েছেন বিশাল এক ক্যানভাসে। এবার তাঁর তালাশ ‘যুদ্ধের ভেতরের যুদ্ধ’ নিয়ে।
আলতাফ পারভেজের জন্ম ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬। দর্শনশাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন শেষ করেন। ছাত্রত্ব ও ছাত্র রাজনীতির পর সাংবাদিকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবন শুরু। পরে গবেষণা ও শিক্ষকতায় সংশ্লিষ্টতা। প্রকাশিত গ্রন্থ ছয়টি। যার মধ্যে আছে—‘কারাজীবন, কারাব্যবস্থা, কারা বিদ্রোহ : অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা’, ‘অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ, কর্নের তাহের ও জাসদ রাজনীতি’, ‘বাংলাদেশের নারীর ভূ-সম্পদের লড়াই’, 'মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ'।
যখন লেখক প্রচুর বই পড়ে, সাক্ষাৎকার নিয়ে এবং ঘটনাকে নিজস্ব বিচারবুদ্ধি সাপেক্ষে বিশ্লেষণ করেন, তখন বোঝাই যায় লেখক একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এগুচ্ছেন। পুরো বইটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না পড়লে 'উদ্দেশ্য' নির্ণয় বড় কঠিন।
"মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনীঃ ইতিহাসের পুনর্পাঠ " শিরোনামের ৬০০ পৃষ্ঠার তথ্যপূর্ণ বইটি লিখেছেন আলতাফ পারভেজ।লেখকের রাজনৈতিক একটি মতাদর্শ রয়েছে তার স্বীকারোক্তি দিয়ে নিজেই লিখেছেন তিনি জাসদ ছাত্রলীগ করতেন।
চার যুবনেতার বিএলএফ (মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝিতে যার নাম মুজিব বাহিনী) আর জাসদের সশস্ত্র সংগঠন গণবাহিনীর আদ্যোপান্ত নিয়ে গবেষণাধর্মী আলোচনা করেছেন আলতাফ পারভেজ। বইয়ের ফ্লপের একটি জায়গায় দাবী করা হয়েছে, "মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে অনালোচিত অংশে আলো ফেলেছেন লেখক এ গ্রন্থে।" দাবী সত্য। এই বইতে রেফারেন্সসহ কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন লেখক যা প্রচলিত ধারণার মূলে গিয়ে আঘাত করবে পাঠকের, আবার ভ্রু কুঁচকে যাবে তথ্যের বিশ্লেষণের ভঙ্গিতে।
মুজিব বাহিনীর গঠন থেকে বইয়ের শুরু সমাপ্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর আগে। মুজিব বাহিনী নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস তত্ত্বের রূপকার সিরাজুল আলম খান বাকী তিন যুবনেতা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ মণি, তোফায়েল আহমেদ আর আবদুর রাজ্জাক মিলে ভারতীয় জেনারেল উবানের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)। বিএলএফের সারা মুক্তিযুদ্ধে কতটা সক্রিয় ভূমিকা ছিল তা নিয়ে একটি প্রশ্ন রেখেছেন আলতাফ পারভেজ।এটি এই বইয়ের অনেকবড় একটি ইস্যু।
"রাষ্ট্রিয়ভাবে ১৫ খন্ডে মুক্তিযুদ্ধের যেসব দলিলপত্র প্রকাশিত হয়েছে-একটি খন্ড তার পুরোপুরি সাক্ষাৎকার বিষয়ে হলেও তাতে মুজিব বাহিনীর সংগঠকদের কারো বক্তব্য সংরক্ষিত হয়নি। "!!! এতো বড় একটি বাহিনীর নেতৃবৃন্দের কোনো বক্তব্য জাতীয়ভাবে লিপিবিদ্যা নেই তা একদিকে যেমন হতাশার। অন্যদিকে, অনুসন্ধানী মনে প্রশ্ন জাগায় কেন তাঁরা কোনো বক্তব্য দেননি।
আবার, অনেকে অভিযোগ করেছেন বিএলএফ যেটি পরে মুজিব বাহিনী নামধারণ করে তার অনেক সদস্য নাকী যুদ্ধ করেন ই নি। এই তথ্যের সত্যাসত্য নির্ণয়ে মুজিব বাহিনীর প্রথম ব্যাচের রিক্রুটিং ও রক্ষীবাহিনীর লিডার সরোয়ার মোল্লা ভাষ্য, "আমাদের প্রধান কাজ ছিল লিডারশিপ দেয়া, গাইড করা....পলিটিকাল কর্মকান্ড। তবে শুধু পলিটিক্স দিয়ে তো আর মানুষ ধরে রাখা যায় না, যদি না তাদের শেল্টার দিতে পারি। এই কারণে তখন কিছু কিছু আ্যকশানে যেতে হয়েছে। " মুজিব বাহিনীর সাথে সেক্টর কমান্ডার ও প্রবাসী সরকারের 'নেতৃত্বকেন্দ্রিক ' দ্বন্দ্ব তো সর্বজনবিদিত (যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনার চেষ্টা করেন) । মুজিব বাহিনীর কর্মকান্ডের খুঁটিনাটি নিয়ে বিস্তর নাড়াচাড়া করেছেন লেখক। ভারতের র(RAW) ও স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ভারতীয় বিদ্রোহীদমনে কাজ করেছে মুজিব বাহিনী। আবার, পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীর ওপর হামলার অভিযোগের কথাও লিখেছেন আলতাফ পারভেজ। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে আর মুজিব বাহিনী বামদমন করছে, খুচরা রাজাকার মারছে। কোথাও কোথাও মুক্তিবাহিনীর সাথেও সংঘাত দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয় "সীমান্তের কেবল ২০ মাইলের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকবে। " মোটকথা, আলতাফ পারভেজ মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীকে কতকটা ভারতের সেকেন্ড অপশন হিসেবে তুলে ধরেছেন, যে বাহিনীর দুটি ট্রেনিংক্যাম্পে যুদ্ধের চে' রাজনৈতিক শত্রু তথা কমিউনিস্ট মোকাবিলার সামর্থ্য ভরপুর এক শক্তি গড়ে তোলাই ছিল লক্ষ্য। আর আলতাফ পারভেজ নানা লেখনীর বরাতে বারবার বোঝাতে চেয়েছেন মুজিব বাহিনীর যুদ্ধকালীন ভূমিকা যৎসামান্য! মুজিব বাহিনী যুদ্ধকালীন বিরূপ কার্যক্রমের যে খতিয়ান আলতাফ পারভেজ বয়ান করেছেন তার সত্যতানির্ণয় করা সময়ের দাবী। সবসময় মুজিব বাহিনীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তাতে তাঁদের সাফল্যগাঁথাই উঠে আসে। কিন্তু আলতাফ পারভেজের লেখায় তার ছিটেফোঁটাও নেই। এক্ষেত্রে মানে দাঁড়াচ্ছে আলতাফ পারভেজও মুজিব বাহিনীর প্রতি সুবিচার করেন নি। তিনি দাঁড় করিয়েছেন এমন এক চিত্র যেখানে মুজিব বাহিনীর শুূধু কালো অধ্যায়কেই পাঠককে গেলাতে চেয়েছেন আর আলোক অধ্যায় তাঁর চোখে পড়েই নি!
"অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং জমা দেইনি। " জ্বী, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাঁরা যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে অস্ত্র জমা দেন জাতির পিতার পায়ের কাছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশে ফিরলে তাজউদ্দীন কিংবা সিরাজুল আলম খান তাঁর সান্নিধ্য পাবার আগেই শেখ মণি ও তোফায়েল আহমেদের সাথে শেখ মুজিবের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এই নৈকট্যের খেসারত সারা জাতিকে দিতে হয়েছে সময়ের বিচারে। শেখ মণি আর সিরাজুল আলম খানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ছিল যতটা না আদর্শের তারচে বেশিবেশি প্রভাবের। মুজিববাহিনীতে সিরাজপন্থী বেশি ছিল। সিরাজপন্থীরা চাইলেন সর্বদলীয় সরকার আর মুজিব যাতে সরাসরি রাজনীতিতে না থাকেন। কিন্তু মণিপন্থীরা চাইলেন মুজিবকে সামনে রেখে সমাজতন্ত্র। ভারতীয় লুটপাটের বিরোধিতাকারী মেজর জলিল, আলী হায়দার জিয়াউদ্দিন ও বিপ্লবে বিশ্বাসী কর্ণেল তাহেররা একত্রিত হলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ছায়াতলে। যেখানে আগে থেকেই ছিলেন আসম আব্দুর রব, কাজী আরেফ, শাজাহান সিরাজরা, যাঁদের মূল ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
১৯৭২ সালের অক্টোবরের শেষে জাসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার, একই সালে জেআরবি (জাতীয় রক্ষীবাহিনী) গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। এই মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা বেশিরভাগ ছিলেন মুজিববাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য। তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত এবং একমাত্র শেখ মুজিবের কাছেই তারা দায়বদ্ধ ছিল। এই বাহিনীকে ভারত ট্রেনিং দিত, যেমন দিত মুজিব বাহিনীকে। লেখক একে নকশাল দমনকারী ভারতীয় বাহিনীর সাথে তুলনা করেছেন।
সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও কেন বঙ্গবন্ধু আরেকটি বাহিনী গড়লেন তার ব্যাখা নিয়ে অনেক ভালো মন্দ ব্যাখা আছে সেদিকে যাচ্ছি না। লেখক রক্ষীবাহিনীর দেশব্যাপী নির্যতনকে পাঠককের সামনে তুলে ধরতে খুব পরিশ্রম করেছেন। কতটা নিষ্ঠুর ও অমানবিক ছিল রক্ষীরা তার বর্ণনায় ঘাটতি নেই।কিন্তু জাসদের গণবাহিনীর রক্ষীবাহিনীকে, আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, লালবাহিনীর মোকাবিলাকে কেন যেন সেভাবে তুলে ধরেন নি। জাসদের কর্মীদের ওপর হামলার তীব্রতা বুঝতে এই বইটি পাঠের বিকল্প নেই। আবার একই লেখক আওয়ামীলীগের কর্মী হত্যাকে হালকাচাঁলে লিখতে গিয়ে বইটির বিশ্বাসযোগ্যতাকে কমিয়ে দিতে কসুর করেন নি।
শেখ মণি তাঁর বাংলার বাণী পত্রিকায় লিখেছিলেন, "আইনের নয়, মুজিবের শাসন চাই " শেখ মণির এই চাওয়াকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আওয়ামীলীগের ই আরেক বিচ্ছেদ্য অংশ যারা জাসদ প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের রক্ত ঝরিয়েছে রক্ষীবাহিনী, যুবলীগ আর ছাত্রলীগ।আর মণির তত্ত্বকে সামলাবার নামে জাসদ স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে বিপদে ফেলেছে, 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার অভিলাষে জাসদ অস্ত্রধারী বাহিনী গঠন করে তরুণদের বিভ্রান্ত করেছে অথচ সারা বইতে অনেকের ভাষ্যে গিয়েছে জাসদের মূলনায়ক সিরাজুল আলম খান স্রৈফ ঝোঁক আর রাগের বশে গড়েছিলেন জাসদ।
আলতাফ পারভেজ মুজিব বাহিনীর অধ্যায়কে লিখেছেন একপেশেভাবে, ��ণবাহিনীকে বাঁচাতে গিয়ে ভিলেন করেছেন বিপক্ষের অনেককে। তবুও এই বই ইতিহাসকে ভিন্নভাবে জানায়, বোঝায়, শেখায় ইতিহাসের আস্তাঁকুড় ঘেঁটে আপনাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে প্রচলিত নায়ক, মহানায়কদের।
বইয়ের শেষে লেখক পরিশিষ্ট সংযোজন করেছেন যা বইটিকে সুসমৃদ্ধ করেছে, বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটিকে বাড়ানোর চেষ্টা প্রশংসনীয়।
আলতাফ পারভেজ মুজিব বাহিনীর অধ্যায়কে লিখেছেন একপেশেভাবে, গণবাহিনীকে বাঁচাতে গিয়ে ভিলেন করেছেন বিপক্ষের অনেককে। তবুও এই বই ইতিহাসকে ভিন্নভাবে জানায়, বোঝায়, শেখায় ইতিহাসের আস্তাঁকুড় ঘেঁটে আপনাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে প্রচলিত নায়ক, মহানায়কদের।
হোক খানিকটা একপেশে তবুও এই ধরনের লেখনী আরো চাই। আলোচনা করুক লোকে, তীব্র একপেশে সমালোচনা হোক একাডেমিক ভিত্তিতে। তাতেই একদিন আসল তথ্যের খোঁজ পাবে পাঠককরা।
সময় নিয়ে পড়ার মতো একটা বই। বেশ সময় নিয়েই পড়লাম।বইটা পড়তে যেয়ে আরো ৪/৫ টা বই ঘাটতে হয়েছে। "মুজিব বাহিনী" নামক রহস্যময় একটা বাহিনী সেই ৭১ থেকে কীভাবে বারবার আমাদের ইতিহাসের পালাবদল ঘটিয়েছে তার খুব সুন্দর অনুসন্ধান বলা যায়।
ইতিহাসের নামে অখাদ্য গেলানোর কাঙালি খোজ থেকে বের হওয়া জরুরি। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এসব বইয়ের পাঠও জরুরি।
বইটার আলোচ্য বিষয় মুজিব বাহিনী। মুজিব বাহিনীর জন্ম একাত্তরে। জন্মের সময় এই বাহিনী বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স(বিএলএফ) নামে পরিচিত ছিল। একাত্তরের ২৫শে মার্চের কালোরাতের পর আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা যখন ভারতে পলায়ন করেন মুজিব নিজ বাসভবনে আত্মসমর্পণের জন্য অপেক্ষা করেন। ২৭ মার্চ পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান শেখ মুজিবের অপেক্ষায় থেকেও যখন দেখা পান না তখন বুঝতে পারেন মুজিব আর আসবেন না।
পরবর্তীতে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। এরাই ছিলেন যুদ্ধরত দেশের রিপ্রেজেন্টেটিভ। এই সরকারের থেকে আলাদা অবস্থান গ্রহণ করে সেই সময়ের তরূণ ছাত্রনেতারা। মুজিবনগর সরকারের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ভারত কেন এই ছাত্রনেতাদের নিয়ে আলাদা একটি বাহিনী গঠন করল বারবার এই প্রশ্ন করেও ভারত সরকার থেকে কোনো উত্তর পায় না মুজিবনগর সরকার।
তখন মনে করা হতো মুক্তিযুদ্ধ হবে লম্বা সময়। ভারত এই সময় ভয়ে ছিল এই পরিস্থিতিতে নতুন রাষ্ট্রে কমিউনিস্টদের উত্থান সম্পর্কে। তারা ভেবেছিলেন এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে মুজিব বাহিনীর প্রয়োজন রয়েছে। তাই এই বাহিনীকে সামরিক ট্রেনিং এর চেয়ে রাজনৈতিক ট্রেনিং দেয়ার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ট্রেনিংকালে তাদের নির্দেশ দেয়া হতো যদি কোনো রাজাকারকে ধরতে পারে তাহলে যেন তথ্য অর্জনের চেষ্টা করে মারপিট করে। এরপর তাদের কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু কখনো যদি কমিউনিস্ট কাওকে সামনে পায় তাহলে যেন সরাসরি গুলি করে মারে। পরবর্তীতে মুজিব দেশে ফিরতে পারবেন কিনা এই শংকাও ছিল তাদের মনে। মুজিব বাহিনী নামকরণের পিছে এটাই মূল কারণ। এই বাহিনী মুজিবের মূল উত্তরাধিকার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল নিজেদের। এছাড়াও ভারতের নাগাল্যান্ড এবং মিজোরাম এ তখন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা ঘটে। নাগা এবং মিজোরা ভারত থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করছিল। ভারতের সন্দেহ পাকিস্তানের আইএসআই এদেরকে অস্ত্র এবং আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করছে। এই নাগা এবং মিজোদের আশ্রয়স্থল ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। মুজিব বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের নামে এই নাগা মিজোদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আক্রমণ করে ভারত।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুজিব বাহিনী রক্ষীবাহিনী, গণবাহিনী, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নানাদিকে বিভক্ত হয়ে পরে। এই সময় সমাজতন্ত্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ব্যাপকভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ব্যাপক ব্যবধানে জয়লাভ করে। মুজিব বাহিনীর একাংশ এই সময় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে। এরা ছিল সিরাজুল আলম খানের অনুসারী। অন্য একদল নামে মুজিববাদের প্রচারে। এরা ছিলেন শেখ মণির অনুসারী। শেখ মুজিব যখন শেখ মণির দলের সমর্থন করলেন সিরাজুল আলম খান দল থেকে বের হয়ে গঠন করলেন জাসদ। মুজিববাহিনীর নব্বই শতাংস ছিল সিরাজপন্থি। পরবর্তীতে এরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রদের মনে জায়গা করে নিল।
মুক্তুযুদ্ধকালে ভারতের সঙ্গে মুজিবনগর সরকারের এক চুক্তি হয় যেখানে উল্লেখ ছিল বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো বাহিনী থাকবে না। এর প্রেক্ষিতে প্রধাণমন্ত্রী শেখ মুজিবের অধীনে গড়ে তোলা হয় জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী রক্ষীবাহিনী। এই বাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারত থেকে সামরিক প্রশিক্ষক আনা হয়। পরবর্তীতে রক্ষীবাহিনীর হাত থেকে প্রতিরক্ষার জন্য জাসদে তৈরি হয় গণবাহিনী।
পরবর্তীতে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর রক্ষিবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে আত্তিকরণ হয়। এরফলে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয় গণবাহিনী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে গেলেই আপনি ৬৯,৭০,৭১ এর নানান সর্বজন আলোচিত পরিচিত ঘটনাবলী নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে দেখলেও দেখবেন ইতিহাসের একটা অংশের ক্ষেত্রে কোনো এক অদ্ভুত ভাবে লেখকগণ নীরব ভূমিকা পালন করেছেন, কিংবা এই অংশের আলোচনাকে তুলে এনেছেন অনেকটা দায়সারা ভাবে। ইতিহাসের সেই অংশের নাম 'মুজিব বাহিনী'। যাদের নিয়ে নানান কথা, সমালোচনা প্রচলিত আছে। সেই বাহিনীর শুরু থেকে পরিণতি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করেছেন লেখক আলতাফ পারভেজ তার 'মুজিব বাহিনী থেকে গণ বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ' বইয়ে।
পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্য ১৯৬২ সালের দিকে ছাত্রলীগ সিরাজুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ভিতর গোপন এক সংগঠন গড়ে উঠে যার নাম ছিলো 'নিউক্লিয়াস'। যেখানে প্রাথমিক দিকে সিরাজুল ইসলাম খানের পাশাপাশি সদস্য ছিলেন আবদুর রাজ্জাকও, যার সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের যোগাযোগ থাকতো সংগঠণের পক্ষ থেকে। পরবর্তীতে ৭০ সালের দিকে শেখ মুজিবেরই নির্দেশনায় সেই সংগঠনে যুক্ত হয় শেখ ফজলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমেদ। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্যই ছিলো বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ার জন্য কাজ করা। এই প্রসঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র যে এক বাস্তব নিদর্শন ছিলো তা লেখক কিছুটা আভাস দিয়েছেন বইটিতে।
শেখ মুজিবুর রহমান সেই সময় এই চার যুবনেতাকে পাকিস্তান সামরিক শক্তির সম্ভাব্য আঘাত মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে ছাত্র যুবকদের জ*ঙ্গিবাহিনী গড়ে তোলার নির্দেশনা দেন, একদিন এই চার নেতাকে ভারতের একটা ঠিকানাও বলে দেন যু*দ্ধাবস্থায় কোথায় গিয়ে যোগাযোগ করতে হবে তা জানিয়ে, অনেকের ভাষ্যমতে যা তাজউদ্দীনও জানতেন। যারই প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে বিএলএফ বা মুজিববাহিনী গড়ে উঠে।
মুক্তিযু*দ্ধের সময়ে তাজউদ্দীন আহমেদেকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশের যে প্��বাসী সরকার গড়ে উঠেছিলো তারই নেতৃত্ব দেশের ১১ সেক্টরে ভাগ করে যু*দ্ধ হলেও এই নেতৃত্ব কখনোই মেনে নেয়নি চার যুবনেতারা। দীর্ঘস্থায়ী যু*দ্ধের জন্য এবং মুজিব মতাদর্শের অধীনে তাই তারা গড়ে তুলে মুজিব বাহিনী, আর এই মুজিববাহিনীর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র এর অধীনে, তাদেরকে প্রশিক্ষণ দান, অ*স্ত্র সহযোগিতা এবং দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মিশনে পাঠানোর ক্ষেত্রেও সকল সিদ্ধান্ত ভারতের র এবং শেখ মনি নিতেন বলে বইটিতে উল্লেখ আছে। এক্ষেত্রে এই মুজিববাহিনীর সাথে প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রের জন্য আ মেরিকার গোয়েন্দা সং���্থা 'সি*আইএ' ও ইস রায়েলি মো*সদেরও কানেকশন ছিলো বলে বর্ণনা আছে।
মুক্তিযু*দ্ধের সময়ে মুজিববাহিনী যতটা না যু*দ্ধ করেছেন তার চেয়েও বেশি মুজিব আদর্শ প্রতিষ্ঠাতে কাজ করে গিয়েছেন বেশি, এক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় তাদের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে সাধারণ মুক্তিযু*দ্ধাদের সাথেও। অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযু*দ্ধের সময়েই অনেক বামপন্থী মুক্তিযো*দ্ধাকে হ*ত্যার জন্য দেশের অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়েছে তারা। এদিকে মুজিব বাহিনীর আড়ালে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী নানা অভিযান পরিচালনা করে, পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স দিয়ে যা নিয়ে ইতিহাসে কোনো আলোচনাই করা হয় না। এক্ষেত্রে পাহাড়ে যে হ*ত্যাযক্ষ চালানো হয় তার কিছুটা বিবরণ পাবেন বইটিতে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের এই অভিযানগুলোর মদদ যুগিয়েছে সিআ*ইএ। এই এসপিপি'র সাথে তিব্বতি অনেক যু*দ্ধাও ছিলো এবং কী যু*দ্ধে প্রাণও দিয়েছে যাদের নিয়ে ভারত কোনো আওয়াজই কখনো করেনি।
যু*দ্ধ পরবর্তী সময়ে যখন শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন এই মুজিববাহিনীকে নিয়েই গড়ে উঠে রক্ষীবাহিনী, যার আবার একাংশ শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থন না পেয়ে বিভক্ত হয়ে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' প্রতিষ্ঠায় গড়ে তুলে মেজর জলিলের নেতৃত্বে 'জাসদ' নামক আলাদা সংগঠন। এই মেজর জলিলকেই যু*দ্ধ পরবর্তী সময়ে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক যখন ঢাকায় লুটপাট চালানো হয় তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতার করে অবরুদ্ধ করা হয়।
এক্ষেত্রে যু*দ্ধ পরবর্তী সময়ে রক্ষীবাহিনী কতৃক দেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের বিরোধী তথা বিপরীত দল, মতগুলোর উপর হ*ত্যা, গু*ম, নির্যাতন নেমে আসে তা ছিলো বর্ণনাতীত বিভৎস। আর এই হ*ত্যাযজ্ঞের বৈধতা দিতে বার বার সংশোধন করা হয় রক্ষীবাহিনীর আইন। এছাড়াও বইটির বর্ণনার এক অংশে যু*দ্ধ পরবর্তী সময়ে বাঙালি কর্তৃক বিহারি হ*ত্যার এক বিভৎস রূপও আলোচনায় উঠে এসেছে। এদিকে রক্ষীবাহিনীর হ*ত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে জাসদ গড়ে তুলে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনী যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো জাসদকে রক্ষা করা ও আওয়ামিলীগের বিরুদ্ধে সশ*স্ত্র ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যার প্রেক্ষিতে তারাও আরেক হ*ত্যাকান্ডে মেতে উঠে।
এদিকে সারা দেশ জুড়ে জাসদের উপর নেমে আসা এসব হ*ত্যাকান্ডের জন্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে আলাদা আইন করে সরকার দেশের সকল সংবাদপত্রগুলো বন্ধ করে দেয় নির্দিষ্ট কিছু সংবাদপত্র ছাড়া। যেগুলোতে কেবল সরকার পক্ষীয় তোষামোদী আলাপই উঠে আসতো। যার ফলে জনগণ দেশের সঠিক অবস্থা জানা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এদিকে সংবাদপত্র বন্ধ হওয়ার পর সাংবাদিকগণ দলে দলে বাকশালে যোগ দিতে শুরু করে নিজেদের সরকারি শুভদৃষ্টিতে রাখার জন্য।
আর এভাবেই আস্তে আস্তে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে, সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে অভ্যত্থানের হাওয়া লাগে, শেখ মুজিব জনগণ থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে যা চূড়ান্ত অবস্থায় রূপ নেয় নিজেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে রেখে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যারই পরিণতি হিসেবে ধরা হয় ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্টকে। যে দিনটি কেবল সময়ের ব্যাপার ছিলো, তা ছাড়া এমন একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে তা নিয়ে বারবার শেখ মুজিব ও মণিকে সতর্ক করার পরও তারা পাত্তা দেয়নি। আর এই অভ্যত্থানের পরে রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর সাথে আত্মীয়করণ করা হলে গণবাহিনীর কার্যক্রমও আস্তে আস্তে স্থিমত হয়ে আসে।
লেখকের এই বইটা বিশাল, তার উপর ১৯৬২ থেকে একেবারে ১৯৭৫ পর্যন্ত এতো পরিমাণ তথ্য তিনি এর ভিতরে চেপে চেপে ঢুকিয়েছেন যে এই ছোট্ট আলাপে পুরো বইটা কভার করে রিভিউ দেওয়া রীতিমতো দুঃসাহসিক একটা কাজ হবে। তার উপর লেখক এমন একটা বিষয়ে তার আলোচনাকে ফোকাস করেছেন যে তা এদিকে আবার অতিরিক্ত থ্রিলিংও বলতে হয়। তাছাড়া এই মুজিব বাহিনী নিয়ে আলাপ আলোচনা কোথাও দেখা যায়ও না।
বইটি পড়তে গিয়ে অবশ্য মোড়ে মোড়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এই বইয়ের আলাপ কেন এত কম হয় কিংবা মুজিববাহিনী নিয়ে লেখা হয় না কেন। কারণ এই অধ্যায়কে আপনি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় বলতে পারেন। যার মধ্যে অন্তত তিনটি চরিত্র ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি আর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র'। এক্ষেত্রে 'র' যে তার নিজের স্বার্থে এই বাহিনী গঠন ও পরিচালনা করেছে তা বইটি পড়ে বুঝতে পারবেন।
আরেকটা বিষয় ভাবতেও আশ্চর্য লেগেছে সেটা হচ্ছে আওয়ামী মতাদর্শ ছাড়া সকল মতাদর্শের বিরুদ্ধে রক্ষীবাহিনী দিয়ে নিপিড়ন ও গু*মের রাজত্ব কায়েম করা, যা বর্তমান সময়ের জন্যেও বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হবে বইটি পড়ে। সেই সাথে ভুক্তভোগী জাসদ নেতার একজনের স্ত্রীর উপর চালানো নির্যাতনের অভিজ্ঞতা পড়ার পর আপনাকে তা হতবিহ্বল করে দিবে। এ যেন পাকবাহিনীদেরই আরেকটি রূপ।
বইটি পড়ার ক্ষেত্রে পাঠকদের একটা বিষয় আমি জানিয়ে দিতে চাই, এই বইটি আপনি যদি কট্টর নন-ফিকশন পড়ুয়া কিংবা একাডেমিক কঠিন বইটা ধৈর্য ধরে পড়ার মতো সামর্থ্য না থাকে তাহলে এই বইটি শেষ করাটা আপনার জন্য বেশ কষ্টের হয়ে যাবে। আর আমারও স্বীকার করতে হয় প্রচন্ড কষ্ট হয়েছে। এক্ষেত্রে অন্তত দুটো বিষয় প্রচন্ড প্যারা দিয়েছে একটা হলো বইটির বর্ণনা কেমন যেন বিদঘুটে হওয়া আর প্রচন্ড রকম অগোছালো উপস্থাপনা। লেখক এক বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে তার ভিতরে কত ডাল পালা মেলে এক জায়গা থেকে সম্পূর্ণ অন্য জায়গায় বিচরণ করেছেন। অর্থাৎ প্রচুর তথ্য উপাত্তে বইটি সমৃদ্ধ হলেও লেখক তা যথাযথ ব্যবহার করে পাঠক উপযোগী টাইমলাইন তৈরি করে তা উপস্থাপন করতে পারেনি।
বইটিতে আপনি মুজিববাহিনীর তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট থেকে মুক্তিযু*দ্ধে তাদের ভূমিকা, মুক্তিযু*দ্ধ পরবর্তীতে এই বাহিনী দ্বারা গঠিত রক্ষীবাহিনী তার বিভক্তিত একটা অংশ জাসদ ও গণবাহিনীর আলোচনা পাবেন। সাথে রক্ষীবাহিনী পরিচালিত হওয়ার জন্য যে আইনটা করা হয়েছিলো তা সংশোধন গুলো সহ পাবেন। সাথে অবশ্য তৎকালীন সময়ে জাসদের বেশ কিছু বিবৃতি, আহমদ ছফার একটা কলামও স্থান পেয়েছে। এই আলোচনা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে মুজিববাহিনী ও জাসদকে নিয়ে যতটুকু বিস্তারিত আলোচনা এসেছে তাতে গণবাহিনী নিয়ে খুব একটা অতো আলোচনা আসেনি। তাছাড়া বইটির বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখককে আমার জাসদ পন্থী মানুষের মতো মনে হয়েছে, যার ফলে লেখার মাঝেই জাসদ ঘেষা মনোভাব ফুটে উঠেছে কিছুটা।
বইটির একটা জায়গায় ফি লিস্তিনদের জন্য বাঙালি কিছু সৈনিক ঐ দেশে গিয়ে যু*দ্ধ করার কথাও উঠে এসেছে, কর্ণেল তাহের তো ফি লিস্তিনের পক্ষে যু*দ্ধ করার অনুমতি চেয়ে সরকারের নিকট আবেদনও দিয়েছিলো যা বইটিতে সংযুক্ত আছে। এছাড়াও ফি লিস্তিনি থেকে বাংলাদেশে কিছু যো*দ্ধা প্রশিক্ষণও নিয়েছিলো যদিও তারা পরবর্তীতে ইস রায়েলের হাতে নিহত হয়।
বইটিতে যা আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে চাইলে আরো বিস্তৃত আলাপ করা যাবে, এতে বই নিয়ে আমার মতামতটা বেশ জটিল হয়ে যাবে। তার চেয়ে কারো আগ্রহ থাকলে বইটি পড়তে পারেন। তবে পড়ার আগে অতি অবশ্যই এটা মাথায় রাখবেন এই বইয়ের বর্ণনা বেশ কঠিন এবং বইটিতে প্রচুর তথ্য উপাত্ত ও রেফারেন্স ব্যবহার করলেও তা বেশ অগোছালো। আর বাংলাদেশের ঐসময়ের ইতিহাসের নানান অংশ থাকলেও লেখক কেবল মুজিববাহিনী, রক্ষীবাহিনী, জাসদ ও গণবাহিনীকেই সামনে রেখে বইটি লিখেছেন বলে সমসাময়িক অনেক বিষয়ই এই বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক না হওয়ায় বইটিতে স্থান পায়নি।
বই: মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ লেখক: আলতাফ পারভেজ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ প্রকাশক: ঐতিহ্য মূল্য: ১০৯০৳ পৃষ্ঠা: ৬০০
Good analytical book on the history of Mujib Force. Mujib Force was created to eliminate the Marxists. Mujib Force was the parent organization of both Rokhi Bahini (Pro-Moni) and Gono Bahini (Pro-Siraj). Mujib Force was trained by RAW and Sujan Singh Uban.
বাস্তবিক অর্থেই এটা ইতিহাসের পুনর্পাঠ।বইটি পড়ার আগে অবশ্যই ইতিহাসের কিঞ্চিৎ ধারণা হলেও থাকতে হবে।আলতাফ পারভেজ বরাবরই আমার অন্যতম পছন্দের লেখক,তার লেখনীতে রেফারেন্স এর বিষয়টা আমাকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করে। আমার ধারণা রেফারেন্স এ তিনি বইয়ের ৬০% ইতিহাস তুলে ধরেন। এই বইয়ের সাথে আমার আবার দেখা হবে,অবশ্যই আমি এটাকে আমার রেফারেন্স বুক হিসাবে ব্যাবহার করবো।