'যখন পুলিশ ছিলাম' আমার জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞালব্দ কাহিনী। এর আগে ইচ্ছা বা অবসর থাকলেও পুলিস সম্বন্ধে ভেতরে বা বাইরের এত কথা এত সহজে আমি লিখতে পারতাম না। কোন পরাধীন দেশের লেখকের পক্ষে তা সম্ভবও না।
স্বদেশী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বন্দে মাতরম জপে ব্রিটিশ ঠ্যাঙানো,বিলেতি পণ্য বর্জন, গায়ে খাদির কাপড় চড়ানোর পাশাপাশি গোপন আস্তানায় মিটিং করে বেড়াতেন বিপ্লবীরা। এই বিরুদ্ধাচরণ করা ঘাড়ত্যাঁড়া বিপ্লবীদের উপর লুকিয়ে নজর রাখা,অনুসরণ আর গ্রেপ্তার করে এই গোপন রাজনীতিকে ভণ্ডুল করে দেয়াটা ছিল পুলিশের কাজ। ব্রড ব্রাশস্ট্রোকে দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের চোখে, স্পাইনলেস জব। আক্ষরিক অর্থেই! এই পুলিশ অফিসারদের খুব বেশি লেখাপড়া না জানলেও চলতো। ক অক্ষর গোমাংস হয়ে শুধু অতি কষ্টে রিপোর্টগুলোতে নাম সই করে দিতে পারলেই ল্যাঠা চুকে যেতো। মানসম্মান শিকেয় তুলে রেখে চোখমুখ বুঁজে ডিউটি করার পাশাপাশি কুতকুতে মুখে ধবধবে সাদা দাঁত বের করে বেকুবের মতো কথার ফাঁকে ফাঁকে ‘ইয়েস স্যার,ইউ ফাদার মাদার,অলরাইট স্যার’ গুঁজে দিতে পারলেই প্রমোশন হতো বুলেট ট্রেনের গতিতে। দেশপ্রেমিক ধীরাজ ভট্টাচার্য্য নিতান্ত ছেলেমানুষ হলেও কর্তব্য আর দেশপ্রেমের মাঝের নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে দ্বিধান্বিত হয়েছেন বারংবার।
কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ধীরাজের দুরন্ত জীবন কেটে যাচ্ছিলো পড়াশোনা আর বাউণ্ডুলেপনায়। বড় ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে ধীরাজদের পরিবারে। এদিকে মাথায় অভিনয়ের নেশা চেপে বসেছে তার। কিন্তু রক্ষণশীল বাঙালি পরিবার মানবে কেন? জোর করে ধীরাজের নাম লেখানো হলো পুলিশি চাকরির খাতায় । ডিউটি হলো ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ। স্বদেশী নেতা আর বিপ্লবীদের অনুসরণ করাই তার কাজ। রহস্য লহরী পড়তে পড়তে ধীরাজ বেশ স্বাপ্নিক হয়ে উঠলেও বাস্তবে ছিলেন নিতান্ত ছেলেমানুষ। কখনো চলতি ট্রামে উঠতে গিয়ে পড়ে যান তিনি। কখনো বা ধরেন ভুল কোনো মানুষকে। সামান্য টেলিফোন লাইনের দায়িত্ব পালন করতে গেলেও বেচারা ধীরাজ করে ফেলেন বড়সড় কোনো ভুল। আত্মজীবনীমূলক এই বইয়ে কর্মরত অবস্থায় নিজের নানা ব্যর্থতা, বোকামি ও ভীরুতার উদাহরণ দিয়ে অকপটে স্পষ্টভাষায় নিজেকে কাওয়ার্ড হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। বইয়ের কোথাও নিজেকে বীরপুঙ্গব হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেননি। তবে ধীরাজ ছিলেন বেশ মিশুক, অমায়িক ও হৃদয়বান। ভালো গান গাইতে পারতেন, আশেপাশের মানুষকে মাতিয়ে রাখতে পারতেন বন্ধুত্বের সুসম্পর্ক দ্বারা।
মোটাদাগে, ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ এর কলকাতা পর্বে এসেছে স্বদেশীদের পিছু ধাওয়া করা দিনগুলোর কথা। আর সেকেন্ড হাফটাকে বলা যায় চট্টগ্রাম-টেকনাফ পর্ব। সারদার ট্রেনিং শেষে ছেলেমানুষ ধীরাজ যখন একটু বয়ঃপ্রাপ্ত, তাকে বদলী করে দেয়া হলো চট্টগ্রামের কোতোয়ালীতে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে,অভিনয় করে দিব্যি কেটে যাচ্ছিলো দিন। কিন্তু এই নিরুদ্বেগ জীবন সইলো না ধীরাজের কপালে। জিআরপির সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্ত্রী মিসেস মুলান্ড হঠাৎ তার প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে পড়লে শাস্তিস্বরূপ ধীরাজকে বদলি করে দেয়া হলো টেকনাফে। টেকনাফ তখন মগের মুল্লুক। বছরের সাত মাস সেই দ্বীপের সঙ্গে বাইরের জগতের কোনো সংশ্রব থাকে না। শুধু শীতকালে যখন সমুদ্র শান্ত থাকে তখন চট্টগ্রাম থেকে সপ্তাহে একদিন স্টিমার যায়-আসে। ভয়ংকর সব অপরাধীদের নির্বাসন দেয়া হতো টেকনাফে। অনেকটা যেন ক্ষুদ্র পরিসরে আন্দামান সেলুলার জেলের জাত ভাই।
‘যখন পুলিশ ছিলাম’ আত্মজীবনী হিসেবে আমার কাছে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে,তার থেকে জরুরি মনে হয়েছে এর ‘অ্যানথ্রোপলজিক্যাল’ পার্সপেক্টিভটা। মোটামুটি ১০০ বছর আগে ইংরেজ শাসনামলের শেষ সময় , স্বদেশীদের স্বরূপ তো বটেই, টেকনাফে মগদের জীবনাচরণের প্রত্যক্ষ বিবরণের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবেও একে দেখা যেতে পারে। ‘মগের মুল্লুক’ কথাটা যে শুধু শুধু আসে নি সেটা ধীরাজ ভালোভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন। একটু বিবরণ দেয়া যাক— ❝টেকনাফ দ্বীপে মদ আর তাড়ি বলতে গেলে বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। পাকা কলা পঁচিয়ে এরা ঘরেই মদ তৈরি করে, আর তাড়ি পয়সায় দু'তিন ভাঁড় পাওয়া যায়। ঐ মগ ছেলেগুলো সকাল থেকে মদ আর তাড়ি খেয়ে এই ক্যাংঘরে এসে বিশ্রাম করে। এদের আলোচনার মুখ্য বিষয় হলো পরনিন্দা আর স্ত্রীলোক ঘটিত ব্যাপার। মগদের মধ্যে ছেলেরা কোনো কাজই করে না, শুধু খেয়েদেয়ে, নেশা করে কাটিয়ে দেয়। যাবতীয় কাজ করতে হয় মেয়েদের। নদী থেকে মাছ ধরে সেই মাছ মাটিতে পুঁতে আর রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা, হাটে বাজারে কেনা-বেচা করা, রান্না করা, অবসর সময়ে রেশমি লুঙ্গি বোনা, তামাক থেকে বর্মা চুরোট তৈরি করা এসব কাজ তো আছেই, তাছাড়া আবার সময় মতো পতিদেবতাকে ক্যাংঘর থেকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দাইয়ে শুইয়ে দেওয়াও আছে।❞
অর্থনীতির কথা চিন্তা করলেও চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। একদম যেন শায়েস্তা খাঁর আমল। এক টাকায় আঠারোটা মুরগী, এক আনায় একটা পাঁঠা!
এ বাদে অ্যাডভেঞ্চারের রোমহর্ষও মিশে গেছে বইয়ের শেষ দিকে। সমুদ্রের পানি থেকে তৈরি লবণের চোরাকারবারিদের ধরতে এক আবগারি কর্মকর্তার সহযোগী হিসেবে ধীরাজের টেকনাফ থেকে বহুদূরের মরিআলাতে চারদিনের হাঁটা পথের অভিযান। গহীন বনজঙ্গল, পর্বত, পাহাড়ী নদী পেরিয়ে মৃত্যু, সাপ, বাঘ ও বুনো হাতির আক্রমণকে রুখে দেয়া সেই অভিযানে ধীরাজের সঙ্গী ছিলেন দশ পুলিশ কনস্টেবল ও কিছু মগ।
টেকনাফে কর্মরত অবস্থায় ধীরাজের জীবনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। থানার কূপ থেকে প্রতিদিন সখীবেষ্টিত হয়ে জল সংগ্রহে আসতো জমিদার কন্যা কিশোরী মাথিন। সময়ের সাথে সাথে ধীরাজের হৃদয় দখল করে ফেলে মগকন্যা। দুজনের মুখের ভাষা ভিন্ন হলেও চোখের ভাষায় তারা নিজেদের কাছে টেনে নেন। এক পর্যায়ে, জাতপাত-ধর্ম-বয়স-পেশা ভুলে ধীরাজ মাথিনের সাথে বিবাহ বন্ধনের দিন-তারিখ-ক্ষণ ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিচ্ছেদ বেদনায় পুড়তে হয় এই প্রেমীযুগলকে। কক্সবাজার জেলার শেষ সীমান্তে টেকনাফ থানার কম্পাউন্ডে অবস্থিত শত বছরের পুরনো বিশুদ্ধ পানির ‘মাথিনের কূপ’ ধীরাজ-মাথিনের সেই যুগপৎ প্রেম ও বিরহের নিদর্শন হিসেবে আজও দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে আছে।
কলিকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ধীরাজ। আর আট-দশটি সাধারণ পরিবারের সন্তানদের মতোই বেড়ে উঠেছিলেন।
আইএসসি পাস করে পড়াশোনা আর হলো না শিক্ষক পিতার ছেলে ধীরাজের। হঠাৎ করে ধীরাজের বড় ভাই মারা গেলে পরিবারে নেমে আসে এক শঙ্কা। গোয়েন্দা আর রহস্য গল্প-উপন্যাসের পোকা ধীরাজের মাথায় অভিনয়ের ভূত চাপে। সে অভিনয়ও করে ফেলে। কিন্তু তার রক্ষণশীল পরিবার মানতে রাজি নয়। ধীরাজের বৃদ্ধপিতা তার পরিচিত জনদের বলেকয়ে একটি চাকরি জুটিয়ে দেন।
ধীরাজ কাজ করবেন পুলিশের গোয়েন্দা হিসেবে। স্বদেশী নেতাদের ফলো করাই তার মূল কাজ। কিন্তু সাদাসিধে ধীরাজ একাজ করতে গিয়ে বড্ড গোল বাধান।স্পাইয়ের জীবন ধীরুর জন্য নয়, তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। একপর্যায়ে পুলিশের ট্রেনিং নিয়ে এএসআই হিসেবে যোগ দেন বঙ্গদেশের চট্টগ্রামে।
ধীরাজ ভট্টাচার্জ যখন চট্টলায় পুলিশ কর্তার বেশে আসেন ঠিক তখনও চট্টলা এতো বৃহৎরূপ লাভ করেনি। লেখক তৎকালীন চট্টগ্রামের জনজীবন ও পরিবেশ সম্পর্কে বেশ মনোমুগ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম শহরে থাকাকালীন পুলিশের এসপি মুল্যান্ডের অহেতুক রোষানলে পড়েন লেখক। তাকে পোস্টিং দেয়া হয় মগ অধ্যুষিত টেকনাফ থানায়। তখন টেকনাফে যেতে দুদিনের মতো লেগে যেত,টেকনাফ যেন দুর্গম অঞ্চল বিশেষ।
টেকনাফ থানায় যোগ দিয়ে জীবনের যেনো ভিন্নরূপ দেখলেন ধীরাজ। আইন কানুনের বালাই নেই! থানার পুলিশরা আইনকে 'ঠুটো জগন্নাথ ' বানিয়ে রেখে নিজেরাই আইন বানিয়ে শোষণ শাসন করছে নিরীহ মগদের।
সেখানেই জীবনের প্রথমবারের কারো প্রেমে পড়লেন ধীরাজ। মেয়েটি রোজ তার বাসার সামনের কূপে জল নিতে আসে। টেকনাফের জমিদার কন্যা মাথিনও ভালোবাসে বাঙালি বাবুকে। মিয়া বিবি রাজি তো কেয়া কারেগা কাজি? কাজির কিছু করার না থাকলেও রিয়েল লাইফ ভিলেনরা অনেক কিছুই করে এবং যার ফলশ্রুতিতে মাথিনকে রেখে ভাগ্যের ফেরে ফিরে আসতে হয় ধীরাজকে।
ধীরাজ আর মাথিনের অমর প্রেমের স্মৃতিচিহ্ন 'মাথিনের কূপ ' এখনো রয়েছে টেকনাফে।
অসাধারণ একটা বই। বেশ অকপটে জীবনের সব অধ্যয়ের পাতা যেন খুলে দিয়েছিলেন লেখক,অস্বীকার করেন নি নিজের দোষত্রুটিও।
'Truth is stranger than fiction' কথাটি হাড়ে হাড়ে সত্যি। ধীরাজ ভট্টাচার্যের আত্মজীবনী পড়ে থ' হয়ে বসে আছি। কোন সে কবেকালের সুদূর টেকনাফের মাথিনের অপেক্ষারত অভিমানিনী মুখ চোখের সম্মুখে বার বার ভেসে উঠছে। বিমূঢ়, হতবিহ্বল হয়ে জীবনের আশ্চর্যবোধকতা নিয়ে ভাবছি। সময়ের স্রোত বেয়ে ধীরাজ ভট্টাচার্যের স্মৃতি-স্মারক আমাকেও বিপন্ন করে ফেলেছে। দিনশেষে বলতেই হয়- what a life ধীউবাবা!
ধীরাজ ভট্টাচার্যের লেখা পড়ে বোঝবার উপায় নেই যে তিনি পেশায় লেখক না নায়ক। সুন্দর সুললিত গদ্যে তিনি তাঁর স্মৃতিফলক খোদিত করেছেন। এমন আত্মজীবনী সত্যি বিরল।
পুরো গল্প মোটামুটি চলনসই হলেও এরকম একজন কাপুরুষ মূর্খের আত্মজীবনী পড়ে মূল্যবান সময় অপচয়ের ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে পারলাম না। তবে জঙ্গল যাত্রার অংশটুকু বেশ ভাল লেগেছে বলে পাঁচে আড়াই দিলাম।
শুরু করার সময় ভেবেছিলাম সাধারণ কোনো বই। অথচ শেষ করার পর শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে, এই বই এতো ছোট কেন? আরেকটু বড় হলে কী এমন ক্ষতি হতো?
একজন পুলিশ অফিসারের লেখার হাত যে এতোটা চমৎকার হতে পারে, সেটাই বা কে জানে? ২১৬ পৃষ্ঠার এই স্মৃতিকথাকে মনে হচ্ছিলো শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে লেখা কোনো উপন্যাস!!।
লেখক ধীরাজ ভট্টাচার্যের পুলিশ জীবনের স্মৃতিচারণ। ছেলেবেলায় নায়ক হওয়ার ঝোক ছিলো। লেখকের নায়কগিরি ছোটানোর জন্য বাবা ছেলেকে ঢুকিয়ে দিলেন পুলিশে। ঐখান থেকেই বইয়ের শুরু।
স্বদেশী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সে সময় পুলিশের চাকরি সম্মানজনক কিছু ছিলো না। ব্রিটিশ সরকারের হুকুমে স্বদেশী আন্দোলনের নেতাদের ধরে ধরে জেলে ভরতে হতো। এটা নিয়ে লেখকের লজ্জা, দুঃখ, অনুযোগ সবই ছিল।
তবে লেখক ধীরাজ পুলিশ হিসেবে ততটা ভালো ছিলেন না। দীর্ঘ দুই বছরেও তিনি কোনো নেতাকে গ্রেফতার করতে পারলেন না। কলকাতা থেকে বদলি হয়ে ধীরাজ এলেন আমাদের চট্টগ্রাম।
কিন্তু বড় সাহেবের মেমসাহেব বউয়ের সাথে হ্যান্ডসাম ধীরাজের ভালো সম্পর্কটাকে বড় সাহেব ভালোভাবে নেননি। বদলি করে দিলেন টেকনাফ।
বলতে গেলে বইয়ের অর্ধেক অংশ জুড়েই টেকনাফের গল্প। সেই গল্প পড়তে গেলে কখনও হাসি আছে, কখনও রাগ হয়। ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের ভয়ঙ্কর রূপটাও আমাদের সামনে চলে আসে।আমার মতে এই বইয়ের বেস্ট চরিত্র ছিলো মজিদ। এই মজিদের দেখা আমরা পাবো টেকনাফেই।
তবে শেষপর্যন্ত বইটা শুধু স্মৃতিকথা হয়ে থাকেনি, বরং হয়ে উঠেছিলো লেখকের প্রেমকাহিনীও। টেকনাফে গিয়েই মাথিন নামের এক মগকন্যাকে হৃদয় দিয়ে ফেললেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। একজন ভীনদেশী, ভীনভাষী পুলিশের সাথে কিশোরী একটা মেয়ের প্রেমকাহিনী পড়তে বেশ ভালো লেগেছে। শেষপর্যন্ত কী হয়েছিলো? সেই উত্তর মিলবে বইতে।
সাধারণত স্মৃতিকথা বলতে আমরা যেমন বই বুঝি, এই বইটা তেমন না। বরং বইটা একই সাথে দুর্দান্ত একটা সাহিত্য এবং সময়ের একটা দলিল। ব্রিটিশ সরকারের আমলে আমাদের চট্টগ্রাম, টেকনাফের একটা ছবিও বইতে আছে।
কাপুরুষেরা বেঁচে থাকে আর সেই কাহিনী লিখে ফেলে। মাথিনেরা বিশ্বাসের রেসে হেরে যায়। আপনাদের প্রিয় আত্মজীবনীমূলক বইগুলোর নাম বলুন। আমার ইদানীংকার প্রিয় হলো এই বইটা। কেনো সেটা বলি। বইটা পড়ার সময় মনেই হবে না যে এটা একজনের জীবনের অংশ।হ্যাঁ,পড়ার সময় মনে হয়েছে অনেকটা নাটকীয় ঢংয়ে লেখা, এতো কিছু কীভাবে হবে! কিন্তু তখনই মনে পড়ে যে শব্দের ক্ষমতা অনেক। সাধারণ একটা ঘটনাকে তারা সুমধুর করে ফেলতে পারে,অন্যের জীবনের অংশ করে ফেলতে পারে। আর এই লেখার মধ্যে ধোয়াশারও কোনো ব্যাপার নেই। যেভাবে এলাকাগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে সেই এলাকাগুলো আপনার চোখের সামনে ভাসবে। অবশ্য এটার আরেকটা কারণ হতে পারে যে এটা আমার এলাকা,আমার বিভাগ নিয়ে লেখা। এখানে উল্লেখিত বিভিন্ন এলাকায় আমি নিজে গিয়েছি আবার যেখানে যাওয়া হয়নি,সেগুলোর এতো গল্প শুনেছি যে মনে হয় আমি গিয়েছি(বই বা কথার ক্ষমতা আরকি)।
আবার আরেকটা জিনিস হলো,লেখক নিজের দোষত্রুটি ঢেকে রাখতে হবে, সেটার প্রয়োজনবোধ করেননি। আর উনি একশো এক অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরেছেন। ক্ষমতার,দেশের,পদের-বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের। যা এখনও সত্য, আর পরিবর্তনের কোনো ধারা দেখতে পাচ্ছিনা।উলটো দিনকে দিন,ক্ষমতার দাপট্য বাড়ছে, স্বাধীন কথাটাই যেনো বন্দী। ছোটবেলায় আমাদের শেখানো হতো,"অর্থই অনর্থের মূল।" কিন্তু সেটার ঠিক ব্যাখ্যা শেখানো হয়নি। ঠিক ব্যাখ্যা হলো-অর্থ থাকা মানে ক্ষমতা, আর ক্ষমতা মানে অন্যের অনর্থের মূল হতে পারবেন,নিজের না।
বই নিয়ে বলতে এসে এসব বলছি কারণ আমি বইয়ের রিভিউ করতে পারিনা। আমি সেসবই বলি যেসব বই পড়ার সময় আমার মনে ঘোরাঘুরি করে। পড়ার সময়কার অনুভূতিগুলো বলি।
এই বই নিয়ে আরেকটা কথা বলি। আপনার লেখককে ব্যক্তি হিসেবে পছন্দ না করার সম্ভাবনা ৯৫%,কিন্তু কাহিনী আপনার অপছন্দ হবে না।
কাহিনীটা নিয়ে বলি। কাহিনী ইন্টারেস্টিং বেশ। কিন্তু নাম দেখে যা ভাবছিলাম পুলিশের চাকরি করার সময়কার কিছু দুধর্ষ ঘটনার গল্প শুনতে পাবো, কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। একজন কাপুরুষ পুলিশের গল্প আগা থেকে গোড়া। চাকরিজীবনে কি ব্যাক্তিজীবনে- কোথাও সাহসের পরিচয় রাখতে পারেন নি। এবার বোধহয় অন্যরকম কিছু করবেন এই চিন্তা করতে করতে কাহিনি শেষ। পড়তে মন্দ লাগেনি। না লাগার কারণ, গল্পে রাখঢাক নেই। গল্পের অতি মহান পুলিশ বাহিনি যে আসলে এক বিরাট লবডংকা সেটা হাইড করার কোনো চেষ্টা নেই। বই লিখছি মানেই আমি বিরাট হিরো, সেরকম কথাও কোথাও বলা নেই। সত্যিকার কাহিনি বোধহয় এই। রঙচঙহীন। তবে রঙ নেই বলা ভুল। মি: মুল্যান্ড এর ঘটনাটা কিংবা ঐ বিপ্লবীর সেই কথাগুলো যা মাঠে বসিয়ে শুনিয়েছিলো? স্বদেশ আন্দোলনের সময়কার একটা চিত্র পাওয়া যাবে বইটাতে। আরো মজার ���লো- লেখকের লাস্ট পোস্টিং ছিলো চট্টগ্রামে। কোলকাতার লোক হয়ে সে এতো বছর আগের যে চট্টগ্রামের বর্ণনা দিচ্ছিলো সেটা পড়তে ভাল্লাগছিলো কারণ জায়গাগুলোর নাম জানা। টেকনাফ ও কতো অপরিচিত ছিলো। ইশ এটা যদি বানানো গল্প হতো! মাথিনের জন্য মনটা বেশ খারাপ হয়েছে। আহারে! বেচারী।
এই বইয়ে সবচে বেশি যে জিনিসটা মন ছুঁয়েছে,সেটা হচ্ছে ধীরাজ বাবুর সহজ সরল লেখনী। আশ্চর্যের বিষয়,এই লোক নাকি কাজ করেছে পুলিশে এবং অভিনয়ে, অথচ এত চমৎকার লেখার হাতটি। এক বারের জন্য ইচ্ছে হয়নি, বইটা রেখে থুয়ে পড়ি। বরং ইচ্ছে হচ্ছিলো পড়তে থাকি। এমন না যে বইয়ের ভেতরের কাহিনি খুব জমাটি, তাও একটি বারের জন্য আলস্য আসেনি। এটা শুধু মাত্র লেখনী আর বলার নৈপুণ্যের কারণে।
"যখন পুলিশ ছিলাম" বইয়ে চট্টগ্রামের কথা এসেছে। ব্রিটিশ আমলের চট্টগ্রাম। এই অংশ টা আমার খুব পছন্দের। এমন না যে লেখক অনেক বিস্তারিত কিছু লিখেছেন চট্টগ্রাম নিয়ে,তা স্বত্বেও পড়তে এত ভালো লাগছিলো। পরিচিত সব জায়গা,পড়ার সময় যেন চোখে ভাসছিলো।
মগের মুল্লুক আমাদের চট্টগ্রামের বিখ্যাত প্রবাদ। তার প্রমাণ মিলল ধীরাজ বাবুর লেখা পড়ে। টেকনাফের অংশটাতে যখন ছিলাম,তখন আমি টিউশনে। আমার স্টুডেন্ট কে পড়ে শোনাচ্ছিলাম,তখনকার বাজারের অবস্থা। সে কিছু তে-ই বিশ্বাস করে না,বিষ্ময়ে হতবাক। তারপর বিস্তারিত যখন বললাম,তখন খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বিশ্বাস করল। আসলে বিশ্বাস করার মতো ও না,একটি টাকায় ছাগল মিলে,কে করবে বিশ্বাস? মগেদের সহজ সরল ধর্ম বিশ্বাস, নিজেদের নীতিতে অটল থাকা। এসব ব্যাপার চোখে লাগার মতো। তাদের হিংস্রতা ও কম ছিলো না। সব মিলিয়ে নতুন একটা ব্যাপারে ধারণা পেলাম। ধীরাজ বাবুর বলার ভঙ্গিটি বেশ মোহনীয়, পড়তে বড্ড আরাম লেগেছে। বিশেষ করে পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়ার গল্পটা,এই অংশটা বেশি ভালো ছিল। বলতে গেলে পুরো বইয়ের মধ্যে এই অংশটি ই উৎকৃষ্ট।
এবার আসি মাথিনের গল্পে,এটা আসলে গল্পই মনে হয়েছে। তবে এরকম সত্য অহরহ ঘটছে। নিজেও ঘটিয়েছি। যা বুঝলাম,পুরুষ মূলত প্রতারক, ভন্ড,কামাসক্ত একটি জীব। এর বাইরে পুরুষের কোন পরিচয় থাকতে পারে না।
যাই হোক, বইটা ভালো। পড়তে চমৎকার লেগেছে। কিন্তু নাম দেখে ভেবেছিলাম জমজমাট কিছু হবে,রহস্য আর তৎকালীন বিষয়ে বিস্তারিত লেখা থাকবে। সে রকম কিছুই পেলাম না। তবে ভালো একটা উপন্যাসের স্বাদ পেলাম।
একটা মানুষের জীবন কতটা বৈচিত্রে ভরপুর হতে পারে? ধীরাজ ভট্টাচার্যের জীবনখানা যেন তারই বাস্তব উদাহরন। আর সেই অভিজ্ঞতার একাংশেরই প্রতিফলন ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত যখন পুলিশ ছিলাম বইতে।
প্রথম জীবনে নায়ক,তারপর রক্ষনশীল পরিবারের চাপে পড়ে অভিনয় জীবন ছেড়ে লেখক যোগ দেয় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে। তৎকালীন স্বদেশী বিপ্লবীদের উপর নজরদারি করাই ছিল মূল ডিউটি। কিন্তু গোয়েন্দা জীবন যে গল্প কিংবা উপন্যাসের মত নয়, লেখক তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে কয়েকদিনের মধ্যেই।
একপর্যায় পুলিশের ট্রেনিং নিয়ে বদলি হয়ে চলে আসেন চট্টগ্রামে। সেখান থেকে তার ডিউটি পড়ে টেকনাফের মগ অধ্যুষিত এলাকায়। তখনকার টেকনাফ ছিল দুর্গম। মূল ভূখণ্ড থেকে সেখানে যেতেই লাগত দুদিনের বেশি ষ্টীমারে, তাও বছরের ছমাস কোন স্ট্রীমার চলত না।
মগদের টেকনাফে ছিল কোন আইনের বালাই। সবকিছু যে যার মত করে চলত। থানার পুলিশরাও বাড়তি ঝামেলা এড়ানোর চুতায় দুপয়সা নিয়ে নিজেরা নিজেরা মিটিয়ে ফেলত মামলা। সেখানেই এক মগ জমিদারের মেয়ের প্রেমে পড়ে লেখক। নাম তার মাথিন।
সকাল বিকাল পানি নিতে আসা ছিল মাথিনের শখ। পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ প্রতিদিন থানার বারান্দায় বসে বসে অপূর্ব সুন্দরী মাথিনের পানি নিতে আসা যাওয়া দেখতেন। আস্তে আস্তে ধীরাজ ভট্টাচার্যের সংগে মাথিনের চোখা চোখি এবং পরে তা প্রেমে পরিণত হয়।
কিন্তু জীবনটা বড্ড বেশিই বেরসিক। ঈশ্বর কেন জানি চায় না সব মানুষ সুখি হোক। ধীরাজ বাবার জরুরী ডাকে ফিরে যায় কলকাতায়, আরে কোনোদিন ফিরে না। এদিকে ভালবাসার মানুষের ফিরে আসার অধির অপেক্ষায় দিন গুনতে গুনতে অনাহার ও অনিদ্রায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জমিদার কন্যা মাথিন। সেই থেকে পাতকুয়াটির নামকরণ হয় ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ।
পুরো বইটি লেখকের বৈচিত্রময় জীবনের এক সহজ স্বীকারোক্তি। অকপটে লেখক স্বীকার করেছেন জীবনের ক্ষমাহীন ভুলগুলো। যা আজো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তখনকার জটিল সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের জীবন, আর বিশেষ করে পুলিশের হালচাল, সবই উঠে এসেছে অসাধারণ এই বইতে।
This entire review has been hidden because of spoilers.
আত্মজীবনী কখনো কখনো উপন্যাস হয়ে ওঠে। এই বইটি একটি সুপাঠ্য আত্মজীবনী। উপন্যাসের মত করে এক বসায় ( এক শোয়ায়) পড়ে ফেলা যায়। মন্ত্রমুগ্ধের মত বইটি পাঠককে আটকে রাখে। প্রথম কিছুদিন লেখকের পুলিশ জীবন পড়লে মনে হতে পারে, আমাদের কথক বোধহয় হেরে যাচ্ছেন। যতরকম ফেল করা যায় গোয়েন্দা বিভাগে সবই যেন তিনি করে ফেলবেন। এরপর ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হয়। লেখক চট্টগ্রামে আসেন। উপন্যাসের খানিকটা মধুর বিষয়ের উপাখ্যান লেখকের জীবনেও আছে। তিনি যেন বাড়ি থেকে বা পরিবার থেকে দূরে এসে সেটি মেলে ধরেন। এরপর বদলি হয়ে টেকনাফে চলে যান। থানার কাজে যাওয়ার সময় জঙ্গলের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, সঙ্গে মানুষের বর্ণনা, পড়লে 'আরণ্যকের' কথা মনে পড়তে পারে। বইয়ের শেষে আসে দুর্দশার চিত্র। উপন্যাসের নায়কদের মত তিনি হেরে যান। পালিয়ে যান সব কিছু থেকে। এই সময়ের বর্ণনা দিতে লেখক কিছুটা হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমা ব্যাবহার করেছেন। কিন্তু করুণ চিত্রটা এখানে পাঠককে ধাক্কা দেবেই। যদিও পাঠক আগেই বুঝে ফেলেন লেখকের জীবনের এই পর্যায়ে কী হবে? তবুও। না পড়লে ক্ষতিই হবে বোধহয়।
Man Proposes, God Disposes কিন্ত অনেক সময়ের মানুষের ইচ্ছা পূর্ণ হয় তবে কিছু সময়ের ব্যবধানে। হতে চেয়েছিলেন নায়ক ভাগ্য কিংবা পরিস্থিতি তাকে পুলিশ বানাল। সবশেষে আবার নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। জীবন গল্পের বর্ণনা আপনার ফিকশন বলে মনে হতে পারে, এত বেশি নাটকীয়। মানুষ অনেকসময় হাত পা বাঁধা পরাধীন। নিজের ইচ্ছার থেকে পরিবারকে গুরুত্ব দিতে হয়,নিজের এই দুর্বলতাকে লেখক স্বীকার করে নিয়েছেন, নিজেকে coward বলে উল্লেখ করছেন। মাথিনের ভালোবাসা এক নির্বাক প্রেমের অমর দৃষ্টান্ত।
সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনও করে না বঞ্ছনা বইটি পড়তে পড়তে কেবল উপরের এই কথাই মনে হচ্ছিল। আত্নজীবনী মোড়কে আমরা যা সাধারণত যা দেখি তা হল "যথা সম্ভব নিজের দোষ ট্রুটি লুকিয়ে ছাপিয়ে যতটা বলা যায়।" সম্ভবত এই একদিক দিয়েই বইটি অসামান্য হয়ে উঠেছে। নিজের দোষ ট্রুটি অকপটে স্বীকার করে গিয়েছেন লেখক। আর সম্ভবত এই কারনেই বইটি শেষ করার পর অদ্ভুত ভালোলাগার রেশ রয়ে গিয়েছে। বইটি লেখক ধীরাজ ভট্টাচার্যের আত্নজীবনী। কিন্তু বইটি পড়ে একবারের জন্যও তা মনে হয় না। মনে হয় যেন একটা উপন্যাস পড়ছি। কি নেই এতে? এ্যাডভেঞ্ছার,সাসপেন্স,রোমান্স,রোমান্সে বাঁধা দেওয়া ভিলেন।সাধারন একজন মানুষের ��ীবন যে কত বৈচিত্রের হতে পারে তা সম্ভবত বইটা না পড়লে বুঝতাম না।
নিতান্তই এক সাধারণ পরিবারে জন্ম লেখকের। নাটক থিয়েটারে আগ্রহ থাকলেও বাবা মায়ের ইচ্ছায় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পুলিশে যোগ দেন। আর উনার প্রায় ছয় বছরের পুলিশে থাকাকালীন সময় নিয়েই রচিত হয়েছে "যখন পুলিশ ছিলাম " । কাহিনী শুরু হয়েছিল খুব সাধারণভাবে। পুলিশ হিসাবে উনার কাজ এবং প্রতিদিনের নানা কর্মকান্ডের বিবরণে উঠে এসেছে তৎকালীন পুলিশের কর্মকান্ড এবং স্বদেশীদের কর্মকান্ড। উঠে এসেছে কিছু তিক্ত সত্য( ভাগ্য ভালো বেচারা ভারতের রাজাকার উপাধি পায় নাই। আমাদের দেশে এইরকম সত্য কথা বললে শিউর রাজাকার উপাধি পেয়ে যেতে চেতনাধারিদের কাছ থেকে) পুলিশের বারবার ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত উনার পোস্টিং হয় অধুনা বাংলাদেশের চট্রগ্রামে। সেই সময় এত জমজমাট ছিল না আজকের বন্দর নগরী। ভাগ্যের ফেরে আবার যেতে হয় মগ অধ্যুষিত টেকনাফে। লেখকের কলমের ছোঁয়ার উঠে আসে তৎকালীন চট্রগ্রামের চিত্র । আর টেকনাফের মানুষের জীবন যাত্রার একটা ধারনা পাওয়া যায়।
আর এই এখানেই জীবনের প্রথ বসন্ত এসে ধরা দেয় লেখকের। প্রেমে পড়েন মগ সুন্দরী মাথিনের। আহা ......মাথিন <3 । ভালোবাসার এই এক গুন। স্থান ,পাত্র, কাল কিংবা ভাষা কিছুই বাধা মানে না। লেককের সাথে সাথে আমরাও পরিচিত হই মগদের সাথে। আর মাথিনের রুপের সাথে। এক বর্ণ মগী ভাষা বুঝতে না পেরেও দুজন দুজনকে মন দিয়েছিলেন । কিন্তু ভিলেন শুধু সিনেমায় থাকে না। বাস্তব জীবনেও থাকে। মাথিনের সাথে উনার প্রেমের শেষ পরনতি কি হয়েছিল পাঠক তা বইটি শেষ করলেই জানতে পারবেন। আপাতত এই নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না।
শুধু কি জলে স্থলে মানে জঙ্গলেও ভারি একটা এ্যাডভেঞ্চার করে এসছিলেন তিনি। চট্রগ্রামের পাহাড়ি জঙ্গলে দারুন কিছু বর্ননা পাউ আমরা বইটিতে ।
পরিশেষে শুধু এইটুকুই বলতে চাই। এটি একটি অবশ্য পাঠ্য বই। বইটি শেষ হয়েছে একটি শব্দ দিয়ে "কাওয়ার্ড" ।আসলেই তো ।জীবনের কোন না কোন সময় আমরা সবাই সত্যি কাওয়ার্ড ।
যেখানে প্রত্যাশার পারদমাত্রা পৃথিবীতে আসার আগেই সন্তানদের উপর দিয়ে দেয় পাহাড়সমান স্বপ্ন অপ্রাপ্তি আকাঙ্খার গুরুদায়িত্ব ।
পরপর অনেকগুলো মুখের অন্নচিন্তা থাকলে বা কদাচিৎ না থাকলেও ষষ্ঠী ঠাকুরন বছরান্তে আশীর্বাদান্ত পাঠিয়ে পূর্ন করনে ভক্তের ঘর।এমনি এক বাড়িতে জন্ম অবিভক্ত বাংলার সবাক এবং নির্বাক চলচ্চিত্রের দাপুটে অভিনেতার নাম ধীরাজ ভট্টাচার্য।জীবন যার কেটেছে হেসে খেলে লুকিয়ে চুরিয়ে রুদ্ধশ্বাস গোয়েন্দা গল্প পড়ে।জুটেছে মায়ের বকুনি,বাবার ধীর শান্ত কন্ঠস্বরের সাবধান বানী।সব সাজানো গোছানো নিপাট ভদ্রলোকের স্বপ্নীল জীবন।
হঠাৎ সে সুরের ছন্দপতন, উল্কাপাতের মতো ঝরে গেলো বড়দা;পুত্রবিয়োগে মাতা শয্যাশায়ী ,পিতা আরো গম্ভীর।জীবনের এই তাললয়ের সাথে যুক্ত হবার আগেই মুক্তির খোঁজে ধীউবাবা(পিতৃপ্রদত্ত ডাকনাম)জুটলেন সিনেমাতে,একে তো ভদ্রস্থ ঘরের ছেলে নেমেছে রং মেখে সং সেজে ছবি করতে তার উপরে গোদের ওপর বিষফোঁড়া প্রথম ছবিতেই সে এক লম্পটের লোলুপদৃষ্টির লীলাখেলা।ব্যস সবে ধন নীলমনির ভবিষ্যতের ভীষণ ভয়ে বাবা ঢুকিয়ে দিলেন পুলিশ বাহিনীতে।
সময়টা তখন স্বদেশীদের,দেশমাতার সব দামাল ছেলেদের দমিয়ে রাখার জন্য দস্তুরমতো টিকটিকি দের সাথে দায়িত্ব নিলেন ধীরাজ মশাই।একে তো অনিচ্ছায় উপরুন্ত এই ধরি মাছ না ছুঁই পানির পন্থায় ওষ্ঠাগত প্রাণের ত্রাতা রূপে দুবার বাঁচলেন দুই স্বদেশীদের হাতেই যমালয়ের রাস্তাটাকে দূর থেকে মেপে।বদলি চাকরির সুবাদে টেলিফোনের তারের টুং টাং শেষে হারমোনিয়ামের সাতসুরে সপ্তমে চড়ে পদান্নতির পাদুকায় উড়ে ঘুরে বেড়ানোর আগেই হর্তাকর্তা মুল্যান্ড সাহেবের পত্মী হাত ছাড়া হওয়ার মিথ্যাভয়ে দন্ড মিললো সেই সুদূর টেকনাফে।
নাফ নদীর সাথে নারীর টানে নাড়ীর বাঁধন বাধার আগেই সহকর্মীর ষড়যন্ত্র,পিতার পত্রপাঠেই প্রবাস ছেড়ে আপন পরিবেশে ফিরে আসার আদেশবাক্যের তোড়ে মগমুল্লুকে মাথিনকে ছেড়ে কলকাতার ক্রোড়ে ফিরে আসা এক বাঙালী ছেলের এই গল্প একনিমিষেই অতীতকালে ফিরিয়ে নেবার এক মস্তবড় মন্ত্র।
ছোটবেলা থেকে এই দুই বইয়ের নাম শুনে আসছি, একই ব্যক্তির পুলিশ আর নায়ক জীবনের কাহিনী। বাসায় বই দুইটাও আছে কিন্ত কেন যেন পড়া হয়নি এতদিন! বইয়ের শুরুতে তার নায়ক জীবনের হালকা ছোঁয়া আছে। তারপর শুরু হয় পুলিশ জীবন। শহরের পুলিশের কাজে কিছুটা বৈচিত্র্য থাকলেও টেকনাফ জীবনের সাথে তার কোন তুলনাই হয় না! বিশেষত মারিয়ালা গ্রামে যাবার পথটুকু অসাধারণ। এমন অভিজ্ঞতা এ যুগে চাইলেও সম্ভব না! তবে দু:খের বিষয় হল, এত বছরেও আদিবাসী দের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি! তারা আগের মতই সহজ সরল অবহেলিত রয়ে গেছে! বাংগালি অভিভাবক রাও এত বছরে বিশেষ পরিবর্তিত হয়নি! জোর করে ছেলেকে পুলিশের চাকরি করতে বলা কারণ এটা 'সরকারি ' চাকরি, emotional blackmail করে, সমাজের দোহাই দিয়ে পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে না দেয়া, সবই আজও সগৌরবে অবস্থান করছে! যাই হোক না কেন, শেষটা সুখের হল ভেবে খুশি হতেই একটা খবর সব চুরমার করে দিল। এটাই জীবন! সেটাও এত বছরে বদলায় নি! এতকিছু বদলায়নি বলেই হয়তোবা সেই পাকিস্তান আমলে লেখা বই আজো পড়তে ভাল লাগে! এখন বই ভাল লাগছে বলে খুশি হব না এত বছরেও আমাদের উন্নতি হয়নি ভেবে দুক্ষ পাব, বুঝতে পারছি না!
I feel pity for this man.His life is full of turmoil and hardship. Sometimes reading the book,lack of courage explicitly disclosed here.At first he abandoned his chance of being an actor only for his parental antipathy to film-world.Then he was forced to sacrifice his love only to honor his father's word. This is a very tragic story, the love between the writer and a local tribal girl called Maathin. The girl killed herself after his departure from Teknaf(He was posted there) without acknowledging anyone. These incidents make a vivid sense of his cowardly attitude.At the last words he confessed it and this is how the book ends.Despite it left me with a gloomy mind, it's worth reading really, finished the book in a sitting. [image error]
" ডিম আগে না মুরগী আগে?" "অবশ্যই ডিম আগে। " "না , মুরগী আগে!" " ডিম আগে । " " না , মুরগী আগে।"
ডিম আগে নাকি মুরগী আগে- এ নিয়ে এরকম মত-বিরোধ চিরকালই চলে এসেছে। তবে একটা প্রশ্নের উত্তরে সবাই ঐকমত্য । তা হলোঃ ধীরাজ ভট্টাচার্যের দুটি বইয়ের মাঝে কোনটি আগে পড়তে হবে? যখন পুলিস ছিলাম; নাকি যখন নায়ক ছিলাম ? এক্ষেত্রে সবাই উত্তর দিয়ে থাকেন আগে পড়তে হবে ধীরাজ বাবুর পুলিস হবার সময়কালের আত্মজীবনী। এরপরে গিয়ে নায়ক হবার আত্মজীবনী। এক্ষেত্রে যখন পুলিস ছিলাম লেখক আগে লিখেছেন বলেই নয়। যখন পুলিস ছিলাম এর তুলনায় যখন নায়ক ছিলাম বইটি বেশ সাধাসিধে বলেই তারা এটি পরে পড়তে বলেন। বেশিরভাগ মানুষই তাই আগে যখন পুলিস ছিলাম বইয়ে লেখকের জীবনের নানা ঘটনার বর্ণনা পড়ে ভীষন আমোদিত হয়। এরপরে গিয়ে যখন নায়ক ছিলাম বইয়ে আগের বইয়ের তুলনায় নিতান্তই ম্যাড়ম্যাড়ে বর্ণনা পড়ে হতাশ হয়ে পড়��।
আমার ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টোটা। আমি আগে পড়েছি যখন নায়ক ছিলাম। যা আমার কাছে আহামরি ভালোও লাগেনি। আবার একেবারে ফেলে দেয়ার মত খারাপও মনে হয়নি। চলনসই বলা চলে। এবার যখন যখন পুলিস ছিলাম পড়ে শেষ করলাম তখন বুঝলাম বিনোদনের ক্ষেত্রে অনুজের তুলনায় অগ্রজ কতটা অগ্রগামী।
বইয়ের শুরুটা হয় এমন ; বড় ছেলের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর মেজ ছেলে ধীরাজকেও সিনেমায় নাম লেখাতে দেখে ধীরাজের মা শয্যা নিলেন। তার বাবা তখন কিছু বললেন না ঠিকই। কিন্তু কদিন পরেই দেখা গেল তার ধীউবাবা কে তিনি পুলিসে ভর্তি করতে তোড়জোড় করছেন। ধীরাজ ও বাবার মুখের দিকে চেয়ে নিমরাজি হলেন। ধীরাজ প্রথমে গেলেন আই.বি.( ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ) ডিপার্ট্মেন্টে। তখন স্বদেশি আন্দোলন তুঙ্গে। ধীরাজের ডিপার্ট্মেন্টের কাজ ইংরেজ মাতার শাসন শৃংখল ভেঙ্গে বেরোতে চাওয়া এসব স্বদেশ ডাকাতদের উপর নজরদারি করা। নিজেদের পুলিস বলে দাবি করলেও বাংলা মায়ের এই সূর্য সন্তানদের উপর এরুপ গোয়েন্দাগিরির কারণে তাদের নাম দেয়া হয়েছিল টিকটিকি। এই টিকটিকিগিরি করতে গিয়ে বইয়ের শুরুতে নানা হাস্যরসাত্মক ঘটনার বর্ণনা যেমন- নজরদারি করতে গিয়ে এক্সিডেন্টের পর যার উপর নজরদারি হচ্ছে তারই শুশ্রূষা পেয়ে বাড়ি আসা; টিকটিকিদের উপর তিতিবিরক্ত অভিযুক্তের পাল্টা ধাওয়ার বর্ণনা পড়ে বেজায় হেসেছি। আবার সন্তানের ভবিষ্যৎ যাতে উজ্জ্বল হয় তাই বিধবা মায়ের আত্মত্যাগ এর কথা পড়ে মন বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল।
এই টিকটিকি জীবন অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সারদায় তাকে পুলিস ট্রেনিং নিতে পাঠানো হয় তার বাবার বন্ধুর কলকাঠি নাড়ানোতে। সেখানে ট্রেনিং শেষে পোস্টিং হন চট্টগ্রামে। আমার নিজের বেড়ে ওঠা ছিল চট্টগ্রামে। প্রায় শত বছর আগের পাহাড়ী সুন্দরী চট্টগ্রামের বর্ণনা পড়ে তাই বারবার নস্টালজিয়ায় ভুগছিলাম।
লেখক অবশ্য চট্টগ্রামেও বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেন না । মুলান্ড নামক বিদেশী অফিসারের রোষানলে পড়ে তাকে বদলি করা হয় টেকনাফে। বাংলার এই একেবারে শেষপ্রান্তে সভ্য লোকের বসবাস নেই বললেই চলে। যত দুর্ধর্ষ আসামীদের এখানে কয়েদ করে রাখা হয়। ভিনদেশে অজানা পরিবেশে , নাকি সুরে কথা বলা মগদের মাঝে পড়ে লেখকের ছেড়ে দে মা , কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
তবে আস্তে আস্তে তিনি টেকনাফে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেন। আর তখনই থানা সংলগ্ন সমগ্র টেকনাফের একমাত্র সুপেয় জলের কুয়া থেকে পানি নিতে আসা মগ জমিদারকন্যা মাথিনের সাথে তার চোখাচোখি ঘটে। আর গান আছে না একটা- চোখ যে মনের কথা বলে চোখে চোখ শুধু রাখা নয় চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে চোখের মত চোখ থাকা চাই। এই গানের মতই একে অপরের মুখের ভাষা না বুঝলেও লেখক আর মাথিন পরষ্পরের চোখের ভাষা পড়েই প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া শুরু করেন। মগ মেয়েরা নিজের স্বামী নিজেই বেছে নেয়। তাই মাথিনের জমিদার পিতাকে নিয়ে কোনো ভয় ছিল না । লেখক তাই সিদ্ধান্ত নেন সামনে মগদের পবিত্র অনুষ্ঠানে মাথিনের কাছে ভালোবাসা নিবেদন করবেন।
এর আগেই ঘটে যায় আরেক ঘটনা। মরিআলা নামক দুর্গম অঞ্চলে সরকারকে ঠকিয়ে গোপনে সমুদ্র থেকে লবণ উত্তোলনকারীদের ধরতে যেতে হয় লেখককে। সেখানে যাওয়ার সময় পাহাড়ী জঙ্গলের এক এপিক এডভেঞ্চারের বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছিল লেখকের সাথে আমিও কাঁধে বন্দুক নিয়ে চলেছি মরিআলা । এ অংশটুকু বারবার আমাকে চাঁদের পাহাড় আর আমাজনিয়া বইটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। যখন পুলিস ছিলাম বইটি যারা লেখকের পুলিসে চাকরি করবার সময়কার নানা উত্তেজনাকর,মাথা ঘোরানো কেস নিয়ে লেখা টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ভেবে বইটি শুরু করেছিলেন তাদের কাছে এ অংশটুকুই সবচেয়ে ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস।
এর পরেই গল্পের অবশ্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক অংশটুকু। যা পড়ে এ রিভিউটি লেখার সময়েও আমার মন খারাপ হয়ে আছে। এটি নিয়ে তাই বেশি কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না । শুধু এটুকুই বলতে চাই ; অকপটে সব সত্যি স্বীকার করা দেখে তাকে অনুতপ্ত মনে হলেও এ বইয়ে মুলান্ড ,সতীশ এর পাশাপাশি লেখক নিজেও আমার কাছে ভিলেন।
প্রোডাকশনঃ বইয়ে টুকিটাকি কিছু বানান ভুল ছিল। চোখে তেমন একটা লাগে না । এটিই যেহেতু প্রথম এডিশন তাই আশা করছি পরবর্তী এডিশনে এটি ঠিক করে নেয়া হবে। সাদামাটা প্রচ্ছদটিও ভালো লেগেছে আমার কাছে। বইয়ের বাকিসব কিছু ছিল একেবারে টপনচ। উপকথা এক্ষেত্রে প্রশংসা পেতেই পারে।
বইয়ের নামঃ যখন পুলিস ছিলাম লেখকঃ ধীরাজ ভট্টাচার্য প্রকাশনীঃ উপকথা মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০ টাকা
এই শেষ রাতের দিকে শেষ হলো ধীরাজ ভট্টাচার্যের আত্মজীবনী অর্থাৎ 'যখন পুলিস ছিলাম'। সাব ইন্সপেক্টরে ৪২ তম ব্যাচে পরীক্ষা দিয়েছিলাম এবার, রিটেনে গিয়ে আর ভাগ্য সহায় হয়নি। যাইহোক, হয়তো পুলিশ হবার একটা অদম্য নেশার জন্যে অথবা, ধীরাজ ভট্টাচার্যের চমৎকার অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনির জোরে এই বই আমার কাছে একদম চমৎকার মনে হয়েছে।
গল্পটা যখনকার তখন স্বদেশী আন্দোলন একদম জোরদার চলছে। ব্রিটিশ সরকারের হুকুমে স্বদেশী আন্দোলনকারী নেতাদের জেলে পুরতে হতো বলে পুলিশের চাকরি যে কিরকম সম্মানের ছিলো তা আর বলার অবকাশ রাখে না। এরকম একটা সময়েই লেখকের চাকরিতে হাতেখড়ি হয়। আর, তারপর থেকে তার চাকরির অভিজ্ঞতাটায় তুলে ধরেছেন তিনি এই বইয়ে। তবে, শুধু চাকরির অভিজ্ঞতায় না। সেই সাথে লেখকের প্রেমের গল্পও জায়গা পেয়েছে বইয়ে।
সবমিলিয়ে বলবো, একটা সুন্দর সাবলীল চমৎকার আত্মজীবনী পড়লাম। অনেকে লেখকের উপর চটেছেন(আমি কারণটা বলছি না,নিজেরে পড়ে নিবেন) তবে, নিজের খারাপ দিকটা উপস্থাপন করতেও সাহসের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে ধীরাজবাবু কতোটা সাহসী তা বইটা পড়ার পরেই উপলব্ধি করতে পারবেন। অবশ্যই পড়বেন। এই বই ফেলে রাখা মোটেও উচিত না।
ধীরাজ ভট্টাচার্যকে আমি চিনতাম না একেবারেই, তারপরও আত্মজৈবনিক এর প্রতি আগ্রহ থেকে বইখানি কেনা। তাছাড়া দোকানে বসে যতোটা পড়েছি তাতে বেশ ভালো লাগবে বলেই মনে হয়েছে। বইয়ের ভূমিকাতে লেখককে তার জীবনের অভিজ্ঞতা লিখবার জন্যে সম্মানীত প্রকাশকদের এতো তোষামোদি করতে দেখেই সন্দেহ হলো ইনি জনপ্রিয় কেউ না হয়ে পারেন না। খোঁজখবর করে জানলাম ধীরাজ ভট্টাচার্য মূলত জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন, প্রথম জীবনে পুলিশের চাকরিতে ঢুকে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। এমনকি তার পুলিশি চাকরির রেশ পরবর্তী জীবনের ঘটনাগুলোকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছিলো ফলে এই পুলিশে চাকরির অভিজ্ঞতাকালীন সময়টা কোনো সিনেমার চেয়ে কম নয়। লেখক না হয়েও তার লেখনী বেশ প্রাঞ্জল। পড়তে পড়তে চিটাগং থেকে জাহাজে করে টেকনাফ, সেই থেকে নীলা, চিটাগং হীলস হয়ে মরিয়ালা থেকে আবার ফিরে কলকাতায় আসা হলো আজ সকালে।
এইটা মিলু সাজেস্ট করেছিল,তাঁর নাকি লেখকের গল্প বলার ভঙ্গি খুব ভালো লেগেছিল,তাই লোভে পড়ে আমিও সতীর্থের অফার থেকে এটা কিনে ফেলে��িলাম। বহুদিন পর পড়তে নিলাম, পড়লাম। আমার ও খুউব ভালো লাগলো।
আমার জার্নাল লেখার অভ্যাস আছে,কিন্ত কোনটা রেখে কোনটা লিখব বুঝতে পারি না, গোলমাল পেকে যায়। এতো এতো মনের কথা কি করে লিখব,সময় কখন হবে বুঝতে পারি না। এটাকেও আমার কাইন্ড অব তারিখহীন জার্নাল মনে হয়েছে। একটা সহজ সরল জার্নাল যেখান থেকে একই সাথে জঙ্গলের নির্জনতা আর কোলকাতা শহরের কোলাহলের ঘ্রাণ আসে। মাথিনের সাথে লেখকের সম্পর্ক পড়ে খুব রাগ হচ্ছিল, ইন্টারফেইথ রিলেশনশিপ কঠিন। লেখক জানতেন এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যত নেই। তাও বুঝে শুনে বেচারা মেয়েটাকে কষ্ট দিলে। সবমিলিয়ে বেশ!
আত্মজীবনী যে এত বিচিত্র-বর্ণিল হতে পারে তা কল্পনাতীত। এই কাহিনীর বেশিরভাগ অংশজুড়ে আছে টেকনাফ। সঙ্গত কারণেই একশো বছর আগেকার ওই টেকনাফের সঙ্গে এখনকার মিল খুঁজতে চাওয়া বাতুলতা। তৎকালে বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন টেকনাফের যে-দুর্গম বিবরণ লেখক দিয়েছেন, তাতে বিস্ময়ের সঙ্গে ঈর্ষাও হয় আমার। অনেক ভাগ্যে এমন সুযোগ মেলে।
লেখক কি আরেকটু সাহসী হতে পারতেন? দুঃখজনক বিয়োগান্তক পরিণতিটা এড়াতে পারতেন? জানা নেই। তবে তিনি নিজেই নিজেকে যেভাবে ভর্ৎসনা করেছেন, তাতে খারাপলাগা বাড়ে বৈ কমে না।
কারো কারো জীবন বোধহয় এমনই হয়, উপন্যাসের চেয়েও বৈচিত্র্যপূর্ণ, ঘটনাবহুল। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের জীবনও সাধারণ। ধীরাজ ভট্টাচার্য অসাধারণ মানুষ হয়তো ছিলেন না, দোষগুণে ভরা মানুষই কিন্তু তার জীবনটা ছিলো ঘটনাবহুল। নিজের জীবনের এমনসব ঘটনা লেখার ক্ষমতা সবার থাকে না, ধীরাজ ভট্টাচার্যের ছিলো, আর ছিলো নিজের দূর্বলতা, দোষ স্বীকার করে নেবার অকপট ক্ষমতা।শিক্ষক বাবার ছেলে ধীরাজের ছোটবেলা থেকে রহস্য কাহিনীর প্রতি খুবই অনুরাগ ছিলো, সে অনেকেরই থাকে। বড়ভাইয়ের অকাল মৃত্যু যখন সংসারটা ওলটপালট করে দেয়, তখন ধীরাজ নাম লেখিয়েছিলেন সিনেমায়। যদিও নায়কের রোলে নয়, ভিলেনের। তখন নির্বাক চলচিত্রের যুগ, সিনেমায় অভিনয় করাটাও সমাজের চোখে সম্মানজনক কিছু নয়, তার উপর কলকাতায় সুপরিচিত শিক্ষক বাবার ছেলে হয়ে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয়, পরিবার থেকে এলো প্রবল আপত্তি। সংসারের হাল বাবা একলা বইতেও পারছেন না, সিনেমার ভূতও কাঁধ থেকে নামানো দরকার। এক ছাত্রকে ধরে ছেলেকে বাবা ঢুকিয়ে দিলেন পুলিসে। অবশ্য ইউনিফর্মধারী পুলিশ না, আই.বি তে, গোয়েন্দা হিসেবে।তখন স্বদেশী যুগ, ইংরেজ রাজ স্বদেশীদের ভালোমতো টাইট দেবার জন্য আই.বি, এস.বির পেছনে দুহাতে খরচ করছে, লোকবল নিয়োগ করছে। কাজ তো জুটে গেলো কিন্তু বিভিন্ন অপারেশনের বেলায় ধীরাজের সাফল্য লবডংকা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি একটা না একটা গোল বাধাবেনই। কখনো স্বদেশীদের ওপর টিকটিকিগিরি করতে গিয়ে উল্টো চলতি ট্রামে ধুতি আটকে আহত হয়ে সেই সাসপেক্ট স্বদেশী নেতাটির সেবা শুশুস্রা আর ভৎসনা পাওয়া, কখনো বাঘা কোন স্বদেশীর পিছু পিছু ঘুরে শেষ পর্যন্ত উল্টো ধাওয়া খাওয়া, স্বদেশী ভেবে নিরীহ যুবককে হয়রানী করে উল্টে লজ্জার মুখে পড়া, এসব ব্যর্থতার পর ডেস্ক জব হিসেবে টেলিফোন অপারেটরের কাজ করতে গিয়ে সেখানে গিয়েও গোলমাল করা, এসবগুলোই ঘটে গিয়েছে। অবশ্য অনেক বাঘা দেশবরেণ্য নেতা যে তলে তলে ইংরেজদের চর ছিলেন সেই অবাক করা তথ্যও তিনি দিয়েছেন, যদিও নাম উল্লেখ করে অপমান করেন নি। চাকরীটাও হয়তো টিকতো না স্রেফ মাথার উপর বাবার ছাত্র রতীলাল বাবু ছিলেন বলেই, সব বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে যাচ্ছিলেন। তারপর সারদায় ট্রেনিং নিয়ে কলকাতা ছাড়লেন। পোস্টিং হলো চট্টগ্রাম রেঞ্জে। সেখানে কলকাত্তাইয়া স্মার্টনেস দেখিয়ে, গান গেয়ে সবার মন কেড়ে নিলেন। চেহারাটাও মনে হয় তখন বেশ লালটু মার্কা ছিলো। সবার ভালোবাসা পেলেন, এমনকি পুলিসের বড়কর্তা মুলান্ড সাহেবের মিসেস এরও। সেটাই কাল হলো, ঈর্ষাপরায়ন মুলান্ড সাহেব ধীরাজকে পাঠালেন টেকনাফে বদলী করে। চট্টগ্রামের সুহৃদরা সদানন্দবাবু, হেমদারাও আটকাতে পারলেন না। টেকনাফে পোস্টিং আজও খুব সুখকর কিছু নয়।আর সেই গত শতকের ত্রিশ কি চল্লিশের দশকে সেটা ছিলো আরও দূর্গম। চট্টগ্রাম থেকে স্টীমারে করে একমাত্র যাওয়া যেত, তাও বছরের ছয় মাস স্টীমার চলতো না, সেই স্টীমার যাত্রাও এতো ভয়ংকর ছিলো যে যখন তখন বাচ্চারা স্টীমার থেকে সমুদ্রে পড়ে যেতো। যদিও লেখক টেকনাফ কে দ্বীপ বলে অভিহিত করেছেন, সেটা আদৌ দ্বীপ নয়। তবে তখন জলপথ ছাড়া সভ্য জগতের সাথে যোগাযোগ প্রায় ছিলো না। একপাশে আরাকান হিলস, আরেকদিকে চট্টগ্রাম হিলস, দুইই তখন অনেক দূর্গম, পায়ে হেঁটে কক্সবাজার যেতেও লাগতো ৪ দিন। সেই টেকনাফে তখন বাঙালি প্রায় ছিলোই না, অধিবাসী সবাই মগ, অর্থাৎ রাখাইন। তখনকার টেকনাফকে স্বর্গ আর নরক দুইই একসাথে বলা যেতে পারে। জিনিসপত্র অত্যন্ত সস্তা, আবার লোকগুলো আদিম। থানার অন্য পুলিশরাও ছিলেন কপিবুক পুলিশ, মহেন্দ্রবাবু, সতীশ একেবারে মার্কামারা পুলিশ, আবার হরকির মতো সুহৃদও তিনি সেখানে পেয়েছিলেন। বন্ধুত্ব হয়েছিলো সুধীর, দাস, মুখার্জির মতো ফরেস্ট অফিসারদের। আর পেয়েছিলেন মাথিনকে। মগ জমিদারের মেয়ে মাথিন, থানার পাতকুয়ায় জল আনতে আসতো। জল আনা তো ছুতো, মাথিন আর ধীরাজের মধ্যে কিভাবে যে ভালোবাসা হয়ে গেলো কে জানে। কেউ কারো ভাষা জানে না, দূত হিসেবে হরকি ছিলো, মগ সমাজও প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারে আধুনিক। সব কিছুই ঠিকঠাক, সংক্রান্তির উৎসবে ধীরাজ বিয়ের প্রস্তাব দেবেন মাথিনকে। কিন্তু ঈর্ষাপরায়ন সতীশ কলকাঠি নেড়ে সব গুবলেট করে দিলো। ভাগ্যও ধীরাজকে সেসময় দূরের এক যাত্রায় পাঠিয়ে দিলো। সে যাত্রায় ধীরাজ দেখা পেলেন মজিদ সাহেবের মতো উদার হৃদয়, সরল প্রাণ এক আবগারি পরিদর্শকের, কিন্তু সংক্রান্তির দিনে উৎসব প্রাঙ্গনে আর থাকা হলো না। তারপর বাবার চিঠি পেয়ে তাকে ফিরে যেতে হলো কলকাতায়, পরিবারের চাপে টেকনাফ ফেরা আর হলো না। পুলিসের জীবন ছেড়ে ঢুকলেন নায়কের জীবনে। আর মাথিন, ধীরাজ কলকাতা পালিয়েছেন শুনে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সে তিলে তিলে ঢলে পড়লো মৃত্যুর মুখে, পুরো টেকনাফ বাসীও তাকে আটকাতে পারলো না। মাথিনের সেই কূপ আজও আছে। ধীরাজ বোধহয় রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীর অপুর মতো পরিবারের চাপে একটি মৃত্যুর কারণ হয়েই রইলেন। তাকে এই জীবন উপন্যাসের নায়ক বলবো না খলনায়ক বলবো জানি না, তবে তার জায়গায় থাকলে আপনি আমি কি করতাম কে জানে। দোষ স্বীকার করলে নাকি কিছুটা হলেও ঈশ্বর ক্ষমা করে দেন। ঈশ্বর আছেন কি নেই জানি না, ক্ষমা বলে কিছু আছে কি নেই তাও জানি না, তবে সেই কবেকার টেকনাফের মগকন্যা মাথিনের জন্য সত্যিই কষ্ট হয়। কষ্ট হয় জঙ্গলের পথে হঠাৎ খাদে পড়ে মারা যাওয়া বৃদ্ধা মায়ের একমাত্র জীবিত সন্তান জংলীর জন্য, মুখার্জির আর্দালি অনাথের কথা ভেবে, মরিআলা গ্রামের সেই দরিদ্র লবণ চাষীদের কথা ভেবে, সম্পত্তির লোভে কাকা-কাক���র হাতে খুন হওয়া সেই অসহায় সুন্দর কিশোর মন্নুর জন্য, পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ খেয়ে পুলিশ যার খুনীদের ছেড়ে দিয়েছিলো, কষ্ট লাগলো ধীরাজের জন্যও। নিজের দোষ ঢাকার জন্য তিনি কোন অজুহাতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন নি, এমন অকপট স্বীকারোক্তি কোন আত্মজীবনীতে সত্যিই বিরল। সব বলে দিয়ে বই পড়ার মজাটা নষ্ট করে দিলাম? নিজে পড়ে দেখুন, আমার বলার চেয়ে না বলা কথাই বেশি পাবেন।
ধীরাজ ভট্টাচার্য, সাহিত্যের একজন অনুরাগী। গানের সুমধুর কণ্ঠ, অভিনয়ের দক্ষতা সব ছিল। একটা চলচ্চিত্রে খলনায়কের ভূমিকায় কাজও করেছিলেন। স্বপ্ন ছিল সোনালী রূপালী পর্দায় নিজেকে দেখার। কিন্তু ছেলের মুখে রঙ চং মেখে অভিনয় করা দেখে মা রেগেই অস্থির। নাওয়া-খাওয়া ছাড়লেন। এ লাইন ছাড়তে হবে। অবস্থা গতিক না দেখে তাই অগত্যা নিজের স্বপ্নকে চাপা দিতে হলো। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া ধীরাজের জীবন বেশ যাচ্ছিল। বাঁধ পড়লো বড়ো ভাইয়ের অকাল মৃ ত্যু তে। আই.এস.সি-টা আর শেষ করা হলো না। কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেলো জীবন। এসময়ই ঐ একটু অভিনয়ে মন দিয়েছিলেন। মায়ের তোপে সেটাও গেল। স্কুলমাস্টার বাবা তাই তার ছাত্র রতীলালকে ধরে পুলিসে চাকরি জুগিয়ে দিলেন। কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা, ইচ্ছা বা মনমানসিকতা ছাড়াই কলকাতা পুলিশের আই.বি তে চাকরি নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে হলো ধীরাজকে। কিন্তু যেথায় মন দেয় না সায়, সেথায় গতি কি হয়? ব্রিটিশ শাসনের অধীন সেই শহরে স্বাধীনতাকামীদের ধরতে টিকটিকি হয়ে ঘোরা বিশেষ সম্মানের যে ছিল না। দেশীয় মানুষ এই সরকারি চাকরিকে ঘিন করতো। কিন্তু করার কিছু নেই। ঐ দৌড়ঝাঁপের পালায় না পেরে তাকে আই.বি এর টেলিফোন ডিউটি দিলো। শুরুতে তাতেও কেমন রকেট সাইন্স দেখছিল সে। S.S-1, S.S-2, S.S-3, 3 down 5 up 7 down করতে হিমশিম খাচ্ছিলো। সয়ে যেতে যেতে আবার কী এক ঝামেলা করে ফেললো। এই করেই জীবন যাচ্ছিলো। এরপর পুলিসের ট্রেনিং করে আসলে আশা ছিল কাছেই কোনো থানায় পোস্টিং হবে। কিন্তু কপাল মন্দ! পোস্টিং হলো সেই চট্টলায়। কিছুই করার নেই। ব্যাগ পত্তর নিয়ে ট্রেনে ছুট। সেখানে নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ আর চট্টগ্রামে যাওয়া নতুন মানুষের সবথেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ ভাষা এই নিয়ে দিন চলছিল। তবে ঐ যে, ❛ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে❜ একটা প্রবাদ আছে না, সেইটাই ভর করলো ধীরাজকে। সাহিত্যপ্রতিভা, সঙ্গীত দক্ষতা আর অভিনয়ের ক্যালমা এখানেও কিছু প্রদর্শন করতে গেলেন। খ্যাতিও পেলেন। কিন্তু বাঁধ পড়লো চট্টগ্রামে নতুন বিলেতি অফিসার এলে। গুন আর প্রতিভার ফলে মিস্টার মুলান্ড সাহেবের বাঁকা নজরে পরে গেলেন। কী এক ঘটনায় মুলান্ড সাহেব তাকে একেবারে বদলি করে দিলেন সুদূর টেকনাফ! ❛The penalty of being to smart❜ পেলেন যাকে বলে। চট্টগ্রামে অল্প দিনেই ভালো সম্পর্ক হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে আদ্র চোখে বিদেয় দিয়ে স্টিমার ধরলেন টেকনাফের। উত্তাল বঙ্গোপসাগরের পথে যেখানে স্টিমারে যেতে সময় লাগে আড়াই দিন! ছ'মাসে একবার মোটে যে জায়গায় স্টিমার আসে বাকি সময় বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ থাকে না। সেখানে পৌঁছে শুরুতে আরো বিড়ম্বনা। মগদের নিবাস টেকনাফ। চিং ছুং কী অদ্ভুত ভাষায় কথা বলে এরা যার এক বর্ণ বোঝার সাধ্যি নেই! ভীষণ অভিমান আর কষ্ট নিয়ে এখানেই থাকতে হবে তাকে। টেকনাফের থানার অদ্ভুত নিয়ম, এলাকাবাসীর দৈন্যতা দেখে অবাক না হয়ে উপায় ছিল না। নিজেদের আইন-ই এখানে স্বীকৃত। তার বাইরে কিছু করার মতো উপায় ধীরাজেরও ছিল না। খেয়ে পড়ে আর তুকতাক ডিউটি দিয়ে দিন চলছিল। কিন্তু এই বান্দা যেখানে সেখানে একটু নদীতে আলোড়ন হবে না কেমনে হয় এটা?
সাধারণ একদিনে অফিস থেকে তাদের কূপে দৃষ্টি পড়লো এক মোহনীয় রূপবতী নারীর দিকে। সে কী সুন্দর! কী সুন্দর! ধীরাজের তো চোখই সরে না। ওদিকে সেই রূপবতী কন্যাটিও চোখে চোখে চায়, আবেগে পানি তোলার কথা মনে থাকে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায় অনিন্দ্য সুন্দর এই কিশোরীর নাম মাথিন। এখানকার জমিদারের কন্যা। ধীরাজের জীবনে এলো প্রথম প্রেম। ❛চোখে চোখে কথা বলো, মুখে কিছু বলো না❜ স্টাইলে চাইতে চাইতেই ধীরাজ-মাথিনের বোবা প্রেম চলছিল। কথা কইতে যাবে কেমনে? মাথিন না বোঝে বাংলা, আর এদিকে ধীরাজ বোঝে না মগী ভাষা। তাও হরকি থেকে শুনে খাতায় লিখে নিয়েছে আর কথা শেষে একটা জোরে টান দিতে হবে তাও মনে রেখেছে। তবে এবার কি হবে প্রেমের পরিণতি? পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পর্কের আগে ডিউটি। ধীরাজকেও সে কাজ করতে ছুটতে হলো ম রিঅলায়। পরিচয় হলো মজিদ সাহেবের মতো অসম্ভব সুন্দর এক মানুষের সাথে। দুর্গম সে পথের অভিজ্ঞতা আর মানুষের রোষের ব্যবহার সব নিয়েই পাঁচদিনের কঠিন যাত্রা শেষে আবার টেকনাফে ফিরে আসে ধীরাজ। এরপর কী হয়েছিল? ধীরাজ নিজেকে কাপুরুষ মনে করে। জীবনের এই অধ্যায়ে এসে আজীবন লালিত স্বপ্ন পূরণের পথে এসেও ফেলে আসা কিছুদিনের স্মৃতি তাকে কাবু করে দেয়। মেরুদন্ডহীন ছিল তাই বলে কঠিন পদক্ষেপ নিতে পারেনি? কয়েকটা মানুষের জীবন তছনছ হওয়ার ফলে ধীরাজের স্বপ্নপূরণ তো কাপুরুষতারই শামিল নয় কি? কী জানি! পাঠক বুঝে নিবে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
❝যখন পুলিস ছিলাম❞ একটি আত্মজীবনীমূলক লেখা। একে আপনি চড়াই উৎরাইয়ে ভরা এক উপন্যাসও বলতে পারেন। ধীরাজ ভট্টাচার্য যে কি না পঞ্চাশের দশকের জনপ্রিয় তারকা তার লিখিত এই উপন্যাস। প্রথম জীবনে যিনি কলকাতা পুলিশে চাকরি করেছিলেন। এরপর নানা অভিজ্ঞতা আর টানাপোড়নে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পুনরায় পর্দার জীবন শুরু করেন। বইটি ১৯৩০ সালে লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়। এখানে ১৯২৩-১৯২৪ সালে লেখকের পুলিসে চাকরিরত অবস্থার ঘটনা লিখেছেন। স্মৃতিকাতর হয়েছেন, নিজেকে কাপুরুষ অ্যাখ্যা দিয়েছেন, সার্ভিসের ভালো-মন্দ দিক সরাসরি দেখেছেন। কিছুতে সায় দিয়েছেন, আবার কিছুতে মুখ বুজে থাকতে হয়েছে। ধীরাজ ভট্টাচার্য একজন অসামান্য সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। যেটা তার লেখায় স্পষ্ট। জীবনী পড়তে গিয়ে অনেকসময় মনে হয়েছে কোনো কাল্পনিক উপন্যাস পড়ছি। বাস্তব কল্পনার থেকেও বেশি বৈচিত্র্যময়, এটা লেখকের সার্ভিসে থাকাকালীন সময়ের ঘটনায় বোঝা যায়। কলকাতা আই.বি থেকে চট্টগ্রাম এবং টেকনাফের যাত্রায় কত ঘটনাবহুল ছিল যা আজ ইতিহাস হয়ে আছে সেসব ভাবলে কাল্পনিক উপাখ্যান মনে হয়। কিন্তু ঘটনাগুলো একেবারে সত্য। লেখক নিজেকে বইতে কোথাও রঙ চঙিয়ে উপস্থাপন করেননি, নিজেকে ভিকটিম হিসেবেও দেখাননি। বরং নিজের গীত গাওয়া থেকে নিজেকে কাপুরুষ রূপেই দেখিয়েছেন। পড়তে গিয়ে আমারও মনে হয়েছে, আরেকটু শক্ত ব্যাক্তিত্বের অধিকারী সে হতেই পারতেন। কিন্তু বাস্তবে নিজের চরিত্রকে সেভাবেই চালাতে হয় যেভাবে আশপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি চলছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের বড়ো জ্বালা। মন চাইলেও সব করা যায় না। সেটাই তো লেখকের সাথে হয়েছে। পুলিসের চাকরিতে এত হ্যাপা হওয়ার জন্য তার দুর্বল ব্যক্তিত্ব কতটা দায়ী? যেখানে মন থেকে সে এই পেশায় আসতেই চায়নি। মা-বাবার কথায় স্বপ্নকে চাপা দি���়ে গায়ে উর্দি লাগিয়েছে, সে পেশায় সফলতার ভাগ খুব বেশি হবে এমন আশা তো ফিকশনের চরিত্র থেকে করা যায়। সুন্দর ভাষায় লেখা জীবনীর একটা অংশ পড়তে আমার বেশ ভালোই লেগেছে। খারাপ লাগা যা ছিল সেসব লেখকের জীবনের মধ্যেই ছিল। চট্টগ্রামের ঘটনায় আমার কাছে মিসেস মুলান্ডের যেমন প্রভাব লেগেছিল তেমন ধীরাজও দায়ী ছিল। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। তবে বইয়ের সবথেকে সুন্দর এবং বেদনার অংশ টেকনাফ। প্রতিকূল পরিবেশের জীবন যেমন সুন্দর ছিল তেমন দাগ দিয়ে গেছে হৃদয়েও। ঐতিহাসিক ❛মাথিনের কূপ❜ আর ধীরাজ-মাথিনের করুণ প্রেমগাঁথার গল্প অনেকেই শুনেছি। সেই ধীরাজই যে এই ধীরাজ সেটা বই না পড়লে জানতাম না। টেকনাফে গেছি। অল্প সময়ের জন্য ছিলাম এই জায়গা সম্পর্কে শুনেছি। তখনও এত বিস্তারিত জানতাম না। বই পড়ে আর একটু ঘাটাঘাটি করে জানতে পারলাম। মাথিনের জন্য আমার কেমন লেগেছে বলে দিলে আমার মনে হয় স্পয়লার হয়ে যাবে যারা পড়েননি তাদের জন্য। লেখকের বাসায় বলতে হয়, লিখে বোঝানো সম্ভব না উপভোগ করতে হয়। এরপর ম রি অলার পথের সেই দুর্গম যাত্রা যা অ্যাডভেঞ্চার থেকে কোনো অংশেই কম ছিল না। সেখানে ঘটনা আমার সবথেকে ভালো লেগেছে। মজিদ সাহেবের চরিত্র, তার দয়াময় মূর্তি এই ব্যাপারগুলো দারুণ লেগেছে। প্রকৃতির বর্ণনা, পথের ক্লান্তিতে একরকম নেতিয়ে পড়া, পরিচিত মুখ দেখে আবেগের আতিশয্য সবকিছু মুগ্ধ করা ছিল। বই পড়তে গিয়ে আমার সবথেকে মজাদার আর লোভনীয় লেগেছে মুরগির মাংসের ঝোলের কথা। যতবার পড়েছি এর কথা ততবার জিভে জল এসেছে! মানুষের ভালো দিক, খারাপ দিক, বন্ধুত্বের মতো জাগতিক বিষয়গুলো আমরা বাস্তবে অনুভব করি, নিজের জীবনেও এমন হয়। তবে সে অভিজ্ঞতাগুলো কলমের খোঁচায় ইতিহাস করে রাখার দক্ষতা হয়তো সকলের নেই। যতীন, রাখলদা কিংবা মজিদের সাথে আর কোনোদিন লেখকের লেখা হয়েছিল কিনা জানি না। টেকনাফবাসী ধীরাজ নামক এই ব্যক্তিকে তখন কেমন চোখে দেখেছিল সেটা প্রায় একশ বছর বাদে আজকে আমি জানি না। শেষটায় লেখকের কেমন লেগেছিল বাস্তবে জানি না, তবে আমার খারাপ লেগেছে। হয়তো কোনো খারাপের পিছনেই ভালো থাকে। তাইতো আমরা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ধীরাজ নামক তারকা পেয়েছিলাম। মৃণালিনী, নৌকাডুবির মতো চলচ্চিত্র পেয়েছিলাম। বইটা পড়তে গিয়ে কখনো খুব হেসেছি, কোথাও খারাপ লেগেছে, কোথাও লেখকের সাথে সমব্যাথী হয়েছি। আবেগের পরিবর্তন বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়েছে। এটাই তো ভালো লেখা পড়ার সার্থকতা। লেখকের পুলিস জীবনের গল্প জানার পর লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনের ❛যখন নায়ক ছিলাম❜ অধ্যায় জানতে উদগ্রীব আমি। শীঘ্রই পরে ফেলবো।
প্রোডাকশন:
উপকথাকে আগেই বলেছি, ❛দামে কম মানে সেই❜। এই বইটিও তাদের সুন্দর প্রোডাকশনের আরেকটি নমুনা। বইটির প্রচ্ছদ আমার খুব খুব ভালো লেগেছে।
❛মাগো জাই ফলেয়ু মাগোঙা নিজ্জামে এ এ এ এ এ এ❜ শেষে কথাটা টান দিয়ে বলতে না ভুললেও, পুরো কথাটা কি বলা হলো?
আর হ্যাঁ, ওপারের পুলিস এপারে এসে পুলিশ হয়ে যায়। তাই ভুল নেই!
অনেক ছোটবেলায় টেকনাফে গিয়ে মাথিনের কূপ দেখেছিলাম। কূপের মুখে নীলের উপর সাদা রঙ দিয়ে লেখা ছিল । আমার একটা ছবিও আছে সে কুয়ার সামনে দাঁড়িয়ে। বইটা পড়ার ইচ্ছা ছিল অনেক ছোটবেলা থেকে কিন্তু কেন যেন হয়ে উঠেনি। শেষমেশ যখন পড়লাম আমি সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে ছিলাম বইটা শেষ করে। কি অসাধারন ভাবে লেখক সহজ স্বীকারোক্তি করেছেন বইটির পাতায় পাতায়। নিজের ভুল, দোষ ত্রুটি তুলে ধরেছেন। একই সাথে উঠে এসেছে তৎকালীন বাঙ্গালী ও মগ সমাজের চিত্র। মধ্য ত্রিশের দশকে টেকনাফ যে কি দুর্গম ছিল তা এখন আমরা চিন্তাও কোর্টে পারি না। চট্টগ্রাম থেকে চারদিন ষ্টীমারে !! সেখানকার সমাজব্যবস্থা এবং রীতিনীতির খুব সুন্দর বিবরন পাওয়া যায়। আরো জানা যায় দুর্নীতি তখনো কি প্রকট ভাবে পুলিশের মাঝে ছিল। সব মিলিয়ে অসাধারন একটা বই।
টেকনাফ এলাকায় নাকি মাথিনের কূপ অাছে। মনটা চাচ্ছে এক দৌঁড়ে সেখানে চলে যাই। এই মাত্র যে বইটা পড়লাম এক কথায় অসাধারণ। অাত্নজীবনী হলেও অনেক উচ্চ মানের সাহিত্য এটি। স্বদেশী অান্দোলন এর সময়কার এক পুলিশের জীবনের গল্প।
জীবন প্রবাহমান নদীর মতো, কখনও শান্তশিষ্টভাবে আপন গতিতে চলে কখনও বা ভরা জোয়ারে দুকূল ছাপিয়ে সবকিছু তছনছ করে দেয়। যখন পুলিস ছিলাম তেমনি এক প্রবাহমান জীবনের গল্প, লেখক ধীরাজ ভট্টাচার্যের পুলিসে থাকার সময়ের গল্প, যে গল্প প্রবাহিত হয়েছে আপন গতিতে। এ এমন এক গতি যে গতির কাছে মাঝে মাঝে আমাদের জলাঞ্জলি দিতে হয় আপন ইচ্ছেকে, কখনও বা বাঁধা পড়তে হয় সমাজ কিংবা পরিবারের অদৃশ্য শিকলে।
দেশে তখন স্বদেশী আন্দোলনের থমথমে অবস্থা, তখনই একদিন বন্ধুর সাথে বায়োস্কোপ দেখতে গিয়ে লেখকের জেদ চাপলো ছবিতে অভিনয় করবেন, সেই জেদের বসেই অনেক চেষ্টার পর সতীলক্ষ্মী সিনেমার এক বদমাশ চরিত্রে অভিনয়ও করে ফেললেন। আর তাতেই টনকনড়ে বাবার, আর তাই ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের এক বড়ো অফিসারকে ধরে ছেলেকে ঢুকিয়ে দেন আই বি তে।
অনেকদিন ধরে স্বদেশী আন্দোলনের চাইঁরাদের উপর নজরদারির কাজ করতে গিয়ে লেখক নানান গন্ডগোল পাকিয়ে বসেন সেখানে আর তাতেই তা থেকে এনে লেখককে বসিয়ে দেওয়া হয় টেলিফোন ডিউটিতে, সেখানেও লাগান ঝামেলা। একের পর এক ঝামেলায় পড়ে শেষে লেখককে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সারদার ট্রেনিঙে এএসআই এর জন্য, সেখান থেকে ট্রেনিং শেষে একেবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায়।
সেখানে হাসিখুশিতে বেশ ভালোই দিন কাটছিলো লেখকের, বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষীও জুটে গেছে অনেক। আর তারপরই এলেন লেখকের পুলিস জীবনের ভিলেন সিনিয়র অফিসার মুলান্ড, তারই রোষানলে পড়ে লেখককে এবার ছুটতে হলো সমুদ্র পথে আড়াই দিনের পথ টেকনাফে, একেবারে বাংলাদেশের শেষ সীমানা, খুব বেশি অপরাধ না করলে যেখানে কাউকে পাঠানো হয় না কোনো পুলিস অফিসারকে, তার উপর আবার সেখানকার বাসিন্দারা হলো মগ, তাদের ভাষা বুঝতেই আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাবে একেবারে।
অবশ্য টেকনাফে হাসি আনন্দে আরাম আয়েশে ভালোই দিন কাটছিলো লেখকের, সমস্যা বলতে কেবল উত্তাল সমুদ্রের জন্য বছরের অধিকাংশ সময়ই স্টিমার না থাকায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। আর এর মাঝেই একদিন থানার সামনের কূয়াতে পানি নিতে আসা এক মগ রাজকন্যার প্রেমে পড়লেন লেখক, যার জন্য রাতের ঘুম হলো হারাম। সামনের চৈত্রসংক্রান্তিতে যখন বিয়ের প্রস্তাবের দিবে বলে লেখক মনস্থির করলেন তখনই ঘটলো এক বিপত্তি।
নীলা থেকে বারো চৌদ্দ মাইল দূরে সমুদ্রের ধারে মারিআলা গ্রামে মুসলিমদের বসবাস, ঐ গ্রামের লোকেরা সমূদ্রের জল জ্বাল দিয়ে লবণ তৈরি করে বিক্রি করে হাটবারে। আর তাতেই সবকিছু ফেলে চৈত্রসংক্রান্তির আগেই ছুটতে হলো লেখককে, আর তাতেই হলেন স্বরণীয় এক ভ্রমণের সাক্ষী।
তারপর! সে এক দারুণ ভ্রমণ বৃত্তান্ত, এখান থেকেই আমার গল্পের প্রতি আকর্ষণ শুরু। যখন পুলিস ছিলাম বইটা যখন হাতে নিই, ভেবেছিলাম এমন এক পুলিস জীবনের গল্প প���়তে চলেছি যেখানে তখনকার সময়ের এক পুলিসের রোমাঞ্চকর পুলিস জীবনের গল্প পড়তে চলেছি, যেখানে থাকবে লেখকের পুলিস জীবনের নানান সব কেস স্ট্যাডি, অভিজ্ঞতা।
তবে এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বইটা জুড়ে এমন কেস ছিলো একটা। লেখকের প্রথম এবং শেষ কেস, তবে এই একটা কেসই লেখকের মনের স্মৃতিতে যেমন দাগ কেটেছে, কেটেছে আমারও। চট্টগ্রামের গহীন পাহাড়ী জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথচলার গল্প আর কেসের সমাপ্তি পড়ে অশ্রুসিক্ত হয়েছি, দুঃখ হয়েছে লেখকের জীবনের গল্প পড়ে। এর কিছু কিছু মুহূর্ত পড়ে আবার মুগ্ধও হয়েছি।
সমাজ আর পরিবারের শিকলের বন্দিত্বের কারণে লেখকের অমর প্রেমের পরিণতি পড়ে দুঃখবোধ হয়েছে অনেক, একটা সাধারণ প্রবাহমান জীবনের গল্পের এইরকম সমাপ্তি কখনই আশা করিনি, জীবনের গল্প বলেই হয়তো এমনটা সম্ভব হয়েছে। সবথেকে ভালো লেগেছে লেখকের সাবলীল গল্প বর্ণনা, এতোটা পরিপক্ব আর বিস্তারিত যে প্রতিটা ঘটনাই পড়ার সময় মনের আয়নায় সিনেমার মতো ভেসে উঠছিলো চিত্রগুলো।
তবে হ্যাঁ, পাঠক বইটা পড়ার সময় মাথায় রাখবেন, এ কোনো এমন পুলিসের গল্প নয় যে গল্প রোমাঞ্চকরে ভর্তি, এ এমন এক জীবনের প্রতিচ্ছবি যেখানে স্বপ্ন আছে, আশা আছে, আছে প্রেম বিচ্ছেদ বিরহ আর আছে রোমাঞ্চকর এক যাত্রার ভ্রমণকাহিনী। আর একদম শেষে আছে মনে দাগ কাঁটার মতো যখন পুলিস ছিলাম এর সমাপ্তি আর যখন নায়ক ছিলাম এর সূচনা।
বইটার উপকথা প্রকাশনীর প্রোডাকশন আমার কাছে দারুণ লেগেছে, বইটা হাতে নিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেছে। ১৯০ পৃষ্ঠার বইখানার প্রথম একশ, একশ ত্রিশ পৃষ্ঠা ধীরে সুস্থে পড়লেও পরের গল্প গুলো গিলেছি গোগ্রাসে, আর শেষে এসে খেয়েছি এক ধাক্কা। সেই সাথে অবাক হয়েছি লেখক নিজেকে নায়ক না ভাবায়, অকপটে নিজের অবস্থা স্বীকার করায়। অথচ অধিকাংশই নিজের গল্পে নিজেকে নায়ক হিসেবেই রাখবেন, দেখবেন সে দলে হয়তো আমিও থাকবো।
সারাজীবনে কখনো ভালো না বেসে থাকার চেয়ে, একবার ভালোবেসে তাকে হারানো উত্তম। -আগাস্টিনভ।
মানুষ জীবনে একবার হলেও ভালবাসে বা ভালবাসা উচিত। কে এই কথা বলেছেন আমি জানি না। তবে হয়ত সত্যি অথবা না। কারণ কারও জীবনে অনেক ভালবাসা থাকার পরও অনেকেই আছেন ভাবেন পূর্ণতা কোথায়। আবার কেউ কেউ কিছু না থেকেও যেন পূর্ণ হয়েছেন অল্প ভালবাসায়।
তাই মানুষের জীবনে ভালবাসার অবদান অনস্বীকার্য বলা যায়। মানুষের অপূর্ণতা তখনই থাকে যখন সেই ভালবাসা তার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। সে তার পূর্ণতা আর খুজে পায় না। হয়ত এটাই নিয়তি। আর জীবনে নিয়তির কাছে সবাই অসহায়। কিন্তু এসব বলছি কেন। বইয়ের কথা বলার জায়গাতে ভালবাসার কথা বলে চলেছি। তার পেছনেও একটি রহস্য আছে। একটি বইয়ের কথা বলছি এবং বইটি হচ্ছে ধীরাজ ভট্টাচার্যের লেখা “যখন পুলিশ ছিলাম”। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে বইয়ের নামের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক কোথায়।
যদিও এই বইটি ধীরাজ ভট্টাচার্যের পুলিশে থাকা অবস্থায় তার জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। সেখানে তিনি তার কাজের এবং দৈনন্দিন সব কিছু উল্লেখ করে গিয়েছেন। এর সাথে তার ভালবাসার উপাখ্যানও রচনা করেছেন। মুল কাহিনীতে যাবার আগে লেখকের সম্পর্কে কিছু জানা যাক। ধীরাজ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯০৫ সালে, যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা ললিতমোহন ভট্টাচার্য ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ ও স্কুল শিক্ষক। নিজ গ্রাম পাঁজিয়ার স্কুলে শৈশবশিক্ষা শেষে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিশন থেকে ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি।
এরপর আশুতোষ কলেজে পড়ার সময় সিনেমার প্রতি প্রবল অনুরাগ জন্মে তাঁর যা তাঁকে কলেজ শেষ করতে দেয় নি। কিন্তু চলচ্চিত্রের প্রতি এই অনুরাগ তাঁর পরিবার নাকচ করে দেন। ফলে চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন পেছনে ঠেলে বাবার আদেশে তাঁকে ভর্তি হতে হয় কলকাতা পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে।
সিনেমার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকলে পরিবারের কথা চিন্তা করে তিনি যোগদেন পুলিশের ইন্টিলিজেন্স। এরপর শুরু হয় পুলিশে টিকে থাকার লড়াই। দিন যতই গড়ায় তার ছিটেফোটা যেন হারিয়ে যায়। এই চাকরি যায় তো যায়। অবশেষে একদিনের ঘটনা অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়। তাই তাকে বদলি করে দেয়া হয় চট্টগ্রাম। এটি ১৯২৩-১৯২৪ সালের দিকের ঘটনা। আমি পুরোটা বলব না, তাহলে বই পড়ার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম এসেও শান্তি নেই। কারণ মানুষ তিনি বেশি আবেগ প্রবণ। তাই সকলের কাছে আপন হলেও কারও কারও শত্রুও হয়েছেন। আবারও সেখান থেকে তাকে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এ বদলি করা হয়। এখানে জানিয়ে রাখি সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভাল ছিল না। টেকনাফ যেতে হত স্টিমারে এবং তাও প্রায় আড়াই দিনের মত সময় লাগত। এছাড়া সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিতে হত।
লেখক তার সব কিছুর বর্ণনায় হুবহু সেটা তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি কক্সবাজার ও টেকনাফে অবস্থিত “মগ” দের আচার আচরণ, কৃষ্টি-কালচার, জীবন বৈচিত্র্যের সব কিছু তুলে ধরেছেন। এছাড়া অপরাধী ধরার জন্য চার পাচ দিন জঙ্গলের যাত্রা পাঠককে রোমাঞ্চিত করতে বাধ্য করবে। দুর্গম পথ ও গরিব লবণ চাষীদের প্রতি ব্যবহার আপনাকেও ভাবিয়ে তুলবে মানুষ স্বার্থের জন্য কতটা নিচে নামতে পারে সেটা সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন।
ধীরাজ ভট্টাচার্যের জীবনের পরিবর্তন আসে এই টেকনাফেই। তার জীবন পরিবর্তন করে দেয় মগ জমিদার কন্যা “মাথিন”।
থানার কূপ থেকে প্রতিদিন সখীবেষ্টিত হয়ে জল সংগ্রহে আসত কিশোরী মাথিন। সময়ের সাথে সাথে ধীরাজের হৃদয়ে স্থান দখল করে ফেলে সেই সুদর্শনা। দুজনের মুখের ভাষা ভিন্ন হলেও চোখের ভাষায় তারা নিজেদের কাছে টেনে নেন। এক পর্যা য়ে, জাতপাত-ধর্ম-বয়স-পেশা ভুলে ধীরাজ মাথিনের সাথে বিবাহ বন্ধনের দিন-তারিখ-ক্ষণ ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিচ্ছেদ বেদনায় পুড়তে হয় এই প্রেমীযুগলকে।
কক্সবাজার জেলার শেষ সীমান্তে টেকনাফ থানার কম্পাউন্ডে অবস্থিত শত বছরের পুরনো বিশুদ্ধ পানির ‘মাথিনের কূপ’ ধীরাজ-মাথিনের সেই যুগপৎ প্রেম ও বিরহের নিদর্শন হিসেবে আজও দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে আছে। কেন ‘মাথিনের কূপ” আজও এত জনপ্রিয় নিদর্শন? ধীরাজ-মাথিনের বিচ্ছেদের কারণ কী? কে, কারা কেন ধীরাজ-মাথিনের বিচ্ছেদের পিছনে দায়ী ছিল? মাথিনের পরিণতি কী হয়েছিল? ধীরাজই বা শেষ পর্যন্ত কী করলেন? কেন করলেন? অনেক প্রশ্ন তবে উত্তর আছে “যখন পুলিশ ছিলাম” বইটিতে। উত্তর গুলো জানতে এই বইটি পড়তে হবে। আশা করছি বইটি সবার ভাল লাগবে।
আরো প্রায় একযুগ আগের কথা, ঘরে তখন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকা আজাদী আসতো। ঐ আজাদী মারফত জেনেছিলাম মাথিনের কূপ ও তা নিয়ে জড়িয়ে থাকা গল্পটি। বারো বছর পর পড়া হলো সেই গল্পের নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্যের আত্মজৈবনিক "যখন পুলিশ ছিলাম"।
লেখার উপক্রমণিকার সাথে অনেক বইপোকা নিজের মিল পাবেন। একাডেমিক বইয়ের মাঝে লুকিয়ে থ্রিলার পড়তে গিয়ে ধরা পড়ার নিতান্ত পারিবারিক ছবি এঁকে এই আত্মজৈবনিকের সূচনা করেছেন লেখক৷ লেখকের যদিও ঝোঁক ছিল অভিনয়ের তবে তখনো বাঙালি তথাকথিত ভদ্র সমাজ অভিনয়কে ভালো চোখে দেখতো না। তাই ছে���ের ডানাছাটার উপায় হিসেবে ঢুকিয়ে দেয়া হলো আই.বি (ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ) তে, এদের প্রধান কাজ ছিল স্বদেশীদের ওপর নজর রাখা। গোয়েন্দা উপন্যাস পড়া আর টিকটিকিগিরি করার পার্থক্য বিস্তর। আইবিতে প্রথম সবক'টা এসাইনমেন্টে ফেল করার পর ধীরাজবাবুকে পাঠানো হলো সারদা পুলিশ একাডেমিতে। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে এএসআই হিসেবে পাঠানো হলো এক ছোট্ট পাহাড়ি শহরে, নাম চট্টগ্রাম।
১৯২৩ এর দিকে কলকাতা থেকে আসা এক যুবকের কাছে চট্টগ্রাম মফস্বল ই বোধ হওয়ার কথা। কিন্তু ধীরাজবাবু মুগ্ধ হোন চট্টগ্রামে। তার ভাষায়, "প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এতো ছোট অথচ এতো সুন্দর শহর আর বাংলাদেশে আছে কিনা জানা নেই।" অবশ্য এখানেও ভাগ্য বিরুপ। পুলিশের তদানিন্তন বড়কর্তা মুলাণ্ডের বিরাগভাজন হওয়ায় তাকে শাস্তিমূলক বদলি দেওয়া হয় টেকনাফ। টেকনাফ তখন পাণ্ডববর্জিত ভীষণ এলাকা। চট্টগ্রাম থেকে যেতে সময় লাগতো ২.৫ দিন, তাও বছরে স্রেফ ৫ মাস। কলকাতা থেকে চিঠি আসতো ১৫ দিনে, টেলিগ্রাম ৭ দিনে। আদিবাসী বেশিরভাগই অশিক্ষিত বার্মিজ (লেখকের ভাষায় মগ), মগের মুল্লুক যাকে বলে। জিনিসপত্রের দাম একদমই সস্তা। নিকটস্থ কোর্ট কক্সবাজারে আসামী চালান করতে চারদিনের হাঁটাপথ। তাই থানার অফিসাররা টাকাপয়সা নিয়ে মামলা চাপা দেয়ার চর্চায় মত্ত। লেখকের সুদীর্ঘ স্মৃতিচারণে ফুটে উঠেছে সেসময়কার টেকনাফ আর বার্মিজদের জীবন ও সংস্কৃতি। সেসময় থানা চত্বরে থাকা এক কূপই সুপেয় পানির একমাত্র উৎস। পানি নিতে আসা এক বার্মিজ জমিদার কন্যা মাথিনের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক হয় লেখকের। বিয়ের ঠিক দুইদিন আগে চাকরির খাতিরে হ্নীলা হয়ে মরিআলা নামের এলাকায় রওনা হতে হয় লেখকে। টেকনাফ থেকে স্টিমারে মংডু (মায়ানমার), উখিয়া হয়ে হ্নীলায়, সেখান থেকে দুর্গম ও শ্বাপদসংকুল চট্টগ্রাম হিলস পেরিয়ে ৬০ কিলো পেরিয়ে মরিআলা। এই চার রাতের অভিযান বইয়ের সুন্দরতম অংশের একটি। লেখক অভিযান শেষে পিতার কাছ থেকে পান আরো একটি চরমপত্র। সেসময়ে বাঙালির ঘরে বার্মিজ বউ না মেনে নেওয়ায় স্বাভাবিক, আবার বার্মিজদের কাছে বিয়ের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে যাওয়ার একটাই বিধান মৃত্যু। শেষ পর্যন্ত কি সমাধান নিলেন লেখক তা না হয় ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্যই উহ্য থাকুক!
বইটির জন্য প্রথম ধন্যবাদ প্রাপ্য "দেশ" পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের। তাঁর পত্রিকায় লেখাটি প্রথম ছাপা হয়। বাংলাদেশ থেকে বইটি এসেছে স্কাই পাবলিশার্স এর ব্যানারে। তবে স্কাইয়ের প্রুফ রিডিং জঘন্য, মুদ্রন প্রমাদ অসংখ্য। এবার আসা যাক বইটির ব্যাপারে, খুব চিত্ররুপময় বর্ণনা না হলেও ছিমছাম মেদহীন লেখা পাঠককে আকর্ষণ করবেই। একই লেখায় আনন্দ, বিষাদ, প্রেম, রোমাঞ্চ সবই জায়গা পেয়েছে। একটা ভালো বই পড়েও রেগেমেগে চোস্ত গালিগালাজ করার সুযোগই বা কয়টা বই এনে দেয়??