আধুনিকতা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে গভীর ও বিশ্লেষণাত্মক পাঠ-আলোচনার সূচনা ঘটেছে, আবু সয়ীদ আইয়ুবের আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৮) সেই আলোচনার এক অনন্য মাইলফলক। একে নিছক কোনও রবীন্দ্রপাঠের গ্রন্থ বলে ধরলে ভুল হবে; বরং এটি এক বহুমাত্রিক বৌদ্ধিক প্রকল্প—যেখানে সাহিত্যতত্ত্ব, দর্শন ও মনস্তত্ত্ব মিলেমিশে তৈরি করেছে এক সূক্ষ্ম আলোচনার জাল।
আসলে এই গ্রন্থটি বাংলা কবিতার পাঠপ্রথাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এক নতুন পাঠ-প্রেক্ষাপট নির্মাণ করে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতার আধুনিকতাবোধ, তার অন্তর্নিহিত ‘sense of evil’, এবং অস্তিত্বের অন্ধকারতম দিকগুলি মুখ্য হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় রবীন্দ্রনাথেরই সেই বিখ্যাত স্বীকারোক্তি:
“আমি বিশ্বাস করি, কবির কর্তব্য কেবল আলো দেখানো নয়, অন্ধকারকেও স্বীকার করা।” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আবু সয়ীদ আইয়ুব এই আলো-অন্ধকার দ্বৈততার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্র-কবিতায় যে দার্শনিক জিজ্ঞাসা, মানসিক দ্বন্দ্ব ও নৈতিক জটিলতা—তা উন্মোচনের চেষ্টা করেন। তাঁর বিশ্লেষণে ‘আধুনিকতা’ একেবারে ইউরোপীয় বোধ থেকে উঠে এলেও, তার বাংলা প্রয়োগ একান্তভাবেই স্থানিক, সাংস্কৃতিক এবং অস্তিত্বগত।
এই সূত্রে বলা যায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব যে “modernity”–র পাঠ সামনে আনছেন, তা নিছক প্রযুক্তি-নির্ভর পরিবর্তন বা পশ্চিমী অনুকরণ নয়, বরং:
"Modernity is the consciousness of being modern." — Marshall Berman
এই চেতনার মধ্যেই কবিতা, দর্শন, এবং সমাজবোধের এক ত্রিমাত্রিক যোগসূত্র গড়ে ওঠে। তাঁর বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেন চলে আসে Nietzsche-র "Abyss"–এর কাছে, বা Rilke-র সেই “terrible angel”–এর মুখোমুখি।
আবু সয়ীদ আইয়ুবের পাঠাভিজ্ঞতা এই ধারণাকেই দৃঢ় করে যে, বাংলা আধুনিকতা কেবল Jibanananda-র বা Sudhindranath-এর হাত ধরে আসেনি, তার গভীরতম বীজ নিহিত ছিল রবীন্দ্র-কবিতার মধ্যেই। তাঁর লেখায় যেন প্রতিধ্বনিত হয় Rigveda–র সেই আদিম প্রশ্ন:
"কুত আ আসীত? কস্য শর্মন?" — (ঋগ্বেদ) (“কে জানে, কোথা থেকে এসেছে এই সত্তা? কারই বা আশ্রয়ে?”)
এই প্রাথমিক অস্তিত্বজিজ্ঞাসা-ই তো আধুনিকতার কেন্দ্রীয় সুর, যার প্রতি রবীন্দ্রনাথের কবিতা অগোচরে হেঁটে গিয়েছে, আর আবু সয়ীদ আইয়ুব সেই পথচলাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।
সুতরাং, আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ কেবল একটি বই নয়; এটি বাংলা সাহিত্যে একটি বৌদ্ধিক যুগান্তরের দলিল। পাঠক যখন এই গ্রন্থে প্রবেশ করেন, তখন তিনি শুধু রবীন্দ্রনাথকে নয়, নিজের সময়, সমাজ, ও আত্মসত্তাকেও নতুন চোখে দেখতে শেখেন। এই পাঠ একরকম আত্ম-উন্মোচনের পর্ব—যেখানে "আলো", "অন্ধকার", এবং "সত্য" কেবল শব্দ নয়, তারা জীবনেরই নতুন ব্যাখ্যা।
আবু সয়ীদ আইয়ুবের আলোচনার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, আধুনিকতার ধারণাকে তিনি কেবল ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ধারা বা সাহিত্য আন্দোলনের নিরিখে দেখেননি। বরং তিনি এর গতিশীলতা, সাংস্কৃতিক পার্থক্য, এবং বহুস্তরীয় ব্যঞ্জনাকে চিহ্নিত করার প্রয়াসে ছিলেন এক অনন্য প্রজ্ঞাবান পাঠক। তাঁর আধুনিকতা-চিন্তা এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়ায়, যেখানে ইউরোপীয় অভিধান শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, চ্যালেঞ্জের মুখে।
পশ্চিমে আধুনিকতা যে Renaissance ও Enlightenment-এর হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে, তা শুরুতে ছিল মানবমুক্তি, যুক্তিবাদ এবং বৈজ্ঞানিক মননের এক আশাবাদী যাত্রা। ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত ঘোষণাই যেন এই বয়ানের প্রতিনিধিত্ব করে: “Let us enlighten men... and liberty will follow as the shadow follows the body.”
তবে এই অগ্রগতিবাদ—যা progressivism নামে আত্মপরিচিত— বিংশ শতকের প্রথমার্ধে দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় ভীষণভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। এক সময় যে reason ছিল মুক্তির হাতিয়ার, সেই যুক্তিবাদই এক পর্যায়ে হয়ে ওঠে যুদ্ধ ও সহিংসতার প্রযুক্তিগত সহায়ক। এই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে মানুষ যখন নিজেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করে, তখনই জন্ম নেয় এক নবধারার সাহিত্যিক ও দার্শনিক চেতনা—‘আধুনিকবাদ’ বা Modernism।
এই নতুন আধুনিকতা ছিল আত্মবিশ্বাসহীন, বিভ্রান্ত, ভাঙনের দিকে ঝুঁকে পড়া। কবিতায় তার প্রকাশ ঘটে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, গভীর নৈরাশ্য, অস্তিত্বজিজ্ঞাসা ও জটিল প্রতীকের আশ্রয়ে।
“Things fall apart; the centre cannot hold; Mere anarchy is loosed upon the world.” — W. B. Yeats, “The Second Coming”
আবু সয়ীদ আইয়ুব এই পটভূমিকে বিবেচনায় রেখে আধুনিকতাকে বুঝতে চেয়েছেন একটি বিশ্লেষণাত্মক কাঠামোর ভেতর থেকে—not just as a time-bound label, but as a fluid philosophical orientation. তিনি বোঝেন, বাংলা সাহিত্যজগতে ‘আধুনিকতা’ পশ্চিমী ইতিহাসের প্রতিলিপি নয়; এটি এক সাংস্কৃতিক পুনর্ব্যাখ্যা—যেখানে রবীন্দ্রনাথের মতো কবির কাজ পশ্চিমের existential modernism–এর সঙ্গে এক অনন্য তুলনামূলক আলোচনার সুযোগ তৈরি করে।
এখানে আইয়ুবের বিশ্লেষণে ফুটে ওঠে সেই অন্তর্দৃষ্টি, যা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় খুঁজে পায় নৈঃশব্দ্য, সংশয়, এবং এক ‘sense of evil’—যা কেবল নৈতিক নয়, অস্তিত্বগত। আধুনিকতাকে তিনি দেখেছেন Friedrich Nietzsche–র “God is dead” উচ্চারণ এবং T. S. Eliot–এর “Waste Land”–এর মধ্যবর্তী শূন্যতা হিসেবে নয়, বরং এক সৃষ্টিশীল উদ্বেগ হিসেবে:
“আধুনিকতা এক জাগতিক উদ্বেগ—নতুনকে আবিষ্কারের, পুরাতনকে অতিক্রম করার, এবং মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করার।” — আবু সয়ীদ আইয়ুব
এই প্রেক্ষাপটে আধুনিকতা হয়ে দাঁড়ায় simultaneously প্রশ্ন ও উত্তর, ভাঙন ও নির্মাণ। এবং বাংলা সাহিত্যে তার আলোচনার সূত্রপাত ঘটে এই বইয়ের হাত ধরে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ শুধুই আলো-ছায়ার কবি নন, বরং একজন গভীরভাবে সচেতন আত্মবিশ্লেষকের ভূমিকায় আবির্ভূত।
আধুনিক ইউরোপীয় কবিতার যে অনিবার্য সুর—অস্থিরতা, আত্মবিরোধ, এবং নৈতিক সংকট—তা ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার থেকে শুরু করে টি. এস. এলিয়ট এবং ডব্লিউ. বি. ইয়েটস–এর কবিতায় এক গভীর প্রতিধ্বনির জন্ম দেয়। বোদলেয়ারের Les Fleurs du Mal (The Flowers of Evil)-এ যেমন শিল্পের গঠনরীতির মধ্যেই উঠে আসে এক “diabolical beauty”—তেমনি এলিয়টের The Waste Land বা ইয়েটসের The Second Coming আমাদের সামনে দাঁড় করায় এক অন্তর্জগতের ভাঙন ও মূল্যবোধগত শূন্যতা।
"I have cultivated my hysteria with pleasure and terror." — Baudelaire
এই আত্মচেতনার বিক্ষিপ্ত, ক্ষতবিক্ষত ভূমিতে দাঁড়িয়েই আবু সয়ীদ আইয়ুব খুঁজে পান এক গূঢ় সাযুজ্য: বোদলেয়ারের sense of evil এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতায় অন্বিত ‘অমঙ্গলবোধ’। যদিও রবীন্দ্রনাথের ভাবভাবনার আধার অনেকাংশে ভারতীয় দর্শনের আলোকসম্পাত, তবু আইয়ুব দেখান, তাঁর কবিতায় যে অসহায়তা, দুঃস্বপ্ন, ও সত্তার সংকট—তা কেবল আলোকরশ্মি নয়, বরং ছায়ারও অনুষঙ্গ বহন করে।
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং লিখছেন: “আমার জীবনের গভীরতম স্তরে আছে এক ‘অনিবার্য বেদনা’, যে বেদনার মধ্যে দিয়েই আমি আমার আনন্দকেও উপলব্ধি করি।”
এই স্বীকারোক্তির মধ্যে রয়েছে সেই অমঙ্গলচেতনার নিরাভরণ প্রকাশ—যা ইউরোপীয় আধুনিকতায় ‘evil’, ‘crisis’, ‘fragmentation’ নামে প্রতিফলিত হলেও, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় তা হয় মরমী, দর্শননির্ভর এবং অন্তরতম।
আবু সয়ীদ আইয়ুব বোদলেয়ারের কবিতায় যে spleen বা বিষণ্ন মেদুরতার ছাপ দেখেন, সেটিই রবীন্দ্রনাথের কবিতায় রূপ নেয় আত্মানুসন্ধানের এক জার্নি হিসেবে।
"The poet is like the prince of the clouds Who haunts the tempest and laughs at the archer." — Baudelaire, “L’Albatros”
এই "storm-haunting" কবিস্বভাবটি যেন রবীন্দ্রনাথের "শেষের কবিতা"–র বা "গীতাঞ্জলি"–র সেই কবিকেই মনে করিয়ে দেয়, যিনি মেঘ দেখে তবুও গহন গানে ডুবে থাকেন।
আসলে, আইয়ুবের অনবদ্যতা এখানেই—তিনি বোদলেয়ারের ‘নরকের ফুল’-এর পাশেই স্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথের ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’, এবং এই বিপরীতমুখী বাণীর মধ্যেও খুঁজে পান এক অন্তর্লীন সংলাপ। বাংলা আধুনিকতার জন্য এটি এক অনিবার্য পাঠ, কারণ তাতেই স্পষ্ট হয়:
১) আধুনিকতা কেবল পশ্চিমের নৈরাশ্য নয়,
২) তা পূর্বের অস্তিত্ববোধ ও আত্মজিজ্ঞাসারও একটি সৃজনশীল রূপান্তর।
রবীন্দ্রনাথ আধুনিক কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায়। তিনি তথাকথিত ইউরোপীয় মডার্নিস্টদের অনুকরণে আধুনিক নন। তাঁর আধুনিকতা— নাৎসি বাহিনীর ট্যাঙ্কের শব্দে, নগরায়নের ধোঁয়ায়, কিংবা ঈশ্বরশূন্য ব্রহ্মাণ্ডে আত্মবিচ্ছিন্ন মানবমনের চিৎকারে গড়া নয়। বরং তা এক গভীর আত্মসন্ধান, এক নিরন্তর মানবিক ও দার্শনিক প্রশ্নের দিকে অগ্রসর যাত্রা—যার সঙ্গে হোমার কিংবা উপনিষদের প্রতিধ্বনি মিলে যায়।
আবু সয়ীদ আইয়ুব এই ভিন্নতাটিই গুরুত্ব সহকারে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর বিশ্লেষণে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেমন ‘অমঙ্গল’ বা জগতের কদর্যতা, মৃত্যুভয়, দুঃখ ও নিঃসঙ্গতার স্বীকৃতি আছে, তেমনই আছে সেই অন্ধকারকে অতিক্রম করার এক আন্তরিক ও সূক্ষ্ম অভীপ্সা।
সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে তিনি লিখছেন: "যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে এই নিঃসহায় দেশ বঞ্চিত। অথচ চক্ষের সামনে দেখলুম জাপান যন্ত্রচালনার যোগে দেখতে দেখতে সর্বতোভাবে কিরকম সম্পদবান হয়ে উঠল। সেই জাপানের সমৃদ্ধি আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি, দেখেছি সেখানে স্বজাতির মধ্যে তার সভ্য শাসনের রূপ। আর দেখেছি রাশিয়ার মস্কাও নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের আরোগ্যবিস্তারের কী অসামান্য অকৃপণ অধ্যবসায়-- সেই অধ্যবসায়ের প্রভাবে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের মূর্খতা ও দৈন্য ও আত্মাবমাননা অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। এই সভ্যতা জাতিবিচার করে নি, বিশুদ্ধ মানবসম্বন্ধের প্রভাব সর্বত্র বিস্তার করেছে। তার দ্রুত এবং আশ্চর্য পরিণতি দেখে একই কালে ঈর্ষা এবং আনন্দ অনুভব করেছি।"
এই অংশের মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রচিন্তার আধুনিকতার হৃদস্পন্দন: অন্ধকারের স্বীকৃতি, কিন্তু নৈরাশ্য নয়; ব্যথার উপলব্ধি, কিন্তু নিষ্পৃহতা নয়। এখানেই তাঁর আধুনিকতা ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের চেয়ে ভিন্নতর—a modernity of transcendence rather than disillusionment।
বোদলেয়ার উনিশ শতকের ইউরোপীয় আধুনিকতার অন্যতম দিকপাল, যিনি Les Fleurs du Mal–এ অসুন্দর, বিকারগ্রস্ত, নিষিদ্ধ ও কদর্য বিষয়াবলিকে শিল্পের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন decadent aesthetics–এর একজন পথপ্রদর্শক, যেখানে ব্যভিচার, রোগ, মৃত্যুকামিতা এমনভাবে চিত্রিত হয়েছে যে তা হয়ে উঠেছে একধরনের celebration of the grotesque—অসুন্দরের মহোৎসব।
বোদলেয়ারের ভাবনায় আমরা পাই এক shock of beauty, যেখানে জগতের কাদা, দুর্গন্ধ, এবং অন্ধকারই কবির কাব্য-সাম্রাজ্যের ধন। এই কাব্যভাষা বিযুক্ত, বিদ্রোহী ও চমকপ্রদ—এটি পাঠককে জাগিয়ে তোলে কিন্তু সান্ত্বনা দেয় না।
অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "অমঙ্গলবোধ" একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির—তা গভীরভাবে নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক। আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর কবিতায় যেভাবে এই বোধের পাঠ বিশ্লেষণ করেছেন, তাতে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের কাছে কবিতা হচ্ছে কেবল এক কাব্যিক অনুধ্যান নয়, বরং উত্তরণের পথ। তাঁর কবিতায় অন্ধকারের স্বীকৃতি থাকলেও, সেই অন্ধকারের মোহে ডুবে যাওয়ার বদলে থাকে তা পার করে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা—এক ধরনের moral transcendence।
তিনি বলেন:
অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো সেই তো তোমার আলো! সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো সেই তো তোমার ভালো ॥ পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যেই গেহ সেই তো তোমার গেহ।
এই যে "উদ্ভাসিত জ্যোতির রেখা", তা বোদলেয়ারের "mud-turned-gold" থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বোদলেয়ার যেখানে অসুন্দরকে সুশোভিত করেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে অমঙ্গলকে অনতিক্রম্য সত্য হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তাকে অতিক্রম করার দায় কাঁধে তুলে নেন।
এই পার্থক্যটি শুধু দৃষ্টিভঙ্গির নয়, তা নান্দনিক ও আত্মিক বোধেরও পার্থক্য। বোদলেয়ার একজন dandy-flâneur—শহরের কুয়াশায় হাঁটে, বিষণ্নতায় ডুবে থাকে, নৈতিক দ্বন্দ্বকে সজ্জা করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ সেই বিপরীতে একজন আত্মশিল্পী, যিনি মনের অন্ধকার গহ্বরেও জ্বালাতে চান আলো, এবং জীবনকে দেখেন প্রবাহমান এক সাধনার পথ হিসেবে।
আইয়ুব অত্যন্ত সজাগভাবে বোদলেয়ার ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আধুনিকতাবোধের এক মৌলিক বৈপরীত্য চিহ্নিত করেন। তাঁর পাঠে, বোদলেয়ারের sense of evil—একদিকে জগতের বিকৃতি, হতাশা ও অস্থিরতার অনুরণন, অন্যদিকে তা যেন এক ironical embrace–এ পরিণত হয়, যেখানে জীবনের দুঃস্বপ্ন ও কদর্যতা এক বিষণ্ন উৎসবের রূপ ধারণ করে।
বোদলেয়ারের জগৎ একধরনের শয়তানরচিত খেলাঘর, যেখানে সৌন্দর্য নেই, আছে তার বিকৃত প্রতিবিম্ব। যেমন তিনি বলেন— "Hypocrite reader—my twin, my brother!" — Baudelaire, Preface to Les Fleurs du Mal
এখানে কবির sense of evil ব্যক্তি, সমাজ ও ঈশ্বর–তিনটির প্রতিই অবিশ্বাস, অনাস্থা এবং এক ধরনের সাংস্কৃতিক ক্লান্তি থেকে জন্ম নেয়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে sense of dread, তাকে আইয়ুব দেখেন এক সম্পূর্ণ ভিন্ন, অনেক গভীরতর আধ্যাত্মিক সুরের প্রকাশ হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ অমঙ্গলকে অস্বীকার করেন না, বরং তার সত্ত্বা স্বীকার করে নিয়ে তাকেই এক অন্তর্জাগতিক উত্তরণের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন:
ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে ॥ দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে, জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে ॥ আমার ইচ্ছা হইতে, প্রভু, তোমার ইচ্ছামাঝে-- আমার স্বার্থ হইতে, প্রভু, তব মঙ্গলকাজে-- অনেক হইতে একের ডোরে, সুখদুখ হতে শান্তিক্রোড়ে-- আমা হতে, নাথ, তোমাতে মোরে নূতন জনম দাও হে ॥
এই "তুমি" ঈশ্বর বা cosmic companion হোন, কিংবা আত্মার অন্তরতম আশ্রয়—এ একধরনের বিশ্বাস, যা আধুনিকতার ক্লেদ ও খণ্ডচেতনার মাঝেও জ্যোতির রেখা হয়ে ওঠে। তাই বোদলেয়ারের মতো নয়, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় অমঙ্গল এক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পরীক্ষার ক্ষেত্র, যা পাঠককে শূন্যতায় নয়, দায়িত্বে আহ্বান জানায়।
এখানেই আইয়ুবের মস্ত বড় বক্তব্য: এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই রবীন্দ্রনাথকে ইউরোপীয় আধুনিকতার reactionary despair থেকে আলাদা করে, স্থাপন করে এক "alternative modernity"–র মডেল হিসেবে—যার ভিত্তি:
১) Indic sensibility: জীবন ও জগৎকে এক অনির্বচনীয় সমগ্র হিসেবে দেখা, যেখানে দ্বন্দ্বও সমাহিত হয় বৃহত্তর সত্যে।
২) Ethical inquiry: নৈতিক দ্বিধা ও প্রশ্ন, যা আত্মা ও সমাজ—উভয়ের চেতনা জাগিয়ে তোলে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা হয়ে ওঠে constructive, inclusive, এবং emotionally resilient—এক বিরল ধারা, যা পাশ্চাত্যের ভাঙনমুখী আধুনিকতার ঠিক উল্টো মেরুতে অবস্থান করে। তাই তিনি শুধু আধুনিক নন—তিনি মৌলিক আধুনিক, মরমী আধুনিক, এক decolonized vision of modernism–এর পথপ্রদর্শক।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার সময়চেতনা অতীত বা বর্তমানের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর পঙ্ক্তিতে, পাঠক একাধারে সময়ের গভীরে প্রোথিত অনুভব খুঁজে পান, আবার ভবিষ্যতের সম্ভাবনার এক ঈষৎ ঝিলিকও অনুভব করেন।
তিনি বলেন:
প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নূতন আবির্ভাবে-- কে তুমি, মেলে নি উত্তর। বৎসর বৎসর চলে গেল, দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-- কে তুমি, পেল না উত্তর।
এই ধূপ, এই ধ্যান, এই উন্মনা চেতনাই রবীন্দ্রনাথকে করে তোলে আধুনিক—তবে তিনি সেই আধুনিক কবি, যিনি নিজেকে কখনওই ইউরোপীয় avant-garde আন্দোলনের সরল পরিসরে ফেলে দেন না। তিনি গড়ে তোলেন এক alternative avant-garde, যার ভাষা ধ্বংসের নয়, আত্মবিকাশের; যার কাব্য অলঙ্কারবর্জিত, কিন্তু অন্তরসারভিত্তিক।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় জগতের ক্লান্তি ও ক্লেদকে শুধু চিহ্নিত করেন না, বরং সেগুলিকে এক আলোকময় নৈতিক পরিশুদ্ধির সুযোগ হিসেবে দেখেন। এ যেন জীবন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আত্মাকে প্রস্ফুটিত করে তোলার এক মরমি সাধনা। তাঁর এই অনন্য দৃষ্টিকোণ তাঁকে স্থাপন করে এক ভিন্ন আধুনিকতাবোধের ধারক হিসেবে—যেখানে আধুনিকতা মানে কেবল বোধগম্যতার ভাঙন বা নৈরাশ্য নয়, বরং এক গভীর আত্মসন্ধান, নৈতিক বিবেচনা ও অন্তর���েতনার উন্মোচন।
কবি বলেন,
দেহমনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে, গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে ॥ আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে, দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে। বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা-- জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনানুভব এখানে কেন্দ্রভূত থেকেও বিস্তারমুখী — তিনি ব্যক্তির অন্তর্জগৎকে ছুঁয়ে পৌঁছাতে চান সমষ্টির আত্মাস্বরূপে। তাঁর কবিতা তাই একযোগে যুগসংলগ্ন এবং যুগাতীত: সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সময়কেও ছাড়িয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল।
আবু সয়ীদ আইয়ুব এই পাঠেই চিহ্নিত করেন রবীন্দ্রনাথের সেই আধুনিকতা, যা একধরনের Indic utopia—অস্তিত্বের খণ্ডিততা নয়, বরং সংহতি ও করুণাবোধের ভিত্তিতে গড়া। এই আধুনিকতা আত্মাকে ভাঙে না, বরং গঠন করে, এবং সর্বোপরি এক "আলোকপ্রাপ্ত মানবতা"–র আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে।
এবারে আমরা আসবো আধুনিক পাঠকের courtroom-এ, যেখানে আইয়ুব হচ্ছেন সেই আত্মবিশ্বাসী ব্যারিস্টার, যিনি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে দাঁড়িয়ে যুক্তির গালিচা বিছিয়ে দেন—আদ্যন্ত দর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব আর এক অসামান্য ঐতিহ্যবোধ দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আধুনিক পাঠক সমাজে যে ধরণের অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে, আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর লেখায় সেসবের এক গূঢ় ও ব্যতিক্রমী উত্তর দিয়ে যান। এই সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে মূলত দুটি ধরণ:
**প্রথমত, অভিযোগ করা হয় যে, রবীন্দ্রনাথের ভাষা আধুনিক কবিতার নিরীক্ষাধর্মী, বিমূর্ত ও বহুস্তরীয় চেতনার তুলনায় অতিরিক্ত স্পষ্ট, সরল ও অলংকৃত—অর্থাৎ, সেখানে নাকি "modernist opacity" বা "semantic ambiguity"–র সেই স্বাদ নেই।
**দ্বিতীয়ত, আরেকটি বহুলচর্চিত আপত্তি হলো, তাঁর কবিতায় অমঙ্গলচেতনার অভাব—এমন একরকম নিরাবেগ সৌন্দর্যচেতনা, যেখানে দুঃখ, ক্লেদ, অর্থহীনতা, এমনকি মেটাফিজিক্যাল হাহাকার পর্যন্ত ঠিকঠাক প্রতিফলিত হয় না।
এই দুই অভিযোগকে আইয়ুব কেবল খণ্ডনই করেন না, তিনি এগুলোর অন্তর্নিহিত পদ্ধতিগত সমস্যাগুলোকেও উন্মোচন করে দেন।
১. ভাষা কি সরল? নাকি পরিশ্রুত?:-- আইয়ুবের মতে, রবীন্দ্রনাথের ভাষার স্পষ্টতা আদতে তাঁর অন্তর্জাগতিক সংবেদনশীলতা ও বৌদ্ধিক পরিশুদ্ধির ফল। এই ভাষা "spiritual transparency"-এর ভাষা—অর্থাৎ, যেখানে সরলতা মানে নয় চিন্তাশূন্যতা, বরং এক পরিশ্রুত মননের দীপ্তি।
কবি বলেন,
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ, সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ। চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে
এই "স্পষ্টতা" এক প্রকার আত্মসিদ্ধ প্রজ্ঞার প্রকাশ—যেখানে প্রতীকের ঘন কুয়াশা নয়, বরং এক ঋজু আলোকরেখা দিয়ে রচে হয় ভাবনার শরীর। আইয়ুব এখানে ইউরোপীয় মডার্নিস্টদের প্রতীকময়তা বা বিমূর্ততার কাঠামোকে প্রশ্ন না করেই বুঝিয়ে দেন, "অস্পষ্টতা" একমাত্র আধুনিকতার মাপকাঠি হতে পারে না।
২. অমঙ্গলচেতনার অনুপস্থিতি? না কি বিবর্তিত রূপ?: -- আইয়ুবের বিশ্লেষণের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ হলো তাঁর এই বক্তব্য: রবীন্দ্রনাথের কাব্যে অমঙ্গল বা দারুণতার অনুপস্থিতি নয়, বরং তার এক বিশুদ্ধ, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক রূপান্তর ঘটেছে।
আইয়ুব দেখান, ‘পুনশ্চ’, ‘শেষের কবিতা" ‘জীবনস্মৃতি’ প্রভৃতি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ যে নিঃসঙ্গ আত্মজিজ্ঞাসা, মৃত্যু ও অস্তিত্বের অনিবার্য অন্ধকার নিয়ে আলোচনা করছেন, তা কম কিছু নয়। এই ছায়া কেবল বিষণ্ণতা নয়, বরং এক মরমি মেটাফিজিক্স—যেখানে দার্শনিক অনুরণন প্রতিধ্বনি তোলে ঈশ্বর, মৃত্যু, ও অস্তিত্বের প্রতিটি সংকটময় প্রশ্নে।
আসলে, রবীন্দ্রনাথের ‘sense of dread’ বা ‘ontological melancholy’ এক প্যাথলজিক্যাল আতঙ্ক নয়, বরং এক আত্মিক দহন, যাকে অতিক্রম করেই তিনি পৌঁছাতে চান জ্যোতির্বিন্দুতে। এই প্রবণতা তাঁকে বোদলেয়ার বা এলিয়টের চেয়ে ভিন্ন এক আধ্যাত্মিক আধুনিক
আবু সয়ীদ আইয়ুবের বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ এক বিকল্প আধুনিকতার প্রতিনিধি—যেখানে ‘ontological melancholy’ নৈরাশ্য নয়, আত্মান্বেষণের অনুষঙ্গ। বোদলেয়ার বা এলিয়টের নৈরাশ্যমূলক আধুনিকতার বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের কাব্যিকতা ‘cosmic integration’-এর পথ খোঁজে। অরুণকুমার সরকারের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক অংশ এই বইকে তাত্ত্বিক উচ্চতায় নিয়ে যায়, যেখানে সাহিত্য রসগ্রহণ নয়, আত্মসন্ধানের মাধ্যম। আইয়ুব শৈল্পিকতা ও নৈতিকতা—দুটিকেই সমভাবে গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা হলো আলোক-আকুল সৌন্দর্যের রূপ, যা সত্যের পথপ্রদর্শক। বইটি পাঠককে কেবল উত্তর নয়, জিজ্ঞাসার অভ্যাস শেখায়—এবং সেই কারণেই এটি সাহিত্যের একটি গূঢ় ও মৌলিক ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে।
এই বইটা আমার পুরোপুরি মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। এতো গভীর আলোচনা আর কি নিপুণভাবে কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর আলোচনা করা হয়েছে তা না পড়লে বুঝা কঠিন।
রবীন্দ্রনাথ এর কবিতা/দর্শন এবং প্রকৃতিকে রবীন্দ্রনাথ কোন সময় কোন আঙ্গিকে দেখেছেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে এই বইয়ে।
বইয়ের অনেক আলোচনা-ই বুঝে উঠতে পারিনি, যেমন রবীন্দ্রনাথের শব্দচয়ন অনেক সময় বুঝে উঠা মুশকিল হয়ে যায়। নবীনদের জন্য একদমই সুখপাঠ্য না এটা। যারা সাহিত্যের রসকস উপলব্ধি করেছেন এবং অন্তত রবীন্দ্রনাথ এর পাঁচ ছয়টা বই পড়েছেন তারা এটা পড়ে দেখতে পারেন। যে কনসেপ্ট গুলো বুঝেছি, সেগুলোতে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি আর মনে মনে ভেবেছি_আগে কেন এভাবে ভাবিনি?? মোদ্দা কথা বইটি রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে আপনার চিন্তা পরিবর্তন করে দিবে।