আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিকের একদম শেষ দিকে লেখা হয়েছে : ‘আরও একটু পর আমরা জানতে পারি, ক্রসফায়ারে একজন মারা গেছে। কেননা ক্রসফায়ারই গন্তব্য আমাদের সকলের। আমি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করি, আরও এক বড়ভাই মারা গেল হয়তো। হয়তো আরও একটি রূপকথা লেখা হলো। […] কেননা চিঠিযুগ শেষ য়ে গেছে অনেক আগেই, থেমে গেছে কুউউ ঝিকঝিক।’ আর উপন্যাস শুরু হয়েছে : ‘শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পরও আমি বসে থাকি স্টেশনের উল্টো দিকে দু’মুখ খোলা সিমেন্টলোহার বড় বড় পাইপগুলোর ওপর। একটু শীত-শীত লাগছে এখন। জামাটা ভালো করে টেনেটুনে আরও জড়সড় হয়ে বসে শীত কমানোর চেষ্টা চালাই আর মনেমনে চিন্তা করি, বড়ভাইকে নিশ্চয়ই আর্মিরা খুব মার দিচ্ছে।’ এর মাঝখানে গোটা উপন্যাসে ধরা আছে সামরিকশাসনধ্বস্ত বাংলাদেশ-যাপিত সেই ইতিহাস ইমতিয়ার শামীম আমাদের সামনে মেলে ধরলেন তাঁর শক্ত কলমে।
ইমতিয়ার শামীমের জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। আজকের কাগজে সাংবাদিকতার মাধ্যমে কর্মজীবনের শুরু নব্বই দশকের গোড়াতে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ডানাকাটা হিমের ভেতর’ (১৯৯৬)-এর পান্ডুলিপি পড়ে আহমদ ছফা দৈনিক বাংলাবাজারে তাঁর নিয়মিত কলামে লিখেছিলেন, ‘একদম আলাদা, নতুন। আমাদের মতো বুড়োহাবড়া লেখকদের মধ্যে যা কস্মিনকালেও ছিল না।’
ইমতিয়ার শামীম ‘শীতের জ্যোৎস্নাজ্বলা বৃষ্টিরাতে’ গল্পগ্রন্থের জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার (২০১৪), সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ দেশের প্রায় সকল প্রধান সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন।
বিষণ্ণতার সাথে সৌন্দর্য যোগ করলে ইংরেজিতে খুব সুন্দর একটা শব্দ পাওয়া যায় -Melancholy। "আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক" অদ্ভুত বিষণ্ণ সুন্দর একটা বই! মাত্র ৮৮ পাতার Melancholic একটা উপন্যাস।
সামরিক জান্তা শাসনের বিপন্ন সময়, প্রিয়জন হারানোর ভুলে থাকা শোক, কুয়াশাঢাকা শিশিরঝরা ডাকঘর আর ডিমাই সাইজের শুভ্র পাতায় লেখা চিঠি, হারিয়ে যাওয়া প্রথম প্রেম.. তবুও অসহায় কিছু অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকা দিন.. ছুঁয়ে যাওয়া একেকটা শব্দ সাজিয়ে লেখা বাক্য.. কি সুন্দর! কি অদ্ভুত সুন্দর!!
"মানুষের সত্যিকারের অনুভূতিগুলি কত অসহায়, মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো কত নির্জন।"
ইমতিয়ার শামীমকে ধন্যবাদ এই চমৎকার বইটির জন্য। লেখকের লেখা অন্য বইগুলোও পড়ে ফেলতে হবে!
ইমতিয়ার শামীম কখনো পড়া হয়নি আগে, যদি ও উনার লেখার পড়ার সাজেশন অনেকেই দিয়েছিলেন। উনার প্রথম উপন্যাস ' ডানা কাটা হিমের ভেতর' পড়ে আহমদ ছফা খুব প্রশংসা করেছিলেন। প্রায়ই ' আমরা হেঁটেছি যারা' আর ' আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক ' দুটি বইয়ের নাম সামনে আসতো। শেষমেশ যখন একজন বন্ধু কি বই উপহার দিবে জানতে চাইলো তখন এই দুটো বইয়ের নাম বলি। উপহার প্রাপ্তির পরপরই পড়তে শুরু করি এবং বুঝতে পারি মানুষ কেনো এত উচ্ছসিত।
ইমতিয়ার শামীম একটা সময় আর জীবনের একটা অংশকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ক্যাপচারড করেছেন এই উপন্যাসে। সামরিক জান্তার হাতে গুম হওয়া বড় ভাইয়ের শোকের বিহ্বলতা দিয়ে উপন্যাসের শুরু হয়। এরপর কৈশোরকালীন বন্ধুত্ব,প্রথম প্রেম,ভাই-বোনের খুনসুটি, নিঃসঙ্গ কুয়াশায় ট্রেনের কুউউ ঝিকঝিক আর চিঠিযুগের অভিনবত্ব। উপন্যাস শেষে হ্নদয়ে ভর করে বাংলার বিষন্নতা নয়,ইংরেজির melancholy।
উপন্যাসের সময়,প্রেক্ষাপট, ঘটনা সব আলাদা হলেও বেশ নস্টালজিক ফিল করেছি। যদি ও সেই চিঠিযুগ পাইনি তবুও চিঠি কিছু পেয়েছি আর মাঝরাতে কুউউ ঝিকঝিক এখনো শোনা যায় আমার ছোট্ট মফস্বল শহরে। এই উপন্যাসের রেশ অনেকদিন মনে থাকবে। এইসব চিঠিযুগ শেষ না হোক,কখনো না থামুক কুউউ ঝিকঝিক..
করুণ সুন্দর🤍 আশির দশকে মফস্বলে বেড়ে ওঠে এক উঠতি বয়সের ছেলের গল্প, তার আশেপাশে থাকা মানুষের গল্প। এ গল্পের কথক সেই ছেলেটি নিজেই। হঠাৎ করেই শুরু এই গল্পের। জলপাই রঙা বাহিনী এসে ধরে নিয়ে যায় তার বড় ভাইকে, তারপর আর তার খোঁজ পাওয়া যায় নি। এমনি করেই তার পরিবারে চিঠির আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার ভাই যেদিন হারিয়ে যায় সেদিন রাতেই ট্রেনের কুউউ ঝিকঝিক শব্দের সাথে সাথে স্টেশনে আসে একটি মেয়ে।
তারপর? 'তারপর আবার আমাদের চিঠিযুগ ফিরে আসে। চিঠিযুগ ফিরে আসে অনবচ্ছিন্ন কুয়াশার মধ্য দিয়ে, চিঠিযুগ ফিরে আসে শিশিরভেজা পথের মধ্য দিয়ে।'
ধীরে ধীরে আশির দশক চলে যায়, হয়তো নব্বইয়ের কুয়াশাও অদৃশ্য হয়। আর 'এদিকে কুয়াশার মত ডাকঘরটা ততদিনে মিলিয়ে গেছে আর বসন্তের উজ্জ্বল আলোতে হলুদ হতে শুরু করেছে আমাদের সব বিলি না হওয়া চিঠি।'
উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ের নিছক প্রেমের কাহিনী বলেই মনে হয়? কিন্তু'মানুষের সত্যিকারের অনুভূতিগুলো কত অসহায়,মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো কত নির্জন!' এই লাইন পড়ে কি মনে হয়? আর কুয়াশা? চিঠি?আর প্রিয় ভাইয়ের ওভাবে হারিয়ে যাওয়া?
পোড়া মাটির টুকরো হাতে নিয়ে যখন গল্পের কথক ছেলেটি জয়নাল ভাইয়ের দোকানের পাশের ফাকা জমির কথা, ডোবার কথা ভাবছিল; আমি তখন ডুবে গিয়েছিলাম নির্জন শাপলার ক্ষেতে। যখন আশেপাশের মানুষজন রেড রোজ, ল্যাভেন্ডার আরও অচেনা নাম না জানা ফুলের কথা বলে ওঠে আমি মনের অজান্তেই বলে ফেলি শাপলা ! তখন অনেকের মুখের অবস্থা দেখে মনে হয় যেন ঐতিহাসিক কিছু বলে ফেলেছি। আমার তখন বড্ড অভিমান হয়।কিন্তু এই অভিমান যে কার উপর- বাড়ন্ত বয়স, ছুটন্ত সময় নাকি শৈশবের সেই খুঁজে না পাওয়া নীলাভ সাদা শাপলার উপর! আমি এখনও বুঝতে পারি না :(
আমার নীলাভ সাদা শাপলা বিলীন হওয়ার পথে তবে কদম ফুল বর্ষার দিনে প্রেমিকার হাতের ছোঁয়া পায়। আর চিঠিযুগ তো শেষ হয়েছে সেই কবে, নিস্তব্ধ রাতের কুউউ ঝিকঝিকও কোলাহলে মত্ত!
~৭ অক্টোবর, ২০২০
মজুমদার ভাই! আপনাকে কি আর বলবো !? জেনে রাখবেন এই পুঁচকে বইটা ধরিয়ে দিয়ে এক পাঠককে অনুভূতি প্রকাশে অসহায় করে ফেলছিলেন :)
"এদিকে কুয়াশার মত ডাকঘরটা ততদিনে মিলিয়ে গেছে আর বসন্তের উজ্জ্বল আলোতে হলুদ হতে শুরু করেছে আমাদের সব বিলি না হওয়া চিঠি।"
"দ্যাখো, মানুষের সত্যিকারের অনুভূতিগুলো কত অসহায়, মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো কত নির্জন।"
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া দুই তরুণ তরুণীর প্রেমের আখ্যান পড়ছেন। যে আখ্যানের সময়কাল চিঠিযুগে। এমন একটা সময় যা আমরা মনে রাখতে চাই না। কিন্তু না, এমনটা ভাবলে ভুল হবে ভীষণ। অবশ্য আমার মনে হয় না কেউ এই ভুলটা করবে। ইমতিয়ার শামীমের পড়া আমার প্রথম বই এটাই। কেমন যেন একটা ঘোরলাগা বিষণ্ণতার আভা ছিল গোটা বই জুড়েই। এই মেলায় কি হলো জানি না, তার সবগুলো বই কালেক্ট করে ফেললাম। এটা বাদে। কিন্তু পড়া শুরু হলো এটা দিয়েই। আমাদের এখনকার লেখকেরা যে বৈঠকী ঢংয়ে লেখতে পছন্দ করেন, তার চেয়ে ব্যতিক্রম ইমতিয়ার শামীমের লিখনশৈলী। শব্দের দারুণ ব্যবহারের পাশাপাশি, গল্পের ভেতরে গল্প বলার ধরণটাও অসাধারণ। তিনি যে নির্দিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী, তা বোঝাতে কোথাও কার্পণ্যবোধ করেননি। তবুও গল্পের টান ঝুলে যায়নি কোথাও। অনবদ্য।
'তারপর আবার আমাদের চিঠিযুগ ফিরে আসে। চিঠিযুগ ফিরে আসে অনবচ্ছিন্ন কুয়াশার মধ্য দিয়ে, চিঠিযুগ ফিরে আসে শিশিরভেজা পথের মধ্য দিয়ে।
সবার ৫ স্টার দেয়ার কারন আজকে বুঝতে পারলাম। বহুদিন পর এই টাইপের নির্ভেজাল কিছু পড়লাম বলে মনে হলো। এই বইয়ের রিভিউ লেখার কিছুই নেই যারা এখনো পড়েননি হাইলি রিকোমেন্ডেট পড়ে ফেলুন।
"আমরা পেয়েছি চিঠি না-পাওয়া রুক্ষ দুপুরগুলো চিঠি পাওয়া দুই অধৈর্য-হাতে ছিঁড়ে পড়া কৈশোর আমরা দেখেছি বিব্রত এক, পাংশুটে এক শুকনো মানুষ মানিঅর্ডারের কুশল-কুপনে মিথ্যুক ঠিকানা
আমরা শুনেছি শেষ ট্রেন চলে গেলে চিঠি না-পাওয়া মায়েদের মতো বৃষ্টির কান্না..." ~ বইটা যখন প্রথম পড়ি ২০১৭ সালের জুনে, তখন বইটা নিয়ে একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে, তখন মাত্র ইমতিয়ার শামীমের 'আমরা হেঁটেছি যারা' পড়েছিলাম। আর ওই একটা বই পড়েই আমি আর দিশা আপু সিদ্ধান্ত নিই, এই লেখকের সব বই পড়তে হবে, আজিজের জনান্তিক আর কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামের কয��েকটা দোকান খুঁজে দুই তিনটা বই পেয়েছিলাম।
পরে চোখ পড়ে এই বইটার উপর, 'আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক '- নামটাও অনেক সুন্দর আর কভারটাতো আরো, এখনের কভার না কিন্তু, একদম আগের এডিশনের কভার। তখনই দিশা আপু আর আমি বইটা খুঁজতে থাকি, কিন্তু কোথায়ও পাইনা। একসময় সাহস করে লেখককে ফেসবুকে একটা মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করি বইটার কথা, পরে উনি জানান বইটা প্রিন্ট আউট। তবে আমরা যেহেতু খুব পড়তে চাচ্ছি উনি আমাকে সফটকপিটা দিতে রাজি হয়েছিলেন।
এভাবেই আমাদের প্রথম চিঠিযুগ পড়ার সুযোগ হয়। পরবর্তীতে দিশা আপু গুডরিডসে সফটকপিটার লিংক দিয়ে দেয় এবং সবাই এই বইটা পড়ার সুযোগ পায়, এখন যেহেতু হার্ডকপি পাওয়া যায় তাই সফটকপিটা সরানো হয়েছে। তো এই ঘটনাটা বলার কারণ এটাই, আগে যে সবাই চিঠিযুগ পড়তে পেরেছিলেন তার ক্রেডিট কিন্তু দিশা আপু আর আমার এবং অবশ্যই লেখকের, যিনি এতো অমায়িকভাবে সফটকপিটা শেয়ার করেছিলেন।
চিঠিযুগের কথা আমরা সবাই জানি, এখানে লেখক বাংলাদেশের সামরিক শাসনামলের একটা ক্ষুদ্রচিত্র তুলে ধরেছেন বইয়ের কথকের মাধ্যমে, যার বড়ভাইকে আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়, এবং এরকম হাজারো বড়ভাইদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে আর ফিরে পাওয়া যায়না।
"গনতন্ত্রও মানুষকে হত্যা করে, সৈরতন্ত্র তো আরও বেশি করে। তা হলে কোনখানে মানুষের মুক্তি? কিন্তু অন্যায় চিরদিন অন্যায়, হোক না তা গনতন্ত্রের অথবা সৈরতন্ত্রের। আহ্ কি দারুণ কথা, পরোয়াই যদি করতে হয় তাহলে মৃত্যুর নয়, অন্যায়ের পরোয়াই করা উচিত। "
আমি নিজেকে ইমতিয়ার শামীম ফ্যানক্লাবের প্রতিষ্টাতা হিসেবে দাবি করলেও কখনো উনার বইয়ের রিভিউ লেখার মতো দুঃসাহসিক কাজ করিনি, কারণ উনার বই পড়া শেষে সবকিছু এলোমেলো লাগে, রিভিউতে কি লিখবো কোন উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাইনা। এই বইটা ২০১৭ সালে পড়ার পরেও একই অনুভূতি হয়েছিল, আমার এখনো মনে আছে, আমি খুব কান্না করেছিলাম, কথকের জন্য, স্নেহার জন্য, তাদের দুজনের না পড়া চিঠিগুলের জন্য। এই অনুভূতির সাথে এই কথাটা খুব মিলে যায়--
"দ্যাখো, মানুষের সত্যিকারের অনুভূতিগুলো কত অসহায়, মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো কত নির্জন।"
আসলেইতো তাই, না?
আপনাদের চিঠি পেতে ভালো লাগে? আমার খুব ভালো লাগে, যদিও লিখতে আলসেমি লাগে, কিন্তু কেউ আমাকে চিঠি লিখলে কি যে খুশি হয়ে যাই! চিঠিযুগটা এখনো থাকলে কি যে ভালো হতো, না?
"এদিকে কুয়াশার মত ডাকঘরটা ততদিনে মিলিয়ে গেছে আর বসন্তের উজ্জ্বল আলোতে হলুদ হতে শুরু করেছে আমাদের সব বিলি না হওয়া চিঠি।
"কেননা চিঠি যুগ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই, থেমে গেছে কুউউ ঝিকঝিক।"
আপনারা যারা এখনো এই বিষণ্ন সুন্দর বইটা পড়েননি প্লিজ জীবনে একবার হলেও পড়বেন আর প্রিয়জনকে চিঠি লেখার চেষ্টা করবেন, নিজেদের ঘরের মধ্যেও হতে পারে এই চিঠি বিলি যেমনটা বইয়ের মধ্যে বড়ভাই, কথক, স্নেহা, অন্তরা, জামিল করেছিল। আর আপনারা চাইলে আমাকেও চিঠি লিখতে পারেন। কারণ আমরা চাইলেই চিঠিযুগ ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারি।
"তারপর আবার আমাদের চিঠিযুগ ফিরে আসে। চিঠিযুগ ফিরে আসে অনবিচ্ছিন্ন কুয়াশার মধ্য দিয়ে, চিঠিযুগ ফিরে আসে শিশিরভেজা পথের মধ্য দিয়ে।"
এই বইটা হ্যারি পটার সিরিজ পড়ার মতো, প্রতিবছর একবার হলেও পড়বো, আর মন খারাপ করে বসে থাকবো। ইমতিয়ার শামীমকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের সবাইকে চিঠিযুগের সাথে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য। আর বিষণ্ণ সুন্দর সব বই লেখার জন্য। 🖤
"বাজারে একটা সুন্দর গেঞ্জি এসেছে। কমপক্ষে ২০টা সেই গেঞ্জি কিনতে হবে । বলে অঞ্জন। — কোন গেঞ্জি? আবারও বলি আমি। — আমাদের সামরিক জান্তার ছবি অ্যামবুশ করা গেঞ্জি। খাল কাটতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে তিনি কোদাল হাতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। গেঞ্জিটার পিঠের দিকে আমরা থাউজেন্ট পাওয়ারের লাল কালি দিয়ে লিখব—'এখানে প্রস্রাব করুন'। কলেজের পেছনের দীর্ঘ দেয়ালজুড়ে প্রস্রাব করে পথচারী, রিকশাওয়ালা আর ছাত্ররা সবাই । ওইখানে মাটির ওপর গেঞ্জিগুলো সারে সারে সাজিয়ে রাখব আমরা। গেঞ্জির কোণগুলো চোখা বাঁশ দিয়ে পুঁতে দেব। প্রস্রাবে প্রস্রাবে ভিজে গেলে উল্টো দিকের সামরিক জান্তাকে স্পষ্ট দেখা যাবে। যে প্রস্রাব করতে আসবে, সেই দেখবে সামরিক জান্তা প্রস্রাবখানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং সেখানকার প্রস্রাব খাচ্ছে।"
কতটুকু ঘৃণা মনে থাকলে এমন বলা যায় কিংবা করা যায়। টাইম ট্রাভেল করে আমার আশির দশকে যেতে ইচ্ছে করছে। দেখতে ইচ্ছে করছে কেমন ছিল সামরিক জান্তার শাসনামল। তারা কতজনকে এভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। কতজনকে ঘুম করেছে।
"আমি কোনোদিনই জানব না মানুষের কত বেদনা, হাজার হাজার বই পড়েও কোনোদিন বুঝতে পারব না কেন মানুষ মানুষের কাছে গিয়েও আবার ফিরে এসে নির্জনে কাঁদে। আমি অংশীদার হতে পারব না এই মানুষের কিংবা এই মানুষের মতো আরও অজস্র কোটি কোটি মানুষের ঘামের স্বেদবিন্দুতে লুকিয়ে থাকা আনন্দউল্লাস, দুঃখবেদনা কোনো কিছুর।"
প্রতিটি মানুষের নিজস্ব বেদনা অন্য কোনো মানুষের পক্ষে উপলদ্ধি করা অসম্ভব। বেদনা-বিরহ, দুঃখ-কষ্টের অনুভূতিগুলো কারো সাথে শেয়ার করলে আমার দুঃখ আরও বাড়ে। তারচেয়ে এই আবেগগুলো ব্যবহার করে কবিতা রচনা করা অনেক সহজ এবং শান্তি দায়ক। যার ফলে অনুভূতিগুলো আনন্দ দেয় প্রবলভাবে।
"আমি বিছানাতে শুয়ে থাকি, আমার এসব একেকটি স্মৃতি মনে পড়ে। আমি রাস্তায় হাঁটি, আমার এইসব একেকটি স্মৃতি মনে পড়ে। আমার কপালের রগ দপদপ করে। আমার মনে হয়, চিৎকার করে একটা কিছু বলি। কিন্তু কোনো কিছুই বলতে পারি না। নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হয়, কিন্তু তারপরও মনে মনে গালিগালাজ করতে থাকি পৃথিবীর প্রতিবাদহীন সকল মানুষকে। মনে মনে বলি আমি, তোমাদের ইতিহাসে সেনাবাহিনী এদেশের গৌরব। কিন্তু আমার ইতিহাস সে চিরকালের ঘৃণা। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন এই সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করে যাব । আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন এই সামরিক জান্তাকে ঘৃণা করে যাব। প্রতিবছর তোমরা সশস্ত্র দিবস উদ্যাপন করবে আর বলবে মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর গৌরবময় ভূমিকার কথা।
প্রতিবছর আমি আমার বড়ভাইয়ের মৃত্যুতে খুব নীরবে বড় ভাইয়ের কবরের কাছে দাঁড়িয়ে মনে করব ক্ষমতা প্রেমিক সেনাবাহিনীর রক্তপাতময় হত্যাযজ্ঞের কথা। প্রতিবছর তোমরা গোয়েবসের মতো বলবে, এই সামরিক জান্তার ডাকেই মানুষ আপ্লুত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে; কিন্তু একদিন নয়, প্রতিদিন এই শহরের পথ দিয়ে যেতে যেতে আমি অনুভব করব, কী করে একজন উর্দিপরা সামরিক জান্তা মসনদে চড়ে আবারও ফিরিয়ে এনেছে অন্ধকার সামরিকতার যুগ এবং খুব গোপনে শত শত মানুষকে ধরে নিয়ে ফাঁসি দিয়েছে সেনানিবাসের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নামকাওয়াস্তে বিচার করে। সামরিক জান্তার নামটির ওপর প্রতিদিন সকালে উঠে আমি আগে থু থু ফেলব তারপর আর সব কাজ শুরু করব।"
হুমায়ূন আহমেদের 'জোছনা ও জননীর গল্প' পড়ার পর সামরিক শাসনামালের কিছু চিত্র মানসপটে ফুটে ওঠেছিল। এই বইটা পড়ে আরও ভালোভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছি।
"তারপর আবারও আমাদের চিঠিযুগ ফিরে আসে। চিঠিযুগ ফিরে আসে অনবচ্ছিন্ন কুয়াশার ফোঁটা হয়ে, চিঠিযুগ ফিরে আসে শিশিরভেজা পথের মধ্য দিয়ে। যেন হঠাৎ-ই দেখা হয়েছে আমাদের ঘন কুয়াশায়, তেমন কোনো পরিচয়ও নেই, কিন্তু আমরা একটু থামি, একজন আরেকজনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেই, চিঠি নেই, চিঠি দেই। তারপর আমরা আবারও অচেনা হই, ���ামান্য পরিচিত প্রতিবেশী হই এবং আরও সামান্য কুশল বিনিময় করি। শীতকাল, কুয়াশা এবং শিশির এইভাবে নতুন এক যুক্তাক্ষর তৈরি করতে থাকে, যে যুক্তাক্ষর দিনে দিনে আমাদের কাছে আরও দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে থাকে। বোধগম্যতা ফিরে পাওয়ার জন্য আমি আরও বেশি করে রাত জাগতে থাকি, বারবার পুরনো চিঠি পড়ি এবং যতবারই প্রতিজ্ঞা করি না কেন, আজকের চিঠিটা ছোট করে লিখব, ততবারই চিঠি বড় হয়ে যায়।"
আহা! চিঠির সেই যুগ হারিয়ে গেল। আমি ভুল সময়ে জন্মগ্রহণ করে বেঁচে থেকেও মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগছি। বর্তমান যুগ আমার জন্য নয়। এজন্য আমি একাকীত্ব এবং বিষণ্ণতাকে ভালোবাসি। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ইদানিং খুব ভালোভাবে উপলদ্ধি করতে পারছি। জীবনের দুর্বিষহ সময় কবিতা বোঝার আসল সময়।
"দ্যাখো, মানুষের সত্যিকারের অনুভূতিগুলি কত অসহায়, মানুষের সত্যিকারের ভালবাসাগুলো কত নির্জন। এমন এক জলজ চোখে সে তাকিয়েছিল যা থেকে কখনো জল উপচে পড়ে না, এমন জলজ চোখ যা চিরদিনই ওই জল ধরে রাখবে। আমার সারা শরীর আবারও থরথর করে কাঁপতে থাকে, মানুষ তার প্রথম সন্তান লালনের অনুভূতি কি অনেক অনেক চেষ্টা কোনোদিন? যে তার পিতামাতাকে দেয় প্রথম অবোধ কান্না আর অবোধ হাসি, যে করেও আর কোনো সন্তান লালনের অনুভূতির সঙ্গে এক করে ফেলতে পারে তার পিতামাতাকে দেয় প্রথম প্রযত্নের স্বপ্ন আর আনন্দ, যে তার পিতামাতাকে দেয় যৌনতানির্ভর প্রেম থেকে মুক্তির প্রথম আস্বাদ সে যখন হারিয়ে যায়, মিলিয়ে যায়, যখন কোথাও তার আর কোনো ছায়া থাকে না, কোথাও তার আর কোনো হাসি কিংবা কান্নার শব্দ শোনা যায় না তখন সে কী নিয়ে বেঁচে থাকে? সত্যিই কি বেঁচে থাকে? সে কি তখন প্রতিদিন অনুভব করে না তার সত্তার একটি অংশে কোনো রক্তপ্রবাহ নেই, জীবনের কোনো স্পন্দন নেই?এই এক অনুভূতি আমার বাবা আর মাকে দিয়ে গেছে সেনাদল, এই এক মৃতজীবন আমার মা আর বাবাকে দিয়ে গেছে দেশরক্ষার অতন্দ্র প্রহরীর কালো চশমা। কতটুকু হাহাকার নিয়ে, কতটুকু হাহাকার লুকিয়ে পিতা তার মৃত সন্তানের কথা বলে, তাও তারই আর কোনো সন্তানের কাছে, তার চোখের অন্তরালে তখন কী কীর্তিনাশা লুকিয়ে থাকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও তা কি বুঝতে পারবে এরা? আমি আমার অতৃপ্ত চোখ নিয়ে আবারও জানালা খুলি, আবারও আকাশের দিকে তাকাই, আবারও ভাবি, শ্রেষ্ঠ রূপকথাটি লিখে গেছে সেই এক অজানা মানুষ যে হয়তো বা তার সন্তানকে, হয়তো বা তার প্রেমকে ফিসফিসিয়ে একদিন বলেছিল, শোনো, আমি মরে যাওয়ার পর আকাশের ওই কোণে তাকালে দেখবে একটি তারা জ্বলজ্বল করছে। পৃথিবীর প্রিয় মানুষের জন্য ওভাবেই তারা হয়ে তাকিয়ে থাকে মরে যাওয়া মানুষ। আমি আকাশের সেই তারার দিকে তাকিয়ে থাকি।"
আসলেই সত্যিকারের অনুভূতিগুলো বড্ড অসহায়, সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো সম্পূর্ণ নির্জন এবং ব্যর্থ। পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে আমি উপলদ্ধি করতে পারি যে আমার আব্বা-আম্মা আমায় আমার অন্য দুইভাই থেকে আমায় কতটা ভীষণ ভালোবাসে। সবকিছু উজাড় করে দেয়। আমি কি তার মূল্য দিতে পারব? আমি কি আমার আব্বা-আম্মাকে তাদের মতো করে ভালোবাসতে পারব?
"মা মরে গিয়ে তারা হয়ে যায়, বাবা মরে গিয়ে তারা হয়ে যায়, প্রিয় মানুষ মরে গিয়ে তারা হয়ে যায়,
তারপর আকাশের কোণে সবচেয়ে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে জ্বলতে থাকে, আর তুমি যদি তাকে সত্যিই ভালোবাস, তা হলে রাতে আকাশের দিকে তাকালে দেখতে পাবে তাকে, দেখবে একটি তারা সবচেয়ে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে জেগে আছে আকাশে, তোমার দিকে তাকিয়ে আছে উজ্জ্বল চোখে।"
আমার আকাশেও দুইটা তারা আছে। একটা আমার নানা আর অন্যটা.....। এই দুইটা উজ্জ্বল তারা আমাকে Melancholy অনুভূতির স্বাদ দেয়।
"স্বাগত সংগীত গাওয়ার আগে ও বলত, এই গান গাওয়ার আগে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সামরিক জান্তার হাতে নিহত এ শহরের আমিনুর রহমানসহ সকল শহিদকে। বলে ও(স্নেহা) বৃষ্টির দিকে তাকিয়েছিল, যদিও এত ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল যে আমরা কোনো কিছুই দেখছিলাম না"
স্নেহারা কি এভাবেই হারিয়ে যায় জীবন থেকে! স্নেহাদের শূন্যস্থান যে আমাদের জীবন্ত মৃত্যুদণ্ড দেয় তা কি জানে না স্নেহারা! জীবন এমনি হয়; তবে অন্যরকম হতে পারত কি! এত সূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকা অসহ্যকর।
"যেদিন তোমার ঋতুক্ষরণ বন্ধ হবে, সেদিন তোমাকে আমি ন্যাপথলিনের গন্ধে ভরা এক রাজ্যে নিয়ে যাব। সেদিন তোমার কোনো হিংসা থাকবে না, প্রতিহিংসাও না; সেদিন তোমার শুনতেও কোনো কষ্ট হবে না। তখন তুমিও তোমার ন্যাপথলিনের গন্ধে ভরা রাজ্যটা আমার হাতে তুলে দিতে পারবে।"
আমাদের ন্যাপথলিনের গন্ধে ভরা রাজ্যটা লুকিয়ে রাখতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে ঋতুক্ষরণ বন্ধ হওয়ার। এভাবেই আবার আমাদের জীবন আবছা কুয়াশায়, পতনশীল ধীর শিশিরবিন্দু আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাল্পনিক রঙে ঝাপসা ধূসর হয়ে ওঠবে। আর আমরা চেয়ে থাকব রাতের আকাশের উজ্জ্বল তারাগুলোর দিকে, যাদের আমরা প্রকৃতই ভালোবাসি, যারা আমাদের পানে চেয়ে আছে ভালোবাসার জন্য, যে ভালোবাসা নিঃশেষে অবিভাজ্য। এভাবেই বেঁচে থাকতে হয় প্রিয়; Melancholy নামক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতির সহচরী হয়ে।
"বসন্ত উড়ে বেড়াতে থাকে, আকাশের মেঘগুলোকেও মনে হয় কত অশঙ্কিত এবং একেকটি দিনের শুরুতেই আমার মনে হয়, অদৃশ্য এক শক্তি আমার পোস্টঅফিস চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। আমি একের পর এক চিঠি লিখি, কিন্তু কোথাও কোনো ডাকঘর খুঁজে পাই না, সব চিঠি আমি সযত্নে লুকিয়ে রাখতে থাকি একদিন না একদিন নিজের হাতে স্নেহার হাতে সেগুলো তুলে দেওয়ার আশায়।"
এতটা বিষাদ, বিরহ, আনন্দ এবং বেদনার স্বাদ খুব অল্প বই থেকে পেয়েছি। এখন আমার পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে ইমতিয়ার শামীমের লেখা সবগুলো বই এই মাসের ভিতরে পড়ে শেষ করা এবং গুডরিডসে রিভিউ লিখে আমার অনুভূতি শেয়ার করা।
বইটা পড়তে গিয়ে একেকসময় একেক অনুভূতি হয়েছে। সিড়িতে পিছন থেকে স্নেহার– “এক্সকিউজ মি। আমি ফ্রিজের ঘটনাটা জানি,” বলা। কিংবা বৃষ্টির দিনে রিকশায় একে অপরের গালে প্রথম চুমু আদান প্রদান অথবা ক্লাসে বসে মেয়েদের চুলের স্টাইল পর্যবেক্ষণ; এইসব জিনিস ঠোটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে দিয়েছিল। আবার বড় ভাইকে সামরিক জান্তার ধরে নিয়ে যাওয়া; স্নেহার বাবার নির্মমভাবে সেই টবগুলো ছোড়ে ফেলা, যেখানে ছিল বসন্তের উজ্জ্বল আলোতে হলুদ হয়ে যাওয়া অনেকগুলো চিঠি; এসব জিনিস হালকা খুশিতে মেতে থাকা মনটাকে একদম কুপোকাত করে ফেলেছিল। আর শেষের দিকের কয়েকটি পৃষ্ঠা একদম মরমে গিয়ে আঘাত করলো। জলপাই রঙের সামরিক বাহিনী হয়তো এখন আর ধরে নিয়ে লোকদের গায়েব করে দেয় না, কিন্তু সে জায়গায় এসে জায়গা নিয়েছে কালো রঙের র্যাব। তবে আমাদের দেশে আর স্নেহার দেখা পাওয়া যায় না। কারণ চিঠিযুগ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে; থেমে গেছে কুউউ ঝিকঝিক! এখন নিজের হাতে ধরে থাকা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে লেখছি, এই প্রজন্ম হারিয়েছে অনেক কিছু, কিন্তু নতুন কিছু খোঁজে পায় নি।
জীবনটা অনেক ছোট, জানেন তো? আর এই ছোট জীবনেও নানা ব্যস্ততা এসে একদম চেপে বসেছে। তাই কষ্ট করে বই পড়ার জন্যে কিছু সময় বের করলে এইসব বই না পড়ে থাকা অন্যায় এবং নিজেকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করা।
"দ্যাখো, মানুষের সত্যিকারের অনুভূতিগুলো কত অসহায়, মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো কত নির্জন।"
ইমতিয়ার শামীমের যে কয়টি বই পড়েছি সবথেকে ভালো লেগেছে এটি। অদ্ভুত সুন্দর একটি বই। একটা বিষন্নয়তার ঘোর লাগা। লেখককে বিশেষ ধন্যবাদ বইটির পিডিএফ দিয়ে পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
"এদিকে কুয়াশার মত ডাকঘরটা ততদিনে মিলিয়ে গেছে আর বসন্তের উজ্জ্বল আলোতে হলুদ হতে শুরু করেছে আমাদের সব বিলি না হওয়া চিঠি।"
Comfort zone এর বাহিরে আমি সচরাচর কোন বই পড়ি না। মাঝে মাঝে হাতে নিয়ে যদি আটকে যাই তাহলে দীর্ঘদিনের মধ্যে zone এর বাইরে একদমই যাই না। এই বইটাকে suggest করেছিলো ডায়না। সে এক আদ্যিকালের কথা! পড়বো বলে সেই যে ফেলে রেখেছি, তারপর বহুবার দেখা হলেও পড়ার চেষ্টা একদমই করিনি। এরমধ্যে কতো জনকে যে দেখলাম বইটা পড়ে, রিভিউ দিয়ে একদম একাকার অবস্থা! আমি সেইসব রিভিউও পড়িনি ঠিকঠাক। তারপর কিছুদিন আগে পড়তে শুরু করলাম। জানিনা কিভাবে পাতার পর পাতা পড়ে ফেললাম। তারপর, একসময় বইটা শেষ হয়ে গেলো। ভদ্রলোকের লেখায় জাদু আছে। অবশ্যই আছে, নয়তো আমার মতো অধৈর্য একজন পাঠককে এতোদিন পরে একটা বই এ এভাবে আটকে ফেলতে পারতেন না। বই এর শেষটা কষ্টের হলেও অসম্ভব সুন্দর। Comfort zone এর বাইরে এসে এই বই পড়লেও, শেষ করার পর মনে হচ্ছে আমি আসলে comfort zone এই ছিলাম। Zone টা একটু বড় হয়েছে, এই যা! আগাগোড়া perfect একটা বই। অবশ্য পাঠ্য।
‘অন্যায় চিরদিনই অন্যায়, হোক না তা গণতন্ত্রের অথবা স্বৈরতন্ত্রের।‘
যদিও কখনও চিঠি লিখি নি বা পাই নি তবুও কেন জানি না চিঠি বরাবরই আমার কাছে এক বিস্ময়কর জিনিস বলে মনে হয়। চিঠির কথা মনে হলেই আমার মনে হয় কেউ একজন একটা সাদা পাতাকে নিজের চিন্তার ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুলছে যার জন্য অপরপক্ষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিন্তু চিঠির যুগ তো শেষ হয়েছে সেই কবেই, তাইতো লেখক ইমতিয়ার শামীম আমাদের সেই চিঠিযুগে ফিরিয়ে নিতে ফেঁদেছেন এক কাহিনী। চিঠিযুগে বসে রেলগাড়ির কুউউ ঝিকঝিক শোনানোর আড়ালে নিয়ে শুনিয়েছেন এক জনপদের কথা যা জলপাই রঙের কোটের দাপটে নিজেকে প্রতিনিয়ত নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিল ।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মফস্বল শহর সিরাজগঞ্জ। ভালোই কাটছিল শহরবাসীর জীবন। কিন্তু অচিরেই ভীষণভাবে ব্যাহত হয় তাদের জীবন যখন আবাসিক এলাকায় হুটহাট ঢুকতে থাকে জলপাই রঙের কোটওয়ালারা। একে একে তারা ধরে নিয়ে যায় কথকের ভাই আমিনুর রহমান, প্রতিবেশী আদিল ভাই, প্রতিবেশী তৌফিকুর রহমানের ছেলেসহ আরও অনেককে। সবার চোখের সামনে তাদের ধরে নিয়ে গেলেও অফিসারকে ধৃতদের সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না, ধৃতরা আর বাড়ি ফিরে আসে না। কথক এসময় বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে শহর কেমন যেন দিনদিন ভীত হয়ে পড়ছে, নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ছে।
এই সময়েই কথকের সাথে পরিচয় হয় স্নেহার। শুরু হয় চিঠিযুগ। সবাইকে লুকিয়ে কুয়াশার চাদরের আড়ালে তারা চিঠি বিনিময় করতে থাকে। কিন্তু এই চিঠিযুগ স্থায়ী হয় না। এক রাতে ঘুমের পর কথক আবিষ্কার করে চিঠির প্রাপককে আর পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু চিঠি লেখা তো শেষ হয় নি। তাইতো প্রাপকের অনুপস্থিতিতেও চিঠি লেখা চলতে থাকে, চিঠি জমতে থাকে, পাতাগুলো বিবর্ণ হতে থাকে।
যেসব বই শেষ করার পর বুক জুড়ে একটা চাঁপা বিষন্নতা দানা বাঁধতে থাকে, এই বইটা তেমনই একটা বই। কোনো প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেললে যে দুঃখের অনুভূতি হয়, বইটা শেষ পর তেমনই একটা অনুভূতি যেন হলো! কিন্তু দুঃখটা কার জন্য হলো সে বিষয়ে যেন নিশ্চিত হতে পারলাম না। এটা কি উর্দিওয়ালাদের হাতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আমিনুরের জন্য? নাকি প্রিয়জনকে হারানো কথকের জন্য? নাকি হারিয়ে যাওয়া স্নেহা বা চিঠিযুগের জন্য? উত্তর যাই হোক না কেন, বইটা ছিল যেন এক বিষাদময় সৌন্দর্য।
স্পষ্টতঃ লেখক দুইটা ভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। একদিকে এক কিশোরের প্রেম আর অন্যদিকে দেশের সামরিক শাসন। কিন্তু লেখক এত নিপুণভাবে এই দুইটা বিষয়কে একীভূত করেছেন যে দুইটা বিষয়কে আলাদাই করা যায় না। ফলে বইটা শুধু এক কিশোরের বিরহ বা দুঃখের আখ্যান বা শুধু একটা যুগের বর্ণনা হয়ে থেমে থাকে নি বরং হয়ে উঠেছে সামরিক শাসনে উত্তপ্ত এক মফস্বল শহরের এক কিশোরের বিরহের আখ্যান। চিঠির মাধ্যমে কথক ও স্নেহার প্রেমের অংশটুকু নিশ্চিতভাবেই ঐ সময়ের মানুষদের স্মৃতিকাতর করে তুলবে আর বর্তমান প্রজন্মের মানুষদের আক্ষেপের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর সামরিক শাসন চলাকালীন সময়ের দেশের অবস্থা জানা যাবে বইয়ের বাকি অংশ থেকে। শাসকের নাম একবারও ব্যবহার না করে লেখক যেভাবে শাসককে চিহ্নিত করেছেন এবং সামরিক শাসনের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন সেটাও অসাধারণ। তাছাড়া শেষদিকে ক্রসফায়ারের ঘটনা উল্লেখ করে লেখক বইটাকে আরও সম্প্রসারিত করেছেন ; তিনি দেখিয়েছেন স্নেহাদের সাথের চিঠিযুগ শেষ হলেও আমিনুরদের মতো প্রতিবাদীদের সাথে ঘটা গুম, খুন এখনও চলছেই। আর এরই মাধ্যমে লেখক ইমতিয়ার শামীম কার্লোস ফুয়েস্তেসের মতে লেখকের দ্বায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। কেননা কার্লোস বলেছেন, ‘ পৃথিবীর প্রতিটা কোণে কল্পকাহিনী লেখকের যে দ্বায়িত্ব থাকে – বানানো কিছু চরিত্রের অবয়বের আড়ালে নিজের জীবদ্দশার সময়টাকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরা আর তার মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে অংশগ্রহণ করা।‘
এর আগে লেখকের ‘ আমরা হেঁটেছি যারা ‘ বইটা পড়েই লেখকের লেখনীতে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কেমন যেন একটা ঘোরলাগা গদ্য ব্যবহার করেন লেখক। ফলে কোনো কোনো বাক্য দুইবার পড়তে হলেও বইটা রেখে দেওয়া যায় না। এই বইটাও তেমনি। কিন্তু এই যে বিষাদময় সৌন্দর্য এর কারণ কি? এ বিষয়ে বিজ্ঞান কি বলে?!
✨"মা মরে গিয়ে তারা হয়ে যায়, বাবা মরে গিয়ে তারা হয়ে যায়, প্রিয়মানুষ মরে গিয়ে তারা হয়ে যায়, আর তুমি যদি তাকে সত্যিই ভালোবাসো, তা হলে রাতে আকাশের দিকে তাকালে দেখতে পাবে তাকে, দেখবে একটি তারা সবচেয়ে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে জেগে আছে আকাশে, তোমার দিকে তাকিয়ে আছে উজ্জ্বল চোখে। সেই এক উজ্জ্বল তারা দেখতে দেখতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি" . গল্পের সূচনা এক সাধারণ সন্ধ্যায়, মফস্বলের একবাড়ির বড়ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় সামরিক বাহিনী। সেই কাহিনী ছাপ ফেলে যায় কলেজ পড়ুয়া ছোটভাই'র মনে। সেই বড়ভাই যিনি কিনা তার অনুজদের চিঠি লেখানো শিখিয়েছিলো তার থেকে আর কোনোদিন চিঠি আসেনি কিংবা তাকেও আর চিঠি পাঠানো যায়নি।
কিন্তু চিঠিযুগ ফিরে আসে। কুউউ ঝিকঝিক ট্রেনে করে পাড়ায় নতুন আসা একটি মেয়ের হাত ধরে। তারপর ঋতু পরিবর্তন আর সময় পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে চিঠিযুগ।
সামরিক বাহিনীর পৈচাশিক দাবানল,উঠতি বয়সি দুই কিশোর কিশোরীর প্রেম, শহরের বুকে ধেয়ে আসা জলপাই উর্দির বাহিনী, মফস্বলের মানুষগুলোর গল্প, আর্মির অত্যাচারে শহিদ হয়ে যাওয়া প্রতিটি ছেলেদের পরিবারের গল্প; একেরপর এক মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় বইয়ের পাতায়। সাথে করুনভাবে সমাপ্তি ঘটে চিঠিযুগেরও। কিন্তু কেনো চিঠিযুগ শেষ হয়? কেনো ডাকঘরগুলো শুন্য থেকে যায়? কেনোই বা বাতাসে বিলীন হয়ে যায় চিঠিরা?
তারপর, হাতে ধরিয়ে দিয়ে যায় একরাশ শুন্যতা। গলার কাছাকাছি কিছু একটা আটকে গেলে যেমন অনুভূতি হয় সেরকম অনুভূতি হয়েছে বইটা শেষ করে।
"মানুষের সত্যিকার অনুভূতিরা কতো অসহায়,মানুষের সত্যিকার ভালোবাসাগুলো কত নির্জন" সবকিছু নির্জন হয়ে যায়, যেভাবে চিঠিযুগ আসে সেভাবেই নাই হয়ে যায়। প্রতিটা পাতা ছাপিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ ছিটকে পড়তে চাইছে__ "কেননা চিঠিযুগ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই, থেমে গেছে কুউউ ঝিকঝিক।" . . .
“দ্যাখো, মানুষের সত্যিকারের অনুভূতিগুলো কত নির্জন, সত্য��কারের ভালোবাসগুলো কতটা অসহায়।”
সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে এক মফস্বলের জীবনধারা নিয়ে লেখা কি দারুণ একটা বই। ছোট্ট একটা বই কিন্তু একেবারে হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, পড়া শেষেও থেকে গেছে এর প্রভাব। পুরো বই জুড়েই ছিল হাহাকার, বিষণ্নতা, হারানোর বেদনা, না পাওয়ার যন্ত্রণা, শূণ্যতা আর কিছুটা রসবোধ। নিঃসন্দেহেই নান্দনিক একটা বই এটা। মফস্বলের সদ্য যৌবনে পা রাখা একজন তরুণ, সামরিক বাহিনীর তার ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, শোক ভুলতে বন্ধুদের সাথে কাটানো সময়, হঠাৎ করেই আসা প্রেম আর হারানো ডাকবাক্সের খোঁজ-এই নিয়েই আমাদের চিঠিযুগ কুউউউ ঝিকঝিক।
আমরা পেয়েছি চিঠি না-পাওয়া রুক্ষ দুপুরগুলো চিঠি পাওয়া দুই অধৈর্য-হাতে ছিঁড়ে পড়া কৈশোর আমরা দেখেছি বিব্রত এক, পাংশুটে এক, শুকনো মানুষ মানিঅর্ডারের কুশল-কুপনে মিথ্যুক ঠিকানা আমরা শুনেছি শেষ ট্রেন চলে গেলে চিঠি না-পাওয়া মায়েদের মতো বৃষ্টির কান্না...
বইটা শেষ করার পর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। এটা কী পড়লাম আমি! ইমতিয়ার শামীম যেন কোনো জাদুর কলমে লিখেছেন এই বই। বারবার তলিয়ে যাচ্ছিলাম সেইসব চিঠিযুগে। বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম শীতের সকালের কুয়াশাঘেরা ডাকঘর কিংবা ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা, সামরিকজান্তা নামক আতংক নামা এক মফস্বলে।
চরিত্রগুলোর সাথেসাথে আমিও হাঁটছিলাম,ব্যথা পাচ্ছিলাম আবার কখনো জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ হোচট খেয়ে ঠের পেলাম,যাত্রা শেষ। আমাকে ফাঁকা স্টেশনে একা দাঁড় করিয়ে রেখে সমস্ত চিঠি,আড্ডা, গান যেন শেষ ট্রেনে উঠে চলে গেছে একেবারে। আর তখন... অদ্ভুত এক মুগ্ধতা,যাত্রাটা আরেকটু দীর্ঘ না হওয়ার আক্ষেপ আর বুক কেমন করা একটা অনুভূতি... ঘিরে ধরেছিল আমাকে।
পুরোটা পড়েছি আর ইউটিউবে চলছিল ৭০-৮০-৯০ এর দশকের পুরনো সব বাংলা গান। এই বইটা সেই গানগুলোর মতো। অনেকখানি নস্টালগিয়া এমন এক সময়কে নিয়ে যে সময়ে আমি ছিলামই না, অনেক খানি কষ্ট, সরলতা, কিছুটা হাহাকার, কিছু নিষ্পাপ আনন্দ রেখে গিয়েছে এই বই। খুব সহজ করে যদি বলি, বইটা নদীর মতো। খুব শান্ত একটা নদী। যে দুপারের ভাঙা গড়া, দুপারের বদলে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থেকে যায় একা। একটা বিষণ্ণতা, একাতীত্বে ফেলে দিয়েছে বইটা। জীবন এত কষ্টের কেন?
অনবদ্য লিখিয়ে ইমতিয়ার শামীমের এই উপন্যাসটি সেই নিকষকালো সময়ের দলিল, যে সময়কে আমরা মনে রাখতে চাইনা। যে সময়ের কথা উঠলে নিজেরা আবিষ্কার করি আমরা তো স্মৃতিভ্রষ্ট। কিংবা এই উপন্যাস নিছক দুই টিনেজের প্রেমোপাখ্যান!
এক মফস্বলের আশির দশকের গল্প এটি। উঠতি কলেজ পড়ুয়া উপন্যাসের কথক। সে বসে আছে রেল স্টেশনের পাইপে। ভাবছে তার বড় ভাইয়ের কথা। যাকে জলপাইবাহিনীর সদস্যরা ধাক্কাতে ধাক্কাতে তুলে নিয়েছে নিজেদের জলপাইরঙা গাড়িতে। তারপর হয়ত হারিয়ে গেছে নির্যাতনের ঘাঁটিতে। যেখানে গেলে কেউ আর ফেরেনা। এসব ভাবতে গিয়ে সে খুঁজে পায় এক বৃদ্ধকে। যে তার কাছে রেলের পাইপে বসে থাকার কারণ জানতে চায়। হঠাৎই মনে হতে থাকে, " মৃত্যু যেমন একদিন বলা নেই কওয়া নেই হুট করে করে আসবে, আর্মিও তেমনি হঠাৎ একদিন আমাদের দরজায় এসে দাঁড়াবে, বলবে, আমাদের সঙ্গে একটু ক্যাম্পে যেতে হবে। তারপর একজন মানুষ তোমার দৃশ্যপট থেকে চিরদিনের মত উধাও হয়ে যাবে। "
এসব হক-নাহক ভাবনায় দোল খেতে খেতে আবিষ্কার করবে কথক সে ট্রেনের কুউউ ঝিকঝিক শব্দ শুনছে। অথবা সবাইকে সমান করতে চাওয়া তৌফিকুর রহমানের ছেলেটাকে ধরে নিয়ে যাবে জলপাইবাহিনী। এটি সেই সময়ের কথা, যখন উর্দিনায়কের শাসনে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহে হয়ে গেছে ডাল-ভাত। সেনানায়ক স্বর্গ -মর্ত্য-পাতাল খু্ঁজে ফিরছেন বিদ্রোহের গন্ধে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন হাজারো নিরপরাধ সৈনিককে। এমনই সময় বগুড়া আর রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা সিপাইকে আশ্রয় দিয়েছিল তৌফিকুর রহমানের ছেলে। বাবা বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। স্বজনকে বাহিনী অবাক কন্ঠে জানায়, " কী বলছেন? আমরা তো কাউকেই ধরে আনিনি। দাঁড়ান-দাঁড়ান, ব্যাপারটা তো খোঁজ নিতে হয়।" উপরের লাইনগুলোর সাথে বর্তমান কোনো বাহিনীর মিল নিঃসন্দেহে আপনার উর্বর মস্তিষ্কজাত কল্পনা। ইমতিয়ার শামীম তো সেনাশাসনের কথা লিখেছেন।
এদিকে কলেজে পড়ুয়াদের এক গল্প আছে। সেই গল্পের টিনেজদের ভাবনাজগৎ আর কীর্তিকলাপ কলেজপাশ করে ফেলেছেন এমন পাঠকদের নস্টালজিয়াতে ভোগাবে।
"শালাকীর্ণ" তোফাজ্জল সাহেবের বাসায় ভাড়াটে হিসেবে আসে স্নেহারা। উপন্যাসের কথকের প্রতিবেশী হবার সুবাদে স্নেহার সাথে আলাদা সম্পর্ক গড়ে উঠে উপন্যাসের কথকের বোনের অন্তরার। এদিকে কথক নিজেও বহুদিন পর ক্লাসে গিয়ে দেখেন প্রতিবেশী মেয়েটি তারই ক্লাসে পড়ে! বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি চলছে। চলছে টিনেজকালের নিত্যনতুন ঘটন-অঘটন।স্নেহার সাথে কথকের চিঠিযুগের সূচনা হয়। সেই চিঠির ডাকবাক্স এক অলীককল্পনা। ডাকহরকরা বয়ে আনে অনিন্দ্যসুন্দর সব চিঠি।
মফস্বলে সেনাশাসক আবির্ভূত হবেন। জান্তার পা চাটা একদল যুবকেরও আবির্ভাব হয়ে যায়। উর্দিশাসকের যোগ্য পবিত্রতম শহর উপহার দিতে জানপ্রাণ দিয়ে কাজে নেমে পড়ে। দোকানগুলো হয় তাদের ফ্রি খাইয়ে জোস জিইয়ে রাখার আসলি দাবিদার। স্নেহা, যে স্নেহা রবীন্দ্রসংগীত গায়। সে সেনাশাসকের উদ্দেশে গাইবে বলে ঠিক হয়। মানতে পারেনা কথক। স্নেহা চিঠিযুগের ডাকহরকরাকে দিয়ে চিঠিতে জানায়, " কোনও কোনও সুন্দর জিনিস অসুন্দর মানুষদের জন্য নষ্ট হয়ে যায়। যেমন,চিন্তা কর, প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, সুন্দর এই গানটি নষ্ট হয়ে গেছে, এখন গানটি শুনলে মনে হয় নর্তকী হেলেন ক্যাবারে নাচছে আর গান গাইছে। "
এরইমধ্যে কলেজেপড়ুয়া এই ছাত্রদের পরিকল্পনা, " আমাদের সামরিক জান্তার ছবি আ্যামবুশ করা গেঞ্জি। খাল কাটতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে তিনি কোদাল হাতে বিশ্রাম নিচ্ছেন।গেঞ্জিটার পেছন দিকে আমরা থাউজেন্ড পাওয়ারের লাল কালি দিয়ে লিখব 'এখানে প্রস্রাব করুন'।"
সেনানায়ক তার সফরসূচি সীমিত করে চলে যান আসল গন্তব্য ক্যান্টনমেন্টে। এদিকে স্নেহা আর কথকের মধ্যে গড়ে উঠছে থাকে সুন্দরতম এক সম্পর্ক। মফস্বল, বৃষ্টিতে রিকসায় ঘোরা আর তারপর একদিন চিঠিযুগের সমাপ্তি।
ইমতিয়ার শামীম লিখেন অসাধারণ। বিগত সেনাশাসনের ছবিকে এতটা চিত্রময়রূপে উপস্থাপনের মুন্সিয়ানা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। লেখক নির্দিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাস করেন। তা গোপন করতে চাননি। তবে এদেশের এসব অশুভ শক্তির উত্থানকে কেন যেন এড়িয়ে গিয়েছেন। ভারতবিরোধীতার সেনাশাসকেরর কৌশলের কথা বলেছেন। কিন্তু এই কৌশল হালে পানি কেন পেল তার সুলুকসন্ধান লেখায় নেই। থাকলে আরো পূর্ণতা পেত। আর হ্যা, ইমতিয়ার শামীম উপন্���াসের ব���স্তবমুখীতাকে বিশ্বাস করেন, প্রবলভাবে লেখাকে করেন রাজনীতিকায়ন। উদ্দেশ্য, সময়-কাল সচেতনতা সৃষ্টি । যে জেনারেলের শাসনের কথা তিনি লিখলেন এখানে ইমতিয়ার শামীমের বড় সাফল্য একটি বারও তার নাম ঔপন্যাসিককে নিতে হয়নি। অথচ যেকোনো পাঠককই বুঝবেন কার কথা বলা হচ্ছে। মাঝে উপন্যাসটা কিছুটা ঝুলে পড়েছিল বলে মনে হচ্ছিল। তবে গতি থামেনি।
❝ক্রসফায়ারে একজন ���ারা গেছে। কেননা ক্রসফায়ারেই মারা যেতে হয়। কেননা ক্রসফায়ারই গন্তব্য আমাদের সকলের। আমি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করি, আরও এক বড়ভাই মারা গেল হয়তাে। হয়তাে আরও একটি রূপকথা লেখা হলাে।❞
বিষন্নতায় ঘোর লাগা অদ্ভুত সুন্দর এক আখ্যান। তীব্র অনুভূতি যেখানে বুকে চেপে বসে, প্রতিক্রিয়া ভাষাহীন হয়ে যায় প্রকাশ হয় শুধু অনুভূতিতে, নিজের ভেতরে।
বই খুলে উৎসর্গ পত্রটুকু পড়েই মনে হয়েছিল - এই বইটি বোধহয় ভাল লাগবে। মিথ্যা হয়নি অনুমান। ইমতিয়ার শামীমের লেখা আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক বহু বহু বছর পর ভেতরে একটা পুরনো ভালবাসার ঢেউ তুললো।
বাংলা বই পড়া হয়না অনেকটা সময়।পড়লেও পুরনো। কি মনে করে এই বইটা হাতে নিয়েছিলাম কে জানে। কিন্তু শুরু থেকে এক মোহে ডুবেছিলাম। কাহিনীর থেকে বেশি হয়তো আমাকে টেনেছে লেখা। আজকাল সবার লেখায় ক্যাজুয়াল ভাবটা বড্ড বেশি। ইমতিয়ার সাহেবের লেখা সেদিক থেকে মুক্ত। কেমন যেন একটা গভীরতা রয়েছে। গল্পের দিনকাল যেমন চিঠি যুগকে ঘিরে গড়েছে তেমনি লেখার ধরণ ও। শুধু কিছু বাক্য অত্যাধিক লম্বা, কমা চিহ্নের হয় বেশি নয় কম ব্যবহার গুলো খুব চোখে লাগে।
নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া আমি কিছুটা হলেও চিঠির স্পর্শ পেয়েছি। ডাকটিকিট সংগ্রহ এর ছোট কয়েকটি লাইন একটানে যেন ছোটবেলার সেই কথা মনে করিয়ে দিল। 'সত্যিকারের ভালবাসাগুলো কত নির্জন' - আসলেও তো তাই। পরতে পরতে থাকা গোপন মায়া কেমন কুউউ ঝিক ঝিক করে বেড়িয়ে আসে বই পড়তে গিয়ে।
'তারপর আবার আমাদের চিঠিযুগ ফিরে আসে। চিঠিযুগ ফিরে আসে অনবচ্ছিন্ন কুয়াশার মধ্য দিয়ে, চিঠিযুগ ফিরে আসে শিশিরভেজা পথের মধ্য দিয়ে।'
সামরিক শাসনের করাল থাবায় হারিয়ে ফেলা বড় ভাই কে মনের ভেতর নিয়ে বড় হওয়া প্রটাগনিস্ট কে এক চেনা মফস্বল শহরে ঘুরতে দেখি। আসে প্রেম, আসে চিঠি, আসে বন্ধু - অবন্ধু। একদিন মফস্বলি নিয়ম রক্ষা করে কথার কানাঘুষোতে প্রেম ঠিকানা বদলায়, অভিজাত হবার দৌড়ে কুউউ ঝিকঝিক শব্দ তোলা বিশাল রেলগাড়িটাও সড়বার পথ খুঁজে। আকাশে চিঠি উড়ে, ক্রসফায়ার হয় স্বাভাবিক শেষ গন্তব্য।
এক একটা দীর্ঘশ্বাস এর গল্প বড় অদ্ভুত কিন্তু অনেক গভীর।
ইমতিয়ার শামীমের লেখার সাথে পরিচয় এই প্রথম। কোথাও কোথাও অগোছালো লাগলেও, অসম্ভব সুন্দর অনেকগুলো কথা নিয়ে এই বইটা। বইয়ের অর্ধেক লাইনই হাইলাইট করে রেখেছি। বই শেষ হবার পরে সেগুলোতে চোখ বুলিয়েছি।
বইটার সময়কাল আশির দশক অর্থাৎ এরশাদ বা সামরিক শাসনের আমল। এই সময়টা নিয়ে আমি কিছুই জানতাম না। পুরো শূন্য। জানার জন্যই মূলত বইটা পড়া। মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেছি কতটা ভয়ংকর ছিল অবস্থা। তবে আমি আরেকটু বৃত্তান্ত আশা করছিলাম সময়টা নিয়ে।
বইয়ের শুরুতেই বুকটা চেপে আসে। একজন আশির দশকের কলেজ পড়ুয়া ছেলের গল্প। কে বা কারা তার ভাইকে আর্মি ভ্যানে করে তুলে নিয়ে গেছে। সে জানে আর্মি ভ্যানে তোলা হলে আর কেও ফেরত আসে না। তার ভাই আর আসবে না। এইত গল্পের সূত্রাপাত। এভাবেই শীত,বসন্ত আর বর্ষার সাথে এগিয়ে যায় হাজার হাজার চিঠি আর গল্প। চিঠিযুগ বিলুপ্ত হওয়ার আগে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় কতগুলো ঋতু চলে যায়।
বইটা পড়ার সাথে সাথেই চিঠি লিখতে হাত নিশপিশ করছে। চিঠির প্রতি দূর্বলতা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। সাদা কাগজের কলো দাগই বোধহয় আমাদের মনের কথা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে। আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক'এর সাথে আমাদের চিঠিযুগ ফিরে আসুক।
"দ্যাখো, মানুষের সত্যিকারের অনুভূতিগুলো কত অসহায়, মানুষের সত্যিকারের ভালবাসাগুলো কত নির্জন।"
গুডরিডে এই বইটার এতো-এতো ভালো রিভিউ দেখে অনেক খুঁজে পিডিএফ বের করে পড়লাম আর তাতেই মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠার বই এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো, কিংবা শেষ হবার আগে আমাকে এতো বিষন্ন করে দিলো। লেখক নিজের মুখেই পুরো গল্প বর্ণনা করে গেলেন- চিঠি দেয়া-নেয়া, শিশিরঝরা সকাল আর কুয়াশা ঢাকা ডাকঘর, রেলষ্টেশন, জলপাই রঙের উর্দি, অমানবিক ক্রসফায়ার এবং একটা হারিয়ে যাওয়া প্রথম প্রেমের গল্প। স্নেহার যাবতীয় চিঠির বাতাসের উড়ে যাওয়ার মতোই আমাদের সত্যিকার প্রেমগুলো উড়ে যায়, কাকভেজা বৃষ্টিতে হুডতোলা রিকশা হারিয়ে যায়, অনেক কুয়াশাভেজা সকালেও আর তাকে ফিরে পাওয়া যায় না। কারো বড়ভাই কিংবা কারো বাবা বা আত্মীয়কে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কিংবা কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃত দেখানো হয়, এরাও আর এই গণতান্ত্রিক দেশে ফিরে আসে না। আসে না নতুন কোনো ট্রেন কিংবা বসন্তের রোদে ঝলসানো আরেকটা হলুদ খাম।
কেননা আমাদের চিঠিযুগ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই, থেমে গেছে কুউউ ঝিকঝিক।।
"মানুষের সত্যিকারের অনুভূতিগুলো কত অসহায়, মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো কত নির্জন।"
লেখককে অজস্র ধন্যবাদ এই বিষন্ন সুন্দর বইটার জন্য। আর এরকম বর্ষার দিনে ঘরে বসে এটা পড়ে ফেলবো একদিনেই সেটা আগে ভাবিনি। এখন মনে হচ্ছে এতদিন এটা না পড়ে জমিয়ে রেখে এই যে এরকম মন খারাপ করা দিনে পড়ে যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে সেটা হয়তো অন্যসময় পড়লে কখনো হতো না বা কি জানি হয়তো হতো!
মাথা ফাকা হয়ে গিয়েছে। এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় মনটা ভরে গিয়ছে বইটা পড়ে। এক জন্য মনটা খারাপ হল? আমিনুলের জন্য? স্নেহার জন্য? নাকি হারিয়ে খোঁজা মূল প্রটাগনিস্টের জন্য? জানি না। আর এই না জানাটাই সম্ভবত ভালো লাগার অন্যতম কারণ। ইমতিয়ার শামীম যেভাবে প্রতিটা বইয়ে মনের অনুভূতিগুলো নিয়ে খেলেছেন । শুধু একটা কথাই বলত হয় "আহা... মধু মধু।" "আমরা হেঁটেছি যারা" পড়ার পর যেই ভালো লাগার অনুভূতি হয়েছিল এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। একটা চিঠির জন্য হাহাকার? একজ স্নেহার জন্য হাহাকার? কিন্ত চিঠিযুগ যে অনেক আগেই শেষ। এক অদ্ভুত মন খারাপ করা নিয়ে শেষ হল "আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক "
রেটিং দিয়ে এই বইয়ের প্রতি ভালো লাগার আসল মাত্রা বুঝানো যাবে না। তবুও দিলাম। না হলে মানুষ জানবে কি করে এই বই সম্পর্কে ?
বইটা সুন্দর। অনেক সুন্দর। কিন্তু কিছু জিনিস আমার ভালো লাগেনি, সেজন্য এক তারা কম। যেগুলো ভালো লেগেছে সেগুলো বলি। আমাদের পরিবারে বা সমাজে কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা তার চারপাশের মানুষের উপর অনেক প্রভাব বিস্তার করে। তাদের চারপাশের মানুষগুলো তাদের উপর একটা আলাদা আস্থা, বিশ্বাস, ভালোলাগা নিয়ে তাদের সাথে থাকে, তাদেরকে সমীহ করে চলে। এই মানুষগুলো সবার খুব কাছে থেকেও কেমন যেনো একটা দূরত্ব নিয়ে থাকে। এমনই একজন মানুষ হলো মার্ক্সস এর বড় ভাই। সে হাড়িয়ে যায়, জলপাই রঙের কালো অন্ধকার তাকে বাসা থেকে নিয়ে গিয়ে আকাশের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র বানিয়ে দেয়। জানলা খুলে তাই মার্ক্সস প্রায় তার হারিয়ে যাওয়া ভাইকে দেখে, আকাশের দিকে তাকিয়ে। শূণ্যে ঝুলে আছে তার বড় ভাই, হয়তো মিটিমিটি হাসছে, নাকি কাঁদছে? মার্ক্স এর বড়ো ভাই ছিলো তার জীবন বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু। ঐযে বললাম কিছু কিছু মানুষ তার চারপাশের মানুষকে খুব প্রভাবিত করে ফেলে, মার্ক্স এর বড় ভাইও তার জীবনে খুব বড়ো প্রভাব ছিল। এমন একজন মানুষের হঠাৎ হাড়িয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারে না মার্ক্স। কষ্ট আর বিষাদের মাঝে ডুবে থাকা মার্ক্স এর বাড়ির ঠিক সামনের বাড়িতে আসে স্নেহা। স্নেহার রূপে যখনে অর্ধেক পাড়া পুরে যাচ্ছিলো তখনও মার্ক্স জানতে পারেনা যে তার বাড়ির সামনেই বসবাস করে সেই মেয়ে। একই কলেজে পড়া সেই মেয়ের সাথে কথা হয় না তার, দেখা হয়, তার বোনের সুবাদে তাদের বাড়িতে স্নেহার আগমনের জন্য। স্নেহার অস্তিত্ব তার বুকে গেথে থাকে স্নেহার সাদা শেলোয়ার কামিজ পড়া শরীর থেকে বেরিয়ে আসা বেলী ফুলের সৌরভে অথবা খুব রাত্রে বারান্দায় আবছা আলোয় নিরবে হেটে যাওয়া স্নেহার অবয়বে। একদিন শীতের সকালে কুয়াশার চাদরের নিচে তাদের হঠাৎ দেখা হয়, ধাক্কা লাগে। দুজন অপরাধী হয় দুজনের কাছে। দুজনের কথা হয়। খুবই অল্প। তারপর কুয়াশার ডাকঘরে তাদের চিঠি পরে রোজ। কলেজ পড়ুয়া দুই যুবক যুবতীর বুকে প্রেমের ফুল ফুটে ওঠে, কিন্তু গন্ধ রয়ে যায় দুটি হৃদয়ে। এ গন্ধ ছড়ানো যাবে না, এ গন্ধ ছড়িয়ে গেলে মফস্বলে বেচে থাকা মুশকিল, এ গন্ধে কেপে উঠবে মফস্বলের প্রতিটি বাড়ি, দালান, ইট হয়তো প্রতিটি বালুও। খুব সঙ্গোপনে চলে তাদের প্রেম। একসময় কুয়াশার ডাকঘর মিলিয়ে যায় বসন্তের ঝড়ে পড়া পাতার গন্ধে। তখনও অনেক কষ্টে চলে তাদের চিঠির লেনদেন। এভাবেই চলে আসে বর্ষা। বর্ষার এক ঝুম ধরা বৃষ্টিতে রাস্তায় দাঁড়ানো মার্ক্স কে স্নেহা উঠিয়ে নেয় রিক্সায়। দেখে ফেলে ওর সকল বন্ধুরা, ওরা এক রিক্সায়। এক ঘন্টার জন্য ভাড়া নিয়ে নেয় স্নেহা। সেদিনের বৃষ্টি সাক্ষী হয়ে থাকে তাদের প্রথম চুম্বনের। তারপর হাড়িয়ে যায়। সব। প্রথম প্রেম, স্নেহা, সকল বন্ধু, চিঠিযুগ, শেষ রাতে ফিরে চলা ট্রেনের কু ঝিক ঝিক। তবুও জীবন বয়ে চলে মার্ক্সস। মাঝে মাঝে সে ফিরে আসে তার মফস্বলে। মার সাথে দেখা করে। বাড়ির সামনের স্নেহাদের বাড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে নতুন বাড়ি, তবুও এ বড়িতে যেনো এখনো চুরি হয়ে যাওয়া কিছু টুকরো জীবন মার্ক্সস কে হাত ইশারায় ডকে। শেষ রাত্রে ট্রেনের কু ঝিক ঝিক মার্ক্স এর বুকে কিসের যেনো একটা দাগ দিয়ে যায়। আকাশের দিকে তাকালে সে এখনো একটা তারা খুব জ্বলজ্বল করে জ্বলতে দেখে, সেটা তার বড় ভাই, স্নেহা নাকি বাবা সে সেই প্রশ্ন করে যায়। উত্তর পায় না। সামরিক জান্তা, সেই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে প্রায় সবাই বলেছে, তাই আমি আর বললাম না।
সত্তরের দশক, সামরিক শাসনের পটভূমিতে ষোলো সতেরো বছর বয়স হবে এমন একটা ছেলের দুঃসহ জীবনের কাহিনী "আমাদের চিঠিযুগ..."। এমনিতে ঔ বয়সের ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে স্পর্শকাতর, তারসাথে যুক্ত হয়েছে ছেলেটার পারিবারিক জীবনের ট্র্যাজেডি।
এই নিয়ে ইমতিয়ার শামিমের দুটো উপন্যাস পড়া হলো। "আমরা হেঁটেছি যারা"র প্রধান চরিত্রের জীবনটাও ছিল টালমাটাল, তবে সেই উপন্যাসটা ছিল গতিময়, এখানে প্রধান চরিত্র একটা দমবন্ধ সময়ে আটকে আছে, মানসিকভাবে একের পর এক মার খেয়ে যাচ্ছে।
বইটি নিয়ে রিভিউ দেয়ার মত আসলে কিছু নেই।গুডরিডসে অনেক সুন্দর রিভিউ পাওয়া যাবে বইটি নিয়ে।আমি শুধু একটা কথাই বলব যখন উপন্যাস টি পড়ার রেশ কেটে যাবে তখনই আবার পড়তে হবে,এর রেশ কাটতে দেয়া যাবে না।এক বিষন্ন রকমের মন কেমন করে উঠার মতন লেখা। অনেক হট্টগোল এর মধ্যে আপনাকে একদম একা করে দিবে, মাথার ভেতর শুধু বড়ভাই, অঞ্জন,অন্তরা, স্নেহা এদের আওয়াজই আপনি শুনতে পাবেন, আর সব কিছু ঘোলাটে।