হুমায়ুন আজাদ। কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষণ, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, উপন্যাসিক, কলামিস্ট, কিশোর সাহিত্যিক, প্রথাবিরোধী এরকম নানা উপাধিতে পরিপূর্ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু মৌলি আজাদের কাছে লেখক হুমায়ুন আজাদ কেবল দেশবরেণ্য একজন ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন খুব কাছের একজন মানুষ। তিনি মৌলি আজাদের বাবা। বাবাকে নিয়ে মৌলি আজাদকে যে কখনও লিখতে হবে হুমায়ুন-তনয়া তা ঘূণাক্ষরেও ভাবেননি, কারণ এ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে (জীবিত অবস্থায় ও মৃত্যুর পর) লেখা হয়েছে হাজার হাজার পাতা। মৌলি আজাদ নিজেও বিভিন্ন সময় নানা পত্রিকায় তার বাবাকে নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে লিখে তাঁর নিবিড় অনুভূতি প্রকাশ করেছেন-কিন্তু হুমায়ুন আজাদ ভক্তদের সেইসব ছোট ছোট লেখা পাঠ করে তৃষ্ণা মিটেনি যেন। প্রথাবিরোধী ও জীবিতকালে সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানকারী প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদের ভিতর-বাহির জানার জন্য লেখিকার পাঠকবৃন্দের কাছে সকল সময়ের দাবি এই অসামান্য লেখককে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই প্রকাশের। পাঠকদের সেই দাবি পূরণ করার জন্যই মূলত মৌলি আজাদের এই লেখার প্রয়াস। লেখিকার আশা, বাবাকে নিয়ে কন্যার লেখা এই বইয়ে পাঠক আবিষ্কার করবে এক অনাবিষ্কৃত লেখক হুমায়ুন আজাদকে।
হুমায়ুন আজাদের লেখা এবং চিন্তা বিস্ময়কর রকমের শক্তিশালী, অন্তত আমার তাই মনে হয়। মানুষটাকে আরেকটু ভালোভাবে জানার ইচ্ছে ছিল। সৌভাগ্যক্রমে তার কন্যা মৌলি আজাদের এই বইয়ের সন্ধান পেলাম, তাই দ্বিতীয় চিন্তা না করেই পড়া শুরু করেছিলাম। যেমন প্রত্যাশা করেছিলাম ঠিক তেমন একটা বই।
বইতে লেখিকা তার পিতার জীবনাচরণকে তুলে ধরেছেন পরম মমতায়। তার প্রাত্যহিক দিনলিপি কেমন ছিল সেখান থেকে শুরু করে তার নিজের বিশ্বাস, লেখার দর্শনের পেছনের যুক্তিগুলো উঠে এসেছে বইতে৷ বড় একটা অংশজুড়ে ছিল ছেলেমেয়েদের সাথে তার স্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে৷ লেখিকার ভাষ্য, "তিনি আমাদের ছোটবেলা থেকে সব কাজ শেখাতেন, যেমন বাজার করতে নিয়ে যেতেন। কীভাবে জিনিষপত্র দরদাম কিংবা রিক্সা ভাড়া ঠিক করতে হয় তাও শেখাতেন।" আরেক জায়গায় লিখেছেন, "তার সময়জ্ঞান ছিল অত্যন্ত প্রখর। যেকোন অনুষ্ঠানে তিনি ঘড়ির কাটা ধরে যেতেন। সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তাম তার সাথে কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে। দেখা যেত আমরা সবার আগে উপস্থিত, আর কেউ নেই।" আসলেও তেমনটাই হওয়ার কথা। টাইম মেইন্টেইন না করলে তিনি কি এত বড় লেখক হতে পারতেন?
অবধারিতভাবে লেখকস্বত্তার কিছু কিছু দিক-ও ওঠে এসেছে- "মাঝে মাঝে একলা দাড়িয়েছি বাড়ির উত্তর দিকে, ভেবেছি কোথায় যাব? দেখতে পাইনি তবে মনে হয়েছে অনেক দূর যেতে হবে।" আরেকটা কথা না বললেই নয়, নারীবাদ, ধর্মীয় বিশ্বাসসহ কিছু বিষয় নিয়ে লেখার কারণে তার কিছু বই এদেশে প্রচন্ড বি*ত*র্কি.ত। হুমায়ুন আজাদ সে ব্যাপারে বলেছেন, "এসব বলতে সাহস লাগে। আমার তো কারো কাছে কিছু চাওয়ার নেই, আমি যা হব/করব, তা নিজেই করব। একারণে কাউকে তোয়াক্কা করি না।" আরেকটা কথা জানলাম হুমায়ুন আজাদ নিয়ে, তার মতে, "লেখক হওয়াটাকে আমি খুব বেশি বড় ব্যাপার মন করি না, অনেকেই তো লিখতে পারে৷ আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি গভীর উপলব্ধিবোধ ও সৌন্দর্যচেতনাকে, আর তা প্রকাশের জন্যই আমি লিখি।" তার লেখা, বিশেষ করে কবিতাগুলো পড়লে আমার মনে হয়না এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করবেন। এতো সুন্দর কবিতাগুলো!
আরেকটা ব্যাপার ইন্টারেস্টিং লাগলো, স্ত্রীর সাথে হুমায়ুন আজাদের পরিচয়। বই থেকে একটা অংশ তুলে ধরছি- "১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসে পড়ার সময় আমার মা বাবার প্রথম পরিচয় হয়। মা-র কাছে শুনেছি, তিনি(আজাদ) নাকি ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তার সাথে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। মা'র হোস্টেলের বাইরেও ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতেন। বাবা নাকি তাকে পাবার জন্য পুরোপুরি পাগল ছিলেন। তবে একারণে পড়ালেখার প্রতি অবহেলা করেননি বিন্দুমাত্র। ক্লাসের সবচেয়ে তুখোড় ছাত্র ছিলেন। মা-কে বিয়ে করার জন্য বাবাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৭ বছর।" একটু হাসিই পেল এটা ভেবে যে, এই প্রচন্ড প্রতিভাধর মানুষটাকেও এসব ডিউটি পালন করতে হয়েছে। ভাবা যায়, হুমায়ুন আজাদ লেখালেখি না করে গার্লস হোস্টেলের সামনে চা-এর কাপ হাতে উঁকিবুকি দিচ্ছেন!
যাহোক, বইয়ের শেষ অংশটা কিন্তু বেদনাদায়ক। রাজনৈতিক প্র#তি হিংসা_র শিকার হয়ে বইমেলায় তার উপর নৃ.শং.স হা#ম.লা, ছেলেকে অপ.হর#ণের পর প্রধানমন্ত্রী উদ্দেশ্যে তার অসহায়ত্বমাখা চিঠি, আর জার্মানীতে তার উপর হ.ত্যা.কা*ন্ড নিয়ে পরিবারের যন্ত্রণাময় সময়ের কথাও মৌলি আজাদের লেখায় ফুটে এসেছে। খারাপ লাগল অনেক। একটা আফসোস রয়ে গেল।
লেখিকাকে ধন্যবাদ দিব হুমায়ুন আজাদ নিয়ে আরো ভালোভাবে জানার সুযোগ করে দেবার জন্য। আর আপনাদের সবাইকে বইটা পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি..