টেস্টে তার এক ইনিংসে ৫ উইকেট নেই। ওয়াসিম, ম্যাকগ্রার মতো শত শত উইকেট নেই তার। ব্রেট লি, শোয়েব আখতারের মতো গতিদানব নন তিনি। তাহলে তিনি কে? তিনি মাশরাফি বিন মুর্তজা। ক্রিকেটের পরিসংখ্যান, স্পিড গানের হিসাব দিয়ে যাকে চেনা যাবে না। কাগজ-কলম আর বই খুলে যাকে চিনতে পারবেন না। শুধু টেলিভিশন আর ছাপার অক্ষর যার পরিচয় দিতে পারবে না। সেই মাশরাফি বিন মুর্তজা। মাশরাফি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার। এই দেশের প্রথম গতিতারকা। মাশরাফি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়কের একজন। মাশরাফি দেশের ক্রিকেটারের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার নাম। ক্রিকেটার কেবল নয়; কোনো জাতির ইতিহাসে এমন মানুষই আসে শতবর্ষের আরাধনায়। মাশরাফি হলো গ্রিক ট্র্যাজেডি আর ভারতীয় রোমান্টিকতার মিশেলে এক মহাকাব্য। এমন মহাকাব্যকে ধরতে পারতেন মহাকবি হোমার বা মহাঋষি বেদব্যাস। মহাকবি বা মহাঋষি নয়, নিতান্ত এক কলম-শ্রমিকের লেখায় বই- মাশরাফি।
বইটা নিয়ে কিছু লিখে ফেলার আগে মাশরাফি কে নিয়ে কিছু লেখা উচিত। আমি এখন অত আর খেলা দেখি না। বাংলাদেশের খেলা হলে দেখি। তাও সবসময় খেয়াল থাকে না। আসলে আগে স্কুল কলেজ লাইফে যে সময়টায় খেলা দেখতাম তখন বাংলাদেশের খেলা দেখতে বসলে অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে পরতাম এবং খেলার মজা থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাপারটা অতি আবেগে পরিনত হত। এজন্য পরে ধীরে ধীরে খেলা দেখা কমিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশের খেলা হলেও প্রতি বল ধরে খেলা দেখি না।
কিন্তু ঘটনা সেটা না। ঘটনার শুরু আমার খেলা পাগল সময়টাতেই। যেসময়টাতে ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনার শুরু তখনকার সময়কার হিরো ছিলো আকরাম,বুলবুল,নান্নু এনারা। কিন্তু যখন থেকে আসলে খেলাটা বোঝার চেষ্টার শুরু এবং সিরিয়াসলি নিতে শুরু করি সে সময়টাতেই মাশরাফির আবির্ভাব। খেলাদেখার শুরুর সময়ে বাংলাদেশের একমাত্র ফাস্ট বোলার হিসাবে জানতাম হাসিবুল হোসেন শান্ত কে। এরপর তার ইনজুরিতে পরে মাঠের বাইরে চলে যাওয়া এবং একটা লম্বা সময় জুড়ে পেসার এবং ফাস্ট বোলারের শূন্যতা। এমন সময়েই মাশরাফির আবির্ভাব। এবং শুরু থেকেই মাশরাফির আমাদের তরুনদের হিরো হয়ে উঠতে শুরু করা।
বইটা আসলে আমার কাছে আমার সেই ক্রিকেট পাগল সময়টারই যেন ফ্ল্যাশব্যাক! অদ্ভুত সেই সময়টা এক এক করে চোখের সামনে আসতে থাকা। যেই ফ্ল্যাশব্যাকের প্রধান চরিত্র মাশরাফি।
দেবব্রত চৌধুরীর লেখার ধরনে বোঝাযায় যে তিনি বেশ আবেগ নিয়ে লেখেন। তাই বইয়ের পাতায় পাতায় ইমোশন জড়ায়ে আসে। কিন্তু সাথে সাথে নির্মোহ তথ্য তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি তার আবেগকে পরিপূর্নতা দেন।
এসব কিছুর বাইরে ব্যাক্তি মাশরাফি,খেলোয়াড় মাশরাফি,ক্যাপ্টেন মাশরাফি, নেতা মাশরাফি, দেশপ্রেমিক মাশরাফি এসব নিয়ে রিভিউতে লিখতে গেলে পুরো বইয়ের আর কিছু বাকি থাকবে না। তাই এগুলো পাঠকের হাতে ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়।
খালি এটুকু বলতে পারি যে পুরো বইটা খেয়ে না খেয়ে এক বসায় শেষ করবার মতন একটা বই। কোথাও এক নিঃশ্বাসের জন্যও আটকায় না। শুধু কখনো কখনো পাঠক হিসাবে উত্তেজনার সঙ্গী হতে হয়, কখনো মাশরাফির কষ্টে বুক ভারি হয়ে আসে, কখনো তার কথায় গর্বে বুক দুহাত ফুলে যায় আর কখনো বা তার পরিনত চিন্তাভাবনার কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।
শুধুমাত্র জীবনের এখনো অর্ধেকটা বাকি থাকতেই তার জীবনী লিখে ফেলার দোষে বইয়ে এক তারা কম দিলাম! :P
মাশরাফি! আমাদের রূপকথার নায়ক!! আমাদের ক্যাপ্টেন!!
ব্যক্তি মাশরাফির চাইতে ক্রিকেটার মাশরাফির পরিসংখ্যান বেশি উঠে এসেছে। পড়তে পড়তে কয়েক জায়গায় রীতিমতো বোর ফিল করেছি। আবার ইনজুরির গল্প, অপারেশন, রিহ্যাব -এসব পড়তে গিয়ে ভীষণ আবেগাপ্লুত ও হয়েছি! নড়াইলের জন্য টান, এক ঝাঁক বন্ধু, একান্নবর্তী পরিবার, অসাধারণ ক্যাপ্টেন্সী, পজিটিভ জীবনবোধ, ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং আদর্শ সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন সহজ সরল ভালো মানুষ মাশরাফিকে খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। ধন্যবাদ তাকে।
বেশ কিছু বানান ভুল আছে বইয়ে যেটা খুব দৃষ্টিকটু। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে লেখক ভুলগুলো শুধরে ফেলবেন।
মাশরাফি মেইবি বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম লিজেন্ড- যার জন্যে সম্পুর্ন অচেনা অজানা মানুষটাও পার্সোনাল ত্যাগ করতে রাজি হয়ে যাবে। মাশরাফি মেইবি বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেট খেলোয়াড়- যে কিনা সবার কাছ থেকেই শর্তহীন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব পেয়েছে। ক্রিকেটার মাশরাফির থেকে বড় অর্জন আজ অনেক জুনিয়র ক্রিকেটারেরই আছে, কিন্তু ব্যক্তি মাশরাফির যে ব্যক্তিত্ব আর সবার কাছে থেকে তিনি যে সম্মানটা পান সেই অর্জন আর কারো নেই। সুপারস্টার ক্রিকেটার আজ আছে আমাদের দলে, লিজেন্ড নেই মাশরাফির মত।
সেই মাশরাফিকে নিয়ে এ বই। জীবনের সায়াহ্নে আসার আগেই জীবনী লেখার প্রচেষ্টা- অন্য কারো ক্ষেত্রে হলে লেখকের অনেক সাহস বলা যেতো। কিন্তু মাশরাফিকে নিয়ে লেখা বলেই বলতে হয়- অন্য কারো ১০ জীবনে মাশরাফির সমান উত্থান পতন নেই। বইয়ে সাবলীলভাবে উঠে এসেছে বাচ্চা কৌশিকের ছোটবেলার নানা দুস্টুমির কথা, উঠে এসেছে ইঞ্জুরিতে জর্জরিত মাশরাফির খেলোয়াড় জীবনের কথা। দেবব্রত মুখোপাধ্যায় এর লেখার স্টাইল অনেক আবেগি, কত মাশরাফি ফ্যান যে এই বই পড়তে গিয়ে চোখে পানি আনবেন তা সহজেই কল্পনা করা যায়। এই বই শুধু ফ্যাক্ট আর স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়ে কাঠখোট্টা বিশ্লেষণে নামেনি, ব্যক্তি মাশরাফি, অধিনায়ক মাশরাফিই এই বইয়ের আলোচ্য। মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে গিয়েছি পুরোটা বই। ৪৭০ পেজের বইয়ের দাম ৫০০ টাকা। ছাত্রদের জন্যে দামটা বেশিই বটে। কিন্তু হাতে নিয়ে বইয়ের পেজ কোয়ালিটি আর বাধাই দেখে মত বদলাবেন সবাই। পেপারব্যাক সংস্করণ করা গেলে হয়তো দাম কিছুটা হাতের নাগালে আসতো। বেশ কিছু বানান ভুল ও আছে- কিন্তু সে তো সব বইয়েই থাকে। এই লেখকেরই সাকিবকে নিয়ে একটি বই আছে, লিখছেন এখন তামিমকে নিয়েও।
মাশরাফির ডাকনাম পাগলা, নড়াইল এক্সপ্রেস। ৭-৮ বার দুই হাটুতে অপারেশনের পরে আজ সেই ১৪৫ কিলোমিটারের এক্সপ্রেস গতি আর নেই, রয়ে গেছে সেই বাচ্চাকালের মত পাগলামি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ড্রেসিংরুমের গুমোট ভাব কাটাতে হলে এই মাশরাফিকে দরকার, দলের কারো মন খারাপ, পারফরম্যান্স খারাপ- সেটা থেকে উঠতে হলেও এই মাশরাফিকেই দরকার। দলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ অনেক আগে থেকেই তিনি। এই মাশরাফি বাড়ি অন্তপ্রাণ- প্রথম টেস্টে ডাক পাওয়ার পরে তার কথা ছিল এই টেস্টে ডাক না পেলেই ভালো ছিল, বাড়ি যেতে পারতাম!! চিন্তা করতে পারেন একজন জাতীয় দলে চান্স পাওয়ার পরে এই কথা বলতে পারে? এ শুধু আমাদের মাশরাফির পক্ষেই সম্ভব।
মাশরাফি টাকার লোভে নাচেন না। আইসিএল এর বিপুল টাকার হাতছানি তিনি সহজেই উপেক্ষা করতে পারেন। এই মাশরাফি বিপদে ফেলতে চান না নিজের কোন বড় ভাইকে। সেজন্যেই তাকে ফিক্সিং এর প্রস্তাব দেয়া সিনিয়র ক্রিকেটারের নাম তিনি প্রথমে বলতে চান না, নিজের জীবনের উপরে হুমকি আসা শুরু হলে তারপরে বলতে বাধ্য হোন। নৈতিকতার প্রশ্নে আপসহীন তিনি ত্যাগ করতে রাজি কাছের বন্ধুকেও। আবার বন্ধু অন্তপ্রান মাশরাফি আইপিএল থেকে পাওয়া কোটি টাকা দিয়ে কি করবেন জানতে চাইলে বলেন, রানার বাসায় কিছু টাকা দেয়া লাগবে, আমাদেরই তো বাসা ঐটা।
মাশরাফি বাংলাদেশের প্রথম খেলোয়াড় যিনি কিনা সবার কাছ থেকে পাহাড় পরিমাণ ভালোবাসা পেয়েছেন, পেয়ে যাচ্ছেন। এই মাশরাফিকে দুরারোগ্য রোগের রোগী ফ্যান জানায়, লিগামেন্ট প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে আমার কাছ নিন, জীবিত মানুষের লিগামেন্ট লাগালে আপনি আরো কয়দিন বেশি খেলতে পারবেন। এই মাশরাফি যখন নিজের স্ত্রীর জন্যে যখন রক্তের ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, সম্পুর্ন অচেনা মানুষ এগিয়ে এসে নিজের হাতের রক্তের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। মাশরাফির শরীরে ইঞ্জুরি হয়নি এমন জায়গা কম, এখনি শুরু হয়েছে হাড়ের ক্ষয়। মেডিক্যাল মিরাকল এই মানুষটার শেষ জীবন কাটবে হুইল চেয়ারে, তীব্র ব্যথায়- এই নিষ্ঠুর সত্য জেনেও তিনি লাফিয়ে পড়েন মাঠে ক্যাচ ধরতে। কারন মাশরাফি যে ভয় পান না!
প্রতিদিন সকালে উঠে তার হাটতে কস্ট হয়। আধাঘণ্টার বেশি সময় লাগে অবশ পায়ে অনুভূতি ফেরাতে, হাটাচলা তো দুরের কথা। তাও ১৬ কোটি মানুষের ভরসা নিয়ে নামেন তিনি মাঠে। মাথায় লাল সবুজের পতাকা বেধে যান ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে। হেরে যাওয়া বিপক্ষ দলকে নিয়ে চোকার্স, বাংলাওয়াশ বলে মজা করা হচ্ছে দেখে প্রতিবাদ করেন। দল থেকে বাদ পড়ার খবর শুনলে কাঁদেন, দলের কোন ছোটভাই কাদলে তাকে থামাতে সবার আগে নিজে ছুটে যান।
মাশরাফি পড়ে শেষ করলাম। বইমেলা থেকে কিনেছিলাম। তাও বের হয়ে যাওয়ার পর আবার দোকান খুঁজে । হ্যা, ক্যাপটেনকে সবার মতোই খুব ভালোবাসি। সবসময়েই তাঁকে নিয়ে সব জানতে ইচ্ছে করতো। দেবব্রত মুখোপাধ্যায় পেশায় সাংবাদিক হলেও মাশরাফির একজন ভক্ত। যে এতো সৎ এবং নিজের প্রশংসায় বিব্রত হন, তাকে নিয়ে আসলে ভালো বাদে খারাপ আর কিইবা লিখবেন! খেলোয়াড় মাশরাফির বাইরে বইটিতে মানুষ মাশরাফিকে পাই আমরা। দেখা গেলো, তিনি আসলে অতিমানব মাশরাফি। শরীরের নানা জায়গায় চোট, রাজ্যের অপারেশন, পাগলা, নড়াইলেই ৬৫ জন বন্ধু , শৈশব, কৈশোর, তাঁর মা, নানী, নাহিদ মামা সব মিলিয়ে মাশরাফি। বইটি পড়ে শেষ করার পরও রেশটুকু রয়ে যায়। মাশরাফিকে ফিকশনাল মনে করে ভ্রম হয়! একটানে বইটি পড়ে শেষ করা যায়। এর কারন, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের ঝরঝরে লেখা। সাকিবকে নিয়ে তাঁর লেখা বইটি পড়া হয় নি। দেখলাম, তামিম এবং তাঁর পরিবারকে নিয়ে লিখছেন। ভালো হল। দেশে এক নতুন ধরনের সাহিত্য চর্চা শুরু হলো। নিয়মিত লিখে যাবেন, এমন একজন জীবনীকার পেলাম আমরা। শুভ কামনা রইল দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের জন্য।
যার জীবন কেবল মাঝপথে রয়েছে তাকে নিয়েই যখন জীবনী লেখা হয়ে যায় সে লোক বিশেষণ সমৃদ্ধ। মাশরাফি ক্রিকেটে না আসলে হয়ত তাকে ক্রিকেটার হিসেবে চেনা যেত না, কিন্তু একই সাথে মানুষ জানত না একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে স্বাভাবিকভাবে অসাধারণ হয়, একজন ক্রিকেটার মাশরাফিকে আবিষ্কার করতে গিয়ে মানুষ মাশরাফির বিশালতায় ক্রিকেটপাঠ গৌণ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশকে যদি আমি ক্রিকেটের বাগান বলি তো মাশরাফি হলো সে বাগানের সবচেয়ে বড় গাছ। হয়ত সবচেয়ে বেশি ফল দেয় না, কিন্তু ছায়া দেয়, ঝড়ে বুক চিতিয়ে সাহস দেয়, দেশের মাটি আঁকড়ে ধরার শিক্ষা দেয়, দৃষ্টি উন্নত করে— ফলে অনেক দূর থেকেও একটি গাছকে দেখা যায়। সে গাছ দেখে বাগানে শামিল হয় আরো শত বীজ। বীজ হল স্বপ্ন, স্বপ্ন হল জীবনের খেলা। জীবন হল একেকটা গল্প, আর মাশরাফি হল সবচেয়ে শক্ত, দৃঢ় কিন্তু করুণ মায়াবী গল্প।
অনুপ্রেরণা হয় সে মানুষটিই যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট করে গেছে, যাকে যত বড় জীবনের পরীক্ষায় পড়তে হয়েছে সে তত বড় অনুপ্রেরণার নাম হয়। মাটিতে যোদ্ধার পড়ে যাওয়ার পরও পরাজয় নিশ্চিত হয় না, নিশ্চিত হয় যোদ্ধা যখন উঠতে নিজের সাথে অসম্মতি জানায়। মাশরাফি হল— উঠে পড়ে চলা মানুষের নাম। সে কেবল খেলার কথা বলি না। একটা লোকের কত বন্ধু থাকতে পারে যাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেই বন্ধুত্ব রক্ষার সংজ্ঞায় থাকা যায়, তার হিসেবটা মাশারাফির জন্য আলাদা। সবার থেকে বেশি, সবার আগে বন্ধু, পরেও বন্ধু। ক্রীড়াঙ্গনের ব্যাক্তিত্ব হিসেবেই মাশরাফি আমাদের ইতিহাস হবেন, কিন্তু তাদের মাঝে হয়ত সবচেয়ে সামাজিক, বন্ধুবৎসল, নৈতিক, মানসিক শক্তির প্রতীক হয়ে রবেন আমাদের- 'পাগলা'।
লেখকের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা এই গাছের ছায়ার গাঢ়ত্ব, বিশালতা বাগানের কীটেদের কাছ পৌঁছে দেয়ায়। তিনি আরো ক্রীড়াব্যক্তিত্ব নিয়েও যে জীবনী রচনা করছেন তার জন্য অগ্রিম শুভকামনা রইল।
কোনো কালেই ক্রিকেটভক্ত ছিলাম না। না তো অত খেলার সুযোগ পেয়েছি বা ইচ্ছা ছিল। তাই স্বভাবতই ক্রিকেটার নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস কাজ করতো না। তবে হ্যাঁ, পত্রিকা, টিভি-নিউজ ইত্যাদির সুবাদে মাশরাফি, মুশফিক কিংবা সাকিব এরকম কয়েকজনের নাম ঠিকই জানতাম। "মাশরাফি" পড়ার পর একইসাথে দুইটা জিনিসের প্রেমে পড়েছি–দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের লেখা এবং মাশরাফির ব্যক্তিত্ব। শুধু এই মাশরাফির কারণেই এখন কালেভদ্রে দুয়েকটা ম্যাচ দেখা হয়। না, আমি মোটেও ক্রিকেটভক্ত নই। মাশরাফির ভক্ত...গর্ব হয় যে, আমাদের একজন মাশরাফি আছে। শ্রদ্ধেয় লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
খেলা আমি খুব একটা দেখি না। এমনকি নিজের দেশের হলেও। তবুও খেলার জগতের একটা মানুষ কি করে আমার।প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে গেছে সেটা মনে হয় খুব একটা অবাক করা বিষয় হবে না, যদি সেই নামটা হয় মাশরাফি। শুধু আমার কেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষেরই এই মানুষটার প্রতি আলাদা একটা দুর্বলতা আছে, সে ক্রিকেট প্রেমী হোক বা না হোক। সেই মাশরাফির জীবনী যখন বের হয়েছে জেনেছি, না কিনে থাকতে পারি নি।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, 'মাশরাফি' বইয়ের লেখক মাশরাফিকে বলেছেন গ্রিক ট্রাজেডি আর ভারতীয় রোমান্টিকতার মিশেলে এক মহাকাব্য। বইটা পড়তে গিয়ে বারবার এই সত্যটি উপলব্ধি করেছি।
নড়াইলের দুরন্ত কিশোর এক ব্যাটসম্যানের ঢাকায় এসে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ফার্স্ট বলার হয়ে উঠার গল্প 'মাশরাফি', আবার সেই ফার্স্ট বোলারেরই অপরিকল্পিত অতিব্যাবহার, অসচেতনতা আর অযত্নের কারনে ভালোভাবে জ্বলে উঠার পূর্বেই ইনজুরিতে পরে ক্যারিয়ার অনিশ্চিত হয়ে যাবারও গল্প মাশরাফি। কিন্তু গ্রিক উপকথার ফিনিক্স পাখির মতই মাশরাফিও নিজের ধ্বংসস্তূপ থেকে বারবার নতুন করে জন্ম নিয়েছেন। বারবার মাঠে ফিরে এসেছেন, মাশরাফি সেই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের লেখা বেশ আবেগময়। তবে সত্যি বলতে কি, মাশরাফির জীবনটাই এরকম যে একদম নিরাবেগ বর্ণনা পড়তে গেলেও কখন যে আপনার চোখ ভিজে উঠবে নিজেও টের পাবেন না। মাশরাফির বাল্যকাল, দুরন্তপনা, ক্রিকেট ক্যারিয়ার, ইনজুরি, প্রেম, বিয়ে সবই সুন্দর ভাবে উঠে এসেছে লেখকের কলমে। স্বাভাবিক ভাবেই মাশরাফির সমসাময়িক আরো অনেক ক্রিকেটার, দেশীয় কিংবা বিদেশী, সবার কথাই এসেছে। সাথে এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কিছু কালো অধ্যায়ও, বিপিএল ম্যাচ ফিক্সিং, এমনকি আরেক দেশসেরা ট্রাজিক ব্যাটসম্যান আশরাফুলের কথাও। তবে ভালো লাগের ব্যাপার হল এসব কিছু নিয়েও বইয়ে আপনি ক্রিকেটার মাশরাফির থেকে ব্যক্তি বা মানুষ মাশরাফিকে খুজে পাবেন। এটাই সম্ভবত লেখকের বড় সার্থকতা। পাশাপাশি মাশরাফির জীবনবোধ, দর্শন আপনাকে মুগ্ধ করবে। মাশরাফির দেশপ্রেম সম্পর্কিত কিছু কিছু কথা খুবই ভালো লেগেছে, ইতোমধ্যে সেসব কথা ফেইসবুকে অসংখ্যবার শেয়ার হওয়ায় সেদিকে গেলাম না।
বইটার প্রথম আর শেষভাগ আমার উপভোগ্য লেগেছে বেশি। কিন্তু মাঝখানে কিছুটা বিরক্তই লেগেছে, এ��� যায়গাটা পাতার পর পাতা শুধু মাশরাফির বিভিন্ন খেলার রান আর উইকেটের খতিয়ান হয়ে উঠেছে। তবে সবচেয়ে বিরক্তিকর ছিল অসংখ্য বানান ভুল বা প্রিন্টিং মিসটেক। প্রথম ৫০ পেইজেই ৭টা ত্রুটি চোখে পরেছে, এবং পুরো বইটাতেই এরকম ত্রুটির ছড়াছড়ি। এরকম একটা বইয়ে এটা কোনভাবেই গ্রহন যোগ্য না। সম্পাদনায় আরো গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ ছিল। আবার এক যায়গার লেখা হয়েছে মাশরাফির দুই হাটুতে ৭টা অপারেশন হয়েছে, তো আরেক যায়গায় লেখা হয়েছে ৮টা, আরেক যায়গায় ৯টা :/। হাটু কোথাও হয়ে গেছে হাত!
আরেকটা যে ব্যাপার চোখে লেগেছে সেটা হল সারা বইয়ে কোথাও মাশরাফ���র শিক্ষাজীবন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয় নি। এটা মনে হয় দরকার ছিল, অন্তত দুলাইনে হলেও বলা উচিত ছিল মাশরাফি কোথায় কতটুকু পড়াশোনা করেছে। নিশ্চয় মাশরাফি অশিক্ষিত না।
৪৭০ পৃষ্ঠার ঢাউস সাইজের বইতে এসব ছাড়াও আছে আরো ৩২ পৃষ্ঠা জুড়ে রঙিন ছবি। তার মানে বইটা মোট ৫০২ পৃষ্ঠা। আছে মাশরাফির দীর্ঘ সাক্ষাৎ, মাশরাফি সম্পর্কে বলেছেন সাবেক অধিনায়ক, হাবিবুল বাশার; সাকিব আল হাসান; সাবেক কোচ ডেভিড হোয়াইটমোর। আর বইয়ের মাঝে মাঝে তো মাশরাফির আত্মীয়, বন্ধু বান্ধবের কথা তো আছেই। ব্যক্তি মাশরাফিকে জানতে হলে আসলে এই বইয়ের জুড়ি নেই।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাইবেল বলা যায় এই বইটাকে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বোলিং চর্চার প্রথম টার্নিং পয়েন্ট বলা যায় মাশরাফি বিন মুর্তজার আবির্ভাব। ইঞ্জুরির কারণে ক্যারিয়ারটা সেভাবে পাখা মেলতে পারেনি বটে, কিন্তু যে উদ্দ্যম, যে আগ্রাসন নিয়ে তিনি বল করতেন, সেটা আমাদের বোলিংকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল।
তবে এই বইয়ের মূল ব্যাপারের খুব ছোট অংশেই আছেন বোলার মাশরাফি। প্রায় পুরোটা জুড়েই আছেন মানুষ মাশরাফি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের মাশরাফি, তাঁর জীবন দর্শন, বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে তাঁর জীবন দর্শন আর নানা ভাবনা। বোলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার প্রায় ১৫ বছর পর তিনি বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব পান(এর আগেও পেয়েছিলেন, ইঞ্জুরির কারণে সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি।) এবং অধিনায়ক হিসেবেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক বড়সড় দিকপরিবর্তনে। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ প্রথম নিয়মিত হারাতে শুরু করে বড় বড় দলগুলোকে।
আর মাঠে ক্রিকেটার মাশরাফির নিবেদনের কথা বাংলাদেশ ক্রিকেটের খোঁজখবর যারা রাখেন তারা সবাই কমবেশি জানেন। হাঁটু গোড়ালি মিলিয়ে সার্জনের ছুরির নিচে গেছেন প্রায় ১০বার। অন্য যেকোন ক্রিকেটার হয়ত অনেক আগেই ইস্তফা দিতেন ক্রিকেটে। কিন্তু মাশরাফি যে অতিমানব। তিনি এত সহজে হার মানবেন কেন!
এই সবকথাই উঠে এসেছে বইয়ে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সকল ভক্তের জন্যই এ বইটি অবশ্যপাঠ্য। মাশরাফি পড়া যায় না, মাশরাফিতে ডুব দিতে হয়।
মাশরাফিকে নিয়ে একটা বই অবশ্যই দরকার ছিলো। দেবব্রত লিখেছেন, সেজন্যে তাকে ধন্যবাদ। মাশরাফিরর জীবনদর্শন, বেড়ে ওঠা, জীবনের বিভিন্ন পট পরিবর্তন, এসব চমৎকার ছিলো। একঘেয়ে ছিলো তার প্রতিটি ম্যাচের পারফরমেন্সের তথ্য, সেই ম্যাচগুলিতে অন্যদের অসাধারণ অনেক কিছুতেই মনোযোগ না দেয়া, একই কথা বারবার চলে এসেছে। তবে সব মিলিয়ে বইটি ভালো লেগেছে।
দেবব্রতর লেখনী কিছু জায়গায় বেশি নাটুকে ঠিকই। কিন্তু মাশরাফির জীবনকে বইয়ের পাতায় তুলে আনতে তিনি যে বিশাল পরিশ্রম করেছেন তা স্পষ্ট, এজন্য তাঁকে নিঃশর্ত ক্ষমা দেয়া যায়। অজানা অনেক কিছু জানিয়েছেন, জানা অনেক কিছু পরিষ্কার করেছেন দেবব্রত। আর, অন্য সবকিছু বাদ দিলেও ৪০৯ থেকে ৪৬৬ পৃষ্ঠায় মাশরাফির সাক্ষাৎকারের জন্যই বইটা উসুল।
লেখক নিজে মাশরাফির ভক্ত বলেই বোধহয় বইটি সময়ে সময়ে কিছুটা বায়াসড বলে মনে হতে পারে। তবে বেশ সাবলীল, সহজ ভাষায় লেখা। মাশরাফিকে 'মাটির মানুষ' ইমেজ দেওয়ার বেশ একটা চেষ্টা দেখা যায়, যতটা চেষ্টা মাশরাফি নিজেও হয়তো করেন না! তবে এই চেষ্টা নিঃসন্দেহে খেলোড়ের ভক্তকূলের কাছে বইয়ের কাটতি বাড়িয়েছে। বইটিকে বাস্তবতা নির্ভর, জীবনীধাঁচের কিছু হিসেবে না নিয়ে বরং সময় কাটানোর জন্য দেশের অন্যতম সেরা একজন ক্রিকেটার ও একজন সফল ব্যক্তির পরিশ্রম ও আত্মপ্রত্যয়ের গল্প হিসেবে নিলেই ভালো লাগবে!
বইটিকে অহেতুক বড় করা হয়েছে। প্রায় সময়ই কোন ম্যাচে কত উইকেট পেল, কত রান করেছিল এসব লেখা। যা যে কেও ক্রিকইনফোতেই পেয়ে যাবে। এর জন্য বই পড়ার দরকার হয় না। বইয়ে আমি আশা করেছিলাম মাশরাফি সম্পর্কে আরোও জানব যেটা বলা যায় ৪০-৫০% সম্ভব হয়েছে। আরোও ভালো কোন লেখক ভবিষ্যতে মাশরাফিকে আরোও বিস্তারিতভাবে আমাদের কাছে তুলে ধরবে আশা করি৷
This entire review has been hidden because of spoilers.
ক্যারিয়ারের একদম শুরু থেকেই ইনজুরির সাথে লড়াই, অসাধারণ অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্ব, দুর্নীতির প্রতি আপোষহীনতা, সবকিছুই সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে মনে হলো, মাশরাফির ক্রিকেটার পরিচয় ছাপিয়ে তার একটা কাল্ট ফিগার দাঁড়িয়ে গেছে, যেটা আখেরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ভালো কিছু কি না বুঝতে আরও সময় লাগবে।
The Man, The Myth, The Legend. How a young boy became the national icon as we know him now. And still playing defying all the odds. Bebabrata did an amazing work.
মাশরাফি বাংলাদেশের ক্রীড়াইতিহাসের এক কিংবদন্তি। তার পথ চলা এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু এরমধ্যেই তাকে নিয়ে কাব্য রচনা শুরু হয়েছে। নিজেকে কলম-শ্রমিক বলে অভিহিত করা দেব্ব্রত মুখোপাধ্যায় এক মহাকবির হৃদয় নিয়ে এই কাজ করেছেন। আবেগের মোড়কে, জটিল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিতর্কিত সব ঘটনার মধ্যে তিনি উপস্থাপন করেছেন মাশরাফিকে। সাবলীল ভঙ্গিমাতে বলে যাওয়া একের পর এক অধ্যায়ের পর যখন শেষে পড়বেন মাশরাফির সাক্ষাৎকার, তখন মাশরাফি ও ক্রিকেট উভয়কেই সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিতে দেখবেন। দিন শেষে খেলাটা একটা খেলা এবং মানুষগুলো মানুষ; কিন্তু খেলা আর মানুষ দুয়ের মধ্যে যে এত কিছূ শেখার থাকতে পারে, এ বই না পড়লে জানতাম না। ও, আপনারা কি জানেন মাশরাফি কার এতো বড় ফ্যান যে একই অনুষ্ঠানে থাকা সত্ত্বেও লজ্জ্বায় অটোগ্রাফ চাইতে চেয়েও চাইতে পারেননি? বইটা পড়লে শুধু এটা না আরো অনেক কিছুই জানা হবে :)
এই বইয়ের যে দিকটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে মাশরাফির অনন্য মনোবলের অনবদ্য বর্ননা। খেলোয়ার হিসেবে যে মাশরাফিকে আমরা চিনি তার সাথে মানুষ মাশরাফির তেমন কোনো পার্থক্য আসলেই নেই। ভনিতা করা মাশরাফির ধাতে নেই।।এই বইতে মাশরাফি বলেছেন খেলার সাথে আমরা যেন দেশপ্রেমকে গুলিয়ে না ফেলি। খেলা শুধু খেলাই, তার মতে দেশপ্রেম অনেক বড় আর মহৎ কিছু যাকে ধারন করার ক্ষমতা একটা ক্রিকেট ম্যাচের নাই।
মাশরাফির জীবনের নাটকীয় উত্থানপতনের গল্প নিয়ে চমৎকার একটা বই। শুরুর ডেভ হোয়াটমোর ও সাইদুজ্জামানের ভূমিকা আর শেষের দিকে মাশরাফির দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটা ছিল অসাধারন। ছোটবেলার বন্ধু মানজারুল রানার স্মৃতিজড়িত অধ্যায়গুলো পড়তে গিয়ে যেমন আবেগাক্রান্ত হয়েছি , তেমনি অন্যরকম ভালও লেগেছে।