" আচ্ছা,সবাই এরকম পুরনো বাড়ির মতো,গাছের মতো এক জায়গায় থাকে না কেন? অন্যখানে চলে যায় কেন? " উপরের ভাবনাটি রায়হানের।রায়হানের কিশোর মনে যে ভাবনাটি উঁকি দেয়,এজীবনে যে কত শত বার তা ভেবেছি। গল্পটি আবর্তিত হয় কিশোর রায়হানকে ঘিরে,তার লহুজং নদীর ধারে টাংগাইল শহরের প্যারাডাইস পাড়াকে ঘিরে,সেখানে তার আব্বা আম্মা,বন্ধু-বান্ধব,স্কুল-ক্লাব,রহমত বুড়া,পরী আপা-এদের সকলকে ঘিরে। ভালো ছেলে রায়হান,পড়াশোনায় ও চৌকস,ভালো আঁকিয়ে,খেলুড়ে আর ভীষন স্বপ্নালু।প্রকৃতি তার চোখে ধরা দেয় মায়ার মত,শান্ত-সজীব।একসকালে রায়হানের সাদা রাজহাঁসটি মারা পড়লো বনবেড়ালের পাল্লায় পড়ে।তারপর থেকেই যত বিপত্তি।রাজহাঁসটি যেন তার সাথে নিয়ে গেলো রায়হানের ভালো লাগার সবকিছু,রেখে গেলো শুধু একাকীত্ব। এই একাকীত্বেই ভুগতে ভুগতে রায়হান দেখে তার চারপাশের মানুষ কেমন বদলে যাচ্ছে,জীবনের ছোট ছোট ভালো লাগা গুলো ও যেন সুড়ুৎ করে পালিয়ে যাচ্ছে। তবে একদিন এইসব হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো রাঁজহাসের সাদা ডানায় উড়ে যেন আবার ঠিকই ফেরত আসে। আবু কায়সারের সাথে পরিচিতি এই বইটি দিয়েই,এত সুন্দর লেখনী যাঁর,যে বইয়ের,সে বিষয়ে এতদিন অবগত ছিলাম না ভেবেই অবাক লাগে।আমার মনে হয় অনেকেই আমার মত লেখকের কথা,এই বইটির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন। শিশু-কিশোর সাহিত্য আর সুন্দর লেখনীর আমি বরাবর ভক্ত। এই দুইটিরই সমন্বয়ে বইটি এত্ত ভাল লাগলো।দুপুরের পর নরম মিঠে আলোয়,শুয়ে শুয়ে বইটি শেষ করলাম,জানিনা কিসের কথা ভেবে,ছোটবেলার কথাই হয়তো,মনটা নরম হয়ে গেলো। লেখকের রচিত বইয়ের সংখ্যা সামান্যই দেখলাম,বাকিগুলোও পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করছি।
কিছু কিছু বই আছে যেগুলোর সমান্তরালে কখনো অন্য কোন বই বসতে পারে না। সেটা তার ভাষা বা কনটেন্ট বা গল্প বলার ভঙ্গীতে কিছু ইউনিক উপাদানের জন্য হয়। এই বইটা হচ্ছে অমন একটা বই। কিশোর উপন্যাসগুলোতে সাধারণত কিশোরদের কর্মকাণ্ড, দুষ্টুমি, দুঃসাহসিকতা ইত্যাদি বাহ্যিক বিষয়গুলো নিয়ে লেখা হয়। সেই বইগুলো প্রাক্তন কিশোররা লিখলেও কিশোরদের মনের খোঁজ সেখানে পাওয়া যায় না। হয়তো ততদিনে তাঁরা কিশোর মনের খোঁজ হারিয়ে ফেলেন। এই উপন্যাস লেখার সময় আবু কায়সারের বয়স যাই থাকুক না কেন, তিনি কিশোরের চোখ দিয়ে চারপাশটা দেখতে পেরেছেন তাই কিশোর মনের অতলও এখানে উঠে এসেছে। এই কারণে বাংলা ভাষায় লেখা সেরা কিশোর উপন্যাসগুলোর তালিকায় এই বইটাকে রাখতেই হবে।
আবু কায়সার চলে গেছেন খুব বেশি দিন হয়নি। তাঁর লেখা ছোটদের বা বড়দের জন্য লেখা বইয়ের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবু তিনি আলোচিত লেখক নন। কেন, কে জানে! অথচ ভাষা, কাঠামো, গল্প বিচারে তিনি একজন উঁচুমানের সাহিত্যিক। সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর মূল্যায়ণের চেষ্টা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা মাত্র। এ'কথা ভাবতে কষ্ট হয় যে, শুধু উদ্যোগের অভাবে খুব দ্রুত আবু কায়সারের লেখাগুলো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে।
কিশোর মনের অতলের সন্ধান বিবেচনায় 'রায়হানের রাজহাঁস'-এর সাথে তুলনীয় কাইজার চৌধুরীর 'পাখী' নামের একটা ছোট গল্প আছে। পাখী বরং রায়হানের তুলনায় অনেক পরিণত। গল্পটা 'শিশু' পত্রিকায় আশির দশকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটা পরে কাইজার চৌধুরীর কোন গল্প সংকলনে ঠাঁই পেয়েছিল বলে জানতে পারিনি। ঐ গল্পটার হারিয়ে যাওয়া নিয়েও কষ্ট হয়।