একদিন দশ এগারো বছরের ছেলে জয়নাল ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করে সারা গ্রামে সে একা। ঠিক তখনি আসে পাকবাহিনী, তাদের হাত থেকে বেঁচে ছেলেটি মায়ের একটি শাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে মাকে খুজতে। এভাবেই এগুতে থাকে এই বইয়ের শিরোনামের গল্প ‘একটি শাড়ি এবং কামরাঙ্গা বোমা’।
‘ভুল সাক্ষাৎ’ গল্পটি একজন গত যৌবন পতিতার গোপন স্বপ্নের গল্প।
মালতী দাস নামে একজন হিন্দু ভীখারি আল্লাহর ওয়াস্তে ভীক্ষা চায়, বৃদ্ধা ভীখারি হওয়ার সত্বেও সে পড়তে চাউ। ‘ছোঁয়া’ গল্পে জড়িত আছে তার অতীতের ভায়াবহ এক স্মৃতি।
ধনী ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করতে চায় নিদারুণ অনুশোচনায়, ‘প্রায়শ্চিত্ত’ সেই ধনীর উপাখ্যান।
গার্মেন্টস শ্রমিক দম্পতি চাপা পরে বিশাল ভবনের নিচে, তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য বাঁচার আকুতি নিয়ে গল্প ‘উপহার’।
বিয়ে করবে তিথি, তার সাথে দেখা হয়েছে এমন এক ছেলের, যে তার পছন্দের একদম বিপরীত। ‘তিথির জোছনা’ গল্পটি সাধারন মেয়েদের অসাধারণ মানসিক অবস্থার প্রতিফলন।
‘একজন গোয়েন্দার অপমৃত্যু’ এটাকে রম্য গল্প বলা যায়। একজন শখের গোয়েন্দার বোকামীতে পরিপূর্ন গল্প।
একজন দরিদ্র কৃষকের মানসিক জগত আলৌকিকভাবে এক রাতে পরিবর্তন হয়ে যায়। তার সে রাতের কাহিনী নিয়ে গল্প ‘সুখের মনি’।
প্রথমে বলে নেই-ইহা একটি বায়াসড রিভিউ। বায়াসড না হয়ে উপায় নেই। ওবায়েদ হকের একটা বই পড়েন, বুঝে যাবেন। আফসোস একটাই, মাত্র 'তেইল্যা চোরা' বইটা পড়া বাকি আছে। শেষ হলে আপাতত ওবায়েদ হকের সব বই শেষ :( লেখকের প্রথম বই, তায় আবার আমার অপছন্দের জিনিস-ছোট গল্প সঙ্কলন। আশা ছিল বেশি কিন্তু চেপে চুপে কমায়া রাখছিলাম। প্রথম গল্পটা পড়ে মনে হয়েছিল, ভালো কাজ করছি। আশা কমানোই উচিত। পরেরটা পরে নড়ে চড়ে বসলাম। খুঁতখুঁত বেশি করি বলে ভাবলাম, পাওয়া গেল একটা বই যেটা ভালো লাগবে না। পরের গুলো পরে বুঝলাম, হি ইজ ওয়ান অফ আ কাইন্ড 'ভুল সাক্ষাৎ' বা 'ছোঁয়া' গল্প দুটো টানেনি। টিপিক্যাল উঠতি লেখকের লেখা মনে হয়েছে। কিন্তু এরপর থেকে যে ছক্কা মারা শুরু তার সাথে শুধু তামীমের গত কালের ইনিংসের তুলনা করা যায়। ভয়ংকর রকম সুন্দর। ছোট গল্প একটা কঠিন জায়গা, এখানে ছোট্ট পরিসরে অনেক কিছু তুলে ধরতে হয়। থ্রিলার গল্পে হয়ত সেটা সম্ভব। কিন্তু এধরনের মানে সামাজিক গল্পে প্রায় অসম্ভব। অন্তত এই বইয়ের আগে ধারনা অনেকটা তেমনই ছিলো। নাম গল্প - একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার। কিন্তু কেন জানি মুক্তিযুদ্ধকে ছাপিয়ে এতে উঠে এসেছে একজন ছেলের তাঁর মায়ের জন্য হাহাকার। 'ছোঁয়া' গল্পটাও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক। এতটা টাচিং গল্প পাওয়া ভার। 'উপহার' এই বইয়ের সম্ভবত সেরা গল্প। সুখের মনি বা তিথির জোছনা, খুব সাধারণ না, আবার অসাধারণও না। একটি গোয়েন্দার অপমৃত্যু - মজা পেয়েছি পরে। দুঃখ লাগছে, আর একটা বই এর পর ওবায়েদ হকের বই শেষ হয়ে যাবে? আবার মেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? আর যদি মেলায় না আসে!!!
এরকম একটা সুন্দর বইয়ের না কি দ্বিতীয় কোনো সংস্করণ বের না হোক তাই ছিল ওবায়েদ সাহেবের ইচ্ছে!লেখক মশাই আপনি কি পাগল?না স্বার্থপর?এমন একটা অমৃতদ্বার কেউ রুদ্ধ করে রাখে😑
ছোট গল্প সবাই লিখতে পারে না, এটা একটা বিশেষ গুন বলে আমি মনে করি। ওবায়েদ হক এই গুনে গুণান্বিত। তার ছোট গল্পের বিষয়বস্তু গুলা এত সুন্দর হয় যা মন ছুঁয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু এটা লেখকের প্রথম দিকের বই তাই বোঝা যায় এখনো পরিপক্ব হয়ে উঠে নি গল্পগুলা। "নেপথ্যে নেমকহারাম" বইটার প্রতিটা গল্প যেভাবে আমাকে নাড়া দিয়েছে এই বইয়ের গল্পগুলা তেমন ভাবে মন ছুতে পারে নি। যদিও গল্পগুলো পড়লে বোঝা যায় যে, বিষয়বস্তু গুলা খুব সুন্দর কিন্তু কোন কারনে এই গল্প গুলা অন্য গল্পের মত অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে নি।
"একটি শাড়ি এবং কামরাঙ্গা বোমা" বইয়ের প্রিয় গল্পগুলা হল:
১. ভুল সাক্ষাৎ: এখানে একজন পতিতার গল্প বলা হয়েছে যে, তার বাচ্চা জন্মাবার পর পরই দত্তক দিয়ে দেয়, কিন্তু বহুবছর পর সেই পতিতা পল্লিতেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হয়ে যায় তার সন্তানের সাথে আরেকবার!
২. প্রায়শ্চিত্ত: এটা একজন হতভাগ্য লোকের গল্প যে এক সময় বেকার জীবনযাপন করেছে, একদিন সে একটা ব্যাগ খুঁজে পায়, দেখে যে সে ব্যাগ ভরা টাকা। সেই টাকা কাজে লাগিয়ে সে বড়লোক হয়! কিন্তু সুখ খুঁজে পায় না। একদিন সে জানতে পারে যে ব্যাগ ভরা টাকা সে নিয়ে এসেছিল সেটি ছিল একটা বাচ্চার মুক্তিপণের টাকা! যে টাকা টা না পেয়ে লোকগুলো বাচ্চাটাকে মেরে ফেলে! উজাড় হয় বাপ-মার বুক!
৩. একটি শাড়ি এবং কামরাঙ্গা বোমা: এটা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কাহিনী।একটা ছোট ছেলের বাড়িতে মিলিটিরিরা হানা দেয়! ছেলেটা লুকিয়ে ছিল বলে জানতে পারে না যে তার বাবা মা কই গেছে, যখন আসে দেখে তার বাসা ফাকা, সে তার মায়ের শড়ি গায়ে জড়িয়ে খুঁজতে বের হয় তার মাকে এবং পরে সে নিজেই যোগ দেয় মুক্তিবাহিনী তে!
৪. তিথির জোছনা: তিথি নামে মেয়েটা খুব অদ্ভুত, চায়ের দোকানদারদের সাথে খাতির, বস্তির ছোট বাচ্চাদের জন্য তার জান কুরবান। কিন্তু বিয়ে করার জন্য ভালো মনের ছেলে খুঁজে পায় না। সে চায় এমন ছেলে যে, এই বস্তির দরিদ্র বাচ্চাদেরও ভালোবাসবে মন খুলে। সে কি পাবে এমন মনের মানুষে দেখা?
রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথা মোতাবেক দুর্বোধ্য বাক্য গঠনে সাহিত্য সৃষ্টির প্রথাকে ভেঙ্গে নাগরিক ভাষ্যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন তখন ছ্যা ছ্যা করে উঠেছিল দুর্দান্ত প্রতাপশালী বাংলা সাহিত্যিকেরা। সাহিত্যের জাত গেল জাত গেল গান গাইতে শুরু করে আজব এক আবহ সৃষ্টি হয়েছিল তখন। হুমায়ুন আহমেদ যখন ছোট ছোট সরল বাক্যের সহজ মারপ্যাচে কঠিন সমাজের কঠিন বাস্তবতাকে টেনে হিঁচড়ে জনগনের হাতে তুলে ধরেছিল তখন ও একি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে। সাহিত্য নাকি সস্তা হয়ে গিয়েছিল তাঁর হাতে পড়ে।
ওবায়েদ হক তাঁর প্রথম গ্রন্থ “একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা”র ভুমিকায় লিখেছেন- “গল্প কবিতা উপন্যাস সমাজের দর্পণস্বরূপ। কঠিন শব্দ, দুর্বোধ্য বাক্য আর ধুয়াচ্ছন্ন কাহিনী কখনো একটা স্বচ্ছ দর্পণ হতে পারেনা”। একজন সাহিত্যিক কি তাঁর পাঠকের হাতে সমাজের দর্পণ তুলে দেবে নাকি তাঁর পাঠককে ল্যাবিরিন্থ এ ফেলে মজা লুটবে সেটা তাঁর একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার। ওবায়েদ হক বেছে নিয়েছেন দর্পণ, পরিস্কার ঝকঝকে। সে দর্পণে সমাজের নগ্নতা যেমন পরিস্কার ফুটে উঠেছে তেমনি ফুটে উঠেছে আবেগ বিবেক এমন সব জটিল মনুষ্য অনুভূতি।
“একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা” তরুন লেখক ওবায়েদ হকের প্রথম গল্পগ্রন্থ। ওবায়েদ হকের লেখার সাথে পরিচয় অন্তর্জালে খুজে পাওয়া “নীল পাহাড়” উপন্যাসের পিডিএফ কপির মাধ্যমে। নতুন লেখক বলে বইটা কিছুটা অবহেলায় পড়ে ছিল বেশ কিছুদিন ইবুক ফোল্ডারে। প্রচ্ছদটা খুব টেনেছিল বলে একদিন পড়া শুরু করে দিলাম, অনেক কষ্ট করে পরে প্রিন্ট কপি সংগ্রহ করতে হয়েছে, বলা যায় বাধ্য করেছে তাঁর উপন্যাসের প্রতিটা লাইন। এরপর একে একে পড়ে ফেলি “জলেশ্বরী”, “তেইল্যা চোরা” ও “নেপথ্যে নেমকহারাম”। একি লেখকের পর পর চারটা বই ভাল লাগা মানে কি নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। কিন্তু লেখকের প্রথম গ্রন্থ “একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা” কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। মুদ্রিত সকল কপি বাজারে শেষ, এবং লেখক পুনর্মুদ্রণ এ আগ্রহী নন। লেখক নাকি তাঁর এই বইয়ের গল্পগুলোকে অপরিনত মনে করেন। কিন্তু পাঠকের ক্রমাগত প্যানপ্যানানিতে অবশেষে লেখক বইয়ের পিডিএফ কপি উন্মুক্ত করেছেন অন্তর্জালে। এবং দুঃখের বিষয় লেখকের প্রকাশিত সকল বই এখন আমার পড়া এবং শুধুমাত্র এই বইটির প্রিন্টেড কপি সংগ্রহ করতে না পাড়ার একটা শুন্যতা আমার বুকশেলফ ও হৃদয়ে দারুনভাবে দৃশ্যমান।
বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক পরিচিতির জায়গায��� লেখা বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা উলটে নাকি লেখকের পরিচয় পাওয়া যায় না, লেখকের পরিচয় পাওয়া যায় প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠার মধ্যের কালো কালো বর্ণগুলিতে। সেকারনে ওবায়েদ হককে চিনতে হলে বিচরন করতে হবে তাঁর বইয়ের বর্ণ থেকে বর্ণে। “একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা” বইটাতে ৮ টি ছোট গল্প ছিল যেখান থেকে ২ টি ছোট গল্প ‘তিথির জোছনা’ ও ‘একজন গোয়েন্দার অপমৃত্যু’ স্থান পায়নি পিডিএফ ভার্সনে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে নতুন দুটি গল্প ‘বুড়ো দাঁড়কাক মড়ে না’ ও ‘বিসর্জন’। পুরনো গল্প ৬ টি হল ‘ভুল সাক্ষাৎ’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘সুখের মনি’, ‘একটি সাড়ি ও কামরাঙ্গা বোমা’,’ছোঁয়া’, ‘উপহার’। প্রতিটা গল্প হৃদয়স্পর্শী, অন্যভাবে ভাবতে শেখাবে। ছোট গল্প সম্পর্কে কিছু বললে সেটা স্পয়লার হয়ে যায়, তাই কিছু বলবো না। পড়ে দেখুন, ভাল লাগবে আশা করি।
এই লেখককে আরো বেশি মানুষের চেনা উচিৎ! উনার লেখার হাত ভালো! আরও বেশি মানুষের উনার বই পড়া উচিৎ! বইমেলাতে উনার বই খুজে পেলাম না! অথচ বস্তাপচা কতশত বই খুঁজে পাওয়া যায়!
আমার পড়া লেখকের প্রথম বই ছিল "নীল পাহাড়"। সত্যি বলতে গেলে, বইটা আমার খুব বেশি ভালো লাগেনি। স্বভাবতই এজন্যেই লেখকের অন্য বইগুলোর প্রতি কোন আগ্রহ জন্মেনি। হঠাৎ করে গুডরিডসে এই বইয়ের উপর এক বন্ধুর রিভিউ দেখে খুব আগ্রহ জন্মালো। কোথাও হার্ডকভার না পেয়ে এবং যেহেতু লেখক বইটার রিপ্রিন্ট করাতে নারাজ, তাই পিডিএফ যোগাড় করে পড়া শুরু করলাম। লেখকের মতে, এই বই মানসম্মত নয় কারণ এটা তার প্রথম দিককার লেখা। কিন্তু বইটা শেষ করে আমি ভাবছি এই প্রথম দিককার লেখাই যদি এত জোস হয়, পরের গুলা কি হবে! আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের পর আর কারো লেখা ছোট গল্পই কেন যেন ভালো লাগে না। একটানা পড়তে অনেক বিরক্ত লাগে৷ কোন ছোট গল্পের বই হাতে নিলে অনেক কষ্টে শেষ করি। কিন্তু এই বইটার গল্পগুলো আমাকে একটানা পড়তে বাধ্য করেছে। এত সুন্দর লেখা। বিশেষ করে, " উপহার" নামের গল্পটা, এক কথায়, "মাইন্ডব্লোয়িং"। অন্য গল্পগুলোও অসাধারণ। সহজ ও সাবলীল ভাষায় লেখা প্রতিটা গল্প। মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়তে হয়।
পড়বো পড়বো করে বছরখানেক হার্ডড্রাইভের এক কোণায় ইবুকটা পড়ে ছিলো। রিডার্স ব্লকটা যেহেতু মোটামুটি কেটেই গেছে তাই আবার খুঁজে নিয়ে পড়ে ফেললাম একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা। আমি প্রায়সময়ই বলি সাম্প্রতিককালের গুণী লেখকদের তালিকা করা হলে ওবায়েদ হক নিঃসন্দেহে প্রথমদিকের সারি অধিকার করে নিবেন। ভূমিকায় উনি বলেছেন কঠিন শব্দ, দূর্বোধ্য বাক্য, ধোঁয়াশাচ্ছন্ন কাহিনী স্বচ্ছ দর্পণ হতে পারে না; কথাটা ভীষণরকম সত্য বলে মনে করি আমি। ওনার বইয়ের প্রতিটি গল্পই তাই সহজ, সরল, প্রাণবন্ত; অনুভব করা যায় ভেতর থেকে।
কয়েকটা ছোট গল্প এমন আছে বইটাতে যেই গুলো সম্পর্কে আমার মন্তব্য শুধু দুইটা শব্দ just awesome. গল্প গুলোতে একটা ভিন্ন কিছু আছে। লেখকের আর কোনো বই পড়াহয়নি তবে আমার মনে হয় একটা ভিন্ন কিছু অপেক্ষা করছে।
এইটা ওবায়েদ হকের প্রথম বই। এর ভুমিকায় তিনি লিখেছেন- “গল্প কবিতা উপন্যাস সমাজের দর্পণস্বরূপ। কঠিন শব্দ, দুর্বোধ্য বাক্য আর ধুয়াচ্ছন্ন কাহিনী কখনো একটা স্বচ্ছ দর্পণ হতে পারেনা।” কী দারুণ উপলব্ধি! লেখকের মনে হয়েছিল যে তাঁর এই প্রথমদিকের লেখাগুলো তাঁকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। এইটা অবশ্য আমারও মনে হয়। নিজের এক বছর আগের লেখা যখন সামনে আসে, তখন মনে হয়, "আয়হায়! এইটা কী লিখসিলাম!!" যার কারণে তিনি এই বইয়ের আর কোনো সংস্করণ বের করতে চাননি। তবুও অনেক বলার পর তিনি এই বইটার সফটকপি তৈরি করার জন্য অনুমতি দিয়েছেন, আবার এই ডিজিটাল সংস্করণের ভূমিকাতেও নিজের উপর নিজেই রাগ ঝেড়েছেন!
আমার পড়া লেখকের প্রথম বই ছিল "নীল পাহাড়"। বইটা পড়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। এইটা পড়েও মুগ্ধ হয়েছি। 'একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা' বইটিতে ৮ টি ছোট গল্প ছিল যেখান থেকে ২ টি ছোট গল্প ‘তিথির জোছনা’ ও ‘একজন গোয়েন্দার অপমৃত্যু’ স্থান পায়নি পিডিএফ ভার্সনে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে নতুন দুটি গল্প ‘বুড়ো দাঁড়কাক মড়ে না’ ও ‘বিসর্জন’। পুরনো গল্প ৬ টি হল ‘ভুল সাক্ষাৎ’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘সুখের মনি’, ‘একটি সাড়ি ও কামরাঙ্গা বোমা’,’ছোঁয়া’, ‘উপহার’। প্রতিটা গল্পই খুব সুন্দর, সহজ ও সাবলীল ভাষায় লেখা। একেকটি একেক সুরের, একেক কাহিনীর। ছোটগল্পের রিভিউ দিলে স্পয়লার দেওয়া হয়ে যাবে, আমি বলবো মাত্র ৯৮ পৃষ্ঠার এই বইটি নিজেই পড়ে দেখুন, অবশ্যই ভালো লাগবে।
গল্পটা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিন্তু গল্পটায় যতটা না মুক্তিযুদ্ধ ফুটে উঠেছে তার চেয়ে বেশি এক মা হারা সন্তানের হাহাকার ফুটে উঠেছে। ভালো লেগেছে।
“একটি শাড়ি এবং কামরাঙা বোমা” ওবায়েদ হক প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ। এখানে মোট আটটি গল্পের সমাবেশ করা হয়েছে। এক একটি গল্পে, সমাজের এক একটি স্তরের প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি আমরা। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের ধনবান ব্যবসায়ী, ছোট্ট বালক থেকে একদম বৃদ্ধা সবার কথা আছে এই গল্পগুলোতে। সবগুলো গল্পের একটুকরো এখানে না বললেই না।।।
১। ভুল সাক্ষাৎ:
নিষিদ্ধ পল্লির একজন প্রভাবশালী বাড়ীওয়ালি মনোয়ারা। এখানে তার ঘরেই সবচেয়ে বেশি মেয়ে আছে। সবার কাছে বর্তমানে খালা নামে পরিচিত মনোয��ারার আসল নামটাই ঘুচে গেছে যখন তার তথাকথিত স্বামী তাকে বিয়ের দিনই এই পল্লিতে মির্জার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। এত বছরে সব ভুলে গেছে সে জীবনের প্রয়োজনে। শুধু একটা বাসনা তার মনে জিইয়ে রেখে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে আছে মনোয়ারা। কিন্তু আজ তার পোষা দালাল খদ্দের ধরে আনতেই চমকে উঠল সে। বড় ভুল সময়ে, ভুল জায়গায়, আজ ভুল মানুষটার সাথে দেখা হয়ে গেল।।।
২। প্রায়শ্চিত্ত:
কামরুল হাসান। জীবনযুদ্ধে সফল এক ব্যবসায়ী। কিন্তু আজ তার হঠাৎ একি হলো? কেন তার নিজের উপর এত তীব্র ঘৃণা? কেন সে আজ নিজের উপর তীব্র ঘৃণায় ক্ষত বিক্ষত একজন মানুষ? কে�� আজ সে বেছে নিতে চাইছে আত্মহননের পথ? “প্রায়শ্চিত্ত” তারই এক উপাখ্যান।।।
৩। সুখের মণি:
হতদরিদ্র কৃষক নুরুলের স্বপ্ন তার বউয়ের তালি দেয়া শাড়ি, তার ভাঙ্গা ঘর, তার দারিদ্র্য সবকিছু পাল্টে দেবে সে। কিন্তু সব স্বপ্ন কি পুরণ হয়? কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সুখের মণিওতো সবার কাছে থাকে না।।।
৪। একটি শাড়ি এবং কামরাঙা বোমা:
১৯৭১ তে যুদ্ধের ডামাডোলে উত্তাল পুরো দেশ। এথেকে ছোট্ট এই গ্রামটাও বাদ পরেনি। এ গায়েরই ছোট্ট ছেলে জয়নাল একদিন গাব গাছের কোটর থেকে তার অবেলার ঘুম সেরে উঠে দেখে পুরো গ্রাম খাঁ খাঁ করছে। মা-বাবা বা গাঁয়ের মানুষ কেউ কোথাও নেই। একটু পরেই সে বুঝতে পারলো পাক হানাদাররা আক্রমণ করেছে তাদের গাঁয়ে। কোন রকমে তাদের হাত থেকে পালিয়ে নিজের ঘরে এসে দেখে মায়ের নতুন লাল শাড়িটা পরে আছে অবহেলায়। পালাবার সময় মা মনে হয় শাড়িটা নিতে ভুলে গেছে। মাকে নতুন ফিরিয়ে দেয়ার আশায় শাড়িটা নিয়ে বেড়িয়ে পরে জয়নাল। আর মাকে খুজতে থাকে। দিন যায়, দিন আসে। একটি শাড়ি আর একটা কামরাঙা বোমা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করে জয়নাল।।।
৫। তিথির জোছনা:
বিয়ের ব্যাপারে খুবই বিরক্ত তিথি। রাজপুত্র টাইপ ছেলেতো তার একদমই পছন্দ হয়না। কিন্তু মেয়ে সুন্দর হলে যা হয়। আর তার মা যেন খুজেঁ খুজেঁ দুনিয়ার যত সুন্দর ধনীর ছেলে আছে তাদেরকেই ধরে নিয়ে আসে। একটুও ভাল লাগে না তিথির। এবার, এবার কি হবে ভাবতেই তার বুক কাঁপছে।।।
৬। ছোঁয়া:
হরিদাস পল্লির কালের সাক্ষী মালতি দাস। গতর যতদিন ছিল তা খাটিয়ে কাজ করে দুবেলার ভাতের সংস্থান করেছে সে। আর এখন শরীর গেছে, সপ্তাহে ছয়দিন ভিক্ষা করে তার দিন চলে। আর বাকি একদিন তার ছুটি, পড়তে শেখে সে এইদিন। বেয়াল্লিশ বছর পর তার একটামাত্র আকুতি বুকে নিয়ে সে পড়তে শেখে।।।
৭। উপহার:
ধসে পড়া গার্মেন্টসের ভেতর আটকে আছে গার্মেন্টস শ্রমিক দম্পতি। তবুও প্রতিনিয়ত বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা শুধুমাত্র তাদের একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য। জীবনের এমন চরম মুহূর্তে এসেও নিজেদের কথা না, বরং ছেলের কথাই মনে আসছে তাদের। তাদের এই আকুতি কি পরম করুণাময়ের দরবারে পৌঁছাবে???
৮। একজন গোয়েন্দার অপমৃত্যু:
গোয়েন্দা মিশকাত যাকে আমরা বাংলার শার্লক হোমস বলতে পারি সে আজ বড়ই চিন্তিত। রান্নাঘরে আম্মার খুন্তি হারানোর কেসটাই এখনো সলভ হলো না, এদিকে বন্ধু রিপনের নতুন কেনা মোবাইল সেটটা নাকি আবার পাওয়া যাচ্ছে না। কি আর করা, বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য তাই মিশকাত রউনা দিলো বন্ধুর বাসায়, পথে তার সঙ্গী হল পাশের বাড়ির পুচকি মেয়ে বিদুষী। একরত্তি মেয়েটা কত কথা শুনায় মিশকাতকে। এখন ঠিকমতো মোবাইলটা পাওয়া গেলেই বাঁচা যাবে।।।
আমার কথাঃ
একটি একটি করে আটটি গল্প শেষ করে আমার অনুভূতি ছিল বর্ণনাতীত। "ভুল সাক্ষাৎ" পরার পর মনে হলো, নিষিদ্ধপল্লীর কষ্টকর জীবনটা আমরা শুধু আন্দাজই করতে পারি, সেই মানুষগুলোর কষ্টের স্বরূপটা অনুভব করতে পারি না। তবুও এই গল্পটা যেন একটু হলেও ভাবায়। "প্রায়শ্চিত্ত" তেমনি ভাবায় আমরা না চাইলেও কতরকম পরিস্থিতির শিকার হয়ে পরি, অসহায় আমরা কি পারি সবসময় তার মোকাবেলা করতে? “সুখের মণি” গল্পটা যেন শেখায় স্বপ্ন নিয়েই আমাদের জীবন, স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকা, কিন্তু সপ্নগুলো কি পূরণ হয় সবসময়???
"একটি শাড়ি এবং কামরাঙা বোমা" পড়তে পড়তে চোখে পানি চলে আসতে চাইছিল। মায়ের লাল শাড়ি তাকে ফিরিয়ে দেয়ার যে আকুলতা সেই ছোট্ট ছেলেটার চোখে ছিল তা আসলেই কষ্টকর। বাংলা মায়ের কত ছেলে সেদিন আপনজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করেছিল তা কি আমরা এতকাল পরে বুঝি, না বুঝতে চাই? অন্যদিকে "তিথির জোছনা" অবশ্যই মনকে দোলা দিয়ে গেছে। "ছোঁয়া" আর " উপহার" তেমনি খুব কষ্টের দুটি গল্প। কষ্টের মাঝেও যেন বাবা-মায়ের ভালবাসার কথায় বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে গল্প দুটি।
আর "একজন গোয়েন্দার অপমৃত্যু" পড়ে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। পুরো বইতে এটাই একমাত্র হাল্কা ধাঁচের গল্প ছিল। লেখক যেন প্রমাণ দিয়েছেন গভীর ভাব আর জীবনবোধ যেমন তার লেখার উপজীব্য তেমনি হালকা লেখা দিয়েও আনন্দ তিনি দিতে পারেন।
সবশেষে বলতে চাই, "একটি শাড়ি এবং কামরাঙা বোমা" গল্পগ্রন্থটি অনেকদিন ধরেই পড়তে চাইছিলাম। কিন্তু আউট অব প্রিন্ট হওয়াতে বেশ কিছু দিন খোঁজার পরেও পড়তে পারছিলামনা। এই অসাধারণ গল্পগ্রন্থটি আমাকে পড়তে দেয়ার জন্য সোহেল নূর ভাই এবং বিকি বড়ুয়ার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। উনারা সাহায্য না করলে এত তাড়াতাড়ি আমি এত সুন্দর সুন্দর গল্পগুলো পড়তে পারতাম না। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবনা। ভবিষ্যতে এভাবেই উনারা অসহায় বই/গল্পপ্রেমীদের বিপদের দিনে বই দিয়ে উদ্ধার করবেন এটাই আশা করব।
মনোয়ারার সারাদিন খুব ব্যস্ততায় কাটে। এতগুলো মেয়েকে সামলানো চারটি খানি কথা নয়। মেয়েগুলি হলো পতিতাপল্লির মেয়ে। কেউ পালিয়ে গেলো কিনা, কেউ অসুস্থ হলো কিনা, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ আত্মহত্যা করলো কিনা। কেননা এখানে কেউ নিজের ইচ্ছায় বাঁচতে পারে না, মরা তো আরো দূরহ! সেই মনোয়ারাকে এখন তার নামে কেউ চেনে না। তার নতুন নাম রত্না। এই পতিতাপল্লিতেই ঘটে তার সবচেয়ে ভুল সাক্ষাৎ। এই ভুলের গল্প নিয়েই "একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা" বইয়ের প্রথম গল্প "ভুল সাক্ষাৎ"।
বইয়ের দ্বিতীয় গল্প "প্রায়শ্চিত্ত"। সফল ধনী ব্যবসায়ী কামরুল সাহেব সারারাত চেস্টা করেও সুইসাইড নোটটা গুছিয়ে লিখতে পারেন নি। স্কুল কলেজে "বাবার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি" লেখা শিখেছেন, কিন্তু সুইসাইড লেটার লেখা কখনো শিখেন নি। সবদিক সফল এই ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা করতে চাওয়ার পিছনের গল্পটি কি? এমন এক পাপের তিনি প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছেন, যে ভুল তিনি করেছেন অনেক অনেক বছর আগে। কি সেই ভুল?
বইয়ের তৃতীয় গল্প "সুখের মণি"। অভাবের সংসার নুরুলের৷ দিন আনতে দিন ফুরায়। তবে পরিবার নিয়ে বিরাট স্বপ্ন দেখে সে৷ ছেলে পড়াশুনা করবে, বড় হবে। পরিবারকে নিয়েই সে সুখী। ছেলেকে পড়াশুনা অন্যের জমিতেও কামলা খাটে নুরুল। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে যখন দেখে হারিকেনের কাপা কাপা আলোতে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়া তার বউ ছেলের শিক্ষিকা হয়ে যায়, তখন তাদের উদ্ভাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে সব ক্লান্তি নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। সেই নুরুল একদিন দেখতে পায় সাপের মনি। যেই মনির লোভে প্রাণ হারিয়েছে তার দাদাও! এই সাপের মণি কি নুরুলের সুখের মনি হবে?
যে গল্পের নামে বইয়ের নাম "একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা"। প্রতিবছর বর্ষায় গ্রামের সব মহিলারা একত্র হয়ে চাঁই বানায়। বানানোর সময় তারা নানারকম গল্প করে। কখনো কখনো তারা গ্রামে নতুন বিয়ে হওয়া বৌ'দের নিয়ে গল্প করে, আবার কখনো জ্বিন-ভূত-রাক্ষস নিয়ে। কিন্তু এবারের বর্ষার চিত্রটা আলাদা। এবার সবাই কল্পনার জ্বিন-ভূত-রাক্ষস নয়, বাস্তবের রাক্ষস নিয়ে গল্প করছে। গল্পে নতুন বৌদের জায়গাটাও নতুন রাক্ষস দখল করে নিয়েছে৷ তারা এই রাক্ষসদের বলতো "পাঞ্জাবি"। ৯/১০ বছরেরর জয়নাল গাছের কোটরে লুকিয়ে ঘুমিয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখে পুরো গ্রামে সে একা। মিলিটারিদের দুটো নৌকা গ্রামে ভিড়েছে। তার আগেই সব গ্রামবাসী পালিয়ে বেঁচেছে। না, পুরো গ্রামে জয়নাল একা না৷ খাকি পোশাক পড়া, কাধে রাইফেল ঝুলানো রাক্ষসরা তাদের গ্রামেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখান থেকে কোন পথে পা বাড়াবে জয়নুল? খুজে কি পাবে তার মা-বাবাকে?
মালতি দাস সপ্তাহে ছয়দিন ভিক্ষা করে, আর একদিন ছুটি। শহরে হিন্দু ভিক্ষুক নেই বললেই চলে, আর ভগবানের ওয়াস্তে আজকাল কেউ ভিক্ষা দেয়ও না। হিন্দুরাও না, কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়৷ তাই মালতি পেটের খাতিরে আল্লাহর আশ্রয় নিলো। এখন সে আল্লাহর ওয়াস্তে ভিক্ষা চায়। সাধারণত কোনো ভিক্ষুক শুক্রবারে ভিক্ষা করার সুযোগ ছাড়ে না। তবে মালতি শুক্রবারে ভিক্ষা করতে যায় না৷ এইদিন তার এরচেয়েও জরুরি কাজ থাকে! কি এমন কাজ মালতির? যার কাছে কালো পিপড়ার সারি আর কালো অক্ষরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই, অক্ষরগুলো তার কাছে মুল্যবান হবে কেনো? এমনি এক আকাঙখার গল্প "ছোয়া"।
উপহারঃ সন্তান হওয়ার পর মায়ের প্রথম অপেক্ষা থাকে মা ডাক শোনার জন্য৷ সেই মা ডাক শুনতে সেলিনা বেগমের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৫টি বছর! কিন্তু এখনো বাবা ডাকতে পারে না তার ছেলে আলাল। আলালের বাবা কালাম মিয়ার এর থেকে বড় আফসোস, ছেলে আব্বা বলতে না পারলেও "আক্কা" বলা শিখেছে। বিছানায় যখন সে প্রাকৃতিক কাজ সেড়ে ফেলে তখন সে চেঁচাতে থাকে "মা আক্কা" বলে। সামনের জৈষ্ঠ্য মাসের ১৭ তারিখ আলালের ১৮ বছর পুর্ন হবে। কি উপহার অপেক্ষা করছে আলালের জন্য?
বইয়ের ৭ম গল্প "বুড়ো দাঁড়কাক মরে না"। পাঁড় মধ্যবিত্ত একজন মানুষ। তবে সমাজে সম্মান টিকিয়ে রাখতে তাকে জুতা পড়তে হয় চকচকে, জামা প্যান্ট পড়তে হয় ভাঁজ করা পরিষ্কার। বউকে শাড়ি ফার্নিচারের প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে হয়। পুত্রের জন্য হাল ফ্যাশনের জামা-জুতা, ব্যাগ। খালি পকেট নিয়ে তাকে অভিজাত্যের ভাব ধরতে হয়। ভিক্ষুক দেখলেই সে ভয় পেয়ে যায়৷ তাদের করুণার বাণে আহত হলেই পকেট খসিয়ে ছাড়বে! কিন্তু একজন ভিক্ষুকের প্রতি কি এমন মায়া তার? যার জন্য তার মনের দাড়ঁকাক জেগে উঠে?
শেষ গল্প- "বিসর্জন": একটা পোয়াতি ছাগল ও নিত্যসঙ্গী হাপানি ছাড়া সকলেই ত্যাগ করেছে লক্ষনকে। গ্রামে মিলিটারি হাজির। বুড়ো বাপকে ফেলে রেখে ঘর ছেড়েছে লক্ষনের ছেলে আর ছেলে বউ। যুদ্ধের সময় মৃত্যুর চেয়ে স্বাভাবিক কিছু নেই। লাশ দেখে চমকালে তখন ঢং মনে হয়। সেই অস্থির সময়ের এক মায়া এবং মায়া বিসর্জনের গল্প।
ওবায়েদ হক এর প্রথম প্রকাশিত বই। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় তার এই ছোট গল্প সংকলন। বইটির প্রথম মুদ্রণ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় মুদ্রণ ছাপার আর অনুমতি দেন নি লেখক। কারণ তার কাছে নিজের এই লেখাগুলো অপরিপক্ক মনে হয়েছে। তিনি চান নি কেউ তার লেখার সাহিত্যমান নিয়ে প্রশ্ন তুলুক। তবে পরবর্তীতে তিনি PdF আকারে বইটি অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেন পাঠকদের জন্য।
১০৪ পৃষ্ঠার বইটিতে ছোট গল্প মোট ৮টি। একেকটি একেক সুরের। একেক কাহিনীর। তবে প্রতিটি গল্প মায়াবী, ঘোর লাগানো। অনেকদিন পর কোনো বই পড়ে এমন আচ্ছন্নতা ভর করেছে। প্রতিটি গল্পই দারুন! তবে "ভুল সাক্ষাৎ", " প্রায়শ্চিত্ত", "উপহার" - গল্পগুলো আমার বেশিই প্রিয়। "ছোয়া", " বিসর্জন", "বুড়ো দাঁড়কাক মরে না" গল্প ৩টির শেষে হৃদয়কে নাড়িয়ে যাওয়া এক অনুভূতি কাজ করে।
"সুখের মণি" গল্পটি ভিন্ন এক বার্তা পৌছে দেয়। তবে যেই গল্পের নামে বইয়ের নাম "একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা" সেই গল্পটিকেই বইয়ের সবচেয়ে দুর্বল গল্প মনে হয়েছে। তবে ফেলনা নয়। অন্য কোনো সংকলনে হয়তো এই গল্পটিই সেরা গল্প হতো। তবে এখানে বাকি গল্পের ভিড়ে এই গল্পই কিছুটা ম্রিয়মান ছিল।
বইয়ের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হলো লেখকের বর্ণনাভঙ্গি। লেখক কাউকে তেমন কোনো উপদেশ দিতে চান নি পুরো বইয়ে। নিজের গভীর দর্শনবোধ ব্যক্ত করেন নি। তিনি শুধু কেবল নিজের মত করে গল্প বলে গেছেন। পাঠকের অনুভূতি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। ঘোর লাগিয়েছেন।
আমার কাছে বইটি দারুণ লেগেছে। লেখকের বাকি বইগুলোও পড়ে ফেলব শীঘ্রই।
bit.ly/obayed বইটি দীর্ঘদিন 'আউট অব প্রিন্ট' থাকার পরে সফট কপি হিসাবে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে (লিঙ্ক উপরে দেওয়া হল)। সোহেল নূর সাহেব, এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের এজন্য ধন্যবাদ জানাই। পুরনো সংস্করণের দুটি গল্প-- 'তিথির জ্যোৎস্না' ও 'একজন গোয়েন্দার অপমৃত্যু' -- বাদ দিয়ে, 'উপহার' ও 'বিসর্জন' নামে নতুন দুটি গল্প এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 'উপহার' --বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এক ট্র্যাজেডির পটভূমিকায় লেখা একটি মর্মস্পর্শী গল্প-- যা সেই বহুল প্রচারিত ছবিটির কথা মনে পড়িয়ে দেয়, অশ্রুসিক্ত করে তোলে চোখ। 'বিসর্জন'-- মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল অতিক্রম করে এই গল্পটি চিরকালীন জীবনতৃষ্ণার--বেঁচে থাকার জান্তব আকাঙ্ক্ষার ছবিটি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছে যে তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' প্রাগৈতিহাসিক' বা তারাশঙ্করের 'তারিণী মাঝি'-র মত ক্লাসিক গল্পগুলির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। অন্য গল্পগুলির ব্যাপারে অন্যরা যুক্তিযুক্ত আলোচনা করেছেনই। গল্পগুলি যথেষ্ট উতরেছে; ওবায়েদ সাহেব গল্পের আরম্ভটা এমনভাবে করেন, যে অজগরের দৃষ্টিপাতে মোহাবিষ্ট হরিণের মত পাঠক চোখ ফেরাতে পারেনা আর, 'এর পরে কি হবে'-র কৌতূহল তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে টেনে নিয়ে যায় শেষ অব্দি। তাই নতুন সংস্করণের বইটি মুদ্রণের ব্যাপারে লেখকের অনীহা থাকার পেছনে যে কারণ তিনি দেখিয়েছেন--'এগুলি কাঁচা হাতের লেখা', পাঠক হিসাবে সেই যুক্তি অমূলক বলেই মনে করি। পাঠক ভালো লেখা যেমন পড়তে চায়, তেমনই একজন লেখকের ক্রমবিকাশের সাক্ষী থাকার সুযোগটাও তাদের কাছে লোভনীয়। বহু অপাঠ্য বই সরবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত; সেখানে এমন একটা বই, যেটা নিজেদের সংগ্রহে রাখার জন্য পাঠকেরা একান্ত আগ্রহী, সেটাকে লেখক মুদ্রিত রূপে দেখতে চাননা-- এটা বেদনাদায়ক। তবু মানুষ ঠিকই পড়বে। সৃষ্টি এমনই জিনিস, যে তাকে স্রষ্টাও ইচ্ছামত ধ্বংস করতে পারেননা; ইতিহাস সাক্ষী।
একটি শাড়ি এবং কামরাঙা বোমা লেখক: ওবায়েদ হক প্রকাশনী: আদী প্রকাশন (বর্তমানে আউট অফ প্রিন্ট) প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০১৩ পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৯৫ মুদ্রিত মূল্য : ১৬০ টাকা মাত্র যে জীবনের অস্তিত্ব আছে জানি, অথচ চিনিনা, কিংবা শোনা হয়নি সে জীবনের স্বাদ যে মানুষ টা একটা ছোটগল্পের মাধ্যমেই পাঠকদের দিতে পারেন তিনি ওবায়েদ হক। "একটি শাড়ী ও কামরাঙ্গা বোমা" গল্পসংকলনটির প্রত্যেকটা গল্পের আলাদা আলাদা রিভিউ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছিনা। প্রত্যেকটা গল্পেরই একটা কমন প্যাটার্ন আছে, আনপ্র্যাডিক্টেবিলিটি।গল্পগুলো বিশ্লেষনের নয়,উপলদ্ধির।বইটির সবচেয়ে স্পর্শকাতর গল্পটির নাম উপহার।দশ এগারো বছরের কিশোরের তার হারিয়ে যাওয়া মা কে খুজে বেরানোর গল্প "একটি শাড়ী ও কামরাঙ্গা বোমা" অথবা আল্লাহর ওয়াস্তে ভিক্ষা করা ভিখারিনীর অতিতের ভয়ানক স্মৃতি নিয়ে লিখা "ছোঁয়া" গল্প দুটো মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা আর আত্মত্যাগ কে আর একবার মনে করিয়ে দেয়। ‘ভুল সাক্ষাৎ’,‘প্রায়শ্চিত্ত’,‘তিথির জোছনা’ বা 'সুখের মনি' প্রত্যেকটি গল্পেই লেখক আমাদেরই চারপাশের বড়বেশি পরিচিত বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন তবে ভিন্ন আঙ্গিকে। ভিন্ন মাত্রায়। যেটি পাঠককে নতুন করে ভাবতে উদ্দীপ্ত করে।বাস্তবতা আর ভালো লাগছেনা?রম্য গল্প 'একজন গোয়েন্দার অপমৃত্যু' সবার শেষে পড়বেন।বাস্তবতাও আপনাকে হাসাবে।জীবনের সাথে "স���্যতা" গড়ে তোলা এক চমৎকার গুণ। একে অর্জন করতে হয় "জীবন"এর হাত ধরেই।জীবনবোধ, দর্শন,সাধারণের মধ্যে অসাধারণত্ব আর সম্পর্ক নিয়ে কখনো কখনো ছোঁড়া প্রশ্ন নিয়ে পাঠক কে ভাবিয়ে তোলার জন্য ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা রইল লেখকের প্রতি :)
লেখকের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ এটি। মোট ৮টি গল্প আছে বইটিতে৷ প্রথম মুদ্রণের সব বই শেষ হয়ে যাবার পর লেখক বইটি পুনঃমুদ্রণের অনুমতি দেননি৷ কারণ, লেখকের কাছে মনে হয়েছে গল্পগুলো মানসম্মত হয়নি। কিন্তু ব্যাপক চাহিদার কারণে দু'টি গল্প পরিবর্তন করে নতুন দু'টি গল্প সংযোজন করে বইটির ডিজিটাল সংস্করণ বের করেন কিছুদিন আগে। এই ঘটনা জানার পর আগ্রহ নিয়ে বইটি শুরু করলাম। কয়েকটি গল্প পড়ার পর মনে হলো, লেখকের নিজের লেখার ওপর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে। কয়েকটি গল্পের উপস্থাপনা ও ঘটনার আকস্মিকতায় মুগ্ধ হয়েছি। আমার স্বল্পজ্ঞানে 'প্রায়শ্চিত্ত', 'সুখের মণি', 'ছোঁয়া' ও 'বিসর্জন' গল্পগুলোকে বেশ উঁচুমানের গল্প মনে হয়েছে। 'একটি শাড়ি ও কামরাঙ্গা বোমা', 'ছোঁয়া' ও 'বিসর্জন' গল্প তিনটি মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা, কিন্তু তাতেও ঘটনার নতুনত্ব আছে৷ এদিক থেকে লেখককে সম্পূর্ণ সফল বলবো৷ বাকি গল্পগুলোও একেবারে ফেলে দেয়ার মত না। সব মিলিয়ে বইটি পড়ে আমি তৃপ্ত। পিডিএফ পড়েও বই কিনেছি এমন অনেকবার হয়েছে। লেখক যদি কখনো বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ বের করেন, তাহলে সংগ্রহ করার আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে রাখলাম। আর লেখকের আরো কিছু লেখা পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি এই বইটি শুরু করার পরপরই৷ ওবায়েদ হকের লেখার সাথে পরিচিত হবার জন্য আগ্রহীদের আমন্ত্রণ রইলো।
ছোটগল্প বোধহয় এইরকমই হয়। খুব বেশি কিছু বলার নেই। লেখক এখনো তরতাজা যুবক। যা বলার ভবিষ্যত প্রজন্মই বলবে। "দিনের শুরু পুরো দিনের আভাস দেয়" এইটা যেমন সবসময় সত্য নয়; তেমনি লেখকের প্রথম প্রকাশ যে তার লেখকসত্ত্বার প্রকৃতরূপ তাও সবসময় সত্য নয়। বরং উল্টোটাই বেশি সত্য। প্রথম প্রকাশের মত মায়া আর হয় না, তাই সেখানে ছলাকলা-কৌশলের ঘাটতি থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আবেগের ঘাটতি কোনোকালেই থাকে না। আশা করি এই লেখক হারিয়ে যাবেন না। সবাই সৃষ্টিকর্তা-প্রদত্ত লেখনী নিয়ে জন্মান না; উনি জন্মেছেন।
লেখকের প্রথম বই এটি, ছোট গল্পের সংকলন। তবে তিনি প্রথম প্রকাশের পর বইটা আর রিপ্রিন্ট করতে দেন নি প্রকাশককে। কী অদ্ভুত!! পরে নিজেই এর পিডিএফ মুক্ত করে দিয়েছেন এবং গল্পের পরিবর্তনও করেছেন । কিন্তু আমি ভাবছি এত সুন্দর বইটা কেন তিনি আর প্রিন্ট করতে দিলেন না!!! ছোট গল্প কি সহজেই লেখা যায়! চিন্তা শক্তিকে ভালো ভাবে কাজে লাগাতে হয়। আর এ ক্ষমতাকে লেখক ওবায়েদ হক খুব ভালো করেই কাজে লাগিয়েছেন। বইয়ের শুরু "ভুল সাক্ষাত" এ আর শেষটা "বিসর্জন" দিয়ে।
আমরা মানুষ যেকারণে কেউই পক্ষপাতিত্বের উর্ধে নই, আমিও তাই। ওবায়েদ হক আমার বেশ প্রিয় লেখক কিন্তু আমি যদি বলি একারণেই এই বইটি এত ভালো লেগেছে তবে লেখক এবং লেখা দু'য়ের প্রতিই অবিচার হবে। নিজ গুণেই বইটির প্রতিটি গল্পই ছোটগল্প যেরকম চুম্বকের মত হওয়া উচিত সেরকমই। চট করে গল্প শেষ হয়ে যায় কিন্তু গল্পগুলো নিয়ে মাথায় চিন্তা ঘোরা বন্ধ হয় না।
জহির রায়হানের পর অন্য কোন লেখকের গল্প পড়ে এতটা মুগ্ধ হলাম। গল্পকে টেনে হিচড়ে বড় করার কোন প্রবণতা লেখকের মধ্যে ছিলো না। প্রত্যেকটা গল্পের মূল ভাবটুকু যেন শেষাংশে আটকে ছিলো। প্রতিটা গল্প পড়ার পর মাথার ভেতর একপ্রকার ঘোর সৃষ্টি হচ্ছিলো। চমৎকার লেখনী, চমৎকার প্রতিটা গল্পই।
সবগুলো গল্পই মনে দাগ কেটে গেছে।ছোট গল্প হিসাবে বইটা অসাধারণ। অনেক খুঁজে পইটা না পাইয়া পিডিফ পড়লাম। আগে যারা বইটা পড়েছে এবং বইটা সমর্পকে বলেছে এখন মনে হচ্ছে তাড়া কম বলেছে। হ্যাপি রিডিং ☺☺
সামাজিক ধাচের গল্প, উপন্যাস যদিও আমার খুব বেশি পছন্দ না, নতুন লেখকদের মৌলিক লেখা পড়তে অনীহা আসে তবুও এই লেখকের লেখা পড়ি। আমার ধারণা তার কিছু বই টিকে থাকবে।
বইয়ের নাম: একটি শাড়ি ও কামরাঙ্গা বোমা লেখক: ওবায়েদ হক প্রকাশক: অরণ্যমন প্রকাশনী
যখন ছোট ছিলাম চাচা চৌধুরী পড়তাম, বিল্লু পড়তাম, সঙ্গে নন্টে ফন্টে, হাদা ভোদা। একটু বড় হয়ে ফ্যান্টম! ভাবতাম বুঝি সব গল্পরা এরকমই হয়,ছবি সহ। সাদা কাগজে ছাপা গল্প প্রথম পড়ি হয়তো স্কুলের প্রাইজ জিতে, মজার গল্পের বই ছিল সেটা। পরের বছর পুরস্কার পেলাম তথাকথিত "কিশোর সাহিত্য"। তখন ভেবেছিলাম হাসি, মজা আর এই এডভেঞ্চার এই হলো "গল্প"। বড় হলাম, বইয়ের তাক হলো, সিলেবাসেও গল্প এলো, সামাজিক, দুঃখের। শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সুনীল, শীর্ষেন্দু কত কত নাম শিখলাম। বুঝলাম এরকমও গল্পও হয়। জানতাম না। আর একটু বড় হলাম, হাতে এল ফেলুদা, শঙ্কু, অনুবাদে এল শার্লক হোমস, ড্রাকুলা আর কত শত। এরপর আর একটু পাকলাম, বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বই নিয়ে আলোচনা হতো, ভেসে আসতো জর ফিকশন, সায়েন্স ফিক্সন, স্পেকুলেটিভ ফিকশন, জিও পলিটিক্যাল থ্রিলার আরো কত দাঁত ভাঙা নাম। এইভাবেই কোন একদিন হয়তো এই আজব নামের বইটা নজরে এসেছিল, একটু হেসেছিলাম, "এ আবার কি রকম নাম?" এই লেখার জনরা কী? সামাজিক, থ্রিলার, ভুত প্রেত, টল টেল নাকি.... দুরুদুরু বুকে কিনেই ফেললাম আর কিছুক্ষন আগে পড়ে শেষও করে ফেললাম। না! কোন জরে জর্জরিত আমি জানি না। এই বই শুধুই গল্পের। নিটোল গল্প যাকে বলে। লেখক দক্ষ জাদুকরের মতো শুধু সহজ সরল কিছু শব্দ নিয়ে খেলে গেছেন। মানুষ কেটে দুভাগ করে দেবার মত কেরামতি দেখানো জাদু নয়, এক্কেবারে এক নিমিষে পয়সা ভ্যানিশ করার মতো "ম্যাজিক"। তবু নিজেকে বিজ্ঞ ভাবা "পাঠক" পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো খিলখিল করে হেসে হাততালি দিয়ে উঠবে। নিজের ভাষাজ্ঞান জাহিরের দায় নেই এই বইতে লেখকের। ক্লাস ফোরের বাচ্চার মতোই সহজ, সরল সে লেখনী। বাংলা ক্লাসে হঠাৎ করে লিখতে দেওয়া "আমি বড় হয়ে কি হতে চাই" রচনার মতোই স্বতস্ফূর্ত!
সেলাম লেখক আপনাকে। আমার হৃদয়ে আর ঘরের ছোট লাইব্রেরিতে আপনার জায়গা আজ থেকে পাকা হলো।
লেখক বইটির পুনঃমুদ্রণ করতে চাননি কারণ বইটির লেখা নাকি নিতান্তই কাঁচা। আমার নিজেরও তাই ধারণা। একটি ছোটগল্প সংকলনের সব গল্প ভালো হবে না সেটাই স্বাভাবিক, তবে এখানে লেখার মধ্যে একটু বেশিই কাকতালীয় ভাব আছে। যেখানে কাকতালীয় ভাব থাকে সেখানে যুক্তি দিলে অনেক ভুল ধরা পরে। আমার মতে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ গল্প হচ্ছে ছোঁয়া। এরপরে বিসর্জন, সবশেষে উপহার। তবে লেখকের মধ্যে সাবলীল একটা ভাব লক্ষ্য করা যায়। বোঝা যায়, তিনি লেখনীতে গুরুত্ব দিচ্ছেন, চেষ্টা করছেন দাঁতভাঙ্গা শব্দ বা বিরামহীন বাক্য যাতে না থাকে। গল্পের মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয়বস্তু টেনে এনেছেন অনেক অংশে। নাম গল্পের কাহিনীও স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। লেখক ইতিহাসের সাথে নিজের ক্যারেক্টার মিশ্রিত করছেন। ব্যাপারটা ভালো। আশা করি, পরবর্তী বইগুলোতে এই মিশ্রণের আরো ভালো ফ্লেভার আসবে।
এই বইটা পড়েই ওবায়েদ হকের লেখার সাথে পরিচিত হই। বইয়ের প্রথম গল্পটা পড়েই একটা বড়সড় ধাক্কা খাই! আমার প্রিয় লেখক জহির রায়হানের লেখার স্টাইলের সাথে কিছুটা মিল খুঁজে পাই যেন। এরপর একরাশ মুগ্ধতায় পড়ে যাই পুরো বই। সেই মুগ্ধতা এখনো কাটেনি, আশা করি লেখক একের পর এক মুগ্ধতা ছড়ানো বই উপহার দিয়ে যাবেন।