অন্ধকার ফজর আলীকে ঘুম পাড়াতে পারছে না । মেঝেতে উপুড় হয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আছে সে , তার বুক ফেটে কান্না আসছে । প্রফেসর ফজরে পিঠে হাত রাখলো , জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে ফজর ? ফজর কুর্তার আস্তিন দিয়ে চোখ মুছে বলল, স্যার আমি এইখানে থাকলে মইরা যামু । -এইখানের খাওয়া দাওয়া পরিশরম সব একসময় তোমার শরীর মানিয়ে নিবে ।
না স্যার , খাওনের কষ্ট সহ্য করতে পারুম, আমগো জীবনে এর চেয়ে বেশি কষ্ট পাইয়া আইছি । -তাহলে কি হয়েছে ? আমার পোলাডার চেহারা ভুইল্যা গেছি স্যার , মনে করতে পারি না । আমি আমার মজিদের চেহার মনে করতে পারি না । – আমি জানি তোমার কেমন লাগছে । প্রিয়জনদের চেহারা বেশিদিন মনে রাখা যায় না , মন ভুলিয়ে দেয়, যাতে চোখ বার বার তাঁদের দেখে । সেজন্যই তারা প্রিয়জন । স্যার আমি এইখান থেইক্যা পলাইয়া যামু। -সবাই আমাকে পাগল বলে , কিন্তু তুমি এখন পাগলের মতো কথা বলছো। তেরটা বুলেটের কথা মনে আছে ? মরনের ভয় নাই, এইখানে প্রত্যেকদিন মরি ।
মুক্তিযুদ্ধ উপজীব্য বেশ কয়েকটা উপন্যাস আমার পড়া হয়েছে। তার মধ্যে "তেইল্যা চোরা" বেশ ব্যতিক্রম একটা জায়গা নিয়েই থাকবে। এটা খুব সম্ভবত লেখকের প্রথম উপন্যাস, তার বাকি বইগুলোও পড়া আছে বলে জানি যে শুরুর বইয়ের জড়তাটুকু পরবর্তী বইগুলোতে ভালোমতন কাটিয়ে উঠেছিলেন।
ময়রার ছেলে ময়রা, আর চোরের ছেলে চোরই হবে- এইটা যেন চিরন্তন সত্য। আমাদের এই বইয়ের মূল চরিত্র ফজর আলি, যার বাবা বিখ্যাত চোর কসর আলি বা কাইল্যা চোরা। কাইল্যা চোরা কখনোই কারো বাড়িতে ধরা পড়েনি, এতই এলেম তার। এখন চোর তো নিজের ছেলেকে চুরিচামারি বাদে অন্য কিছুর শিক্ষা দিতে পারবে না, তাছাড়া চোরের ছেলেকে কাজেই বা কে রাখবে। যদিও ফজর আলির মায়ের এতে কোনো সায় নেই। এরপরেও ছেলেকে নিয়েই বেরিয়ে পড়লো চুরি করতে, একেবারে হাতে-কলমে শিক্ষা দিবে৷ বিধিবাম, সেবারই কসর আলি প্রথম ও শেষবার ধরা খেল, এবং এক গণপিটুনিতেই শেষ সে।
পরিবারের মূল চালিকাশক্তিই যখন আর নেই, তখন ফজর আলি তার বাবার আসনে বসলো, তার নাম হলো তেইল্যা চোরা। এতে মায়ের মতো ফজর আলির বউয়েরও ঘোর আপত্তি। কিন্তু রক্তগত স্বভাব। কে শোনে কার কথা! চালিয়ে যায় বাবার রেখে যাওয়া পেশা।
তবুও বউয়ের নিরস মুখ আর গ্রামবাসীর ভর্ৎসনা সহ্য করতে না পেরে এই পেশা ছেড়ে দেয় ফজর আলি। আর চুরি করবে না বলে কসম কাটে পাঁচ বছরের সন্তানের মাথায় হাত রেখে।
কিন্তু চোর ছিল বলে কেউ তাকে কাজ দিতে চায় না। যে এক জায়গায় কাজ পেলো, সেখানেও বিনাকারণে চোর অপবাদ নিয়ে পাঁচ বছরের জেল হলো তার। সে যখন জেলে, তখন ১৯৭১ সাল, মুক্তিযুদ্ধ শুরু। জেলের ভেতরে যারা ছিল, তাদের ধারণা বাঙালিরা বা হিন্দুদের দালালরাই বাঙালিদের মারছে৷ কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে যখন তারা নির্মম সত্যটা জানতে পারলো, ততক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। ইউসুফ নামের যেই আসামী চেয়েছিল জেল থেকে বের হয়েই রাজাকারের দলে নাম লেখাবে, সবচেয়ে বড় ধোঁকাটা সেইই খেলো।
যেই ফজর আলীকে সবাই তেইল্যাচোরা বলে ডাকতো, সে হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা সুজন। . . . সার-সংক্ষেপ পড়ে যদি মনে হয় সব কাহিনী বলেই দিয়েছি, তাহলে ভুল করলেন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী এতটুকু সংক্ষেপে লেখা যায় না। ওবায়েদ হক আমাকে সবসময়ই মুগ্ধ করেন। উনার লেখায় একধরণের সাবলীলতা টের পাওয়া যায়, মনে হয় পরম যত্নে কেউ সাদা কাগজে কালি দিয়ে ছবি আঁকছে। সাধারণ সব চরিত্র নিয়ে অসাধারণ একটা গল্প বুনেছেন তিনি।
এই বইটিকে একটি ক্যানভাস হিসেবে ধরি, আর ওবায়েদ হককে ধরা যাক একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে। যার ছবি আকার প্রধান উপকরণ রঙ নয়,শব্দ। একের পর এক শব্দ দিয়ে,অবিশ্বাস্য মুন্সিয়ানায় অসাধারণ একটা মাস্টারপিস রচনা করেছেন তিনি।
প্রথম অংশে একটা চোরের চোর হয়ে ওঠা, বংশানুক্রমে কেন ও কীভাবে একটা চোর চোরই থেকে যেতো, সে চাইলেও কেন একটা স্বাভাবিক জীবন পেতো না, তার পরিবারের অস্বচ্ছলতা, জীবনের কঠোরতা, মানবিক চাওয়া পাওয়া বেদনাগুলো যে একজন চোরেরও থাকতে পারে তা ফুটে উঠেছে।
দ্বিতীয় অংশে জেলখানার জীবনের কথা বলা হয়েছে। জেলখানার ভেতরের জীবনের লেখাটা আমার কাছে দূর্বল লেগেছে। প্রিজন ব্রেকের পার্ট টুকু লেগেছে সবচেয়ে দুর্বল। অনেক নাটকীয়তা চলে আসছে (উনার প্রায় সব লেখায় কেমন যেন একটু নাটকীয়তা থাকে, যেটা আমার পছন্দ না)।
শেষ অংশে আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী আর্মিদের নিষ্ঠুরতার বর্ণনা। এরকম বর্ণনা অন্য বইয়েও পড়েছি। তবে এখানেও মনে হয়েছে লেখক হয়তো একটু অতিরঞ্জিত করেছেন।
গল্প আর চরিত্র গঠন উভয়ই সুন্দর। লেখকের আগের লেখায়ও দেখেছি ছন্দপতন হতে। কোথাও কোথাও লেখা খুব ভালো লেগে যায়, পরবর্তীতে আবার সাধারণ লেখা। আবার একটা অসচেতন আকাঙ্খা তৈরি হয় কখন আরেকটা সুন্দর লেখার ঝাপটা পাবো।
বইয়ের ভালো লাগা কিছু লাইনঃ
বাঙ্গালি কিছু পারুক আর না পারুক চাটুকারিতা ঠিক পারে।
জেল হাজতে নিজের চিন্তা ছাড়া অন্য কারো চিন্তা মাথায় আসে না।
জেলখানায় ভয় আছে, হিংসা আছে, লোভ আছে, কিন্তু মায়া নেই।
মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালীর ইতিহাসে সবচেয়ে স্মৃতিময়, এক মহাকাব্যিক আখ্যানের নাম। কি অদ্ভুত এক সময়, যখন অত্যন্ত ক্ষুদ্র মানুষগুলোও হয়ে উঠেছিল মহীরুহের মতো বিশাল! তেমনই এক মানুষ ফজর আলী, ওরফে তেইল্যা চোরা। ছোট্ট এক গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা ছিল চোর, সে নিজেও চোর। সমাজের নিগৃহিত মানুষদের একজন। ছেলের মুখ চেয়ে চুরি ছেড়ে গতর খাটিয়ে উপার্জনের পথ বেছে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু ভাগ্য তাকে সেই চুরির অপবাদ নিয়েই জেলে যেতে বাধ্য করল। সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়াদ খাটতে চলে গেল ফজর আলী, ওদিকে দেশে বাধল যুদ্ধ।
গল্পের কাহিনী খুবই সরল, আরও একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। কিন্তু তবুও এটি স্বকীয় হয়ে উঠেছে কেবল একটা কারণে, আর তা হচ্ছে লেখকের অদ্ভুত সুন্দর বাচনভঙ্গি, সেই সাথে তার চরিত্র গঠনের ক্ষমতা। বইয়ের প্রতিটি চরিত্র তিনি এমনভাবে তৈরি করেছেন যে মনে হয় তারা আমার কত দিনের চেনা। তাদের দুঃখে মন খারাপ হয়, আনন্দ দেখলে ভাল লাগে। তারা যখন আতঙ্কগ্রস্থ হয় তখন ভয়ে কেপে ওঠে আমার বুক।
ওবায়েদ হকের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ, অদ্ভুত রকমের স্বচ্ছ, সরল বর্ণনাভঙ্গি। তীব্র কষ্ট বা সুখের ঘটনার বিবরণ তিনি দিতে পারেন একই রকম নির্লিপ্ত রসবোধের সাথে। তার তৈরি চরিত্রগুলোর সাথে পাঠক তাই একই রকম একাত্মতা নিয়ে যুক্ত হতে পারে, ঠিক যেমনটা খুব সম্ভব লেখক নিজে তাদের তৈরি করার সময় বোধ করেছেন। তাই ফজর আলীর স্ত্রী আমেনা, তার ছেলে মজিদ, অথবা রোশনী, নসু মাঝি - এই সব মানুষগুলো একান্ত আপন হয়ে ধরা দেয়। পাকিস্তানীদের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ হওয়ার পরে ইউসুফ মুন্সীর তীব্র মর্মবেদনা, আজন্ম পাঞ্জাবী হয়ে উঠতে চাওয়া বাচ্চু যখন মরার আগে পাকিস্তানীদের শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিয়ে যায় তখন তার ক্ষোভ, অথবা লাশের স্তূপ দেখার পরে ফজর আলীর স্তম্ভিত মনোভাব - এগুলো খুব সহজেই আত্মস্থ করা যায়। আর সব কিছু ছাপিয়ে অনুভব করি সেই অস্থির সময়ে মানুষের মাঝে বিরাজ করা আতঙ্ক, ভয় আর দুর্দশার স্বরূপ। ফজর আলী যখন বলে, "আমার যুদ্ধ শেষ হয় নাই," তখন গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। বুঝতে পারি, কেন মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এত গর্বের বস্তু, কেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শত শত গল্প-উপন্যাস-কবিতা-সিনেমা-গান আমাদের দেখা-শোনা-পড়া হয়ে যাওয়ার পরেও তা পুরনো হয় না।
ওবায়েদ হক অত্যন্ত নিভৃতচারী মানুষ বলেই উপলব্ধি করছি, তার প্রতিটি বইয়ের লেখক পরিচিতির জায়গায��� থাকা কথাগুলোই সেই প্রমাণ দেয়। সেগুলো উল্লেখ করছি না লেখা বেশি বড় হয়ে যাওয়ার ভয়ে। আগ্রহী পাঠক তার বই সংগ্রহ করে পড়লেই জানতে পারবেন। আর তেইল্যা চোরা বইটি আপাতত আউট অফ প্রিন্ট হলেও সাজিদ ভাই আশ্বাস দিয়েছেন যে আগামী বইমেলায় রিপ্রিন্ট করা হবে। সুতরাং পাঠকদের আশা হারানোর কোন কারণ নেই।
উপন্যাসটির কয়েক পাতা পড়ার পড়েই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এটা বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাস গুলোর একটি। অন্যরা কী মনে করি আমি জানিনা। কিন্তু অন্ততপক্ষে আমার মতে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই উপন্যাস আমাকে হতবাক করেছে, শিহরিত করেছে, চমকে দিয়েছে। আমার মনে হয়, এই উপন্যাসের বীভৎস আর জঘন্য ঘটনা গুলো কারো পক্ষেই সহজ ভাবে নেওয়া সম্ভব না।
স্বাধীনতার মাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি উপন্যাস পড়ার ইচ্ছা থেকে ও ওবায়েদ হকের ‘তেইল্যা চোরা’ এর ফিজিক্যাল কপি পেয়ে যাওয়ায় শেষমেষ বইটা পড়া হল।
আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা নতুন কোন লেখকের মৌলিক উপন্যাস পড়ব। কারন, যেই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী ছিল না, তাদের ভিতরে মুক্তিযুদ্ধের ধারনাটা কতোটা গভীরে ছড়িয়েছে, তা সবসময়ে জানতে ইচ্ছা করে। আমি লেখকের জন্মসাল জানি না, কিন্তু, এটা জানি যে এখন দুধরনের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশী রয়েছে। এক পক্ষ ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পায় নি। এদের মধ্যে যারা ইচ্ছুক, তারা নিজেরা ইতিহাসটুকু জানার চেষ্টা করে গেছে। আর যাদের কিছু আসে যায় না, তাদের কখনো জানা হয় নি। আরেক পক্ষের মানুষরা এখন তৈরি হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের খুঁটিনাটি জেনে এরা বড় হচ্ছে। আমি জানি না কি কারনে আমার এমন মনে হচ্ছে যে লেখক আমাদের মতোই পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধকে আবিষ্কার করেন নি এবং আমাদের মতোই ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ পড়ে রাশেদের জন্য মন খারাপ করেছেন। আমার ধারনা ভুল হতে পারে।
যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়তে ভালোবাসে তাদের কাছে এই উপন্যাসের প্রতিটা উত্থান-পতন পরিচিত মনে হবে। কারন, ইতিহাসের মূল অংশ এটাই ছিল যে আমরা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম। কাহিনীর সবটা জুড়েই ফজর ওরফে তেইল্যা চোরার দেয়ালে বারবার পিঠ ঠেকে যায় এবং সেই জীবনযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আসার আগেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। তার চোখ দিয়ে আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে দেখি। এমন এক গ্রামে ফজরের বাস, যাদের ধারনাই ছিল না যে যুদ্ধ হলে আসলে হবেটা কি। আর গ্রামবাসীরা যে খুব সরল বা সদয় ছিল, এমন কিছুও লেখক দেখান নি। দুর্বলের উপর অত্যাচার করে আমোদ পাওয়ার চিরায়ত এক চিত্র এঁকে এরপর যুদ্ধের দিকে আস্তে আস্তে পাঠককে নিয়ে যান তিনি। এখানেও তিনি কোন তাড়াহুড়ো করেন নি। কারন, বাচ্চু যে মনে প্রাণে পাকিস্তানি হতে চায়, তা আমরা এই ফাঁকে জানতে পারি। আরো জানতে পারি যে জেলে বসে ইউসুফ মুন্সী মুক্তিবাহিনীর লোকদের হিন্দু ও ইন্ডিয়ার দালাল বাদে আর কিছু ভাবে না। সুজনের সাথেও আমাদের পরিচয় হয়। তার প্রবল ইচ্ছা জেল থেকে বেরিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার। আর দিনরাত বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা প্রফেসর সাহেবকে আমাদেরও রহস্যময় মনে হয়। যু্দ্ধের বাতাস থেকে এই জেলখানা মুক্ত থাকে না এবং এদের কয়েকজন জেলের তুলনায়ও আরো নিষ্ঠুর এক মঞ্চে এসে হাজির হয়। অকল্পনীয় ভয়াবহতা তাদেরকে স্পর্শ করে। তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়।
লেখকের লেখনী নিয়ে অভিযোগ করার কোন জায়গা নেই। গল্প বলার প্রতি তাঁর আন্তরিকতা স্পষ্ট। কোন অংশেই তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন গালভরা ও ফাঁপা বক্তৃতায় চলে যান না। খুবই নির্লিপ্তভাবে দেখাতে থাকেন যে কার কি ভাবনা ছিল তখন এবং এসব ভাবনার ভিন্নতা পাঠককে বেশ ভাবিয়ে তুলে। উপন্যাসটিতে বীরাঙ্গনাদের উপর অত্যাচারের বিষয়টিও কাহিনীর অংশ হিসেবে এসেছে যা আমার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের সব উপন্যাসে কাহিনীর প্রয়োজনে আসা ভীষন জরুরী হয়ে পড়েছে।
সবার শেষে অবশ্যই ব্যক্তিগতভাবে রিমুকে একটা ধন্যবাদ দিব। কারন, সে এই বই না পড়লে আমার এ সম্পর্কে জানাই হতো না এবং শুধুমাত্র সে রেকমেন্ড করায় বইটা পড়েছি বলে আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।
ওবায়েদ হকের ‘জলেশ্বরী’ ও ‘নীল পাহাড়’ পড়ার ইচ্ছা আছে। আশা করি, সেগুলোও ‘তেইল্যা চোরা’ এর মতো চমৎকার এক পাঠাভিজ্ঞতা দিবে।
বর্তমানে বেঁচে আছেন আর ভালো লিখতেছেন এমন লেখকের সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। তবে যারা আছেন তাদের লিস্ট করলে সবার উপরে যে ওবায়েদ হক জায়গা করে নিবেন সে কথা একবাক্যে বলা যায়। যে লেখার মাধ্যমে চিত্র আঁকা যায় সে লেখা বাংলার ক্লাসিক রাইটারদের পর জহির রায়হানের লেখাতে পেয়েছিলাম। যেসব লেখার ভেতর একবার ঢুকে পড়লে আর বেরোনো যায়না। পুরো একটা ক্যানভাস চোখের সামনে খেলা করে। আর শব্দগুলো জীবন্ত হয়ে রক্তমাংসের মানুষ আর সবুজ-রঙিন পৃথিবী হয়ে যায়। যেখানে মনের ভেতরের স্ক্রিনে তাদের সম্মিলিত অভিনয় ঝকঝকে পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়। ঠিক তেমোনি বৈশিষ্ট্য ওবায়েদ হকের লেখার। লেখকের একটা বই বাদে (বর্তমানে প্রিন্টআউড) সব বই পড়া শেষ আমার। এতটুকু বলতে পারি প্রত্যেকটা বই বর্তমানে যেমন জনপ্রিয় ভবিষ্যতে তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি জনপ্রিয় হবে।
তেইল্যা চোরা বইটি অন্য সব বইয়ের মতোই। যেখানে সমাজ, মানুষ, নিগ্রহ, আশা আকাঙ্খার মাঝে ৭১ এসে উপস্থিত হয়। সে সময়টা নিয়ে লেখা তাই স্বাধীনতাকে টানতেই হয়। আর সেই স্বাধীনতার কল্যানে সমাজের অনেক নিম্নবর্গ ট্যাগ ধারী মানুষরা হয়ে ওঠেন একেকটা ওয়ার হিরো।
ময়রার ছেলে ময়রা হবে আর চোরের ছেলে হবে চোর। এই এক ধারণা থেকে বের হতে অনেক সময় লেগে গেলেও অবশেষে কসর আলীর ছেলে ফজর আলী ঠিক স্রোতের বিপরীত কাজটাই করতে উদ্যোত হয়। ফলাফল যা হবার তাই। আমি ভালো হলেই যে জগতের সবাই ভালো হয়ে যাবে একথা তো বলা যাবেনা। সেই প্রাচীন কথা "আপনি ভালো তো জগৎ ভালো" ফলপ্রসূ হবার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। ছেলের নামে শপথ করে ফজর আলী ভালো হয়ে গেলেও সমাজ আজও তাকে কাইল্যা চোরা আর তেইল্যা চোরা বলেই মানে।
ভালো হবার সুযোগ সমাজ দেয়না একথা ভুল। সুযোগ সমাজ দেয় যদি সেখানে সমাজের স্বার্থ থাকে। সমাজের স্বার্থ মানে সমাজকর্তার একার স্বার্থ। যেখানে স্বার্থ নেই সেখানে সমাজের উচ্চমাপের মানুষদের নিম্নমানের মন সায় দেয়না। ফলে অহবেলাই, মিথ্যে কারণে, অতীতের কারণে ধুঁকে মরতে হয় একটু আশার আলো খোঁজা মানুষদের।
তেইল্যা চোরা শুধু চোরকে নিয়েই লেখা না। চোরের মাধ্যে সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তোলা এক অনন্য বই তেইল্যা চোরা। "বঙ্কিমচন্দ্র" তার "কমলাকান্ত" তে রূপক-অর্থে সমাজের আসল চিহ্ন দেখালেও সেই রূপকথার সারমর্ম যেমন খুব সহজেই অনুমান করা যায় তেমনি সমাজনির্ভর লেখা গুলোতেও সমাজের চিত্র খুব সহজে অনুমান করা যায় যদি সেটাকে নিছক গল্প না ভেবে নিজের সমাজের সাথে কল্পনা করে পড়া যায়।
সমাজের প্রথার, নিয়মনীতির মারপ্যাঁচে আঁটক���য় শুধু নিম্নশ্রেণীর মানুষরা। যাদের গোলা ভরা ধান থাকেনা, যাদের পুকুর ভরা মাছ থাকেনা, যারা প্রয়োজনে-অপ্রোয়জনে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ভূরিভোজের আয়জন করতে পারেনা, তাদের জন্য তখন সব নিয়মনীতি বরাদ্দ হয়ে যায়। যে কোনো একদিক দিয়ে তো পুষিয়ে দিতেই হবে!
কিন্তু এই ক্রান্তিলগ্নে কে হাল ধরবে? সমাজপতি? না ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরতেও নিম্নশ্রেনীর মানুষদেরই দরকার। যখন পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমনে লণ্ডভণ্ড পুরো পূর্ব-বাংলা তখন হাল ধরার সাহস দেখায় চোর, বদমাশ, দুবেলা না খেতে পাওয়া মানুষরাই। যে তেইল্যা চোরা কে মানুষ সম্মানের ভয়ে কাজ দিতে অস্বীকার করে তাদেরই সম্মান নির্ভর করে তেইল্যা চোরাদের মতো মানুষদের উপর।
তেইল্যা চোরা এক বিচ্ছিন্ন এলাকার বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর কথা। তবে এ কথা পুরো বাংলার। এ কথা পুরো বিশ্বের। সময়, কাল, পাত্র ভেদে কিছুটা এদিক ওদিক হলেও সমাজ সেই সৃষ্টিলগ্ন থেকেই একই রয়ে গেছে।
"তুমি খুব ভালা গো মাঝি তুমি খুব ভালা। এইবার আসলে তোমারে দিমু, ভালোবাসার মালা।"
৭১ এর অস্থিতিশীল একটা সময়। রাজনীতির মারপ্যাঁচ আর ঢাকঢোল বাজিয়ে যুদ্ধ যখন এদেশে প্রবেশ করবে ঠিক তার আগে ধরা পরলো ফজর আলী ওরফে তেইল্যা চোরা। চুরিতে ইস্তফা দিয়ে সে যেদিন গায়ে গতরে খেটে টাকা রোজগারের শপথ নেয় সেদিনই জেলে যেতে হয় তাকে। জেলের পুলিশের বেদম আঘাত সহ্য করতে পারে ফজর আলী কিন্তু বাড়িতে তার স্ত্রী আর কিশোর ছেলেটা কি খাচ্ছে,কিভাবে দিন পার করছে সেই চিন্তা যেন সব কষ্ট ছাপিয়ে যায়। ঠিক এমনই এক অস্থিতিশীল অবস্থায় এক চোরের জেলের জীবন আর ওদিকে স্বামী ছাড়া বৌ আর বাবা ছাড়া সন্তানের জীবনযুদ্ধ নিয়ে লেখা ওবায়েদ হকের 'তেইল্যা চোরা'।
ওবায়েদ হকের লেখার সাথে আমরা মোটামুটি পরিচিত আর সেই পরিচিতির খাতিরে তার বেশ কিছু লেখার সাথে পরিচিত হয়েছি। তেইল্যা চোরা সেই সারির দিক থেকে সম্ভবত চতুর্থ। লেখকের বইতে যেই ব্যাপারগুলো উঠে আসে সেটা হলো তিনি এমন অবহেলিত লোকজনের কথা বলার চেষ্টা করেন সেটা সাধারণত কেউ বলেনা বা লেখেনা বা লিখলেও হয়ত হাতেগোনা দুয়েকটা। এই বইতেও তেমন একদিকে সদ্য জেলে যাওয়া তেইল্যা চোরার জীবন আর অন্যদিকে চোরের পরিবারের জীবন দুটো দুই মেরুর গল্প। একদিকে জেলে গিয়ে ফজর আলী নতুন মানুষদের নিজের পরিবারের মত মনে করে আর অন্যদিকে স্বামী ছাড়া বৌ আমেনা শুরু করে টিকে থাকার সংগ্রাম যেই সংগ্রামের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। লেখকের একটা গুণ আছে আগেও বলেছি সেটা হচ্ছে অল্প কথায় বিরাট কিছু বুঝিয়ে বলতে পারেন। তবে এইযে মাঝে মাঝে এই অল্প কথা আর উপমার ব্যবহার একটু একঘেয়ে লেগে যায়। যুদ্ধের কিছু ব্যাপার মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিলো একপাক্ষিক। তবে সব মিলিয়ে বেশ ভালো লেগেছে তেইল্যা চোরা।
এই বইটা নিয়ে যত ভালো কথা শুনেছি, সব ঠিক শুনেছি। ছোট্ট বই। থেমে থেমে অনেক কিছু চিন্তা করতে বাধ্য করা বই। প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ। চরিত্ররা মনে দাগ কাটার মতো। একটা লাইন ছিল এমন, ধর্মবিদ্বেষ তার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। যার কথা বলা হচ্ছে, সে একজন অসম্ভব ভালো মানুষ। কিন্তু এই বদ্ধমূল prejudice সে কখনো কাটাতে পারবে না। মানুষের অনেক রূপের দেখা মেলে এই বইতে─নিঃস্বার্থভাবে পরিচিত/অপরিচিত এমনকি শত্রুরও পাশে দাঁড়ানো মানুষ, চিন্তাভাবনা ছাড়া অন্যকে বেঁচে দেওয়া মানুষ, যতটা হিংস্র হওয়া সম্ভব মানুষের উপর তারচেয়েও বেশি নির্যাতন চালানো মানুষ।
বইয়ের প্রিয় শব্দ কুটুম। প্রিয় লাইন : 'বাঙালি পুরুষ যখন বউ আর চোরকে শায়েস্তা করে তখন তার মনে কোনো মায়া থাকে না।'
লেখকের 'জলেশ্বরী' বইটা পড়ে আমি অনেক মুগ্ধ হয়ে ছিলাম। আজ 'তেইল্যা চোরা' পড়লাম। চোর এবং তার পরিবার কিংবা চোরের আশেপাশের মানুষজনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বইটা। ১৯৭১ এ যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন কারা যুদ্ধে নেমে পরে, আর কারা ভাল ছেলেটির মুখোশ পরে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত ছিল, তার একটি চিত্র বইটিতে উঠে আসে। সহজ, সাবলীল ভাষায় অনেক কঠিন পরিস্থিতির বর্ণনা কি দারুণ ভাবেই না করেছেন লেখক। কখনো হাসি পেয়েছে, কখনওবা দুখে বুকটা ভারী হয়ে এসেছে। এক চোর পরিবারের কাহিনী, দেশ নিয়ে ভাবনা, ভাগ্যবিরম্বনার ফিরিস্তি ছিল বইটাতে। আরো ছিল আমাদের বাঙালীদের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম চরিত্রের বিশ্লেষণ। সবমিলিয়ে অনেক ভাল লেগেছে বইটা।।
আমার মুখ থেকে একটা বইয়ের গল্প শুনতে শুনতে বন্ধু হাতের সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে ভাবের সহিত মুখে প্রজ্ঞা এনে বললো, 'ওবায়েদ হক পড়। তোর মনেহয় ভালো লাগবে...' বলেই ক্ষ্যান্ত দিলোনা। লেখকের একটা অনলাইন গল্প পড়ালো। বললাম ভালো, তবে বিশেষ ভালো লাগলোনা। ওদিকে, আমি ততদিনে নতুন যুগের সাহিত্যিকদের অলসতায় বিরক্ত। ভাবলাম বন্ধু আমার বইটই তেমন পড়েনা তো, সাধারণ গল্পকে অসাধারণ ভাবসে, ও আর কি বুঝবে। আমি পড়েছি আরও ভালো গল্প। ধরেছেন ঠিকই, এরপর আর বিশেষ বেইল দেইনাই বিষয়টাকে। তখন ওবায়েদ হকের প্রকাশিত বই বোধহয় একটাই, দেখতে দেখতে চোখের সামনে ৪টা বই প্রকাশ হয়ে গেলো। দিন কেটে গেলো, আমিও সাঁতার কেটে গেলাম জীবন স্রোতে। গ্রাম্য ঘ্রাণ হতে ঘর বাঁধলাম বহু দূরের শহরে। এত দূর শহরে, যেই পুরো শহরে আমি একা। আমি গ্রাম ভুলে গেলাম।
এই গল্পটা একই সাথে গ্রামের এক সিধেঁল চোরের গল্প বলে, আবার পরক্ষণেই মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে। এক চোর, যাকে আপনারা কখনো ভালো হতে দেবেন না। কাজ দেবেন না কারণ সে চোর। ভাত দেবেন না কারণ সে চোর। বাধ্য হয়ে চুরি করলে বলবেন ,শালার ব্যাটা চোরের ঘরের চোর! পুরো গুষ্টি ধরে চোরের পরিবারকে চোস্ত করে ধুয়ে দেবেন। এই মোরাল দ্বন্দ নিয়ে গল্পটা শুরু হলেও শেষ হলো এক করুণ মুক্তিযুদ্ধের গল্পে।
জহির রায়হান এর হাজার বছর ধরে যখন প্রথম পড়ি, আমার খুব আফসোস হচ্ছিলো এই ভেবে যে জহির রায়হান আর বেঁচে নাই। এত সরল গদ্যে আর কে লিখবেন গ্রাম বাংলার গল্প? যেখানে সত্যিকারের কিছু গ্রাম্য ন্যারেটিভ, সমস্যা উঠে আসবে? কোনো অসাধারণ দৃশ্য বর্ণণাকারী, আবেগমাখা গল্পকার নয়, একদম সাধারণ চোখে দেখা অসাধারণ চোখের গল্পকার খুঁজছিলাম। যিনি এমন কিছু খুঁটিনাটির দেখা দেবেন আর দশজন সাহিত্যিক থেকে তাকে আলাদা করে দেবে। 'তেইল্যাচোরা' যখন পড়ছিলাম, সেখানে জোয়ারদার সাহেবের বিচারের দৃশ্যে এসে হঠাৎ আমি একটা জহির রায়হানীয় গন্ধ পেলাম! হাজার বছর ধরে গল্পের সালিশের যে আবহটা, ঠিক সেরকম আবহ। পাঠক, যিনি আমার লেখাটি পড়ছেন মাফ করবেন। কারণ দুটো গল্পের কোনোই মিল নেই। না বিষয়বস্তুতে, না বর্ণণায়। তবু এতবড় তুলনায় কেন গেলাম? ওইযে একটা অনুভূতির জন্য। যেই প্রাচীন চাপা অসহায় অনুভূতিটা জহির রায়হান দিয়েছিলেন, সেরকম কিছুর জন্য। তার গদ্যের প্রাচীন ভাবের জন্য। আপনি জানেন কি হতে যাচ্ছে, কি ভয়ংকর সরল একটা পরিণতি...কিন্তু আপনার কিচ্ছু করবার নেই। কিংবা আমরা বলতে পারি দ্বৈত চরিত্রগুলির জন্য। যাদের আপনি খুবই অপছন্দ করছেন, কিন্তু দরকারে আপনার সবচাইতে বেশি ভরসার স্থান হবে সেই চরিত্রগু���োই। কিংবা এক গল্প থেকে অন্য গল্পে স্মুথ ট্রানজিশনগুলো্র জন্য। সামাজিক গল্প থেকে হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধের মাঠে পদার্পণ। কি দারুণ! ওবায়েদ হক তো আমাকে সেই ভরসা দিয়ে ফেলেছেন ইতোমধ্যেই যে না, জহির রায়হানের উত্তরসূরী হিসেবে তিনি পারবেন চালিয়ে নিতে।
তিনি সরল ভাষায় গল্প বলেন। অন্যরকম কিছু তুলে আনেন যা সাধারণ লেখকদের চোখে পড়েনা। তার গল্পে আবেগ আছে। পরিণাম আছে। একটা হাহাকার করা অনুভূতি আছে। তবুও তার বইটি অসাধারণ নয়। কেন নয়?
মাত্র একটি বইয়ের বিচারে তার লেখার সমালোচনা করা ঠিক না। তবুও আমার মনে হয়েছে তার লেখার ধরণ কখনো সখনো অতিই সরল। একটানা লেখা, স্বরের তারতম্য কম। আবেগ কোথাও কোথাও অতিনাটুকে দৃশ্যে রূপ নিয়েছে। আমার বারবার মনে হয়েছে লেখক আরেকটু সময় কেন নিচ্ছেন না। আরেকটু রয়েসয়ে পরিণত কেন করছেন না ক্যারেক্টার আর্ক গুলো। এই একটা বই পড়েই আমার মনে হয়েছে লেখকের আসলে আরেকটু সময় নেয়া উচিৎ তার গল্পকে পরিণত হতে দিতে। সরল গদ্য পড়তে কার না ভালো লাগে, তবুও লেখার ভঙ্গিমা নিয়ে আরেকটু নিরিক্ষা করা উচিত। হয়তো তাহলে একসময় তার গ্রেট হবার পটেনশিয়ালটা কাজে লাগবে।
আরও মনে হয়েছে আমার আরও দেশীয় লেখা পড়া উচিত। আমার ভাষায় এক্সপ্লোর করা অনেক বাকি। যেইসব বিষয়কে 'বেইল' না দিয়ে এতদূর এসেছি, সেসব একটু আধটু চেখে দেখা বাকি।
কিছু কিছু অংশ আমাকে স্কিপ করতে হয়েছে, লেখকের জবানীতে সমস্ত সত্য হয়ে ধরা দিচ্ছিলো।আমি কল্পনাপ্রবণ পাঠক লেখকের সমস্ত চরিত্রের সাথে আমি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিলাম সেই ঘটনার অংশ হয়ে। লেখকে সাধুবাদ।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা নজরুল সঙ্গীতের রেওয়াজ করা হিয়াদি যখন কোনো এক বিকালে আমারে আইসা বলে, ''বুঝলি, নজরুল তেমন গ্রেট সাহিত্যিক না।" তখন তেমন অবাক হই না। ওর দারুণ এই স্টেটমেন্ট শুইনা কথা চালায় যেতে আগ্রহী হই বরং। পা দুলায় দুলায় অজ্ঞের মতো মতামত দেই,"যারে নিয়ে মেতে আছো, তারেই গ্রেটের আসন থিকা নামায় দিলা?" সে তখন শুরু করে তার হালকা চালের বিশ্লেষণ। আমি শুনে যাই। একইরকম অবাক হই না, যখন আব্দুল বারী চাচা ড্রয়িং রুমে বসে কাপের পর কাপ চা সাবাড় করেন আর আমাকে রবীন্দ্রনাথের ভুল ধরায় দেন। শুনি। মাঝেমধ্যে মতামত দেই। আর ভাবি, আসলে কেউই গ্রেট না। সৈকতের সাথে একবছর পর কথা বলার পর যখন ও বললো, ওবায়েদ হক আসলে ততোটাও ভালো না! তখনও আমি অবাক হই নাই। যদিও ও এককালে আমাকে দারুণ মুগ্ধতার সাথে এ বই সাজেস্ট করসিলো। এক বছর অনেক লম্বা একটা সময়। এতে মুগ্ধতা কেটে যেতেই পারে। তাই, ওর সাথে তাল মিলাই। আঙুল চালায় মেসেঞ্জারে লিখি,"একদম! ওনি অনেকের থেকেই ভালো, কিন্তু এতোটাও আহামরি না।"
ওবায়েদ হক মাঝারি মানের লেখক। ইউনিক কিন্তু মাঝারি মানের লেখক। ইউনিক কেন? এই প্রশ্নটা আসতে পারে। উনার গদ্যে মূলত একটা প্রাচীনতা আছে। পড়ার সময় আপনার মনে হইতে পারে উনি শরৎচন্দ্রের সাধু রীতির গদ্যকে চলিত ভাষায় রূপান্তর করে একটা গদ্য আবিষ্কার করসেন। যেই গদ্য ব্যবহারে উনি দারুণ পারদর্শী এবং বেশ ভালো কিছু বই লিখসেন এই গদ্যকে আঁকড়ে ধরে। এই জিনিসটা বেশি লেখকের মাঝে নাই, বা থাকলে তারা এতোটা সফল না। এইজন্য, ওবায়েদ হক ইউনিক। কিন্তু মাঝারি কেন বললাম? উনি গল্প বলেন। গল্প আরও অনেকেই বলেন। কিন্তু উনার গদ্য কি এই গল্প বলার শিল্পটাকে ঠিক অসাধারণের পর্যায়ে নিয়ে গেছে? আমার মনে হয় না। এর একটা প্রধান কারণ উনার বাক্য গঠনে বৈচিত্র্যতার অভাব। একই বিভক্তিযুক্ত শব্দ দিয়েই উনি একের পর এক লাইন শেষ করেন। সরল গদ্যই উনার শক্তি—এ কথা হয়তো উঠে আসবে। কিন্তু হুমায়ূন-সমরেশ-শংকরও সরল গদ্যে 'মিডিওক্যার' অনেক গল্প লিখে গেছেন। তবে, উনাদের ভেজালহীন গদ্য আর গল্পের শক্তিতে অনেক অনেক সময় সেইসব সাহিত্যও বেশ ভালোভাবে উতরে গেছে। সক্কল শ্রেণীর পাঠককে ছুঁইসে। ওবায়েদ হক? আমি বলবো, উনার ক্ষেত্রে সেইরকম কিছু হইতেসে না। 'জলেশ্বরী'-তে অন্তত কাব্যিকতা মিশিয়ে ছিলেন। অই কিছু কিছু উপাদেয় অংশের কারণে বইয়ের অনেক অংশের এভারেজ জিনিস মাফ করে দিতে পারসিলাম। তেইল্যা চোরা-তে সেই সুযোগ নাই। খুব একটা দারুণ জিনিস চোখে পড়ে নাই পুরা বইয়ে।
নীল পাহাড়পড়ে নেই আগে, এরপর ওবায়েদ হকের সাহিত্য নিয়া আরও বিস্তারিত লিখবো। আপাতত এর বেশি আগানো ঠিক না।
রেটিং:2¼(দশমিকের কোঠা না থাকার দুঃখে গুড্ডু ছেড়ে দিবো কোনদিন)
ওবায়েদ হক এর লেখা প্রথমবার পড়লাম। উনার লেখা নিয়ে অনেক প্রশংসা শুনেছি এবং তা যে কতটা সত্য তা এই বই পড়ে বুঝতে পারলাম। এই বই এর প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বই এর মূল চরিত্র ফজর আলী যার বাবা বিখ্যাত চোর কাইল্যা চোরা ওরফে কসর আলী। ফজর আলী ও কিন্তু তার বাবার পেশা থেকে সরে আসেনি। সে ও পরে বিখ্যাত চোর তেইল্যা চোরা হয়েছে। ফজর আলীকে তেইল্যা চোরা তার বাবা বানায়নি, এই সমাজ বানিয়েছে। "চোরের পোলা চোর হইবো, জজ ব্যারিস্টার হইতো না"। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন "খাইতে পাইলে কে চোর হয়?"। যে সমাজ নীতিকথার বুলি আওড়ায় সেই সমাজ ই তাদের গলায় চোর এর মেডেল ঝুলিয়ে দিয়েছে। এই গল্প কিন্তু ফজর আলীর তেইল্যা চোরা হয়ে উঠার গল্প নয়। এই গল্প হচ্ছে তেইল্যা চোরার একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠার গল্প। বউ আর ছেলের জন্য ফজর আলী চুরি ছেড়েছিল কিন্তু ভাগ্যের উপহাসে চুরি বিনা চোরের অপবাদে জেল হয়েছিল তার। তারপর নানা কথা, ফজর আলীর পরিবার এর দুর্দশা ও একসময় ফজর আলীসহ আরো তিনজনের জেল থেকে পালানো। ফজর আলী জেল থেকে পালানোর আরো আগে থেকে দেশে আগুন জ্বলছিল। জেল থেকে পালানোর পর সেই আগুন নিজ চোখে দেখে ফজর আলী। তার বুকেও আগুন জ্বলতে থাকে। এই বই থেমে থেমে অনেক কিছু চিন্তা করতে বাধ্য করে। ওবায়েদ হক বাস্তবতার নির্মম সত্যকে লাইনে লাইনে গেথে দিয়েছেন। বই এর প্রতিটি চরিত্র নিয়ে বেশকম লেখা আছে এবং যা আছে তাতেই চরিত্রগুলো মনে দাগ কেটে যায়।
হাইপ এমন একটা জিনিস যেটা থেকে আমি একশো গজ দূরে থাকি। কারণ বাঙালীর হাইপ সবসময় নেগেটিভ জিনিস নিয়ে বেশি। তাই বর্তমান লেখকরা যারা হাইপের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে নিজেদের বইয়ের তিন চারটা মুদ্রন শেষ করে ফেলছে তাদের বইয়ের কাছ থেকে আমি একটু দূরে দূরেই থাকি। এটা আমার নিতান্তই ভীতি ছাড়া অন্য কিছু না। আশাহত হওয়ার ভীতি।
যাক গে, আসল কথায় আসা যাক। বইয়ের গরমা গরম বাজারের চিপায় চাপায় দেখি কিছু পাঠকদের মধ্যে এক লেখকের জন্য দীর্ঘশ্বাসের ছড়াছড়ি। লেখকের নাম ওবায়েদ হক।লেখকের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করলাম। লেখকের পারসোনালিটি ইমিডিয়েটলি অ্যাট্রাক্ট করল। প্রচারণাবিমুখ একজন লেখক। কখনো পাঠক সরাসরি লেখকের সাক্ষাৎ পায়নি। তবুও লেখালেখি নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু পাঠককূলে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তাই ভেবে দেখলাম কিছু একটা পড়ে না দেখলেই নয়।
তাই নীরিক্ষামূলকভাবে লেখকের কিছু ছোটগল্প পড়ার জন্য উদ্যোগী হলাম।ফেসবুকে লেখকের প্রোফাইল থেকে পেয়েও গেলাম দুটি গল্প।পড়ে ফেললাম টুক করে। প্রথম গল্পের নাম ‘বুড়ো দাঁড়কাক মরে না’। অনেস্টলি বলতেই হচ্ছে অনবদ্য একটা গল্প ছিল। শুরু থেকে সমাপ্তি পুরোটুকুই একেবারে দুর্দান্ত।যদিও গল্পটি তার প্রকাশিত কোনো গ্রন্থতে নেই। কোনো এক সংকলনের গল্প।পরের গল্প যেটা পড়লাম সেটার নাম ‘অ-সুখ’। এই গল্পটাও দারুণ। তবে আমার আগেরটাই বেশি ভাল লেগেছে।
ছোটগল্প দুটো পড়ে মোটামুটি ইম্প্রেসড হলাম।গল্প দুটিতে শব্দের চয়ন এবং কাহিনীর ধারা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এবং গল্প দুটির আগা গোড়া কোনো অসংগতি নেই। তাই মোটামুটি আশ্বস্ত হয়ে লেখকের উপন্যাস পড়ার জন্য মনস্থির করলাম। মেলাতে ‘তেইল্যা চোরা’ বইটি কালেক্ট করলাম। যদিও জনপ্রিয়তার খাতিরে কিনতে গিয়েছিলাম লেখকের ‘নীল পাহাড়’ উপন্যাসটি।দুঃখের বিষয় স্টলে গিয়ে পেলাম না। আউট অফ প্রিন্ট নাকি। এবার আসা যাক, ‘তেইল্যা চোরা’ উপন্যাসটার দিকে। উপন্যাসটির পটভূমি রচিত ‘তেইল্যা চোরা’কে অর্থাৎ উপন্যাসের মূল চরিত্র ফজর আলীকে নিয়ে।ফজর আলী পারিবারসূত্রেই চোর।তার বাবা কসর আলী পরিচিত ছিল ‘কাইল্যা চোরা’ নামে। এই কাইল্যা চোরা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়ে গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে প্রাণ হারায়। তাই কাইল্যা চোরার বউ অর্থাৎ ফজর আলীর মা চায় নি যে তার ছেলেও এই পেশায় আসুক। কিন্তু অনেকটা বাধ্য হয়েই ফজর আলীকে চুরির পেশায় আসতে হয়।
ফজর আলীর জীবন তার স্ত্রী আমেনা ও মজিদকে নিয়ে। এক সময় বউ-ছেলের মুখের দিকে চেয়ে ফজর আলী চুরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ছেড়েও দেয়। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় জমিদারের বাড়িতে মিথ্যা চুরির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ফজরকে যেতে হয় জেলে। জেলে তার পরিচিতি হয় আরো কিছু উল্লেখযোগ্য কয়েদির সাথে যারা উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এদিকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধ। হানাদাররা গ্রামে গ্রামে শিশু এবং মহিলাদের নির্বিচারে অত্যাচার করছে এই খবর শুনে ফজর আলী এবং তার সঙ্গীরা পালানোর ফন্দি আটে। এবং ফজর আলী জেল পালিয়ে তার পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারে কী না এই নিয়ে ‘তেইল্যা চোরা’ উপন্যাসের মূল কাহিনী।
দুঃখের বিষয় হলেও বলতে হচ্ছে ছোটগল্পগুলি যতটা আশাজাগানিয়া ছিল, ‘তেইল্যা চোরা’ উপন্যাসটি ততটা আশা পূরণ করতে পারে নি। প্রথম দিকে এবং মধ্যদিকে লেখার খেই হারিয়েছে। এবং কিছু শব্দ এবং উপমা মনে হয়েছে লেখক জোর করেই ব্যবহার করেছেন। কিছু কিছু বিষয় একটু সিনেম্যাটিক লেগেছে। তবে শেষের দিকে উপন্যাস জমে উঠেছিল।
সব চরিত্রগুলো ভাল মত ফুটিয়ে তুলেছেন। ফজর আলী, আমেনা থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল মাইনর চরিত্রগুলোর ক্যারেকটার ডেভেলপমেন্ট ভাল ছিল।ভাষা সাবলীল।লেখক অনুভূতি নিয়ে ভালই খেলতে পারেন সে কথা আন্দাজ করা যায়। তবে গঠনশৈলী এবং শব্দের ব্যবহার দেখতে গেলে আমার পড়া পূর্বে উল্লেখিত গল্প দুটির চেয়ে ‘তেইল্যা চোরা’ বেশ দুর্বল। যারা গল্প দুটি পড়েন নি, লেখকের প্রোফাইলে গিয়ে পড়তে পারেন এবং নিজেই কম্পেয়ার করে দেখতে পারেন।
তাই শেষমেশ বলব,‘তেইল্যা চোরা’ এভারেজ লেগেছে। অনেকেরই আবার অনেক ভাল লেগেছে। হয় তো, এটা পাঠক হিসেবে নিতান্তই আমার ব্যর্থতা কিংবা আমি এই হাইপ নামক জিনিসটার নির্মম শিকার।
‘তেইল্যা চোরা’ প্রকাশ করেছে বিদ্যানন্দ প্রকাশনী। মেলায় এই প্রকাশনীর বিক্রেতাবিহীন স্টলের ব্যাপারটা ভাল লেগেছিল। তাছাড়া বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের 'এক টাকায় আহার' এবং 'এক টাকায় শিক্ষা' উদ্যোগটা আসলেই প্রশংসনীয়। এদের যে কোনো বই কিনলেই তার থেকে এক টাকা করে দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা এবং আহারের পিছনে ব্যয় হবে।তাদের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।
ওবায়েদ হকের বইসহ বিদ্যানন্দের অন্য সকল বই পেতে 'বিবিধ' বুক শপ এ যোগাযোগ করতে পারেন।
'কসর আলী' তার কাজের জন্য ছিলেন দিগ্বিজয়ী। তবে কসর আলী নামে তাকে কেউ চিনতেন না। যেমন তার শরীরের রঙ এবং গড়ন, তেমন তার পেশার সাথে জড়িয়ে তাকে ডাকা হতো 'ক্যাইল্যা চোরা ' নামে। ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার, আইনজীবীর ছেলে আইনজীবী, চোরের ছেলে হবে চোর। কসর আলীর কথা অনুযায়ী - " চোরের পোলা চোর হইবো, জজ ব্যারিস্টার হইবো না"!
এবং হয়েছিলো তাই। কসর আলীর ছেলে ফজর আলী। সেও বাবার পেশা অনুযায়ী চোর-ই হয়েছিলো। বাবার ধর্ম মেনে সেও চুরি'কেই পেশা হিসেবে মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছেলের উপর মিথ্যা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর সারাজীবন চুরি করবেন না। কিন্তু বললেই হলো নাকি! আমাদের সমাজ, সমাজের মানুষ কি অত সহজেই আমাদের ভালো পথে ফিরে আসতে দেয়! হুম হলোও তাই সহজে তাকে ভালো হতে দিলো না। বিনা দোষে তাকে যেতে হলো জেলে। এসব শুনে হয়তো মনে হবে এটা নিতান্তই একজন চোরের জীবনের গল্প। কিন্তু এ গল্প কিভাবে একটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প হয়ে দাড়ায় তা এ উপন্যাসের মাধ্যমে জানা যায়।
প্লটের অন্যান্য চরিত্র - ' তেইল্যা চোরার স্ত্রী আমেনা, মাঝি নসু, তার ছেলে মজিদ ' এসব মানুষগুলোও যেনো আপন কেউ হয়ে ভেসে ওঠে চোখের সামনে৷ আজন্ম পাঞ্জাবি হয়ে উঠতে যাওয়া বাচ্চুও মরার আগে পাকিস্তানিদের গালি দেয় ' শুয়োরের বাচ্চা ' বলে। লাশের স্তূপ দেখার পর ফজর আলীর স্তম্ভিত মনোভাব । তেইল্যা চোরা কিভাবে হয়ে উঠে একজন মুক্তিযুদ্ধা। শেষে বলে - ' ' আমার যুদ্ধ শেষ হয় নাই রে '
এটি ' ওবায়েদ হক ' এর প্রথম উপন্যাস। লেখকের প্রায় সকল বই ই আমার পড়া। দারুণ লেখেন তিনি৷ কিছু কিছু লেখা পড়ার পরও তার মুগ্ধতা কাটে না। কেমন একটা গোরের মাঝে কাটে অনেকা সময়। পাঠক'কে সেরকম পরিস্থিতিতে ফেলার মতো লেখক হচ্ছে ওবায়েদ হক। বলাই বাহুল্য তিনি একজন সুলেখক।লেখকের 'কাঙালসংঘ ' নামে একটি বই ২০২১ বইমেলায় বের হয়েছে।
ওবায়েদ হক আমার প্রিয় লেখক।বরাবরের মতো "তেইল্যা চোরা"ও আমাকে মুগ্ধ করেছে। ফজর আলীর বাবা কাইল্যা চোরা ওরফে কসর আলী ছেলেকে চুরি বিদ্যা ছাড়া আর কিছু দিয়ে যেতে পারেনি।মাস্টারের বউয়ের হাতে মজিদের চোরের ছেলে হওয়ার কারণে মার খেতে দেখে সে ঠিক করে আর চুরি করবে না।ভদ্র কাজ করে বেঁচে থাকবে নাহয় না খেয়ে মারা যাবে।চোরের কলংক নিয়ে সে সমাজে সহজে কাজ পায় না।জোয়ারদারের দয়ায় সে কাজ পেলেও মিথ্যে চুরির অপবাদ নিয়ে থাকে জেলে যেতে হলো পাঁচ বছরের সাজা নিয়ে।জেলে গিয়ে পরিচিত হলো ইউসুফ মুন্সি,বাচ্চু,সুজন মাস্টার এবং প্রফেসরের সাথে।তার জেলে যাওয়ার পরেই দেশে শুরু হলো যুদ্ধ এর ডামাডোল,বাংগালী জেলারের পরবর্তীতে আসলো পাঞ্জাবী জেলার,জেলখালা রূপ নিলো পাকিস্তানিদের টর্চার পয়েন্টে।জেলে বস���ই ফজর আলী যুদ্ধ এর খবর পায়।আর আতংকিত হয় আমেনা,মজিদের নিরাপত্তা নিয়ে।জেলের মধ্যেই অনেক সময় ফজর এবং সুজনকে গণকবর খোঁড়তে হয় মুক্তিদের দাশ দাফনের জন্য।ফজর আলী জেল থেকে বের হতে চায় আমেনা আর মজিদের জন্য,ইউসুফ মুন্সী,বাচ্চু রাজাকার হওয়ার জন্য এবং সুজন মাস্টার বের হতে চায় মুক্তি হওয়ার জন্য।প্রফেসরের সাহায্যে ওরা জেল থেকে পালায়। রাজাকার হতে চাওয়া ইউসুফ মুন্সী কি করবে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে তার স্ত্রী,মেয়েকে নির্যাতিত হতে দেখে? ফজর আলী কি আমেনা,মজিদের খোঁজ পায়? সুজন কি মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতে পারে? সারাজীবন পাঞ্জাবী হতে চাওয়া বাচ্চু যখন মারা যাওয়ার আগে পাকিস্তানি শুয়োরের বাচ্চা বলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ তখন আমি তার ক্ষোভ অনুভব করি।ফজর আলী যখন লাশের স্তুপ দেখে স্তম্ভিত হয় তখন লেখকের লেখনীর জোরে আমিও স্তম্ভিত হই।ফজর আলী যখন বলে,"আমার যুদ্ধ শেষ হয় নাই" তখন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।বুঝতে পারি কেন মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্বের বস্তু।
তেইল্যা চোরা একটি চোর পরিবারের গল্প,মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
বইয়ের নাম 'তেইল্যা চোরা' দেখে ভেবেছিলাম বইটাতে হয়তো তেলাপোকার কোন ম��টাফোর ব্যবহার করা হয়েছে৷ কিন্তু আদতে বইয়ের মূল গল্প ফজর নামে একজন সিঁদ কাটা চোরের গল্প, যে তেল মেখে চুরি করে। বাপ দাদার পেশা চৌর্যবৃত্তিকে সে নিজের পেশা হিসেবে নিলেও ছেলে মজিদের কথা ভেবে সে চিন্তা করে সে আর চুরি করবে না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে যে ফজর এতকাল চুরি করেও ধরা পড়েনি সেই ফজরই এইবার চুরি না করেও ধরা পড়লো চুরির দায়ে। গরীব ফজরের মেলে না উকিল। ফলস্বরুপ তার ৫ বছরের জেল হয়। ওদিকে দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্ত্রী আমেনা আর ছেলে মজিদের চিন্তায় জেলের ভাত ফজরের গলা দিয়ে নামে না। জেলে আরো নানা কিসিমের মানুষের সাথে পরিচিত হয়। পরিচিত হয় নানা মানুষের দর্শনের সাথে আর এভাবেই এগিয়ে যায় গল্প। এ গল্পে ফজর ছাড়াও রয়েছে পাকিস্তান ভক্ত ইব্রাহিম মুন্সী, বাচ্চু। আরো আছে প্রফেসর সাহেব, সুজন মাস্টার।
ওয়াবেদ হকের বাকি সব গল্পের মতো এ গল্পটাও পাঠককে মুগ্ধ করে৷ তবে ওবায়েদ হক 'নীল পাহাড়', 'জলেশ্বরী'তে পাঠকের মনে যে মুগ্ধতা ছড়াতে পেরেছেন এ গল্পে তা কিছুটা কম আছে বলে আমার মনে হলো। অথবা হতে পারে ওবায়েদ হকের কাছ থেকে এক্সপেক্টেশন বেশী থাকার কারণেই এ গল্পটা মুগ্ধতার সীমা ছাড়াতে পারেনি। তবে এটাও যে একটা দারুণ উপন্যাসিকা সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
বই: তেইল্যা চোরা লেখক: ওবায়েদ হক জনরা: মুক্তিযুদ্ধ প্রচ্ছদ: মেজর এমরান প্রকাশনী: ৫২ (বায়ান্ন) প্রথম প্রকাশ: মে ২০১৭ [বিদ্যানন্দ] পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১৮ মুদ্রিত মূল্য: ২০০/-
জয় বাংলা... শুধু দুটো শব্দ নয়। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যখন বাঙালিরা দুটো শব্দ উচ্চারণ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তো, শত্রুর গুলি হাসিমুখে বুক পেতে নিতো; পাকিস্তানিদের বুক কি কেঁপে উঠতো না?
একজন চোর, একজন গুন্ডা, একজন খুনি কখনো যুদ্ধ করবে কেউ কি ভাবতে পেরেছিলো? বেশ কিছু চরিত্র রয়েছে। আছে প্রত্যেকের নিজস্ব গল্প। গল্পগুলো জড়িয়ে যায় উননিশো একাত্তরের সেই ভয়াবহ সময়ে!
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক লেখাগুলো পড়লে একইসাথে কষ্ট হয়, ভয় হয় তো আবার গর্বও হয়। স্বাধীনতা সুখের ছিল কিন্তু সে সুখ পাওয়ার আগে যে দীর্ঘ সময় নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে লেখক বইয়ে সেটাই তুলে ধরেছেন। বইয়ের প্রেক্ষাপট মূলত যুদ্ধের সময়কালের। পাকিস্তানিদের বর্বরতা, নির্যাতন, বাঙালিদের ঘুরে দাঁড়ানোর কথা সবই আছে। সুন্দর একটা বই। একগুচ্ছ কষ্ট লেখক এক মলাটে বেঁধেছেন আর একটি আশার আলো। নাদির গুন্ডা ও প্রফেসরের অংশটুকু ভোলার মতো না। মনে থাকবে "তেইল্যা চোরা"- কেও। উঁহু, মুক্তিযোদ্ধা "ফজর আলি" ওরফে "সুজন"।
শুক্রবারের দুপুরে উঠানে চৌকি পাতা, শীতকালের হালকা রোদ। পাশের পুকুরে মাছ ধরবার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জাল ঝুলে থাকে: উঠোনের সামনে তাকালে বিশাল ধানক্ষেত – সদ্যকাটা ধানের আগাছা শাদা গরু চরে খায়, সকালের বেগুন ভর্তা সাথে এক পিস মুরগী আর একটুকুন ভাত সাঁটিয়ে আমি তেইল্যা চোরা নিয়ে বসি। যাপিত জীবনের নানাবিধ ঝামেলার মাঝে হয়ত ফজর আলীকে সেভাবে অনুভব করতে পারিনা। কিন্তু সেই সামগ্রিক কষ্টের জায়গা তো এক।
ওবায়েদ হকের “তেইল্যা চোরা” একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস, যেখানে গ্রামীণ জীবনের কঠিন বাস্তবতা, সামাজিক অপমান, মানবিক সংগ্রাম ও আত্মপরিচয়ের সন্ধানকে লেখক গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি মূলত ফজর আলী নামের এক চোর পরিবারের সন্তানকে ঘিরে, যে উত্তরাধিকারে চোর হলেও নিজের জীবনের এই পরিচয় থেকে মুক্তি চায়। সে চায় পরিবর্তন, চায় নিজের পরিবার স্ত্রী আমেনা ও ছেলে মজিদকে নিয়ে সম্মানজনকভাবে বাঁচতে।
ফজর আলীর এই সংগ্রাম শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সমাজের সঙ্গে এক ধরনের নীরব যুদ্ধ। সমাজ তাকে যে অবজ্ঞা দেয়, সে অবজ্ঞার মধ্যে থেকেও সে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। লেখক তার চরিত্রের এই দোলাচলকে অসাধারণ সংবেদনশীলতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গ্রামীণ বাস্তবতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, ভেদাভেদ ও হানাদারদের ভয়াবহতা ,সব মিলিয়ে গল্পটি এক বাস্তব মানবজীবনের প্রতিফলন।
গল্প বলার ক্ষেত্রে অলঙ্কারিক জটিলতা না রেখে লেখক সরল, শক্তিশালী শব্দচয়ন ব্যবহার করেছেন, যা গল্পকে আরও বাস্তব মনে হয়। চরিত্রগুলোর সংলাপ স্বাভাবিক ও গ্রামীণ আঙ্গিকে গাঁথা, ফলে পাঠক খুব সহজেই সেই সমাজে নিজেকে খুঁজে পান। আমেনা, রোশনি,নসু ,মুন্সি বা সুজন মাস্টার প্রতিটি চরিত্রই গল্পে নিজস্ব অবস্থান নিয়ে এসেছে, যা উপন্যাসটিকে একঘেয়ে হতে দেয়নি।
উপন্যাসটির অন্যতম শক্তি হলো এর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে মুক্তিযুদ্ধ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের গল্প নয়; বরং সাধারণ মানুষের চোখে দেখা যুদ্ধ, তাদের জীবনের বঞ্চনা ও ভয়ের গল্প। লেখক দেখিয়েছেন, কীভাবে সমাজের নিচুতলার মানুষরাও যুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের পরিবর্তনে প্রভাবিত হয়, যদিও ইতিহাসের আলোচনায় তাদের কথা খুব কমই উঠে আসে।
ওবায়েদ হকের লেখা প্রথম পড়লাম, পড়েই প্রেমে পড়লাম। এত নির্লিপ্তভাবে এত কঠিন কঠিন কথা শোনানো কিন্তু বেশ কঠিন; এমন অবলীলায় এমন বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি বাস্তবতা চোখের সামনে মেলে ধরাও বেশ জটিল- এই কাজ লেখক করতে পেরেছেন। ফজরকে মিথ্যা চুরির দায় নিতে দেখেছি আর ঘরের কিছু হারানো গেলে গৃহকর্মীকে সন্দেহ করার কথা মনে করেছি ... আমেনার শুকিয়ে যাওয়া চোখের পানির কথা পড়েছি আর আশেপাশের আমেনাদের চোখের পানিকে পাত্তা না দেয়ায় নিজেকে শাপসপান্ত করেছি... মজিদের একটা খেলনা ঘোড়ার জন্য ছটফটানি দেখেছি আর রাস্তায় চকলেট বিক্রি করা পিচ্চিগুলোর চেহারা মনে করার চেষ্টা করে ছটফট করেছি... টিকে থাকার স্বার্থে সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেনীর মানুষেরাই কীভাবে একে অন্যকে পায়ে মাড়ানোর চেষ্টা করে কদম হোসেন বা হুরমতি কিংবা বলরামপুরের সব খেটে খাওয়া মানুষ তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে দ্বিধায় পড়েছি যে দায় আসলে কার? "তেইল্যা চোরা" কি তাহলে বলরামপুরের গল্প? নাহ, ১১০ পৃষ্ঠার সীমিত পরিসরের মধ্যেই গল্প বলরামপুর থেকে শুরু হয়ে ডালপালা ছড়িয়েছে মোহাম্মদপুর আর নিশিকান্দি গ্রামে; গল্পে এসেছে কয়েদখানার করুণ অবস্থা; বেশ্যাঘর আর গঞ্জে লিঙ্গবৈষম্যের রূঢ়তা। "তেইল্যা চোরা" তাহলে কি কেবল খেটে খাওয়া, নিপীড়িত মানুষের জীবনের কথা বলেছে? নাহ, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধের ছবিটা দেশের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এমনভাবে মেলে ধরা হয়েছে যে মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। যুদ্ধের গল্প আবছা আবছা পড়তে পড়তেই একটা সময় দেখলাম সুজনের সাথে আমিও দুঃস্বপ্ন দেখছি... বাচ্চুর পশ্চাদদেশে কষে লাথি মারার ইচ্ছা কষ্টে দমন করছি... ইউসুফ মুন্সিকে এক হাত দেখে নেয়ার ইচ্ছা পোষন করছি... "তেইল্যা চোরা" তবে কি কেবল কষ্ট আর অপরাধবোধের বোঝা মাথায় চাপিয়ে দেয়? নাহ, বাস্তবতার বিষণ্ণতাও যে একটুখানি ভালোমানুষির আলোয় ম্লান করে দেয়া যায় সেই রেশ এখানে ওখানে তেইল্যা চোরা ছড়িয়ে দিয়েছে। সমাজকে গালাগাল করতে করতেই একটা সময় মনে হলো আমিও প্রফেসরের পেছন পেছন অন্ধের মতোন ছুটছি... কালো শরীরের নসু মাঝির নৌকায় চড়ে আকাশে উড়ছি... রোশনীর দৃঢ়তায় তব্ধা খেয়ে যাচ্ছি... হুরমতিকেও একটু যেন ভালোবেসে ফেলছি!
লেখকের লেখনী আসলে লং-এর মতোন; চরিত্রগুলোর উপস্থিতির সময় অল্প হতে পারে কিন্তু রেশ অনেক প্রখর! লেখকের লেখনী বাসকের রসের মতোন- সাদামাটা বাক্যই মনের ভেতরটা পুড়িয়ে দেয়! -পেটে যখন জ্বালা শুরু করে, তখন আর কবরের আজাবের কথা মনে থাকে না। -বাঙালি পুরুষ যখন বউ আর চোরকে শায়েস্তা করে তখন তার মনে কোন মায়া থাকে না। কী নিরীহ চেহারার বাক্য কিন্তু কী বীভৎস এর মর্ম! লেখক অবলীলায় পাঠকদেরকে যেন অদৃশ্য চড় মেরেছেন এক একটা বাক্য দিয়ে, সংলাপের মধ্য দিয়ে। আর অদৃশ্য চর খেয়ে খেয়ে পাঠক আমি একটু একটু করে প্রেমে মজেছি...
"তেইল্যা চোরা"-র গল্প আদতে রূপকথার গল্প নয়, আপনার-আমার খুব চেনা গল্প। তবুও পাঠক আমি হয়রান হয়েছি। "তেইল্যা চোরা" আসলে তেলাপোকার মতো ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকা সেইসব মানুষদের গল্প যারা ডায়নাসরের মতোন অতিকায় নয় বলে তাদের হারিয়ে যাওয়া আমাদের চোখে পড়ে না… যারা সংখ্যায় অনেক বলে তাদের অস্তিত্বের লড়াই আমরা গ্রাহ্য করি না… যাদের টিকে থাকার যুদ্ধ আমাদের গায়ে আঁচ লাগালে চোখের পলকে তাদের পিষে মারতে আমরা দু’বার ভাবি না… কিন্তু দিনশেষে ওরাই বেঁচে থাকবে, মরে গিয়েও বেঁচে থাকবে, ওরা বেঁচে থাকবে মাটির ঘোড়ার ভাঙ্গা মাথায়, কালী গাঙ্গের কালো মাঝির অকৃত্রিম হাসিতে, আমেনার চোখের পানিতে আর ফাতেমা-জুলেখার শাড়ির আঁচলে।
-বইটা পড়ার সময় মিশ্র একটা অনুভূতি কাজ করবে আপনার মধ্যে। কখনো পড়তে গিয়ে বিচলিত হয়ে যাবেন,কখনো আনন্দে চোখ উজ্জ্বল হয়ে যাবে, আবার আবেগপ্রবণ হলে চোখের কোনে অশ্রুবিন্দুও জমতে পারে। সেই সাথে নিকৃষ্ট পাক -বাহিনীর নির্মমতা এবং তাদের নিচ কান্ড- জ্ঞান আপনাকে রাগে বুকে আগুন জ্বালাবে। - একেবারে সেরা একটা উপন্যাস ছিল তেইল্যা চোরা। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস তো কত রকমেরই হয়, কিন্তু এই বইটা অন্যরকম এক অনুভূতিতে ভরা। তেইল্যা চোরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে তার মর্যাদা ফিরে পেল। এর চেয়ে আনন্দের আমার জন্য শেষটা কিছুই ছিল না।
পছন্দের কিছু লাইন : "যুদ্ধের সময় দুনিয়াটা অদ্ভুত হয়ে যায়। জমিদাররা সব ভিক্ষুক হয়ে গেছে, ভিক্ষুকরা সব জমিদারি ভান ধরেছে। ইঁদুররা সব রাজাকার হয়ে পিঠে রাইফেল নিয়ে সিংহ হয়ে গেছে। তাদের বুক আছে, সে বুকে সাহস নেই। তাদের জিহ্বা আছে, সে জিহ্বায় লোভের লালা ঝরে পড়ে। একজন সিঁদ কাটা চোরও মুক্তিযোদ্ধা হবে ;কেন হবে? প্রতিশোধ কিংবা ঘৃণার জন্য অথবা নতুন পরিচয়ের জন্য। রাইফেল ছাড়াও সে যোদ্ধা, তার বুকে আগুন আছে"
বইয়ের প্রথমাংশ পড়ার সময়ে একটা বই আর একটা মুভির কথা মাথায় আসতেছিল। বইটা ভগীরথ মিশ্রের "তস্কর" আর মুভিটা "জয় ভীম"। সম্পদের অসম বন্টনে সমাজের একটা অংশ চৌর্যবৃত্তি তে ঝুঁকে পড়ে সেটা আমরা সবাই জানি। মাঝে মাঝে হয়ত তাদের উপর বিনা অপরাধেই নিষ্ঠুর বিচারের বোঝা চাপায়ে দেয়া হয়। সেইটাই প্রথম অংশে তুলে ধরছেন। পরের অংশে আসল মুক্তিযুদ্ধের খন্ড খন্ড অংশ।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এই বই না লেখা হইলে বাংলা সাহিত্যের খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাইত না। কারণ, সাধারণ প্লটে সাধারণ লেখনীতে আহামরি কিছু পাইলাম না। অনেক লেখক ই সাধারণ প্লটে শব্দের অসাধারণ খেলা করেন তখন গল্পটা হয়ে যায় জীবন্ত।
বইটা হালকা আমেজে পড়ার জন্য বেশ ভাল। অনেক পজিটিভ রিভিউ দেখে উচ্চাশা নিয়ে পড়ার দরুনই হয়ত হতাশাটা বেশি কাজ করছে।
হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী উপন্যাস ও নাটক "কোথাও কেউ নেই" এর বাকের ভাইয়ের কথা মনে আছে? সেখানে উনি সমাজের চোখে একজন গুন্ডা অথচ নিজের ভেতর কি চমৎকার মনুষত্ব্যের গুণাবলি নিয়ে চলেন সেই জিনিস হুমায়ূন আহমেদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।
এরকম দ্বৈত চরিত্র দিয়ে এই উপন্যাস ভর্তি। যাদেরকে সমাজের বাজে মানুষের দলে ফেলা হলেও তারা প্রয়োজনের তাগিদে বিলিয়ে দেন একেবারে সর্বস্ব!
একদম নিখাদ মুক্তিযুদ্ধের প্লট। বেশ খারাপই লাগলো পড়ে। কতো কতো ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা, তার কতোটুকুই বা মূল্যায়ন করতে পারছি আমরা? নাদির গুন্ডার অংশটুকুতে বারবার বাকের ভাইকে দেখতে পাচ্ছিলাম!