সন্ধে সাড়ে ছয়টা । সারাটা দিন কাজ ছিল না । অনেকদিন পর বস এসেছেন লস অ্যাঞ্জেলেসে, রানা এজেন্সির রিপোর্ট চেক করছেন পেছনের কামরায় বসে । রিসেপশনে খামোকা মাছি না মেরে টেবিলের ওপর পা তুলে সান্ধ্য-দৈনিকটা একনজর দেখবে বলে হাত বাড়াতে গিয়েও থমকে গেল গিলটি মিয়া । দরজার ফ্রস্টেড গ্লাসের ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ...
লস অ্যাঞ্জলেসে গিয়ে গিলটি মিয়ার একটা কেসে জড়িয়ে গেল রানা । একদিনেই বেরিয়ে এল আসল খুনি ।
কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম 'নবাব'। তাঁর পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন। কাজী আনোয়ার হোসেন সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসাবে ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামক গুপ্তচর চরিত্রকে সৃষ্টি করেন। এর কিছু আগে কুয়াশা নামক আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র তার হাতেই জন্ম নিয়েছিলো। কাজী আনোয়ার হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে বিদ্যুৎ মিত্র নাম ব্যবহার করে থাকেন।
'খুনের তদন্ত কত্তে এয়েচি, বাওয়া । চোটপাট দেকাবেন না, আমি রানা এজেন্সির গোয়েন্দা আচি । আমি হচ্চি গিয়ে মিশটার গিলটি মিয়া দ্য গ্রেট!'
কত, কতগুলি বছর পর সবার প্রিয় গিলটি মিয়ার সেই অতি পরিচিত ও ভালবাসার একমবদ্বিতীয়ম অনন্যসাধারণ বাচনভঙ্গিমার অবিস্মরনীয় সংলাপগুলো আবার আমার নতুন করে পড়ার সৌভাগ্য হলো ? অনেস্টলি আমার খেয়াল নেই, তবে ১৫-১৮ বছর হবে সম্ভবত । মাসুদ রানা সিরিজে রানা বাদেও অগণিত কালজয়ী পার্শ্বচরিত্র এসেছে, গত পঞ্চাশ বছরে অসংখ্য মনে রাখার মতো, স্মৃতিতে দাগ কাটার মতো চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে, তার মাঝে আমার মতে গিলটি মিয়া চরিত্রটি অন্যতম সবচেয়ে জ্বলজ্বলে একটি নক্ষত্র । সেই প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে রানা-৮ সাগর সঙ্গম-১ এ সর্বপ্রথম আগমনের পরে বিগত বছরগুলোতে গিলটি মিয়া হয়ে ওঠেছে রানা সিরিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ । দূঃখের বিষয়, ইদানিংকার সময়ের প্রায় কোন কাহিনিতেই গিলটি মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায় না, আর বেশ অনেক বছর ধরে তার অনুপস্থিতি পুরনো রানা পাঠক হিসেবে খুব বেশি অনুভব করছিলাম । অপেক্ষার পালা অবশেষে শেষ হল আজ, আর কী অপূর্ব মুগ্ধতার সাথে ! এর চেয়ে ভাল উপলক্ষও বোধ হয় হওয়া সম্ভব ছিল না, রানার পঞ্চাশ বছরপূর্তিতে রহস্যপত্রিকার বিশেষ রানা-সংখ্যায় স্বয়ং কাজীদার সম্পূর্ণ নিজের হাত থেকে বেরুনো সেই আদি ও অকৃত্রিম গিলটি মিয়া দ্য গ্রেট যার তুমুল কথার ফুলঝুরিতে উপচে পড়া হাস্যরসের পাশাপাশি পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে সূক্ষ্ণ অভিব্যক্তি, সাথে চিরতরুণ চিরদুর্ধর্ষ মাসুদ রানা তো আছেই । মাত্র অল্প কয়েক পৃষ্ঠার এই ছোট গল্পটিতে গিলটি মিয়া ব্যাক ইন ফুলফর্ম প্রথম লাইন থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত, নিজের অজান্তেই হা হা করে শব্দ করে হেসে ওঠতে বাধ্য হয়েছি বেশ কয়েকবার তার অবিরাম বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসাত্মক সব ভিন্টেজ সংলাপে ।
মাত্র একদিনের একটা খুনের রহস্য তদন্তে বিসিআই স্পাই মাসুদ রানার বদলে পুরোদস্তুর রানা এজেন্সির মাসুদ রানা হিসেবে এটা একটা নিখাঁদ গোয়েন্দাকাহিনি । কিন্তু বাহ্যিকভাবে প্লট সাদামাটা মনে হলেও তার মাঝেই বরং আরো ভাল করে ফুটে ওঠেছে কাজীদার কলমের ধার, তার সহজাত জন্মগত বর্ণনাভঙ্গি আর অনায়াসসাধ্য চরিত্র চিত্রায়ণ । কী তরতর করেই না গোগ্রাসে গিলে ফেললাম চোখের পলকে পুরো লেখাটা, মনে হলো একধাক্কায় ক্ষণিকের জন্য রানা-সিরিজের স্বর্ণসময়ে ফিরে গিয়েছি ! বর্তমানের রানার উপন্যাসগুলোতেও অবশ্যই কাজীদার সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকে, তবে বয়স হয়ে যাবার দরুণ মূল কলমপেষার দায়িত্বটা বোধকরি তুলে দিয়েছেন সহযোগী লেখকদের হাতে । যার ফলে গল্প যতই অসাধারণ রোমাঞ্চকর হোক না কেন, আমার মতো পুরনো রানা পাঠকের কাছে পূর্ববর্তি কাহিনিগুলোর তুলনায় বর্তমানের লেখনির ঈষৎ পার্থক্যটা না চাইতেও দৃষ্টিগোচর হয়ে যায়, সেই চির সাবলীলতার বদলে মাঝে মাঝে কিঞ্চিত আড়ষ্টতা অনুভব করি বর্ণনাভঙ্গিমাতে । আজকে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আশি বছর বয়সেও আমাদের কাজীদার লেখনির ক্ষমতা ঠিক আগের মতই আছে তার হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে, এক বিন্দুও টসকায়নি ! এখনো তিনি যখন নিজে একটা আস্ত কাহিনি লিখেন (যত ছোট বা যত সাধারণ গল্পই হোক) সেটার সাবলীলতা, সুখপাঠ্যতা তার অর্ধেক বয়সী অন্যান্য যেকোন সহযোগী লেখকের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে থাকে । কী ভাবে সম্ভব এটা ? মাসুদ রানা যেমন বাংলা সাহিত্যে ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হবার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরেও সেই একই দাপটে ভক্তদের কল্পনার জগত আর বইয়ের শেলফ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, রানার স্রষ্টা ধ্বংসপাহাড়-এর পঞ্চাশ বছর পরেও ঠিক একই প্রতাপে কলম চালানোর সামর্থ্য রাখেন । যে সিরিজের লেখক নিজেই চিরযুবা, সে সিরিজের নায়ক চিরযুবা হবে না-ই বা কেন ? নিমিষেই গল্পটা শেষ করে ফেলে এমন আফসোস হলো বলার মতো না, কাজীদার লেখা পড়ার তৃপ্তি কি মাত্র ১০ পৃষ্ঠায় মেটে ? ৩০০ পৃষ্ঠা হলেও তো মিটতো না ! উনার যে এখনো কতটা দেবার বাকি আছে তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম, মনে প্রাণে কামনা করি আগামীতে যেন অন্তত একটি বিশাল সাইজের পূর্ণদৈর্ঘ্য রোমাঞ্চকর রানা-উপন্যাস কাজীদা পুরোপুরি নিজের কলমে আমাদের উপহার দেন ।
কাজীদার রানাকে নিয়ে লেখা বড় গল্প অন্তরে পাপ। এক মেয়ে রানা এজেন্সিতে এল, ওর ভাই অবৈধভাবে আমেরিকায় এসেছে। মেয়েটা চায় স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হাত থেকে যেন রক্ষা পায় ওর ভাই। রাজি হলো গিলটি মিয়া মানবতার খাতিরে। পরদিনই ঐ মেয়ের ভাই খুন আর গিলটি মিয়ার পিছে লেগে গেল ভাড়াটে খুনী! অনেকেই বলেছে প্লট নাকি অত ভাল না, কিন্তু আমার কাছে খারাপ লাগেনি। গিলটি মিয়ার ইউনিক বাচনভঙ্গী ছিল, ছিল রানা-গিলটির ডাবল অ্যাকশন। এর বেশি আর কী লাগে?
কাহিনি কেমন সেটা মুখ্য না, বড় কথা হলো স্বয়ং কাজীদার কলম থেকে বহুদিন পর বেরিয়েছে রানা। কাজীদার ট্রেডমার্ক লেখনী, শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। সাথে দারুণ বোনাস গিলটি মিয়ার হিউমার ভর্তি পাঞ্চ ডায়লগ।