টানা প্রায় ৬০ বছরের বর্ণাঢ্য সাংবাদিক-জীবন তাঁর। তাঁর এই জীবন আর ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর ‘বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠা যেন সমান্তরাল। এদেশের সাংবাদিকতা পেশার গোড়াপত্তনের এবং সেই পেশাকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের ইতিহাসেও সক্রিয় সহচর এবিএম মূসা। ফলে তাঁর এই আত্মজীবনীর সুবাদে আমরা যেমন পেয়ে যাই এদেশের সাংবাদিকতার ধারাবাহিক ইতিহাস, তেমনি পেয়ে যাই তাঁর বাল্য, কৈশোর ও যৌবনে দেশের তথা আমাদের এই উপমহাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনারও প্রায় অনুপুঙ্খ অননুকরণীয় বিবরণ-ভাষ্য। পাঠককে যেমন তা মোহিত করবে, তেমনি পাকিস্তান আমলে বাঙালিরা যাতে ক্রীড়াক্ষেত্রে উজ্জ্বলতর কৃতির অধিকারী হতে না পারে, সে লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কীভাবে তলে তলে ফুঁসে উঠেছিলেন বাঙালি ক্রীড়া-সংগঠকরা, এ-সংক্রান্ত বিবরণের পাঠও মুগ্ধ করবে তাঁদের সমভাবে। এই আত্মজীবনী এবিএম মূসার হলেও লেখার প্রসাদগুণে তা এ দেশের ইতিহাসেও উজ্জ্বল আধার হয়ে উঠেছে ।
সূচিপত্র
মুখবন্ধ ৯
ভূমিকার পরিবর্তে ১২
জন্ম-শৈশব-কৈশোর
বংশপরিচিতি ১৭ গণ্ডগ্রাম থেকে শহরে ২০ অবশেষে চট্টগ্রামে ২৫ তখনকার চলাচলের বাহন ২৭ বদর-বদর বলে স্কুলে পথে ৩১ সবাই হইহই করে উঠল ‘ফানি হাগরা’ বলে ৩৪ ‘ফুটিয়াছে’ মানে ‘ভেটকাই রইয়্যে’ ৩৮ তিন বেলাই শুধু ‘বেলা’ ৪১ সাদর সম্ভাষণ ‘আস্তক-বস্তুক’ ৪৬ উৎসবের সেই দিনগুলি ৪৯ সেই না-ভোলা স্মৃতি ৫২
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তরকাল
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগমনবার্তা ৫৯ বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলি ৬৩ গান্ধী আশ্রম ৬৮ লালদীঘিতে নেই লাল গোলাপ ৭০ ওয়াহাবি মতবাদের সঙ্গে পরিচয় ৭৩ রঙ্গম রঙ্গিলারে ৭৭ মাইজভান্ডারের উটের কান্না ৮০ মিরসরাইয়ের সুফি-সাধক সন্দর্শনে ৮৩ ব্ল্যাক আউট, রেশন আর ব্ল্যাক মার্কেট ৮৬ তালগাছের কামান ৮৯ বিমান হামলার সময় জামে মসজিদ ৯৩
সাংবাদিক জীবন
চট্টগ্রাম নিবাসের দ্বিতীয় পর্ব ১০৫ সাংবাদিকদের সংগ্রাম ১০৮ আমার চল্লিশ ও পাঞ্চাশের দশক ১১১ আমার সাংবাদিকতার আদি পর্ব ১১৫ আমার দ্বিতীয় বাড়ির কথা ১২৫ বিধিনিষেধের বেড়াজালে সাংবাদিকতা ১৩০
ভাষা আন্দোলন
আমার ভাষা আন্দোলন ১৩৪ সর্বস্তরে বাংলা : প্রথম সূচনা গাড়ির নম্বর প্লেটে ১৩৬
ক্রীড়াজগৎ
খেলার মাঠে রাজনৈতিক চেতনা ১৪০ ক্রীড়াক্ষেত্রে দুটি ধারা ১৪৪ শুধু সংগঠকদের মধ্যে নয় ১৪৮ খেলার মাঠে রাজনীতি ছিল কেন ১৫২ ক্রিকেটের ব্যাপারে মাথাব্যথা থাকলেও ১৫৬ শুরু হলো সাঁতারের মহাযজ্ঞ ১৬০ ব্রজেন দাস জাতীয় গর্বের প্রতীক ১৬৩ অ্যাথলেটিকসে আমাদের মেয়েরা ১৬৮ যাত্রা অব্যহত থাকুক ১৭২ রিপোর্টারদের পছন্দ-অপছন্দ ১৭৬ স্মরণের আবরণে মরণের ঢাকি ১৮০ সাঁতার কেন হারিয়ে গেল ১৮৪
সাংস্কৃতিক অঙ্গন
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদচারণ ১৮৭
রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ
মহত্তম সেই দুজনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক ১৯০ সাতই মার্চের অবিস্মরণীয় যুদ্ধ ১৯৫ মুক্তিযুদ্ধের মিডিয়া সেন্টার ১৯৮ মুক্তিযু্দ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি ২০৬ সেই মহৎ মানুষটি এবং তাঁর পরিবার ২১১ বাকশাল ২২৬ পলায়ন, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ২২৯
কিংবদন্তি সাংবাদিক এবিএম মূসার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ 'আমার বেলা যে যায়'। চট্টগ্রামে নিজের বেড়ে ওঠা, এদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতার সূচনা, পাকিস্তান আমলে সাংবাদিকতার খণ্ডচিত্র ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কিছু ঘটনা স্থান পেয়েছে বইটিতে।
প্রথাগত স্মৃতিচারণার বই এটি নয়। প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আত্মকথা লেখার সিদ্ধান্ত নেন এবিএম মূসা। অসুস্থতাসহ নানা কারণে লিখে উঠতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে সমাধান হিসেবে যুগান্তর লেখা তার আত্মকথাধর্মী কলামগুলোতে এই বইতে অর্ন্তভুক্ত করেন। সেই স্মৃতিকথার মতো লেখাগুলোর সংকলন হলো 'আমার বেলা যে যায়'।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অন্যতম ভিত্তিস্তম্ভ মূসা সাহেব। তাঁর আত্মকথা নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলাম। কিন্তু একেবারে নিরাশ হতে হলো। চাটগাঁয়ে কিশোরবেলার স্মৃতি ভালো লেগেছে, বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ইতিকথা জানতে পেরেছি। হাঙর ও কুমিরবেষ্টিত অস্বচ্ছ জলে কীভাবে সাংবাদিকতা করেছেন তার দু'চারটি দৃষ্টান্ত আমাকে অভিভূত করেছে।
খেলার সাথে রাজনীতি মেশানো- না মেশানো নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। মূসা সাহেবের জবানিতে পাকিস্তান আমলে ক্রীড়াক্ষেত্রে বাঙালিদের ওপর জুলুৃমের ইতিবৃত্ত পড়লে আপনিও হয়তো আগামীতে খেলাধূ্ুলায় জালিম কোনো দলকে সমর্থন দিতে দু'বার বিবেচনা করবেন। কারণ খেলার সাথে রাজনীতি মেশানোর অভ্যাস এদেশের মানুষের রক্তে অনেক আগেই মিশে গেছে।
পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার মাধ্যমে এদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতার শুরু৷ যে মানুষটি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রীড়া সাংবাদিকতার আরম্ভ করেন তার তার লাডু ভাই৷ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এসএসসির বেশি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তার ছিল না। কিন্তু খেলাধুলাকে ভালোবাসতেন, ক্রীড়াঙ্গনে পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা আদায়ে সচেষ্ট থাকতেন। ফলশ্রুতিতে একাত্তরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। আর ফেরেননি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংবাদিকতার অবিস্মরণীয় স্মৃতি মূসা সাহেবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন। তখনকার বিদেশি সাংবাদিকদের ভূমিকা পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবিএম মূসা। '৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। বাকশালের প্রেক্ষাপট নিয়ে মূসা সাহেব লিখেছেন। উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জন সংসদ সদস্য বাকশালের পক্ষে ছিলেন না। সংসদে এই ব্যবস্থা পাসের প্রতি নিজেদের অনাস্থার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানাতে একটি মাধ্যম খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কেননা তাদের কারো-ই বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি এটা বলার সাহস ছিল না। তবু দলীয় ফোরামে এই প্রস্তাবের বিপক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই প্রতিবাদ করিয়ে দিতে জেনারেল ওসমানী বলেছিলেন, বাংলার জনতা বঙ্গবন্ধুর শাসন চায়, তারা জেনারেল বঙ্গবন্ধুর শাসন চায় না। তীব্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানান তরুণ সংসদ সদস্য মানিক মিয়ার ছেলে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন৷ তখন আওয়ামী লীগের আরেক এমপি আমজাদ সরদার মঈনুল হোসেনের ওপর হামলা চালান। জোর করে বের করে দেন সভা থেকে।
বাকশাল পাসের দিনের কথা সংক্ষেপে লিখেছেন তখনকার এমপি মূসা। আক্ষেপ করেছেন যে গণতন্ত্র অর্জন করতে পঁচিশ বছর লেগেছিল তা মাত্র তিন মিনিটের ভোটে বাতিল হয়ে গেল!
বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবিএম মূসা। এই মহান নেতার দরাজ দিলের পরিচয় মেলে, এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী তিনি নিজে। সেইসব ঘটনা পড়লে নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুকে আরও উজ্জ্বলভাবে চিনতে পারবেন পাঠকেরা।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীকে আজ সেভাবে স্মরণ করা হয় না। এমনটি দলটি নিজের প্রতিষ্ঠাতাকে ন্যূনতম সম্মান জানাতে কুণ্ঠিত। এবিএম মূসা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে অত্যন্ত তথ্যবহুল এবং যৌক্তিক লেখা লিখেছেন। পড়লে জওয়াব পাওয়া যাবে কিছু চর্চিত বিষয়ের। ভাসানীকে নিয়ে প্রোপাগাণ্ডাগুলোর খণ্ডন হবে সুন্দরভাবে।
মূসা সাহেবের আত্মকথা হিসেবে বইটি অপাংক্তেয় এবং অনুত্তীর্ণ।