জঙ্গলের পুরুষ বাঘেরা শরীরের ফেরোমনের গন্ধে জানায় এলাকা আমার। মানুষের ফেরোমন নেই, বোমা আছে। বোমা ফাটে, জিন্দাবাদ ধ্বনি হয়। ছায়াপিণ্ড মানুষেরা চা-বিস্কুট খায়, আর আধোস্বরে বলে, ' কী যে হচ্ছে!'
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর জন্ম ২৪ আগস্ট, ১৯৫১ সালে উত্তর কলকাতায়। রসায়নে বিএসসি (সম্মান), বাংলায় এমএ, সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করেছেন। লেখকজীবন শুরু করেন সত্তর দশকে। প্রথম দিকে কবিতা লিখলেও থিতু হয়েছেন গল্প ও উপন্যাসে। তাঁর লেখা গল্পের সংখ্যা প্রায় ৩৫০। প্রথম উপন্যাস ‘চতুষ্পাঠী’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। পাঠক মহলে সাড়া ফেলেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী। বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ এবং কলাম কিংবা রম্যরচনাতেও সিদ্ধহস্ত। তাঁর রচিত ‘হলদে গোলাপ' উপন্যাসটি ২০১৫ সালে আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়। ‘অবন্তীনগর' উপন্যাসের জন্য ২০০৫ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পুরস্কার, সর্বভারতীয় কথা পুরস্কার, তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার, গল্পমেলা, ভারতব্যাস পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। সাহিত্যের বাইরে তিনি গণবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
স্বপ্নময়ের লেখা পড়তে যেয়ে একটা বিষয় খেয়াল করলাম। তিনি খুব নিস্পৃহ ভঙ্গিতে গল্প বলতে থাকেন। চরম নাটকীয় ঘটনাতেও সেই নিস্পৃহতা একটুও টলে না। এভাবে গল্প বলতে বলতে তিনি একটা সময় পাঠকদের প্রচণ্ড ধাক্কা দেন। স্বপ্নময়ের অবিচল গদ্য ধাক্কার ভয়াবহতা বাড়িয়ে দ্যায়। "ভেজা বারুদ" বইতেও একই অবস্থা। মজার গল্প।আনন্দ ও কৌতূহল নিয়ে পড়ছিলাম। লেখা ভালোই, তবে আহামরি কিছু ছিলো না। প্লট পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও শেষে এসে যা জোর ধাক্কাটা খেলাম!! আমাদের ভেজা বারুদের জীবন নিয়ে এ এক স্যাটায়ার, এ এক ট্র্যাজেডি।
স্বপ্নময় চক্রবর্তী এই উপন্যাসের বয়ান করেছেন একদম নিরাসক্ত ভঙ্গিতে। হরিপদ চক্রবর্তীর মতো ভেজা বারুদ দিয়ে আমাদের সমাজ ঘেরা। অন্যায় অত্যাচারের আঁচ বাঁচিয়ে কোন রকমে শান্তিতে জীবনটা পার করা ই জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য।প্রতিবাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে জ্বলে উঠবার মতো তাতালো বারুদ কি হতে পারে সবাই? নাকি ভেজা বারুদ হয়ে ও পারিপার্শ্বিকতার চাপে জ্বলে উঠতে হয় কাউকে কাউকে? সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার একটা কঠিন নিরাসক্ত বর্ণনা এই উপন্যাস। সব মিলিয়ে ভালো লেগেছে...
বইটা সুন্দর। ঘটনা প্রবাহ চমৎকারভাবে এগিয়ে গিয়েছে, প্রথমদিকে বেশ উৎফুল্ল একটা ভাব থাকলেও উপন্যাসের শেষে এসে থমকে যেতে হয়েছে। লেখক চমৎকার ভাবে উপন্যাসটাকে উপস্থাপন করেছেন। আমাদের চারপাশে ব্যাঁকা সাহা, হরিপদ বাবু এবং গুরপদ কর্মকারের মতো মানুষে ভর্তি। কেউ শান্ত এবং নিজের পক্ষে ঘটে যাওয়া অন্যায় নিয়েও নিস্পৃহ আবার কেউ কেউ এসব ঘটিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করে। ক্ষমতা, স্বার্থান্ধতা সমাজের অনেক মানুষের লোমকূপে প্রবেশ করে রয়েছে। আর সে-সব এখন আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে অনেকটা ব্যাধির মতো করে… রেটিং: ৩.৫/৫
জ্ঞানচক্ষু খুলে দেওয়ার মত এক রাজনৈতিক উপন্যাস। সাহসী স্বপ্নময় চক্রবর্তী। সাহিত্য বেঁচে থাকুক। এভাবেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাক কত না বলা কথা, আকুতি আর নিঃশব্দ গোঙানি।
"পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে পথ চেনা জনস্রোতে নানান মতে মনোরথের ঠিকানা, হবে চেনা, হবে জানা।।
অনেক তো দিন গেল বৃথাই সংশয়ে, এসো এবার দ্বিধার বাধা পার হয়ে তোমার আমার সবার স্বপন মিলাই প্রাণের মোহনায় কিসের মানা।"
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখা এই প্রথম পড়লাম। চমৎকার! রুল টানা খাতায় বিরতিহীন লিখে যাওয়ার মতন সরল, স্বচ্ছন্দ লেখা। গল্প তেমন কিছু না; আধভেজা, আধপোড়া দেশলাইয়ের কাঠির মতন মানুষদের গল্প। এদের বারুদে জ্বালা ধরানো যায় না হাজারবার ঠুকলেও; একমাত্র গুরুপদ কর্মকার, ব্যাঁকা সাহাদের মতন বোমা যখন ফাটে, তখন দেশলাই, বট, অশ্বত্থ- সব পুড়িয়ে ছাই করে। এই চিতাভস্ম তুলে আবার গঙ্গায় ভাসায় সমাজবন্ধুরা। মৃত চেতনার সৎকার। যুগ-যুগের একই নিরবধি গল্প। এসব গল্পে ছায়া ছায়া কিন্তু অবশ্যম্ভাবী একটা অনর্থের আশঙ্কা থাকে প্রতি পাতায়, কিন্তু কাহিনী তবুও মথের মতন আগুনের দিকে এগোতে থাকে অবিরাম। বইয়ের শেষপাতায় ট্র্যাজেডি থাকলে বিকৃতভাবে আনন্দিত হই আমরা, সার্থক হলো যেন আশঙ্কা। কিন্তু সেই রাতে ভাত কিছুটা বিস্বাদ ঠেকে মুখে। পানি দিয়ে গিলে পরবর্তী হরিপদ, সুলতা, চানুর পুড়ে যাওয়া দেখতে বসে যাই আমরা, আর হাত বাড়িয়ে ওম নিই সেই আগুনে।