৫ নং সেক্টরের টেকেরহাট সাব-সেক্টরের একটি গেরিলা দল। এঁরা সকলেই গণযোদ্ধা। সুনামগঞ্জ এবং হবিগঞ্জের বিস্তৃত হাওর অঞ্চল জুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও দেশীয় দালালদের পরাস্ত করেছেন দুর্ধর্ষ কৌশল ও ক্ষীপ্রতায়।
গেরিলা দলটির প্রধাণ ২২ বছরের তরুণ জগতজ্যোতি দাস প্রাণ দিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তাঁর সাহস ও আত্মত্যাগ এখনও উপকথার মত ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলের মানুষের মুখে।
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আজও এই জনপদের প্রধাণ প্রাণশক্তি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিচালনায় সবশ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে এটি ছিল বিশুদ্ধ গণযুদ্ধ, নিছক সামরিক অর্জন নয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় অনন্য সংযোজন এই গ্রন্থে উঠে এসেছে বেশ কিছু প্রকাশিত গণহত্যার ঘটনা, অসামান্য মানবিক গল্প- যেগুলো 'তুচ্ছ' থেকেছে আমাদের নগরকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে।
হাসান মোরশেদের বেড়ে ওঠা এবং স্থায়ী আবাস সিলেট শহরে। পড়ালেখা এবং কর্মসূত্রে থেকেছেন ভারত ও যুক্তরাজ্যে। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন। সিলেট অঞ্চলের পর্যটন উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন।
জগতজ্যোতি দাস ও তাঁর গেরিলা দলের যুদ্ধের কথা সংগ্রহের জন্য, দাসপার্টির জীবিত গেরিলাদের সাক্ষাতের জন্য প্রায় একবছর ধরে ঘুরেছেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই হয়ে হবিগঞ্জের বানিয়াচং আজমিরীগঞ্জ পর্যন্ত।
'দাস পার্টির খোঁজে' হাসান মোরশেদের তৃতীয় গ্রন্থ, এর আগে রাজনৈতিক ফিকশন 'শমন শেকল ডানা' এবং অরুন্ধতী রায়ের আলাপচারীতার অনুবাদ 'দানবের রূপরেখা' প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালে।
সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য বই।প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা, বীর মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতি দাস-সিরাজুল ইসলামসহ দাস পার্টির সদস্যদের রোমাঞ্চকর সব অপারেশন,হানাদার বাহিনীর তাণ্ডব, নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ, মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকার ও সুবিধাবাদীদের উত্থান-সবই এই বইয়ের আলোচ্য বিষয়।মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের একটামাত্র সাব-সেক্টর এই বইয়ের উপজীব্য কিন্তু এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা পড়ে মনে হয়,এ যেন সারা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বই।
১. একটি বহুমূখী বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে বইটি সমাপ্ত হলো। প্রচণ্ড ক্রোধ, গর্ব, আক্ষেপ, বিষাদের রাজত্ব সেই অনুভূতি জগতজুড়ে। হাসান মোরশেদের প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে লেখা মুক্তিযুদ্ধের এক পরিশ্রমী উপাখ্যান 'দাস পার্টির খোঁজে'। ছোট্ট একটা মুক্তিযোদ্ধা দল দাস পার্টি। শহীদ জগতজ্যোতি দাস যার নেতা। মাত্র একুশ বছর বয়সের অসমসাহসী এই বীর যোদ্ধা ৩৬ জনের গেরিলা দল নিয়ে হাজার পাকিস্তানী-রাজাকার বাহিনীর বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন বৃহত্তর সিলেটের হাওড় অঞ্চলে। এবং রাজাকার ও পাকবাহিনীর সাথে এক অসম যুদ্ধে নির্মমভাবে প্রাণ দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ বীরত্বের গৌরব বহন করে। যথারীতি বাংলাদেশ সেইসব অনন্য বীরত্বগাঁথা ভুলে এগিয়ে গেছে আরো সাড়ে চার দশক। বেঁচে থাকা গেরিলারা কে কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ খোঁজ করে না। সেইসব 'নিখোঁজ' গেরিলার সন্ধানে ছড়িয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী এক তরুণের অনুসন্ধানী অভিযান, জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী এবং গেরিলাদের মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকার সমন্বয়ে রচিত হয়েছে দাস পার্টির খোঁজে।
২. জগতজ্যোতি দাস এবং দাস পার্টি বিষয়ে আরো কয়েকটি বই প্রকাশিত হলেও তাদের সাথে এই বইয়ের মৌলিক পার্থক্য হলো দেখার নৈকট্য এবং দূরত্বে। অন্য বইগুলো শুনে শুনে দূরে বসে লেখা হয়েছে। আর হাসান মোরশেদ দাস পার্টির যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে নিজের পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে অভিযানের বিবরণ সংগ্রহ করেছেন জ্যোতির সহযোদ্ধাদের মুখ থেকে, সেই বিবরণ ভিডিওবন্দী করেছেন, অক্ষরবন্দী করেছেন। একাত্তরে ক্ষতবিক্ষত হওয়া মানুষগুলোর প্রত্যক্ষ বিবরণ আমাদের থমকে দেয়, অশ্রুসজল করে, আমরা বিক্ষুব্ধ হই।
৩. বইটি পড়ে আমাদের আরেকটি অভিজ্ঞান হয়। একাত্তরে যাদের বীরত্ব গাঁথা পড়ে আমরা আবেগে আপ্লুত হই, সেই মানুষগুলো এমনকি স্বগোত্রের কাছেও কতটা অনাদৃত অবহেলিত সেটা জেনে আমাদের মাথা নুইয়ে যায় মাটির দিকে। আমরা এক অকৃতজ্ঞ জাতি। হাসান মোর্শেদের সাথে আমাদের ঘুরতে হয় সদরপুর থেকে আজমিরীগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ থেকে মাকালকান্দি, মাকালকান্দি থেকে জলসুখা, জলসুখা থেকে দিরাই। আমরা হাওড় বাওড় নদী নালা কাদা পেরিয়ে একেকজন গেরিলাকে আবিষ্কার করি, একেকজন বীরাঙ্গনার সাক্ষাত পাই, আর থমকে দাঁড়াই। যে সাক্ষাতের সবগুলো বর্ননা আমাদের সুখী করে না, অনেক বর্ণনা আমাদের স্তব্ধ করে, মর্মাহত করে। আমরা আরো আবিষ্কার করি, একাত্তরের অনেক দালাল হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ শক্তির ক্ষমতার অংশীদার। সময় পাল্টে গেলে রাজাকার হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের দল বলে বিবেচিত আওয়ামীলীগের নেতা। কোথাও কোথাও এখনো প্রবলভাবে বঞ্চিত নিপীড়ত হচ্ছেন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ যাঁর সব কেড়ে নিয়েছে, স্বাধীন দেশেও তিনি সর্বহারাই থেকে যান। জগতজ্যোতির মতো বীর যোদ্ধা নিজ গ্রামেই থেকে যায় প্রায় অপরিচিত।
৪. আমরা হুজুগে জাতি। মাত্র চার দশকেই এদেশের অনেক সর্বত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার নাম আমরা ভুলতে বসেছি। ভুলতে বসেছি অমানুষিক জান্তব বর্বরতার মুখোমুখি হয়েও বুকের রক্ত দিতে দ্বিধা করেননি এদেশের একেবারে নির্বিবাদী সাধারণ মানুষটি পর্যন্ত। কোন রকম বিনিময় মূল্যের আশা না করে অকাতরে ধন প্রাণ সব দিয়ে লাল সবুজ পতাকাটি আমাদের দিয়ে গেছে যারা, সেই মহান সর্বত্যাগী হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর নামটি যেন ইতিহাসে ঠাঁই পায় সেই চেষ্টাটা আমাদের উপর অর্পিত একটি দায়িত্ব। 'দাস পার্টির খোঁজে' মাঠে নেমে হাসান মোরশেদ সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করেছেন।
৫. জগতজ্যোতি দাস নেই, কিন্তু তাঁর সহযাত্রীদের মধ্যে ইলিয়াসের মতো অনেকে এখনো জীবিত আছেন, বুকের এফোড় ওফোড় হয়ে যাওয়া গুলির আঘাত সয়ে। কেউ বা বুকের মধ্যে চার দশকের বুলেটের সীসার টুকরো বহন করে। জীবনের প্রবল প্রতিকূলতার স্রোতে মাথা উঁচু করে রেখেছেন তাঁরা। কিন্তু সত্যি কি মাথা উঁচু? এত অবহেলা, এত বঞ্চনা, জীবন যাপনের এত অসঙ্গতি নিয়ে তাঁরা কিভাবে আয়ুষ্কাল অতিক্রম করছেন আমরা অনেকেই জানি না। মুক্তিযুদ্ধের সুফল ভোগ করা ব্যক্তিরা কী একবার তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন না? জগতজ্যোতি স্মৃতির অংশ হয়ে গেলেও তাঁর জীবিত সহযাত্রীদের কাছে আমাদের কিছু ঋণ পরিশোধের সুযোগ আছে। সেই সুযোগ কী নেবো আমরা?
লেখকের বিশাল আওয়ামীপ্রীতি সত্ত্বেও - সত্ত্বেও কথাটা পনেরো বা ষোলোতে খটকা লাগার মতো হলেও, বিশের এই আওয়ামী জাহেলিয়াতে এসে এই প্রীতিটারে এখন সন্দেহ আর কৌতূহল ছাড়া দেখার উপায় বিশেষ একটা নাই - সেই সুবিশাল আওয়ামীপ্রীতিকে ছাড়িয়ে এইটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। লেখার কোয়ালিটি না, কন্টেন্টই এইখানে ভাষা হারানোর জন্য যথেষ্ট। আরো কাজ, আরো অনেক কাজ হইতে পারে, পারতো, একাত্তর বিষয়ে, কিন্তু যা হয় নাই, তা একটু হইলেও হইছে এই বইয়ে। একাত্তর নিয়ে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন প্রামাণিক বই যদিও আছে, সেগুলি অনেক কাঠখোট্টা। এইখানে ব্যক্তিগত মুগ্ধতা এসেছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের মানচিত্রসমেত সাক্ষ্য এসেছে, প্রকৃতির কিছু বর্ণনা এসেছে (মেনে নিচ্ছি যে দ্বিতীয় সারীর বর্ণনা), আর আছে কিছু খেদ। সর্বাঙ্গসুন্দর না, লেখা অনেক জায়গায় একঘেয়ে হয়ে আসে, কিছু রিপিটিশন আছে, কিন্তু তবুও, জেম একটা।
কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতি দাস ও তাঁর দাস পার্টির বীরত্বের কাহিনী সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ এলাকার হাওড় অঞ্চলের মানুষজনের মুখে মুখে থাকলেও তাঁর মুক্তিযু্দ্ধের স্মৃতি ভালোভাবে ডকুমেন্টেড না।
মুক্তিযুদ্ধের চুয়াল্লিশ বছর পর (২০১৫ সালে), দাস পার্টির না জানা গল্পগুলোর খোঁজে বের হয়েছিলেন হাসান মোরশেদ। ভ্রমণ করেছেন দাস পার্টির স্মৃতি বিজড়িত কিছু এলাকা। আলাপ করেছেন জগতজ্যোতি দাসের কয়েকজন সহযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে। দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন বহন করা কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে, কিছু বীরাঙ্গনাকে। লিপিবদ্ধ করেছেন কিছু মূল্যবান তথ্য। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী এখন আর বেঁচে নেই, যারা বেঁচে আছেন তারা বৃদ্ধ, যতটুকু মনে করতে পেরেছেন তারা লেখককে জানিয়েছেন। প্রতিটি অভিযানের জীবন্ত বর্ণনা এখন আর পাওয়া সম্ভব না। তথ্য ক্রসচেক করাও সম্ভব না। তারপরও লেখকের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তিনি আমাদের জগতজ্যোতি দাসের সহযোদ্ধা ইলিয়াসের স্মৃতিচারণ পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন��� রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার স্মৃতি বহন করা মানুষদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা জানিয়েছেন। চিকিৎসা না পাওয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার কথা জানিয়েছেন।
আমার প্রশ্ন ঐ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের এমন অর্থনৈতিক দুরবস্থা কেন? বৃদ্ধ বয়সেও কেন তাদেরকে কায়িকশ্রম করে খেতে হয়? তারা কি ভাতা পায় না? ভাতা কি সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা খেয়ে ফেলে?
এ গ্রন্থেই বহু হোমরাচোমরা লোকজনের দল পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার আলাপ আছে। এমনকি রাজাকারের বংশধরেরাও এখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জনপ্রতিনিধি হয়েছে। লেখক সম্ভবত "নেতা/নেত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে" এমন কিছুতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু রাজনীতিবিদরা আমজনতার মত আলাভোলা হয় না, এসব অনুপ্রবেশে তাদের মৌনসম্মতি থাকে। মুক্তিযুদ্ধকে তারা রাজনৈতিক একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। ধর্মকে যেমনটা ব্যবহার করে থাকে আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষ।
এই বইতেও মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে ধর্মের রাজনীতি খুঁজে পাওয়া যায়। যখন একজন মুক্তিযোদ্ধা স্মরণ করেন সশস্ত্র রাজাকারদের খতম করার কথা, তখন পাশ থেকে কেউ একজন বলে খতম হওয়া রাজাকারেরা সবাই "মুসলিম" ছিল, সেজন্য তাদেরকে জানে মারা উচিত হয় নি।
লেখক ডায়েরির মত করে বইটা লিখেছেন। বইটা ভালোভাবে সম্পাদনা করলে একটু সুখপাঠ্য হতে পারতো। লেখার মান একটু দুর্বল হয়ে গেছে। বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কথা লিখে কাগজ নষ্ট করেছেন, বিশেষ করে বইয়ের প্রথমার্ধে। তিনি কোথায় হোটেলে উঠলেন, কোথায় অটোরিকশায় উঠলেন, কখন নৌকায় উঠলেন, তার সহযাত্রী কে নৌকার সামনে, কে নৌকার পেছনে দাঁড়িয়েছে, আকাশে মেঘ আছে নাকি আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে; এসব অপ্রয়োজনীয় কথা বারবার লেখার কোন দরকার ছিল না।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে বিজয় অর্জন করেছি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি কিছু আঞ্চলিক বাহিনী গড়ে উঠেছিল। যারা নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে স্বাধীনভাবে যুদ্ধ করে গেছেন। সেক্টর-৫ এর টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে এমনই এক দলের নাম 'দাস পার্টি'। এই দাস পার্টির খোঁজেই লেখক ঘুরে বেরিয়েছেন হাওরাঞ্চলে, কথা বলেছেন দাস পার্টির যোদ্ধাদের সাথে। তারই বর্ননা ও প্রতক্ষ্যদর্শীদের বয়ান রয়েছে বইটিতে।
'দাস পার্টি' কি শুধু মানুষের মুখেই পরিচিত ছিল নাকি তাদের ছিল আনুষ্ঠানিক পরিচিতি? কাগজপত্র ঘাটলে দেখা যায় 'দাস পার্টি' নামে তাদের একটি সাংগঠনিক মুক্তিবাহিনী ছিল এবং যার কমান্ডার ছিল জগতজ্যোতি দাস নামের ২২ বছরের এক তরুণ। জগতজ্যোতি দাস সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র ছিলেন। ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। ২৫শে মার্চের পাকিস্তানি আগ্রাসনের পর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং দেশের ভেতরে চলে আসেন যুদ্ধ করতে। জগতজ্যোতি দাসের নামানুসারেই বাহিনীর নাম ছিল 'দাস পার্টি'। হাওর অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের আতঙ্কের নাম ছিল 'দাস পার্টি'।
'দাস পার্টি'র কমান্ডার জগতজ্যোতি দাস ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে রাজাকারদের ধাওয়া করতে গিয়ে পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে পড়েন। দীর্ঘক্ষণের যুদ্ধে সহযোদ্ধাদের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমছিল। শেষতক ইলিয়াস চৌধুরী ও জগতজ্যোতি দাস যুদ্ধ চালিয়ে যান। ইলিয়াসের পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হলেও তিনি অস্ত্র ফেলে দেন নি। একপর্যায়ে পাকিস্তানি পক্ষের একটি বুলেট জগতজ্যোতি দাসের মাথা ভেদ করে চলে যায় এবং তাঁর সর্বশেষ বাক্য ছিল, 'আমি যাইগ্যা।' জগতজ্যোতি শহীদ হওয়ার পর ইলিয়াস লাশকে পানিতে ডুবিয়ে পিছু হটেন কিন্তু পরদিন লাশ ভেসে উঠলে পাকিস্তানিরা সেই লাশ প্রদর্শনের জন্য আজমিরীগঞ্জ বাজারে একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে।
নাম ভূমিকায় দাস পার্টির সংশ্লিষ্টতা থাকলেও বইটিতে এর বাইরেও আরো অনেক যুদ্ধের বর্ননা লেখক তুলে ধরেছেন। হাওর অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের একাত্মতা, সাব-সেক্টরের বিভিন্ন অপারেশন, রাজাকার বাহিনীর বর্বরতার ভুক্তভোগীদের বয়ান, তৎকালীন পাকিস্তানপন্থীদের পরবর্তীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায় জীবনযাপনের বিষয়াদি উঠে এসেছে বইটিতে।
বিষয়বস্তুর খাতিরে অসাধারণ বই। তবে আমার কাছে বর্ননাভঙ্গি ভালো লাগেনি। বর্ননার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। রাজাকার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ঘেরাওরের পর হত্যার একটা ঘটনা দুইজায়গায় দুইরকম উল্লেখ করেছেন। তবে দুইটা ঘটনাও হতে পারে। সার্বিক দিক দিয়ে খুব ভালো বই বলব না। তবে মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য বীরত্বের কাহিনি ও একটি 'দাস পার্টি' সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে পড়তে পারেন। হ্যাপি রিডিং।
একটা মানুষের সঠিক ইতিহাস জানার ও জানানোর সদিচ্ছা থেকে এই সুন্দর বইটা পেলাম আমরা। হাসান মোরশেদ ভাটি অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি জগৎজ্যোতি দাস ও তার পরিচালিত "দাস পার্টি"র বৃত্তান্ত খুঁজে বের করেছেন সহযোদ্ধাদের স্মৃতি থেকে। বইটাকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়: যুদ্ধকালীন ট্যাক্টিক্স ও যুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির সংজ্ঞা পরিবর্তন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ - সেটাকে যতোটাই ইমোশনাল পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে বিচার করা হোক, অন ফিল্ড ট্যাক্টিকাল ব্রিলিয়ান্স ছাড়া কোনো যুদ্ধই জেতা সম্ভবত নয়। এটা মুক্তিযোদ্ধারা কখনও তাদের ট্রেনিং এর মাধ্যমে, কখনো ইনটুইশন দিয়ে বা কখনো অজান্তিতে কাজগুলো করে ফেলেছেন, যা কিছু এখনকার দিনে মিলিটারি একাডেমি গুলোতে শেখানো হয়। দাস পার্টির যুদ্ধের এরিয়া অব রেসপনসিবিলিটি ছিল হাওড় অঞ্চল। প্রায় বিচ্ছিন্ন একেকটা দ্বীপে তারা যেভাবে গেরিলা অপারেশন চালিয়েছেন, স্বল্পসময়ের ট্রেনিং ও টেকনোলজিক্যাল ডিজএডভান্টেজ বিবেচনায় সেটা খুবই পেশাদার ও মাইন্ডবোলিং আউটপুট দিয়েছে। বইয়ের আরেকটা অংশ হৃদয় বিদারক। আমরা দেখতে পাই, যুদ্ধকালীন নপুংসক রাজাকার জনগোষ্ঠী কিভাবে যুদ্ধপরবর্তী সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নেয়। এবং পরবর্তী কয়েক দশকে কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হবার বিপরীতে রাজাকারদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করা হচ্ছে। এটা শুধু ভাটি অঞ্চল না, সামগ্রিক দেশেরই একটা খণ্ডচিত্র বহন করে। আমরা আরো আশ্চর্য হই একজন গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কিভাবে চল্লিশ বছরে নিজের বিবেক জলাঞ্জলি দিয়ে দেন প্রভাবশালী স্থানীয় রাজাকারদের পুনর্বাসন করার মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার অভিপ্রায়ে। বইটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছে: সকল বীরশ্রেষ্ঠ কেন পেশাদার সামরিক বাহিনীর সদস্য? হাওড় অঞ্চলের মতো অনেক জায়গায় অসামরিক যোদ্ধাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের সামগ্রিক ফল আমাদের এই স্বাধীনতা। সেক্ষেত্রে "জগৎজ্যোতি দাস কেনো বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পেলেন না?" এটা একটা অনেক বড়ো চিন্তার খোরাক যোগায়। পরিশেষে সবাইকে এই বইটা পড়বার জন্যে আমন্ত্রণ জানাই। মুক্তিযুদ্ধের এ এক অতি মূল্যবান দলিল।
বীরশ্রেষ্ঠ জগতজ্যোতি দাস এবং একটি জনপদের উপাখ্যান: বইয়ের নাম: দাসপার্টির খোজে লেখক : হাসান মোরশেদ জনরা: মুক্তিযুদ্ধ,ইতিহাস,ভ্রমণ প্রকাশনী: ঐতিহ্য
পটভূমি: মুক্তিযুদ্ধের সময় সুনামগঞ্জ ছিলো সেক্টর ৫ এর অধীনে। পরবর্তীতে টেকেরঘাটকে সাব-সেক্টর করে ক্যাপ্ট��ন মুত্তালিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এসময় তার অধীনে স্পেশাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল আসে। ভারতীয় অফিসাররা আলাদাভাবে এই দলকে প্রাধান্য দিয়েছিলো এবং দলপ্রধান জগতজ্যোতি দাসের নাম অনুসারে এই দলের নাম হয় "দাস পার্টি"। এই দলটা মূলত মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সক্রিয় হয় এবং নৌপথ সহ স্থলপথে ঝটিকা আক্রমনে পাকিস্তান আর্মি এবং রাজাকরদের জন্য ত্রাস হয়ে ওঠে। দলের মধ্যমণি অসীম সাহসী জগতজ্যোতি দাসের মাথার দাম নির্ধারিত হয় জীবিত অথবা মৃত।যুদ্ধের অন্তীম মূহুর্তে জগতজ্যোতি একটি অপারেশনে মারা গেলে বেতারকেন্দ্র থেকে তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করার কথা বলা হয়। জগতজ্যোতি এবং তার দাস পার্টির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক উপাখ্যান ব্যাখা করেছেন হাসান মোরশেদ।
ভালো-খারাপ: তরুন জগতজ্যোতি দাস ও তার দাস পার্টির মুক্তিযুদ্ধে অবদান তুলে ধরার জন্য লেখক চষে বেরিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্র,সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দাস পার্টির জীবিত যোদ্ধা সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা, এবং সাধারন মানুষদের। তুলে ধরেছেন তৎকালীন নারকীয় অত্যাচার এবং দাস পার্টি সহ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা। বাধার শিকার হয়েছেন তৎকালীন যুদ্ধাপরাধী এবং বর্তমান আওয়ামীলীগ সদস্যদের। এমনকি লেখকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয় এই বই লেখাকে কেন্দ্র করে। বইয়ের বর্ণনা, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার যেনো ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ৭১ এ, যেখানে এলএমজি হাতে নিয়ে পাকিস্তানী বাংকারে ডুকে পড়ছেন জগতজ্যোতি দাস, শক্তহাতে প্রতিরোধ করছেন রাজাকারদের। জগতজ্যোতি যে অপারেশনে মারা যান তারপরে জগতজ্যোতির লাশ তার সহযোদ্ধারা পানিতে ডুবিয়ে দেন। কিন্তু পরেরদিন লাশ ভেসে উঠলে পাকিস্তানি ও রাজাকাররা তার লাশ নিজ গ্রামে নিয়ে আসে এবং গাছের সাথে বেধে রেখে প্রদর্শনী চালায়। এমনকি সাংবাদিক এনে ছবিও তোলায়।মুক্তিযুদ্ধে যে মানুষটার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব পাওয়ার কথা ছিলো সেই মানুষটাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা তো দেওয়া হয় ই নি,এমনকি ইতিহাসে তাকে স্মরনীয় করে রাখার কোনো উদ্দ্যোগ ও সরকার নেয়নি। হাসান মোরশেদের মতো লেখক এবং আমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় জগতজ্যোতিদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের কাছেও একই প্রত্যাশা।
অনেকদিন কোনো মুক্তিযুদ্ধের বই পড়ি না। পড়তে নিলেই একরাশ হতাশা এসে ভর করে- এত আত্মত্যাগের কি আমরা কোনো মূল্য দিতে পেরেছি? কিন্তু হারুন আহমেদ ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক হাসান মোরশেদের ❝দাসপার্টির খোঁজে❞ বইটি পড়ে ফেলতেই হলো,কাকতালীয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধের এই মাস্টারপিস বইটি শেষ হলো ডিসেম্বর মাসেই। এই বইয়ের অনেক লেখাই আগের পড়া- সচলায়তন ব্লগে, যদিও পড়া শুরু করার আগে খেয়াল ছিল না। পড়তে যেয়ে নস্টালজিক হয়ে গেলাম কিছুটা- পুরনো ব্লগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।
জগৎজ্যোতি দাস- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রায় ভুলে যাওয়া একজন বীরের নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাটি অঞ্চলের ত্রাস ছিলেন তিনি। নেতৃত্ব দেন এক বিশেষ বাহিনীকে- যারা ইতিহাসে পরিচিত দাস পার্টি নামে। অতি বিপদজ্জনক অপারেশনগুলোতে অংশ নেয় দাস পার্টি- সাবমেশিনগান কাধে জগৎজ্যোতি দাস যেন পরিনত হন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। তাঁর ভয়ে ভীত হয়ে থাকত পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। কেও এক বিন্দুও ছাড় পায়নি এই বীর সেনানীর হাতে। এসএমজি হাতে একাই ঢুকে পড়েছেন বাংকারে, কখনো প্রতিকূল মুহূর্তেও ভীত হননি তিনি। এমনকি মৃত্যুর আগ মূহুর্তে তার স্বভাবচিত হাসি দিয়ে সহযোদ্ধা ইলিয়াসকে বলেছিলেন, ❝যাইগ্যা❞।
বইটিকে গবেষণাগ্রন্থ বললেও ভুল হবে না। লেখক বাংলাদেশের ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় নিয়ে কাজ করেছেন, যা নিয়ে খুব কম লিখিত দলিল আছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা সালেহ আহমেদের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে বইটি শুরু হয়েছে। পেশায় সাংবাদিক সালেহ আহমেদ ছিলেন সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমন্বয়ক - দাস পার্টিকে যিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তার থেকেই লেখক সন্ধান পান দাস পার্টির অন্য সদস্যদের, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস চৌধুরীসহ আরও অনেককে। কেউ হয়ত জীবিত, কেউ বা মৃত, আবার কেউ বা চরম দারিদ্র্যতার সাথে সংগ্রাম করে বেচে আছেন। তাদের সাথে কথা বলে, সিলেট-সুনামগঞ্জ-হবিগঞ্জে লেখক খুঁজে ফেরেন এক জীবন্ত কিংবদন্তির গল্প- দাস পার্টির জগৎজ্যোতি দাসের সাহসিকতার গল্প।এর সাথে এসেছে বৃহত্তর সিলেটের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার সাহসিকতার গল্প, হাসিমুখে প্রাণোৎসর্গের গল্প।
কিন্তু এই বীরত্বগাথাই কি ইতিহাসের একমাত্র দিক? মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে ছিল অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা- নিজের একটা দেশ হবে, যে দেশে অন্তত খেয়ে-পরে সম্মানের সাথে বাচতে পারবে সবাই। কিন্তু দেশ গড়ার সে স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গিয়েছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তো দূরেই থাকুক, দেশমাতৃকার অনেক সূর্যসন্তান স্বীকৃতি পর্যন্ত পান নি- কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশের স্বীকার হয়ে হয়েছেন দেশান্তরি। আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিরা ধীরে ধীরে তাদের যায়গা পোক্ত করেছে, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা ভারী হয়েছে হতাশার এই দীর্ঘশ্বাসে।
দেশের ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানাতে, দেশের মানুষের আত্মত্যাগের কথা উপলব্ধি করাতে এই রকম সুলিখিত গবেষণাগ্রন্থের বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের অনেক না লেখা অধ্যায় এখনো আবিষ্কার করা বাকি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং তা তরুন সমাজের মধ্যে সঠিকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব বজায় থাকবে বলে মনে করি। মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে দেশকে সবাই এগিয়ে নিয়ে যাবে-এটাই প্রত্যাশা।
আমি ফিকশনের পোকা। পছন্দের জনরা "শিশুসাহিত্য "। অকপটে স্বীকার করি,আমি বানানো রূপকথার জগৎ কে ভালোবাসি,তার কারণ যখন-ই আমি বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছি,নর্দমা আর ডাস্টবিনের পঁচা গন্ধ আমার মন-জগতকে অসুস্থ করে তুলেছে!
" দাস পার্টির খোঁজে " বইটার খবর জেনেছি, অনেক আগে। নানান কারণে পড়া হয়ে উঠেনি। অবশেষে পড়লাম।
"জগতজ্যোতি দাস"। দাস পার্টির কমান্ডার। যুদ্ধের সময় তার বয়স ২২/২৩ বছর। পাকিস্তানিরা ডাকত" টেরর-জ্যোতি"। টেরর না ডেকে অবশ্য উপায় ছিল না,এই যুবক তাদের রাতের ঘুম হারাম করে ছেড়েছে। সাহস ছিল তার বাঘের মত,পরোক্ষে লুকিয়ে ছিল একটি ভালোবাসায় পূর্ণ মন। নিজের দলের কোন যোদ্ধা র মন খারাপ হলে,নিজে গিয়ে তার মন ভালো করতেন,তার মানবতা-ই কাল হয়েছিল নিজের জন্য! ঘাতকের বুলেট যখন তার মাথা ভেদ করে, জ্যোতি বলেছিল "আমি য্যাইগা"। জ্যোতি চলে গেলেন দেশ কে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এনে।
দেশ স্বাধীন হয়। যে স্বাধীন দেশের স্বপ্নে মশগুল হয়ে ঘর ছেড়েছিলেন,প্রাণের মায়া ত্যাগ করেছিলেন জগতজ্যোতি,সিরাজুল ইসলামের মত অকুতোভয় তরুণেরা,স্বাধীন দেশ তাদের কতটুকু মনে রেখেছে? জলসুখা গ্রামের মানুষ কে দেয়া ইলিয়াসের ভাষণ আম��র বার বার মনে পড়ে " এই মাটিতে দাদার রক্ত মিশে আছে। এইখান থেকে তোমাদের কেউ উচ্ছেদ করতে পারবে না "। জগতের মত যারা দেশকে সর্বস্ব দিয়ে গেছে,জাতি তাদের ভুলতে বসেছে। অথচ " দালালরা" ঠিকই বুক উচিয়ে চলে। বীরাঙ্গনা কে "নটী-বেডি" বলে। একজন যোদ্ধা শুধু রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য বলে,দালালদের বিচারের মতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে"ফালতু ঝামেলা" বলে। এই কুকুরের বিষ্ঠার মত কদর্য বাস্তবগুলো,আমাক��� নাড়া দেয়। সুস্থ থাকতে পারি না। আজাদ সাহেব বলেছিলেন " সব নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে"। এই নষ্টদের নগ্নতা সহ্য করতে পারি না বলে, এসব বাস্তবতা এড়িয়ে চলি,এটা পলায়নপরতা ও বলা চলে। মেনে নিতে না পেরে পালিয়ে যাই।
তবে স্বপ্ন দেখি, অমাবস্যার রাত কাটবে। সেদিন আমি কল্পনার রূপকথা নয়। আমার দেশকে ভালোবাসব নিজের মতো। দেশের ইতিহাস জানতে বা পড়তে আর কুন্ঠা বোধ করব না। সেদিন জগতজ্যোতি'র মত মানুষদের মাথায় করে রাখবে মানুষ, যেমনটা ইলিয়াস বা দাস পার্টির অন্য যোদ্ধারা রাখে। আশায় বাঁচে চাষা,সুদিন ফিরবে,শহীদের রক্ত ব্যর্থ হবার নয়।
বইটির ১০০তম পৃষ্ঠার পাঠক দেখতে পায় একজন তরুণ একটি পিলারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে প্রচণ্ড পরিশ্রম আর ক্লান্তিতে তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। ছবিতে বোঝা যায় না যে দুইদিন আগে পাক আর্মির একটি বুলেট তার কপাল ভেদ করে চলে গেছে।
ছবিতে আরও বোঝা যায় না যে এই পিলারে তার মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে দেবার আগে রাজাকার আর পাকিস্তানি আর্মি সেই মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে প্রদর্শন করিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। তাঁর নিজ গ্রাম হবিগঞ্জের আজমেরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে পিতামাতাকে টেনে এনে দেখানো হয় এই মৃতদেহ। উল্লিখিত ছবিটা আজমেরীগঞ্জ বাজারের। তুলিয়েছিল স্থানীয় রাজাকার আর পার্কির আর্মি সদস্যরা। একজন দুর্ধষ পাকিস্তানের দুশমন আর ভারতীর দালালকে হত্যার বিজয়ের স্মারক হিসাবে।
এই দুর্ধষ ভাটি অঞ্চলের নৌপথের ত্রাস, মাত্র ২২ বছরের তরুণের নাম জগতজ্যোতি দাস। যার নামে অঙ্কিত ভাটি অঞ্চলের নৌপথের সবথেকে ভয়ঙ্কর গেরিলা বাহিনী "দাসপার্টি"। তৎকালীন পাকিস্তানপন্থী জনগোষ্ঠীর (হয়তো আজও কিছু মানুষের) দৃষ্টিতে দেশের এই শক্র আর ভারতের দালালের একটা ঘটনা বই থেকে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। যার বর্ণনাকারী জগতজ্যোতি দাসের সবথেকে কাছের যোদ্ধা ও ভাই ইলিয়াস চৌধুরী।
"টেকেরঘাট (সুনামগঞ্জ) শরনার্থী শিবিরে আয়োজন করা হয়েছিল দুর্গাপূজা। মুক্তিযোদ্ধারা ছিল সেখানে, ভারতীর জওয়ানরাও আমন্ত্রিত ছিল। এক হিন্দিভাষী জওয়ান বাঙালি এক মেয়েকে উত্যক্ত করেছিল পূজামন্ডপে। জ্যোতি সেই জওয়ানকে মেরে মাথা ফাটিয়ে আটকে রাখেন। এই ঘটনা তীব্র প্রতিবাদ হয় ভারতীয় শিবিরে। একজন ইউনিফর্ম পরা জওয়ানকে আঘাত করা মানে গোটা বাহিনীকে অপমান করা। জ্যোতি এবং তাঁর দলকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় মেজর ভাটের দপ্তরে। কোর্ট মার্শাল হবে। জ্যোতি মেজর ভার্মাকে স্পষ্ট উচ্চারণ বলেন, পাকিস্তান আর্মির যে আচরণের জন্য আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি, সেই আচরণ ভারতীর সৈনিকের কাছ থেকে পেয়েছি বলেই আমরা আঘাত করতে বাধ্য হয়েছি। গুলি করে মেরে ফেলতে হলে মারবেন কিন্তু হাত বাঁধা অবস্থায় না। হাত খোলা অবস্থায় আমাদের গুলি করবেন। আমরা ক্রিমিনাল না, আমরা মুক্তিযোদ্ধা।"
১৯৭১, আগষ্ট থেকে নভেম্বর এই তিনমাস জগতজ্যোতি আর তাঁর দাস পার্টি ভয়াবহ ত্রাস হয়ে উঠেছিল ভাটি অঞ্চলের পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের কাছে। তাঁর নাম হয়ে ওঠে "টেরর দাস" অদম্য, অপ্রতিরোধ্য। দাস পার্টির আর্মির রসদবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে, অস্ত্রবাহী লঞ্চ দখল, রাজাকারদের নৌকা উড়িয়ে দেয়া চলতে থাকে নিয়মিত। পাকিস্তান সরকার বাহিনীর নৌযানকে এই পথ এড়িয়ে চলার বলিষ্ঠ নির্দেশনা জারি করে। তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করা হয় জীবিত অথবা মৃত।
এই জগতজ্যোতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিম্মৃত অষ্টম বীরশ্রষ্ঠ। কমান্ডার জগতজ্যোতির মৃত্যুর পর অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদক প্রদানের ঘোষণা করেন। এমনকি জগতজ্যোতি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ঘোষিত প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ লিখেছেন:
‘বীরগতিপ্রাপ্ত জগৎজ্যোতিকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল একাধিকবার এবং তার বীরত্বগাঁথা প্রচার হচ্ছিল সম্মানের সঙ্গে। অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয় জগৎজ্যোতির বীরত্বগাঁথা। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের ঘোষণা সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে আসেন বাংলাদেশ সরকার, কোন এক অজ্ঞাত কারণে। ১৯৭২ সালে জগৎজ্যোতিকে বীরবিক্রম (তৃতীয় পর্যায়ের) খেতাবে ভূষিত করা হয়।’
এই বইটি মূল ধারা জগতজ্যোতি এবং তাঁর দাসপার্টি হলেও ঠিক যেন ভাটি অঞ্চলের হাওড় আর নদীর মত আর অনেক ছোট বড় ধারা এঁকবেঁকে গেছে ভিন্ন ভিন্ন দিকে। দাসপার্টির সদস্যদের সন্ধানে আমরা দেখতে পাই আর অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের নিঃস্ব দারিদ্রতম অবস্থা। স্বীকৃতিহীন, গুরুত্বহীন, অসহায়, নিরুপায় জীবন।
আমরা দেখতে পাই ব্রজেন্দ্র দাস একজন হিন্দু গুলিবিদ্ধ প্রতিবেশিকে রক্ষা করার দায়ে একজন মুসলিম ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয় স্ত্রী কুলসুম বিবির চোখের সামনে। বুকে বাতাস ভরে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আমরা গর্ব করি, আমরা কি জানি সেই চেতনার আকীর্ণ খনির কোথায় গেলে সন্ধানে মেলে?
ব্রজেন্দ্র দাসকে সেই গুলি বহন করতে হয়েছে স্বাধীনতা উত্তর ৪৩ বছর। লেখক হাসান মোরশেদ এই বইতে অনেকবার ধন্যবাদ পেতে পারেন। তার ভেতর একবার অন্তত এই গুলি অপারেশন করে বের করার ব্যবস্থা করে দেবার জন্য। কিন্তু সবথেকে বড় যে কারণে তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন সেটি প্রায় দু বছর ধরে ভাটি অঞ্চলে দিনের পর দিন ভ্রমণ করে এই বইটির গবেষণার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের উপর বেশ কিছু বই পড়া হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এটি আমার পড়া প্রথম বই। যা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমার অনুভূতি নিছক নাড়া দেয়নি, পুর্ণনির্মাণ করে গেছে।
বইটি পড়তে অনেকসময় ভাটি অঞ্চলের নামগুলো শাল্লা, দিরাই, আজমেরীগঞ্জ, মিঠামাইন, জগন্নাথপুর নামগুলো জট পাকিয়ে যায়। যা পড়লাম আবার ফিরে পড়তে হতে পারে। কিন্তু প্রতিবার চোখের শিরায় শিরায় রাতের অন্ধকারে নৌকা ভেসে ওঠে। সেখানে হাতে এলএমজি আর স্টেনগান নিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা নির্ঘুম, সর্তক চোখে এগিয়ে যাচ্ছে হয়তো শাল্লা কিংবা দিরাই কিংবা জয়কলস। উদ্দেশ্য দুধর্ষ গেরিলা আক্রমণে ছিনিয়ে নেবার পরাধীন দেশের আরেকটা গ্রাম কিংবা আরেক টুকরো মাটি।
ইলিয়াস জিজ্ঞাসা করেন, 'দাদা, কী করব?' জ্যোতি নির্মোহভাবে বললেন, 'তোর যা খুশি কর।'
কমান্ডার যেন জানতেন এটাই তার শেষ যুদ্ধ। বিকাল সাড়ে তিনটার একটা গুলি এসে লাগে ইলিয়াসের বুকের বাঁ পাশে। মাথার গামছা খুলে বেঁধে দিতে দিতে জ্যোতি জিজ্ঞাসা করেন, 'বাঁঁচবি?' ইলিয়াস উত্তর দেন, 'মনে হয় বাঁচতে পারি।' জ্যোতি জবাব দেন, 'তাহলে যুদ্ধ কর।'
ঘটনাটা জগৎজ্যোতি দাসের সর্বশেষ যুদ্ধের একটা মুহূর্তমাত্র। ১৯৭১ এর ১৬ নভেম্বর জ্যোতি ও তার দল যখন রাজাকারদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে মরণপণ যুদ্ধে ���্যস্ত আমি ২০২১ সালে বসে 'দাসপার্টির খোঁজে' বইটা পড়তে পড়তে ভাবি কী অসামান্য সাহসী ছিলেন তারা। ওদের আসলে আর কী বিশেষণ দিয়ে বিশেষায়িত করা যায়? সেদিনই বিকালের আলো ফুড়িয়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা বুলেট এসে লাগে জ্যোতির মাথায়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পড়তে বলেন, 'যাইগ্যা।'
অনলাইনে গেমিং-এর দুনিয়ায় দিন রাত যুদ্ধ করতে ব্যস্ত থাকা এই তরুণ প্রজন্ম কখনও কল্পনাও করতে পারবে না সত্যিকারের যুদ্ধের বিভীষিকা ঠিক কতোটা! যুদ্ধ কি পরিমাণ হিংস্র হয়! মৃত্যু কতো বিভৎস! লেখক হাসান মোরশেদ দারুণ একটা কাজ করেছেন। পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বের করেছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু দুর্গম এলাকা ৫ নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাবসেক্টরের বীর যোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস ও তার গেরিলা দলের অন্যান্য সদস্যের। সবাইকে পাওয়া না গেলেও যারা বেঁচে আছেন, কিংবা সেসময় যুদ্ধে অন্যান্য ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার নেয়া, ম্যাপের মাধ্যমে সচিত্র বর্ণনায় তুলে ধরেছেন। সেসব নারকীয় বর্ণনার সাথে বইয়ের পাতায় পাতায় মিশে ছিল আফসোস আর হাহাকার। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পার হয়েছে ঠিক, কিন্তু সত্যিকারের স্বাধীনতা এসেছে কতোটুকু? আর তাই তো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একেকজন দেশ ছাড়েন অভিমানে, কেউ কেউ গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকেন সেই একাত্তরের ঘাতকদের বংশ পরম্পরার কাছে । স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় একজন বীর যোদ্ধাকে কেন যুদ্ধের সময় সশস্ত্র রাজাকারদের হত্যা করা হলো? ৭১ যারা ছিলেন তরুণ, কিশোর.. তাদের চামড়ায় এখন ভাঁজ পড়েছে, চুল-দাঁড়িতে পাক ধরেছে। আর ক'টা বছর পর হয়তো মুক্তিযোদ্ধারা কেউ থাকবেন না... ইতিহাসগুলো সংরক্ষণ করা তাই এখন বড্ড জরুরী! বইটা অবশ্য অবশ্য অবশ্য পাঠ্য!
আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং গিয়েছিলাম গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো, ছোট্ট একটি কাজে। নভেম্বরে আবারও গিয়েছিলাম, সম্পূর্ণ অকাজে, আওয়ারা ঘুরে বেড়ানোর জন্য। দুইবার গিয়ে মন ভরেনি। এই ভাটি অঞ্চলে আমি আবারও যেতে চাই। বারবার যেতে চাই। পেরুয়া গণহত্যায় পরিবারের ছয় সদস্য নিহত হলেও আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যাওয়া হিরেন্দ্র শেখর রায় চৌধুরী ছিলেন আমার কলেজ শিক্ষক। বই নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে দেখলাম ব্যক্তিগত ভাবাবেগ প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে বেশি। আবেগের তোড় কমুক, তারপর ভালো-মন্দ বলা যাবে। তাছাড়া গদিনশিন চেতনামারানি দলটির উপর মহাখাপ্পা হয়ে আছি। অষ্টপ্রহর কাজে-অকাজে জায়গায়-বেজায়গায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আওড়ে চলা দলটিই একাত্তরের পর রাজাকারের ছেলেপুলে আর সহযোগীদের দলে ভিড়িয়েছে। এসব নিয়েও বলার আছে অনেক কিছু। এখন বলতে গেলে স্রেফ আখাটা গালি বের হবে।
জানতে পেরেছি, ভারতের অঞ্জলি লাহিড়ী জগতজ্যোতিকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন। পড়তে হবে।
(এই সেই ভেড়ামোহনা নদী, যার কথা বারবার বইয়ে এসেছে, যে নদীতে একাত্তরে যুদ্ধযান ডবিয়ে দেওয়াসহ নানাভাবে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নাস্তানাবুদ করেছে দাস পার্টি এবং হত্যার পর প্রদর্শনী শেষে এই নদীতেই ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল দাস পার্টির প্রধান জগতজ্যোতির লাশ।)
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ব্যক্তিগত কিছু বাহিনি গড়ে উঠে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ভারত থেকে ট্রেনিং ও অস্ত্র সাহায্য নিয়ে তারা নিজস্ব লোক নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য। এমনই একটি বাহিনি হলো দাস পার্টি। সিলেট অঞ্চলের এই দাস পার্টির খোঁজে বের হয়েই লেখক বইটি লিখেছেন।
বইটিতে দাস পার্টির যুদ্ধ দিনের কর্মকাণ্ড, আক্রমণ, গ্রুপের বেঁচে যাওয়া সদস্যদের বয়ানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে৷ যুদ্ধের আগে ও পরে যুদ্ধবিরোধীরা কিভাবে দেশের ক্ষমতা পর্যন্ত উঠে এসেছে তাও উল্লেখ করা হয়েছে বইটিতে৷
আমাদের বাঙালিজাতির সবচেয়ে গৌরবময় এবং সবচেয়ে স্পর্শকাতর ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। যেখানে বৃহৎ স্বার্থে সব বয়সী এবং সব পেশার মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিল নিজের দেশকে রক্ষা করার তাগিদে। তবে সেই বৃহৎ কর্মযোগের ভাঁজে ভাঁজে এমন অনেক গণমানুষের কথা লুকিয়ে আছে যাদের কথা আমরা জানি না। তেমনি এক লুকিয়ে পরা ইতিহাসের নায়ক হলো জগতজ্যোতি দাস। অকুতোভয় এই বীর যুদ্ধ করেছেন ভাটি অঞ্চলে। বিশেষ করে নদীপথে পাকিস্তানি সেনাদের এবং রাজাকারদের যোগাযোগ সুবিধা অকার্যকর করার জন্য। মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যে তার সহযোদ্ধাকে "যাইগ্যা" বলার সুযোগ পেয়েছিলেন। সে ছিল "দাস পার্টি" নামের দলের কমান্ডার এবং "দাস পার্টি" নামের দলের নাম করণ করা হয়েছিল তার নামে। ১৬ নভেম্বর তার মৃত্যুর পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করার কথা থাকলেও পরে বীরবিক্রমে ভূষিত করা হয় কিন্তু পরিপত্র অনুযায়ী বীরোত্তম! দাসপার্টির অসংখ্য যোদ্ধরা এই তরুণকে নিজেদের লিডার মেনে যুদ্ধে নানা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিল। লেখকের লেখা হতে জানা যায় বর্তমানে দাস পার্টির বেশ কিছু সদস্য জীবত তাদের বয়ান অনুযায়ী এই লিখিত হয়েছে সাথে শাল্লা, দিরাই, আজমিরিগঞ্জের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের বয়ান, যারা ১৯৭১ সালে দাস পার্টিকে কাছ থেকে দেখেছেন। যুদ্ধের অসংখ্য নির্মম অত্যাচারের কথা পড়তে গিয়ে গা কেঁপে উঠবে। যেমন একটা বাচ্চাকে টেনে হাত পা আলাদা করে ফেলা, একজন বৃদ্ধকে গাছে ঝুলিয়ে ছাল ছড়িয়ে লবন দেওয়ার মতো কাজ, কোলের শিশুকে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলা, মন্দির প্রাঙ্গণে পূজা হবে সেইসময় আক্রমণ চালিয়ে নারীদের ধর্ষণ। আর এসবই হয়েছিল পাকিস্তানিদের দালাল রাজাকারদের সরাসরি হস্তক্ষেপে। যেই রাজাকার এতই শক্তিশালী যে '৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তখন আনন্দ মিছিল করেছিল সাথে সেই সময়ের একজন মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে চরম অপমান করেছিল। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় '৭১ এর যারা পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছিল তারা আজ প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষমতার আসনে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। আর তাদের ছত্র তলে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে হচ্ছে, এর চেয়ে নির্মম আর কী হতে পারে?
৫ নং সেক্টরটা আমার সেক্টর। মানে সুনামগঞ্জ জেলা এই সেক্টরেই পড়েছিল। টেকেরঘাট সাব সেক্টর একদমই কাছে। জগৎজ্যোতি দাস হচ্ছেন দাসপার্টির দাস যাঁর নামে। সেই জগৎজ্যোতি দাস এবং দাস পার্টির আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র। আমিও সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী। জীবনে অল্প কিছু গর্ব করার মতো ঘটনার এটা একটা। লেখককে কৃতজ্ঞতা এইভাবে অ্যাডভেঞ্চার করে করে সত্য খুঁজে বের করে সকলের সামনে নিয়ে আসার জন্য। 'দাসপার্টির খোঁজে' পড়তে পড়তে কতবার যে চোখে জল এসেছে গুণে শেষ করা যাবে না হয়তো। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের করুণ অবস্থা পড়তে কার ভালো লাগে? লেখকের বলিষ্ঠ লেখনী ছুঁয়ে গেছে রাজাকার এবং নামধারী রাজনীতিকদের ও, যাঁরা সুযোগ নিয়ে নিয়ে গদিতে আসীন ছিলেন। নিজের চাকরির সুবাদে আজকাল অভাবনীয় সুন্দর সুনামগঞ্জকে চিনতে পারছি। আর এই বইটি পড়ার মাধ্যমে জানলাম এই সব স্থানে কত গর্ব করার মতো, একই সাথে মর্মান্তিক কাহিনী ঘটে গিয়েছে। ইচ্ছে আছে, একটু ঝাড়া হাত পা হয়ে এই নিজ জেলার মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্মৃতিবিজড়িত স্থান ঘুরে দেখার। আর এই ইচ্ছে জাগিয়ে তুলেছেন লেখক হাসান মোর্শেদ।
বীরদের বীরত্বব্যঞ্জক প্রকৃষ্ট বই দাস পার্টির খোঁজে। এখানে যেমনি রয়েছে বীরগাথাদের গল্প তেমনি প্রত্যক্ষদর্শ���র বয়ানে উঠে আসা তৎকালীন পাক আর্মি ও দেশীয় কুলাঙ্গার রাজাকারদের নির্মম নির্দয় অবিচার, অত্যাচার। কোলের বাচ্চাকে ছুড়ে ফেলে হত্যা, শিশুর হাত পা টেনে ছিড়ে হত্যা করা, সন্তানসম্ভবা নারীকে ধর্ষণ,লুট আরো কত অত্যাচার কত অমানবিক।পাশবিক অত্যাচার ও মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েও শুকলাল পুরকায়স্থ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মৃত্যু বরণ করে। তার চামড়া কেটে লবণ মাখিয়ে দিলেও তিনি তার দেশপ্রেমের প্রতি অনড় থাকেন।
দীর্ঘদিনের স্বাধিকারের আন্দোলনের পথিকৃৎ '৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধ। সামান্য মানুষগুলো দেশপ্রেম নাহয় স্বজন হারানোর শোক,প্রতিশোধ স্পৃহাবোধ থেকে অকুতোভয়ে একত্রিত হয়ে অসামান্য বীরত্বের সাথে দেশের বিজয় ছিনিয়ে নেবার ইতিহাসে রয়েছে বহু সূর্যসন্তানের ত্যাগ তিতিক্ষা, প্রাণ উৎসর্গ। তেমনিই সূর্যসন্তান জগতজ্যোতি দাস 'বাংলা জ্যোতি' রেখেছিলো প্রাণবাজি অস্ত্রহাতে একের পর এক সমরক্ষেত্র জয় করে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি করলে তৎকালীন পাক আর্মি রাজাকার বাহিনীর আতঙ্ক নাম দাস পার্টি। দাস পার্টির কামান্ডার ছিলেন শৌর্যশালী জগতজ্যোতি দাস তার নামের সাথে মিল রেখে এই দলের নামকরণ। জগতজ্যোতির সাথে অদম্য নির্ভীক অসমসাহসী দেশস্বাধীনের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একদল লড়াকু সহযোদ্ধারা যারা নিজেদের নিয়মিত অপারেশন ছাড়াও অন্যদলের প্রয়োজনে বা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে যুদ্ধ করেছে। দাসপার্টির খোঁজ করতে গিয়ে লেখক আরো কয়েকটি গেরিলাযোদ্ধার গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন ,বইতে তাদের অপারেশনের কথাও উঠে এসেছে।
দেশ স্বাধীন হয় কিন্তু বীর দেশপ্রেমিকদের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক আন্তঃকোন্দোল অসমন্বয়ের তড়িৎ সুযোগে দলবদল করে ধুরন্ধর রাজাকাররা আবার ক্ষমতায় চড়ে বসে তারপর তারা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর ওৎ পেতে থাকে। পরিস্থিতি অনুকূলে আসা মাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের জুতা পেটা, বীরাঙ্গনাদের লাঞ্ছিত করে।
মু্ক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অবশ্যপাঠ্য এক অসাধারন দলিলে লেখক খুব যত্ন সহকারে তার সব পরিশ্রম ঢেলে সাজিয়েছেন যা পাঠককে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করে সংগ্রামের চেতনাবোধে। শুধু এইটুকু আকুতি…পড়ুন।
অামাদের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এর মাঝে কোন বেসামরিক লোক নাই। অথচ জগতজ্যোতি দাস এর নাকি প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ হওয়ার কথা। যার গেরিলা দলের অংশগ্রহণে মুক্ত হয় সিলেট অঞ্চল।
সেই জগতজ্যোতি ও তাঁর গেরিলা দল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক উপাখ্যান দাস পার্টির খোঁজে.....
মাঝারি মানের লেখা আর একজিকিউশনের কারনে ভ্রমণ কাহিনী বলে মনে হয়েছে বেশি।
কিন্তু অসাধারণ একটা কাজ, হোক না লেখাতে ঘাটতি, এরকম দলিল আসলে অনেক অনেক দরকার। গল্পটা দাস পার্টিকে নিয়ে, দাস পার্টির জন্যে। আশা করি এরকম আরও আরও বই পাবো, এলাকা ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখা এখনো বাকি। অনেক বাকি!!!
স্বাধীনতার এত বছর পরও যখন মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার হত্যার কৈফিয়ত দিতে হয় তখন দেশের স্বাধীনতা আদতেই অর্জিত হয়েছে কিনা তা বেশ ভাবায়।
অনেক তথ্যবহুল বইটি। মাকালকান্দির সেই বৃদ্ধা, ব্রজেন দাস, প্রমীলা দাস, শুকলাল পুরকায়স্থ তাদের প্রত্যেকের কাহিনীতে ফুটে উঠেছে সেই পাশবিক নির্যাতনের ছবি।
দাশপার্টির কমান্ডার জ্যোতির বীরত্ব লেখক সুন্দর করে তুলে ধরেছেন, খালেকের মত এখনো শক্তিধর রাজনৈতিক দলের নেতার বিরুদ্ধেও তার লেখনী থামেনি বলে লেখককে সাধুবাদ জানাই।
তবে কিছু জায়গায় একই জিনিসের রিপিটেশন কিছুটা একঘেয়েমি করে তুলেছে।
মুক্তিযুদ্ধের কেবল এক অঞ্চলকে ঘিরেই এত ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা এই বইটি না পড়লে জানা হত না। অবশ্যই সবার বইটি পড়া উচিত।
হাসান মোর্শেদ ৭১ এর সবচেয়ে দুর্গম সাব-সেক্টরের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন এই বইয়ে। তথ্য সংগ্রহ করতে ছুটেছেন আজমিরিগঞ্জ থেকে দিরাই থেকে হাওরের মাঝখানে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত যেখানে যুদ্ধের সময় ৭৯ জনকে একসাথে মেরেছিল পাকিস্তান আর্মি আর রাজাকাররা। এই গনহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী যে কয়েকজন প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন তাঁদের ভয়াবহ বর্ণনা শুনলে সামনে এগুনো যায় না। এক নিঃশ্বাসে ২০০ পেইজের বইটা পড়ে শেষ করে এখনো সবকিছু প্রসেস করতে পারছি না।
যেকোনো গনহত্যাই ভয়ঙ্কর রকমের নৃশংস। হাওর অঞ্চলের হিন্দুরা প্রাথমিক টার্গেট হলেও বাদ যায়নি কোনো শ্রেণি-পেশা-ধর্মের মানুষই। লেখক যে কয়টা গনহত্যার কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো পড়তে গেলেই বুঝা যায় এই পাকিস্তানীদের মূল উদ্দেশ্য কি ছিলো। আর এই বিশাল ইতিহাস পাড়ি দিয়ে এসেও এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। কৃষক যুদ্ধ থেকে ফিরে দেখেছেন জমি দখল করা হয়েছে, হিন্দুদের সম্পত্তি পানির দামে কিনে নিয়েছেন প্রভাবশালী কেউ। আবার এই বিভৎস অত্যাচার থেকে বাঁচতে অনেকেই হয়েছেন দেশান্তরি। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেশান্তরি হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুকুমার দাসও, যিনি ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দানব ও তার দলটিকে শাস্তি দিয়েছিলেন যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ব্রাশফায়ার করে মেরে।
১৯৭১-এ দেশের সবচেয়ে সাহসী বাইশ বছরের যুবকটির বীরত্বের ইতিহাস খোঁজার আখ্যান এই বই। শহীদ জগৎজ্যোতি দাস যুদ্ধ করেছেন তার দুর্ধর্ষ গেরিলা দল দাস পার্টি নিয়ে সুনামগঞ্জের হাওর ও নদীপথ ধরে। ২৮ মার্চের সুনামগঞ্জ প্রতিরোধে অংশ নিয়ে পরে চলে যান ভারতে। সেখানে স্পেশাল ট্রেনিং নেয়ার পর তাকে প্রধান করে গড়ে তোলা হয় দাস পার্টি। দল নয়, পার্টি। তাঁর নামানুসারেই তাদের দলের নাম দাস পার্টি। এই দাস পার্টি তখন সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ত্রাস। পাকিস্তান মিলিটারি ও বিশাল রাজাকার বাহিনীর সাথে অনেকগুলো যুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে অংশ নেয় দাস পার্টি। রাজাকারদের থেকে ব্রীজ দখলমুক্ত করে সেটা উড়িয়ে দেয়া থেকে শুরু করে থানা লুট, মিলিটারির রসদ ও অস্ত্রভর্তি বার্জ ডুবানো - দাস পার্টি ছিলো অপ্রতিরোধ্য। তাঁকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য তাঁর মাথার দাম হাঁকে পাকিস্তানীরা। কিন্তু আমরা এই দুর্দান্ত গেরিলার পরিনতি আগে থেকেই জানি।
১৬ তারিখের সম্মুখ যুদ্ধে একে একে সব সহযোদ্ধার মৃত্যুতেও দমে যাননি জ্যোতি। ইলিয়াসকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন নিজের প্রিয় এলএমজি হাতে। গুলি ইলিয়াসের বুকে বিঁধে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, সেখানে গামছা বেঁধে সঙ্গ দিয়ে গেছেন তাঁর প্রিয় দাদাকে। সেই দিনের প্রায় অর্ধশত বছর পরও এই গেরিলা যোদ্ধা লেখকের কাছে ঐ সন্ধ্যার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলেন। জ্যোতির লাশ পাশের নদীর পানিতে ডুবিয়ে জীবন নিয়ে ফিরেছিলেন ইলিয়াস। আর সেই লাশ রাজাকাররা নিয়ে যায় আজমিরিগঞ্জে, বেঁধে রাখে বাজারের বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে সর্বসাধারণের দেখার জন্য। ছবিও তোলে।
প্রাচীন পুঁথির নায়কদের মতো সৌভাগ্যবান নন জগৎজ্যোতি দাস। এই অঞ্চলের সবচেয়ে আলোড়িত ইতিহাসের নায়কের লাশ ভেসে যায় নদীর পানিতে, আর ওদিকে আওয়ামীলীগের চেয়ার জুড়ে বসে একই এলাকার রাজাকাররা যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে নারকীয় গনহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানী মিলিটারীরা। তাঁর নামের শেষে বীরবিক্রম নাকি বীরোত্তম বসবে সেটা দেখুক সরকারই। তবে এই যে একটা বিশ্বাস বা একটা আদর্শের জন্য সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র, পাকিস্তান মিলিটারির এক তৎকালিন কর্ণেল বা গ্রামের কৃষক বা স্কুলের মাস্টার, সবাই একই দেশের বিভিন্ন সেক্টরে, সাব-সেক্টরে, হাওরে বা জঙ্গলে অস্ত্রহাতে দাঁড়িয়ে যান, কারো পা উড়ে যায় বোমায়, কেউবা পাকস্থলীতে বুলেট নিয়ে কাটিয়ে দেন ৪৪ বছর, এই যে প্রায় একই সময়ে সমান্তরালে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার সাহস এই মানুষগুলো দেখিয়েছেন, এই সাহস এখন সংক্রমিত হওয়া বেশি জরুরী।
শহীদ জগৎজ্যোতি ও তাঁর দাসপার্টির কাছে অনেক কৃতজ্ঞ এই দেশের প্রত্যেকটা মানুষ।
ভাঁটি অঞ্চলের নৌকমান্ডো দাস পার্টির বীরত্বগাথা যেন নেটফ্লিক্সের দুর্ধর্ষ থ্রিলার। তবে আমাদের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার - চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরা দারিদ্র্যপীড়িত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, ৫০ বছর ধরে ধর্ষণের গ্লানি বয়ে বেড়ানো বীরাঙ্গনা নারী, যুদ্ধে রাজাকারদের হাতে সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে পথে বসা দরিদ্র পরিবার, আওয়ামী লীগের পদাধিকারী স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী যুদ্ধাপরাধী রাজাকারের উদগ্র উল্লম্ফন - এই বেদনা, এই যন্ত্রণা, এই অক্ষম ক্ষোভ মনে হয় না বইয়ের পাতায় কিংবা টিভি পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। তাই বৃদ্ধা ধর্ষিতা নারীর মুখে ধর্ষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা শুনে লেখক ও তার সহকর্মী কেঁদে ফেলেন, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসে অক্ষম ক্রোধে আমি দাঁত কিড়মিড় করতে থাকি। রাজাকার কর্তৃক হতভাগা গ্রামবাসীকে উলটো করে ঝুলিয়ে ছুরি হাতে কুরবানির পশুর মতো মাংস ছাড়ানোর সাক্ষ্ম্য পড়ে আমি অনুভব করি ন্যায়বিচারের আদি ও অকৃত্রিম নীতি আসলে একটাই - লেক্স ট্যালিওনিস। চোখের বদলে চোখ। রক্তের বদলে রক্ত। বাংলাদেশের মতো দুঃস্থ রাষ্ট্রে আইন-আদালত-ট্রাইব্যুনালের হাত নিশ্চয়ই সেসব জায়গায় পৌছাবে না যেখানে এখনও টেলিফোন নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পৌছেনি, যেখানে ৫০ বছর ধরে দেহে বুলেট বহমান যোদ্ধার অস্ত্রোপচারের জন্য একটা হাসপাতাল গড়ে উঠেনি! খুব শান্তি পেতাম, যদি গল্প-উপন্যাসের কল্পজগতের ন্যায় একজন ভিজিল্যান্টি আইন-আদালতের অসম্পূর্ণ ন্যায়-বিচার অস্ত্র হাতে পূরণ করে দিতো!
ইংরেজি ভাষায় পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের জেনোসাইড ও বঞ্চনা নিয়ে অভিসন্দর্ভ লিখিত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে কোন দৃঢ় গবেষণা হয়নি। বাংলাদেশের জেনোসাইডের সাথে অন্যান্য জেনোসাইডের গুণগত সাদৃশ্য-পার্থক্য অনুসন্ধান, জেনোসাইড বিচার সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন-শাস্ত্রে বাংলাদেশের জেনোসাইড গবেষণা কী ভূমিকা রাখতে পারে, বাংলাদেশের রক্তাক্ত অতীতের সাথে যুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বোঝাপড়া সম্পাদন - অনেক কিছুই হওয়ার ছিলো যা আমাদের গাফিলতি ও ব্যর্থতায় হয়নি। বাংলাদেশের কোন অজপাড়াগায়ে বসে ইন্টারনেট ঘেঁটে হলোকস্ট, আরমেনিয় জেনোসাইড, ফিলিস্তিনের নাকবা, উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের জেনোসাইড, এমনকি কাশ্মিরের ইতিহাস নিয়েও গবেষণা করে বইয়ের পর বই লিখে ফেলা যাবে; কিন্তু বাংলাদেশের হাজার হাজার প্রত্যন্ত জনপদে বিভীষিকাময় জেনোসাইডগুলোর স্মৃতি উত্তরজীবীদের প্রয়াণের সাথে ক্রমশঃ মিলিয়ে যাচ্ছে। জেনোসাইডের সাক্ষী আমাদের এসকল নিউরন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে নিভে যাচ্ছেন, আমরা জাতিগতভাবে ধীরে ধীরে স্মৃতিভ্রষ্ট হচ্ছি। তার আগেই লেখক নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে কিছু সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ ও ক্যামেরাবদ্ধ করার অসীম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন। বাংলাদেশের বাকি সকল অঞ্চলের সাক্ষ্যগুলো লিপিবদ্ধ হলে আমরা উপলব্ধি করতাম জনযুদ্ধের গণযোদ্ধাদের কী অসম্ভব আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই দেশ, যে আত্মত্যাগ হতে পারতো সাম্য ও সুশাসন-ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের অনুপ্রেরণা।
দারুণ একটা বই। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ইতিহাসের কাঠখোট্টা ভাবটা নেই বরং প্রত্যক্ষদর্শী, মুক্তিযোদ্ধা আর ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার, বিভিন্ন মানচিত্র ও ছবির দ্বারা বইটাকে আকর্ষণীয় করেছেন লেখক। বইটা পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে মুগ্ধ হয়েছি দাস পার্টির বীরত্ব দেখে, মাঝে মাঝে ক্রুদ্ধ হয়েছি পাক বাহিনীর বর্বরতার বর্ণনা শুনে আবার মাঝে মাঝে অবাক হয়েছি তৎকালীন স্বাধীনতা বিরোধীদের বর্তমানে ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান দেখে।
লেখকের লেখনী ততটা পছন্দ হয় নি। পুনরাবৃত্তি প্রচুর, বিরক্তও হয়েছি দু-এক জায়গায়। কিন্তু লেখক যে পরিশ্রমটা করেছেন এক অজ্ঞাত বীরের দলকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তা প্রশংসনীয়।
সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে যুদ্ধ করেন জগতজ্যোতি দাস। গেরিলা যুদ্ধা, দাস পার্টির লিডার। যুদ্ধক্ষেত্রেই শহীদ হন ।৪৪ বছর পর তার সহযোদ্ধাদের খুঁজতে গিয়ে ভ্রমনে বেরোন লেখক। দিনলিপির মত করে লেখা বইটিতে আছে সেই ভ্রমনে পাওয়া যুদ্ধকাহিনী , আর আছে, মেরুদন্ডহীন আমাদের ( বর্তমান আমাদের) কাপুরুষকতার কিছু নমুনা। 🙂
মুক্তিযুদ্ধের সময় হাওর অঞ্চলে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের জন্য এক ত্রাসের নাম ছিল জগতজ্যোতি দাস। তার নেতৃত্বে দাস পার্টি বহু অপারেশন পরিচালনা করেন সেই সময়ে, কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক মাস আগে সম্মুখ সমরে শহীদ হন। দাস পার্টির গণযোদ্ধাদের নিয়েই এই বই। এখন কেমন আছেন হাওর অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা, তাঁদের সাধারণ জীবন যাপন, অনেক না পাওয়ার কথা জানতে পারলাম। বই পরে মনে হলো হাওর অঞ্চলে পাক বাহিনীর চেয়ে আরও বেশি নৃশংস ছিল রাজাকাররা এবং যুদ্ধের পরে রাজনীতির খেলায় তারা বা তাদের সন্তানেরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় পদে পৌঁছে গেছে, এখনো কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করে মুক্তিযোদ্ধাদের। হাওর অঞ্চলের যুদ্ধ নিয়ে এর আগে কোন বইয়ে এত বিস্তারিত বর্ণনা ছিল বলে আমার জানা নেই।
বৃহত্তর সিলেটের ৫ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর টেকেরঘাটের একটি গেরিলা দল দাস পার্টি। মাত্র ২২ বছরের এক তরুণ জগতজ্যোতি দাস এই দাস পার্টির প্রধান।অশিক্ষিত খেটে খাওয়া কৃষক, শিক্ষিত তরুণ, সদ্য কিশোর এবং মধ্যবয়সী যোদ্ধা ছিলো এই দাস পার্টিতে। যুদ্ধকালীন সময় দাস পার্টি তাদের অসীম দক্ষতা ও সাহসিকতায় হাওড় এলাকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, দালাল,রাজাকারদের পরাস্ত করেছিলো। এটা গণযোদ্ধাদের সম্মেলন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রাণপাত করে নড়াই করেছে সবাই। দলনেতা জগতজ্যোতি আসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন, এই বীরযোদ্ধাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব দেবার ঘোষণা দেয়া হয় কিন্তু পরে তাঁর ভাগ্যে জুটেছিলো "বীর বিক্রম" খেতাব।
" দাস পার্টির খোঁজে " মুক্তিযুদ্ধের এক মৌলিক বই। অসাধারণ একটা বই।
জগতজ্যোতি দাস। তার গল্পের শুরু হয় বালাট শরণার্থী শিবির থেকে। সেখানে আশ্রিত বাঙালিদের উপর প্রায়ই নির্যাতন চালাতো স্থানীয় খাসিয়া সন্ত্রাসীরা। মারধোরের পাশাপাশি মদ খাওয়ার জন্য চাঁদাবাজি চলতো। একদিকে দেশতাড়িত অসহায় জনতা, তার উপর এই অত্যাচার। অবস্থা বেগতিক! ঠিক তখন তাদের উদ্ধারে আসেন এক তরুণ। আরও মানুষবল নিয়ে খাসিয়াদের একদিন ধরে চরম শাস্তি দিয়ে জানিয়ে দিলেন নিজের অমিত সাহসের কথা। এরপর খাসিরারা আর বাঙালিদের অত্যাচার করার সাহস পায়নি। পরবর্তীতে এই তরুণ সিলেট বিভাগীয় অঞ্চলে পাকিস্তানিদের ত্রাস হয়ে উঠেন। তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করেন বিশেষ মুক্তিফোর্স 'দাস পার্টি'। তাঁদের অকুতোভয় কাব্য থেকে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামক ছন্দ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪৫ বছর পর এই দাস পার্টির খোঁজে বেরিয়েছেন লেখক হাসান মোর্শেদ। ১ বছর ধরে তিনি সিলেট অঞ্চলে ঘুরে বেড়ান। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেখা করেন, স্মৃতিকথা সংগ্রহ করেন। জগতজ্যোতিকে তিনি আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। সেই চেষ্টাচড়িতের লিখিত সংকলন এই বই। বইটি শুধু জগতজ্যোতিকে চেনার জন্য পড়তে বসা। কিন্তু পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বেড়িয়ে এলো গণহত্যা এবং যুদ্ধের বহু কথা। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার হতদরিদ্র অসহায় অবস্থার ছবি এবং বর্ণনা শুনে কখনো ভিজে গিয়েছিল চোখের কোণা। শক্ত হয়ে গেল গলার দিকটা। বিশেষ করে একাত্তরের ঘাতক দালালরাই যখন স্বাধীন বাংলার বুকে ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধাদের দফায় দফায় অপমান করে টিকে আছে বহাল তবিয়তে, তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্ট হয়ে গেলো। এভাবে আরও শত শত অপ্রিয় সত্য এই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে যা হজম করতে সময় দরকার।
বইয়ের নতুন সংস্করণে লেখক আরেকটি ঘৃণ্যকর ঘটনা জুড়ে দিলেন। বই প্রকাশের দায়ে তার নামে মামলা করেছে স্থানীয় পাকিস্তানের দালালরা। সেই মামলায় লড়তে গিয়ে তিনি খুঁজে পান মেঘনা ফোর্সের মুক্তিযোদ্ধাদের। সেখান থেকে আরও নতুন তথ্য বেরিয়ে আসে। যা পড়তে পড়তে কখন বইয়ের শেষ পাতায় চলে আসলাম, টের পেলাম না।
এই বইটি মুক্তিযুদ্ধকে জানতে চাওয়া প্রতিটি তরুণ, শিশু, বৃদ্ধের জন্য। এই বইটি যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানতে চাননা, তাদের জন্যেও। এখানে ফুটে উঠেছে উপমহাদেশীয় রাজনীতির এক অদ্ভুত চিত্র, যা ভাবতে গেলে মাথা হেঁট হয়ে যায়। বইয়ের এক পাতায় এক মুক্তিযোদ্ধার তার বাবাকে লেখা চিঠি পড়েছিলাম। সেখান তিনি লিখেছেন,
"মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন"।
সেই যোদ্ধা শহীদ হলেন তার আশঙ্কামতেই। কিন্তু তিনি যে স্বাধীনতার আশ্বাস দিয়েছিলেন তার পিতাকে, তা কি আদৌ পূরণ হয়েছে? প্রশ্ন থেকে যায়।
দাস পার্টির খোজে হাসান মোরশেদের প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা একাত্তরের এক হারিয়ে যাওয়া উপাখ্যান। বৃহত্তর সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, টেকেরহাট অঞ্চলের হাওরভিত্তিক জনগণের থেকে কিভাবে এক প্রকৃত গণবাহিনী উঠে আসে, গেরিলা কায়দায় সাপ্লাই লাইন ধ্বংস আর স্থানীয় রাজাকার-শান্তি বাহিনীর সাথে পাওয়ার ক্লাশে জড়িয়ে পরে তার সরেজমিন উপাখ্যান৷ স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক লেখা অনেক থাকলেও দাস পার্টির খোজ পড়া লাগবে দুইটা কারণে।
১. বইটা কোনো হিরোর গল্প না, এইটা একটা ট্রাজেডি। দাস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জগতজ্যোতি দাস এইখানে একটা ফুটনোট মাত্র, প্রকৃত হিরো সালেহ চৌধুরী আর সহযাত্রী ইলিয়াস, যাকে এখন স্থানীয় চেয়ারম্যান এর লোকজন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও দেন না। বইটা ট্রাজেডি বীরাংগনা কুলসুম বিবির কারণে, যাকে এখন লোকেরা 'নটির বিটি' বলে ডাক দেয়, বীরাংগনা প্রমীলা দাসের কারণে, যার কান কাটা যায় ধর্ষণের সময়, আর তার মেয়ের পরিবার ভেংগে যায় এই কথা জানাজানি হওয়ার পর। ট্রাজেডি অসংখ্যা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার জন্য, যারা এখনো হয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত হন নাই, কিংবা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে অশীতিপর জীবনযাপন করছেন। বইটা ভিক্টোরি ল্যাপ না।
২. বই টাকে শুধু মুক্তিযুদ্ধের বই বললে ভুল হবে। বইয়ে আছে হাওর অঞ্চলের অসামান্য সৌন্দর্যের বর্ণণা, আর যুগ যুগ ধরে চলে আসা পাওয়ার ক্ল্যাশের হিসাব, যেই সমীকরণ এর অংশ ধর্ম, শ্রেণী, অর্থ, প্রতিপত্তি আর সর্বোপরি রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বাদ দিলেও শুধুমাত্র হাওর অঞ্চলের আর্থসামাজিকতা বুঝতে চাইলে বইটা পড়া উচিত।
মুক্তিযুদ্ধের ৯০ টা বই আজকাল হয় শেখানো কথা হাজারবার উগড়ে দেয়া অপবিষ্ঠা, আর নয় নামমাত্রে পুরস্কার পাওয়ার রাস্তা। এই বইটা পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য, পেয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু সেটা ভিন্ন কারণে। বইটা পড়ার তাগদ রইলো।
গেম অফ থ্রোনসের হাউজ বোল্টনের কথা মনে আছে? যাদের পতাকায় থাকত চামড়াছেলা মানুষের প্রতিকৃতি?
বিশ্বাস হবে যদি বলি এই বাংলাদেশেই ৫০ বছর আগে এক সত্যিকারের বোল্টন ছিল? রাজাকার চেয়ারম্যান খালেক।
লেখক ঘুরে বেড়িয়েছেন সিলেটের বিভিন্ন প্রান্তে দাসপার্টির খোঁজে। জগৎজ্যোতি দাস, বাংলাদেশের এক চিরন্তন আক্ষেপের নাম। আমরা তাঁকে তাঁর সম্মান দিতে পারিনাই। তাঁর জীবিত সহযোদ্ধারাও বা কী পেলেন এত বছরে? বই পড়ে বাংলাদেশি হিসেবে লজ্জাই হবে শুধু।
শহীদ জগৎজ্যোতি দাসের ভূমিতে আজো রাজত্ব করে বোল্টনের বংশধররাই। তাঁদের প্রভাবে মিথ্যা মামলায় দেশ ছাড়েন মুক্তিযোদ্ধা, মানহানির মামলা খান লেখক।