কলকাতার বই বললে বই পড়ুয়াদের চোখে চকচক করে উঠে আনন্দ কিংবা মিত্র & ঘোষের ঝাঁ চকচকে বইগুলো। কিন্তু একটা ব্যাপার যেটা জানা হয়নি সেটা হলো এই মিত্র & ঘোষ প্রকাশনের মি. মিত্র কে আর মি. ঘোষটাই বা কে?
বিশিষ্ট সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্রকে কে না চেনে। তিনিই সেই মি. মিত্র। আর ঘোষ বাবু হলেন তার ছোটবেলাকার বন্ধু সুমথনাথ ঘোষ। প্রকাশন সংস্থা তো হলো.. এরপর থাকে কত্তো কাজ! সেসব কিছু সামলে সেই ছোট্ট প্রকাশনা সংস্থাটা কি করে মহীরুহ হয়ে উঠল সেটার গল্প লিখেছেন সবিতেন্দ্রনাথ রায়। আসলে এই বইটায়(মানে প্রথম খন্ডটা)যে সময়ের কথা বলা হয়েছে তখন মিত্র & ঘোষ সবে কুঁড়ি থেকে প্রস্ফুটিত হচ্ছে হচ্ছে করছে। আর সবিতেন্দ্রনাথ রায় সেই ছোট্ট সংস্থার ছোট্ট চাকুরে। ছোট্ট কথাটা আসলে তার ক্ষেত্রে দুইভাবে ব্যবহার করা যায়, বয়সে এবং পদবীতে।
'কলেজস্ট্রিটে ৭০ বছর' বইটা ঠিক আত্মজীবনীও না আবার কিছুটা আত্মজীবনী ধাঁচেরও। ছোট্ট সবিতের পরিবারে চলছে নানান টানাপোড়ন। যেখানে জীবন ধারনই কষ্টকর সেখানে পড়াশোনা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু না। দিনে চাকরি আর রাতে কলেজ এই দুই করে চালিয়ে গেছেন সংগ্রাম। ও হ্যা! একটা কথা বলাই হয়নি.. তিনি আবার গজেন্দ্রকুমার মিত্রের স্ত্রীর ছাত্র ছিলেন। সেই সুবাদে মিত্র & ঘোষে জুটে যায় চাকুরি। চোখের সামনে দেখেছেন বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের। শুনেছেন তাদের বাগবিতণ্ডা, গল্প, আড্ডা। সাক্ষী হয়েছেন এক মহাকালের। বলা চলে প্রথম খন্ডটা এক কিশোরের দৃষ্টিতে দেখা। এ বইয়েও রয়েছে নানান অজানা তথ্য। ওই যে! প্রথমেই বলেছিলাম কিন্তু! এটা শুধু আত্মজীবনী না, আত্মজীবনীর ঢঙে দুই মলাটে আবদ্ধ ঝলমলে রঙিন একটা শতকের খন্ডিতাংশ। যে সময়টা জুড়ে রয়েছেন গজেন্দ্রকুমার মিত্র, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবিশেখর কালীদাস রায়, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল, বিমল কর, বিমল দে, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণদয়াল বসু, সজনীকান্ত রায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতির মতো নামীদামী সাহিত্যিকেরা।
চিন্তা করে দেখেন, ক্লাস টেনে পড়ুয়া কিশোর, যার পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর আংশিক অংশ পড়ানো হয়। বাংলার প্রস্তুতি হিসেবে প্রশ্নের উত্তর লিখে খাতা দেখাতে যেয়ে আবিষ্কার করে স্বয়ং লেখক দাঁড়িয়ে আছে সামনে। ভাবা যায়? সে হিসেবে বলতে হয় সবিতেন্দ্রনাথ মহাশয়ের ভাগ্য বটে!
গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষ - এই দুই বাল্যবন্ধু মিলে গড়ে তোলেন পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স। ত্রিশের দশকের মাঝে যাত্রা শুরু করে এই প্রকাশনী। যেখানে দেশভাগের পরপরই সদ্য তারুণ্যের ছোঁয়া পাওয়া সবিতেন্দ্রনাথ রায় চাকরি নেন। কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটে সাত দশকের বেশি সময় কাটিয়েছেন সবিতেন্দ্রনাথ রায়। লেখকদের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে পাওয়া সাত দশকের স্মৃতির ঝাঁপির পহেলা খণ্ড এই বই।
আজকের কলেজ স্ট্রিটে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এখানে স্থানান্তরিত হয় প্রকাশনার অফিস। আর, এই অফিসেই ভিড় জমাতেন তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের মতো মহৎ লেখক। আসতেন সজনীকান্ত দাস, কবিশেখর কালিদাস রায় ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
গজেন্দ্রকুমার মিত্রের স্ত্রী পাড়ার দরিদ্র ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় পড়াতেন। অত্যন্ত আন্তরিক এই মানুষটির কাছেই সবিতেন্দ্রনাথ রায় পড়তেন। এসএসসি পাস করার পর সংসারের হাল ধরতেই দিনে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্সে চাকরি এবং রাতে পাঁচটা থেকে নয়টার রিপন কলেজে ভর্তি হন। প্রথমদিকে লেখককে কাজ তেমন করতো হতো না। বই বিক্রির হিসাব টুকে রাখতেন। নতুন কোনো বই প্রকাশিত হলে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে সেই বইয়ের প্রচার করতেন। আর, বিকেলে নামজাদা সাহিত্যিকদের আড্ডার কথাগুলো গোগ্রাসে গিলতেন।
আনন্দ পাবলিশার্সের নাম তখনো লোকে জানে না। বই প্রকাশ নিয়ে মিত্র ও ঘোষের সাথে বেঙ্গল পাবলিশার্স, ডি এম লাইব্রেরিসহ কিছু প্রকাশনীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো। তবে সেই দ্বৈরথ কখনো শালীনতার সীমা অতিক্রম করেনি।
এই বইয়ের প্রধান আকর্ষণ তিনটি। এক. তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের মতো কালজয়ী কথাসাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে 'ফার্স্ট হ্যান্ড' অভিজ্ঞতা জানতে পারা দুই. আজকের কলেজ স্ট্রিটে আদিতে কেমন ছিল সেই নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় এবং তিন. সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের লেখায় মজলিশিভাব।
এই তিন কারণেই বইটা তরতরিয়ে পড়া যায়।
বইটি কী অসামান্য কোনো স্মৃতিকথা? না, তেমন নয়। 'কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর' সিরিজের প্রথম বই না পড়লেও পাঠক হিসেবে অসাধারণ কিছু মিস করবেন না। আমার প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল। তা-ও পড়তে ভালো লেগেছে। লেখকের গদ্য গতিময় ও পাঠক হিসেবে আমাকে ধরে রেখেছে। সবকিছু মিলে, ভালো পাঠ-অভিজ্ঞতা। সিরিজের বাকি বইগুলো নিশ্চয়ই পড়ব।
'কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর' বইয়ে সবিতেন্দ্রনাথ রায় 'মিত্র ও ঘোষ' প্রকাশনীতে অর্ধশতাব্দীর অধিক চাকরির অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। লেখক ম্যাট্রিক পাশ করার পর মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীতে কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখানে থেকেই পড়ালেখা সমাপ্ত করেন। এখনও তিনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য হয়ে প্রকাশনা পরিচালনা করছেন।
সৌভাগ্যজনকভাবে লেখকের সাথে আমার অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। লেখকের মতো আমিও বাংলাদেশের সবার প্রিয় প্রকাশনীতে পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরি(আনন্দ) করছি। আমারও বাতিঘরে আজীবন থাকার ইচ্ছা আছে।
তিন খণ্ডে লেখা 'কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর' প্রথম খণ্ড শেষ করেছি। দ্বিতীয় খণ্ড আজ থেকে পড়া শুরু করব। ইস্, আমার ভাগ্য এত ভালো কেন! খুশিতে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।
বাতিঘর নিয়ে কত প্ল্যান যে করতেছি সঞ্জিব দা'র সাথে। বাতিঘরের প্রবেশ দরজায় পরামর্শ বক্স রাখব কিছুদিনের মধ্যে। কত অদ্ভুত অভিজ্ঞতা যে হচ্ছে। আগামী বছর থেকে বাতিঘরের ম্যা.... বের করা হবে। আর কত কিছু। থাক এখানে কিছু না বলি।
সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের স্মৃতিচারণে চমৎকার ফুটে উঠেছে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের কলেজ স্ট্রিট। কলেজ স্ট্রিটের স্মৃতিচারণার এই প্রথম পর্ব মূলত মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীর উত্থান এবং তাকে কেন্দ্র করে লেখকদের আড্ডার গল্প। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্করের ব্যক্তিজীবন, মিত্র ও ঘোষের দুজন প্রকাশক সুলেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষের বন্ধুত্বের কথা, সেকালের সাহিত্যপাড়ার সার্বিক পরিস্থিতির বর্ণণা তো আছেই। তার পাশাপাশি পুরো বই জুড়ে আবির্ভাব ঘটেছে একের পর এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের: প্রবোধকুমার স্যানাল, সজনীকান্ত দাস, বনফুল, জসীম উদদীন, শৈলজাদনন্দ, কবিশেখর কালিদাস, মনোজ বসু, বন্দে আলী মিয়া, সুনীতিকুমার প্রমুখের।
ছোট্ট পরিসরে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের জীবনী আরেকটি উল্লেখযোগ্য ��ংযোজন।
বই পড়তে পড়তে কিছু প্রিয় প্রকাশনা সংস্থা দাঁড়িয়ে যায়। আর এটা স্বাভাবিকই। বাংলাদেশে যেমন প্রথমা, ইউপিএল, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, বেঙ্গল এর বই ভালো লাগে তেমনি কলকাতার আনন্দ, নিউ এজ, মিত্র ও ঘোষ, দে'জ পছন্দের। বাদল বসুর পিওন থেকে প্রকাশক পড়ে প্রভূত আনন্দ পেয়েছিলাম। লেখকদের কাছ থেকে দেখা এবং তাঁদের রঙ্গরস এবং আড্ডার এক সরেস বিবরণী বাদলবাবু পেশ করেছিলেন। তাই ভাবলাম মিত্র ও ঘোষের আগাগোড়াটা জেনে নেই, যেহেতু সবিতেন্দ্রনাথ ৩ পর্ব জুড়ে এবং উত্তর পর্ব সহ ভালোরকমই সব বর্ণনা করে গেছেন৷ মিত্র ও ঘোষের মিত্র যে গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং সুমথনাথ ঘোষ, দুজনেই খ্যাতিমান সাহিত্যিক তা সকলেই কমবেশি জানেন। কিন্তু প্রকাশনা সংস্থা চালানোর ক্ষেত্রে নানান লেখকদের সাথে যেসব আলোচনা, আড্ডা হয় সেইসব বিষয়বস্তুই এই বইটির প্রাণ। আর আড়াল থেকে অভাবে বেড়ে উঠে এস এস সি শেষ করে কলেজে পড়তে পড়তে পার্টটাইম কাজ করা ভানু ওরফে সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের কলমে সেগুলো আরো বেশি জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে পাঠকের কাছে৷ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই বেশি অংশ জুড়ে ছিলেন। তাঁকে সবাই ডাকতেন বড়দা বলে। অমায়িক এই সাহিত্যিকের দারুণ সব সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি ছিল একটি খাঁটি মন। যে কারণে সকলেই তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং ভালোবাসতেন৷ অপর সমসাময়িক প্রবাদপ্রতিম ঔপন্যাসিক তারাশঙ্করের সাথে তাঁর ছিল অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। রেষারেষির বালাই ছিল না। একবার পুরীতে গিয়ে বিভূতিভূষণের মালপো খেতে ইচ্ছে হল৷ আর সেটা হাজির। এরপর ইচ্ছে হল ল্যাংড়া আম আর পায়েস খেতে। যে বাড়িতে উঠেছেন, সেই বাড়ির গিন্নী হঠাৎ করে তাও নিয়ে হাজির। বিভূতিভূষণের পরলোকে বিশ্বাস ছিল৷ এই ঘটনাগুলোকেও তিনি জগন্নাথের ইচ্ছায় প্রাপ্তি ভেবে বসেছিলেন! সজনীকান্ত দাস, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, বাণী রায় প্রভৃতি লেখকদের কাছে লেখা আনতে গিয়ে পরিচয় হতো সবিতেন্দ্রনাথ এর। আড্ডায় আসতেন অনেক সাহিত্যিক। অনেক প্রকাশকের সাথেও আলাপ হয়েছে। অনেক কিছুই অমূল্য স্মৃতি হয়ে ধরা আছে বইটিতে৷ বন্দে আলী মিয়ার সাথে পরিচয় আর তাঁর বাঙালিয়ানার গল্পটি সুন্দর, হৃদয়ছোঁয়া৷ পরিশিষ্টতে বিভূতিভূষণের সংক্ষিপ্ত জীবনীটি যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। এছাড়াও গজেন্দ্রকুমার মিত্রের একটি স্বাদু প্রবন্ধ ও যোগ করে দেয়া হয়েছে। তবে চলচ্চিত্র এবং উপন্যাস (পথের পাঁচালী) এর তুলনা করে সত্যজিৎকে একটু দোষারোপের সুরটা ভালো লাগে নি। আত্মজীবনী ছাড়াও সাহিত্যিককে চেনার একটা ভালো উপায় এই স্মৃতিকথা, যা অন্যের চোখে সেই মানুষটি কেমন ছিলেন তা দেখিয়ে দেয়। এই বইটি সেই কাজটা সার্থকভাবে করেছে।
লেখনী বিবেচনা করলে ৩ দিতাম, কিন্তু বিভূতিভূষণ বা তারাশঙ্করের মত কিংবদন্তিতুল্য লেখকদের অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণগুলোর জন্য ৪ দিতে হলো। এই যেমন, বিভূতিবাবু আর গ্রাম্পি বুড়ো নীরদ সি চৌধুরী যে কলেজের সহপাঠী ও পরে দু'বছর মেসমেট ছিলেন, এমন কিছু কথা জানার জন্যই ২-১টা তারা বেশি দেয়া যায়।
খুব জটিল ভাষা বা জটিল লেখা আমি পড়তে পারি না। পাঠক হিসেবে এই ব্যাপারে আমি অক্ষম। আর এই বইটির প্রথম গুন হলো তার সরলতা। তার ভাষা যেমন সরল তেমনি সরল তার ভাব। এতে আছে শুধুই সরল মনের স্মৃতিচারণা। তার বাইরে আর কিচ্ছু নেই।
লেখক পরবর্তী কালে মিত্র ও ঘোষ পাব্লিশারের কর্ণধার হলেও যে সময়ের গল্প উনি এখানে বলেছেন তা অনেক আগেকার, তখন তিনি নেহাতই কর্মচারী। এগুলি স্বাধীনতার আগে আর পরের ঘটনা। ১৯৩৪ এ মিত্র ও ঘোষের জন্ম থেকে ১৯৫০ অবধি। আর লেখকের নিজের কথায় "শ্যামাচরন দে স্ট্রীট তখনও ঘিঞ্জি হয়ে ওঠেনি"।
এই বইতে পাঠক কোনও চটুল খবর পাবেন না,পাবেন না কোনও লেখকের ব্যাপারে মুচমুচে খোরাক। কারন বইটি ওভাবে লেখা হয়নি। লেখা হয়েছে একটি সদ্য স্কূল পাশ করা কলেজে ভর্তি হওয়া বালকের চোখ দিয়ে,যে কর্মজীবনের প্রথম দিন থেকেই দেখতে লাগল সাহিত্যের আকাশের ঝলমলে তারা নক্ষত্ররা কেমন সুন্দর করে ভীড় জমাতেন "হাউস অফ কমন্স-এ" আর তারপরে শুরু হত নির্ভেজাল আড্ডা। মুড়ি বাদাম আর তেলেভাজা সমেত।
এই বইটি পড়া, অনেকটা নিজের দাদামশাই-এর কাছে তার কর্মজীবনের শুরুর গল্প শোনার মতন। এরম গল্প হয়ত প্রায়শই উনি বলেন, কিন্ত প্রত্যেকবার যেন শুনতে আরও ভালো লাগে।
বইটির প্রচ্ছদ আরেকটু ভালো হতে পারত। যেটি বর্তমান প্রচ্ছদ তার থেকে ভালো হত যদি মলাটের ঠিক ভেতরের হাতে আঁকা ছবিটি ব্যাবহার করা হত।
কিছু ঘটনাক্রম ভাল, তবে লেখনীর কারণে পড়ে যথেষ্ট আরাম পাইনি। কেমন একটা দায়সারা ভাবে গড়গড় করে বলে যাওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, সবই সত্য ঘটনা, ঠিকভাবে গুছিয়ে লিখতে পারলে হয়তো এগুলোই আরো সরেস লাগতো। এবং কিছু জিনিস বাদ দিলেও ক্ষতি ছিল না।
যাই হোক। কেবল তথ্যের জন্য যারা পড়তে চাইছেন, পড়তে পারেন।
'কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর ' বইয়ের তিন পর্ব ছাড়াও পরে 'কলেজ স্ট্রীটে উত্তরপর্ব' নামে আরেকটা বই প্রকাশ হয়। সবগুলো বইয়ের আলাদা রিভিউ না দিয়ে এখানে একবারেই দিলাম। বইয়ের নাম দেখলেই বুঝা যাবে লেখক বই প্রকাশনার সাথে সত্তর বছর ধরে জড়িত। এই সত্তর বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনা অঘটনার যেমন দেখেছেন, তেমনি অনেক সাহিত্যককেও কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। বই পাড়ার সেই সব স্মৃতি নিয়েই এই বই। বইয়ের যেসব লেখকের কথা উঠেছে তাদের বেশিরভাগই একটু আগের, ৪০-৫০ দশকের। আরও ভাল করে বললে মিত্র ও ঘোষ যাদের বই প্রকাশ করে, তাদের। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, অন্নদাশঙ্কর, মুজতবা আলি, গজেন্দ্র কুমার, অবধূত এইরকম আরও অনেকে । লেখকের নিজের জীবনেরও অনেক ঘটনাও আছে। আছে বই ছাপানোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেখানে হয়, লেখকের ভাষায় দপ্তরিবাড়ির কথা। বইগুলোর সবচেয়ে বিরক্তিকর জিনিস হচ্ছে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বইগুলি থেকে ২৫-৩০% পুনরাবৃত্তির জন্য অনায়াসেই বাদ দেওয়া যাবে। অপ্রয়োজনীয় ভাবে তিনখণ্ড করার কারনেই এই অবস্থা। অনেকসময় অন্য কারও সম্পর্কে লিখতে গিয়ে নিজের ভাষা���় না লিখে অন্য লেখকের থেকে সরাসরি অনুচ্ছেদ আকারে যুক্ত করেছেন। এতে মনে হয় বইয়ের গতি কিছুটা ধীর হয়ে যায়। যাদের বাংলা সাহিত্যের লেখক সম্পর্কে আগ্রহ আছে তারা নির্দ্বিধায় এই বইগুলি ধরতে পারেন। সত্তর বছরের সময়কে ধারাবাহিক ভাবে লেখার চেষ্টা করলেও সবসময় ধারাবাহিকতা রাখা যায় নি। সবগুলি বই পড়া শেষ হলেই তখন খণ্ড খণ্ড ছবিগুলো একত্রিত হয়ে সম্পূর্ণ ছবি হবে।
১৯৩৪ সালে মিত্র এন্ড ঘোষ প্রকাশনীর সৃষ্টি, প্রায় শতবছর ধরে এখনও যা টিকে আছে। সাহিত্যিক গজেন্দ্র কুমার মিত্র ও তার বন্ধু আরেক সাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ মিলে এই প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন। প্রথমদিকে স্থায়ী কোন দোকান ছিলো না, ট্রাঙ্কে করে এরা দুজনে বিভিন্ন শহরে ঘুরে প্রবাসী বাঙালিদের কাছে বই বিক্রি করেছেন, মাঝে মাঝে অন্য প্রকাশনীর টেক্সটবুক নিয়ে গ্রামের স্কুলগুলোতে বিক্রি করে পয়সা জমিয়ে সেই পয়সা প্রকাশনীতে বিনিয়োগ করেছেন। এভাবেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে মিত্র এন্ড ঘোষ। সবিতেন্দ্রনাথ রায়, মিত্র এন্ড ঘোষের চাকরীতে যোগদেন ১৯৪৯ সালে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, পড়াশোনা চালিয়ে যাবার পাশাপাশি কাজে যোগ দিয়েছিলেন। সে সময় মিত্র এন্ড ঘোষে আড্ডা দিতে আসতেন সুনীতিকুমার, বিভূতি ভূষণ, তারাশঙ্কর, প্রবোধ কুমার, প্রমোদ কুমার, সজনীকান্ত এমন সব সাহিত্যিক । সবিতেন্দ্রনাথ ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত সময়ের কথা লিখলেও তার দেখা অর্থাৎ ১৯৪৯-৫০ সালের ঘটনাগুলোই এই পর্বে বেশি আছে। আছে তার নিজের ছোটবেলার কথাও, পরিশিষ্টে বিভূতি ভূষণ কে নিয়ে, পথের পাঁচাালী নিয়ে, আড্ডা কালচার নিয়ে আরও কয়েকটি ছোট রচনাও।