‘কদর্য এশীয়’ আদ্যোপান্ত একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। তিনি বলেছেন যে এ গল্প কল্পিত যে-কোনো এশীয় দেশের। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, সে দেশের নাম বাংলাদেশ-যার জন্মই হয়েছে ঔপন্যাসিকের মৃত্যুর পরে। আরো লক্ষণীয়, দেশের রাজনীতিই কাহিনীর মুখ্য প্রতিপাদ্য নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তৃতীয় বিশ্বের সম্পর্কের বিন্যাস ও অভ্যন্তরীণ উৎকণ্ঠা উন্মোচন এর মূল লক্ষ্য। স্রষ্টা হিসাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মহিমা এভাবে অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। এ এক অচেনা শিল্পী, এতদিন যাঁকে আমরা জানার সুযোগ পাইনি।
Syed Waliullah was born on 15 August 1922 at Sholashahar in Chittagong. After completing his Bachelor’s from Ananda Mohan College in Mymensingh, he enrolled at Calcutta University but did not complete his Master’s. Proficient in both Bangla and English, he worked for the Statesman during 1945-1947. After the Partition, he moved to Dhaka and joined Radio Pakistan as assistant news editor. In 1950 he was posted to Radio Pakistan, Karachi. From 1951 to 1960 he served as press attache at Pakistan missions in New Delhi, Sydney, Jakarta and London. It was in Sydney that Waliullah met Anne-Marie Thibaud, whom he later married and who translated Lal Shalu into French. In 1960 Waliullah moved to Paris where he served as first secretary at the Pakistan Embassy till 1967 when he joined UNESCO. Syed Waliullah did not live to see the liberation of his motherland, passing away in Paris on 10 October 1971.
Syed Waliullah (Bengali: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ) is often considered the pioneer of existential analysis of the characters psyche and root cause analysis of social-psychic conflicts in the literature of Bangladesh. The last two of his three novels, specially Kando Nadi Kando, show his mastery in revealing the inner depths of his characters. Contemporary writer Shahidul Jahir was influenced by him.
Novels: লালসালু(Tree without roots), ১৯৪৮ চাঁদের অমাবস্যা (Dark moon), ১৯৬৪ কাঁদো নদী কাঁদো (Cry, o river), ১৯৬৮ The Ugly Asian, 1959
Play: বহিপীর (১৯৬০) তরঙ্গভঙ্গ (The Breakers), ১৯৬৫ সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) উজানে মৃত্যু
Short story collection: নয়নচারা (১৯৫১) দুই তীর ও অনান্য গল্প (Akte Tulse Gaser Khine), ১৯৬৫
‘শিম কিভাবে রান্না করতে হয়’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ'র ইংরেজী ভাষায় লিখিত স্যাটায়ার ‘How does one cook beans' এর বাংলা অনুবাদ। রচনাটির একটি subtitle বা উপশিরোনাম আছে, 'এক এশীয়র ফ্রান্স অভিযান'। দীর্ঘদিন অপ্রকাশিত থাকা লেখাটির প্রচার প্রচারণা নিতান্ত কম বলে লেখকের দেয়া মূল ইংরেজী উপশিরোনামটি পেলামনা; তাই অনুবাদকের শব্দচয়নের রুচির ওপরই এ বেলা ভরসা করতে হচ্ছে। আমাদের এশীয়দের চোখে ইয়োরোপীয়দের অনেক আচরণই অদ্ভুত, বেমানান এমনকি পাগলাটে মনে হয়। যে সুবিশাল ভৌগোলিক দূরত্ব এই দু অঞ্চলের মাঝে হাত পা মেলে শুয়ে আছে, তাতে করে সমাজ সংস্কৃতির এ পার্থ্যকটা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ইয়োরোপীয়দের দৈনন্দিন নানা আচার ব্যবহার এক ফ্রান্স বেড়াতে যাওয়া এশীয় যুবকের চোখে কেমন ঠেকে তা-ই মূলত ‘শিম কিভাবে রান্না করতে হয়’ ব্যঙ্গাত্নক রচনাটির উপজীব্য। ওয়ালীউল্লাহ্ এই লেখাটি আবু শরিয়া ছদ্মনামে লেখেন। শিবব্রত বর্মনের অনুবাদে লেখাটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন।
সাধারণত স্যাটায়ার বা কমেডী ঘরানার রচনা দু ধরনের ভঙ্গিতে লেখা হয়। এক, লেখক তাঁর রচনায় হাস্যকর সব ঘটনার অবতারণা ঘটান (এখানে ‘হাস্যকর’ শব্দটি স্রেফ হাসির উদ্রেককারী মজার ঘটনা অর্থে ব্যবহার করছি। ‘হাস্যকর’ শব্দটির যে ঋণাত্নক প্রয়োগটি আছে, সেটিকে সচেতনভাবেই বেমালুম অস্বীকার করে যাচ্ছি! দুরাশা করি, আমার শব্দঝুলির নিতান্ত গরীবী দশা এ লেখা যিনি অনুগ্রহ করে পড়ছেন তিনি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন)। এ জাতীয় স্যাটায়ারে ভাষার বাহুল্য বেশী একটা প্রাধান্য পায় না, পায় ঘটনার অতিঘটন। ভলতেয়ার, জর্জ অরওয়েল, আবুল মনসুর আহমেদ, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এ ধারাতেই ব্যঙ্গাত্নক রচনা লিখে গেছেন। স্যাটায়ার লেখবার দ্বিতীয় যে আরেকটি ভঙ্গি আছে, তাতে কাহিনী কম, ভাষার মাধুর্য বেশী। প্রতিটি ভাষারই নির্দিষ্ট কিছু মারপ্যাঁচ আছে। যথার্থ সময়ে সে সব মারপ্যাঁচের মোক্ষম প্রয়োগে কত চমৎকার হাস্যরস যে তৈরী হতে পারে সে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নিয়মিতই অনুভব করি। দ্বিতীয় ধারার স্যাটায়ারিস্টরা তাঁদের নিজ নিজ ভাষার এই মারপ্যাঁচকে অবলম্বন করেই স্যাটায়ার লেখেন। উইলিয়াম সমারসেট মম, পি. জি ওডহাউস, জেরোম কে জেরোম এঁদের লেখা হল এই ধারার। কেউ যদি হাতে আতশ কাঁচ নিয়ে জেরোম কে জেরোম বা ওডহাউসের লেখায় অনুসন্ধান করতে বসেন, দেখবেন, তাতে গল্পের পরিমাণ আসলে ন্যূনতম। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পাঠক যা পড়েন তা স্রেফ ভাষার কেরদানি। প্রথম ঘরানার স্যাটায়ার লিখতে একজন লেখককে ভয়ানক তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি সম্পন্ন হতে হয়। চারপাশের সমাজের দৈনন্দিন চিত্র, অবস্থাভেদে মানুষের আচরণের ভিন্নতা ইত্যাদি বিষয় প্রথম ঘরানার স্যাটায়ারিস্টদের নখদর্পণে। আর দ্বিতীয় ঘরানাটির লেখা লিখতে চাই ভাষার ওপর দারুণ দখল। ইংরেজী ভাষাটির চমৎকার একটি কূটনৈতিক দিক আছে, যার প্রয়োগ সরলরেখার মত সোজা একটি কথাকে মূলভাব অক্ষুণ্ণ রেখে জিলাপীর মতো ভীষণ প্যাঁচালো এক রূপ দিতে পারে। ইংরেজী ভাষার অদ্ভুত সুন্দর এই গুণটির কারণে ভাষাটি দ্বিতীয় ঘরানার স্যাটায়ার লেখার জন্য দারুণ উপযোগী। বাংলা ভাষায় ওডহাউস, মম কিংবা জেরোমের মতো ভাষার কেরদানি দেখিয়ে ব্যঙ্গ রচনা বেশী একটা হয়নি। গোটা বাংলাভাষাতেই স্যাটায়ার একটি দুর্লভ বস্তু। বঙ্কিমচন্দ্র, ত্রৈলোক্যনাথ, বনফুল, আবুল মনসুর আহমদ, আহমদ ছফা এই ক’টি নাম ছাড়া আর বিশেষ কাউকে কী মনে পড়ে?
‘শিম কিভাবে রান্না করতে হয়’ শিরোনামের অনুবাদটি পড়ে মনে হলো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মূল ইংরেজী রচনাটিতে সেই চিরাচরিত ‘ব্রিটিশ হিউমার’ বা ভাষার মারপ্যাঁচের প্রয়োগ-ই ঘটিয়েছিলেন। বাংলা অনুবাদকের হাতে পড়ে রচনাটি বড্ড রসকষহীন হয়ে পড়লো। ‘ব্রিটিশ হিউমার’ ধরণের লেখার মূল ভিত্তিটাই যখন ভাষার অলিগলির প্যাঁচালো পথে সুকৌশলে স্কি করা, অনুবাদ কর্মে সচেতন না হলে অনুবাদটি সেই গলিতে পথ হারাবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যাকরণগত দিক থেকে শুরু করে প্রায়োগিক অনেক ব্যাপারে বাংলা ভাষা ইংরেজীর প্রতিবিম্ব, তবু দু’টি ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি সত্ত্বা, ভাষা দু’টির সৌন্দর্যও সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক ভাষার গালি আরেক ভাষার বুলি। ইংরেজী 'hug' আর বাংলা 'হাগ' কী আর এক?
ব্রিটিশ শাসনামলের ভারতে যখন বিধবা বিবাহ প্রচলনের আন্দোলন শুরু হলো, গোঁড়া হিন্দু অনেক পুরোহিত তখন গাঁইগুঁই করা শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা বিধবা বিবাহে রাজী হলেন কিন্তু শর্ত আরোপ করলেন বিধবাকে কুমারী হতে হবে। বিধবা নারীর কুমারিত্ব অটুট আছে কিনা জানার উপায় কি? পুরোহিতেরা বুদ্ধি বাতলে দিলেন, কুমারিত্ব ইন্সপেক্টর নিয়োগ দেয়া হোক। প্রতিটি প্রকাশনা সংস্থারও এমন একজন ইন্সপেক্টর থাকা সম্ভবত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে যিনি নির্ধারণ করবেন কি ছাপা হবে আর কি ছাপা হবেনা। ‘প্রথমা’র এমন একজন ইন্সপেক্টর আছেন কিনা জানিনা, তবে এই বইটি ছাপাবার সিদ্ধান্ত তো সংস্থাটির ওপর মহলের কাউকেই নিতে হয়েছে। এই ব্যক্তিটি যথেষ্ট রুচিবান হলে সম্ভবত এই অনুবাদটি ছাপতে দিতেননা; সম্ভবত অনুবাদটিই করতে দিতেননা। সবকিছুর অনুবাদ হতে হবে এমন কোন কথা নেই। সব কাব্যের, সব গল্পের অনুবাদ হয়না। ‘শিম কিভাবে রান্না করতে হয়’ লেখাটির ভঙ্গিমা বলে এটি মূল ভাষা ইংরেজীতে থাকলেই ভালো হতো। জড়ভরত বাংলা অনুবাদটি পাঠককে ওয়ালীউল্লাহ’র ক্ষমতা সম্পর্কে ভীষণ ভুল ধারণাই দেবে।
ওয়ালীউল্লাহ’র এই রচনাটি ইংরেজীতে লিখবার পেছনে একটি উদ্দেশ্য ছিলো, যা সৈয়দ আবুল মকসুদ বইটির ভূমিকাতে ব্যখ্যা করেছেন। আবুল মকসুদ বলেছেন “ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা অহংকারী। তারা গর্বিত তাদের সভ্যতা, সম্পদ ও সংস্কৃতি নিয়ে। তারা হেয় জ্ঞান করে এশীয়দের। যে এশীয়দের তারা শোষণ ও লুন্ঠন করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। তিনি (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ) চেয়েছিলেন এশিয়াবাসীর আবেগ ও বঞ্চনার কথা পশ্চিমি পাঠকদের কাছে স্যাটায়ারের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে”। ভাষার দূরত্বের কারণে উদ্দেশ্য থেকে ভীষণ বিক্ষিপ্ত অনুবাদটি হাস্যকর রকম চওড়া মূল্যে খরিদ করবার পর একজন এশীয় আমার সাথে আরেকজন এশীয় প্রকাশক বঞ্চনা করলেন, এমন বোধই হচ্ছে! প্রথমা চাইলেই মূল ইংরেজীতে বইটি ছাপতে পারতো, তাতে পাঠক (পড়ুন ক্রেতা! ) দু চার দশজন হয়তো কম হতো, কিন্তু লেখার মান ও উদ্দেশ্য অটুট থাকতো। বর্তমান বাংলা অনুবাদটি পড়ে কেউ লেখকের ব্যঙ্গের লক্ষ্য ধরে ফেলতে পারবেন, এটি আমার কাছে নেহাৎ ই একটি কষ্টকল্পনা।
পুনশ্চঃ প্রকাশক সংস্থার ইন্সপেক্টর নিয়োগের প্রস্তাবে অনেকের ভুরু হয়তো কুঁচকাতে পারে। হয়তো প্রশ্ন তুলবেন অনেকেই, সাহিত্য একটি নৈর্ব্যক্তিক বিষয়, এটি যাঁর যাঁর রুচির ওপর নির্ভরশীল। ছাপাখানায় কি যাবে আর কি যাবেনা, এই প্রশ্নের মীমাংসাকারী ইন্সপেক্টর এর যোগ্যতা কি হওয়া উচিৎ? সবিনয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করি, বিধবা নারীর কুমারিত্ব যাচাইকারী ইন্সপেক্টর হতে হলে যে যোগ্যতার প্রয়োজন ছিলো, প্রকাশনা ইন্সপেক্টর এর যোগ্যতাও তা-ই!
This brilliantly crafted political allegorys landscape is an imaginary Asian country. Orwell's famous political fictions doesn't seem to fit our homeland properly. But our first-man, Syed Waliullah, surpassed Orwell to some extent here.
নামটা পড়ে চমকে উঠেছিলুম। যাব্বাবা! লেখক কি শেষ জীবনে সামাজিক উপন্যাস ছেড়ে রন্ধনপ্রণালীর উপর বই লেখা শুরু করেছিলেন নাকি? তারপর চোখে পড়লো নামের নীচে একটা সাবটাইটেল আছে 'এক এশীয়র ফ্রান্স অভিযান'। এইটুক দেখার পর মনে হলো তাহলে নিশ্চয়ই এইটা লেখকের ভ্রমণকাহিনী হবে। ফ্রান্সে দীর্ঘদিন ছিলেন, ভ্রমণকাহিনী লেখা তো তাঁর মৌলিক অধিকার। আর ভ্রমণের স্থানটা যখন বিশ্বের রসনার রাজধানী ফ্রান্স তখন তো নাম রসনা সংক্রান্তই হতে হয়। খুব ভালো, খুব ভালো; লেখকের সৃজনশীলতার প্রশংসা করতেই হয়!
যাহোক, এইসব ভাবতে ভাবতে বইটা খুলে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর আগের সব ধারণা ভেঙে গেল। নাহ, এই বই লেখকের ভ্রমণকাহিনী নয়, রান্নার বই তো নয়ই। তাহলে কী নিয়ে কাহিনী? এক কথায় বললে এইটা একটা স্যাটায়ার। ঔপনিবেশিক চিন্তাধারা থেকে ইউরোপিয়দের নাক উঁচু স্বভাব আর এশীয়দের নিজেদেরকে হীন ভাবার স্বভাবকে লেখক ব্যঙ্গ করতে চেয়েছেন। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে পুরা বই পড়ে এরচেয়ে বেশী কিছু বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। মূল ইংরেজি লেখায় হয়ত লেখক রসসমৃদ্ধ করেই লিখেছিলেন কিন্তু অনুবাদে রস ঝরে পড়ে রীতিমতো 'বেরস' একটা রচনায় পরিণত হয়েছে। পড়ে আরও একবার উপলব্ধি করলাম কিছু লেখা আসলেই অনুবাদের জন্য না।
কী বলা যায় একে? বাংলাদেশের "১৯৮৪"? আসলে এই বই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার পুরোটাই ধারণ করে। কখনো ১৯৭৫, আবার কখনো ১৯৯৬, আবার ২০২২। ওয়ালীউল্লাহ সবসময়ই মানুষের ভেতরের বিশ্লেষণের দিকে মনোযোগী ছিলেন। এখানেও ব্যতিক্রম না, বরং এশীয় তথা বঙ্গীয় অঞ্চলের মানুষের আদর্শ, দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন, আশা-হতাশাকে সামগ্রিকভাবেই তুলে ধরেছেন। অনুবাদকের প্রশংসা না করেও পারি না। শিবব্রত বর্মন ইজ অলওয়েজ গ্রেট। কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে বাংলায় ওয়ালীউল্লাহ এভাবেই লিখতেন শব্দ, বাক্য ইত্যাদি। জানি না কেন এই বই বাঙালী তেমন পড়ছে না, বা পড়লেও সাড়া দিচ্ছে না। তবে অচিরেই এর বুঝদার পাঠক পাওয়া যাবে সেই আশা রাখি।