ইমতিয়ার শামীমের জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। আজকের কাগজে সাংবাদিকতার মাধ্যমে কর্মজীবনের শুরু নব্বই দশকের গোড়াতে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ডানাকাটা হিমের ভেতর’ (১৯৯৬)-এর পান্ডুলিপি পড়ে আহমদ ছফা দৈনিক বাংলাবাজারে তাঁর নিয়মিত কলামে লিখেছিলেন, ‘একদম আলাদা, নতুন। আমাদের মতো বুড়োহাবড়া লেখকদের মধ্যে যা কস্মিনকালেও ছিল না।’
ইমতিয়ার শামীম ‘শীতের জ্যোৎস্নাজ্বলা বৃষ্টিরাতে’ গল্পগ্রন্থের জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার (২০১৪), সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ দেশের প্রায় সকল প্রধান সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন।
এই বইয়ের রিভিউ লিখা সম্ভব না। বইটা পড়ে মাথা ফাঁকা হয়ে গেসে। এ কোন বাংলাদেশের কথা লিখা? এমন ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে আমি কখনোই কিছু পড়ি নাই। ওই সময় নিয়ে অনেক অনেক কম জানি। ইদানীং যা একটু পড়ছি সবই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এই বইটা পড়ে ভয়াবহ ভয় পেয়েছি। জায়গায় জায়গায় স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। মনে হয়েছে আর পড়তে পারব না। আবার পড়েছি। লেখনী অনেক সুন্দর। তন্ময় হয়ে পড়েছি।
এখন আমার একটা প্রশ্ন আছে। বইটা অনেকদিন ধরেই অনেক জায়গায় খুজছিলাম। শেষ পর্যন্ত আজিজে জনান্তিক প্রকাশনীর দোকানে পেলাম। গিয়ে দেখি ৪-৫ টা কপি আছে আর। সব গুলোই ময়লা। জিজ্ঞেস করেছিলাম রিপ্রিন্ট হয়নি নাকি। দোকানদার বললেন, না। এই বইয়ের যদি রিপ্রিন্ট না হয় অনেক ভালো একটা বই হারিয়ে যাবে। এই বইটার পিডিএফ ও নাই। এত ভালো একটা বই তো বহুবার প্রিন্ট হওয়ার কথা। সেই ৪-৫ টা কপি শেষ হয়ে যাওয়ার পর মানুষজন বইটা কিভাবে পড়বে?
বিঃদ্রঃ সুহান ভাই, মারুফ ভাইকে বিশেষ ধন্যবাদ বইটা পড়ে রিভিউ দেয়ার জন্য।
জীবনানন্দ মৃত্যুর আগে আর কিছু বুঝতে চাননি। কারণ সব রাঙা কামনার শিয়রে ধূসর মৃত্যুর মুখ জেগে থাকে। নির্জন খড়ের মাঠে পৌষের সন্ধ্যায় হেঁটে, সুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসতে দেখে, ধানের গুচ্ছের মত সবুজ সহজ ভোরের সৌন্দর্য অবলোকন করে, অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটাকে ভালোবেসে, খড়ের চালের ওপর মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার শুনে, জীবনের নিভৃত কুহক প্রাণভরে উপভোগ করেছেন কবি।আর কিছু প্রার্থনা করে লাভ নেই, আর কিছু চাওয়ার নেই, নিজের নিয়তি তাই নির্বিবাদে মেনে নিয়েছেন কবি।
ইমতিয়ার শামীমের "আমরা হেঁটেছি যারা"র তথাগতও সব বরণ করে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সহিংসতা, রক্ষীবাহিনী, রাতবাহিনী, জলপাই বাহিনী, মানুষের নির্বিচার মৃত্যু,দুর্ভিক্ষ, বই পোড়ানো, বাবার অন্তর্ধান, সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন, প্রগতিশীলতা আর মানবমুক্তির স্বপ্ন নিয়ে শুরু হওয়া রাষ্ট্রের মধ্যযুগের দিকে উলটোরথে যাত্রা সবকিছু তথাগত মেনে নিয়েছে। মেনে না নিয়ে উপায় ছিলো কী? জীবনানন্দ প্রশ্ন করেছিলেন, "আমরা মৃত্যুর আগে কী বুঝিতে চাই আর?" তথাগত কি এই প্রশ্নটা নিজেকে করেছে? উত্তর পেয়েছে সে কোনো? উত্তর কি আছে? বিরুদ্ধ স্রোতে অসহায় একা ভেসে তথাগতও মৃত্যুর আগে হয়তো কিছু বুঝতে চায়নি। নরম নদীর নারী অন্ধকারে কুয়াশার ফুল ছড়ানোর দৃশ্য দেখার বদলে সে দেখেছে রক্ত, আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভরে যাওয়ার দৃশ্য দেখার বদলে সে দেখেছে গুম, খুন আর আগুনের তাণ্ডব। এ থেকে মুক্তি নেই, এ থেকে পালানোর পথ নেই- জীবনানন্দের সম্পূর্ণ বিপরীত পথে তথাগত মৃত্যুকে মেনে নিয়ে নির্বাণ লাভ করেছে (করতে বাধ্য হয়েছে!)
আমার "আমরা হেঁটেছি যারা"র গল্পটা কেমন হবে? যারা বুকে এক টুকরো আগুন নিয়ে বেঁচে আছে তাদের সবার? মৃত্যুর আগে চেতনা ব্যবসা, নির্বিচারে ভিন্ন মতাবলম্বীদের খুন, বিচারহীনতা, ধর্ম থেকে ধর্মান্ধতার দিকে যাত্রা, ভয়ের সংস্কৃতি, সেল্ফ সেন্সরশিপ - কী দেখা বাকি আছে আর? জীবনানন্দ মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন, প্রকারান্তরে জীবনকেও। আমরা বরণ করতে পারবো না মৃত্যুকে; জীবনকেও না।
কিছু বই আছে, যেগুলো পড়ার পরে মাথার ভেতর ক্রমাগত বুদবুদ ফাটে। এমন একধরনের চিন্তা বা বোধ তখন কাজ করে - যে পাঠক জেনে যান, বাদবাকি হার্ডকাভার কী পেপারব্যাকের চাইতে বুকশেলফে এই বিশেষ বইটিকে একটু আলাদা রাখা দরকার। তেমন বই নিয়ে কথা বলাটা মুশকিলের ব্যাপার। ইমতিয়ার শামীমের উপন্যাস ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ নিয়ে লিখতে বসে সেই দশাই হয়েছে।
বাংলাদেশের সাহিত্য চর্চার উঠানটিতে ইমতিয়ার শামীম বেশ পরিচিত লেখক। ‘আমাদের চিঠি যুগ কুউউ ঝিকঝিক’, ‘ডানাকাটা হিমের ভেতর’, ‘আত্নহত্যার স্বপক্ষে’, ‘গ্রামায়নের ইতিকথা’, ‘কখনও বৃষ্টিশেষে’র মতো তার বহু কাজকেই আমি অনুসরণ করেছি সজ্ঞানে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে স্বদেশ এবং স্বকালের মাটিকাটায় লিপ্ত থাকা পরিশ্রমী লেখকদের যা হয়, তার বইগুলোকে খুঁজে পেতে রীতিমতো ঘাম ফেলতে হয়। পরিচিত এক পড়ুয়াকে ইমতিয়ার শামীমের সমস্ত বই একত্রে উপহার দেবো বলে খুঁজছি দীর্ঘদিন, আমার মুঠোফোনে বইয়ের দোকানদার এখনো বার্তা দিলো না। এ পরিস্থিতি বিবেচনায়, এমন হওয়াটা বিচিত্র নয় যে আলোচ্য লেখকের ‘আমরা হেঁটেছি যারা’র মতো উপন্যাসও কোনো কোনো পাঠকের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। এই লেখাটির উদ্দেশ্য তাই বলতে গেলে ইমতিয়ার শামীমের সেই সঞ্চারপথটির দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ। তবে সর্বজ্ঞ সমালোচকের ভূমিকায় অভিনয় করাটা আমার জন্য একেবারেই অসম্ভব, তারচেয়ে আনাড়ি পাঠকের পার্টে নেমে সোজা বাংলায় দুয়েকটা কথা বলার চেষ্টা করা যায়।
‘আমরা হেঁটেছি যারা’ উপন্যাসটি আমার হাতে এসেছিলো এ বছরের গোড়ার দিকে, ফেব্রুয়ারির মেলায়। একলা এলোমেলো হাঁটতে গিয়ে বইটি চোখে পড়ে, এবং মনে আসে যে এই বই নিয়ে সম্বন্ধে বাছাবাছা ভালো কথা শুনিয়েছিলেন কোনো সুহৃদ। হাতে নিয়ে পাতা উল্টাই। জীর্ণশীর্ণ হয়ে আসা প্রচ্ছদ প্রায় দেড়যুগের পুরানো। দোকানদার আমার অনুরোধে একটি সুদৃশ্যতর কপি খুঁজতে গিয়ে ঘেমে যায়, কিন্তু অমন কিছু নেই যেহেতু- সে আর দেবে কোত্থেকে? অতএব আমি বাসায় ফিরি জনান্তিক প্রকাশনীর ওই আধমরা প্রকাশনাটি নিয়েই।
পড়তে বসি আরো কদিন পর। এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠা থেকেই আমার দশা হয় ‘রাটাটুলি’ অ্যানিমেশনে রেমির রান্নার স্বাদ প্রথমবারের মতো নেয়া সেই ফুড ক্রিটিক আন্তন ইগোর মতো। আমি সতর্ক হয়ে উঠি, শীর্ণ আকারের বইটি তখন থেকেই আমাকে ক্রমাগত দিয়ে যায় আঘাত। তথাগতের সাথে হাঁটতে হাটঁতে নির্জন পৌষ সন্ধ্যায় কুয়াশার ফুল না দেখে অথবা একটি জনপদের জীবনের নিভৃত কুহক না বুঝে পাঠকের তখন উপায় থাকে না।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তথাগত। কাহিনির শুরুতেই জানা যায়, শ্রেনীশত্রু খতম করা রাতবাহিনী চাঁদা দাবি করেছে তথাগতের মুক্তিযোদ্ধা পিতার কাছে। রাতবাহিনীর তখন প্রবল প্রতাপ, তাদের জন্য গ্রামে গ্রামে নিয়োজিত করা হয়েছে জামার হাতায় তর্জনী খচিত রক্ষকদলকে। কিন্তু এই রক্ষকদলও খরচাপাতি ছাড়া কাউকে নিরাপত্তা দিতে অক্ষম। প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা তথাগতের পিতা একটিই রাস্তা দ্যাখেন, তাকে যোগ দিতে হবে মশালবাহিনীতে। কিন্তু পিতা বাড়ি থেকে সরে পড়লেও তথাগতের পরিবারটি রাতবাহিনী বা রক্ষকদলের আক্রোশ থেকে রেহাই পায় না। গ্রন্থাগারের বই পুড়িয়ে রাতবাহিনী তাদের বিপ্লব আর হাঁসমুরগিবাছুর ধরে নিয়ে গিয়ে রক্ষকদল তাদের রক্ষাযজ্ঞ সম্পন্ন করতে থাকে। ফলে তথাগত, যে কিছুদিন আগেও উনিশশো একাত্তরের অব্যবহিত পরের সেই সময়টিতে মুক্তিযোদ্ধা পিতার হাত ধরে গ্রামের পথে হেঁটে বেড়িয়েছে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়ে মনীষার সাথে; সেই তথাগত, বাবার মুখে গল্প শুনে যে হয়ে পড়তো আর্কাদি গাইদারের তিমুর; সেই তথাগত, যার পিতা গ্রামের সকলের থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে জন্ম দিয়েছিলেন রবিনসন ক্রুশোর মতো এক একাকী বাড়ির-সে বড় মান���ষ হয়ে ওঠে ওই রাতবাহিনী আর রক্ষকদলসমৃদ্ধ একটি রাতের অভিজ্ঞতাতেই।
কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামকরণের দিকে একটু সতর্ক হয়ে আরেকবার লক্ষ ক���া যায়। তথাগত। ইমতিয়ার শামীম আমাদের মনে করাচ্ছেন এমন একজনকে, দীর্ঘপথ হেঁটে যার হয়ে গেছে নির্বাণ লাভ। অবশ্য বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ওই বিশেষ কালটি একজন সংবেদনশীল মানুষের কাছে অ্যাতোটাই জরা-ব্যাধি-মৃত্যু সংকুল, নির্বাণের ভান না ধরে তার আর উপায় কোথায়? রক্ষকদল প্রকাশ্যেই একে ধরছে- তাকে মারছে, কিন্তু মেজর ডালিম রেডিওতে ঘোষণা দিলো তো এরপর তাদের আর দেখা পাওয়া যায় না। ফলে তথাগত হওয়া ছাড়া দর্শকের আর উপায় নাই। আবার ওদিকে মশালবাহিনী থেকে ফিরে আসছে তথাগতের পিতা, শেখ মুজিবের ছবি এখনো তিনি টানিয়ে রাখেন দেয়ালে, কিন্তু তাকে পুনরায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে পরিপাটি জলপাইবাহিনী, চিরতরে। ততদিনে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে স্কুলের মৌলভি স্যার, সে জানিয়ে দিচ্ছে জাতীয় পোষাক আচকান আর মেয়েদের মাথা ঢাকা এখন থেকে বাধ্যতামূলক, এবং হ্যাঁ/না ভোটের যাঁতাকলে তাকে কিছুটা হলেও জায়গা ছাড়ছে খালকাটা পার্টির লোকেরা।
বাংলাদেশ আর জীবনানন্দের রুপসী বাংলায় প্রচুর তফাৎ বলেই পথ-ঘাট-মাঠের ভেতর এখানে আর আলো থাকে না। ইমতিয়ার শামীম তা জানেন বলেই আশ্চর্য এক বর্ণনায় তার উপন্যাসটি আমাদের কেবল অন্ধকারের দিকে হাঁটায়। তথাগত গ্রাম ছেড়ে যাবে শহরে। কিন্তু সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে জিতে ছাত্রেরা আয়োজন করবে ড্রাম ভর্তি বাংলা মদ আর ব্লু ফিল্মের, সেখানে চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া শুভ্রা মেয়েটিকে দিন বদলের ধাক্কায় গাইতে হবে চটুল কোনো গান। আর একের পর এক বাহিনীর গরমের চোটে তখন আর দাঁড়ানো যাবে না। জলপাই বাহিনী থাকবে, সাথে যোগ হবে রগকাটা বাহিনী। এই রগকাটা বাহিনী স্কুল কলেজে গিয়ে ধর্মপালনের সদুপদেশ দেবে, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলের সময় এরা কম্যুনিস্টের রগ কাটলে পুণ্য কতটা বেশি- সেই হিসাবও করবে। এসবের ফাঁক দিয়েই দেশে গণতন্ত্র আসবে। আর গণতন্ত্র এলেই যেহেতু সব ঠিক, কাজেই ধর্ষণের কোনো সেঞ্চুরি হবে না, কোন বুদ্ধিজীবী কবি বলবে না যে -এরা অন্য দল থেকে আসা ছেলেপিলে, এরা আমাদের কেউ নয়, এরা সহীহ পেঙ্গুইনবাহিনী নয়।
রাজনীতিমনস্কতার পাশে যে বিষয়টা বলবার মতো থাকে এই উপন্যাসে, সেটা হলো একই সাথে তথাগতের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে অবস্থান। বর্ণনার জোরে নির্দিষ্ট কোনো কালে তিনি নেই, একটি বাক্য শুরু করবার আগ পর্যন্ত ধারণা করা যায় না লেখক কোন সময়বিন্দুতে অবস্থান করছেন। তবে সমস্তটা পড়ে গেলে আবার এটাও বলা যাবে যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখক একটা ধারাবাহিক অবনমনই দেখিয়ে গেছেন।
সম্প্রতি পড়া আরো এক উপন্যাস ‘পেটালস অফ ব্লাডে’র কথা স্মরণ করা যায় এ প্রসঙ্গে। নগুগি ওয়া থিয়াংগোর এ উপন্যাসটিতে বেশ স্পষ্ট ভাবে উঠে এসেছে মাও মাও বিদ্রোহের পরের দশকটিতে কেনিয়ার বদলে যাবার হালচাল। কয়েকটি মানুষের শহরমুখী যাত্রা, যার মাধ্যমে উঠে আসছে একটি জনপদের ইতিহাস- থিয়াংগো গল্প বলেছেন এভাবেই। কিন্তু সেই ইলমর্গ গ্রামের মুনিরা, কারেগা বা আবদুল্লাহর আমাদের সামনে ব্যক্তি হিসেবে যতটা উপস্থিত, বাংলাদেশের তথাগত তেমনটা নয়। নগুগি ওয়া থিয়াংগো জনপদের ইতিহাস বাতলাতে গিয়ে আশ্রয় করেছেন ব্যক্তির সংশয় আর ব্যক্তির ক্ষয়, অন্যদিকে ইমতিয়ার শামীম তথাগতকে একেবারে দর্শকের মতোই হাঁটিয়ে নিয়েছেন ইতিহাসের পথে। ব্যক্তির যে সংশয়, সেটা এ উপন্যাসে জায়গায় জায়গায় উপস্থিত, তবে প্রতীকি। তথাগত যতটা একক, তার চাইতেও বেশি তাই সামষ্টিক। সৎ বোন মনীষায় তার প্রথম নারীসঙ্গ হলেও একসময় প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সপ্রতিভ সমন্বয়যুক্ত মারিয়াকে দেখা যায় তথাগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে।
সব মিলিয়ে এই উপন্যাস পড়তে গিয়ে এক ধরনের বিবমিষা হয়। মনে হয়, তথাগতের হেঁটে যাওয়া বা ইমতিয়ার শামীমের এই সঞ্চারপথ বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ অ্যাতোটা নগ্ন করে উপস্থাপন করে আমাদের সামনে – হোক বনসাই সংস্করণে- এমনটা পাইনি কখনো আগে। সৎ সাহিত্য, পাঠকের চোখের মাঝে বাইনোকুলার কী মাইক্রোস্কোপ ঠেসে দিতে পারে। তবে কলমের জোর থাকলে সাহিত্য পাঠ করেই পাঠক বুঝে নিতে পারেন প্লাস না মাইনাস পাওয়ারের চশমা তার দরকার। ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ এই প্রেক্ষিতে আমার মতো অজস্র কানা পাঠকের ভিড়ে একটা বলবার মতো কাজ। মনে পড়ে,সল বেলো একবার বলেছিলেন, আমরা যে কিছুতেই মন বসাতে পারি না, তার মাঝ থেকেও মনোযোগ কেড়ে নেয়াটাই হচ্ছে শিল্প। ইমতিয়ার শামীমের ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ পড়ার অভিজ্ঞতা এই উক্তির সাথে একেবারে যুতসই। অজস্র অসুর পরিবেষ্টিত হয়ে ও’হেনরির সেই লাস্ট লিফ গল্পের মতো ছবি আঁকায় মগ্ন থাকা এক শিল্পীর কাজ বলে বোধ হয় লেখাটাকে।
পৃথিবী এখন প্রবেশ করেছে বিগ ব্রাদারের যুগে, প্রতিনিয়ত নজরদারি এখন স্মার্টফোনের পর্দায় অপেক্ষা করে আমাদের জন্য। আলোর অভাবে মানুষ দেখতে পায় না, কিন্তু বেশি আলোতে চোখে তার ঝিলমিলও লাগে। তথ্যের অবাধ প্রবাহের ক্যাকোফোনি আর বিবিধ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি কী ঘাত-প্রতিঘাতের এই যুগে মনোযোগ ধরে রাখাটা, একাগ্র হওয়াটা হয়ে পড়েছে কঠিনতর। মানুষকে এই ক্ষমতা যোগান দেয়া শিল্প ছাড়া সম্ভব বলে মনে হয় না। ইমতিয়ার শামীমের মতো কিছু শক্ত কলমের মানুষের হাঁটাচলা চালু রাখাটা এখন তাই দরকার সবচেয়ে বেশি।
যা কিছু আগে দেখেছেন, শুনেছেন, পড়েছেন; সেগুলো হলো পচা বল সাবান, কসকো সাবান। একটু জীবনানন্দ, একটু ছেলে ভুলানো আন্দোলন, একটু চটপটি; হয়ে গেল চমৎকার সাহিত্য। রাস্তা জুড়ে নিয়ন আলোয় নাচছে প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ। হাওয়া দিলে এইভাবেই উল্টে যাবে বইয়ের পাতা, আমি দেখব গড়ে উঠছে নতুন নতুন ফ্লাইওভার। না। ভালো লাগছে না। হিজিবিজি ইতিহাসের লেখা, দ্রোহের লেখা চুবিয়ে নেওয়া হল সরকারী সাদা চুনগোলা টবে। লেখালিখি-বইয়ের উপর পুরস্কারের ছড়াছড়ি, যেন টিএসসির রাস্তা জুড়ে বাউলের চুল। আর গলির মুখ আটকে দাঁড়িয়ে আছে ছেঁড়া শাড়ি পড়া অন্ধ থেমিস, আহা কি দৃশ্য!
আমরা মৃত লেখকদের সম্মান করি, ব্লগারদের কথায় ভয় পাই, পুলিশকে বাপ বলি। আমরা লেখালিখি বলতে প্রথমআলোর বই বুঝি, আইন বলতে র্যাবের ক্রসফায়ার। আমরা ফ্লাইওভারকে উন্নয়ন বলি, রামপালকে প্রগতি। আঁতলামি বলতে বাম বুঝি আর How are you doing? বলাকে স্মার্টনেস।
এই বইয়ে কাজলা দিদির কোনো গল্প নেই। তথাগতের কথকতায় চোখে আঙুল মেরে গেছে অনেককিছুই। পুরাতন বিদ্রোহের এক গোপন কোড। হাজারো নিপীড়িতদের দীর্ঘশ্বাস এবং হৃদয়হীন জগতের হৃদয়। একই সঙ্গে নিস্পৃহ খোঁজাখুঁজি ও অকীর্ণ সত্য। ডান থেকে বাম, মহাজন থেকে প্রান্তিক, টকশো থেকে গ্রাফিতি, সকলেরই আছে নিজস্ব সত্তা।
এ বই গতকাল সকালে শেষ করসিলাম, কিন্তু রিভিউ দেই নাই। সেই সময় হাজার চেষ্টা করেও দিতে পারতাম না, এইটা আমি জানতাম। এই জন্যই দেই নাই। এখনও দেওয়া সম্ভব না, তবু নিজের জন্য হইলেও এই বই নিয়া কিছু একটা লিখতে হয়।
আমি ইমতিয়ার শামীমের 'আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক' পড়ে একদম বেকুব বনে গেসিলাম। শেষ করে আমি অবাক হয়া ভাবলাম, এইরম লিখল কেমনে লোকটা? এইভাবে আঘাত করলো কেমনে? অনেক চিন্তা করেও ��ুঁজে বাইর করতে পারি নাই সেই কারণ। হয়তো লেখকের লেখার আলাদা একটা স্টাইল, অথবা বিমর্ষতা ভরা গদ্য, অথবা উপন্যাসটা যে সময়ের উপর লিখিত, সেটারই আলাদা একটা মাদকতা…..যা-ই হোক না কেন, চিঠিযুগ আমারে পুরা স্তব্ধ কইরা ফেলছিল।
আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক উপন্যাসটাও শুরু হইসিলো বাংলাদেশের এক অন্ধকার সময়ের ছবি ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে। কিন্তু সেই উপন্যাস ছিল নিখাদ প্রেমের উপন্যাস। সেটায় জলপাই বাহিনির আকাম কুকাম প্রধান বস্তু না। মফস্বলের এক শহরের দুই কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়ের হাসি কান্নার প্রেমই সেই উপন্যাসে প্রধান।
কিন্তু আমরা হেঁটেছি যারা উপন্যাস পুরাই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। এই উপন্যাসে তথাগত, মারিয়া বা মনীষা মূল ভিত্তি না। এই দেশের লোকেরা দীর্ঘকাল ধরে যে নানা বাহিনির পেতে থাকা কাটার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, সেটাই এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি।
কত কত বাহিনি! মুক্তিযুদ্ধের পরপরই জন্ম নিল 'রাত বাহিনী' আর 'রক্ষী বাহিনী'। রক্ষী বাহিনীর গলা কাটা, লাঠি পেটার ভয়ে তথাগতের মুক্তিযুদ্ধা সাহসী বাবা বলছিলেন,''এখন বাঁচার একটাই উপায়। জাসদে যোগ দেয়া।” একদিন রাত বাহিনী তথাগতের বাড়িতে আক্রমণ করলো, ওর বাবার খোঁজ করলো, লাল বই ছাড়া সব বই জ্বালায় দিল। পরদিন সকালে রক্ষী বাহিনী এলো, তথাগতের বাবা জাসদে যোগ দিছে বইল্যা ওরা আবার ঘর দোর ভাঙলো, খড় জ্বালায় দিল, গরু বাছুর ধরে নিয়ে গেলো। দুই বিপরীতমুখী বাহিনী কতোটা একই ধরণের কাজ করতে পারে সেটা দেখে আমি পুনরায় তাজ্জব হইলাম।
অতঃপর পচাত্তরের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুরে হত্যা করা হইলো। সঙ্গে সঙ্গে আবার সবকিছুর পরিবর্তন। মৌলভী স্যার এসেম্বলি তে আইস্যা ঘোষণা দিলেন যে কাফের তার চৌদ্দ গোষ্ঠী সহ মারা গেছে। এখন জাতীয় পতাকার পরিবর্তন হওয়া সময়ের ব্যাপার। আবার পাকিস্তানের পতাকা উড়বে। স্কুলে আসতে হবে পাজামা, পাঞ্জাবি আর টুপি পড়ে। মেয়েরা চুল খোলা রাখতে পারবে না, বিছানার চাদরের মতো বড় ওড়না পড়া লাগবে। গঠিত হইলো ফতোয়া বাহিনী। এই অংশ পড়তে পড়তে আমি আবার তাজ্জব হয়া যাই। এই ফতোয়া বাহিনী এখনও মেয়েদের ওড়না পড়ার স্টাইল নিয়া ওয়াজ করতেছে, এদের কেউ আটকানোর কথা পর্যন্ত ভাবে নাই।
তো বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আসলো জলপাই বাহিনী। ওদের কথা এতো জানতাম, এতো বেশি জানতাম, তারপরও ওদের সব কৃতকাজের কথা শুনেও আমি তাজ্জব হইলাম, না হয়ে থাকা গেলো না। এরা কোনো লুকাছাপা ছাড়া মেরে ফেললো তথাগতের বাবাকে, সলীলের গান গাওয়ার জন্য মেরে ফেললো মামুন রে। মিছিলে তুলে দিল ট্রাক। হত্যা করলো জাতীয় চার নেতারে। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে লাগাইলো রাষ্ট্র ধর্মের তাকমা। আমি অবাক না হয়া থাকি কেমনে।
জিরো পয়েন্টে আজকালকার গণতন্ত্রের প্রতীক নূর হোসেন গুলি খেয়ে গণতন্ত্রকে মুক্তি দিল। জলপাই বাহিনী গা ঢাকা দিল। কিন্তু এই দেশ বাহিনী ছাড়া থাকে কেমনে? সেইটা তো সম্ভব না। মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো আমাদের অতি পরিচিত রগ কাটা বাহিনী।
”আমি অবাক হয়ে যাই। মিছিলের পর মিছিলে ঢুকে পড়ছে রগ কাটা বাহিনী। তাদের মাথায় টুপি, হাতে কিরিচ রামদা, এমনকি রাইফেল স্টেনগান।”
হলের পর হল দখল করে চলছে রগ কাটা বাহিনী। ছাত্রদের পড়ার টেবিলে পাঠ্যবুক ছাড়া অন্য কোনো বই থাকলে, সেই বই মোতাবেক ব্যবস্থা। কারো টেবিলে লাল বই থাকলে তার আর খালি হাত পায়ের রগ কাটা না। একদম গলা কাটা।
হয়তো কারো রক্ত ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে, নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। আর রগকাটা বাহিনীর ছেলেগুলো বলছে, কমুনিস্ট কাটলে নেকি বেশি।
গোলাপি ম্যাকাপ লাগানো ম্যাডামও আছেন। যিনি গোলাপি লিপ্সটিক লাগান, গোলাপি শাড়ি পরেন,খালি হিন্দুয়ানির ভয়ে গোলাপি টিপটা লাগান না। তিনি খালি রগ কাটা বাহিনির সঙ্গেই মানিয়ে চলেন না। উনারও একটা নিজস্ব বাহিনি আছে, ঈগল বাহিনি। আর উনার প্রতিপক্ষ দলের? জি, তাদেরও একটা বাহিনি আছে। ইমতিয়ার শামীমের ভাষায় সেই দলের নাম পেঙ্গুঈগল বাহিনি।
রাত বাহিনি, রক্ষী বাহিনি, জলপাই বাহিনি, গণ বাহিনি, রগ কাটা বাহিনি, ঈগল বাহিনি, পেঙ্গু ঈগল বাহিনি…..এতো এতো বাহিনির কথা পড়ে আমার রাগে মাথা গরম হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার বড্ড অসহায় লাগতেছে। কারণ এই যে কাটা তারের উপর দিয়ে কোনোমতে হাটতেছি, সেই হাঁটা হঠাৎ করে একদিন থেমে যেতে পারে। কাটা উপড়ে ফেলার সামর্থ্য আমার নেই। হয়তো কোনোদিন রগকাটা বাহিনি পঙ্গু করে রেখে যাবে, নইলে পেঙ্গুঈগল বাহিনির স্টাম্পের বাড়ি খায়া মারা যাবো, অথবা রাত বাহিনি কোনোদিন আবার জেগে উঠলে নিজ বিছানায় গলা কাটা লাশ হয়ে পড়ে থাকব।
ছোট সাইজের দেড়শো পৃষ্ঠার প্যাপারব্যাক বইয়ের গায়ের দাম ২৫০ টাকা। কেনার সময় মনে হালকা খচখচানি হইতেছিল, বিশেষ করে এই বইয়ের যখন পিডিএফ এভোয়লেবল। কিন্তু সেই খচখচানি কবে কোথায় উড়ে গেছে। রয়ে গেছে শুধু এক বুক শূণ্যতা আর হতাশা।
"প্রসারে চাই প্রচার" তত্ত্বে সম্ভবত ইমতিয়ার শামীম বিশ্বাস রাখেন না। নতুবা যে বইটি ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে গুডরিডসে আর বইয়ের গ্রুপগুলোতে এক দশক বাদে আলোচনা না হলে পাঠক তো জানতেই পারত না সাংবাদিক ইমতিয়ার শামীম কী অপূর্বতম এক উপন্যাস লিখেছেন।
১১৯ পাতার বইটি মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক অধ্যায়কে এত গভীরভাবে স্পর্শ করে গিয়েছে যে, বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সেই ইচ্ছেকে চাপা দিতে হয় খুব সজ্ঞানে কারণ বাংলাদেশের রাজনীতির যে তমসাচ্ছন্ন পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি কিংবা প্রতিনিয়ত পেরুতে সংগ্রাম করে যাচ্ছি তাকে আরো একবার অতিক্রম করবার চ্যালেঞ্জ সামনে এনে দেন ইমতিয়ার শামীম।
" অনেক রাতে আমাদের জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো এসে মণীষার মুখের ওপরে অধরা মায়ার জাল বুনতে থাকে।" - ঠিক প্রথম লাইনেই পাঠককে মোটামুটি বেঁধে ফেলার ব্যবস্থা করবেন লেখক।উপন্যাসটির কথক তথাগত। তার ছেলেবেলা থেকে কাহিনী এগিয়ে যায়। প্রেক্ষাপট সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ।কিশোর তথাগত নির্ভার শান্তিময় ভঙিতে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু সেই ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেলে সে আবিষ্কার করে,
" তারপরই অস্পষ্ট বুটের আওয়াজ শুনে ঠিক -ঠিক বুঝে নেই রক্ষীর দল এসেছে বাবার খোঁজে।" কেন তথাগতের বাবার খুঁজতে আসছে রক্ষীবাহিনী? তার বাবাও তো মুক্তিযোদ্ধা। কেনই বা তথাগতের বাবার সন্ধানে রাত বাহিনী আসে, যারা, " বোঝানোর চেষ্টা করে শ্রেণীবিপ্লব শুরু হয়ে গেছে, এবার তবে শ্রেণীশত্রু খতম করার পালা। যাকে মারা হবে সে হলো শ্রেণীশত্রু।" কারণ তথাগতের বাবা আর আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতোই যারা নিজের পরিশ্রমে পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে বাঁচতে চান। এরাই আবার রাত বাহিনীর কাছে শত্রু। এই রাত বাহিনীর পরিচয়,
" রাত বাহিনীর কেউ তাদের বোকা বুড়োর গল্প বলে। বলে চিনের চেয়ারম্যানের কথা। "
ইমতিয়ার শামীম সরাসরি নকশাল কথাটি উল্লেখ করেননি, সর্বহারাদের নাম নেননি। অথচ ওপরের বর্ণনা পড়লে বুঝতে বাকি থাকে না কাদের কথা বলতে চাইছেন পাঠককে।
কিশোর তথাগত এবার আরো ভালো করে পরিচিত হয় রক্ষীবাহিনীর সাথে। তার স্মৃতিচারণ,
" জেনে গেছি রক্ষী বাহিনীর জামার হাতায় তর্জনি তোলা কাটা আজি আঁকা থাকে, বড় চুল মোটেই পছন্দ করে না তারা।অবশ্য তারা কি পছন্দ করে তাও বোঝা যায় না ভাল করে।"
তথাগতের বাবা যখন নিরাপত্তা চাইত��� যায়। রক্ষী বাহিনী তার কাছে ১০ হাজার টাকা চায়। দিতে রাজি হন না তিনি।মুক্তিযোদ্ধা পিতার মনে পড়ে মুজিব বাহিনীর সাথে বামপন্থি বাহিনীগুলোর যুদ্ধকালীন তিক্ততার কথা।এরই মাঝে তিনি উল্টো যোগ দেন জাসদে! সেই থেকে হন্যে হয়ে তথাগতের পিতাকে খুঁজতে থাকে রক্ষীরা। যখন তখন হানা দেয় বাড়িতে। রক্ষীর হানাতে তথাগত ভাবে,
" প্রতিদিনই ওরা হানা দেয় কারও না কারও ঘরে, গরু-ছাগল না হলে মোরগ-মুরগি ধরে নিয়ে যায়। আর বিকৃত দেঁতো হাসি ছুঁড়ে প্রতিবারই বলে, অনেকদিন ভালমন্দ খাওয়াদাওয়া হয় না, কিছু মনে কইরবেন না। "
উপন্যাসে দেখতে পাই, কারও মন অবশ্য কিছু মনে করে না।
তথাগতের সাথে এক অদ্ভূততম সম্পর্ক তার বাবার সাথে। বাবা তাকে অনেকটা হিমুর বাবার মতো কিছু বাণী বলে।অবশ্য ইমতিয়ার শামীমের বাণীগুলো নিঃসন্দেহে ভিন্ন।তথাগতের পিতার সাথে সেই সম্পর্ক স্বপ্নে বোনা, এই নিবিড়তম স্মৃতিতে বিভোর তথাগতের মনে হতে থাকে,
" আমি এত তরুণ হতে যাই যে আমাকে কিশোর বলে বিভ্রম হয়,আমি এত কিশোর হয়ে যাই যে আমাকে বালক বলে ভুল হয়, এত বেশি বালক হয়ে যাই যে আমাকে শিশু বলে মনে হতে থাকে। "
কিন্তু এই স্বপ্নাতুর অনুভূতিতে মোহাবিষ্ট হয়ে থাকা হয়না তথাগতের। সে বাস্তবে বাস করে। সেখানে সে দেখে তার নিজের মা মারা গেছে। বাবা এক বিধবা নারীকে বিয়ে করেছেন। তারই কন্যা মণীষা। আরেকটি চমকের নাম মণীষা। সৎ বোন হলেও খানিকটা দুর্গার রূপে আবির্ভাব হয় সে। আর তথাগতের ভূমিকা অপুর। নাহ্। ঠিক ততটা সহজ করে ভাবেননি লেখক। মণীষার সাথে তথাগতের সম্পর্ককে ইমতিয়ার শামীম অন্যভাবে বিবৃত করতে চেয়েছেন। তা পাঠক হিসেবে অস্বস্থিতে ভোগাতে ছাড়েনি আমাকে। তবুও তথাগত আর মণীষা। সমবয়সী দুজনের কিশোরবেলার সম্পর্কে অনির্বচনীয় ভঙিতে উপস্থাপন করেছেন লেখক।
বাবা জাসদে।পলাতক।এক বর্গাজমি ছাড়া আয়ের উৎস নেই। চারিদিকে অস্থিরতা। বাবা ফিরে আসার আগপর্যন্ত রক্ষী বাহিনীর দৌরাত্ম্যকে ভালোই কাছে থেকে দেখেছে তথাগত। রাত বাহিনী আসে তথাগতের পিতার সন্ধানে। তারা বাড়িতে ভাঙচুর করে। তথাগতের বাবার লাইব্রেরির সব বই আগুনে পোড়াবার আগের দৃশ্যকে খুব সুন্দর নাটকীয়তার সাথে ইমতিয়ার শামীম লিখেছেন, " উ-উ-উ জ্ঞ্যানী হ'য়েছে! আরেকজনও তা অবলোকন করে এবং আরেকজনকে বলে, দেখ তো আমাদের পাঠচক্রেরর জন্যি কুনডা কুনডা নিয়ে যাওয়া যায়? আগেরজন মনযোগ দিয়ে বইয়ের পুট দেখতে থাকে এবং অবশেষে মন্তব্য করে, সব প্রতিক্রিয়াশীলদের বই। এইসব দিয়ে কুন কাজ হবে না। পোলাপানের মাথা আরে খারাব হয়ে যাবে।" অতীতের কথা বলতে বলতে ঔপন্যাসিক আমাদের নিয়ে যান তথাগতের বর্তমানে।যেখানে সে মারিয়া শুভান্বিতার সাথে ঘুরছে ঢাকাময়। একটু আধটু গাঁজা টানতে হচ্ছে তথাগতকে। বর্তমানে এসেও ঘোরঘোরালো পরিস্থিতিকে কল্পনা করে তথাগত। যে বর্তমানকে প্রত্যহ নিয়মকরে সবাই টিভিতে দেখি, পত্রিকার পাতায় পাতায় পাই সেই বর্তমানকে।তখন তার মনে হতে থাকে, " ধর্ষণগাথাই আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ গাথা। " আবার কৈশোরের স্মৃতিতে চলে যায় তথাগত। যেখানে প্রতি মুহূর্তে তার ভয় যদি রক্ষীরা দেখে ফেলে, যদি রাত বাহিনীর লোকেরা ক্ষেপে যায়। এই ভয় আর আতঙ্কের মাত্রাকে অভাবনীয় পর্যায়ে নিয়ে যায় দারিদ্রতা। গ্রামে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। এইসময় বাজার থেকে দিয়াশলাই উধাও হয়ে যায়। কালো বাজারির বিরুদ্ধে অভিযানে নামে রক্ষীবাহিনী। এক হাটুরু কে দিয়ে ইমতিয়ার শামীম বলালেন, " চাইল ডাইল যহন মজুত করে তহন কুনু শালার দেখা পাওয়া যায় না। আর এগন নিজেদের সিগারেট খাওয়ার ম্যাচ খুঁজে না পায়া মাতুব্বরি করছে।শালার পক্ষী বাহিনী। "
এহেন বক্তব্যদানকারীর শাস্তির ব্যবস্থা লেখক রক্ষীদের দিয়েই করেন। সবাই বাবা থাকতে তথাগতকে স্নেহ করত, এখন কেউ খবরও নেয় না। বাবার পরিচয়ে নয়। কিশোর তথাগতের মনোজগৎ চাইছে নিজের পরিচয়বোধ তৈরি করতে। কিন্তু তা কি হয়। কারণ তথাগত জেনে গেছে সবাইকে বইতে হয়,
" পূর্বপুরুষের পরিচয়ের বোঝা, যাবতীয় সামাজিক ঋণ, লোকনিন্দা, পারিবারিক অবস্থানের সরল ও বক্ররেখা।"
যে বাবা বইপাগল ছিল, সে কি শুধুই তথাগতকে বইয়ের গল্পই শুনিয়েছে। না। বাবা তাকে শিখিয়েছে, সবকিছু বইতে মেলে না। চারদিকে চোখ খুলে খুঁজতে হয়। হ্যা, অন্ন যোগাতে গিয়েই মাঠে পড়ে থাকতে দেখে তিন-তিনটি হাত-পা বাঁধা মাথাকাঁটা লাশ। আঁতকে উঠে তথাগত আর মণীষা। বৃদ্ধ কৃষক হালিম এসে লাশগুলোকে নিজের ক্ষেত থেকে উঠিয়ে অন্যের ক্ষেতে ফেলে দেন। ন্যূনতম ভয়,আতঙ্ক,প্রশ্নবোধ জাগে না। যেন রোজই দেখেছেন এসব খুনোখুনি।
একসময় শোনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করা হয়েছে। বিশ্বাস হতে চায়না তথাগতের। কিছুদিন পর তার বাবা ফিরে আসে।এদিকে দেশের অবস্থা ভয়াবহ। যারা এতদিন ঘাপতি মেরে ছিল তারা হাজির হয় পর্দায়। তথাগতের মৌলভি স্যার বলতে থাকে, " এই জাতীয় পতাকা তো পাল্টে যাবে। " তথাগত লক্ষ্য করে যারা এতদিন বেশ হম্বিতম্বি করত তারা সবাই চুপসে গেছে। সময় এখন মৌলভি স্যারদের অনুকূলে।তিনি এখন জোরসে রীতিনীতি প্রনয়ণ করে চলছেন। ইমতিয়ার শামীমের এই মৌলভি যেন তৎকালীন মুজিবপরবর্তী মৌলবাদী বাংলার প্রতিচ্ছবি।এরই মধ্য জলপাই বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। তারা একদিন হাজির হয় তথাগতের বাবার খোঁজে। বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানো দেখে অবাক হয়ে জানতে চায়, " আপনি তো জাসদ করেন। এর ছবি রেখেছেন কেন? বাবা বলে, এখন আমরা যাই করি না কেন যুদ্ধের সময় তিনি আমাদের সবার নেতা ছিলেন। এমনকি যারা তাঁকে হত্যা করেছে, যিনি এখন সামরিক বাহিনীর প্রধান হয়েছেন তারা সবাই তো তাঁর অধীনে যুদ্ধ করেছি।" ইমতিয়ার শামীম একজন জাসদ কর্মীর মুখে যতই বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তুল দিন না কেন, তৎকালীন রাজনীতি কিন্তু অন্য সাক্ষ্য দেয়। অবশ্য সচেতন পাঠক উপন্যাস পড়তে বসে, নিশ্চয়ই ইতিহাসের পাঠ নিতে চাইবে না।
তথাগতের জাসদকর্মী বাবাকে নিয়ে যায় জলপাই বাহিনী। আর ফিরিয়ে দেয় মৃতদেহ হিসেবে। বলে পালাতে গিয়ে নিহত। ক্রসফায়ার আরকি! জিয়াউর রহমানের আমলে উইচ হান্টিংয়ের মতো জাসদ খোঁজার কথা পাই উপন্যাসে। আরও পাই সেনাবিদ্রোহে গণফাঁসির আলামত। লেখক তথাগতকে দিয়ে জিয়ার আমলের প্রতি ইঙ্গিত করেন,আগে লাশ পড়ে থাকত ক্ষেতে, রাস্তায়, নালায় আর এখন মেরে সযত্নে কবর দিয়ে পাহাড়া বসানো হয় কিংবা গুম করে আত্মীয়স্বজনের কাছেই নিরীহ গলায় খোঁজ করা হয়! এদিকে জিয়ার আমলের হ্যাঁ/না ভোটের স্মৃতি তথাগতের মুখে, " যুবকবয়সী তোজাম্মেল লিডার বনে গেছে এই সুযোগে।দলবল নিয়ে হ্যাঁ মার্কা ব্যালটপেপার সে এত বেশি ফেলে যে ভোটারের সংখ্যার চেয়েও বেশি ভোট পড়ে যাওয়ায় কিছু ভোট আবার গণনার পর গায়েব করতে হয়। "
জিয়ার আমলে ধর্মভিত্তিক দল,পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর উত্থানের কথা বারবার স্মরণ করেছেন ইমতিয়ার শামীম।ছাত্র শিবিরের দল হিসেবে উত্থানের চিত্রকে হয়তো খুব গভীরভাবে দেখেছেন ইমতিয়ার শামীম।তাই এই দলটির ধর্মের নামে রাজনীতির বিকিকিনি কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থী বা অন্যান্য দলের কর্মীদের ওপর রগকাটা বাহিনীর আক্রমণকে একেবারে বাস্তবতার নিরিখে লিখে গিয়েছেন ইমতিয়ার শামীম।কতটা ঘৃণা করেন এই রগকাটা বাহিনীকে তা লুকাতে চেষ্টা করেন নি। যেমনি মনোভাব লুকিয়ে রাখেন নি তথাগত যখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যায়, তখন তাকে দিয়ে বলিয়েছেন, " এক দফা এক দাবি / এরশাদ তুই কবে যাবি।" কোনো সুস্থলোক সেনাশাসনকে সমর্থন করতে পারে না। সেই জলপাই বাহিনীর খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের অবস্থা কি হয়েছিল তা জানাতে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সাথে, জিয়ার শাসনামলের সাথে। একইসাথে বারবার ইমতিয়ার শামীম জানাতে চেয়েছেন জলপাই বাহিনীর আসল মনোভাব কেমন ছিল।কীভাবে পত্তন ঘটলো রগকাটা বাহিনীর।
বাবার একটি পিস্তল খুঁজে পেয়েছিল তথাগত। মা আর বোনের পরিণতি ভিন্নদিকে নিয়ে যায় তথাগতকে। তাতে সায় থাকে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার। জনকন্ঠে কর্মরত ইমতিয়ার শামীম উপন্যাস কম,রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। আর পাঠককে নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারে প্রদক্ষিণ করিয়ে এনেছেন বাংলাদেশের সেই বন্ধুর, খানাখন্দ আর শ্বাপদসংকুলে ভরা সেই সময়ের সাথে যেপথে ইমতিয়ার শামীমরা হেঁটে এসেছে। এই উপন্যাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হয়তো লিখেছেন ইমতিয়ার শামীম। লুকছাপা নেই। সাদাকে সাদা,কালোকে কালো বলার সৎসাহস আমরা বেচে দিয়ে, নিজেরা বেঁচে আছি। সেই দলে নন লেখক। নিঃসন্দেহে উপ���্যাসের আয়তন বৃহৎ হতে পারতো, কাহিনী শেষ পর্যন্ত সেদিকেই যাচ্ছিল। হঠাৎ নাটকীয় (তবে বাস্তব) সমাপ্তি।
আমাদের সাহিত্যিকদের মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী সময় নিয়ে লিখতে বড্ড অনীহা। বিশেষ করে স্বাধীনতার অব্যবহিতকাল পরের অস্থির সময়গুলো আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত তাদের লেখায়। যা-ও বা নিতান্তই নগণ্য পরিমাণে লেখা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই আবার পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট। লেজুড়বৃত্তি আমাদের জড়িয়ে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। লেজুড়বৃত্তির এই নাগপাশ থেকে মুক্ত নন আমাদের সিংহভাগ সাহিত্যিকও। আশ্চর্যজনকভাবে লেজুড়বৃত্তির মোহ থেকে মুক্ত ইমতিয়ার শামীম---অন্তত এই বইয়ে তো বটেই।
একাত্তরের পর থেকে এরশাদের সামরিক শাসনের আমল পর্যন্ত সময়কাল বেশ অস্পষ্ট নতুন প্রজন্মের কাছে। সেই সময়কাল নিয়েই লেখা ইমতিয়ার শামীমের আমরা হেঁটেছি যারা। বইয়ের ঘটনাকাল শুরু মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরমুহূর্ত থেকে। সে বড় অস্থির সময়। দেশ তো স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু শত্রুর তো শেষ হয়নি। বাইরের শত্রু চলে গেছে, কিন্তু দেরি হয়নি ঘরের শত্রু বিভীষণের ফণা তুলতে। তাই, অস্ত্র হাতে দেশ স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই তারাই মেতে উঠে সীমাহীন লুটপাট আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েমে। দেশ স্বাধীন করা মানুষগুলোই বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে একে অপরের মুখোমুখি। স্বাধীনতা এসেছে যার অনুপ্রেরণায় সেই তিনিই গড়ে তোলেন রক্ষীবাহিনী নামক এক শোষণ-যন্ত্র---তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় জাসদের দল, রাতবাহিনী। প্রথমদল দিনেদুপুরে চালায় অত্যাচারের স্টিম রোলার , দ্বিতীয় দল চালায় রাতের আঁধারে গলাকাটা, ধরবিহীন লাশে ভোরে উঠে দেশ। আপাতদৃষ্টিতে সাদা চোখে দুই বাহিনীকে একে অপরের বিরোধী মনে হলেও মনে হয় যেন তাদের ভেতর এক অলিখিত চুক্তি আছে, পালাক্রমে তাণ্ডব চালানোর ব্যাপারে। তারপর একসময় রক্ষাবাহিনী-রাতবাহিনীকে হটিয়ে, জলপাইবাহিনীর সাহায্যে ক্ষমতায় আসে নতুন শাসক। এতদিন যে ক্ষত ঘাপটি মেরে ছিল, সেই রাজাকার বাহিনী আবার বেরিয়ে আসে নতুন রূপে। এরপর একে একে ক্ষমতায় আসে জলপাই বাহিনী, ঠোলা বাহিনী, ঈগল বাহিনী---একের পর এক বাহিনী। একেকটা বাহিনী আসে অত্যাচারের নতুন নতুন পদ্ধতি নিয়ে। একাত্তরের পর মুজিব বাহিনী, রক্ষী বাহিনী, রাত বাহিনী, লাল বাহিনী থেকে শুরু করে পেঙ্গুঈগল বাহিনীর সময়কাল পর্যন্ত বিস্তৃত এ বইয়ের কাহিনি।
নির্মোহ ভঙ্গিতে লেখক বর্ণনা করে গেছেন একের পর এক বাহিনীর, শাসকদের নিপীড়ন-গাথা। ইমতিয়ার শামীম কঠিন কথাগুলো তুলে ধরেন সাবলীল ভঙ্গিতে। তাই আমার মতো সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার বাইরে যায় না তার লেখা। বইটি পৃষ্ঠা সংখ্যা মাত্র ১২০, কিন্তু এর ক্যানভাসটা বিশাল। ছোট্ট এই বইটা থেকে যে স্ফুরণ ঘটবে এমন কল্পনাতীত এক বিশাল ক্যানভাসঅলা গল্পের তা কে জানত! দুর্ভাগ্য, সাধারণ পাঠকের চোখের আড়ালে পড়ে আছেন এরকম শক্তিমান এক লেখক। আরও বেশি আলোচনার দাবি রাখে ইমতিয়ার শামীমের লেখা। এই বই সম্পর্কে অল্প কথায় সবচেয়ে ভালো বলেছেন সুহান রিজওয়ান ভাই--- "Disturbingly brilliant."
যুদ্ধের পর একটি নতুন দেশের জন্ম হয় আর পাশাপাশি জন্ম হয় দেশ দখলের, শোষণের লালসা কিংবা শাসন করার বা কর্তৃত্বের আকাঙ্ক্ষা পূর্বেই ছিল যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে! কে না কর্তৃত্ব চায়? একা একা কি আর পারা যায় এত বড় দায়িত্ব নেয়া? মানু্ষরা মিলে একেরপর এক বাহিনী গড়ে তোলে; এক বাহিনী কার্যক্রম চালায় তো আরেক বাহিনী একটু বসে যায়; এরপরে আবার সেই বাহিনী আসে। আসতেই থাকে একেরপর এক। চারদিকে অরাজকতা, অন্যায়, অবিচার। দুর্ভাগা দেশমাতা! তবুও বাহিনীর শেষ নেই। এরই মাঝে কেউ কেউ সবকিছু আপন খেয়ালে সূক্ষ্ণভাবে খেয়াল করে। ভাবতে থাকে জীবনের শুরু থেকে এই আবহে মিশে যাওয়া সত্ত্বার ব্যাপারে, দিয়ে যায় অদ্ভুত দর্শন।
If you miss the train I'm on You will know that I'm gone. You can hear the whistle blow a hundred miles.🎵🎵
অনন্তকাল ধরে মানুষ হেঁটে চলেছে। এই নিস্তব্ধতায় হাহাকার করা মানুষের পদধ্বনি তো শত মাইল দূর থেকেই শোনা যাওয়ার কথা। কেউ শোনে, কেউ শোনে না, কেউবা না শোনার ভান করে থাকে।
People walked & still walking!
আরও একটি বিজয়ের দিন,জন্মদিন! হাঁটতে হাঁটতে অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি বয়সটা শুধু বেড়েই যাচ্ছে!!
বইটা আমি প্রথমবার পড়ি ২০১৭ সালে। তখন পড়ার পরে আমি বলেছিলাম এটা রিরিড করা সম্ভব না। এতটাই ডিস্টার্বিং একটা বই। কিন্তু পেন্ডুলামের হার্ডকপি এডিশনটা দেখে আবার পড়ার ইচ্ছা জাগলো। ছোট্ট একটা বই, আমার শেষ করতে তিনদিন লেগেছে, এতোটাই পাওয়ারফুল একটা বই। কিছুক্ষণ পড়ার পরে স্তব্ধ হয়ে বই বন্ধ করে বসে থাকতে হয়। আর ভাবি এরকমও বাংলাদেশ ছিল!! তবে বেশি ভাবতে হয়না, কারণ তখনের সাথে আর এখনের খুব একটা পার্থক্য নাই।
এখনকার লেখকেরা লেখার টপিক বা প্লট খুঁজে পান না, অথচ যুদ্ধপরবর্তী দেশ নিয়ে কত অসাধারণ বই লিখা যায়, তা ইমতিয়ার শামীম দেখিয়ে দিয়েছেন।
বইটা তথাগতকে নিয়ে, যার বাবা রাত বাহিনী আর রক্ষী বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে পারলেও জলপাই বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। বইটা মনীষা, মনীষার মা, মামুন,শুভ্রা, মারিয়া ও আইয়ুবকে নিয়ে। যে আইয়ুব রগকাটা বাহিনীর শিকার হয়েছিল।
লেখক এখানে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে গজিয়ে উঠা অনেক বাহিনীর কথা বলেছেন। লেখকের ভাষায় -
"এতটুকু এই জীবন আমার, একজীবনেই কত স্মৃতি, কত বাহিনী। মুজিব বাহিনী, রাত বাহিনী, রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী, গণ বাহিনী, জলপাই বাহিনী। বাহিনী দাঁড়ায় সোজা হয়ে। বাহিনী দাঁড়ায় আরাম করে। বাহিনী ডানে ঘোরে, বামে ঘোরে, উল্টো ঘোরে। আমাকে মিছিলে দেখে অনেকেই বলে, কোন পার্টি করি আমি। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারিনা স্পষ্ট করে। কখনও বলতে চাই, আমি আসলে প্রতিদিনই শোকমিছিল করি।...."
বইটা আমার এত প্রিয়, আমি পাঁচ কপি কিনেছিলাম। তিন কপি তিন বন্ধুকে দিয়েছিলাম, আর দুই কপি আমার কাছে আছে। ইচ্ছে করে সবাইকে ধরে ধরে বইটা পড়াই।
আমি এখনি দেখতে পাচ্ছি, বইটা একসময় ক্লাসিকের কাতারে পড়বে।
দানবের সাথে মানুষের যুদ্ধে রুখাশুখা মরণশীল মানুষ কখনো পেরে ওঠে না। জান বাঁচানোর তাগিদে তাদেরকে দৌড়াতে হয় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। তবু মানুষকে দানবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, এটাই বড় কথা, সে বাঁচবে না মরবে সেটা বড় ব্যাপার নয়। সে যদি না দাঁড়ায়, সে যদি প্রতিবাদ না করে, তাহলে সে তার মনুষ্যত্বকেই অপমান করে। মরে যাবার ধ্রুব সত্যটাকে তুড়ি মেরে দেবতাদের বিরুদ্ধে,দানবের বি��ুদ্ধে ��েমন দাঁড়িয়েছিলো গ্রিক বীর হেক্টর কিংবা এই জুলাই বিপ্লবের ফ্রন্ট ফাইটাররা। ঘরে থাকা সন্তানের মুখ তাদের পিছু ডেকেছে। বাবা ডেকেছে পিতৃত্বের অধিকারে। মাও ডেকেছে স্তন্যধারার দোহাইয়ে। নিজের সমস্ত ভীরুতা আর দীনতাকে নিয়ে মরে মরে বেঁচেছে সে দানবের উন্মাদ আস্ফালনের শিকার হয়ে। কারবালার প্রান্তরে কত মানুষই মারা গেছে, মানুষ শুধু মনে রেখেছে হাসান,হোসেন,মীর কাশেম, সখিনার মতো মানুষদেরকে। নাম না-জানা, বেঠিকানা আরো অনেকে পথ হাঁটে। তাদের মাও শাড়িতে লেগে থাকা হলুদ বাটা, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে অপেক্ষা করে। তাহিরের মেয়ের গলা, 'বাবাকে আমি মিস ইউ বলি, আর বলি লাভ ইউ...’ নিউজ চ্যানেলের ভিউ বাড়াতে বিবেকবেচা সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করে, 'বাবা কোথায় জানো?' অস্ফুট স্বরে সে বলে, ‘মারা গেছে...’ এভাবে যুগে যুগে আমাদের মায়েরা ও মেয়েরা অপেক্ষা করে। আর আমাদের গতি থামানোর জন্য মুজ��ব বাহিনী আসে, রক্ষীবাহিনী আসে, রাত বাহিনী আসে,লাল বাহিনী আসে, গণ বাহিনী আসে, জলপাই বাহিনী আসে, রগকাটা বাহিনী আসে, ফতোয়াবাজ বাহিনী আসে, ঠোলা বাহিনী আসে, ঈগল বাহিনী আসে, পেঙ্গুঈগল বাহিনী আসে, পুলিশ বাহিনী আসে,ছাত্রলীগ পেটোয়া বাহিনী আসে, বাহিনী আসতেই থাকে। বাহিনী আরামে দাঁড়ায়, সোজা হয়, ডানে ঘোরে, বামে ঘোরে, ফরোয়ার্ড মার্চপাস্ট করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, আমরা থামি না, তারা আমাদের হত্যা করে, কিন্তু মায়ের কপালে শিশির ফুটতেই থাকে, আমরাও পুনর্জন্ম নিতে থাকি। আমাদের মা বাবার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে,মায়ে কপাল গড়িয়ে শিশির পড়ে মাটির উপর। আমাদের মা কেবল আমাদের দিকে তাকিয়ে মায়া-মায়া চোখে অবিরাম হেসে চলে... আর আমাদের সবাইকে ধোঁয়া ওড়া ভাত বেড়ে দিতে থাকেন।
কিছুটা ব্যক্তিগত,কিছুটা ঐতিহাসিক স্মৃতিতে মিলেমিশে আছে শিউলি ফুল আর শিশিরে ঢেকে থাকা এক সময়পথ। উপন্যাসের একটা নিজস্ব আবরণ আছে। তার ভেতরে প্রচ্ছন্ন রেখে অনেক কথা বলে নিয়েছেন ইমতিয়ার শামীম,অনেক আত্মপ্রসঙ্গ। গ্রামবাংলার মোহময় রূপে আমাদের মুগ্ধ করার প্রচেষ্টা করেন না তিনি,স্মৃতিমেদুর বিষণ্ণ টোনে গুঁজে দেন চাপ চাপ অন্ধকার।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তথাগত। তার সেই মুক্তিযোদ্ধা বাবাকেই নুয়ে পড়তে হয়েছে চাঁদা দাবি করা রাতবাহিনীর কাছে। রাতবাহিনীর হাত থেকে বাঁচাতে তৈরি করা এই রক্ষীবাহিনীও বিনা খরচাপাতিতে কাউকে নিরাপত্তা দিতেও অক্ষম। তথাগতের বাবা আত্মরক্ষার্থে মশালে যোগ দেয়া ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো রাস্তা দেখতে পান না। রোষানলের পুরোটা এসে পড়ে তথাগত আর তার পরিবারের উপর। রাতবাহিনী ফিরে আসে আর তার বাবার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের বই পুড়িয়ে নিজেদের বিদ্রোহ প্রকাশ করে। রক্ষীবাহিনীরা ঘরের হাঁস-মুরগি-বাছুরসহ সকল জিনিসপত্র বাগিয়ে নিয়ে। তথাগতরা আধপেটা হয়ে বাঁচে। শাপলাবিলে ভেসে উঠতে দেখে পঁচাগলা, গলাকাটা লাশ। অনেক অনেকদিন পরে, একদিন তথাগতের বাবা ফিরে আসেন মশালবাহিনী থেকে। কিন্তু তার আর ঘরে থাকা হয় না। তাকে তিনদিনের মাথায় হত্যা করে জলপাই বাহিনী। আবার ক্ষমতার হাত বদল হয়। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই ভালো লাগে না তথাগতের। গ্রাম ছেড়ে চলে আসে শহরে। কিন্তু এ যেন ভিন্ন এক জগতে এসে প্রবেশ করে তথাগত। শহরে কিলবিলে মানুষের ঝাঁক। আর ঝাঁকের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অসংখ্য বাহিনী। জলপাইবাহিনী, রগকাটা বাহিনী, ফতোয়া বাহিনী, পেঙ্গুইন বাহিনীসহ আরো কত কত বাহিনী। জলপাই বাহিনীর সামনে সলিল চৌধুরীর গান গাওয়া নিষেধ। অসাম্প্রদায়িক হতে চাইলেই রগকাটা বাহিনী ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরায়। এই রগকাটা বাহিনী স্কুল কলেজে গিয়ে ধর্মের ছায়াতলে আসতে তাগাদা দেবে, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলের সময় কমিউনিস্টের রগ কাটলে পুণ্য কতটা বেশি, সেই হিসাবও করে। এসবের ফাঁক দিয়েই দেশে গণতন্ত্র আসবে। আর গণতন্ত্র এলেই যেহেতু সব ঠিক হবার কথা তাহলে ধর্ষণের সেঞ্চুরি হয় কেন সেটার জবাব থাকে না। কোনো বুদ্ধিজীবী কবি বলবে না যে এরা অন্য দল থেকে আসা ছেলে,এরা ওদের কেউ নয়। কারণ,সারাজীবন সীতার বস্ত্রহরণের মতো শৈল্পিক বাতাবরণে প্রতীকী কাব্য করে এই লেহনপ্রবণ কবিদের কাটে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়কাল নিয়ে ছোট ক্যানভাসে অথচ অকপট হিম্মতে ইমতিয়ার শামীমের এই বিস্ফোরণপ্রবণ আখ্যান আমাদের বিহ্বল করে।
শেষ পর্যন্ত আমরা আসলে কী চাই? নির্বাণ? কাক কাকের মাংস খায় না,অথচ মানুষ মানুষের মাংস খায়- এই সত্যকে মেনে নিয়েই আমরা হাঁটি সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত নির্বাণের পথে। ইমতিয়ার শামীমের ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ সেই চির প্রবহমান স্বপ্নভঙ্গের কথা বলে,ক্ষয়ের কথা বলে। এই গল্পের নায়ক তথাগত হলেও তার ব্যক্তিগত পরিসরের গল্প পাঠককে হাজির করে এই জনপদের নিভৃত কুহকের গল্পের সামনে। স্বাধীনতার পরের বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলিল বললেও কম বলা হয়। কারণ, একটি পরিবারের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার পাল্টে পাল্টে যাওয়া ছবির মধ্যেও এক আটপৌরে বিলীয়মান জীবনের দেখা মেলে। ইমতিয়ার শামীমের অনন্য কাব্যগন্ধী ভাষায় লেগে আছে সেই ক্ষয়ের সুর,রোদের আল্পনা,হিজলবনের প্রসন্নতা আর হাহাকারে ভারী দীর্ঘশ্বাস। তথাগত- যার নামের অর্থই নির্বাণপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি, সেই তথাগত নামধারী এক হেক্টরের গল্প আমাদের শুনিয়েছেন লেখক ইমতিয়ার শামীম। তথাগত এমন এক যুবক যে দীর্ঘপথ হেঁটে পেয়েছে নির্বাণ। শঙ্খ ঘোষের কবিতার মতোই জীবন তার—
‘আমার দু:খের দিন তথাগত আমার সুখের দিন ভাসমান এমন বৃষ্টির দিন পথে পথে আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।
আবার সুখের মাঠ জলভরা আবার দু:খের ধান ভরে যায় এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে আমার জন্মের কোনো শেষ নেই। ’
তথাগতরা এভাবেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বারবার জন্মে ফিরে আসে। দানবের কামড়ে তাদের আধখাওয়া জীবন দুঃখের ধানে ভরে থাকলেও তারা দাঁড়ায়।
উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপর সময় থেকে মিলেনিয়ামের আগ পর্যন্ত। চরম নৈরাজ্যময় এই সময়ের সাক্ষী কাহিনীর প্রধান চরিত্র তথাগত। শুধু সাক্ষী নয়, ভিকটিমও। ত্রিশ বছরের কাছাকাছি কালের পরিক্রমায় বারবার ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। আর যারাই ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে, তারাই বুঝিয়ে দিয়েছে নৈরাজ্য কায়েম থাকলে মানুষ কেমন মাংসাশী বন্য জানোয়ারের মত নৃশংস হয়ে উঠতে পারে, অথবা সেসব বন্য জানোয়ারের থেকেও বেশি নৃশংস।
ইমতিয়ার শামীমের লেখনশৈলী কাহিনীর ইনটেনসিটি অনুভব করতে আরও সাহায্য করে, পড়তে শুরু করলে মনোযোগ থাকে নিরবচ্ছিন্ন। তার লেখা গদ্যকবিতার মত মনে হয়, পরম অনুভবের ঘোর লেগে যায়। উপন্যাসের নামটাও জীবনানন্দের দাশের বিচিত্র অনুভবের ঘোরলাগা "মৃত্যুর আগে" কবিতার প্রথম তিনটা শব্দে - আমরা হেঁটেছি যারা।
নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির একটি "আমরা হেঁটেছি যারা"। অন্ধকার একটা সময়কে ফিকশনের স্বচ্ছ পর্দায় ঢেকে লেখক দেখিয়েছেন ও অনুভব করিয়েছেন সেই সন্ত্রস্ত সময়ের আতঙ্ক। তথাগতের চোখ দিয়ে আমরা দেখি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের নৈরাজ্যময় সময়ের সুযোগে সৃষ্টি হওয়া কমিউনিস্টদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ফসলের ক্ষেতে পড়ে থাকা লাশের স্তুপ, মাথার খুলি। আমরা আরও দেখি "রক্ষীবাহিনী" নামে সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত এক গুণ্ডাবাহিনী, যাদের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো গ্রামের নিরীহ মানুষজন। এরপর উত্থান ঘটে সামরিক শাসকদের; বিদ্রোহ ক���তে পারে এমন সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্য গুম হয়ে যায়। বামপন্থীদের বাড়ি থেকে তুলে এনে মারা হয় এনকাউন্টারে। আমরা এইসব জানতে পারি তথাগতের ভাবলেশহীন বর্ণনায়, অনুভবও করতে পারি একটু একটু।
মুক্তিযুদ্ধে জাতির সাথে বেঈমানি করা জামাত-শিবির ফিরে আসে। আবারও ইসলাম ও নৈতিকতার সেল্ফ অ্যাপয়েন্টেড ইজারাদার হয় তারা। রাজাকারি ভূমিকা আড়াল করে শিবির বলে- আমরা কোন রাজনৈতিক সংগঠন করিনা, আমরা শুধু পড়ালেখা করি আর ইসলামের আলোর পথে মানুষদের ডাকি। তথাগত তাদের বিশ্বাস করেনা। তার অবিশ্বাসের যুক্তিযুক্ত কারণ আমরা ভবিষ্যতে দেখতে পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে রগকাটা বাহিনী হিসেবে খ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জন করে ইসলামি ছাত্রশিবির।
এরপর সামরিক শাসকেরও ক্ষমতার পালাবদল হয়। গান থেকে স্লোগান- তরুণদের সবকিছুকেই ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করে সামরিক শাসক। দ্রোহের কণ্ঠস্বরকে শাসক কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা করে। তথাগত কখনও কখনও প্রতিবাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলায়। কখনও নিরব দর্শক হয়ে দেখে।
একদিন দেশে গণতন্ত্র আসে। সবাই গণতন্ত্রপন্থী হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার চেয়ে সন্ত্রাসটাই যেন বেশি চলতে থাকে। গ্রামাঞ্চলে গুণ্ডা সন্ত্রাসীরা দলবদল করে নৈরাজ্য জারি রাখে। ধর্মীয় ফতোয়াবাজরা পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পায়, আর মাটিতে পুতে বিচার করতে চায় "চরিত্র ��ারাপ" মেয়েদের।
যদিও গণতন্ত্রযুগে (1990s) তথাগতের বর্ণনা অতটা সুস্পষ্ট মনে হয় না আমার কাছে। তবে এতটুকু বোঝা যায়, অন্ধকার কাটেনি তখনও, অন্ধকার কাটাবে এমন আলোর রেখাও সে দেখেনা। তথাগত যখন পুলিশ কাস্টডিতে, তখন ধর্ষণ করতে করতে সেঞ্চুরির পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারমতো একই জেলায় বাস করা এক ছাত্রনেতা। তথাগত ঠিকই বলেছিল, "ধর্ষণগাথাই আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ গাথা।"
ইমতিয়ার শামীমের লেখা একেবারে নির্মোহ নয়, বামপন্থীদের প্রতি তার রাগটা কম, এমনটা মনে হয়েছে। আওয়ামী পন্থীদেরকে মন্দের ভালো মনে হলেও হতে পারে। সামরিক শাসনকালে হয়তো খুব প্রিয় মানুষদের হারিয়েছেন তিনি, সেই দুঃস্বপ্ন ভোলবার নয়। আর জামাত-শিবির? হেল নো! ইমতিয়ার শামীম পড়ালেখা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিবিরের জান্তব মূর্তি তিনি ভালোমতোই দেখেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রভাবে জামাত-শিবিরের প্রতি লেখকের ঘৃণাটা বেশি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি চরম বামপন্থী সন্ত্রাসী, সুযোগ সন্ধানী সন্ত্রাসী, স্বৈরাচারী সন্ত্রাসী এবং ধর্মীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য দেখি না। সবাই তাদের সময়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, সবাই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত কোটেশনের ছায়া অবলম্বনে একটা কথা লিখি: All terrorists are equal, but some are more equal than others -এমন মতবাদে আমি বিশ্বাস করি না।
লেখকের কিঞ্চিৎ বায়াস থাকলেও পাঁচে পাঁচ না দিলে তৃপ্তি পাবো না। ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে উপন্যাসে। আর পুরো সময়জুড়ে তাঁর জাদুকরী লেখার মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম!
শেষ কবে এরকম মুগ্ধতা নিয়ে বই শেষ করেছিলাম মনে পড়ছে না। মশিউল আলমের "ঘোড়া মাসুদ" এর কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে তারো আগে পড়া শহীদুল জহিরের লেখা, কিংবা ইলিয়াসের লেখা।...ভালো থাকুন ইমতিয়ার শামীম, ভালো থাকুক বাংলা সাহিত্য।
মনে হলো অনেকদিন পর একটা 'সত্যিকারের' উপন্যাস পড়লাম।
জীবনানন্দীয় স্টাইলকে ছুঁয়ে দগদগে ক্ষত দিয়ে শুরু , তারপর ক্ষত থেকে বিক্ষত হতে থাকা রক্তাক্ত ইতিহাস আর চিন্তার অর্কেস্ট্রা, শেষে জলন্ত অঙ্গার কন্ঠে চেপে শব্দহীন হয়ে যাওয়া, উপন্যাসের গতিপথ এই। কিন্তু কেবল 'এই' বলে এর যাত্রাকে সীমাবদ্ধ করা অসম্ভব।
এই যাত্রার সূচনা করেছে তথাগত। সে হেঁটে গেছে যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক উথালপাতাল সময়ের পথ দিয়ে। এক তথাগত বুদ্ধের যাত্রা ছিল দুঃখ ভরা সংসারের মোহ ভেঙে নির্বাণ লাভের পথে , আর আমাদের তথাগত'র যাত্রা বুকে উজ্জ্বল টকটকে ক্ষত বেঁধে সময়ের ওপরে বসে নির্বাণের পথে হাঁটা।
"আমরা হেঁটে চলি। মা আমাদের জন্যে রান্নাঘরে চুলা জ্বালে, রান্না শুরু করে। তার কপালে এক-একটা শিশির ফুটে ওঠে উনুনের আঁচে আর এক-একটা মানুষ-তাড়ুয়া আবারও মানুষ হয়ে ওঠে। মানুষ হয়ে উঠে তারাও আমাদের হাত ধরে হাঁটতে থাকে। গ্রাম পেরিয়ে নদী পেরিয়ে খাল পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে আমরা হেঁটে চলি, মায়ের কপালে শিশির ফুটতে থাকে, আমাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমাদের গতি থামানোর জন্যে বাহিনীর পর বাহিনী আসে, মুজিব বাহিনী আসে, রাত বাহিনী আসে, রক্ষী বাহিনী আসে, লাল বাহিনী আসে, গণ বাহিনী আসে, জলপাই বাহিনী আসে, রগকাটা বাহিনী আসে, ফতোয়াবাজ বাহিনী আসে, ঠোলা বাহিনী আসে, ঈগল বাহিনী আসে, পেঙ্গুঈগল বাহিনী আসে, বাহিনী আসতেই থাকে, বাহিনী আরামে দাঁড়ায়, সোজা হয়, ডানে ঘোরে, বামে ঘোরে, ফরোয়ার্ড মার্চপাস্ট করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, আমরা থামি না, তারা আমাদের হত্যা করে, কিন্তু মায়ের কপালে শিশির ফুটতেই থাকে, আমরাও পুনর্জন্ম নিতে থাকি,আমরা তাদের ব্যূহ ভেদ করে বেরিয়ে এসে হাঁটতে থাকি, হাঁটতে হাঁটতে আমরা তরুণ হয়ে উঠি, এত তরুণ যে আমাদের কিশোর মনে হয়, এত কিশোর যে আমাদের বালক মনে হয়, এত বালক যে আমাদের শিশু মনে হয়, আমরা হাজার হাজার শিশু হুটোপুটি করতে করতে, পাখির কিচিরমিচির তুলতে তুলতে নদীর মতো কলকলিয়ে, বানের পানির মতো খলখলিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি, বাড়ির উঠোনে এসে হল্লা করতে থাকি, মা বেরিয়ে আসে, মা বাবার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে, মা'র কপালের শিশির গড়িয়ে পড়তে থাকে মাটির উপর, মা তা একটুও মোছার চেষ্টা করে না, মা কেবল আমাদের দিকে তাকিয়ে মায়া-মায়া চোখে অবিরাম হেসে চলে.. আর আমাদের সবাইকে ধোঁয়াওড়া রোয়া রোয়া ভাত বেড়ে দিতে থাকে।"
আলোর থেকে অন্ধকারের দিকে কেউ যেন জোর করে টেনে নিয়ে চলেছে তথাগতকে। তাও নেভাতে পারেনি তার মধ্যে বেঁচে থাকা লেলিহান শিখা। বাবার বলা গল্প, মনীষার হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখা হাত, মারিয়ার হাজারো স্বপ্ন, মামুনের গান, বাঁচিয়ে রেখেছিল তাকে। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তী বঙ্গভূমি তথাগতর থেকে কেঁড়ে নিয়েছে তার বাড়ি ফেরার সমস্ত রাস্তা। তাই মৃত্যু মিছিলে পা বাড়িয়ে সবার মত সেও হেঁটে চলেছে হারিয়ে যাওয়া মাতৃভূমির খোঁজে। লেখক কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় তীব্র সুখের সময়ে, তীব্র বেদনার বিষ একটু করে মিশিয়ে দিয়েছেন তা ব্যখ্যার অতীত। মাটির আলপথ বেয়ে ছুটে চলার আনন্দে যখনি চোখ বুজেছি, মানুস-তাড়ুয়া হয়ে গলা কাটা লাশ, বাস্তবের মতো আমার গলা টিপে ধরেছে। এ বিভৎসতা এড়িয়ে চলবো বলেই হয়তো আমিও তথাগতর মত আকড়ে ধরে বাঁচতে চাই চুক, গে কিংবা হেক্টরকে। সবশেষে, হারুণ আহমেদ মহাশয়কে অনেক ধন্যবাদ, এই বইটি পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
আমি কিছুদিন বই পড়বো না, বলতে গেলে বই পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। কারণ আমি এই বইয়ের মোহ আরো কিছুদিন জাগিয়ে রাখতে চাই। আরো কিছুদিন এই বইয়ের যে বর্ণমালাযুগে তৈরী বিস্ময়করা বাক্যগুলো, সে বিস্ময় নিয়ে থাকতে চাই, ভাবতে চাই আরো কিছুদিন। বইটি না পড়েও কিছুদিন মনোযোগী থাকতে চাই বইটি নিয়ে। বইটি পড়ার সময় সবকিছু থমকে যাওয়ার মত যে অনুভূতি, তা জাগিয়ে রাখতে চাই আরো কিছুদিন
বিষন্নতায় ঘেরা এ যেন অদ্ভুত এক রাজনৈতিক আখ্যান। সেই একাত্তরের পর থেকে ঘটনা গুলো যেন উঠে এসেছে তীব্র সত্য আর মূরাকামি ধাচে। তারপরও এত ভিন্ন, এত অসাধারণ।
এতো এতো তেতো সত্য বুকে চাপ তৈরি করে। হঠাৎ রঙিন চশমার অপরিহার্যতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাওয়ায়। আচ্ছা, এই যে আমরা নানাকিছু না দেখে থাকার ভান করে বেঁচে আছি, তা আমাদের আত্মা বাদে আর কি কি নিয়ে যাচ্ছে? যখন এরকম উপন্যাসের ছদ্মবেশে আজকের সময়টা নিয়ে ইতিহাস লিখবে কেউ, তখন অসীম উন্নাসিকতার নজিরটুকু টের পেয়ে সেই পাঠকও এখন এই বই পড়ে যা টের পাচ্ছি, তা পাবে কি? এক দু্ষ্ট চক্রের খপ্পরে পড়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হতে থাকা আমরা যাকে ভবিতব্য ভেবে ভালো দিনের আশায় দিন গুনছি, তা সবসময়ে এক মন্দের ভালো হয়ে গলায় আটকে থাকবে। তথাগতের বাবার পোড়ানো বইগুলোর সাথে আমরাও হাঁটতে হাঁটতে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছি। জেনে গেছি অভিজ্ঞতা দিয়ে যে কাঁটা আটকে থাকা গলা একেবারে কোন গলা না থাকার চেয়ে ঢের ভালো।
কিছু বই রেটিং এর উর্ধ্বে থাকে, পাঁচ তারাও কম হয়ে যায়। ইমতিয়ার শামীমের 'আমরা হেঁটেছি যারা' তেমনই একটি বই, যার রিভিউ লেখার সাধ্য আমার নেই। আর ইমতিয়ার শামীমে বারবার এতই মুগ্ধ হচ্ছি যে তাঁকে নিয়ে নতুন করে বলার মতোও কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
নিষ্ঠুর। সুন্দর। অনেকদিন পর একটা বই পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। কিভাবে যে বর্ণনা করবো তা বুঝে উঠতে পারছি না। বই এর প্রতিটা পৃষ্ঠা যেনো দুঃখের একেকটি মুক্তো হয়ে জমতে জমতে মুক্তোর পাথর হয়ে বুকে কষ্টের ভার বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। উদ্বেগ, আশঙ্কা, মৃত্যু আর বিষাদকে লেখক এমন ভাবে শব্দজালে বুনেছেন যে সেগুলো পড়ে বুক ভারী হয়ে ওঠলেও, চোখ বিদ্রোহ করে বসে, চোখে পানি আসে না, কিন্তু মনে হয় একটু কাঁদলে হয়তো ভালো লাগবে। একটা বই যখন খুব ভালো লাগে তখন মনে হয় চারপাশের সবাইকে বলি বইটা পড়ো, বইটা পড়ো। এই বইয়ের অর্ধেক শেষ করার পরই আমি মোটামোটি প্ল্যান করে ফেলেছি এর পর কাকে কাকে এই বইটা পড়তে বলবো। এতো সুন্দর বই! এই বই নিয়ে কোনো রিভিউ না, সরাসরি বই পড়ে ফেলা উচিত।
গল্পটা তথাগত নামক একজনের বেড়ে উঠার গল্প।যার জন্ম স্বাধীনতার কিছু আগে।তথাগত মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলো ভারতের শরনার্থী শিবিরে তারপর একে একে তার বেড়ে উঠার সাথে সে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে এই দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে।একে একে আসে সর্বহারার দল,রক্ষীবাহিনী,জাসদের গণবাহিনী,আর্মি,আসে জামাত শিবির ইত্যাদি ইত্যাদি।এসব বিভিন্ন বাহিনী আর রাজনৈতিক দলবাজিতে নষ্ট হয়ে যায় শুধুমাত্র মানুষের জীবন।হাপিত্যেশ করে একটু দম নেয়ার জন্যে।
'আমরা হেঁটেছি যারা' বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার গল্প।মানুষের হেরে যাওয়ার গল্প।হতাশার গল্প।অবলীলায় এসব অপ্রিয় কথাগুলো বলার জন্যে লেখককে ধন্যবাদ।
ইমতিয়ার শামীমের লেখার ধাঁচ অনেকটা হুমায়ুন আজাদের মতো।হুমায়ুন আজাদের মতোই তিনি ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে তুলে ধরতে পারেন দেশের রাজনৈতিক দুরাবস্থার কথা।সম্ভবত লেখকের অনুপ্রেরণা হুমায়ুন আজাদ (আমার ধারণা)।লেখকের আরও এক দুইটা বই পড়লে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে।তবে পড়তে ভালো লাগে।হুমায়ুন আজাদের ফিল পাওয়া যায় (পজিটিভলি বলছি)।
বইটিকে এক তারা কম দিয়েছি দুটি কারণে - এক.তথাগত'র বাবার মুক্তিযুদ্ধের পরে জাসদে যোগ দেয়ার কোন যথাযথ ব্যাখ্যা খুঁজে পাই নি। দুই.তথাগত'র বাবা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলে তাদের আর্থিক দুরাবস্থা দেখা দেয়।দিনে এক বেলাও ঠিকভাবে খেতে পায় না এমন অবস্থা।কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর পর তাদের অবস্থা সেরকম হয়নি।ব্যাপারটা কনফিউজিং!
কিছু বই থাকে পড়ার পর মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। তারপর আস্তে আস্তে রাশি রাশি চিন্তা এসে হানা দেয় মস্তিষ্কে। এখন আমার সেই অবস্থা। লেখতে ইচ্ছে করছে না,ইচ্ছে করছে তথাগতের সাথে পথ হাঁটি,মামুনের গান শুনি; তাদের দলের সাথে মিশে যাই... তবু আমি লিখছি,কারণ আমি চাই একটা ভালো বইয়ের কথা মানুষ জানুক।
"আমরা হেঁটেছি যারা" যুদ্ধ পরবর্তী একটা পরিবারের গল্প। আরো সূক্ষ্মভাবে বললে,যুদ্ধ পরবর্তী একটা টলমলে দেশের গল্প।তথাগত,মনিষা,মারিয়া,মামুনের মতো সাহসী অসহায় মানুষের কথা।
কি দারুণ লেখা। মোহময়। এই বইটাতে একেবারে বুঁদ হয়ে ছিলাম। ভালো বই বুঝি এমনি হয়। অনবদ্য।
বইটার এত বেশি রিভিউ লেখা হয়েছে যে আর তেমন কিছু বাকি নেই বলার মতো। অভিযোগ শুধু দু'টো জায়গায়। ১. ইমতিয়ার শামীমের বই বাজারে সহজলভ্য নয়। কিনতে গেলে বেশ হ্যাপা নিতে হয়। রকমারি থেকে কিংবা আজিজ থেকে কিনতে হয়। অনেকে আজিজে গিয়ে প্রিন্ট আউট হয়ে যাওয়ায় বইও পান না। এর কারণ কি লেখকের নিরুৎসাহ নাকি নিম্ন মানের প্রকাশনার নিম্ন দৃষ্টিসমপন্ন মার্কেটিং? ২. ঔপন্যাসিক বলতে হুমায়ূন আহমেদ বাদে শহিদুল জহির বা শাহাদুজ্জামান যেভাবে আলোচিত হন ইমতিয়ার শামীম তার ধারেকাছেও হন না। কেন হন না সেটা আমার জানা নেই। লেখার মান হিসেবে আমার কাছে ওনাদের চেয়ে ইমতিয়ার শামীমকে কিছু জায়গায় এগিয়ে থাকতে দেখেছি বলে আমার মনেহয়। এর কারণ কি হতে পারে? ঘনীভূত লেখার ধরন? ভাবের জমাটবাধা প্রকাশ? লেখনীশৈলির বিশেষ ধরন? নাকি অন্যকিছু?
ইতিহাসকে নিজের ভাবের সাথে মিশিয়ে এভাবে প্রগাঢ় রুপে লিখতে আমি অন্য কোথাও দেখিনি। সম্ভবত যাদের ভালো লাগে ওনার লেখা নিজেকে রিলেট করতে পারার কারণে ভালো লাগে। বাক্য বিন্যাস বা শব্দের কাঠামোগত স্বকীয়তা থাকায় একদম র' স্বাদ পাওয়া যায়। যেটা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। তবে আমার কাছে উপন্যাসের প্রথমার্ধ বেশি ভালো লেগেছে শেষের চেয়ে। তাই সম্ভবত রেটিং ১ টা কম দিয়ে ফেললাম।
ক্ষয়ের গল্প অনেক রকমভাবে বলা যেতে পারে, বা তা অনেক রকমের হয়। উপন্যাসের জগতে ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষরণের প্যারালালে সমাজের বা রাষ্ট্রের ক্ষরণ দেখাতে পারাটা এক রকমের বিশেষ ঐতিহ্য অনেক কাল আগে থেকেই। তবে আমাদের তো আধুনিকের পরের যুগ, আর আধুনিকোত্তর উপন্যাস মেলোড্রামা দূর - প্লট, এমনকি চরিত্রগুলোকেও তেমন স্কোপ দিতে চায় না। মাল্টিলেয়ার্ড হবার আকাংখ্যা তার থাকে, কিন্তু চরিত্র বা গল্প জমাট বাঁধার বিপক্ষে তার অবস্থান, সে শুধুই যেন বা সূর্য ডোবার সময় কিছু ঝোড়ো বাতাসের মাঝে আবিরের রঙ, বাতাসে ভেসে আসা ফিনাইলের ঘ্রাণ এবং অনেক দূর থেকে আসা কোলাহলের মত, শোঁকা যায় শোনা যায়, খানিকটা দেখাও হয়ত যায় অথচ ছোঁয়া যায় না।
ইমতিয়ার শামীমের আমরা হেঁটেছি যারা গত শতাব্দীর একেবারে শেষ বছরগুলোয় লেখা। প্রকাশিত হয়েছিল এই শতাব্দীর শুরুতে। এবং এরও দুই দশক পর আমি যখন বইটা পড়লাম, লেখকের এক প্রজন্ম পরের মানুষ হিসেবে কিভাবে আমি একে বুঝে নেব? আমার মাথায় ঝড় তোলে যে কোন লেখকের উপন্যাস রচনার উদ্দেশ্য, তার প্রকরণ, তার সফলতা-ব্যার্থতার রাফখাতা। আপনি যদি শুধু স্মৃতিচারণকে মূখ্য করে তুলতে চান, আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে বর্তমান থেকে আপনি অদৃশ্য, স্মৃতির মাঝেই বারবার বেঁচে উঠতে চাইছেন। কিন্তু স্মৃতি ব্যবহার করে উল্টো কাজও কী করা যায় না? ধরেন, লিখলেন এমন স্মৃতির কথা, পাঠক চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবে না যে এই স্মৃতি তার পূর্বপুরুষেরও স্মৃতি যেহেতু সেও এই মহাপৃথিবীর মহাজনপদেরই উত্তরাধিকার, যে ক্ষয় ও ক্ষরণের মধ্যে দিয়ে চরিত্রগুলো এগিয়ে যায় পঠিত উপন্যাসের জগতে, তাদের সাহিত্যিক বাস্তবতা বিদ্রূপের স্বরে যেন বলতে থাকে - যাপন করা বাস্তবতার থেকে তার পার্থক্য বিশেষ নেই, অতীত তার চেহারা কিছুটা বদল করে বর্তমানেও রাজত্ব করছে।
উপন্যাসের ঘন শব্দের জালে আমরা হেঁটেছি যারা সেই সময়ের গল্প করে যখন স্বাধীন দেশের ক্ষমতার খেলা চলছে যেন দূর থেকে অন্য কারও চেলে রাখা দাবার ছক অনুসারে। এই খেলাকে সফল করে তুলছে উঁচু থেকে প্রান্তিক, সকল পর্যায়ের লোভী মানুষেরা, যারা এই দেশেরই সন্তান। কাক কাকের মাংস খায় না, কিন্তু মানুষ মানুষের মাংস খায় - এই কালো সত্য এই দেশের ইতিহাসে দগদগে এক ক্ষত হয়ে আছে, ইমতিয়ার শামীম কি সেই কথাই ধরে রাখতে চেয়েছেন? নিশ্চয়।
আর সেই ইতিহাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকেছে মামুনের মত চরিত্র। যারা সব কিছু তুচ্ছ করে মাটির বুকে শক্ত পায়ে দাঁড়ায় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে মাথা উঁচু করে। থাকে মনীষার মত প্রেমিকা, মারিয়ার মত স্নিগ্ধতা। পৃথিবীর অন্ধকার চক্র যাদের গিলে খায়। হিউম্যান স্পিরিটের এক নড়বড়ে যায়গায় দাঁড়ানো উপন্যাসের কথক তথাগতকে আমি দেখি সে এতসব মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই কিনা, একজন নায়ক হয়ে উঠতে চেয়েছে, তাকে পলায়নপর আর আমরা বলে উঠতে পারি না। আজকের বাংলাদেশ যে ইতিহাসের ফলাফল হয়ে ধুঁকে চলল, সেই ইতিহাসের ধারাভাষ্য আমরা হেঁটেছি যারা। এই উপন্যাস যেন বা তথাগতর মতই, নীরবে নিজের বক্তব্য ধরে রেখেছে। যে বক্তব্য এদেশের শাসকেরা প্রতি যুগে বালির নিচে চাপা দিতে চেয়েছে। পারেনি কি? মনীষার মত ভাগ্যবতী আমরা নই, আমাদের মুখে কেউ অধরা মায়ার জাল বুনে চলে না। তবে কথা থেকে যায়। যে কথা ভুলে যাওয়ার উপায় আমাদের নেই।
আবার ফিরে যাই উপন্যাসটির নির্মাণে। প্রথমত, জিনিসটা আনপুটডাউনেবল মনে হয়েছে। একবার শুরু করলে কেউ শেষ না করে বসে থাকা কঠিন। এর নন-লিনেয়ার শরীরে শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত একটা আশংকা যাগে। বারবার মনে হতে থাকে তথাগত কি কোন আরোপিত লব্ধিতে পৌঁছাতে চায়, নাকি কাউকে দোষী করছে, আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাইছে বা দেখাতে চাইছে কোন আকস্মিক নাটকীয়তা? নাটকীয়তা বা শক দুটিই এ বইয়ে আছে, কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় অমনটি ছাড়া আর কীই বা হতে পারত? আর, শেষ পর্যন্ত তথাগত কিছুই চায় না পৃথিবী থেকে। তার লক্ষ্য এক খণ্ড নির্বাণ। সেখানে এ উপন্যাস এক আশ্চর্য স্বকীয় অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে তার যাবতীয় সম্ভাবনা নিয়ে।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্বাধীন দেশের একটা চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক, কতগুলো নির্মম সত্য প্রকাশিত হয়েছে, বিভৎস অত্যাচার এর বিবরণ গুলো পড়ে শিউরে উঠেছি কতবার! একটা পরিবার একসাথে হাঁটার গল্প, একে একে হারিয়ে যাওয়ার গল্প, হারিয়ে ফেলার গল্প, হারাতে হারাতে নাই হয়ে যাওয়ার গল্প 'আমরা হেঁটেছি যারা'। আমরা যারা হাঁটি নি তাদের জন্য একটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি হওয়ার গল্প।
কতটা বিষণ্নতা, কতটা মন খারাপ উপহার দিয়ে যেতে পারে একটা বই শ্রদ্ধেয় ইমতিয়ার শামীমের ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ সেটার ভালো উদাহরণ। বইটার প্রেক্ষাপট রাজনৈতিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়, আরও ভালোভাবে বলতে গেলে পঁচাত্তরের ঠিক আগে, পঁচাত্তরের পর, সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন, রাজনৈতিক অরাজকতা এসব প্রেক্ষাপটের মধ্যে দিয়ে একজন সাধারণ ছেলের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা হয়েছে, যার পিতা ছিল একজন সক্রিয় জাসদ কর্মী। বইটাতে উঠে এসেছে সেসময়কার রাত বাহিনী, রক্ষীবাহিনী, জলপাইবাহিনী(আর্মি), ছাত্র শিবির সবার সৃষ্টি নৈরাজ্য ও অরাজকতার ইতিহাস। যেসবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নিতান্ত-ই সাদাসিদে তথাগত নামক ছেলেটিকে। যাকে একসময় পোহাতে হয় চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি।
ইমতিয়ার শামীমের গল্প বলার ধরণের মধ্যেই একধরণের মায়া আছে। কখন পরবাস্তবতা, কখনো নির্মমতা আর কখনো কঠিন বাস্তব, এত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন যেন সব চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। অন্তরে গিয়ে আঘাত হেনেছে, শেষ বিকেলে উপহার দিয়ে গেছে এক পশলা বিষণ্নতা। নতুন করে উপলব্ধি করা গেছে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের দীর্ঘসময় ধরে চলা রাজনৈতিক অরাজকতা। কখনো বাকশাল, কখনো স্বৈরাচার, কখনো সামরিক শাসন, কিভাবে প্রভাব ফেলেছে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রায়, খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেটা। লেখকের লেখনি এতই শক্তিশালী, পড়ার সময়ে যা আপনার মনোজগতে আলোড়ন তুলতে বাধ্য। দীর্ঘদিন মনে থাকবে বইটার কথা, দীর্ঘদিন মনে থাকবে ঐ অস্থির সময়টাতে ‘যারা হেঁটেছিল’ তাদের কথা 🙂
বইয়ের প্রথম ত্রিশ পৃষ্ঠা পড়তে খুবই কষ্ট হয়েছে। এত দীর্ঘ বাক্য, এত কমা'র ব্যবহার, তাল রাখতে পারছিলাম না। আরেকটা ব্যাপার হলো, লেখক খুব দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করেন। এটা একটা সমস্যা বটে। তবে একবার তার গীতল গদ্যভঙ্গির ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পরে টানা পড়তে পেরেছি। উপন্যাসের কাহিনী একাত্তর পরবর্তী সময় থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত। মোটামুটি উল্লেখযোগ্য সব ঘটনা লেখক কাভার করেছেন। কখনও প্রতীকের আড়ালে, কখনও সরাসরি। যারা চোখ কান খোলা রাখে, তাদের বুঝতে সমস্যা হবে না। বেশ অকপটতা এবং সাহসের সাথেই বলা হয়েছে এসব। খুনাখুনি, মারামারি, টর্চারের সাথে সমান্তরালে চলেছে প্রেম আর মানবিকতা। যাদের ডিস্টোপিয়ান সমাজ নিয়ে আগ্রহ আছে, তারা পড়ে অনাবিল সুখ পাবেন। হুমায়ুন আজাদের "ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল" যাদের ভালো লেগেছে, তারা এটা পড়ে দেখতে পারেন।
এমন মেদহীন ভাবে জীবন-রাজনীতির মোড়কে সময়ের গল্প পড়া হয় নাই অনেকদিন।আরো আলোচনার দাবি রাখে এই বই। সম্প্রতি বইমেলা-২০২০ এ পেণ্ডুলাম পাবলিশার্স বাজার থেকে হারাইয়া যাওয়া এই বই এর নতুন সংস্করণ বের করছে।
কিছুদিন ধরে ৫ স্টার দেয়ার মতো অনেক ভালো ভালো বই পড়লাম এই বইটিও তার অন্যতম।
কিছু বই থাকে যা আমাদের রেটিং দেয়ার উর্দ্ধে এই বইটি আসলে তাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময় নিয়ে অনেক বই পড়েছি কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তীকালীন বই খুব কমই পড়েছি আর যাও কিছু পড়েছি সব ছিলো পক্ষপাতিত্ব দোষে বিলীয়মান।
৭১ পরবর্তী সময় থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র বনাম সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে চমৎকার লেখনশৈলী। এসেছে হাজার পুরনো উপজীব্য, ধর্মব্যবসা, চিরায়ত রাজনীতিতে মুনাফা লুটে নেওয়া শোষণকারীদের কথা। জিয়ার সাথে এসেছে রাজাকারদের প্রশ্রয়দানের কথা।
এখানে ফুটে উঠেছে শেখ মুজিবের যোগ্য মানুষদের সরিয়ে অযোগ্যদের স্থান দেয়া। ছাত্র আন্দোলন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের গল্পগুলো।