‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’ ঊনিশ শতকের শেষ ত্রিশ বছর এবং বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের স্মৃতিচারণা।
ন্যূনধিক পঞ্চাশ বছরের আখ্যানে তৎকালীন বাংলার সারস্বত-সমাজ প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রাধান্য পেয়েছে এবং বাংলাসাহিত্যের কর্মযজ্ঞে সেইসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
Rai Bahadur Dinesh Chandra Sen (Bengali: দীনেশ চন্দ্র সেন) was a Bengali writer, educationist and researcher of Bengali folklore. He was the founding faculty member and the Ramtanu Lahiri Research Fellow of the Department of Bengali Language and Literature of the University of Calcutta.
In 1882, he passed his University Entrance examination from Jagannath University in Dhaka. In 1885, he passed his F.A. examination from Dhaka College. He passed his B.A. examination with Honours in English literature in 1889 as a private student. In 1891, he became the headmaster of the Victoria School in Comilla. During 1909-13, he was a Reader in the newly founded Department of Bengali Language and Literature of the University of Calcutta. In 1913, he became the Ramtanu Lahiri Research Fellow in the same Department. In 1921, the University of Calcutta conferred on him the Doctorate of Literature in recognition of his work. In 1931, he received the Jagattarini gold medal for his contribution to the Bengali literature. He retired from service in 1932.
He worked on collection and compilation of Bengal folklore. Along with Chandra Kumar De, he published Mymensingh Gitika (Ballads of Mymensingh), a collection of 21 ballads.
জসীমউদদীনের 'জীবনকথা' যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জনেন, কবির গদ্য কত সারল্যমাখা ও সুপাঠ্য। বাংলায় এমন সহজিয়া ভাষায় লেখা আত্মস্মৃতি বিরল। দীনেশচন্দ্র সেন আমৃত্যু জসীমউদদীনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পূর্ববঙ্গের মানিকগঞ্জের সন্তান দীনেশচন্দ্র সেনের আত্মকথায় আবার স্বাদ পেলাম সুন্দর গদ্যের। যেখানে দীনেশচন্দ্র সেন তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা এত সহজভাবে লিখেছেন যেন মনে হবে, মজলিশে বসে কথা বলছেন। কোনো ভণিতা নেই, নেই গাম্ভীর্যের নামে শব্দের কারসাজি। কবি জসীমউদদীনের গুরু দীনেশচন্দ্র সেনের প্রায় তিন শ পাতার আত্মকথার প্রকাশক কবির প্রকাশনী 'পলাশ'।
মানিকগঞ্জের সুয়াপুরে জন্মেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। তা-ও কমসেকম দেড় শ বছরের বেশি সময় আগে। তখন মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে কম-বেশি তিন দিন লাগত! পুরোনো ঢাকায় স্কুলে পড়েছেন দীনেশচন্দ্র সেন। তখনকার পুরান ঢাকার সঙ্গে আজকের পুরান ঢাকার খুব বেশি তফাৎ পাঠক খুঁজে পাবেন না। যেমন: দীনেশচন্দ্র সেন দেখেছেন, ঢাকাবাসী মশায় কাবু। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যায়। তখন হাঁটাচলা করা মুসকিল হয়ে ওঠে। মুসলমানদের জন্য স্থায়ী গোরস্থান ছিল না। তাই মরদেহ যেখানে-সেখানে কবর দেওয়া হত। আর, বন্যা কিংবা বর্ষার মৌসুমে পানিতে কবর ডুবে লাশ বেরিয়ে পড়ত। অনেক সময় দুর্গন্ধে চলাচল করা অসম্ভব হতে পড়ত।
দীনেশচন্দ্র সেন তখন স্কুলের ছাত্র। ঢাকায় কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ল। দিনরাত মানুষ মরছেই। গোর দেওয়া লোক নেই। দাহ করার মানুষের সংকট। ভয়ে সহজে কেউ আসে না। ঢাকা ছেড়ে পালানোর একটা ঝোঁক তৈরি হলো। শতবর্ষের আগের কথা। দীনেশচন্দ্র সেন দুঃখ নিয়ে লিখেছেন, জনগণের ভয়কে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি যানবাহনের ভাড়া বেড়ে গেল। দুই থেকে তিন গুণ দাম দিয়েও নৌকা পাওয়া যায় না। ঘোড়ার গাড়ি মেলে না। দীনেশচন্দ্র সেন নিজেও ভয় পেয়েছেন। মানিকগঞ্জে বাড়িতে চলে যাবেন। তখন পাঁচ টাকা লাগত নৌকা রিজার্ভ করে গেলে। মাঝি মওকা বুঝে প্রায় এক শ টাকা চাইল! দীনেশচন্দ্র সেনের এই ঘটনার সঙ্গে করোনার সময়কে আতংককে পুঁজি করে মাস্ক ব্যবসায়ীদের 'ব্যবসার' কথা মনে পড়ল। প্রতি ঈদেই ভাড়া বেশি নেওয়ার অপসংস্কৃতি তো রইলই। অর্থাৎ এক শ বছরে আমাদের খাসলত জাররা পরিমাণ বদল হয়নি।
দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পেছনের কাহিনি সুন্দরভাবে শুনিয়েছেন। বেশ গল্পের মতো লাগে। কোনো আড়ম্বর নেই। বরং বিনয়াবনত সেই বর্ণনা।
পূর্ববঙ্গবাসীকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা সহজভাবে কখনোই গ্রহণ করতে পারেনি। হোক তা হিন্দু কিংবা মুসলমান। তরুণ দীনেশচন্দ্র সেন তখনো ত্রিশ পার হননি। কুমিল্লায় শিক্ষকতা করতেন। সেই সময় বাংলা সাহিত্য জগতের নক্ষত্র বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন পূর্ববঙ্গের দীনেশচন্দ্র সেন। দেখা হওয়ার আগে ভেতর ভেতর উত্তেজনায় যেন ফুটছেন। সাহিত্যের কোন কোন বিষয় নিয়ে আলাপ করবেন - তা চিন্তা করতেই তার ঘুম হারাম। সাক্ষাৎ করতে গেলেন বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে। তরুণ দীনেশচন্দ্রকে নামধাম জিজ্ঞেস করলেন বঙ্কিমচন্দ্র। লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন, তার কথায় তখন আঞ্চলিকতার টান সাফ বোঝা যায়। বঙ্কিমচন্দ্র যখন শুনলেই তার সাক্ষাতপ্রার্থী তরুণটি পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছে, তখন আলাপের ভঙ্গি বদলে গেল। পুরো সময়টুকু তিনি পূর্ববঙ্গের কৃষিকাজ নিয়ে কথা বললেন। চাষবাস নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। একবারও সাহিত্য নিয়ে দীনেশচন্দ্রের সঙ্গে কথা বললেন না। ও-মুখো তিনি হলেনই না। এভাবেই বহুল প্রত্যাশিত সাক্ষাৎকার সমাপ্ত হলো কৃষক ও কৃষিকাজ ইত্যাদি নিয়ে আলাপের মাধ্যমে। দীনেশচন্দ্র সেন অত্যন্ত বেদনা নিয়ে বৃদ্ধ বয়সে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাকে সাহিত্যালোচনার যোগ্য জ্ঞান করেনি ও হেয় চোখে দেখেছেন তার প্রধান কারণ দীনেশচন্দ্র সেন পূর্ববঙ্গের - এমনটাই মনে করতেন দীনেশচন্দ্র সেন। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সাহিত্যিকদের জগতে পূর্ববঙ্গীয় কেউ প্রবেশ করুক তা তারা চাইত না - এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন দীনেশচন্দ্র সেন।
অসুস্থতা, আত্মীয়স্বজনের প্রকৃত রূপ ও অনাত্মীয়ের পরম সুহৃদের মতো এগিয়ে আসার কথা আবেগ নিয়ে লিখেছেন দীনেশচন্দ্র সেন। পড়তে গিয়ে মনে হলো, কৃতজ্ঞতাস্বীকার তাঁর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। কত শত লোকের অবদানের কথা স্মরণ করে ঋণস্বীকার করলেন তার হিসাব রাখা কঠিন।
এই বইয়ের একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম ইতিহাসমূলক গ্রন্থ 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' নিয়ে আলাপ। সেই আলাপের সবটুকু ভালো লাগেনি। একমাত্র এটিই বইটির খামতি। নতুবা যে কোনো বিচারে বইটি পাঁচ তারকা পেতে পারে।
সামাজিক জীবনের ইতিহাস হিসেবে দীনেশচন্দ্র সেনের আত্মকথার আলাদা মূল্য রয়েছে। সাহিত্যজগৎ নিয়ে অনাগ্রহী পাঠকের জন্য বইটির মূল আকর্ষণ হবে, সহজসরল গদ্য। এমন বলার ভঙ্গি নিঃসন্দেহে পাওয়া যায় না। সবমিলিয়ে, চমৎকার একটি আত্মস্মৃতি। পড়লে ঠকবেন না।