’কাঁহা গেলে তোমা পাই ১ম খন্ড’ প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। প্রচুর জনপ্রিয়তা পায় বইটি। উপন্যাস আকারে শ্রীচৈতন্য এর অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে লিখেছেন বইখানা। তবে আফসোসের বিষয় লেখক খুবই ইন্টারেস্টিং একটা জায়গায় এনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন (২০১৭ সালে) বিধায় ২য় খন্ড আর আমরা পাবো না। ২য় খণ্ডে হয়তো যুক্তিযুক্ত একটা সমাধান পেতাম আমরা।
চৈতন্য এর অন্তর্ধান নিয়ে কয়েকটি থিওরি জানতাম : ১. কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে বাহ্যজ্ঞান লোপ পায় আর সে সময়ে তিনি পুরীর সমুদ্রে ঝাপ দেন। তাঁর দেহ আর খোঁজে পাওয়া যায়নি। ২. পুরীর টোটা গোপীনাথ মন্দিরের গোপীনাথ ঠাকুরের মূর্তিতে তিনি মিশে গেছেন। ৩. পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের জগন্নাথদেবের দারুময় মূর্তিতে বিলীন হয়েছেন। ৪. মন্দিরের পান্ডাগণ মিলে উনাকে হত্যা করে মন্দিরের মধ্যেই দেহ সমাহিত করে ফেলেছে। ৫. রথের চাকা পায়ের ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার পর অথবা বা রথ টানতে গিয়ে পায়ে ইটের আঘাত লেগে সেপটিক হয়ে তিনি মারা যান। গোপনে উনার দেহ মন্দিরের বাগানে সমাহিত করা হয়।
এখন জয়দেববাবু নতুন আরেকটা কথা শুনালেন এই বইতে। ৬. শ্রীচৈতন্য মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করার পর দরজা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায় অথবা কেউ বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার পর ভক্তগণ মন্দিরের পান্ডাদের ডাকাডাকি হাকাহাকি করার সময়ে দেখতে পায় মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসী বের হয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই বলছেন তিনিই চৈতন্য, সন্ন্যাসীরূপে পুরী ত্যাগ করেন।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে জয়দেববাবু এখানে শ্রীচৈতন্যকে মিশাচ্ছেন কর্তাভজাদের আদি গুরু আউল চাঁদ বা আউলিয়া চাঁদ এর সঙ্গে। যদিও টাইমফ্রেম মিলছে না। তারপরও চিন্তা-ভাবনার জন্য নতুন একটা থিওরি পাওয়া গেল।
যে বা যাঁরা এই বইটির পরিচিতি হিসেবে "শ্রীচৈতন্য-অন্তর্ধান বিষয়ক একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ" তকমাটি জুড়েছেন, তাঁদের মতো অশিক্ষিত বা মিথ্যেবাদী এই বাংলাতেও বিরল। কেন? একে-একে লিখি। প্রথমত, এই বইটির জন্য এমন কোনো উপাদান ব্যবহার করা হয়নি যা অন্যান্য গবেষকদের হাতে নেই। এই একই উপাদান নিয়ে কার্যত চৈতন্য অন্তর্ধান বিষয়ক কুটির শিল্প ফেঁদেছেন লেখক ও প্রকাশকেরা। তাদের মধ্যে মাত্র দু'টি বই নিরপেক্ষ গবেষণা হিসেবে পাঠযোগ্য। তারা হল~ (ক) তুহিন মুখোপাধ্যায়ের 'চৈতন্যের শেষ প্রহর' (পত্রলেখা) ও (খ) রজত পালের 'চৈতন্য: শেষ কোথায়' (বইচই)। বাকি সবই সস্তা থ্রিলারের মতো তথ্য কম, তত্ত্ব বেশি, কল্পনা সবচেয়ে বেশি— এই মডেলে কাজ করেছে। দ্বিতীয়ত, ফিকশনের আড়ালে লেখার চেষ্টা করতে গিয়ে বইটির গবেষণালব্ধ মূল্য বহুল পরিমাণে কমে গেছে। লেখকের অন্য সব লেখার মতো এখানেও একটি আত্মজৈবনিক চরিত্র আছে— এক্ষেত্রে তার নাম জয়ন্ত নয়, বরং আনন্দ। তার সঙ্গে আছে, সম্ভবত কালকূটের লেখার প্রভাবে, একাধিক তরুণী ও বয়স্কা নারীচরিত্র। সর্বোপরি এতেও এমন বেশ কিছু চরিত্র আছে যারা কলতলা, বা আধুনিক বাংলা সিরিয়ালের মতো চিৎকার আর কুশ্রী ভাষা ছাড়া অন্য কিছুর ব্যবহার করে আলোচনা চালাতে অক্ষম। তৃতীয়ত, তথা এই বইয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ, এটি যে ধরনের অনুসন্ধান করেছে তা ফেলুদার মতো নয়, বরং জটায়ুর মতো। অর্থাৎ এতে প্রথমেই একজনকে অপরাধী ভেবে নিয়ে বাকি অপরাধটি তার স্কন্ধে আরোপ করার চেষ্টা হয়েছে। সবক'টি সম্ভাবনার বিশ্লেষণ না করে এখানে প্রথম থেকেই এই ভেবে এগোনো হয়েছে যে চৈতন্যের অন্তর্ধান নয়, বরং হত্যার জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করতে চাইছে আনন্দ। এইরকম গবেষণা, আর যাই হোক, প্রামাণ্য নয়। বইটি প্রথম খণ্ড যথাযথ কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছেই থেমে গেছে। তবে হ্যাঁ, তার মধ্যে লেখক চৈতন্যদূষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং সমকালীন ইতিহাসের দিকে আমাদের নতুন করে তাকাতে উৎসাহ দিয়েছেন। এও স্বীকার্য যে ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় এবং দীনেশচন্দ্র সেন শ্রীচৈতন্যের মৃত্যু নিয়ে যে সম্ভাবনার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন, তাদের নিয়ে প্রথম সিরিয়াস কাজ এটিই। তাই এই বইয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে— এটুকুই। আর হ্যাঁ, যাঁরা ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর ফলে এই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত (এবং চৈতন্যের হত্যাকারীদের একেবারে পাকাপোক্ত চিহ্নিতকরণ) হয়নি বলে আক্ষেপ করেন, তাঁদের একটা মাথায় রাখা প্রয়োজন। ১৯৭৭ সালে এই প্রথম খণ্ড প্রকাশের পরেও কিন্তু লেখক ১৮ বছর জীবিত ছিলেন। সেই সময়ে তাঁর অন্য নানা বইপত্র প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে বেশ ক'টি ওডিশার ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়েই। কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডটি তিনি প্রকাশ করেননি। সেক্ষেত্রে তার মধ্যেই অকাট্য প্রমাণ ইত্যাদি ছিল, এমনটা ভাবি কীভাবে? ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের মতো এক অকালপ্রয়াত গবেষকের কাজগুলো নতুন করে পঠিত হওয়া প্রয়োজন। তবে গত চল্লিশ বছরের গবেষণা ও অনুসন্ধান বহু নতুন তথ্যকে আমাদের সামনে এনেছে। তাই লেখাগুলো আজকের কোনো গবেষকের সম্পাদনা দাবি করে। প্রকাশকেরা সেই বিষয়টি মাথায় রাখবেন, এমন আশা রাখি।
বইটা সম্বন্ধে বলার আগে এটা লেখার প্রেক্ষাপট তা জানা উচিত বলে আমার মনে হয় | ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ভক্তিবাদের জনক শ্রী চৈতন্যদেব মারা যান নীলাচলে এবং তার মৃত্যু নিয়ে আমরা কিছু কিছু গল্প গুজব শুনে থাকি | যেমন কৃষ্ণের নাম করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যা করেন, বা পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের মূর্তির মধ্যে তার দেহে বিলীন হয়ে যায়, অথবা রথের চাকা পরে পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হলে সেখান থেকে সেপটিক হয়ে তিনি মারা যান, সত্য মিথ্যা কোনোটিই আমার জানা নেই | অধ্যাপক ডঃ জয়দেব মুখার্জী কোনোভাবে এই গুজবগুলি অস্বীকার করে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান শুরু করেন এবং তা লিপিবদ্ধ করেন তার এই ২ খন্ডের গ্রন্থতে | তার গবেষণা অনুযায়ী চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পেছনে এক গভীর ষড়যন্ত্র ছিল যা যেভাবেই হোক চাপা পরে যাই এবং তার পেছনে অনেকাংশে দায়ী গোবিন্দ বিদ্যাধর যিনি পরবর্তী উড়িষ্যার রাজা হন | কিন্তু তার এই গবেষণায় ছেদ পরে যখন ২০১৭ সালে জয়দেব মুখার্জীর অপঘাতে মৃত্যু হয় এবং তার সাথেই চুরি যায় তার গবেষণার সমস্ত নথিপত্র | মূলত এ কারণেই আমি পড়া শুরু করি, প্রচন্ড তথ্যসম্মৃদ্ধ ও আকর্ষণীয়, কিন্তু অধ্যাপকের লেখার হাত বড়োই কাঁচা | সস্তার থ্রিলার উপন্যাস বানানোর থেকে উনি প্রবন্ধ লিখলে হয়তো ভালো করতেন |
প্রথমেই বলি মতামত ব্যক্তিগত, কারো খারাপ লাগলে আমি দুঃখিত, এড়িয়ে যেতে পারেন, অযথা তর্ক করবেন না। আমি চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান সম্পর্কে আগে কোনও বই পড়িনি, তাই খোলা মনে বইটি পড়তে বসেছিলাম, যা মনে হয়েছে পড়ে তাই লিখছি। নাতিদীর্ঘ একটি বই, যার বিষয়বস্তু প্রথম ��েকেই স্পষ্ট। লেখার ধরণ দেখে সাহিত্যিক কম, ঐতিহাসিক বেশি মনে হয়েছে। বক্তব্যের রিপিটেশন খুবই বেশি। চৈতন্য দেবের শেষ পর্যন্ত কি হলো তা জানিয়ে যেতে পারননি। পড়ে তৃপ্তি পেলাম না। অতৃপ্ত আত্মার মতো অন্য বইয়ের সন্ধান করতে হবে। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম, তাই বলতেই হচ্ছে যে হতাশ হতে হয়েছে আমাকে, এখানে লেখক গবেষণা হয়তো করেছেন, অনেক পড়াশোনা যে করেছেন সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু গুছিয়ে যেন বলতে পারলেন না। বারবার বলছেন যে আমাকে যুক্তিকে ভক্তির ওপরে রাখতে হবে, কিন্ত বারংবার খেই হারিয়ে ফেলছেন, যে চরিত্রগুলিকে নির্মাণ করেছেন তারা কারা, কেনই বা দুমদাম তাদের আবির্ভাব হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এমনও অনেক জায়গা আছে, যেগুলো অবান্তর। বইটির ভালো খারাপ দুই দিকই আছে। সেগুলো একটু পয়েন্ট করে বলছি। ভালো দিক – 1. রেফারেন্স ছাড়া কোনও কথা বলেননি, এ থেকে বোঝা যায় ওনার মধ্যে গবেষণার মত মানসিকতা ছিলো। 2. যে প্রশ্নগুলো গৌরাঙ্গের সম্পর্কে হওয়া উচিত সেগুলিকে যথাযথ ভাবে প্রদিপাদন করেছেন। এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। যা কিছু আমার দৃষ্টিকটু লেগেছে – ১. সপক্ষে যুক্তি, বিপক্ষেও যুক্তি, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত কোথায়। একজন গবেষকের কাছে সকলেই স্বকীয়তা আশা করেন। ২. নিজের মনের কথাগুলো বলার জন্য একাধিক চরিত্রের নির্মাণ করেছেন। যাদের কোনও দরকার ছিল না। ৩. ঐতিহাসিক অনুসন্ধান হতে হতেও যেন হচ্ছে না, কোথাও যেন একটা কল্প কাহিনী বলে মনে হচ্ছে। ৪. শুধু রেফারেন্স দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা কিভাবে সম্ভব। কোনও ঠোস প্রমাণ নেই। ৫. একই তত্ত্বের পুনরাবৃত্তি হওয়াতে কিছুটা বিরক্তই লাগছিলো। ৬. কাজের কথার সাথে সাথে জানেন বলে অনেক অবান্তর প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন। (আদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা, তার সমাধিস্থল ইত্যাদি ইত্যাদি।)
যে প্রত্যাশা নিয়ে বইটি পড়তে বসেছিলাম তা পূরণ হয় নি। অবশ্য তখষন জানতামও না যে এটি প্রথম খণ্ড এমনকি বইয়েও লেখা নেই সেটি। তবু কোথাও সম্ভবত শ্রীচৈতন্য এর মৃত্যু রহস্য নিয়ে এই বইয়ের রেফারেন্স পড়েছিলাম তাই আগ্রহ কাজ করেছিল বইটি পড়ার। মধ্যযুগের বাংলার বা উড়িষ্যারও ইতিহাসে শ্রীচৈতন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তার পথ ধরেই এসেছে গৌড়িয় বৈষ্ণব সমাজ, অনেক সমাজ সংস্কার হয়েছে। আরো বেশি হতে পারতো কিন্তু তার দেখানো পথে তার পরবর্তীরা হাঁটেন নি।সেটা অবশ্য এই বইয়ের আলোচনার বিষয় নয়। তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল, সেই রহস্যের সমাধান প্রায় পাঁচশ বছর পর কি আদৌ সম্ভব, সেটা নিয়েই বরং এই বই। তবে ইতিহাসের ঢং এ নয় লেখক এই বই লিখেছেন উপন্যাসের ঢং এ। সেটা করতে গিয়ে তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। নানা চরিত্রের সমাহার এসেছে যদিও হঠাৎ হঠাৎ করেই কিন্তু তাদের পরিচয় অস্পষ্ট, অস্পষ্ট তাদের ভূমিকা এবং বক্তব্যও। বিপরীতমুখী কিছু মত এই বইয়ে দেয়া আছে আরো কিছু বলতে বলতেও পাঠকের কাছে না বলাই থেকে গেছে। সবমিলিয়ে উপন্যাস হিসেবে এটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলতেই হবে। আর চৈতন্য মৃত্যু রহস্য সমাধান এত বছর পর এসে আসলে হয়তো সম্ভব না, কিন্তু লেখক এই বিষয়ে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন তাই যে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলাম না।