বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক বর্ণিল চরিত্র শাহ্জাহান কিবরিয়া। তিনি আজীবন শিশুদের নিয়ে ভেবেছেন, কাজ করেছেন অক্লান্ত, শিশুদের জীবনমানকে উন্নত করার স্বপ্ন দেখেছেন নিরন্তর। এর পাশাপাশি লিখে গেছেন অবিরল ধারায়। ছোটদের জন্য মৌলিক গল্প-উপন্যাস যেমন লিখেছেন, তেমনি বিদেশি ভাষা থেকে চিরায়ত সাহিত্য অনুবাদ করেছেন অসামান্য নিষ্ঠায়।
শাহ্জাহান কিবরিয়া (Shahjahan Kibria) তাঁর লেখক নাম, পোশাকি নাম মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া। সাংবাদিকতা দিয়ে পেশা জীবন শুরশু করলেও তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন একজন শিশু-দরদি মানুষ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির দীর্ঘকালের পরিচালক। এক যুগেরও অধিক সময় শিশু একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এই দীর্ঘ সময়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা গভীর প্রভাব ফেলেছে তাঁর সাহিত্য-জীবনে। শিশুমনস্তত্ত্বের নানা রহস্যময় দিক তিনি এ সময় যেমন প্রত্যক্ষভাবে নিরীক্ষণ করেছেন, তেমনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন অভিভাবকদের মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী, অস্বাভাবিক ও পরিণামহীন আচার-আচরণ। এসবই হয়ে উঠেছে তাঁর লেখালেখির বিষয়-অনুষঙ্গ। সহজ-সরল সাহিত্য উপাদান ও শাণিত নির্মাণ শৈলী তাঁর রচনার প্রাণ। গল্পরসের সঙ্গে তিনি প্রায় সব রচনায় ঘটিয়েছেন শিশু অধিকারের মূল চেতনার মেলবন্ধন। তাঁর সুজন আজও ভোলেনি (১৯৯০), প্রমা ও মুক্তিযোদ্ধা (২০০০), একটি কলমের জন্য (২০০৬), মনীষার বিড়াল ছানা (২০০১) ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ এই বক্তব্যের পক্ষেই সাক্স্য দেয়।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শাহ্জাহান কিবরিয়ার প্রিয় বিষয়। নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম-বহুল সাহসিকতাপূর্ণ জীবন আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে লেখেন ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’ জীবনীগ্রন্থ। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটে তাঁর শিশুসাহিত্যে। ১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মানুষের সঙ্গে অবলা জীবজন্তুও এক কাতারে ছিল, এই অবিশ্বাস্য সত্যকে আমাদের শিশুসাহিত্যে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রকাশ করেন শাহ্জাহান কিবরিয়া, তাঁর ‘বাঘা’ কিশোর উপন্যাসে। বাঘা একটি পোষা কুকুর, অথচ লেখকের কুশলী উপস্থাপনায় মানবিক আচরণ ও শৌর্যে এটি হয়ে উঠেছে শিশুসাহিত্যের একটি আদর্শ চরিত্র। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও জেলে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও শাহ্জাহান কিবরিয়া ছিলেন সোচ্চার। চরম ইতিহাস বিকৃতির নির্মম বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে তিনি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস (২০০০)। স্বদেশ, স্বকাল, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি বীরগাথা তাঁর রচনায় পায় বাড়তি মাত্রা, যা শিশু-কিশোরদের দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করে। এর পাশাপশি বিদেশি রূপকথা ও লোককথা অনুবাদ করে তিনি আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন। এই ধারায় শিশুসাহিত্যে অনবদ্য সংযোজন ইরানের মজার গল্প (১৯৮৩), প্রাচ্যের রূপকথা (১৯৮০), আফ্রিকার রূপকথা (১৯৮৮), ওয়েস্ট ইন্ডিজের রূপকথা (১৯৯৭), নাইজেরিয়ার রূপকথা (১৯৯২) ইত্যাদি গ্রন্থ। এখানেও তাঁর শিশুসাহিত্য জীবনমুখী ইতিবাচক ও কল্যাণ ভাবনায় উজ্জ্বল। প্রকৃতপক্ষে এক অঙ্গীকারাবদ্ধ শিশুসাহিত্যের স্রষ্টা তিনি। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির অধিক।
শাহ্জাহান কিবরিয়ার জন্ম ১৯৪১ সালের ২৪ জানুয়ারি, নোয়াখালী জেলার অধুনালুপ্ত শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মাইজদী কোট শহরে। ১৯৫৭ সালে নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই. এ. পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে ১৯৬৩ সালে অনার্স এবং ১৯৬৪ সালে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সাময়িক শাসন বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কিছুকাল কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলনে। মনেপ্রাণে আজীবন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক তিনি। ইতোপূর্বে শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
নিষ্ঠাবান এই শিশুসাহিত্যিক এখন পূর্ণ অবসর জীবনযাপন করছেন। গ্রন্থপাঠ ও সাহিত্যচর্চাই এখন তাঁর আনন্দময় নিত্যকর্ম। - See more at: http://dainikazadi.org/details2.php?n...