বাছাই কিছু কল্পবিজ্ঞান সম্পাদনা : শুভজিৎ বরকন্দাজ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ - সুমিত রায় প্রকাশণা - পানকৌড়ি প্রকাশনী পরিবেশক - অরণ্যমন বই
বাংলা সাহিত্যে 'কল্পবিজ্ঞান' শব্দটা সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন, 'আশ্চর্য' পত্রিকার আবির্ভাব সংখ্যায়। এক্ষেত্রে তাঁর অনুপ্রেরনা ছিল ইংরেজি 'সাইন্স ফিক্শন' শব্দবন্ধ। ১৯৬৩ সালে অদ্রীশ বর্ধনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে জন্ম নেয় বাংলার প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা 'আশ্চর্য', যাতে সেই সময়ে একাধিক বিখ্যাত সাহিত্যিক নিমগ্ন হয়েছিলেন কল্পবিজ্ঞানের চর্চায়। অদ্রীশ বর্ধন সম্পাদিত 'আশ্চর্য' পত্রিকার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের একটা নতুন যুগ শুরু হয়েছিল। সেই শুরু, তারপর থেকে ধীরে ধীরে জোয়ার এসেছে বাংলার কল্পবিজ্ঞান চর্চার। সেই সময় কল্পবিজ্ঞান ঘরানায় অদ্রীশ বর্ধন ছাড়া অন্য যারা কলম ধরেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন - ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়, অনীশ দেব, সিদ্ধার্থ ঘোষ, সমরজিৎ কর, দিলীপ রায় চৌধুরী, সঙ্কর্ষণ রায় প্রমুখ।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কল্পবিজ্ঞানের এই ধারাটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বিমল কর, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সমরেশ মজুমদারের মতন মূলধারার সাহিত্যিকেরা। মূলধারার সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তাঁরা চমৎকার কল্পবিজ্ঞানের গল্প (মূলত সামাজিক সায়েন্স ফিক্শন এবং সায়েন্স ফ্যান্টাসি) পাঠকদের উপহার দিতে থাকেন। বাংলার কল্পবিজ্ঞান চর্চার সেই ধারটিকেই বর্তমানে সক্রিয় রেখেছেন অভিজ্ঞান রায় চৌধুরী, সৈকত মুখোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, রাজেশ বসু, হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, অন্যান্য দাশ, বিবেক কুন্ডুর মতন জনপ্রিয় লেখকেরা।
বাংলার কল্পবিজ্ঞানের এই বর্তমান ধারার সাথে শিশু-কিশোর পাঠকদের পরিচয় করে দেবার উদ্দেশ্যে শুভজিৎ বরকন্দাজ 'বাছাই কিছু কল্পবিজ্ঞান' নামে কল্পবিজ্ঞান গল্পের একটি অনবদ্য সংকলন সম্পাদনা করেছেন। পূর্বে প্রকাশিত কল্পবিজ্ঞানের সংকলনগুলির থেকে ব্যতিক্রমী করবার উদ্দেশ্যে এই মুহূর্তে যাঁরা জীবিত আছেন এবং সৃষ্টির আনন্দে এখনো লিখে চলেছেন শুধুমাত্র তাঁদের লেখাই এই সংকলনটিতে স্থান পেয়েছে। নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে মোট ঊনত্রিশজন কল্পবিজ্ঞান লেখককের লেখা রয়েছে এই বইটিতে, যার অধিকাংশ গল্পই আগে কোথাও সংকলিত হয়নি।
বইয়ের ঊনত্রিশটি গল্পের মধ্যে থেকে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু গল্প বেছে নিয়ে সেই গল্পগুলির বিষয়বস্তু নিচের আলোচনায় তুলে ধরলাম।
উলট-পুরাণ - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
বরেণ্য সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যাযে লেখনীর সাথে আমরা সকলেই কম-বেশী পরিচিত। অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয়বস্তকেও কৌতুকের মোড়কে মুড়ে পরম উপাদেয় করে পরিবেশন করার ব্যাপারে তাঁর একটা নিজস্ব রেসিপি আছে।উলট-পুরাণ কাহিনীটিও সেই পরিচিত রেসিপির স্বাদে-গন্ধে ম-ম করছে। কাহিনিটিতে এমন একটি সময়কালকে তুলে ধরা হয়েছে যখন পৃথিবীর মানুষ উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে। নতুন করে আবিষ্কার করার মতন এইমুহূর্তে আর কিছু বাকি নেই। অথচ এই অবস্থাটাই সমগ্র মানবজাতিকে এমন এক চরম সংকটের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, যার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার ক্ষমতা তারা এ যুগে হারিয়ে ফেলেছে। সংকটের মুহূর্তের বর্ণনাগুলি তাঁর লেখনীর গুণে হয়ে উঠেছে অত্যন্ত সুস্বাদু এবং সাথের মজাদার সংলাপগুলি গল্পের সেই স্বাদকে আরও বহুগুন বাড়িয়ে তুলেছে।একশভাগ শীর্ষেন্দু-সুলভ একটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনী দিয়ে এই সংকলনের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে।
রোবটবন্ধু - রতনতনু ঘাটী
বর্তমান প্রজন্মের প্রায় সকল শিশুই তাদের বাবা-মায়ের উচ্চাশার চাপে শৈশব হারাতে বসেছে। সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদের সাথে খেলার মজা কি, তাদের সাথে সুখদুঃখ ভাগ করে নেবার আনন্দ কতখানি তা তারা প্রায় ভুলতে বসেছে। বাবা-মা উভয়ের নিজস্ব কর্মজগতে ব্যস্ত থাকার কারণে নিজেদের দুঃখ-যন্ত্রনা বোঝানোর মতন কাউকে তারা কাছে পাচ্ছে না, ফলস্বরূপ হতাশা এবং একাকিত্ব তাদেরকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এই অবস্থায় একটি রোবট কি তাদের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারে? লেখক রতনতনু ঘাটী বর্তমান প্রজন্মের ছোটদের চাহিদা এবং তাদের যন্ত্রণার চিত্রটিকে অতন্ত্য সুনিপুণভাবে এই গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন। সমস্ত অভিভাবকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে শুধুমাত্র তাঁদের ব্যক্তিগত চাহিদা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার মাসুল কি ভাবে দিতে হচ্ছে এই প্রজন্মের ছোট ছোট শিশুদের। এইঅবস্থায় একটি রোবট একটি শিশুমনের গোপন ইচ্ছার হদিশ পেয়ে কিভাবে নিজেকে বদল করে হয়ে ওঠে তার প্রকৃত বন্ধু ! যে জগৎ সেই শিশুটির অভিভাবকদের কাছেও ছিল অধরা, তার সন্ধান কিভাবে পেল এই রোবটটি সেই আশ্চর্য কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে।
সন্দেহের এক কণা - অনীশ দেব
'সন্দেহ' হল মানব শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই মারণ বিষ যার সামান্য উপস্থিতি যেকোন নিরপরাধ ব্যক্তির জীবনকে ছারখার করে দিতে পারে। এই বিষের প্রয়োগ যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে সেই কাহিনীই লেখক অনীশ দেব বৰ্ণনা করেছেন এই গল্পে। এই কাহিনীটি পড়লে পাঠকরা একদিকে যেমন এই বিষের তীব্রতা অনুভব করতে পারবেন, অন্যদিকে তেমনি তাদের হৃদয় ব্যথাতুর হয়ে উঠবে একটি নিরপরাধ ব্যক্তির করুন পরিণতির কাহিনী জেনে। এটি এই সংকলনের অন্যতম সেরা গল্প।
রোনা - অদ্রীশ বর্ধন
এই গ্রহের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হল মানুষ। বিদ্যা-বুদ্ধির সঠিক প্রয়োগে পৃথিবীর সকল প্রাণীদের চেয়ে সে এগিয়ে এবং এ নিয়ে তাদের মনে গর্বের অন্ত নেই। কিন্তু জীবনে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে যখন এই মানুষও নিজেদের অসহায় মনে করে। অর্জিত সকল বিদ্যা-বুদ্ধি কাজে লাগিয়েও সেই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর কোন পথ সে খুঁজে পায় না। সেই সময় তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় ভিনগ্রহের এক জীব 'রোনা'। রোনা কিভাবে এই অসহায় মানুষদের কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করল সেই কাহিনীই লেখক অদ্রীশ বর্ধন ভারী সুন্দরভাবে বলেছেন এই গল্পে।কাহিনীটি অদ্রীশবাবুর লেখা একটি অন্যতম সেরা গল্প।সম্পাদক শুভজিৎ বরকন্দাজকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই এরকম মর্মস্পর্শী একটি কাহিনী এই সংকলনে রাখার জন্য।
ফ্লাইট নং ৩২ - অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
আমরা নিজের জীবনযাত্রাকে আরো উন্নত এবং গতিশীল করার উদ্দেশ্যে আবিস্কার করেছিলাম যন্ত্র। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে এই যন্ত্রকে আমরা করে তুলতে থাকলাম আরো আধুনিক এবং ত্রুটিহীন। ধীরে ধীরে সময় যত এগোতে থাকল আমাদের জীবনে যন্ত্রের চাহিদাও তত বাড়তে থাকল এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল তাদের ব্যবহার। ধীরে ধীরে আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িয়ে গেল এই যন্ত্র-সভ্যতা, যার থেকে আমরা নিজেদের আর মুক্ত করতে পারলাম না। যন্ত্রের প্রতি ক্রমবর্ধমান এই আসক্তি ও নির্ভরশীলতা আমাদের কোন দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে?এই গল্পে ভবিষ্যত পৃথিবীর একটা সময়কালকে তুলে ধরে লেখক সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন।যন্ত্রের প্রতি অতি নির্ভরতার ফল কি হতে পারে এবং তা আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে তার অত্যন্ত বাস্তব একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই গল্পে। এই গল্প প্রমাণ করে লেখক অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী শুধুমাত্র সুদক্ষ কল্পবিজ্ঞান লেখকই নন, একজন অসাধারণ ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও বটে !
বোয়িং ২০৫০ - হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
যেকোন কাহিনীর শেষে আকস্মিক চমক বা ট্যুইস্ট দিয়ে পাঠকদের হতবাক করার ব্যাপারে লেখক হিমাদ্রিকি��োর দাশগুপ্ত বরাবরই সিদ্ধহস্ত। তা সে ভূতের গল্প হোক বা কোন ঐতিহাসিক ঘটনা, সামাজিক গল্প হোক বা প্রেমের কাহিনী সবেতেই কাহিনীর শেষে পাঠকদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে এক বিশেষ চমক। এই কাহিনীটিও তার ব্যতিক্রম নয়। একটি আদ্যপান্ত থ্রিলার ভিত্তিক কাহিনী লেখকের সুনিপুন কলমের মোচড়ে কিভাবে একটি সার্থক কল্পবিজ্ঞানের গল্পে রূপান্তরিত হল তা বুঝতে হলে এই কাহিনীটি অবশ্য পাঠ্য।
পার্কিং যত বি-৮৯ - বিবেক কুন্ডু
রাউলিংয়ের হ্যারি পটার সিরিজের প্ল্যাটফর্ম নম্বর নয় তিন বাই চারের কথা মনে পড়ে? হ্যাঁ ঠিক ধরেছ, লন্ডনের কিং'স ক্রস স্টেশনের সেই প্ল্যাটফর্মের দেওয়াল, যা ভেদ করে শিক্ষানবিশ উইজার্ডসরা হওগওয়ার্ড এর জাদু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার ট্রেন হওগওয়ার্ড এক্সপ্রেস ধরত। এই প্ল্যাটফর্মের হদিস মাগলরা কখনোই টের পেত না। বিবেক কুন্ডুর 'পার্কিং লট বি-৮৯' গল্পে রাউলিংয়ের এই কল্পনাশক্তির বেশ জোরালো প্রভাব আছে তা লেখার শুরুতেই বলে রাখা ভাল, তবে ওইটুকুই। বাকি কাহিনীটা লেখক বিবেক কুন্ডুর মস্তিষ্কপ্রসূত।নর্থ সিটি মলের মধ্যে রয়েছে এই বি-৮৯ নম্বরের পার্কিং লটটি, যার একটি থামের মধ্যে দিয়ে অনায়াসে প্রবেশ করা যায় আর একটা ভিন্ন জগতে। তবে এক্ষেত্রে মজাটা হল এই যে থামের উল্টোপাশে রয়েছে এই জগতের অবিকল প্রতিবিম্ব। দুই জগতের মধ্যে তফাত হল সময়ের ব্যবধানের, আর এই কারণেই এপাশের জগৎটা ওদিকের অস্তিত্ব টের পায় না। সময়, স্থান এবং অর্থ-সামাজিক অবস্থানের হেরফের ঘটিয়ে লেখক বিবেক কুন্ডু আধুনিক এবং অত্যাধুনিক শহুরে জীবনযাত্রার এক আশ্চর্য কাহিনী শুনিয়েছেন এই গল্পে।
রুয়েনঞ্জারি রহস্য - কৃষ্ণেন্দু বন্দোপাধ্যায়
রুয়েনঞ্জারি পর্বতমালা অতিক্রম করতে গিয়ে একদিন একটি বিমানে অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা ঘটে।যার তদন্ত করতে কঙ্গো সরকার ডেকে পাঠায় দুই বিজ্ঞানীকে। কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই রুয়েনঞ্জারি পর্বতমালার বুকে তা জানতে শুরু হয় তাদের অভিযান।অচিরেই তাদের এই অভিযানটি হয়ে ওঠে দুঃস্বপ্নময়।এডভেঞ্চার কাহিনীর মোড়কে লেখক কৃষ্ণেন্দু বন্দোপাধ্যায় খুব সুন্দর একটি কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী পাঠকদের উপহার দিয়েছেন, যার মধ্যে রুয়েনঞ্জারি পর্বতমালার অজানা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।
হেশোরাম রহস্য ও স্যার সত্যপ্রকাশ - স্বপন বন্দোপাধ্যায়
সুকুমার রায়ের সৃষ্ট সেই বিখ্যাত চরিত্র হেশোরাম হুঁশিয়ার কে মনে আছে? হেশোরাম হল মস্তবড় এক শিকারী যার অভিজ্ঞতার ঝুলি সুবিশাল। সেই হেশোরাম হুঁশিয়ারকে স্মরণ করে লেখক স্বপন বন্দোপাধ্যায় নির্ভেজাল মজা এবং এডভেঞ্চার মিশিয়ে খুব সুন্দর একটি কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী বুনেছেন যার মুখ্য চরিত্রে রয়েছেন স্যার সত্যপ্রকাশ এবং বগলাচরণ। কাহিনীর বিষয়বস্তু ভাবনায় এবং পরিবেশনে বেশ নতুনত্বের ছাপ আছে।
স্বপ্নপথ - জয়দীপ চক্রবর্তী
বিজ্ঞানী অশেষ মিত্র সুদীর্ঘ পরিশ্রম করে আবিষ্কার করেন অত্যাশ্চৰ্য এক ওষুধ। কিন্তু তার এই আবিষ্কারটি জনসমক্ষে আসার আগেই চুরি হয়ে যায়। পুলিশি তৎপরতায় চোরকে শেষ অবধি ধরা সম্ভবপর হলেও অশেষবাবুর আবিষ্কৃত এই ওষুধ ব্যবহারের ফল তার ওপর হয়েছে মারাত্মক। অশেষবাবুর আবিষ্কৃত ওষুধটি কি মানুষের ব্যবহারের উপযুক্ত নয় ? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চোখ রাখতে হবে লেখক জয়দীপ চক্রবর্তীর লেখা এই কাহিনিটিতে। গল্পের শেষে একটি দারুন চমক পাঠকদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ওরা ঢুকে পড়েছে - সাগরিকা রায়
১৯৩৮ সালের ৩০শে অক্টোবর আমেরিকার বেতার বিভাগ থেকে সম্প্রসারিত হয়েছিল ৬২মিনিটের একটি বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠান।প্রখ্যাত অভিনেতা ওরসন ওয়েলসপাঠ করেছিলেন এই জি ওয়েলস রচিত 'দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড'। অনুষ্ঠান চলাকালীন কাহিনীটি বেতার দর্শকদের মনের মধ্যে এমন ভীতির সঞ্চার করেছিল যে তাদের ধারণা হয়েছিল এলিয়েনরা বুঝি সত্যিই পৃথিবীকে আক্রমণ করেছে এবং তাদের যে কোন মুহূর্তে প্রাণহানি হতে পারে।কল্পবিজ্ঞানের একটি কাহিনী মানুষের মনের মধ্যে কি পরিমান ভয়ের উদ্রেগ সৃষ্টি করতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে এই ঘটনাটি। এরকমই একটা ভয়ের পরিবেশ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন লেখক সাগরিকা রায় 'ওরা ঢুকে পড়েছে" গল্পের মধ্যে দিয়ে।কাহিনীর শুরুতেই দেখা যায় পৃথিবীর বুক থেকে অস্তিত্ব মুছে যাওয়া মানুষেরা ফিরে আসতে শুরু করেছে তাদের পুরোনো পরিবারে। ঘটনাটি পরিবারের বর্তমান সদস্যদের কাছে বিস্ময়কর হলেও প্রিয়জনের ফিরে আসার আনন্দে বিষয়টি নিয়ে তারা বিশেষ প্রভাবিত হন না। ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুকে এই ধরণের মানুষদের আনাগোনা বাড়তে থাকে এবং তার পাশাপাশি ঘটতে থাকে হাড়হিম করা কিছু ঘটনা। কাহিনীটি সম্পূর্ণ পাঠ করার পর পাঠকদের মনেও ওদের ফিরে আসার ভয়টা দুর্দান্তভাবে জাঁকিয়ে বসবে একথা জোর গলায় যায়। কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী যে এরকম ভয়ের হতে পারে তা আরেকবার প্রমাণ করলেন সুলেখক সাগরিকা রায়। নিঃসন্দেহে সংকলনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি এই গল্পটি।
সময়ের ফেরিওয়ালা - বৈশাখী ঠাকুর
বর্তমান সমাজে সুষ্ঠভাবে জীবনযাপন করার জন্য আমাদের সকলকেই নানারকম পেশার সাথে যুক্ত থাকতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষদের কাছে এই পেশা শুধুমাত্র জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম নয়, তাদের কাছে এ হল কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর স্বপ্ন-সোপান। যে সিঁড়িতে পা ফেলে ওঠা যায় সেই উচ্চতম স্থানে যা সমাজের বাকি লোকেদের চোখে ঈর্ষণীয়।অর্জন করা যায় অঢেল অর্থরাশি, সীমাহীন প্রাচুর্য এবং বৈভব।বদলে শুধু খরচ করতে হয় জীবনের মূল্যবান সময়। আরো আরো পাবার মোহে জীবনের অতি-প্রয়োজনীয় সময়টুকুও তারা বন্ধক রাখে লক্ষ্য-পূরণের কঠিন সিন্দুকে। পরবর্তীকালে মোহভঙ্গ যখন হয় তখন উপলব্ধি করে জীবনের কত অমূল্য সময় তারা খুইয়েছে এই মরীচিকার পিছনে ছুটে।কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীর মোড়কে জীবনের এক কঠিন সত্যকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বৈশালী ঠাকুর এই গল্পে। ভীষণ সময়পোযোগী একটি লেখা,যা পাঠকদের ভাবতে বাধ্য করবে।লেখিকার ভাবনাকে সেলাম জানাই।
টাইম ট্রাভেল - অধীর সিনহা
ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ সাহিত্যিক এই জি ওয়েলস 'দ্য টাইম-মেশিন' নাম একটি সায়েন্স ফ্যান্টাসি লেখেন। কাহিনীতে তিনি একটি যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছিলেন যাতে চড়ে মানুষ ইচ্ছামতন অতীত বা ভবিষ্যৎ সময়কালে অবাধে বিচরণ করতে পারত।পরবর্তী সময়ে এই 'টাইম-মেশিন' যন্ত্রের ধারণাটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে তা নিয়ে প্রচুর সাহিত্য, সিনেমা, টিভি সিরিজ এর সৃষ্টি হয়। লেখক অধীর সিনহার লেখা এই কাহিনীটিও এই 'টাইম-মেশিন' কে কেন্দ্র করে লেখা।গল্পের শুরুতেই এক চরিত্রকে দিয়ে টাইম মেশিন সৃষ্টি করে তাতে চড়ে সময় ভ্রমণের সুব্যবস্থা করেছেন। বিপত্তি ঘটেছে এরপরই! গল্পের কাহিনী যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা না করে কল্পনার ডানায় ভর করে ভেসে বেরিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। পাঠকদের পক্ষে গল্পের এই অংশটি ট্রাভেল করা প্রচন্ড কষ্টসাধ্য কাজ এবং গল্পের শেষের টুইস্টটি অত্যন্ত ক্লিশে আর বহু ব্যবহারে জীর্ন। কাহিনীটিকে অন্যভাবে ভেবে আরো মৌলিক কিছু পেশ করলে ভাল হত। এই সংকলনের সবচেয়ে দুর্বলতম কাহিনী এটাই।
ভিসিটের ভাসরা - তরুণ কুমার সরখেল
সত্যজিৎ রায়ের লেখা 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু' গল্পটি মনে পড়ে? অমাবস্যার রাতে পঞ্চা ঘোষের বাঁশবাগান পার হতে গিয়ে বঙ্কুবাবু মুখোমুখি হয়েছিলেন ক্রেনিয়াস গ্রহ থেকে আসা ভিনগ্রহী জীবের। হুবহ সেই গল্পের দুর্বল অনুকরণ বলা চলে তরুণবাবুর লেখা এই কাহিনীটিকে। পড়তে হলে মূ���-গল্পটি পুনরায় পড়ার সুপরামর্শ দিলাম।
জলবানর রহস্য - রাখী নাথ কর্মকার
ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাটালিনা আইল্যান্ডের সুগভীর জলরাশির তলদেশে সন্ধান পাওয়া যায় এক আশ্চর্য পিরামিডের। অজানা ধাতু দিয়ে গড়া এই পিরামিডের মধ্যে কারা বাস করে? কি উদ্দেশে তারা এখানে এসেছে? সমুদ্রের গভীরে কোন অজানা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তা জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে এই কাহিনীটি। গল্পের মধ্যে প্রয়োজন ���তিরিক্ত তথ্যের উপস্থিতি কাহিনীটিকে অহেতুক জটিল করে তুলেছে এবং তার ফলে গল্প পড়ার মজাটাও অনেকটাই নষ্ট হয়েছে।
অপারেশন ডার্ক গডেস - দীপ ঘোষ
আকাশগঙ্গা শিপিং কোম্পানির ফ্লাইটে চালান করা হচ্ছে একটি দুষ্প্রাপ্য মূর্তি। এই মূর্তিটিকে নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানান কুসংস্কার এই সময়ের বিভিন্ন গ্রহের বাসিন্দাদের মনে। ভিনগ্রহী কিছু প্রাণীদের নজরে রয়েছে এই মূর্তিটি এবং চালান পথে এটিকে ছিনিয়ে নেবার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। শেষমেশ কি হয়? গল্পের শেষে একটা চমৎকার 'গুগলি' অপেক্ষা করছে পাঠকদের জন্য। একটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর শেষভাগ যে এমন চমকপ্রদ হতে পারে তা এককথায় অভাবনীয়। লেখক দীপ ঘোষকে আন্তরিক অভিন্দন জানাই এরকম সুন্দর একটি ভাবনাকে কাহিনীর আকারে পাঠকদের উপহার দেবার জন্য। ভবিষ্যতে ওনার কলম থেকে এরকম আরো গল্প শোনার অপেক্ষায় রইলাম।
উপরে উল্লিখিত কাহিনীগুলি ছাড়াও দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের লেখা 'প্রথম পদক্ষেপ', অনন্যা দাশের 'হতেও তো পারে', বনশ্রী মিশ্রের 'গুজবঘর' এবং অর্পণ পালের 'স্থানুমানব' পড়তে পাঠকদের ভাল লাগবে।
এই বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণের দ্বায়িত্ব বর্তীত হয়েছে শিল্পী সুমিত রায়ের উপর। সেই কাজটিকে তিনি অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। বইয়ের প্রতিটি কাহিনীর সাথে রয়েছে একটি করে ইলাস্ট্রেশন বা অলংকরণ এবং প্রতিটি অলংকরণ অত্যন্ত যত্নের সাথে আঁকা হয়েছে। ইলাস্ট্রেশনগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কাজগুলি হল -'রোবটবন্ধু' গল্পে রোবটের তিতিরকে সেবা করার দৃশ্যটি, 'টাইম ট্রাভেল' গল্পের টাইম ট্রাভেল যন্ত্রে ছবিটি, 'মারিয়ানা ট্রেঞ্চের নীচে' কাহিনীতে গল্পের ক্লাইমেক্সের দৃশ্য, 'রোনা' গল্পে পিত-পুত্রের রোনাকে পর্যবেক্ষণ করার মুহূর্তটি, 'চশমা' গল্পে কাহিনীর মূল দুই চরিত্রের স্কেচ এবং 'অপারেশন ডার্ক গডেস' কাহিনীতে এলিয়েনদের আক্রমণ করার দৃশ্যটি। বইয়ের প্রচ্ছদটিকে অলংকরণগুলির তুলনায় দুর্বল লেগেছে।এক্ষেত্রে প্রচ্ছদটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুললে বইটির আকর্ষণ আরো বাড়ত বলে মনে করি।
প্রায় নির্ভুল ছাপা,চমৎকার বাঁধাই, পাঠযোগ্য ফন্টের ব্যবহার এবং সর্বোপরি হার্ডকোভের বাইন্ডিং এ মোড়া এই বইটি হাতে তুলে নিলে পড়তে ইচ্ছে করবেই। তাই আর দেরি না করে আজই সংগ্রহ করে ফেলুন কল্পবিজ্ঞানের গল্পে ঠাসা এই দুর্দান্ত সংকলনটিকে।
*** উপরের লেখাটি ২০১৭ সালের "ইষ্টিকুটুম" পূজাবার্ষিকীর 'বই আলোচনা' বিভাগে ছাপা হয়েছিল ***