হুমায়ুন আজাদ অভিনব অপ্রথাগত রীতিতে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সেই সময়ের চারজন প্রধান বাঙালির : অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ডক্টর আহমদ শরীফ, ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান, ও কবি শামসুর রাহমানের । সাক্ষাৎকারগুলো পেরিয়ে গিয়েছিলো বাঙলাদেশি সাক্ষাৎকারের সীমাবদ্ধতা। এগুলোতে প্রথম দেখা গিয়েছিলো যে, সাক্ষাৎকারদাতা ও গ্রহণকারী উভয়েই সমান গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারে, এবং গ্রহণকারীর গুরুত্বের ওপরই নির্ভর করে সাক্ষাৎকারের মূল্য৷ এসব সাক্ষাৎকারে রুদ্ধ বঙ্গীয় সমাজের পাঁচজন মুক্তমনে কথা বলেছেন জীবন, যৌনতা, ও আরো বহু বিষয়, ও অন্তরঙ্গ জীবন সম্পর্কে। সাক্ষাৎকারেগুলো হয়ে উঠেছে সময়ের দলিল, ও অপ্রকাশিত অন্তরের অকপট প্রকাশ । এ-সময়ের চারজন প্রধান বাঙলির অন্তর্লোক, ও তাদের উপলব্ধির শিখায় বিশশতকের বাঙলাকে বুঝতে হলে আসতে হবে এ-সাক্ষাৎকারগুলো কাছে। এই প্রথম বাঙলাদেশে সাক্ষাৎকার হয়ে উঠেছে সৃষ্টিশীল ও মননশীল।
Humayun Azad (Bangla: হুমায়ূন আজাদ) was a Bangladeshi author and scholar. He earned BA degree in Bengali language and literature from University of Dhaka. He obtained his PhD in linguistics from the University of Edinburgh in 1976. He later served as a faculty member of the department of Bengali language and literature at the University of Dhaka. His early career produced works on Bengali linguistics, notably syntax. He was regarded as a leading linguist of the Bangla language.
Towards the end of 1980s, he started to write newspaper column focusing on contemporary socio-political issues. Through his writings of 1990s, he established himself as a freethinker and appeared to be an agnostic. In his works, he openly criticized religious extremism, as well as Islam. In 1992 Professor Azad published the first comprehensive feminist book in Bangla titled Naari (Woman), largely akin to The Second Sex by Simone de Beauvoir in contents and ideas.
The literary career of Humayun Azad started with poetry. However, his poems did not show any notable poetic fervour. On the other hand his literary essays, particularly those based on original research, carried significant value.
He earned a formidable reputation as a newspaper columnist towards the end of 1980s. His articles were merciless attacks on social and political injustice, hypocrisy and corruption. He was uncowed in protesting military rule. He started to write novels in 1990s. His novel Chappanno Hazar Borgomile is a powerful novel written against military dictatorship. Azad's writings indicate his distaste for corrupt politicians, abusive military rulers and fundamentalist Islam. Nevertheless, his prose shows a well-knit and compact style of his own. His formation of a sentence, choice of words and syntax are very characteristic of him. Although he often fell victim to the temptation of using fiction as a vehicle of conspicuous political and philosophical message, he distinguished himself with his unique style and diction.
On August 11, 2004, Professor Azad was found dead in his apartment in Munich, Germany, where he had arrived a week earlier to conduct research on the nineteenth century German romantic poet Heinrich Heine. He was buried in Rarhikhal, his village home in Bangladesh.
In 2012, the Government of Bangladesh honored him with Ekushey Padak posthumously. Besides this, he was honored with Bangla Academy Award in 1986.
এ বইতে হুমায়ুন আজাদ তাঁর সময়ের সেরা ৫ জন সৃষ্টিশীল, মননশীল আর মুক্তবুদ্ধির ধারক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন। কোন সেই ৫ জন?
তাঁরা হলেন- জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক, আহমদ শরীফ,শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান এবং কামরুল হাসান।
এই ৫ জনের মাঝে কামরুল হাসানের সাক্ষাতকার নেয়া সম্ভব হয়নি, কেননা তারআগেই তিনি মারা যান।
মোটকথা, এ বইতে সমকালীন বাঙালি জগতের চার উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের সাথে আরেক নক্ষত্র হুমায়ুন আজাদের দীর্ঘ কথোপকথন লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এ বই নিয়ে বেশি বলার নেই। বিচিত্রসব বিষয়আশয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে,খোলামেলা যুক্তিতর্ক হয়েছে যার কিছু বুঝতে পেরেছি আর কিছুকথা মস্তিষ্ককে নাড়া দিয়েছে, ভাবতে বাধ্য করেছে।
সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় ছিলো, হুমায়ুন আজাদ সবাইকে তাঁর চিরায়ত ঢঙে প্রশ্ন করেছেন আর সবাই নিজের মতো করে বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিয়েছেন।
জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের সাথে আলাপচারিতা ছিলো বিশেষকরে উল্লেখ্য।
আহমদ শরীফও সমাজ,রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলেছেন।
শামসুর রাহমান ও শওকত ওসমান মূলত সাহিত্যজগৎ নিয়েই মেতে ছিলেন।
হুমায়ুন আজাদের "সাক্ষাৎকার" পাঠের পর... . হুমায়ুন আজাদঃ বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এতোটা প্রতিভা ইয়ার্কিতে ফুরাইল।’ আপনাকে পড়ার সময় বঙ্কিমের ওই মন্তব্যটি মনে পড়ে;- আপনার সমস্ত লেখায় চোখে পড়ে ওই ইয়ার্কি। শব্দ প্রয়োগে, মন্তব্যে, চরিত্রসৃষ্টিতে, ঘটনা বর্ণনায় নিঃস্পৃহ ভঙ্গি রক্ষা না করে পরিহাস- ইয়ার্কিকে আপনি বড়ো করে তুলেছেন কেন? . শওকত ওসমানঃ বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা নিতান্ত মূর্খতা প্রসূত। প্রজন্মের ফারাকের কথাও উত্থাপন করা যায়। রোমান্টিসিজমের হাওয়ায় মাতাল বঙ্কিমচন্দ্র এবং এই হাওয়া ইউরোপ-আগত। খণ্ডিত ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তাবাদ উপনিবেশে সাম্রাজ্যবাদদের কোলাবোলেটরদের কাছ থেকে আসে। বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদ তাই সাম্প্রদায়িকতা হয় শেষ পর্যন্ত। বৃটিশের ডেপুটি তো। ঈশ্বরগুপ্ত খাঁটি বাঙালী এবং বুদ্ধির ওপর দাঁড়িয়ে কবিতা লেখেন। আর বঙ্কিমচন্দ্র গদ্য লিখলেও বুকে হাঁটেন। দু-জনে দু-ধারার শিল্পী। একজন তন্ময় ও অন্যজন মন্ময়- দার্শনিক পরিভাষায়। কম্যুনিকেশন কোথা থেকে হবে? তাই প্রতিভাধর বঙ্কিম মূর্খের মতো ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেছেন। আমি আজও ঈশ্বরগুপ্ত উপভোগ করি। বুদ্ধিনির্ভর না হয়ে বক্ষনির্ভর হওয়ার ফলে গত দুশো বছর সামাজিক কী দুর্ভোগ আমরা বহন করেছি। তা কারো চোখ এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। স্যাটায়ার একটা শিল্পমাধ্যম। তার ওপর তুমি এতো খড়গহস্ত কেন? সার্ভেন্টিজের মতো মহৎ শিল্পী তো সহজে নাকচ হয়ে যাবে। (সাক্ষাৎকার, হুমায়ুন আজাদ, পৃষ্ঠা ৭০) . ওহ, কী দুর্দান্ত খোঁচাটাই না দিলেন শওকত ওসমান হুমায়ুন আজাদকে। আজাদ সাহেব তো ওই ব্যাপারে আর একটা কথাও বাড়ালেন না। “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” বলে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে যেন বাঁচলেন। . হুমায়ুন আজাদকে যতটুকু পড়েছি আমি তাতে তাকে আমার বেশ উগ্র বলে মনে হয়েছে। নিজের মতামত ছাড়া অন্য কারো কোন মতামতকে গ্রাহ্য না করার একটা দুর্বিনীত ভঙ্গি, একটা রুঢ় অহমের বর্শা সর্বদা তার মেরুদণ্ডের সাথে লাগানো ফলে কাউকেই তিনি ঝুঁকে দেখতে নারাজ। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে বলে ফেলেন মধ্যম মানের কবি, আবার মুহূর্তের মধ্যেই বলে ফেলেন এখনকার ঔপন্যাসিকরা উপন্যাস লেখেন না, লেখেন অপন্যাস। আবার সেই একই আজাদ যখন কারো প্রতি মুগ্ধতা দেখান (অবশ্য খুব কম মানুষই আছে যারা তাকে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন এক জীবনে) তাদেরকে বসান দেবতার আসনে। তার কালের জীবিত বাঙালীর প্রতি খুব একটা মুগ্ধতা কখনোই ছিল না হুমায়ুন আজাদের। তারপরেও যে কয়জন মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল তাদের চারজনের (জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ডক্টর আহমদ শরীফ, কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান আর কবি শামসুর রাহমানের) সাথে কথোপকথনে মেতেছেন হুমায়ুন আজাদ তার এই “সাক্ষাৎকার” বইতে। . যেহেতু বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা থাকে হুমায়ুন আজাদ একজন প্রথাবিরোধী লেখক সুতরাং তিনি যখন সাক্ষাৎকার নেন তখন সেটাও প্রথামাফিক না হয়ে হয় হুমায়ুন আজাদের মতন প্রথাবিরোধী। সেই সাক্ষাৎকারে যেমন দুজনের মধ্যকার কথাবার্তা থাকে তেমনি থাকে হুমায়ুন আজাদের ব্যক্তিগত কথা, যার সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে তার সম্পর্কে সুসামাচার, ব্যক্তিগত কথাবার্তা ইত্যাদি ইত্যাদি। . দারুণ সুখপাঠ্য একটা বই। অনেক অজানা এবং মননকে জাগানো কথা উঠে এসেছে তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে। বাংলাদেশে মননশীল সাক্ষাৎকার প্রায় হয়ই না। যেমন গৎবাঁধা প্রশ্ন থাকে প্রশ্নকারীর, ঠিক তেমন উত্তরদাতারাও ওইরকমই উত্তর দেন। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ এইখানে বাধাহীনভাবে প্রশ্ন করেছেন। হুমায়ুন আজাদের প্রিয় বিষয় ধর্ম-নারী-নাস্তিকতা-প্রেম-যৌনতা-পানীয় বিষয়ক কথা এসেছে অবধারিত এবং দ্বিধাহীনভাবে। উত্তরদাতারাও মন খুলে নিঃসংকোচে উত্তর দিয়েছেন। তবে এই সাক্ষাৎকারগুলো নেয়ার সময় যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে তাদের লেখালেখি খুব বেশি পড়ে যাননি হয়তো হুমায়ুন আজাদ। অথবা এমনও হতে পারে পড়ে যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি তিনি, যেমনটি বোধ করেছেন শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময়। এই একটা মাত্র সাক্ষাৎকার পড়ার সময় বোঝা যায় শামসুর রাহমানের লেখা খুব ভালো মতন পড়ে এসে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ, তাই তো ডিটেইলিং-এর বেশ ছাপ রয়েছে তাতে। . খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। বারবার পড়ার মতন। প্রত্যেকটি সাক্ষাৎকারই চমৎকার লেগেছে পড়তে। . সবাইকে পড়ার তাই আমন্ত্রণ জানিয়ে ধন্যবাদ।
আগে সাক্ষাৎকার বলতে যা পড়েছি তা হলো, প্রশ্নকর্তা আগে থেকেই কিছু প্রশ্ন তৈরি করে সেই অনুযায়ী প্রশ্ন করে যান, একটা কথার সাথে আরেকটার প্রাসঙ্গিকতা থাকলো কি থাকলো না তা বিবেচনা না করে যন্ত্রের মতো প্রশ্ন উত্তর খেলা চলতে থাকে। উত্তরদাতার উত্তরের প্রেক্ষিতে নতুন কিছু সংযোজন বিয়োজন এসব সাক্ষাৎকারে দেখতে পাইনি। সেই হিসেবে হুমায়ুন আজাদের এই সাক্ষাৎকার বেশ ব্যাতিক্রম।
চারজন ব্যাক্তির সাক্ষাৎকার এখানে সংযুক্ত হয়েছে। সমাজ, কাল, দেশ, শিল্প সাহিত্য নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলেছে, যেখানে একজনের মতের সাথে অন্যজনের মতের ভিন্নতা। আবার সব্বাই যেনো একটা জায়গায় গিয়ে এক।
যেমন, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু ধারণায় বিশ্বাসী। অন্যদিকে ডঃ আহমদ শরীফ এটার ঘোর বিরোধী। অথচ দুইজনের বক্তব্যেই যুক্তি আছে দেশ কাল সমাজের প্রাসঙ্গিকতায়।
আবার আহমদ শরীফ মনে করতেন দুর্দশা দূর করতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যাবস্থার দরকার আছে। যদিও তিনি মোটামুটি ছোটোখাটো বুর্জোয়া লাইফ লিড করেন। অন্যদিকে সমাজতন্ত্র নিয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অবস্থান মাঝামাঝি। তিনি মনে করতেন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র হয়তো খুব একটা খাটব��� না। কিন্তু তার জীবনকে যাপনের পদ্ধতি ছিলো খুবই সীমিত। নিজের প্রয়োজনের বাইরে কোনোকিছুই ব্যাবহার করতেন না।
শওকত ওসমানের সাথে সাক্���াৎকারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। কথার মাধ্যমে একজন আরেকজনকে ঘায়েল করার কিছু চিত্র উঠে আসে এই সাক্ষাৎকারে।
সবচেয়ে খোলাখুলিভাবে সাক্ষাৎকার নেয় শামসুর রহমানের। হুমায়ুন আজাদ অনেক সময় বিভ্রান্ত করে ফেলছিলেন শামসুর রহমানকে। সাক্ষাৎকার কিভাবে নিতে হয় সেটা এই সাক্ষাৎকার পড়েই শেখা উচিত; আজকাল যারা গৎবাঁধা ধারায় সাক্ষাৎকার নেয় তাদের।
ছোট্ট এই গ্রন্থের সবকিছুই পজিটিভ একটি বিষয় ছাড়া। হুমায়ুন আজাদের স্তুতি। পছন্দের মানুষদের অতিরিক্ত বন্দনা।
এই সাক্ষাৎকার গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদের সমসময়ের ৫ জন(হুমায়ুন আজাদসহ) সৃষ্টিশীল-পণ্ডিত ও আমৃত্যু জ্ঞানসাধক ব্যক্তিত্বের চিন্তাভাবনা ও সাহিত্যসাধনা সম্পর্কে জানা যাবে। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আর ডক্টর আহমদ শরীফের সাথে সাক্ষাৎকার ভালো ছিল। কারণ তাঁরা তাদের নিজস্ব সমাজ-রাষ্ট্র ভাবনার কথা বলেছেন। কিন্তু ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান আর কবি শামসুর রহমান শুধু তাদের ব্যক্তিগত সাহিত্য নিয়েই মেতে ছিলেন। এজন্য অবশ্য প্রশ্নকর্তা আজাদ সাহেবই দায়ী। আর হুমায়ুন আজাদের মুক্ত প্রশ্ন সাক্ষাৎকারকে মনোগ্রাহী করেছে।
'আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ' কে কেন সাহিত্যবিশারদ বলা হতো তা নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম। এই সাক্ষাৎকার পড়ে সন্দেহমুক্ত হলাম। কারণ তাঁর কাছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অনেক পুঁথি ছিল। যা পরবর্তীতে আহমদ শরীফকে চাকরি দেওয়ার শর্তে ৫০০ এর অধিক পুঁথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেছিলেন। যেগুলো নিয়ে আহমদ শরীফ পরবর্তী জীবনে গবেষণা করেছেন।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, "বাংলাদেশে কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অতি সহজে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সুযোগ আছে।"
হুমায়ূন আজাদ আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর ভাষায় "সে সময়ের চারজন প্রধান বাঙ্গালির" সাক্ষাৎকার নেন। তিনি নিজেই সূচিপত্রে সাক্ষাৎকারের মানুষদের পরিচয় করিয়েছেন এইভাবেঃ
" আবদুর রাজ্জাকঃ এই সময়ের জ্ঞানতাপস (১৯৮৪) আহমদ শরীফঃ পণ্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী (১৯৮৫) শওকত ওসমানঃ কথাসাহিত্যের পথিকৃৎ (১৯৮৫) শামসুর রাহমানঃ নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৯১) "
ইনাদের মধ্যে প্রথম দুজন ঢাবির অধ্যাপক তথা আজাদের সহকর্মী। তদুপরি আহমদ শরীফ আজাদের সরাসরি ঢাবির শিক্ষক এবং শওকত ওসমান আজাদের সরাসরি ঢাকা কলেজের শিক্ষক। গতানুগতিক পত্রিকার মত সাক্ষাৎকার এর কংকালে নয় বরং আজাদ সাক্ষাৎকারের শুরুতে, মাঝে, শেষে প্রায়ই সাহিত্যশিল্পগুণ সমৃদ্ধ উঁচুমানের ন্যারেটিভ রেখেছেন। ফলে সাক্ষাৎকারটি চারজনের পরিবর্তে আসলে ক্ষেত্রবিশেষে হয়ে ওঠে পাঁচজনের সাক্ষাৎকার। একমাত্র শামসুর রাহমানের বেলায় আজাদ কোন ভূমিকা না করে স্পষ্টতই প্রতীয়মান করতে চেয়েছেন যে, শামসুর রাহমানকে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ইনাদের ছাড়াও আজাদ শিল্পী কামরুল হাসান এর সাক্ষাৎকার নেওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করেন, কিন্তু তার আগেই শিল্পীর মৃত্যু হয়।
এতদপ্রসঙ্গে এরপর আজাদ তাঁর স্বভাবসুলভ অহমিকায় লিখেছেনঃ "আমি আর সাক্ষাৎকার নেয়ার মতো কোন বাঙালি পাই নি।"
বইটিতে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের চায়জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এই চারজনই অত্যন্ত বিখ্যাত, বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রেখেছেন। ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন আজাদ নিন্দা ও প্রশংসা উভয়ই লাভ করেছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে হয়েছেন চরমভাবে বিতর্কিত। জ্ঞানের অভাব ছিল উনার, একথা উনার চরম শত্রুও হয়ত বলতে দ্বিধাবোধ করবেন। এহেন ব্যক্তি যদি সাক্ষাৎকার নেন, তবে তা আগ্রহউদ্দীপক হওয়ার কথা। কিন্তু বইটা পড়ে আমার মনে হল এসব সাক্ষাৎকার উনি অনেকটা প্রস্তুতি ছাড়াই নিয়েছেন। উনাদের সম্পর্কে যা জানতেন তা নিয়েই কাজটা সেরে ফেলেছেন। যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এখন উনাদের নামটা বলা জরুরী। প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক, প্রফেসর আহমেদ শরীফ, সাহিত্যিক শওকত ওসমান এবং কবি শামসুর রাহমান। নিঃসন্দেহে নামগুলো অনেক ভারী।
যেমনটা বলেছিলাম, হুমায়ুন আজাদ কোন প্রস্তুতি ছাড়াই সম্ভবত সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এবং গল্পের ঢংয়ে প্রশ্নগুলো করেছেন। ভাল দিক হচ্ছে উনি প্রশ্নের মাঝে মাঝে উত্তরদাতার পরিচয় এবং জীবনদর্শনও সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছেন। সবশেষে উত্তরদাতা সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভংগির কথাও বলেছেন।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে অনেকেই চেনেন। আহমেদ ছফা যদ্যপি আমার গুরুতে ওনাকে নিয়ে প্রচুর লিখে গিয়েছেন। এর বাইরে নতুন করে হুমায়ুন আজাদ খুব বেশি তথ্য দিতে পারেননি অথবা বের করতে পারেনি। আগে যা বলেছেন তাই ঘুরায়ে ফিরায়ে আবার বলেছেন। আহমেদ শরীফের সাক্ষাৎকাটা বেশ হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম প্রচারিত এই জ্ঞানবৃক্ষকে আজাদ সাহেব অনেক প্রশ্ন করেছেন এবং স্বভাবসুলভ চাছাছোলা ভংগীতে উত্তর দিয়েছেন আহমেদ শরীফ। এই অংশটা বইয়ের শ্রেষ্ঠতম সংযোজন। এরপরের জন হলেন কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। উনার অংশতে খুব আকর্ষনীয় কিছু পাইনি। তবে ভদ্রলোককে ভালই স্মার্ট মনে হল। সর্বশেষ জন হলেন কবি শামসুর রাহমান। উনার সাক্ষাৎকার এই বইয়ের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ। খোলামেলা অনেক কথাই বলেছেন। মৌলবাদীদের নিয়ে আতংক প্রকাশ করলেন। তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দল এবং গণবিপ্লবের ধারাগুলা নিয়ে উনার মন্তব্য জুলাই ২০২৪ বিপ্লবের ভবিষ্যৎ অনেকটাই বলে দেয়। আমি আশা রাখি এবার তা ভুল প্রমাণিত হবে।
সব মিলায় একটা জিনিস বুঝলাম অনেক কিছুই আমি বুঝি না। এসব লোকের জ্ঞান আর প্রজ্ঞা আমার লেভেল বাইরে। তাও যাই বুচ্ছি তার মধ্যেই লিখালাম। ভুলভাল হইলে মাফ করে দেবেন।
সাধারণত আমরা যেই সকল সাক্ষাৎকার পড়ে থাকি, সেগুলো থেকে এই সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনাকে সাক্ষাৎকারের মাঝেই বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দিয়ে হুমায়ুন আজাদ যার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তার সাথে বন্ধন তৈরি করতে সহায়তা করবে, আপনি তখন ঐ ব্যক্তির কথাগুলো আরও ভালোভাবে গ্রহন করতে পারবেন। এখানে হুমায়ুন আজাদ মোট চারজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যারা সকলেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সাহিত্য, শিল্প অঙ্গনে বেশ বড় ভূমিকা এবং ছাপ রেখে গেছেন। সেই চারজন হলেন- ১. অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ২. ডক্টর আহমদ শরীফ ৩. ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান ৪. কবি শামসুর রাহমান কিন্তু, এইখানে যেই মানুষটা তাদের সাক্ষাৎকার নিলেন তিনি আবার, হুমায়ুন আজাদ। তাই বলা যায় বইটিতে আপনি পাঁচজন জ্ঞানীগুনী মানুষের কথোপকথন শুনবেন। আমি কথোপকথনই বলবো, সাক্ষাৎকার বলতে চাইনা বইটিকে, সাক্ষাৎকার বলতে আমাদের দেশে যা প্রচলিত রয়েছে তার অনেক উর্ধ্বে বইটি। বইটিতে কখনো আলোচনা হয়েছে আমাদের ইতিহাস নিয়ে, আমাদের শিল্প-সাহিত্যে নিয়ে। যেখানে মানুষগুলো তুলে ধরেছেন নিজেদের দৃষ্টিকোণ।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করাটা খুব কঠিন কাজ, তবে হুমায়ুন আজাদ পক্ত হাতে সামলিয়েছেন। তিনার বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূ���্ণ দিক ছিলো সাক্ষাৎকার শুরুর আগে ও শেষে তথ্য সংযোজন। যেমন : জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সম্পর্কে লিখেন, "১৯৪৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত যাত্রা করেন আব্দুর রাজ্জাক। পড়াশুনা করেন লন্ডন অফ ইকনমিকসে। তিনার গবেষণার বিষয় ছিলো 'ভারতের রাজনীতিক দল'। তিনার গবেষণা পরিচালক ছিলেন বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কি" লেখকের আলোচনার ভাবে সাক্ষাৎকার অপেক্ষা কথোপকথোন শ্রেণীর লেখা বলা উত্তম মনে হয়।
হুমায়ুন আজাদের কিছু অসাধারণ প্রশ্নের উদাহরণ তুলে ধরা হলো,
১.[আবদুল রাজ্জাক : এই সময়ের জ্ঞানতাপস ]
★ তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের সমাজ কী ভালো? => ভালো আর মন্দের তালিকা ক'রে যে বাঙলাদেশের সমাজকে ভালো বলা যাবে, তা না। ভালো এই অর্থে যে এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সুযোগ আর সম্ভাবনা আছে। কথা হলো আমার প্রত্যাশা কতটুকু পুরণ হতে পারে? এমন কি আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে বুঝি সেখানকার কৃষ্ণকায়দের গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কোনো সুযোগ নাই, কিন্তুু বাংলাদেশের অধিবাসীদের সে-সুযোগ আছে।
★বিশ্বব্যাপী এখন রাজনীতিতে মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটছে।আপনার কী মনে হয় আগামী পঞ্চাশ বছরে সারা গ্রহ ভ'রে বিভিন্নরকম ধর্ম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে? => ধর্মের মূল কথা হচ্ছে এই জীবন মৃত্যুপরবর্তী এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহান জীবনের গৌণ উপাংশ মাত্র। এ ছাড়া ধর্মের কোনো সংজ্ঞা নাই। আমার মনে হয় না যে এমন বিশ্বাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভের কোনো যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনা আছে। ★শ্রেণীহীন সমাজব্যাবস্থা আমাদের জন্যে কতোটা দরকার? => আর্থনীতিক অসাম্য থাকা উচিত না, বেশি অসাম্য থাকা ভয়ংকর। একেবারে থাকবে না, এটাকে বাস্তবসম্মত লক্ষ ব'লে মনে হয় না।
২. [আহমদ শরীফ: পন্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী ]
" আমার পুঁজি হচ্ছে আমার ক্ষতি স্বীকারের শক্তি, এজন্য আমি অবিমৃষ্যকারীর মতো কথা বলে চলেছি"
★ আপনি সংস্কারের কোন দুর্গে আঘাত করেছেন? =>বিশ্বাসের দুর্গে আঘাত করেছি, কেননা বিশ্বাস হচ্ছে যুক্তির অভাব। যেসব বিশ্বাস উন্নতির আধুনিকতার প্রগতির সুষ্ঠু সমাজ গ'ড়ে তোলার পক্ষে বাধা, সেগুলোকে আঘাত করেছি। শাস্ত্রীয় অচার-আচরণ সবটাই কুসংস্কার, তার বিরুদ্ধে চিরকাল লিখেছি। ★ কোন দার্শনিক ধারাটিকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? => নাস্তিক্যধারা। জগৎ -জীবন -স্রস্টার রহস্য জানার আগ্রহ থেকে দর্শন শাস্ত্রের শুরু। কুলকিনারা না পেয়ে দূর্বলেরা আস্তিক্য দর্শনগুলো গ'ড়ে তোলেন, পরবর্তীকালে সেগুলো ধর্মনির্ভর দর্শনে পরিনত হয়। অবশ্য কেউ কেউ সংশয়বাদী হয়েছেন, নাস্তিক্যবাদী হয়েছেন। শাস্ত্রকে আমি মনে করি ম্যান মেইড ★ বিবাহপূর্ব শারীরিক সম্পর্ক আপনি কী দৃষ্টিতে দেখেন? => এতে আমার আপত্তি নেই। সামাজিক কারনেই বিয়ে দরকার, মারামারি ঠেকিয়ে রাখার জন্য। বিয়ে হচ্ছে সমাজ স্বীকৃত যৌনসম্ভোগের অধিকার।
৩. [ শওকত ওসমান : কথাসাহিত্যের পথিকৃৎ ]
★ মাদ্রাসা শিক্ষা আপনাকে কতোটা ধর্মানুরাগী ও কতোটা ধর্মবিরাগীতে পরিণত করে? => ইংরেজদের মধ্যে একটা কথা চালু আছে, ' গীর্জায় ঢোকো প্রার্থনার জন্যে নয়, ওখানে কী অনাচার হয় তা দেখার জন্য। ' সব ইন্সটিটিউশনের ভেতরে কিছু যোগবিয়োগ ঝলমল করে বা লুকোচুরি খেলে। মাদ্রাসা তার বাইরে নয় কিছু। ★ নিজেকে আপনি সফল না ব্যর্থ মনে করেন? => রবীন্দ্রনাথের একটা গান তুমি মনে করিয়ে দিলে ডক্টর আজাদ : 'কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী।' পৃথিবীকে ভালোবেসেছি এই ত যথেষ্ট। ★ বার্ধক্য আপনার কেমন লাগছে? যৌবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে? => বার্ধক্য পড়ন্ত বিকেলের মতো। এখানে এক রকমের আমেজ আছে। ক্লান্ত বলদ পা ফেলে কিন্তুু খুব দৃঢ়তার ভার। ইংরেজিতে যাকে বলে 'স্টেডি'। যৌবনে ফিরে যাওয়ার মতো ভীমরতি বার্ধক্যে এখনও পৌছাই নি। ৪. [ শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা ] ★ এখন এই ষাট বছর পেরিয়ে যাবার পর প্রেমের আবেগ কেমন? সেই তিরিশ বছর বয়সের মতোই, না অন্যরকম? => আমি মনে করি মানুষের প্রেমের যে-অনুভূতি তা সবচে তীব্র এবং প্রবল। আমার দেহের বয়স বেড়েছে এবং মনেরও কিছু বয়স বেড়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় আমার প্রেমের অনুভূতি এখনো তীব্র আছে, এবং আমৃত্যু আমি ভালো বেসে যেতে পারবো। •তিনি ব্যাক্তিগতভাবে প্রচলিত অর্থে মনুষ্যধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনার মতে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলায় উঁচু মানের লেখক বুদ্ধদেব বসু। •পাশ্চাত্যের সাহিত্যের মানের সাথে বাংলা সাহিত্যের মান সমতুল্য। কিন্তুু, আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা অনেকক্ষানি পিছিয়ে আছে। বইটি পাঠ করে বাংলা সাহিত্য ও বিভিন্ন সাহিত্যিকদের কিঞ্চিত পরিচয় লাভ করা সম্ভব। • লেখকের সামান্যতম অহমিকা প্রকাশ পায় অবতরনিকাতে, " তিনি বলেন, তিনার ইচ্ছে ছিলো শিল্পী কামরুল হাসানের সাক্ষাৎকার নিতে। তবে তা সম্ভব হয়নি। তিনি এখানে উল্লেখ করেন ' আমি আর সাক্ষাৎকার নেয়ার মতো কোনো বাঙালি পাই নি।' অনিন্দসুন্দর একটা বই। দেশের কথিত বুদ্ধিজীবীদের মতাদর্শ পড়ার উত্তম রসদ।
বইটির সবথেকে স্বার্থক দিক হলো খুব ক্ষুদ্রতার মাঝেও বাংলা সাহিত্য ও শিক্ষকতার চারজন শ্রেষ্ঠ মানুষের ব্যক্তিত্ব মোটামুটি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আর এখানেই সাক্ষাৎকার বইটির লেখক এবং সংকলক হুমায়ুন আজাদের সফলতা। প্রশ্নের নির্বাচন ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং উপভোগ্য।
আবদুর রাজ্জাকঃ এই সময়ের জ্ঞানতাপস আহমদ শরীফঃ পণ্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী শওকত ওসমানঃ কথা সাহিত্যের পথিকৃৎ শামসুর রহমানঃ নিঃসঙ্গ শেরপা
সত্তর-আশির দশকে আহমদ ছফা এবং হুমায়ুন আজাদের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলের। কখনো কখনো একে অপরের প্রতি সমালোচনা ছাড়িয়েছে শালিনতার মাত্রাও। তবে এই সাপ আর নেউলে সে ব্যক্তিটির কাছে এসে শান্ত এবং সম্পূর্ণ একমত হয়েছে তিনি জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। এই ঋষিতুল্য মানুষটির প্রতি আহমদ ছফার আর হুমায়ুন আজাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর পর্যবেক্ষণের কোন বিশেষ পার্থক্য না থাকাটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে এই বইটির প্রথম কথোপকথনে।
পণ্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী ড. আহমদ শরীফ। এই কথোপকথনে যে দিকটা আমাকে আলোড়িত করেছে সেটা হলো হুমায়ুন আজাদের একটা প্রচ্ছন্ন সমীহ ছিল আহমদ শরীফের উপর যেটা লেখকের একরোখা ব্যক্তিত্বের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষাতত্ত্বের উপর প্রগাঢ় পণ্ডিত আহমদ শরীফ প্রশ্নের উত্তর ছিল সহজ এবং সাবলীল। নিজস্ব চেতনা, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি সহজ কিন্তু প্রচণ্ড সাহসী। কথোপকথন পড়ার আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে আহমদ শরীফের প্রথাবিরোধী স্পষ্ট ব্যক্তিত্ব সম্ভবত লেখকের ব্যক্তিত্বেও বড় ধরনের প্রভাব রেখে গিয়েছিল।
সবথেকে আক্রমণাত্নক এবং গভীরতা মননশীলতা ভিত্তিক সাক্ষাৎকার ছিল এটি। শেখ আজিজুর রহমান ওরফে শওকত ওসমানকে লেখক দেখাতে চেয়েছেন বাংলায় আধুনিক মুসলিম সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ একজন কথা সাহিত্যিকরূপে। কিন্তু তিনি বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। কথোপকথনের একটা স্থান হুমায়ুন আজাদ স্পষ্ট করে জানান এবং প্রশ্ন করেন, জননী উপন্যাসটির প্রাথমিক যে ইতিহাসের উল্লেখ শওকত ওসমান করেছেন সেটি অপ্রাসাঙ্গিক এবং পুরো উপন্যাসটিকে ১০০ থেকে ১৫০ পৃষ্ঠায় বেঁধে ফেলা যেত কিন্তু দীর্ঘায়িত করা কেন হল? শওকত ওসমানের উত্তরটি ছিল অবিচলতি এবং যথার্থ। আগ্রহীরা বইটি পড়ার সময় জেনে নেবেন।
এই সমগ্র সাক্ষাৎকার সংকলনের সবথেকে উপভোগ্য অংশ জুড়ে আছেন কবি শামসুর রহমান। সবথেকে বেশি কথোপকথনও আছে এই অংশে। প্রথমে আক্রমণাত্নক মনে হলেও পরে বুঝেছি হুমায়ুন আজাদ কবির সাথে একটু খেলতে চেয়েছেন। সম্ভবত শামসুর রহমানের প্রতি লেখকের অধিকারবোধ ছিল তুলনামূলক বেশি। এলোপাথাড়ি কিছু কিছু প্রশ্নে আমি অনুভব করলাম কবি থেমে গিয়ে��েন, তারপর আবার উত্তর দিয়েছেন। শামসুর রহমানের কবিতায় বিদেশী লেখক যেমন ডিলান টমাস, ডব্লিউ বি ইয়েটস, পল এলুয়ার, কলিন উইলসনের প্রভাবের কথা যেন জোর করে স্বীকার করিয়ে নিয়েছিলেন লেখক। করেছেন প্রচুর একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন। মনে হচ্ছিল দুষ্টমির ছলে শুধু প্রশ্ন নয় এলোপাথাড়ি নুড়ি পাথর ছুঁড়ে মারছেন লেখক কবির গায়ে। আর কবি দুহাত গিয়ে ঠেকিয়ে চলেছেন। সব বোধ হয় ঠেকাতে পারলেনও না।
এই চারজনের ভেতরে যেখানে মিল দেখতে পেলাম। সেটা হলো ঈশ্বর বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের দর্শনে। প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতক্ষেত্র সমূহে প্রায় ঈশ্বর ও ধর্ম সম্পর্কে গভীরভাবে জ্ঞানী এবং উদাসীন। ধর্মের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক দিক এবং সাহিত্যে ধর্মচর্চার প্রভাব গুরুত্ব দিলেও নিজস্ব বিশ্বাসের ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বলতে সবাই অনাগ্রহী।
শুধুমাত্র "প্রথাবিরোধী" হিসেবেই বাংলাদেশের জনমানুষের কাছে বিপুল পরিচিত-নিন্দিত হুমায়ুন আজাদ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলাদেশ জন্ম পরবর্তী চার প্রধান বাঙ্গালির, দুজন পণ্ডিতঃ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ও ডক্টর আহমদ শরীফ এবং দুজন সৃজনশীল লেখকঃ উপন্যাসিক শওকত ওসমান, ও কবি শামসুর রাহমান । ক্ষীণকায় এই গ্রন্থ আকারের সীমাবদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করে আজাদের কথার সুরে বাংলাদেশ অঞ্চলের এই চার আলোকিত মানুষের অন্তরের আলোকছটা প্রায়ই অনুপ্রাণিত করে যাবে পাঠকে । প্রসঙ্গত, আবদুর রাজ্জাকের স্বচ্ছদৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য,
“হু আঃ গত এক দশকের বাঙলাদেশি রাজনীতির প্রধান লক্ষণ কী ব’লে আপনার মনে হয়? আ রাঃ প্রশ্নটা এত নির্বিশেষ ভাষায় করা হয়েছে যে উত্তরটাও নির্বিশেষেই হবে । এটা ঠিক যে দেশের সাধারণ মানুষ-রিকশাওয়ালা, বস্তিবাসীরা শেখ মুজিবুর রহমানের সময় একটু বেশি সোজাভাবে দাঁড়াতো, একটু বেশি শক্তিশালী বোধ করতো । তাঁর পরে যে তারা খুব খারাপ আর্থিক অবস্থায় পড়ে গেছে, বা তাঁর সময়ে যে খুব ভাল আর্থিক অবস্থায় ছিল, তা না । তবে এটা আমি খুব স্পষ্টভাবেই বুঝি যে এখন বিপুল সংখ্যক মানুষ অনেকটা অসহায় বোধ করে, আগে এমন অসহায় বোধ করতো না । সমাজের যত বেশি সংখ্যক মানুষ বুঝতে পারে যে সমাজে তারাও গুরুত্বপূর্ণ, তারাও সমাজের জন্য অপরিহার্য, ততোই ভাল । গান্ধী বা জিন্না জনগণের নেতা ছিলেন, জনগণের অংশ ছিলেন না, কিন্তু মুজিবের সময় জনগণ এমন বোধ করতে থাকে যে শেখ মুজিব তাদেরই অংশ । বর্তমানে এ-অবস্থাটা নাই । হু আঃ আমার কাছে বাঙলাদেশের সমাজকে নষ্ট সমাজ ব’লে মনে হয় । আপনার কেমন মনে হয়? আ রাঃ আমি এর সঙ্গে একেবারেই একমত নই । বরং আমার কাছে এই এলাকাটিকেই সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল এলাকা ব’লে মনে হয় । বাঙলাদেশের ছোটো থেকে বড় হওয়ার, তুচ্ছ অবস্থা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার যে-সুযোগ রয়েছে, তা এই উপমহাদেশের আর কোথাও নাই । শুধু উপমহাদেশ কেন, সারা পৃথিবীতেই নাই । হু আঃ এর অর্থ কি এই যে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের সমাজ ভাল? আ রাঃ ভাল আর মন্দের তালিকা ক’রে যে বাঙলাদেশের সমাজকে ভাল বলা যাবে, তা না । ভাল এই অর্থে যে এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সুযোগ আর সম্ভাবনা আছে । কথা হলো আমার প্রত্যাশা কতোটা পূরণ হ’তে পারে? এমন কি আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে বুঝি সেখানকার কৃষ্ণকায়দের গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সুযোগ নাই, কিন্তু বাঙলাদেশের অধিবাসীদের সে-সুযোগ আছে । ... হু আঃ শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা আমাদের জন্য কতোটা দরকার? আ রাঃ অর্থনীতির অসাম্য থাকা উচিত না, বেশি অসাম্য থাকা ভয়ংকর । একেবারে থাকবে না, এটাকে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ব’লে মনে হয় না । ষাট বছর কেটে যাওয়ার পরেও সোভিয়েত ইউনিয়নের শতকরা দশজন লোক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, আর ওই শতকরা দশজন লোকই সব কিছু স্থির ও নিয়ন্ত্রণ করে । এটাতো দূর করার কথা না । অর্থনীতিক অসাম্য দূর হয়েছে, আর বেশি কিছু না । শুধু অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দিলে সমাজকে তো ঠিকমতো সংজ্ঞায়িত করা করা হয় না । আমি যদি ব্যক্তি হিশেবে মূল্য না পাই অথচ আমার আয় যদি অন্যের সঙ্গে সমান হয়, তবে তা মূল্যবান না । এটা ঠিকই সোভিয়েত ইউনিয়নে আর্থ অসাম্য দূর হয়েছে । তবে তার জনে মূল্য দিতে হয়েছে । সেই মূল্য হচ্ছে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে অবিমিশ্র অসাম্য ।” (ডিসেম্বর ১৯৮৪)
এছাড়াও বহুবার প্রজ্ঞাবান আবদুর রাজ্জাকের জ্ঞানদীপ্তিতে ক্ষণে ক্ষণে আলোকপ্রাপ্তি ঘটে । হুমায়ুন আজাদের কৌতূহলী আকাঙ্ক্ষায় রাজ্জাকের ব্যক্তগত জীবনের অন্দরমহলেও খানিকটা উঁকি দেয়া যায় ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অবদানকারি গবেষক-শিক্ষক আহমদ শরিফ, যিনি কিনা কোলকাতার কমিউনাল চর্চার বিপরীতে ঢাকার প্রতিনিধি হিসবে মধ্যযুগের মুসলমান সাহিত্যিকদের প্রায় একমাত্র আবিষ্কর্তা হয়ে তাদের কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন । পুরো ইতিহাস বদলে দিয়েছিলেন । সেই আহমদ শরিফ ঢাকায় ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন একজন মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবেই । এটা ব্যক্তির ইতিহাস দিয়ে বোঝা যাবে না, এটা একটি সংস্কৃতির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-বিন্যাস-পরম্পরা থাকে তা দিয়েই বুঝতে হবে । হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকারে আহমদ শরিফের এই গবেষক দিক, তার ব্যক্তিত্বের ইস্পাত কঠিন অথচ মানবিক দিকগুলো-জীবনযাপন, শিক্ষক জীবন এবং তাঁকে যে কারণে নিন্দা করা হয় সেসব দিকেরও সন্ধান পাওয়া যায় । আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকার কারণে আহমদ শরিফকে কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তার জীবন যাপনের কিছু টুকরো পাঠকের সামনে তুলে ধরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন একজন শিক্ষক আসলে কেমন এবং শিক্ষকের শক্তিমত্তার দিকটাই বা তার জীবনাচরণে কীভাবে প্রকাশ পায় ।
শওকত ওসমান বা শামসুর রাহমানকেও নিঙরে নিয়েছেন ইতিহাস-পরম্পরা এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনিতীক প্রেক্ষাপটে । আজাদের চেষ্টায় ছিল এই সৃজনশীল মানুষদের চিন্তাধারার গতিপ্রকৃতি, রাজনীতির শুলুক-সন্ধান । মানব সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে আর তার বিস্তৃতি সমাজ, ধর্ম, শাসন, দর্শন, শ্লীল-অশ্লীল, পবিত্র থেকে অপিবিত্র পর্যন্ত ।
আজাদ প্রকৃত অর্থে প্রথাবিরোধী কিনা বা তার ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় প্রথাবিরোধীতার লক্ষণ দেখায় যায় কিনা এসবই ভিন্ন আলাপ । আজাদ তার নিজের সময়ে যেভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে নিজে কথা বলতেন এবং অন্যদের সাথে কথা বলতেন তা আজকের আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক বাস্তবতায় কল্পনাও করা যায় না । আর আজাদের ক্ষুরধার গদ্য শৈলী পাঠ করার আনন্দও অস্বীকার করি কী করে! তাই এই কৃশকায় বইটি বিষয় বৈচিত্র্যময়তায় মনের গভীরে দাগ কেটে যায় অনায়াসে ।
এক মহাতারকা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অন্য চার মহাতারকার। তাই ১+৪=৫ তারকা দিলাম।
সাক্ষাৎকার গ্রহীতা যদি জ্ঞানের গভীরতায় সাক্ষাৎকার প্রদানকারির চেয়ে পিছিয়ে থাকেন তাহলে তাদেরকে সঠিকভাবে ধরা যায় না। তখন আমরা কিছুটা জানতে পারি কিছুটা পারিনা। হুমায়ুন আজাদের নেয়া এই সাক্ষাৎকার সেই অভাব ঘুচিয়েছে। এখানে আসলে শুধু প্রশ্ন আর উত্তর নয় বরং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের আলোচনা হয়েছে। কিছু কিছু কমন প্রশ্ন তিনি চারজনকেই করেছেন যা থেকে আমরা সেই বিষয়ে চা���জনের নিজস্ব মতামত জানতে পারি। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতভিন্নতাও আমরা দেখি তবে একটা জায়গায় তারা চারজনই এক; তারা একটি ন্যায়ানুগ সমাজের স্বপ্ন দেখতেন যে সমজের ভিত্তি হবে মানবিক মূল্যবোধ, যে সমাজ তাড়িত হবে যুক্তি দ্বারা।
সে বইই ভালো বই যে বই আমাদের ভাবায়, চিন্তা করতে শেখায়। তাই সাক্ষাৎকার ভিত্তিক বই হয়েও এটি একটি ক্লাসিক লেবেলের বই।
হুমায়ুন আজাদ সাক্ষাৎকার নেননি চিরাচরিত রীতিতে। তাই ভাল লেগেছে। প্রথম তিনজনের ক্ষেত্রে জায়গায় জায়গায় টীকা যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। তবে আব্দুর রাজ্জাকের অংশ থেকে নতুন খুব একটা কিছু পেলাম না।
চারজন প্রধান বাঙালি :আব্দুর রাজ্জাক,আহমদ শরীফ,শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান এর সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন এই বইয়ে।উঠে এসেছে এসব বাঙালির জীবনযাপন, বিশ্বাস,বোধের চূড়ান্ত প্রকাশ।তাদের জীবনের না জানা কথা,জীবন সম্পর্কে তাদের ভাবনা তুলে ধরেছেন অকপটে। না বলা নানা কথা, জ্ঞানের প্রচন্ড প্রকাশ সম্পূর্ন হয়েছে।তাদের কবিপ্রতিভা,জ্ঞানের রাজ্যে তাদের বিচরনের নানা গল্প সাক্ষাৎকারে এসেছে। এই চার মহান বাঙালি সম্পর্কে জানতে, তাদের জ্ঞানের গভীরতা বুঝতে অবশ্যপাঠ্য এই বই।
বিভিন্ন সময়ে প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের টক শো দেখার সুযোগ হয়েছে, বই পড়া তো হয়েছেই। তাঁর উল্লেখ করার মতো বিশেষ একটি দিক আছে, তা হলো কোনো লুকোছাপা নাই। যা বলেন এবং লিখেন তা অত্যন্ত অকপটেই বলেন বা লিখেন।
এই বইয়ে জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান ও শামসুর রাহমান এই চারজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ। সাক্ষাৎকারের বেলাতেও তিনি তাঁর সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছেন যা বইটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। উক্ত চারজন ব্যক্তিই আমাদের জাতীয় ও সাহিত্য অঙ্গনে অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, এমনকি সাক্ষাৎকার নেওয়া হুমায়ুন আজাদও প্রভাবশালী লেখক। তাদের জীবন ও জগৎ নিয়ে মনখোলা প্রশ্ন, সেই প্রশ্নের অকপট উত্তরে ঝলমলে হয়ে ফুটে ওঠেছে জীবন, সাহিত্য, দর্শন ও সমাজ। অনুসন্ধিৎসু মনের জন্য এই বই হতে পারে যুৎসই একটি খোরাক।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে হুমায়ুন আজাদের অ্যাপ্রোচ বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এগুলোকে সাক্ষাৎকারের চেয়ে কথোপকথন বলাই শ্রেয়, যদিও হুমায়ুন আজাদ ক্ষেত্রবিশেষে নিজের কথা, মতামত বা প্রশ্ন দীর্ঘ করলেও অন্য ব্যক্তিটিই যে মুখ্য তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। হুমায়ুন আজাদ বিদগ্ধজন, কাজেই তাঁর প্রশ্নগুলো ক্লিশে "আপনার প্রিয় ফুল কোনটি" বা "আপনার শৈশব কোথায় কেটেছে" জাতীয় জিজ্ঞাসায় সীমাবদ্ধ ছিলো না। তিনি অত্যন্ত ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে সাহিত্য বিষয়ক সিরিয়াস ধরনের প্রশ্ন করেছেন; মাঝে মাঝে প্রেমিকা যৌনতা শরীর মদ্যাসক্তি বিষয়ক ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসাও বাদ পড়েনি। প্রচলিত সাক্ষাৎকারের রীতিতে এই ধরনের প্রশ্ন সাধারণত করা হয় না বিব্রত করবার আশঙ্কায়, তবে এই বিষয়গুলোর অবতারণা হলেও সাক্ষাৎকারদাতা ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা সন্দেহাতীতভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, তাঁরা আদৌ বিরক্ত বা বিব্রত হননি, ফলে কথোপকথনের সাবলীলতা নষ্ট হয়নি। এছাড়া মাঝে মাঝে হুমায়ুন আজাদ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খুঁচিয়ে কিংবা বিব্রত করেই উত্তর বের করতে চেয়েছেন, অপরজনের ভাবনা আদর্শ সাহিত্যকর্ম নিয়ে অকপটে বিরূপ মতামত দিয়েছেন, তবে সেসবকে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়নি। এই চারটি সাক্ষাৎকারের মধ্যে সবচেয়ে উপভোগ্য ছিলো শওকত ওসমানেরটি, তবে বাকিগুলোও চমৎকার।
যারা জ্ঞানী তারা সর্বত্রই সমাদৃত।কারন যারা জ্ঞানী তারাই একটি জাতির প্রকৃত ইতিহাস, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে। জ্ঞানীদের সম্মান পৃথিবী চিরকাল দিয়ে গেছে এবং যাবেও। কিন্তু আমার আপসোস হয় সেই সকল জ্ঞানীদের জন্য 'যারা তাদের পুরো জীবনব্যাপী জ্ঞান অর্জনের পেছনে দৌঁড়েও নিজের রবকে, নিজের সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পায় না'। এমন জ্ঞানীদের জন্য এক কলসি সমবেদনা ছাড়া আর কিছুই নেই আমার কাছে।
পরিশেষে বলব , বইটি থেকে চিরপরিচিত কিছু নাম যাদের সম্পর্কে খুব বেশি জ্ঞান আমার ছিলো না, তাদের সম্পর্কে কাছ থেকে জানতে পেরেছি। আর, হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ধরনটা বেশ চমৎকার ছিল। মনোযোগ ধরে রেখেছে পুরোটা সময়।
বরাবের মতই হুমায়ুন আজাদ তাঁর ঝাঁঝালো মেজাজ নিয়ে উপস্থিত, যে কারনে সাক্ষাৎকারগুলো উপভোগ্য । সাক্ষাৎকার গ্রহনকারী, প্রদানকারীর চেয়ে কম সরব হওয়াই শোভন মনে হয়, যদি হুমায়ুন সেটা বিশ্বাস করেন বলে মনে হয়নি । এ জন্যই আহমদ শরীফ এর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, 'বিনয়ের চেয়ে প্রতিভার ঔদ্বত্যই শ্রেয়' । সুখপাঠ্য একটা সাক্ষাৎকার গ্রন্থ ।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভিন্নভাবে জানার এক মাধ্যম সাক্ষাৎকার। লেখক এখানে সাক্ষাৎকারের আগে বা পিছে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংযুক্ত করেছেন। যা সাধারণত দেখা যায় না। একারণেই একটা পূর্ণতার ছাপ পাওয়া যায়। এখানেই লেখকের সার্থকতা। তিনি পাঠকের আকাঙ্খা কে ধরতে পেরেছেন। ব্যতিক্রমী ধাঁচের এই সাক্ষাৎকার এ জন্যেই ভালো লেগেছে। আলোচনাতে এসেছে অনেক কিছুই। মিল ছিলো, ছিলো অমিলও। এর মধ্যেই ভালো লেগেছে, ক্লান্তি আসেনি কোথাও।।