Syed Shamsul Haque (Bangla: সৈয়দ শামসুল হক) was a Bangladeshi poet and writer. Haq lived alternately in Dhaka and London. He wrote poetry, fiction, plays - mostly in verse and essays. He, the youngest writer to be honored with Bangla Academy Award, achieved it at the age of 29. He was honored with Ekushey Podok in 1984.
(সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মেছিলেন। বর্ণাঢ্য লেখকজীবনের অধিকারী সৈয়দ হক। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্রের গান – যা লিখেছেন সবকিছুতেই পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, সাফল্য।
মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান সৈয়দ হক। এখন পর্যন্ত বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ লেখক তিনি।
সৈয়দ হকের লেখালেখির শুরু তাঁর শৈশবেই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে লিখে ফেলেন দুই শতাধিক কবিতা। ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ‘উদয়াস্ত’ নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়। সেটাই তার প্রথম ছাপা হওয়া লেখা।
সেই বছরই বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে গিয়েছিলেন তিনি। কাজ করেন পরিচালকের সহকারী হিসেবে। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করেননি। পুরোপুরি মনোযোগ দেন লেখালেখিতে।
১৯৫০-এর দশকেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। এ সময় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয় ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’। তাঁর উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়।
সৈয়দ শামসুল হক চিত্রনাট্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্য প্রচুর গান লিখেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’।
তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘একদা এক রাজ্যে’, ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘অপর পুরুষ’, ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’।
বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘বারো দিনের জীবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’।
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যনাট্য। এ ছাড়া অসংখ্য অনুবাদ এবং শিশুসাহিত্যে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সৈয়দ হক।)
বেসরকারি অফিসের নিরীহ কেরানি নজরুল ইসলাম নিজেকে আবিষ্কার করে বদ্ধ কামরায়। সে বুঝতে পারেনা কেনো তাকে আটক করা হয়েছে। তিনজন পাকিস্তানি সৈন্য তাকে নানা প্রশ্ন করতে থাকে। একাত্তরের মার্চের সময়ে সে কি করছিলো,কোথায় গিয়েছিলো ইত্যাদি। সে উত্তর দিতে গিয়ে দেখে যে আরো বিপদে পড়ে যাচ্ছে। যেমন দুপুরে কোথায় খেয়েছিলো প্রশ্নের জবাবে সে উত্তর দেয় সদরঘাটের হিন্দু মাছ-ভাতের হোটেলে। মুসলমান হয়ে হিন্দুর হোটেলে কেন খেতে গেলো এ পাল্টা প্রশ্নে সে আরো বিপাকে পড়ে যায়। নানা প্রশ্নের যখন যখন এক সৈনিক খবরের কাগজের টুকরো মেলে ধরে যাতে বাংলাদেশের পতাকার উপর লেখা "জয় বাংলা'। নিচে লেখা " তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নতুনের কেতন উড়ে কালবৈশাখীর ঝড়।" তখন সে বুঝতে পারে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে ওরা গুলিয়ে ফেলে কেরানি নজরুল ইসলাম কে। সে বারবার বোঝাতে চায় যে সে কবি নজরুল নয়, কিন্তু ব্যর্থ হয়। নেমে আসে অত্যাচার, নৃশংসতা। ওরা কবি নজরুল তথা কেরানি কে বিবৃতি দিতে বলে কারন কবির কথা সবাই শ্রদ্ধার সাথে মানে, যাতে লেখা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশের অখণ্ডতা রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব করছে,তাদের বাধা প্রধানকারী দেশের শত্রু।ইসলাম প্রতিষ্ঠার এই মহৎ জেহাদে সবাই যেনো শরিক হয়। কেরানি নজরুল ভীতু মানুষ যে, কোন রকমে মুক্তি চায় এখান থেকে।সে কি এই ঘৃণিত বিবৃতি দিয়ে বাড়ি চলে যাবে ? নাকি নিরীহ নজরুল বিদ্রোহী নজরুলের চেতনা ধারণ করে গর্দান উদ্যত করে প্রতিবাদ করবে?
খুব ছোট্ট কিন্তু কি বিশাল ইমপ্যাক্টফুল আশ্চর্য এই লেখা! সৈয়দ সাহেবের এই উপন্যাসিকা সবসময় মুগ্ধ করবে আমায়।
নজরুল ইসলাম বেসরকারি অফিসের একজন কেরানি। একদিন হঠাৎই তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন এক বদ্ধ কামরায়। বুঝতে পারেননা কেনো তাকে আটক করা হয়েছে। তিনজন পাকিস্তানি সৈন্য তাকে নানা প্রশ্ন করতে থাকে। একাত্তরের ২৫ শে মার্চের সারাদিন সে কি করছিলো,কোথায় গিয়েছিলো, কার কার সাথে দেখা করেছে। সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দেখে, সে আরো বেশী বিপদে পড়ে যাচ্ছে। আর সব কথার মাঝে একটা প্রশ্ন বার বার করে তার কাছে করা হচ্ছে -- সে কবিতা লেখে, সে কবি, তার কবিতা পত্রিকায় প্রকাশও পেয়েছে। এসব শুনে তার মাথায় গোলমাল পাকিয়ে যায় কারণ, সে তো কখনোই কবিতা লেখে নাই। একটা সময় সে বুঝতে পারে নামের কারণে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে ওরা গুলিয়ে ফেলে কেরানি নজরুল ইসলাম কে। সৈয়দ শামসুল হকের খুবই কম পরিচিত অসাধারণ এক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস "নীল দংশন"
১৯৪৮ সালে বর্ধমান থেকে ঢাকায় আসা কাজী নজরুল ইসলাম, যে কেরানি এক বেসরকারি অফিসে, যখন ২৭শে মার্চ ঢাকা ত্যাগ করার সময় সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়। এরপর, অজ্ঞাত স্থানের এক কক্ষে রাখা হয় তাকে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বারে বারে। সেনাবাহিনীর অফিসারদের কাছে সে কবি নজরুল। তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও, যে শর্ত মানতে হবে, সেটাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় বর্ধমানের কাজী নজরুল ইসলামের কাছে, যে কবি নয়।
আকারে ছোট, কিন্তু অত্যন্ত প্রভাববিস্তারকারী এক উপন্যাসিকা।
২০২৫ রিভিউ বিষয়: বই রিভিউ: ৫০ বই: নীল দংশ।ন লেখক: সৈয়দ শামসুল হক
গল্পটা কেন যেন একটা ধাক্কা দিল। প্রেক্ষাপট মু।ক্তিমযু।দ্ধের। কিন্তু এই ঘটনা চিরন্তন। এইভাবেই দংশ। করবে, করে যায়। শো।ষিত সাধারণ মানুষ। ছা পোষা কেরানী কাজী নজরুল ইসলাম। বি।দ্রো হী কবির নামে নাম। শুধু এই নামের জন্য্ তাকে তুলে নিয়ে যায় পাক হানা।দার বাহিনী। ট।র্চার স।এলে তাকে ভয়া।বহ কশট দিয়ে মুখ থেকে, লিখিত নেয়ার চেষ্টা করা হয়, সেই বি।দ্রোহী কবি। কিন্তু ছা পোষা কেরানী, সত্য -মিথ্যেই আছন্ন। সে রাজী হয় না, মিইথ্যে কাগুজে ছাপ দিতে। তারপর?
না, এটা কোন রিভিউ না, কেবল নিজের মনে যা একটু এল, লিখে গেলাম।
কেবল নজরুলের মত ঘটনা কত শত ঘটেছে। আজ ২৫ সালে এসে, এরকম আর কিছু না ঘটুক।
সব শেষ কথার শেষ “ তোরা সব জয়ধ্বনি কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর! ঐনূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড় তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!”
সেই সময়ে পাকিস্তানী হানাদার রা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে কাজী নজরুল ইসলাম নামক এক বিদ্রোহী ভদ্রলোক জ্বলাময়ী সব কবিতা লিখে বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য প্রলুব্ধ করতেছে । সুতারাং তারা ঠিক করে কাজী নজরুল ইসলাম কে ধরলে সমস্যাটার একটা সমাধান করা যাবে । তো ধরে নিয়ে আসা হয় কাজী নজরুল ইসলাম কে । কিন্তু ভালোরকম টর্চার করার পরেও নজরুল কিছুতেই মানতে চাচ্ছেন না যে সে কবিতা লেখেন । কি ব্যাপার ? গোলমালটা কোথায় ?
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অনেকই আছে বাংলা সাহিত্যে। তার মধ্যে বেশ কিছু খুব মেধাবী, কিছু এভারেজ আর কিছু গৎ-বাঁধা। মুক্তিযুদ্ধ আমার পছন্দের জনরা নয়; তাই বলে ব্যতিক্রম কিছু পেলে ভালো লাগবেনা তা না। সব্যসাচী লেখক বলে খ্যাত সৈয়দ শামসুল হক সমসময়ই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এর মূল কারনই কিন্তু লেখালেখি নিয়ে তার নানা সময়ের নানা "নিরীক্ষা" এবং ফলতঃ পরাণের গহীন ভেতর(কবিতা), এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (কবিতা), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ(উপন্যাস), নিষিদ্ধ লোবান(উপন্যাস), নীল দংশন (উপন্যাস)। এরকম আরো অনেক নাম নেয়া যায়, সে লিস্টে না যেয়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস "নীল দংশন" নিয়ে কথা বলি।
কাহিনির শুরু বা মোড় এখান থেকেই। ২৭ শে মার্চ সামান্য সময়ের জন্য কারফিউ ওঠে গেলে গল্পের মূল চরিত্র "নজরুল ইসলাম" তাঁর বৌ বাচ্চাকে দেখতে জাফরগঞ্জের উদ্দেশ্যে বের হয়। কিন্তুু মিরপুর ব্রিজের ওপর থেকে থাকে মিলিটারিরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নেয়। এই জিজ্ঞাসাবাদটাই যেন হয়ে উঠে একটা কবিতা।
এই কাব্যিক বা টুইস্টেড জিজ্ঞাসাবাদ কে কেন্দ্র করেই রচিত এই উপন্যাস।
- নাম কি? - নজরুল ইসলাম। - কাজী নজরুল ইসলাম? - হ্যাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম। - জন্মস্থান বলুন? - বর্ধমান জেলায়। - ভারতে? - হ্যাঁ, ভারতে।পশ্চিম বাংলায়।ঢাকায় আসি ১৯৪৮ সালে। - কবিতা লিখতে শুরু করেন কবে থেকে? - কবিতা?
এরকম একটা প্রশ্ন বুঝতে পারে না। তাঁকে কেনই বা এমন প্রশ্ন করা হবে! সে তো কবি না, কবিতা লেখে না। সামান্য কেরানী। সে আরো ফেঁসে যায় যখন তল্লাশিতে তার পকেটে পাওয়া যায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের কবিতার একটি অংশ --"তো-রা স-ব জ-য়-ধ্ব-নি ক-র"।
একটা সময় সে বুঝেতে পারে তাঁরা তাঁকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভেবেছে! কেননা তাঁর নামও কাজী নজরুল ইসলাম! তাঁর জন্মস্থানও যে বর্ধমানে, '৪৭ এর দেশবিভাগে সে এদেশে এসেছিলো। সে হাসতে হাসতে অস্বীকার করে, বিনিময়ে তার উপর নেমে আসে আরো তীব্র নির্যাতন। তার পরে একটা পর্যায়ে তার সামনে একটা একটা বিবৃতি দেয়া হয়:- "আমি কাজী নজরুল ইসলাম দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে আমি বাঙালির দেশদ্রোহিতায় আমি আমি ক্রুদ্ধ এবং মর্মাহত। "
একটা মাত্র "দস্তখত" এই বিবৃতির নীচে তার মুক্তির পাসপোর্ট। একটি মাত্র দস্তখত..... ঠিক তখনি এই নজরুল ইসলামের মধ্যে ভর করে কাজী নজরুল ইসলাম..!! অন্য কোনো নজরুল দ্বারা এই নজরুল ইসলাম নিয়ন্ত্রিত হতে থাকেন। এখান থেকে মূলতঃ পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করবেন একজন শৈল্পিক বোদ্ধা হিসেবে।
এই ঘটনাপ্রবাহ আপনাকে ভাবাবে, ভিন্ন ভাবে ভাবতে ও দেখতে শেখাবে। ঠিক যেন কবিতার মতো- কবিতার কিন্তু ভুল কোন ব্যাখ্যা নেই। আপনি যেভাবে যে প্রবাহে আপনার ভাবনা বইতে দেবেন- সেটাই ঠিক। এই উপন্যাস আপনাকে ভাবাবে- দেখাবে কিভাবে একজন ছা-পোষা ভীতু কেরানী তার অন্তিম পরিণতি নিশ্চিত জেনেও বিদ্রোহী কবির সত্তা ধারণ করে সে ঘোষণা করে "বিদ্রোহ"।
কিভাবে একটা কবিতা না লিখেও জীবনে - একজন হয়ে ওঠেন আরেকজন সত্যিকারের "কাজী নজরুল ইসলাম"। কিভাবে এবং কখন একটা কবিতা বা সৃষ্টি হয়ে ওঠে শ্রষ্ঠার থেকেও বড়।
এবং একি সাথে দেখবেন সৈয়দ শামসুল হক কিভাবে এই লেখায় একটা অন্তঃসারশূন্য সময়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার প্রয়াস কি নিপুনভাবেই না করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তথাকথিত উপন্যাসগুলোতে এমন ব্যতিক্রমী কনসেপ্ট দেখানোর ব্যাপারটা বোধহয় এর আগে ঘটেনি। উপন্যাসের এক অসম্ভব ক্ল্যাইমেক্সের মোড়ে নিঃশব্দ ভায়োলেন্সের আঁচটা বেশ স্পষ্ট। এমন টানটান গদ্যে ন্যারেটর এতটুকু স্বস্তি বা জিরোবার জায়গা রাখেনি পাঠকের জন্যে - এবং এটাই যেন "নীলদংশনের" সার্থকতা। স্মার্ট, ছিপছিপে এবং টানটান উত্তেজনাময় গল্পে যেমন আছে পাকহানাদার বাহিনীদের র্নিবুদ্ধিতার চিত্র, তেমিন উল্টো পাশে আমারা পাই আপোসহীন ও আদর্শবাদী অবতারে আমাদের প্রোটাগনিষ্টকে। যুদ্ধের অনুষঙ্গ বা মোটিভ হয়ে ওঠে তখন কবিতা; তবে গদ্যে।
মূল প্লটের ভরকেন্দ্র যে কবিতা সেটা থেকে সরে না যেয়ে গদ্যের শুরুতেই লেখক আমাদের যে প্রোটাগনিস্টের সাথে পরিয় করিয়ে দেন - কাহিনি যতই অগ্রসর হয় আমরা সেই প্রোটাগনিষ্টকে ক্লিনচিট দিতে পারি না হয়তো। শ্লেষ আর কৌতুকের স্বর বেয়ে বেয় বরং "বুকপকেটে পাওয়া কবিতা" হয়ে ওঠে গদ্যের মূল প্রোটাগনিস্ট। কাহিনির শুরু থেকেই এমন শ্লেষ আর কৌতুকের স্বর মাখা থাকে উপন্যাসের পাতায় পাতায়।
সৈয়দ শামসুল হকের "নীলদংশন" উপন্যাসটি শুধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিষয় না, বরং আমাদের দেখায় খারাপ এবং ভালোর ধোঁয়াটে আপেক্ষিকতার মধ্যে আমাদের যে বেঁচে থাকা - তা হয়তো যায় না। তারপরেও আমরা বেঁচে থাকি। সেই জীবনটাকে যে বাহারি অনুশাসন ক্রমশ বেঁচে থাকার ভিন্ন ভিন্ন প্যারামিটার হিসাবে সাজিয়ে দেয়, তার পরিধি ঘেঁসে মিছিল, ব্যারিকেড থেকেও নৈঃশব্দ হয়ে ওঠে সফল প্রতিবাদের টনিক। এমনই এক বিরল ভাবনার গদ্যরূপ "নীল দংশন"।
এই উপন্যাস আপনাকে দেখাবে এবং শেখাবে কি্ভাবে বিশেষ মুহূর্তে এবং প্রয়োজনে "‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করতে" পারার শক্তি রপ্ত করে। তবে "নীল দংশনকে" পড়ার বেলা "না" বলবেন না।
এই অসাধারণ উপন্যাসটি পাঠের তৃপ্তি ও অভিজ্ঞতা আপনাদের মনে থাকবে।
বই - নীল দংশন। লেখক - সৈয়দ শামসুল হক। প্রকাশন - বিদ্যাপ্রকাশ।
- নাম কি? - নজরুল ইসলাম। - কাজী নজরুল ইসলাম? - হ্যাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম। .................... - জন্মস্থান বলুন? - বর্ধমান জেলায়। - ভারতে? - হ্যাঁ, ভারতে।পশ্চিম বাংলায়।ঢাকায় আসি ১৯৪৮ সালে। - কবিতা লিখতে শুরু করেন কবে থেকে? - কবিতা?
প্রতিটি জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয় এভাবে, শেষ হয় কবিতা লেখে কিনা জিজ্ঞাসা করে।একই প্রশ্ন করা হয় বার বার এবং প্রতিবারেই মনপুতঃ উত্তর যাওয়া যায় না বলে চলতে থাকে অকথ্য নির্যাতন।চেতন ও অচেতন অবস্থায়ও চলতে থাকে জিজ্ঞাসাবাদ।
অনেকের মতো ১৯৪৮ সালে জন্মস্থান বর্ধমান ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে কাজী নজরুল ইসলাম। সেই থেকে বাংলাদেশই তার ভালোবাসার স্থান। ২৭শে মার্চ পরিবারের কাছে জাফরগঞ্জে যাওয়ার পথে অনেকের সাথে পাকবাহিনীর কাছে ধরা পড়ে নজরুল। সবাই ছাড়া পেলেও সে ফেঁসে যায়।কারণ তল্লাশি করে তার পকেটে পাওয়া যায় পত্রিকার একটা কাটা অংশ যেখানে ছিল কবি নজরুলের কবিতার একটি অংশ --"তো-রা স-ব জ-য়-ধ্ব-নি ক-র"।
বিদ্রোহী কবি সন্দেহে শুরুতে আন্তরিকতার সাথে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।জিজ্ঞাসা করা হয় মার্চের দিনগুলোতে তার কার্যকলাপ সম্পর্কে। ��াদাসিধে নজরুল প্রতিবারেই তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয় সে যে বিদ্রোহী কবি নন এটা।ফলে পাশবিক নির্যাতন চলতে থাকে তার উপর। সন্দেহ ও জিজ্ঞাসাবাদ সহজে শেষ হয় না বলে সমান্তরালে চলতে থাকে নির্যাতন।
অধৈর্য পাকবাহিনী অবশেষে অন্য উপায় অবলম্বন করে। তারা একটি বিবৃতিতে তাকে স্বাক্ষর করতে বলে,যেখানে লেখা ছিল 'মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডে কবি ক্ষুদ্ধ।অবিলম্বে পাকিস্তান রক্ষায় তাদের এগিয়ে আসা।' এবারও না সূচক উত্তর আসে তার কাছ থেকে। শেষ চেষ্টা হিসেবে পাকবাহিনীরা মানুষকে সুপথে আনার জন্য তাকে একটি কবিতা লিখতে বলে।বিদ্রোহী কবি না হয়েও নজরুলের মধ্যে জেগে বিদ্রোহী কবির সত্তা ,সে বুঝতে পারে পাকবাহিনীর ভয়ের উৎস। তাইতো অন্তিম পরিণতি নিশ্চিত জেনেও বিদ্রোহী কবির সত্তা ধারণ করে সে ঘোষণা করে"বিদ্রোহ"।
খুবই সাদামাটা একটি গল্প।যেখানে নেই যুদ্ধের ভয়াবহতা কিংবা মুক্তিবাহিনীর সাফল্য গাঁথা। সাধারণ একটি চরিত্রকে নিয়ে লেখক কবি নজরুলের বিদ্রোহী মনোভাব তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং এ কাজে তিনি সফল। বাঙালি সংস্কৃতি তথা কবি নজরুল এবং তার কবিতাকে কতটা ভয় পায় শোষক গোষ্ঠী,সেই চিত্রই এই গল্পের প্রধান উপজীব্য।গল্পটি পড়তে গিয়ে মনে পড়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প 'রেইনকোট' গল্পটির কথা। সেই প্রধান চরিত্রের মত নজরুলও একজন সাধারণ মানুষ যারা স্থান ও কাল ভেদে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। অন্য অর্থে নজরুলও একজন মুক্তিযোদ্ধা,কারণ তিনি অন্তরে লালন করেছেন দেশপ্রেমকে।স্ত্রী-সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও তিনি শোষকশ্রেণির হাতের পুতুল হননি। সবশেষে ছোট এই উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন কথাসাহিত্যের অপূর্ব ব্যবহার,যা অনেক দিন মনে রাখার মত।
'নামে নামে যমে টানে'- একটা প্রবাদ আছে। এই প্রবাদ দিয়ে বুঝানো হয়, নামের কারণে অনেক সময় অন্য ব্যক্তিও সাফার করে। কারণ ওই এক ই 'নাম'।
( সামান্য স্পয়লার আছে )
নজরুল ইসলাম একজন কেরানি। ১৯৭১ সালের ২৭ শে মার্চ সে ঢাকা ত্যাগ করার সময় সেনাবাহিনীর হাতে আটকা পড়ে। অজ্ঞাত এক রুমে অনবরত তাকে 'জিজ্ঞাসাবাদ' করা হয়। ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলা হয় । তবে পাক সেনাদের দাবি একটাই 'কবিতা'।
কবিতা? যেই ভদ্রলোক কোনোদিন প্রিয়তমাকেও চিঠি অব্ধি লিখেনি সে লিখবে কবিতা? তাও বিদ্রোহের? বাঙালিদের নাকি উস্কানিমূলক কবিতা লিখে তা দাবী করে সেনারা। নজরুল ধীরে ধীরে বুঝতে পারে নামের কারণেই সে ফেঁসে গেছে! বেঁচে ফেরার পথ ও আছে । নতুন নজরুল হওয়া, পাকবাহিনীর নজরুল হয়ে বেঁচে থাকতে হবে ,তাদের পক্ষে কবিতা লিখতে হবে।
কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে নজরুল তা পারেনি। নিজে কবিতা না লিখলেও আসল কাজী নজরুলের জন্য পথ খুলে রেখে গিয়েছে আরেকটি প্রতিবাদী কবিতা লেখার, আরেকটি জয়ের উল্লাস জানানোর মিছিলের জন্য।
'মোরা একটি কবিতার জন্য যু দ্ধ করি' -তাই না?
ছোট্ট মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই উপন্যাসিকা এতটা প্রতাপশালী, প্রভাবশালী!!! নেই কোনো ড্রামাটিক অত্যাচার , অদ্ভুত শক্তিশালী চরিত্র। অথচ আশ্চর্য এক শিক্ষা দিয়ে গেছে নজরুল। দেশ প্রেমের জন্য মানুষের আবেগ , অনুভূতি, জীবন দিয়ে রক্ষা করার গল্প বলে গেছে।
'সৈয়দ শামসুল হক' এত চমৎকার উপন্যাস লিখে গেছেন তা আমি জানতাম না। ৬০ পেইজের এই উপন্যাস পড়ে আমি মুগ্ধ। এক কথায় বলবো 'অতি চমৎকার'।
▫️বই: নীল দংশন ▫️লেখক: সৈয়দ শামসুল হক ▫️প্রকাশনায়: ঐতিহ্য
গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা একটি ঔপন্যাসিকা। যেখানে নজরুল নামের ব্যক্তিকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মনে করে তুলে আনা হয় রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের কারণে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে সরকার বিরোধী একটি কবিতা তোলপাড় করে করে বিদ্রোহী তরুন, যুবকদের মাঝে। যা পাক ও রাজাকার গোষ্ঠীকে বায়ুরুদ্ধ করে তোলে।
গ্রন্থটিতে আমরা জানতে পারি একটি কবিতার শক্তি। সামান্য কয়েকটি বাক্য কিভাবে জোচ্চর শাসকগোষ্ঠীর ঘুম হারাম করে দিতে পারে!
রচনাটিতে আদর্শকে বড় মাপে দেখানো হয়েছে। শকুনের সামনেও ব্যক্তিত্বকে ছাড় না দিয়ে সর্বদা সত্যের হাত ধরে এগোনোর প্রচেষ্টা যে গল্পের চরিত্রকে মৃত্যুকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে জ্ঞাত হয়েও কট্টর আদর্শবাদের জায়গায় নজরুল নামের ব্যক্তিকে অনড় রেখেছিলেন লেখক।
কবি নজরুলের সাম্যবাদের চিন্তা থেকে সরে এসে পাক-দালালদের সাথে হাত মেলানোর যে চুক্তির প্রস্তাবনা চারিত্রিক নজরুল প্রত্যাখ্যান করেছে তাতে হয়ত তার জীবননাশ ঘটবে কিন্তু মৃত্যুর আগে আত্মার কাছে, সমাজের মধ্যে সে থাকবে একজন বীর হয়ে। অবরুদ্ধ নজরুল জানত একটি প্রত্যাখ্যাত প্রস্তাবে হাজারো বীর মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তাই হয়ত সে প্রাণের বিপরীতে বেছে নিয়েছিল বীরদের। (হাবিব)