Jump to ratings and reviews
Rate this book

নির্বাসিতের আত্মকথা

Rate this book
উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট চরিত্র। মুরারীপুকুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে দ্বীপান্তরিত হতে হয়। ঠাঁই হয় আন্দামানের কুখ্যাত জেলে। "নির্বাসিতের আত্মকথা" কারাবাসের সেই অন্ধকার দিনগুলিরই এক মর্মস্পর্শী বিবরণ।

135 pages, Unknown Binding

First published January 1, 1921

2 people are currently reading
79 people want to read

About the author

Upendranath Bandyopadhyay

3 books2 followers
উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন হুগলি জেলার চন্দননগরের গোঁদলপাড়ায়।

চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দেন এবং সারা ভারত পরিক্রমা করেন।

এরপর চন্দননগরে ফিরে এসে শিক্ষকতার বৃত্তি গ্রহণ করেন এবং ক্রমশ জড়িয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে। যুগান্তর, কর্মযোগিন্, বন্দেমাতরম্ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর লেখা।

মুরারীপুকুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে নির্বাসিত হতে হয় আন্দামানে। টানা এগারো বছর কারাবাসের পর মুক্তি পান তিনি। তারপরেও অব্যাহত থাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তাঁর উত্তাল রাজনৈতিক জীবন।

পরবর্তীকালে গান্ধিজির অহিংস নীতির অনুরাগী হয়ে পড়েন উপেন্দ্রনাথ। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি সমধিক।

১৯২১-এ প্রকাশিত হয় "নির্বাসিতের আত্মকথা"। উপেন্দ্রনাথের অন্যান্য উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ: ঊনপঞ্চাশী, ধর্ম ও কর্ম এবং ভবঘুরের চিঠি।

আমৃত্যু দৈনিক বসুমতী-র সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল বিপ্লবী এই সাহিত্যিকের জীবনাবসান হয়।

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
16 (57%)
4 stars
10 (35%)
3 stars
2 (7%)
2 stars
0 (0%)
1 star
0 (0%)
Displaying 1 - 7 of 7 reviews
Profile Image for Shadin Pranto.
1,469 reviews560 followers
October 12, 2022
সৈয়দ মুজতবা আলী 'নির্ব্বাসিতের আত্মকথা'র অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন৷ বইটার প্রতি আলাদা একটি আগ্রহও জন্মেছিল। আজ পড়লাম৷ এবং বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যয়ের জীবনকথা আমাকে মুগ্ধ করলো।

১৯০৬ সাল, কলকাতা শহর। 'যুগান্তর' পত্রিকায় তখন গরমগরম লেখা বের হচ্ছে। এই পত্রিকাকে ঘিরে জড়ো হয়েছ একদল মুক্তিকামী। বয়সে সকলেই যুবা। তাঁদের দলনেতা বারীন ঘোষ। এই আড্ডাতেই এসে আস্তানা গাঁড়লেন উপেন্দ্রনাথ বাঁডুজ্জে। পুরো পরিবেশ- প্রতিবেশ গমগম করছে। নিত্যই সারা দেশ থেকে নতুন ছেলের দল হাজির হচ্ছে। লক্ষ্য একটাই ব্রিটিশ বিতাড়ন। উপেন্দ্রনাথ লিখেছেন,

' গুলি গোলার অভাব তাহারা বাক্যের দ্বারাই পূরণ করিয়া দিলেন। দেখিলাম, লড়াই করিয়া ইংরেজকে দেশ হইতে হটাইয়া দেওয়া যে বড় একটা বড় কিছু কথা নয়, এবিষয়ে তাঁহারা সকলেই একমত। '

এমন উদ্যামী কর্মীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অরবিন্দ ঘোষের ভ্রাতা বারীন ঘোষ। কলকাতার মানিকতলার বাগান বাড়িতে হাজির ছেলেপেলেদের অন্নের ব্যবস্থা তো করতে হবে। কিন্তু হাতে নগদ পয়সা নেই। দু'বেলা শাক,ভাতের জোগাড় করাই কষ্টের। তবুও কারো উৎসাহের কমতি নেই। যুগান্তরের বিক্রি বেড়েই চলছে। বাড়ির চারপাশে অচেনা লোকদের আনাগোনাও চোখে পড়বার মতো। সেদিকে কারো খেয়াল নেই।

বারীন ঘোষের ইচ্ছা একজন সাধু এসে দীক্ষিত করুক সবাইকে। তাই দেশময় সাধুর সন্ধানে ঘুরতে হয়েছে। উপেন্দ্রনাথ অনেক তীর্থে ভ্রমণ করেছেন। সাধুসঙ্গ লাভ করেছেন। তাদের মতো কঠিন জীবনযাপনের একটি প্রচেষ্টা উপেন্দ্রনাথের ছিল। পাঞ্জাবি ছাইভস্ম মাখা সাধুদলের সাথে বেড়িয়ে এসেছেন নেপাল। সেখানে আবিষ্কার করেছেন নেপালিদের সাধুসন্তদের প্রতি আস্থা ভারতবর্ষের চেয়ে ঢের বেশি।

নেপাল ভ্রমণ শেষে ফিরলেন কলকাতায়। মানিকতলার ঢেরায় ফিরে এসে দেখেন হুলস্থূল কারবার। আরো অনেক কিশোর-যুবক ভিড় জমিয়েছে। তাদের মধ্যে 'আমার কারাজীবনী'র লেখক বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তও আছেন।

হঠাৎ পুলিশ এসে যুগান্তর পত্রিকা বন্ধ করে দিল। সম্পাদককে গ্রেফতার করতে চাইলে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হলো। উপেন্দ্রনাথ বলেন তিনি সম্পাদক, উল্লাসকর, বারীন ঘোষরাও একই দাবি করছে। তখন মোটাতাজা একজনকে সম্পাদক ঠাওড়িয়ে তাকেই ধরে নিয়ে গেল পুলিশ।

পুলিশ এক রাতে হানা দিল। সে রাতেই বারীন ঘোষ অস্ত্র আর গোলাবারুদ মাটিতে পুঁতে রেখেছিলেন। শেষ রক্ষা হয়নি। সবাইকে ধরে ফেলল৷ বারীন ঘোষ ভাবলেন, তিনি যদি অস্ত্রশস্ত্র এবং নিজেদের পরিকল্পনার কথা সব স্বীকার করে নেন তাহলে হয়তো অনেক নির্দোষ ছেলে পুলিশি নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু ভুল। ব্রিটিশ পুলিশদের থেকে বেশি তৎপরতা দেখাচ্ছিল, বাঙালি পুলিশ সদস্যরা। তাদেরই যেন এই বিপ্লবীদের থেকে কথা বের করতে অধিক উৎসাহ।

আলিপুর জেলে সবাই। অনেকের সাথে অরবিন্দ ঘোষও আছেন। কারাজীবনের স্মৃতিই মুখ্য। আনন্দ-বেদনার খোরাক পাঠকের কাছে। প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। পরে দেখলেন এ এক ভিনজগৎ। তিনবেলা খেতে হয় অদ্ভুত খানা লপসি। টাকা হলে সেখানেও মেলে ভালো খাবার, পাওয়া যায় বিশেষ সুবিধা।

টাকা নেই। তাই মামলা লড়তে চাইছে না কোনো আইনজীবী। একজন একরকম বিনে পয়সায়ই মামলা লড়তে রাজি হলেন। তিনি হলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। দেশবন্ধু উপাধি তখনো তিনি পাননি। আদালতে ব্রিটিশ সাহেব একদিকে বিচার করছেন। অপরদিকে, আদালতে এসে নিজেদের মধ্যেই হইহুল্লোড় করে কাটাচ্ছে বিপ্লবীর দল।

বিচারক একপর্যায়ে উপেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিল, ভারতবর্ষের লোকেরা নিজেরাই নিজেদের শাসন করতে সক্ষম কীনা? উত্তরে উপেন্দ্রনাথ বলেছিলেন,

' সাহেব দেড় শ বছর পূর্ব্বে কি তোমরা ভারতবর্ষ শাসন করিতে? না আমরা তোমাদের দেশ হইতে শাসনকর্ত্তা ধার করিয়া আনিতাম? '

বিজ্ঞ আদালত নির্দেশ দিলেন, উপেন্দ্রনাথের এই বক্তব্য যেন সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হয়।
উপেন্দ্রনাথদের মধ্য থেকেই একজন সরকারের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলো। ক্ষোভের জন্ম হলো অন্যদের মনে।এই বিশ্বাসঘাতককে হত্যা করতে চাইলেন বিপ্লবী কানাইলাল। পারলেন না। তবে দৃঢ়ভাবে মেনে নিলেন ফাঁসির দণ্ড।

রায় হলো মামলার। বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির আদেশ এবং অন্যদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি। রায় ঘোষণার আগেই অরবিন্দ ঘোষ বলেছিলেন, তিনি ছাড়া পাবেন। ঠিক তাই ঘটলো। কারাবন্দি অরবিন্দ ঘোষকে নিয়ে নানা আলোচনা আগেই চলছিল। উপেন্দ্রনাথের লেখায় অরবিন্দ ঘোষের সাধারণ অরবিন্দ থেকে 'ঋষি' অরবিন্দ হওয়ার ঘটনার কিছু ইঙ্গিত আছে।

নিজেরা ন্যূনতম প্রতিরোধ ছাড়াই ধরা পড়েছিলেন পুলিশের হাতে। এই নিয়ে আত্মসমালোচনা দেখেছি উপেন্দ্রনাথের কলমে। কিছুটা অনুশোচনাবোধও লক্ষণীয়।

সমন এসে গেছে। পাড়ি দিতে হবে কালাপানি। সেই কালাপানির আন্দামানে কাটাতে হবে যাবজ্জীবন। আন্দামানে পাঠিয়ে দেওয়ার আগে গোরা সেপাই কটাক্ষ করে বলল, স্বদেশকে চিরবিদায় জানাতে। কারণ আন্দামান থেকে কেউ তো জীবিত ফেরেনি৷ উপেনরা কী ফিরবে?

পোর্টব্লেয়ারে নেমেই দশাসই ইংরেজ জেলারের সাথে সাক্ষাৎ। আন্দামানের জেলের বিবরণ সংক্ষিপ্ত। এই কারাগারে নরক গুলজার। অমানুষিক অত্যাচারের স্মৃতি আছে, উপেন্দ্রনাথ দেখেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিষ এই আন্দামানেও এসে গেছে। পাঞ্জাবি পুলিশওয়ালাদের পক্ষপাত মুসলমানদের প্রতি। হিন্দু সেপাইরাও নিজ গোষ্ঠীর পক্ষে।

প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জেলের পরিস্থিতি পালটে গেল৷ ইংরেজদের পরাজয়ে বন্দিদের মধ্যে ফূর্তির কমতি নেই। গোরা সেপাইদের মুখ শুকনো। বন্দিদের মনে আশা যুদ্ধ শেষে নিশ্চয়ই মুক্তি মিলবে৷ কিন্তু যুদ্ধ সমাপ্ত হলো৷ উৎসব হলো। মুক্তির কোনো খবর নেই। এভাবে দিন, মাস এমনকি এক বছরও চলে গেল। নাহ্, এই বন্দিশিবির থেকে হয়তো জীবিত ফেরা হবে না। নৈরাশ্য অনেকের মনেই৷ ঠিক তখনই মুক্তির বার্তা পৈাঁছলো। ততদিনের উপেন্দ্রনাথ, বারীন ঘোষ আর উল্লাসকরদের একযুগ সাজা খাটা হয়ে গেছে।

আলিপুর জেল থেকে ছাড়া পেলেন রাতে। সারারাত ঘুরে ঘুরে দেখলেন একযুগ আগে ছেড়ে যাওয়া কলকাতা। অবশেষে ফিরলেন স্বগৃহে৷ একবছর বয়সী পুত্রকে রেখে কারাবাসী হয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ। এসে দেখলেন ছেলে কিশোর বয়সে পদার্পণ করেছে। পিতাকে দেখে কেমন যেন মুখ লুকিয়ে রাখছে।

উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যাপাধ্যায়ের লেখায় সুন্দর গতি লক্ষণীয়। কোথায় বইটি ঝুলে পড়েনি৷ বরং ঈষৎ সংক্ষেপিত হয়েছে। আন্দামানের আরো বিশদ বর্ণনা পেলে ভালো লাগতো। একযুগ আন্দামানে ছিলেন। অথচ এই বারো বছরের কথা খুব দ্রুত লয়ে বলে গিয়েছেন। যেন তাড়াহুড়া ছিল।

বিপ্লবী দলগুলোর কার্যক্রম, ব্রিটিশ সরকারের তৎপরতা আর কারজীবনের দুঃসহ স্মৃতিকে নিজস্ব রসবোধ মিশিয়ে লিখেছেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যােপাধ্যায়। কারাগার, বিপ্লবী দল নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে, তাঁরা পড়ে ফেলুন। ঠকবেন না আশা করি।
Profile Image for Maruf Hossain.
Author 37 books258 followers
January 14, 2019
পঞ্চতন্ত্রেরএকটা প্রবন্ধে এই বইয়ের রেফারেন্স পাই প্রথমে। বইটার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আলী সাহেব। তার মধ্যে গুডরিডসেও আরেকজন রিকমেন্ড করলেন। তাই তুমুল আগ্রহে পড়তে বসা।
এবং আমি অভিভূত!
ইংরেজ-বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের গোড়ার দিকের বিপ্লবী লেখক। দেশোদ্ধারে বিপ্লব করতে নেমেছিলেন আরও ক'জন টগবগে বি��্লবীর সঙ্গে। তাঁদেরই আন্দোলন, ধরা পড়া, অত:পর নরকতুল্য আন্দামানে নির্বাসনের আখ্যান এ বই।
আন্দামানে যে-নরকে পুড়েছেন তাঁরা, তাতে তাঁদের নরকের সাজা বোধহয় এ পৃথিবীতেই ভোগ করা হয়ে গেছে।
ভারতবর্ষের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুর দিকের অবস্থা এবং ইংরেজ তথা শাসকশ্রেণির শঠতার জীবন্ত দলিল সুখপাঠ্য এ বই।
অদ্ভুত উইটে ভরপুর এ বই।
ভাবছি, একটা মানুষকে এই জীবন কতটা আঘাত, দুঃখ, শঠতা, নির্মমতা উপহার দিতে পারলে তিনি সেই নরকতুল্য জীবনকে নিয়ে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে নিষ্ঠুর রসিকতা করার ক্ষমতা লাভ করতে পারেন!
Profile Image for Farhan.
725 reviews12 followers
December 20, 2018
I haven't read anything as intriguing and fantastic as this one since Baren Basu's 'Wrongroot'. It's humorous, it's tragic, it's fiery, it's a document of truth, but at the end of the day it's peace. Such a masterpiece!
Profile Image for Dev D..
171 reviews26 followers
February 24, 2019
উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম একজন কর্মী। বিশ শতকের শতকের শুরুতে ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হয় তখন স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার বয়ে গিয়েছিলো বাংলা জুড়ে। সেই সময় ১৯০৬ সালে উপেন্দ্রনাথও এই আন্দোলনে যোগ দেন। এর আগে কিছুদিন সন্ন্যাস গ্রহণ করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তার মন বসে নি। সেসময় তিনি শিক্ষকতার পেশা নিয়ে থিতু হবার চেষ্টায় ছিলেন। স্বদেশী আন্দোলন শুরু হওয়ায় তাতে বাংলার আরো অসংখ্য তরুণ, যুবকের মতো উপেন্দ্রনাথও জড়িয়ে পড়েন। যুগান্তর পত্রিকার সাথে জড়িত স্বদেশীদের যে দলটি ছিলো তিনিও তাদের সাথেই ছিলেন। এই দলের নেতা ছিলেন বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র, উল্লাস কর, উপেন্দ্রনাথ প্রমুখ। তবে খবরের কাগজে যতোটা গলাবাজি তারা করতে পেরেছিলেন বাস্তবে আন্দোলন ততোটা সক্রিয় হয় নি। স্বশস্ত্র আন্দোলন শুরু করার জন্য মানিকতলায় একটি বাগান বাড়িতে তারা দল বেধে ছিলেন। দু’চারটে ব্যর্থ বোমাবাজিও করা হয়েছিলো। তারই ফলশ্রুতিতে আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলায় তাদের প্রায় সকলেরই জেল হয়। মামলায় সাজা প্রাপ্ত হন প্রায় সবাই। বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র, উল্লাস কর প্রমুখের সাথে উপেন্দ্রনাথের কপালেও জোটে দ্বীপান্তরের সাজা। সেকালে আন্দামানের পোর্টব্লেয়ারে গুরুতর সাজাপ্রাপ্তদের পাঠানো হতো। উপেন্দ্রনাথরা একে ছিলেন রাজনৈতিক বন্দী, তার উপর প্রায় সবারই সাজা ছিলো যাবজ্জীবন জেলের। সেই আন্দামানের জেল জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ, যার সাথে বোধহয় তুলনা চলে একমাত্র নরকেরই। বার বছর জেল খেটে তবে তার মুক্তি মেলে। এই বইয়ে তার সেই স্বদেশী আন্দোলনের সময়ের এবং জেল জীবনের বিচিত্র কাহিনী উপেন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন। কালাপানির বা ইংরেজ আমলের কুখ্যাত আন্দামানের জেল সম্পর্কে আগে বিশেষ কিছুই জানতাম না। ইংরেজদের হয়তো অনেক ভালো গুণ ছিলো, কিন্তু এইরকম কতশত শোষণ, অত্যাচার তারা করে গেছে তা আজ আমরা আর ভালো করে উপলব্ধি করতে পারি না। উপেন্দ্রনাথদের বিপ্লব হয়তো অতিমাত্রায় রোমান্টিক, এ্যাডভেঞ্চেরাস ছিলো, কিন্তু শেষে যে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি তাদের হতে হয়েছিলো তার বর্ণনা পড়ে সত্যিই আঁতকে উঠতে হয়।
Profile Image for A. M. Faisal.
76 reviews20 followers
June 4, 2020
বইটির খোঁজ পাই মুজতবা সাহেবের পঞ্চতন্ত্রতে। এমন সুরসিক ও পণ্ডিত লেখক যে বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করছেন তা একবার চেখে দেখা আবশ্যক মনে হয়েছিল। করে ফেললাম। এবং, আমার পাঠেন্দ্রিয় সার্থক। ১৯২১ সালে প্রকাশিত বইয়ে বেশির ভাগ জায়গায় পাওয়া যায় পরিমিত হাস্যবোধ আর কিছু জায়গায় আবেগের নির্মম পেষণ।

লেখক উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি যে হাস্যরস তৈরিতে বিশেষ সিদ্ধহস্ত তা বইটির প্রথম ক পাতাতেই প্রমাণিত হয়ে যায়। এরপর শুধু উপেনবাবুর লিখার স্রোতে গা ভাসিয়ে ভেসে চলা। মূলত ১৯০৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনের কাহিনী এই বইয়ে স্থান পেয়েছে। ডাক্তারি শেষ না করে বি এ পাস করে শিক্ষকতার শুরুর পর বন্দে মাতরম পত্রিকার জের ধরে 'যুগান্তর' সমিতিতে যোগদান। বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়কার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল অনুশীলন আর এই যুগান্তর। সেই সংগঠনটির একজন সক্রিয় সদস্যের বয়ানে সেই সময়কার নানা বিষয় মূর্ত হয়ে উঠে উপভোগ্য স্বাদে।

বারীন্দ্র ঘোষকে ঘিরে যুগান্তর হয়ে উঠে ইংরেজ শাসনবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মূল শিকড়। যদিও বেশিরভাগ সদস্যই নিতান্ত অনভিজ্ঞ ও কেবল বিপ্লব ঘটানোর মননে একজোট, তারপরো এদের বন্দুক-বোমার জোর না থাকলেও গলাবাজি দিয়ে তারা তা পুষিয়ে দিতে সক্ষম। উপেনবাবুর এই বই এইসব আদর্শবাদী তরুণ বিপ্লবীদের নিয়ে। যার প্রথম অংশ ক্ষুদিরাম বসুর ১৯০৮ সালের হামলা পর্যন্ত ১৯০৬ থেকে এবং দ্বিতীয় অংশ বার বছর আন্দামানে কারাবাস নিয়ে।

এই প্রথম অংশের রস-কৌতুকের বিস্তার একেবারে গলা অবধি।
মানিকতলায় এই নব্যবিপ্লবীদের আখড়া গড়ে উঠে। তারা এখানে 'যুগান্তর' পত্রিকার কাজের পাশাপাশি নতুন সদস্য যোগাড়ের কাজ করে। আড্ডা দেয়। নতুন আদর্শে উজ্জীবিত হওয়ার জন্য সাধুর খোঁজ করে। একবার ভারতময় সাধুর খোঁজে বেরিয়ে পরে উপেন ও তাঁর দলবল। নর্মদার উৎপত্তিস্থলে তিনি উদাসী সাধকদের সাথে ছাই মেখে নেপাল ঘুরতে চলেন। এই অভিযানে এই সন্ন্যাসব্রতের কষ্টসাধন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে মুক্তি চান। বারীনের নতুন উদ্যমে দল সাজানোর ডাক পেয়ে "তল্পির মধ্যে লোটা কম্বল আর তল্পার মধ্যে একগাছা মোটা লাঠি" নিয়ে ছুটে আসেন কলকাতা। সাধুব্রতের আধ্যাত্মিকতার খোঁজের এখানেই সমাপ্তি।

উল্লাসকর দত্তের দলে যোগ দেয়াতে বোমা বানানোর তোরজোড় শুরু হয় এবং বাংলার লাটসাহেবকে বোমা দিয়ে ঘায়েল করার ফন্দি আঁটে বিপ্লবীরা। কিন্তু অনভিজ্ঞতা তাদের কাল হল। তারা ডিনামাইট জোগাড় করে ট্রেইন উলটে দেয়ার চিন্তা করল। রেললাইনের নিচে ডিনামাইটের কার্ট্রিজ রেখে দেয়া হল। আর তাতে -
উড়া ত দূরের কথা-ট্রেনখানা একটু হেলিলও না। শুধু কার্ট্রিজ ফাটার গোটা দুই ফট ফট আওয়াজ শূন্যে মিলিয়ে গেল, লাটসাহেবের একটু ঘুমের ব্যাঘাত পর্যন্ত ঘটিল না।

এর কিছুদিন পরেই ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল উল্লাসকরের বানানো বোমা দিয়ে কিংসফোর্ড সাহেবকে হত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে পুলিশ মানিকতলায় হানা দিয়ে সকল সদস্যকে ধরে নিয়ে যায়। লেখকের ভাষ্যমতে তারা এতটাই অনভিজ্ঞ ছিল যে, ক্রমশ তাদের আঙ্গিনায় যে অপরিচিত লোকেদের আনাগোনা বাড়ছিল, তাতে তারা মোটেও গা করে নি। কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদ ছিল। যার ফলে সকল সদস্য এক অপরের পরিচিত ছিল। ইউরোপে-আয়ারল্যান্ডে যেমন নানা বিচাগ-নানা এলাকায় আলাদা পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে গোপনীয়তা রক্ষা করা হত তা তারা করতে পারে নি। ফলে আলীপুর বোমা হামলার ঠিক দুদিনের মধ্যে তারা সবাই তাদের মানিকতলার ঘাঁটি থেকে পাকড়াও হয়। ধরা পরার কাহিনীটা লেখক এঁকেছেন নিপুণ হাস্যরসের তুলিতে। ভ���গ্যের পরিহাসকে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিয়েছেন।
ঘুমোতে যাবার সময় পাহারা রাখা হয়নি এটা যেমন ভুল তেমনি পালিয়ে না যেয়ে পুলিশের কথায় বিশ্বাস করে সঙ্গী সাথীদের কথা প্রকাশ করা আরো মারাত্মক ভুল। বারীন ঘোষ এ হামলার আশংকা করে অস্ত্র-বোমা মাটিতে পুঁতে ফেললেও নিজেদের রক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে পারেননি। রাতের আঁধারে পুলিশের সাথে চোর পুলিশ খেলতে যেয়ে উপেন বাবু আশ্রয় নেন বারান্দার পাশে একটা ছোট স্টোররুমে। চটের পার্দার আড়ালে আরশোলা আর ইঁদুরের সাথী হয়ে ভোর সাতটা পর্যন্ত সেখানে কাটান। সেই সময় ইনস্পেক্টর সাহেবের খেয়ালের বস��� রুমের কাছে আসেন। তখন উপেন বাবু পর্দার ওপারে দম বন্ধ করে আছেন পর্দানসীন বিবির মতো। লেখকের ভাষায়-
সাহেব সোজা আসিয়া আমার লজ্জানিবারণী পর্দাখানিকে একটানে সরাইয়া দিলেন। তারপরেই চারিচক্ষের মিলন-কি মধুর! কি স্নিগ্ধ! কি প্রেমময়!

এরপর তাদের জেরা করে বের করার চেষ্টা চলে অন্যান্য বিদ্রোহীদের পরিচয়। যুবকগুলোর ভুলোপনার সুযোগ নিয়ে পুলিশ তাদের থেকে আদায় করে নেয় স্বীকারোক্তি। একজন সব বলে দিয়েছে বলে অন্যদের থেকে কাহিনী বের করার বহু পুরনো ছলের শিকার হন লেখকের বেরাদরেরা।
পুলীস যে ঠিক ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের বংশ-সদ্ভূত নয় এ কথাটা তখন আমাদের মাথায় ভালো করিয়া ঢুকে নাই

ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্টেটমেন্ট নিয়ে সবাইকে পাঠানো হয় আলিপুর জেলে। সেখানে যেয়ে প্রথম জেলের স্বাদ পান উপেন বাবু। কারাগারে নরক গুলজার।
প্রথমদিকটাতে মানাতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে এসবের সাথে অভ্যস্ত হয়ে পরেন। লপসী(ফেনমাখানো ভাত) ছিল জাতীয় খাবার। তাই খেয়েই অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন জেলের ভেতরেও টাকার শক্তি। রুপোর সিকির জোরে ভাতের স্তূপের নিচে কই মাছ ভাজা মেলে, রুটির ফাঁক থেকে বের হয় আলু পেঁয়াজের তরকারি। আবার প্রহরীর পাগড়ির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে পান-চুরুট। ব্রিটিশদের মতে আদর্শ শাসনব্যবস্থার কাছাকাছি একটা ব্যবস্থায় তাদের অধীনে ভারতবর্ষ শাসিত হলেও এখানে ঘুষ আর অনিয়মের যে ব্যাপক বিস্তৃতি তা তিনি দেখিয়েছেন বারবার। আর শাসনব্যবস্থার আনুকূল্যলাভের আশায় স্বদেশীদের প্রতি ভারতীয়-বাঙ্গালিদের যে অতিরিক্ত অত্যাচার তাতেও ব্যথিত হয়েছেন উপেনবাবু।
অরবিন্দ ঘোষ এই সময়ে শ্রী অরবিন্দ হয়ে উঠেন। তাঁর ভাবচেতনার জগতের পরিবর্তনের একাংশ আলিপুরের কারাবাস পর্বে দেখা যায়। আলিপুর বোমা মামলাতে তাঁর খালাস হবে এটা আগেই বলে দেন তিনি। এরই মাঝে তাদের একজন, নরেন্দ্র গোস্বামী রাজসাক্ষী হয়ে জেলারের হেফাজতে চলে গেলে তাকে মারতে কানাইলাল ও সত্যেন কান্ড করে ফেলে। নরেন্দ্র মারা পড়ে। সেইসাথে কানাইলালের হয় ফাঁসি।
এইসব ঘটনার মাঝেই তীব্র হুল্লোড়-মচ্ছব করে দিন কেটে যাচ্ছিল কিন্তু ১৯০৯ সালে রায় ঘোষিত হয়। উল্লেখ্য, বিপ্লবীদের টাকা-পয়সা ছিল না দেখে কোন উকিলই মামলা নিচ্ছিল না কিন্তু শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন দেশবন্ধু সি আর দাশ। রায় আসে বেশিরভাগেরই যাবজ্জীবন কালাপানি। উপেন-সাথে উল্লাসকর, বারীন্দ্র, হেমচন্দ্র, সুধীর, হৃষীকেশের দ্বীপান্তর সাজা হয়। হৃষীকেশ ছিলেন উপেনের পূর্বতন বন্ধু। তাঁর প্রসঙ্গে তিনি লেখেন-
উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে ও শ্মশানে - যে একসঙ্গে গিয়া দাঁড়ায় সেই বান্ধব।

কালাপানি অধ্যায় সময়ের হিসেবে বড় হলেও লেখক একটু তাড়াহুড়া করেছেন। তিনদিনের জাহাজ যাত্রায় নাবিকদের সাহায্যে প্রাণ রক্ষা করেন। কেননা তিনদানের আহার্য ছিল কেবল চিড়া। মুসলমানের মধ্যে সহানুভূতির সাথে যে ব্রাহ্মণের ধর্মাচার বিগড়ানোর অভিপ্রায় ছিল তা উপেন বাবুরা অগ্রাহ্য করেন। ধর্ম রক্ষা হয়েছিল কিনা তা না জানলেও তাদের পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটা বেঁচেছিল।
কালাপানিতে যেয়ে নিতান্ত কঠিন সময়ের সম্মুখীন হন তারা। জেলারদের যথেচ্ছ অত্যাচার, শাস্তির প্রকার বিবেচনায় না এনে শ্রমের ক্ষেত্রে সাম্যবাদ, কাজ আদায় করে নিতে নিষ্ঠুরতা - সবকিছু দেখে মানুষের জন্য স্বাভাবিক থাকা দুষ্কর। তার উপর রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে সরকারের নির্দেশ ছিল অন্যান্য আসামী থেকে যেন বেশি সুবিধা না দেয়া হয়। ফলে ক্রমে দুঃসহ হয়ে উঠে কারাবাস। মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত শুরু হয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল সম্পর্কে আত্মোপলব্ধি ও অনুশোচনা। কীভাবে নিজেদের নির্বুদ্ধিতা ও গল্প করার প্রবণতার কারণে নিজেদের উপর এই শাস্তির খড়গ নেমে এসেছে তা হাড়ে হাড়ে টের পান লেখক। বিপ্লবীদের স্বাধীন হওয়া নিয়ে দ্বিমত না থাকলেও স্বাধীন হওয়ার পর দেশচালনা নিয়ে বহুমত বিদ্যমান ছিল। আর নেতাদের লোভ নিয়ে খুব অল্প করে প্রকাশ করছেন উপেন বাবু এভাবে-
যে জাতি বহুদিন শক্তির আস্বাদন পায় নাই, তাহাদের নেতারা যে প্রথম প্রথম ক্ষমতা লোলুপ হইয়া দাঁড়াইবে তাহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছু নাই। আর নেতাদিগের মধ্যে অযথা প্রভুত্ত্ব প্রকাশের ইচ্ছা থাকিলে অনুচরদিগের মধ্যে ঈর্ষা ও অসন্তুষ্টি অনিবার্য।

আবার তিনি টলস্টয়ের Resurrection এর প্রসঙ্গ টেনে বলেন বিপ্লবীরা স্বভাবতই অহংকারী ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয় যার বলে তারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে উদ্ধত হয়। তারা সাধারণত কল্পনাপ্রবণ ও একদেশদর্শী। বেশিরভাগই আবার নিউরোটিক। ফলে পাগল হয়ে যাবার প্রবণতা বেশি থাকে। এই দাবী করার পেছনে উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, তাঁর পিতামহী বায়ুরোগগ্রস্ত ছিলেন ও অনেক বিপ্লবীদের বংশের মধ্যে এই রোগ পাওয়া যায়।

তাঁর লেখাতে পোর্ট ব্লেয়ারের কাঠামোগত বর্ণনা নেই বললেই চলে। কয়েদীদের দিয়ে সেখানে নারিকেল ও সরিষার তেল তৈরির জন্য ঘানি টানানো হয়। মাথাপিছু দৈনিক ৩০ পাউন্ড। এছাড়া আরেকটি পরিশ্রমের কাজ নারকেলে ছোবড়া থেকে দড়ি তৈরি করা।
প্রথমে ছোবড়া কাঠের উপর ফেলে মুগুর দিয়ে পিটিয়ে নরম করে নেয়া লাগে। এরপর উপরের খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয়। তারপর পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে আবার পিটিয়ে নিতে হত যাতে শক্ত, লম্বা তার গুলো বাদে ভুসিগুলো ঝড়ে যায়। শেষে রোদে শুকিয়ে নিলেও দড়ি পাকানোর জন্য তার প্রস্তুত হয়ে যায়। একদিনেই হাতে ফোসকা ফেলে দেবার জন্য এ যথেষ্ট।

খাবারের নিদারুণ অবহেলার সাথে আছে পাঠান পাহারাদারদের অবিবেচক অত্যাচার। সাধারণ কয়েদীদের পাঁচ বছর কারাভোগের পর আয় রোজগারের নানা পদ্ধতি থাকলেও রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য সে রাস্তা ছিল বন্ধ। শারীরিক অত্যাচারের সাথে ছিল অকথ্য গালিগালাজ। যেগুলো হজম করতে গেলেও তীব্র মানসিক শক্তির প্রয়োজন বলে লেখকের মন্তব্য পাওয়া যায়।
ইন্দুভূষণ আত্মহত্যা করে ফাঁস টাঙ্গিয়ে। উল্লাসকর কারাবাসেই মানসিক ভারাসাম্য হারিয়ে ফেলে। অনেকে মুক্তির আশায় পাগল হবার ভানও করে।
আন্দামানে যে যত শক্ত তার কদর তত বেশি। প্রহরীদের মাঝেও, কয়েদীদের মধ্যেও। এই শক্ত-পোক্তগিরিতে রক্ষকরা যদি কঠোর উপায়ে কাজ হাসিল করতে পারতো তবেই কয়েদীরা বলতো-'শালা বড় মারদ হৈ'। আর নরম আচরণ নারীর স্বভাব প্রকাশ করার মতো। জীবনযুদ্ধের এ নির্মমতম শিক্ষা (!) চল্লিশ বছর পার করে উপেনবাবুর মাথায় ঢোকে।

গান্ধীজির অহিংসা আন্দোলন শুরুর আগেই উপেন বাবু আন্দামানে Passive Resistance এর নমুনা দেখেন নন্দগোপাল নামের এক বিপ্লবী থেকে। নির্ধারিত সময়ে তেল তৈরির কোটা পূরণ না করে নিজের সুবিধামতো খেয়ে-ঘুমিয়ে কাজ করে জেলারের ব্যবস্থার প্রতিবাদ করে সে। শাসাতে এলে নিয়ম ও স্বাস্থ্যবিধির দোহাই দিয়ে নিশ্চিন্তে আদেশ অমান্য করে যায়। শুরু হয় এর মাঝেই ধর্মঘট-অনশন। পরিশ্রম কমানো, সহনশীল খাবারের ব্যবস্থা ও মিত্রদের সাথে মেলামেশা করার চাহিদা-এই তিন দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান তারা। এরই সাথে ১৯১৪ সাল থেকে শুরু হয় 'গাদার' বা 'গদর' পার্টির শিখ বিদ্রোহীদের কালাপানিতে আগমন। তাদের খাবারের বন্দোবস্ত নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ রাজ কিছুটা শিথিল হতে শুরু করে আর জেলের বাইরে নানা কাজে বাঙ্গালি বিপ্লবীদেরকে নিযুক্ত করতে থাকে। তাছাড়া কুঠুরির নিদারুণ ব্যবস্থাপনা, রোগ-শোকের চরম বেড়ে যাওয়া আর তার সাথে কয়েদীদের জবর ধর্মঘট সব মিলিয়ে সরকার রফায় আসতে বাধ্য হয়। পোশাক পরিধানে রীতি-নীতি উঠে যায়। মাইনে আসা শুরু হয়। নিজ হাতে রান্নার বন্দোবস্ত হয়। এসময়ে লেখকের মতে জাঙ্গিয়া, টুপি, হাতাকাটা কুর্তা ছেড়ে কাপড় ও হাতাওয়ালা কুর্তা পড়তে পারাটাও নিদারুণ আনন্দের ছিল।

এ কারাবাসে আরেকটি উপলব্ধির কথা লেখক লিখেছেন জাত-বৈচিত্র্য নিয়ে। জেলে হিন্দু-মুসলিম-শিখ, মারাঠা-বাঙ্গালি-পাঞ্জাবি-পাঠান-মাদ্রাজি-গুজরাতিদের সম্মিলন ঘটে কিন্তু ঠিক ঐক্যবোধটা দেখা যায় না। লেখক ঠিক কাঠখোট্টা ব্রাহ্মণত্বের অনুসারী না হলেও জাত-পাতের এই ভেদাভেদ দেখে ব্যথিত হন। সকলেই বামুনের উপর এক হাত দেখে নিতে পারলে যেন খুশি হয়। তার উপর কারাবাসের দীর্ঘ যাতনা ও অত্যাচার হতে রক্ষা পেতে মানুষ যে কিছু একটার উপর ভরসা করবে-সেটাই স্বাভাবিক। তাই নিতান্ত গোবেচারা ঢিলেঢালা হিন্দুরাও ফুটখানেক টিকি রেখে দিত আর মুসলিমরা গজাত পেল্লাই দাড়ি। দিন দিন ধর্মের ভক্তি বাড়তে থাকে। আর তার সাথে বাড়ে অন্য ধর্ম থেকে নিজের ধর্মে নিয়ে আসার তোরজোড় বা নিতান্ত ধর্মে অনাসক্তদের কড়া বাঁধনে বাঁধার প্রয়াস। আবার জাতিগতভাবে দেখা যায় আরেক বিশাল পার্থক্য। ভারতীয় জাতিসত্ত্বার আড়ালে বহু মতবাদের চর্চা হত। মারাঠি নেতারা বলত, "বঙ্কিমবাবু 'বন্দে মাতরম' এ 'সপ্তকোটি' কন্ঠের কথা বলেছেন, তিরিশ কোটির কথা বলেননি। বাঙ্গালি কবিরা বলত, 'বঙ্গ আমার, জননী আমার'। তাই বাঙ্গালির জাতীয়তাবোধ অতি সংকীর্ণ।" পাঞ্জাবী বলে, "রামমোহন রায় এদেশে ইংরাজি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল। তাই তিনি বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী।" মারাঠীদের মতে, ভারত কখনো একীভূত হলে তার শাসনভার থাকা উচিত মারাঠাদের হাতে। তাদের ভাব থেকে প্রতিভাত হয়-
হিন্দুস্থানী ও পাঞ্জাবীরা গোঁয়ার, বাঙ্গালী বাক্যবাগীশ, মাদ্রাজী দুর্ব্বল ও ভীরু-একমাত্র পেশোয়ার বংশধরেরাই মানুষের মত মানুষ।

এহেন উগ্র জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব সেই বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই ছিল তা এখানে বুঝা যায়। লেখক নিজেও শেষ বয়সে হিন্দু মহাসভায় যুক্ত হন। এই সংঘটি মূলত ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের জবাবে হিন্দুত্ববাদ প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এরকম বহুধা আদর্শে ভারতীয়দের বিভাজনে অনেকাংশে দায়ী কিন্তু ব্রিটিশ সরকার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মানি-ভারত ষড়যন্ত্রে শামিল হয়ে প্রবাসী শিখদের একাংশের ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারত হতে উঠানোর যে তৎপরতা শুরু হয় তার উল্লেখ ও প্রভাব দেখা যায় এই বইয়ে। মাদ্রাজে এমডেনের বোমা হামলা হলে কালাপানির বাসিন্দারা উচ্ছ্বসিত হয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যেকোন শক্তির সপক্ষে বিপ্লবীদের অবস্থান এখানে লক্ষনীয়। আবার যুদ্ধ হতে বিদ্রোহের কারণে যেসব সৈন্য এখানে আসতো তাদের মুখে নানা মনগড়া কাহিনী শুনে অভিভূত হত কয়েদীরা। এর মাধ্যমে তুর্কি বাহিনীর এনভার পাশার কিংবদন্তী হয়ে উঠে। কয়েদীরা গুজবে বিশ্বাস করতে থাকে যে, জার্মানরা এসে কালাপানি হতে তাদেরকে নিয়ে যাবে। আইরিশরা কালাপানির ব্যবস্থাপনাতে বেশি থাকাতে অনেক ক্ষেত্রে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতির আচরণ করা হত সহমর্মিতার খাতিরে। এমন কথাও শোনা যায় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করলে ব্রিটিশ রাজ কালাপানির বন্দিদের মুক্তি দিয়ে দিবে। এরই মাঝে রাশিয়ার বিপ্লব শুরু হয়। দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর পেরিয়ে যায়। ১৯২০ সালে জেল কমিটি এসে অবস্থা দেখে যেয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করে। মুক্তির দেখা মেলে না। এমনকি যুদ্ধের পরে জেলার সরকার থেকে ছুটি চাইলে তা মিলে না। কারণ তিনি আইরিশ। অবশেষে সেই মুক্তি আসে। তারা ২৬ জন বের হয়ে আসে।

কলকাতায় খিদিরপুর ঘাটে আন্দামান ডকে এসে নামে বার বছরের কালাপানি ভোগা উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। জুতা পরার অভ্যাস হারিয়ে ফেলা, কলকাতার রাস্তা ভুলে যাওয়া, জাত-পাতের জন্য নিজের আত্মাভিমান ফেলে আসা নতুন উপেনবাবু। সংকল্প
ছিল সংসারধর্মে মনোযোগী হওয়া। কিন্তু লেখক পরবর্তী জীবনে আবারো 'অ্যানার্কি'তে যুক্ত হন।

মুজতবা সাহেব লিখেছেন,
"সকল বাঙ্গালির অবশ্য পাঠ্য"

এ বাক্যের মহিমা পড়ামাত্রই টের পাওয়া যায়। নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মাঝেও লেখক যে সূক্ষ্ম বিষয়ে রসিকতা খুঁজে নিয়েছেন, শঙ্কার সময়ের বর্ণনাতে ঢেলে দিয়েছেন নিজের বৈঠকি ঢং। মুজতবা আলী সাহেবের সাথে এক্ষেত্রে ভয়ানক মিল।

নিজের পরিবারের কথা খুব সামলে এড়িয়ে গেছেন লেখক। কেবল এসেছে দেড় বছরের পুত্রের কথা যখন তিনি কালাপানি রওনা হন আর যখন ফিরে আসেন তখন কিশোর ছেলেকে দেখেন। এ বইয়ের মাহাত্ম্য সেই সময়কার বর্ণনাজ্ঞাপনে যখন বাংলা স্বদেশি আন্দোলনে উত্তাল, রাজযন্ত্রের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ দানা বাঁধছে। এরই মাঝে কিভাবে কতিপয় বাঙ্গালি যুবক গান্ধীজীর অহিংসা প্রতিবাদের আগে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয় আনাড়ির মতো আর তার ফলস্বরূপ একযুগ দ্বীপান্তরে কারাবরন করে আসে - সেই গল্পই রসিয়ে, মজিয়ে নিবেদন করেছেন উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিমশাই।
গদ্যের তরলতায় মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা লেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। উল্লেখ্য, এটাই লেখকের প্রথম প্রকাশনা। কালাপানির বর্ণনাতে কিছুটা ঝুলে গেলেও এক বসায় শেষ না করে উঠা প্রায় অসম্ভব। সকল সুরসিক পাঠকের অবশ্যপাঠ্য। আবার বাঙ্গালি বিপ্লববাদের প্রথমদিককার কর্মকান্ডের ছোটখাটো দলিল। প্রামাণ্য না হলেও অনেক ধরণের অনুভূতির সন্নিবেশনে এটি হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত গাঁথা। একই সাথে কৌতুকরস, বেদনারস, দর্শনরস, আত্মোপলব্ধিরস - এত সুন্দর করে ছোট্ট আকারে প্রকাশ করা খুব কম বইয়ে মিলবে। এত বিদ্রোহ-আন্দোলন-ধর্মঘটের পর শেষ পাতায় যেয়ে শান্তির আকাঙ্ক্ষা। এতেই পুরো লেখার সার্থকতাটা মূর্ত হয়ে উঠে।
Profile Image for Riddhiman.
157 reviews14 followers
December 14, 2017
This is an autobiographical account by revolutionary Upendranath Bandopadhyay. In this book, he depicts the events leading to his sentence in Andaman cellular jail to the time of his release and return to Kolkata. Like many people, Upendranath at first believed in achieving independence through religious unity. For this purpose he traveled over various parts of India in search of religious guidance. Finally, he realized the error of his ways and joined actively as a revolutionary with Barin Ghosh. It was during one such conspiracy that their group was arrested and deported to Andaman.
The writing is lively and touches upon various themes and has references to a lot of famous personalities like Deshbandhu Chittaranjan Das, who took up their case and successfully converted the penalty from capital punishment to deportation; as well as Aurobindo Ghosh, the depiction of the latter being pretty interesting. As a prisoner in Andaman, he was starting to show signs of the saint he was about to become and had already achieved some remarkable feats through meditation. The book also talks about the author's interaction with various people and communities during his imprisonment. The narration style is very unassuming, seemingly portraying the narrator as insignificant (which we know was not true at all). Non fiction does not appeal to me generally, but I really enjoyed reading this.
Displaying 1 - 7 of 7 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.