গল্পটা শাওন, বাদল কিংবা বৃষ্টির। কিংবা, রেনু, মিন্টু, রিন্টুর। কিংবা হায়দার আলীর। কিংবা জসিম, কিংবা মুসাফির মান্নানের। কিংবা ছোট্ট নিধির। গল্পটা হয়তো আনন্দের। কিংবা প্রতিশোধের। কিংবা বিষাদের।
Shariful Hasan hails from Mymensingh, Bangladesh. He has spent his childhood by the banks of Brahmaputra river. He completed his Masters in Sociology from University of Dhaka and is currently working in a renowned private organization.
Shariful's first novel was published on 2012 titled Sambhala. With two other books, this captivating fantasy trilogy has received widespread acclimation both within and beyond the borders of Bangladesh. The Sambhala Trilogy was translated in English and published from India.
Although his inception consisted of fantasy and thriller, he has later worked on a variety of other genres. These works have been received fondly by the Bangladeshi reader community. Lot of his works have also been published from different publications in West Bengal.
Award- Kali O Kalam Puroshkar 2016 for 'অদ্ভুতুড়ে বইঘর'
ফ্যান্টাসি, শিশুসাহিত্য, মার্ডার মিস্ট্রির পরে এবার শরীফ ভাই হাজির হয়েছেন মেঘ বিষাদের গল্প নিয়ে। জনরায় ভাগ করলে বলবো ক্রাইম ফিকশন, কিন্তু ঠিক থৃলার নয়। হ্যা, থৃলারের সব উপকরণ আছে, খুন, সাসপেন্স, মোটিভ- সব, কিন্তু শেষমেশ এটা থৃলার নয়। দুর্দান্ত একটা ক্রাইম ফিকশন, সাথে ট্রাজেডি। আমার কাছে সব থেকে ভালো লেগেছে এই বইয়ে শরীফ ভাইয়ের লেখনী। সাম্ভালা পড়বেন আর এটা পড়বেন- পার্থক্যটা চোখে পড়বে। অনুভূতিগুলোর বিশুদ্ধ বর্ণন, পরিবারের মানুষগুলোর মাঝে টানাপোড়ন, প্রতিশোধ আর কিছু জীবন থেকে নেয়া আপ্তবাক্য- মনে থাকবে অনেক দিন।
এবারের গল্প মেঘের গল্প, অথবা কোন রৌদ্রকোজ্জ্বল দিনের। এবারের গল্প কিছুটা বিষাদ অথবা বিষাদহীনতার গল্প, অনুভূতি বা অনুভূতিহীনতার গল্প, আনন্দ ও ট্র্যাজেডির গল্প, প্রেম ও বিচ্ছেদের গল্প, বন্ধুত্ব ও বন্ধুত্বহীনতার গল্প। এবারের গল্প দু’টি পরিবারের গল্প, পরিবারদ্বয়কে ঘিরে কিছু মানুষের গল্প, মানুষে মানুষে সম্পর্কের গল্প। সাধ এবং সাধ্যের গল্প, সম্পর্কে সম্পর্কে টানাপোড়েনের গল্প, প্রেম-ভালবাসা-প্রীতির গল্প। এবারের গল্প অপরাধ ও অপরাধবোধের গল্প, হত্যা এবং প্রতিশোধের গল্প, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী, রাজা অথবা নীতির গল্প। সব মিলিয়েই এক আশ্চর্য প্যাকেজ শরীফুল হাসানের “মেঘ বিষাদের গল্প” উপন্যাসটি।
কাহিনীর শুরু হয় শাওন নামের এক যুবককে দিয়ে। আগাগোড়া বোহেমিয়ান, বাউন্ডুলে স্বভাবের যুবক শাওন বাইরে থেকে বাসায় ফিরে দেখে তার ছোটমামা ড্রইং রুমে বসে আছেন। ছোটমামা শাওনকে বলেন তার মায়ের কাছ থেকে তার ব্যাপারে জরুরী কিছু সিদ্ধান্ত শুনে নেয়ার জন্য। পিতৃহীন পরিবারে মায়ের ছোট ভাই এই মামা-ই অনেকটা অভিভাবক স্বরূপ। মামার দেয়া সিদ্ধান্তটাও শাওনের জীবনে বেশ অভাবনীয়। মায়ের কাছে সেটা শুনে শাওন খুব বিস্মিত হয়। এভাবেই কাহিনীর শুরু। তারপর ধীরে ধীরে কাহিনীতে আগমন ঘটে রেনু, বাদল, বৃষ্টি, মিন্টু, রিন্টু, মান্নান, জসিম, হায়দার, শায়লা, আম্বিয়া বেগম, মজনু মিয়া, সমীরন, মনির, কাশেম, তৃণা এমন অনেকের। আরো একজনের আগমন ঘটে। ছোট্ট নিধির। যে চরিত্রের কোন পার্থিবতা নেই, গল্পে কোন বিস্তার নেই কিন্তু উপন্যাসের কেন্দ্রীয় এক চরিত্র এই নিধি।
শাওনের চরিত্রের সাথে জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ততোধিক জনপ্রিয় চরিত্র হিমুর যথেষ্ট মিল ছিলো। মনে হয়েছে লেখক হিমুর কথা মাথায় রেখেই শাওনের চরিত্রায়ন করেছেন। বোহেমিয়ান, ঘরছাড়া, বন্ধনহীন, ভাবনাহীন, রোজগারহীন এক অভাবনীয় চরিত্র। তেমন কোন কাজ নেই, চিন্তা নেই, যার কাজ রাস্তায় রাস্তায় হেটে বেড়ানো। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাড়া এমন চরিত্র পাওয়া দূর্লভ। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা চলে এই শাওনকেই। যাকে ঘিরেই সৃষ্টি হয় আরো নানা পার্শ্ব চরিত্রের, নানা ঘটনার, মেঘ বিষাদের গল্প।
কাহিনীর গতি খুব সাবলীল। পেছনের কাভারে লেখা “গল্পটা হয়তো আনন্দের কিংবা প্রতিশোধের” বাক্যটি পড়া থাকায় প্রথম থেকেই একটা থ্রিলিং ফিল হতে থাকে। প্রথম দিকে সারাক্ষনই এক প্রশ্ন- এ গল্প কিসের প্রতিশোধের গল্প? যেহেতু প্রতিশোধের গল্প, তাহলে নিশ্চই কোথাও কোন হত্যা কিংবা কিডন্যাপ কিংবা জালিয়াতি অথবা বিশ্বাসঘাতকতার ধোয়াশা আছে। যদিও সেই মাহেন্দ্রক্ষনের জন্য পাঠককে অপেক্ষা করতে হবে বেশ। কাহিনীর কিছুটা গভীরে গেলেই প্রকাশিত হয় দুর্দান্ত এক ষড়যন্ত্রের প্লট।
অপরাধ, সন্ত্রাস, রাজনীতি, হত্যাকান্ড, বিশ্বাসঘাতকতা এতোকিছু থাকা সত্বেও কিন্তু আক্ষরিক অর্থে বইটিকে থ্রিলার জনরাতে ফেলা যায়না। এ যেন থ্রিল থাকা সত্বেও ঠিক থ্রিলায় নয়, হইয়াও হইলোনা থ্রিলার একটা ভাব। মনের মাঝে এক চাপা অস্বস্তি। এটা কি থ্রিলার? নাকি আমাদের সমাজের কঠিন বাস্তবতা।
লেখকের গল্প বলার ঢং খুব মনোমুগ্ধকর। সহজ, সরল, দ্যোতনা জাগানিয়া, আবেগী। চরিত্রায়ন, দৃশ্যায়ন গুলো লাগছিলো অতি পরিচিত। যেন আমার আশেপাশেই সব ঘটছে, পুরো বইটি পড়ার সময় এমন এক অনুভূতি কাজ করছিলো ভেতরে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে বিভিন্ন চরিত্রের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর বর্ণনা। যেগুলো বেশ কাব্যময় করেছে উপন্যাসের পাতাগুলোকে।
বইয়ের মতো প্রচ্ছদও মনকাড়া। পাখিগুলো যেন সত্যিই পাঠককে মেঘ বিষাদের কোন গল্প শোনাতে এসেছে। উপরে রক্তাক্ত সূর্যটি যেন আমাদের পচা-গলা-রক্তাক্ত সমাজেরই প্রতীক।
আর বেশী কিছু বলবো না। এক কথায় দুর্দান্ত পাঠ। শরীফুল হাসানের সাম্ভালা পড়েই তাঁর ভেতর সম্ভাবনার দীপ্তি দেখা গিয়েছিলো। এই বইখানা পড়ে সেই বিশ্বাস আরো পাকাপোক্ত হলো। আশা করি লেখকের কাছ থেকে আমরা পাঠকেরা এমন আরো অনেক দ্যোতনা জাগানিয়া উপন্যাস পাবো। - গ্রন্হ পরিচিতি
" মেঘ বিষাদের গল্প " বইটার খুব প্রশ্নংসা করেছিলো Salman । ইচ্ছে ছিলো অনেক আগেই পড়ার ।কিন্তু নানা কারণে পড়া হয়নি। অবশেষে বইটা পড়তে পারলাম । জানতাম বইটা সামজিক । তাই সেইরকম প্রপারেশন নিয়েই বইটি পড়তে বসেছিলাম । কিন্তু আমার এক্সপেক্টেশন যা ছিল বইটি তা তো পূরণ করছেই বরং আরো কয়েকগুণ হয়ে গেল । সামাজিক হয়ে গেলো ক্রাইম ড্রামা। আসলে শারীফুল হাসান ভাইকে থ্রিলার লেখক হিসেবেই ভালো জানতাম । কিন্তু সামাজিক, ড্রামা জনরায় ও যে তিনি এমন দুর্দান্ত লিখবেন আসলেই ভাবতে পারিনি। বইটা শেষ করার পর আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম । ঠিক যেন বইয়ের নামকরণের সার্থকতা প্রমাণের জন্যই বইটি কিছুটা বিষাদ রেখেই শেষ হয়েছে । কিছুক্ষণের জন্য আমি আসলে ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমি আসলে বাসে বসে আছি । যাচ্ছিলাম ধানমণ্ডি। মনটা এতই খারাপ হল যে ৩২এ এসে বাস থেকে নেমে গেলাম। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে তারপর গন্তব্যে গেলাম। প্রথমে একটা কথায় আসি। বইয়ের চরিত্রে প্রেমে অনেকেই পড়ে ।আবার কেউ কেউ তীব্র ঘৃণাও অনুভব করে । শীর্ষেন্দুর দূরবীন পড়ার আমার তেমই লেগেছিলো। ধ্রুবকে আমার সোজা বন চটকনা দিতে ���চ্ছে করেছিলো । এই বইতে শাওনকে যদি আমি সামনে পাইতাম বন চটকনা না ওর চৌবিশটা দাঁত ধাবড়াইয়া ফালাইয়া দিলাম -_- । এতই মেজাজ খারাপ হইছে ওরে নিয়�� । বইয়ের কাহিনী খুব সিম্পন - বাবাহীন পরিবারের দুই ভাই আর এক বোন । বড় ভাই শাওন লেখাপড়া করে স্বইচ্ছায় ভাদাইম্যা । ছোট বোন লেখাপড়া নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস । আর সংসার চালায় বখে যাওয়া ছোট ভাই বাদল। মা সব সব ভাদাইম্যা শাওনকে নিয়ে চিন্তায় থাকে । অথচ যে ছেলেটা সংসার চালাতে গিয়ে বখে গিয়েছে তাঁকে খুব একটা দেখে শুনে রাখে না। গল্প এগিয়ে যায় শাওনের ভাদাইম্যাগিরি আর বাদলের নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে । আরেক পাশে আছে রেনু , মিন্টু আর রিন্টু । সম্পর্কে এরা শাওনদের মামাতো ভাই বোন । বাবার কড়া শাসনে সর্বদা বেজার মুখে থাকে ভাইবোনেরা । গল্পের আরেকটি শক্তিশালী চরিত্র হায়দায় আলী এবং তাঁর মেয়ে নিধি। সবগুলো চরিত্র এক সূত্রে গেঁথে যায় একটি খুনের ঘটনার জের ধরে । যে ঘটনাটি পাল্টে দেয় সমস্ত চরিত্রের সমীকরণ। হিসাব নিকেশ সব নেই হয়ে যায় । আছে ক্রাইম, আছে সাসপেন্স, আছে মোটিভ । আর সব কিছু মিলেই মেঘ বিষাদের গল্প । আসলে বেশি কিছু বলতে পারছি না ।যেহেতু সামাজিক বই ।কাহিনী অত প্যাঁচালো কিছু না। বেশি কিছু বললে স্পয়লার হয়ে যাবে । আমার রেটিং - ৫/৫ আমার মতে শরীফুল ভাইয়ের বেস্ট বই এটি । সাম্ভালা থেকেও আমি এই বইটিকে এগিয়ে রাখবো । সবচেয়ে ভালো লেগেছে শরীফুল ভাইয়ের লেখনী। পড়লেই বুঝতে পারবেন । শারীফুল ভাইয়ের কাছে অনুরোধ থাকবে থ্রিলার লেখার পাশাপাশি যেন এইরকম আরো সামাজিক বই লিখেন ।
যদিও আমি রিয়ালিস্টিক ফিকশানের ফ্যান নই, কিন্তু এই বাংলাদেশের তিনজন লেখক আছেন যাদের রিয়ালিস্টিক ফিকশান আমার খুবই ভালো লাগে। শরিফুল ভাই তার মাঝে একজন।
গত পরশু রাতে নিজের কাজ শেষ করতেই সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছিল, তখন ভাবলাম ঘুমানোর আগে একবার বইটা হাতে নেই। এর আগে ৫০ পেইজ পড়েছিলাম, এরপর থেকে শুরু করেছিলাম তখন। ভেবেছিলাম, অল্প কয়েক পেইজ পড়েই ঘুমিয়ে যাবো। পারিনি, প্রায় ১৬০ পেইজ পর্যন্ত একটানা পড়তে বাধ্য হয়েছি, এবং এরপর পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গেছি, মনে নেই।
সকালে (আমার জন্য সকাল, আপনার জন্য বিকেলও হতে পারে) ঘুম থেকে উঠে বাকি অংশটা না পড়ে পারিনি। দিস ইজ এ গুড পিস অফ লিটারেচার। শরিফুল ভাইয়ের লেখনী সবসময়ই ভালো এবং বর্ণনাভঙ্গী চমৎকার। যদিও এটা সামাজিক উপন্যাস, কিন্তু এরপরেও এখানে থ্রিলিং ইলিমেন্ট আছে, যা গল্পটাকে আরো বেশি উপভোগ্য করে তুলেছে।
কিছু চরিত্রের পরিণতি দেখে কষ্ট লেগেছে, কারণ ওদেরকে আসলেই পছন্দ হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, ওদের কষ্ট আমাকেও ছুঁয়ে গিয়েছে।
পুরো গল্পটা থার্ড পার্সন লিমিটেড পয়েন্ট অফ ভিউতে থাকলেও, বেশ কিছু যায়গায় একই চ্যাপ্টারে পয়েন্ট অফ ভিউ বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। আশা করি পরবর্তী এডিশানে এটা ঠিক করে নেয়া হবে।
শরিফুল ভাইয়ের একটা বইয়ের অপেক্ষায় আছি। কোনটা, সেটা শরিফুল ভাই জানেন। আমি খুব আশা করছি যে ওটা ২০১৮ বইমেলার আগেই কমপ্লিট করে ফেলবেন উনি।
একটি অবশ্য পাঠ্য বই....শরীফুল হাসান যে জায়গায় হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন....হোক সেটা থ্রিল্লার বা ফ্যান্টাসি বা এই বইয়ের মত.... অদ্ভুত এক বিষন্নতা গ্রাস করেছিল আমাকে বইটা শেষ করার পর...ডাবল থাম্বস আপ....
বেশ কিছু সেরা সেরা থ্রিলারের পর এবার শরীফুল হাসান লিখেছেন একটু অন্য ধাঁচের গল্প। একজন লেখকের স্বার্থকতা তখনই প্রমাণিত হয় যখন তিনি একাধিক ঘরানায় মুন্সিয়ানা সফলভাবে তুলে ধরতে পারেন। এই বইটি পড়ার পর শরীফুল হাসান সেই মাপকাঠিতে পুরোপুরি সফল বলে আমার মনে হচ্ছে।
এই গল্পটা শাওনের, বাদলের। এই গল্পটা রেনুর, রেন্টুর, মিন্টুর। এই গল্পটা তৃণার। এক সাধারণ পরিবারের গল্প, নুন আনতে যার পান্তা ফুরায়। যে পরিবারের বড় ছেলে বোহেমিয়ান, ছোট ছেলের উপর পরিবার চালানোর ভার। যার উপার্জন সৎ না অসৎ তা দেখার সময় নেই কারও।
এই গল্পটা হায়দারের। রাজনীতির নেশায় মরিয়া এক মানুষ, মরিয়া হয়ে যে দারুণ এক ঝুঁকি নিয়ে ফেলে। হিসেবের গণ্ডগোলে এলোমেলো হয়ে যায় তার জীবন। সবকিছু হারিয়ে সে নামে প্রতিশোধের মঞ্চে। এই গল্পটা তাই প্রতিশোধের। লোভের, ক্রোধের, আহত ভালবাসার।
এই গল্পটা অনুতাপের। সব কিছুকে ঝুকির মুখে ফেলে দিয়ে ফিরে আসার, ঘুরে দাড়ানোর। কে অপরাধী? কে শিকার? কাকে ঘৃণা করা উচিত? কাকে উচিত ভালবাসা? দিনের শেষে এই প্রশ্নগুলোর জবাব কি মেলে খুব সহজে? যদি মেলে, তবে কিভাবে? কার কাছে?
মেঘ বিষাদের গল্প পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল, বহু দিন পর কোনো মন উদাস করা বই পড়তে বসলাম। বই শেষ হলেও যার রেশ রয়ে যায়, তেমন এক বই। থ্রিলারের তো ইদানীং অনেক ঘরানাই হয়। শরীফুল হাসান ভাইয়ের মুখ থেকেই শুনেছি, এই বইটিকে ঠিক থ্রিলারে ফেলা যায় না। কিন্তু আমার মনে হয়, একে থ্রিলার বললেও দোষের কিছু হবে না। কিন্তু সেই হিসেবে লেখক সম্পূর্ণ নতুন এক ঘরানার সূচনা করেছেন। যার নাম - মন খারাপ করে দেয়া থ্রিলার! বইটি পড়ার পর পাঠক নিজেই মিলিয়ে নিতে পারবেন যে আমার মতামত কতটুকু সত্যি। বাতিঘর প্রকাশনীর বইয়ের মান যে দিনকে দিন আরও উন্নতির দিকে যাচ্ছে, এই বইটাই তার প্রমাণ।
সময় অনেক পরিস্থিতি বদলিয়ে দেয়, সাথে বদলে যায় সম্পর্কযুক্ত মানুষগুলোও। কেউ প্রয়োজনের তাগিদে তো কেউ অবচেতনভাবে তো আবার কেউ উদ্দেশ্য উর্জনের জন্য বদলে যায়। এই হঠাৎ পরিবর্তন বা বদলিয়ে যাওয়া ইতিবাচক হতে পারে তো নেতিবাচকও। কিন্তু হঠাৎ বদলে যাওয়া মানুষগুলোকে চিনতে প্রায়ই গোলকধাঁধায় পড়তে হয়। যে একবার বদলে যেতে পারে সে কি আবারও বদলে যেতে পারে না?
সাদাসিধা একজন মানুষ ছিলেন শাওনের বাবা। চেয়েছিলেন প্রথম সন্তান মেয়ে হবে আর নাম রাখবেন 'বৃষ্টি'। কিন্তু পরপর দু'টো ছেলে হলে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে তৃতীয় সন্তান মেয়ে জানার পর জন্মের আগেই নাম দিয়ে দেন। বর্ষাকাল পছন্দ করেন বলে যথাক্রমে নাম রাখেন; শাওন, বাদল ও বৃষ্টি। তিন ভাইবোনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মিল কম হলেও ভাবে কমতি পাওয়া কঠিনই। সুন্দর সাজানো-গোছানো পরিবার নিমিষেই বদলে যায় শাওনের বাবার মৃত্যুর পর। চারটি প্রাণ যেন হঠাৎই অন্ধকার রাজ্যে তলিয়ে যেতে থাকে। ছোট মামা সাহায্যে এগিয়ে এলেও কি মামা বাবার জায়গা নিতে পারে? দায়িত্ব থেকে বরাবরই শাওন পালিয়ে বেড়ায়। কোনোকিছুতেই খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখায় না সে। ছোট হওয়ার পরও পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় বাদল। ডানপিটে সাহসী ছেলেটির আর লেখাপড়ার পাঠ শেষ করা হয়ে ও��ে না। সন্ত্রাসী বনে যায় অল্পসময়ের মধ্যেই। বিবেকের দংশন ও পরিবারের চাহিদা দু’য়ের মধ্যে ফেঁসে ঠিকবেঠিকের হিসাবে গোলমাল করেই চলেছে। চঞ্চল বৃষ্টিকে ঘিরেই যেন পরিবারের তিন সদস্য বেঁচে আছে।
বড় অপারেশনের প্রস্তাব পাওয়ার পর বাদলের মন সায় দেয় না। খুন করবে সে? অন্যায় জীবনে বহু করেছে কিন্তু তাজা প্রাণ নিজ হাতে পৃথিবীর বুক থেকে মিশিয়ে দেওয়া কি এতোই সহজ? তবে টাকার পরিমাণ দেখে, ��রিবারের সদস্যদের কথা ভেবে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু পরিণাম সম্পর্কে আগেই যদি বাদল জানতো তাহলে কি হতো? শুরু হয়ে যায় ভয়ংকর এক প্রতিশোধের খেলা...!!!
খুন, প্রতিশোধ, মোটিভ, সাসপেন্স থাকার পরও থ্রিলার বই বলা যায় না। কেননা বইয়ে মোটাদাগে ফুটে উঠেছে চরিত্রগুলোর জীবনের গল্প। খুনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চরিত্রগুলো জড়িয়ে যায় কিন্তু প্রত্যেকের নিজস্ব গল্পই যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে। তাই ক্রাইম ফিকশন বলবো। কারণ গল্পটা যে দায়িত্বের, ভালোবাসার, মায়ার, বন্ধুত্বের, অপরাধের, প্রতিজ্ঞার, প্রতিশোধের, আনন্দের, বেদনার এবং... বিদায়ের!
গল্পটা অনেকের... শাওন, বাদল, বৃষ্টি, রেনু, মিন্টু, হায়দার আলী, পিচ্চি নিধি, জসিমসহ আরও অনেকের। শাওন বারবার হুমায়ূন আহমেদের 'হিমু' চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। একেবারে ছন্নছাড়া না হলেও দায়িত্ব জ্ঞানহীন অনেকটাই। সকল পরিস্থিতিতেই কেমন জানি শীতল আচরণ করে। বইয়ে সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর চরিত্র শাওনকেই মনে হয়েছে। কোনো কিছুকেই গুরুত্বের সাথে নেয় না। দিনের পর দিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেঁচে থাকাই যেন জীবনের উদ্দেশ্য। ছোট ছোট প্রয়োজনে ছোট ভাইয়ের ওপর বেঁচে থাকা অকর্ম এক চরিত্র। শাওন একবার বলেছিল দায়িত্ব সবাই নিতে পারে না এবং দায়িত্ব নিতে না পারা একজন সে নিজেও। শেষে এসে হায়দার আলীর বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে শাওন মনে যখন বলে বেঁচে গেলে পরিবারের দায়িত্ব নিবে তখন পড়ে আসলে হাসিই পেয়েছে। জীবনে এতো শতবার সুযোগ পাওয়ার পরও যার দায়িত্বজ্ঞান জন্মায়নি তার প্রতি আসলে বিশ্বাস হয়নি। সময় থাকতেই যদি সে পরিবারের জন্য এগিয়ে আসতো তাহলে গল্পটা বিষাদের নাও হতে পারতো।
বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র কে এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার। হাতেগোনা পছন্দের কয়েকটা চরিত্রের মধ্যে বাদল একজন। আমার জন্য বাদলই মূখ্য চরিত্র। অপরাধ জগতে অগাধ বিচরণ হলেও পরিবার ও বন্ধুদের জন্য জীবন দিতেও যেন তার বাঁধে না। বিবেকের দংশনে তিলে তিলে যেমন মারা যাচ্ছে তেমনি নিজের আবেগ শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণও করছে। বাদলের প্রতি তার বন্ধুর ত্যাগ ভোলার মতো না। কতজনই বা এমন পারে? তবে বন্ধুত্বের আরও একটা উদাহরণ হলো জসিম। কমবেশি সব চরিত্র নিয়েই লেখক গল্প বলেছেন।
শুরুর দিকে কাহিনী অনেক ধীরে এগিয়েছে। মাঝামাঝি এসে ধৈর্য্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। শাওনের জন্য রাগও হচ্ছিল। তাই বেশ কিছু সময়ের বিরতি নিয়ে বাকিটা শেষ করেছি। ষড়যন্ত্র ও মোটিভ পরিষ্কার হলেও আরও কিছুটা বর্ণনা থাকলে ভালো হতো। তাড়াহুড়ো করে যেন শেষ হয়ে গেছে। শরীফুল হাসানের সম্ভবত বইয়ের হ্যাপি এন্ডিংয়ে শত্রুতা আছে। ওনার যতোগুলো বই পড়েছি অধিকাংশই ট্রাজেডিক এন্ডিং। তবে এই বইয়ের এন্ডিং স্যাড হলেও ভালো লেগেছে। সমাপ্তি এমন না হলেই বরং মনে দাগ কাটতো না। লেখকের সম্প্রতি সময়ের লেখনশৈলীর সাথে পরিচয় আগেই হয়ে গেছে তাই ২০১৭ সালে বের হওয়া বইয়ের প্রতি ভালোলাগা আশানুরূপ হয়নি। তবে মোটামুটি ভালোই লেগেছে।
মেঘ বিষাদের গল্প। গল্পটা হয়ত শাওন, বাদল কিংবা বৃষ্টির।
সাধাসিধা আলাভোলা একটা ছেলে শাওন। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ছোট ভাই বাদল সংসার চালায়। কিভাবে চালায় তাও জানে না শাওন। কখনো জানতেও চায়নি। সে তার মত করেই থাকতে চায়।
অন্যদিকে অল্পবয়সে সংসারের হাল ধরা ছেলে বাদল। আয়ের সব রাস্তাই তার মোটামুটি জানা আছে। অপদার্থ বড় ভাইকে বন্ধু বান্ধব নিয়ে মেতে থাকতে দিয়ে সেই সব ঝক্কি ঝামেলা সামলায়।
ওদের ছোট বোন বৃষ্টি। লেখাপড়ার পাশাপাশি মাকে কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করে।
গল্পটা হয়ত রেনু, মিন্টু, রিন্টুর।
বাদলের মামাত বোন রেনু। আর একটা পরিচয় আছে। যার সাথে আর কয়টা দিন পরেই বাদলের বিয়ে। মামাই ঠিক করেছেন এই বিয়ে। ওদের বিয়েটা কি প্রেমের বিয়ে? বলা যায় আবার নাও বলা যায়।
ভাই মিন্টু পড়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবার সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় তার থেকে খরচের টাকা নিতে চায়না, বাড়ি ও আসে না।
সবচেয়ে ছোট রিন্টু। স্কুলে পড়ে, অল্প বয়সেই পেকে গেছে। মায়ের থেকে হাতখরচের টাকা নিয়ে দেদার উড়ায়।
গল্পটা আবার হায়দার আলী, শায়লা আর ছোট্ট নিধিরও হতে পারে।
বছর চল্লিশের মত বয়স হায়দার আলীর। একসময়কার তুখোর মেধাবী ছাত্রনেতা রাজনীতির পাশাপাশি ব্যাবসাও সফল। স্ত্রী শায়লা আর ছয় বছরের মেয়ে নিধিকে নিয়ে তার সোনার সংসার।
হঠাৎ একরাতে নির্মম একটা ঘটনা উলট পালট করে দিল তাদের সবার জীবন। স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন হয়ে গেল। এটাই বাস্তবতা। গল্পটা অন্যরকম হয়ে গেল।
আমার কথা : এর আগে সাম্ভালা পড়ে শরীফুল হাসানের লেখার জন্য অন্য রকম একটা টান তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই লেখাটা ব্যাতিক্রম। তাই এর ভালোলাগাটাও অন্যরকম। এই লেখাটা যেন মনে করিয়ে দেয় জীবন এত সহজ না। জীবনটা সিনেমার মত হয়না।
কেউ নেই কোথাও, শুধু আছে কিছু দ্বায়িত্ববোধ, আছে কিছু করার তাগিদ, কিন্তু নেই অনুপ্রেরণা, কোনো চাহিদা, বেঁচে থাকাটা শুধুই বেঁচে থাকা, মরে গেলেও কোনো অসুবিধা নেই, এই দমকা বাতাস ঠিকই বইবে, ঠিক এই জায়গায় বসে হয়তো দীর্ঘশ্বাস ছাড়বে অন্য কোনো দন্ডিত কাপুরুষ।
পড়তে পড়তে সত্যি মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। জীবন্ত বর্ণনায় বার বার মনটা আরু খারাপ হতে লাগলো। আসলে জীবন কোনো উপন্যাস নয়, আবার জীবনই সবচেয়ে বড় উপন্যাস। জীবন বড় নিষ্ঠুর। আমরা চাইলেও এই আগ্নেয়গিরির উদগির করা লাভা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারি না। সত চেষ্টাকে একেবারেই ব্যর্থ করে দিয়ে জীবন তার পথ করেনেয়।
শরীফুল হাসান ভাইয়া আমার পছন্দের একজন লেখক। ওনার স্টোরিটেলিং আমার খুব ই ভালো লাগে। লাইক উনি যদি কোনো সুনির্দিষ্ট গল্প বা প্লট ব্যতীত কথার কথা লাইনের পর লাইন বর্ণনা করে যান, আমার বিশ্বাস আমি ঐটাও পড়তে পারবো।
বইটা যথেষ্ট ভালো লেগেছে। শেষ টা এখনো হজম করতে পারি নাই। ধাক্কাটা হজম হচ্ছে না। মানে বিষাদ্গ্রস্থতা আরকি। শেষ্টা তীব্র বিষাদে ছায়া। তবে পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে এতটা বিষাদ আনতে গিয়ে হয়ত কিছু হোল রেখে যেতে হলো কি? একশানের লাস্ট দৃশ্য একটু ঘোলাটে এবং বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি পরে। মনে ���লো একটু যেনো তাড়াহুরা। সেই সমস্ত কিছু কেটেছে এই সামাজিকের পরবর্তী সামাজিকে ওনার, যেখানে রোদেরা ঘুমায় তে। দুইটা বই ই অবশ্য অবশ্য পাঠ্য।
গল্পটা ঠিক থ্রিলার না। পুরোপুরি সামাজিক ধাচের, সাথে হালকা 'থ্রিল' আছে। এইটাই এই বইটার ওয়াও ফ্যাক্টর। আমি তা মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। গল্প টা ছিলো বাবা মরা পরিবারের বোহেমিয়ান বড় সন্তান শাওন এর। তার ছোটো ভাই যে সংসার চালানোর দায় কাধে নিয়েছে এবং টাকার জন্যে খারাপ রাস্তায় ও যেতে বাধ্য হয় বাদলের। গল্পটা কি তৃণার? আমি জানি না! আমি জানি গল্পে জড়িয়ে আছে ময়মনসিংহ শহরের আধুনিকা মেয়ে তৃণা। খুব গভীরভাবে জড়িয়ে। ভালো লেগেছে দেখে, অনাড়ম্বর রেনুকে দেখে। গল্প টা যে রেণুর ও! আহ রেণু! বাড়ির বউ ঠিক যেমন হবার দরকার তেমন একটি মেয়ে! গল্পটা কি কবি থেকে সংসারি হওয়া 'মুসাফির' মান্নান কিংবা তার স্ত্রী পরীর? আমার দ্বিমত আছে। তবু তারাও আছে কারন তারা জড়িয়ে আছে একদম বেখেয়ালী উদাসীন বোহেমিয়ান শাওনের সাথে। গল্পটা শাওনের ছোটোবন বৃষ্টির আর তার আহ্লাদী সব আব্দারের। গল্পটা মিন্টুর! পাবলিকে পড়ুয়া এক বাম পন্থী সুশীল ছেলের। গল্প টা টিনএজ এর দুর্দান্ত সময়ে থাকা রিন্টুর ও! আর? আর জামিলের। শাওনের বন্ধু জামিলের! শুধুই কি বন্ধু! শুরু থেকে একদম ব্যতিক্রম ভাইব্জ দিয়ে যাচ্ছিলো আসলে। গল্পটা মজিদ মিয়ার কিংবা আম্বিয়া খাতুনের ছেলেমেয়েদের!
কিংবা বলতে পারেন পুরো গল্পটাই হায়দার সাহেব আর শায়লার ই! হায়দারের বাচ্চা মেয়ে নিধি, রাজনীতি প্রেম, আনুগত্য, অনুতাপ, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস ঘাতকতা, প্রতিশোধ, সন্তানের জীবন ঝুকিতে রেখে পারিপার্শ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্ল্যান করা। তার স্ত্রী শায়লার আফসোরের এবং অবশ্যই বাদলের অনুতাপের!
বই টা পড়তে গিয়ে সো কল্ড না, প্রকৃত 'নাইন্টিজ কিডস' এর প্রত্যেকে দেখতে পাবে তাদের শৈশোব এবং কৈশোর! শাওনকে দেখে কখনো কখনো নিজেকেও আমি খুজে পেয়েছিলাম। উদ্দ্যেশ্যহীন, বোধবুদ্ধিবিহীন উদাসীন যুবক! সব কিছু মিলিয়ে আমার মনে হয় না আমি কোনো থ্রিলার পড়েছি। সামাজিক শতভাগ মনে হয়েছে। গল্পের মধ্যে পেয়েছি সমাজ বাস্তবতা, বিষাক্ত বাস্তবতা সহ সমাজের নানান দিক। লেখক উঠিয়ে এনেছেন সুন্দর করে। লেখকের লেখনশৈলীতে আমি বরাবরের মতোই বেশ মুগ্ধ। শুধু শেষ দৃশ্য নিয়ে কিছু যৌক্তিক-অযৌক্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অভাব পেয়েছি বলে মনে হলো। বই টা শেষ করেছি একদিন আগে। সারাটা দিন আমাকে বিষাদ তাড়া করে বেড়ালো! মনে হচ্ছে ল্যুপে পড়ে গিয়েছি, তা এখনো আছে। মানুষের জীবনের দিক বুঝি এভাবেই পালটে যায়! দীর্ঘশ্বাস!
শরীফুল হাসান ,যে ধরনের বই লেখান না কেন সেগুলা বিশেষ ভাবেই সফল । মিষ্ট্রি, মার্ডার,ত্রিলার হিস্টোরিক্যাল ত্রিলার প্রত্যেক্তি বইয়ে আলাদা কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে চলেন। প্রতি বছর তার লেখার অপেক্ষা করে থাকি । গল্প এগিয়ে গিয়েছে দুর্ধর্ষ গতিতে । প্রমে বিষাদ, সাংসারিক জীবন ভবঘুরে জীবন, প্রতিশোধ এক সাথে হয়ে উঠেছে অনবদ্য। সবথেকে মারাত্বক লেখা ছিল শেষের চ্যাপ্টারটা । শেষের চ্যাপ্টার পুরা লেখাটাকে অন্য একটি মাত্রায় পৌছে দিয়েছে। আগামীতে নতুন কোন চমকের অপেক্ষাতে থাকলাম ।
* মূল চরিত্রের সাথে হুমায়ূন আহমেদের 'হিমু' চরিত্রের প্রচ্ছন্ন ভাব ছিল।
* সাসপেন্স আনতে গিয়ে কাহিনীটা কিছুটা লম্বা বানিয়ে ফেলেছেন লেখক। উনার লেখার হাত ভাল। কিন্তু , যা এক বাক্যে বলা সম্ভব, তা কেন দশ বাক্যে বলার তো কোনই কারণ হতে পারে না!
* শেষে এসে উনার আগে পড়া একটা বইয়ের মতোন , আঁধারের যাত্রী, কেমন জানি বানিয়ে ফেলেছেন। আরেকটু গুছিয়ে লিখলে চমৎকার হতো।
এবছরের জুন মাসের ২৩ তারিখ লেখকের লেখা "ছায়া সময়" বইটা দিয়ে আমার শরিফুল হাসানের দুনিয়ায় যাত্রা শুরু। প্রথম বইটা ছিল সাংঘাতিক রকমের অসাধারণ। ওইয কিছু বই থাকে না যে বই শেষ করার পরও বইয়ের চরিত্র গুলার প্রতি একটা অদৃশ্য টান থেকে যায় দীর্ঘ সময় বা দীর্ঘ দিন, অনেকটা তেমনই। এরপর তার লেখা আরেকটা বই পড়ি, "রেড পয়জন" যেটা আসলে আমার কাছে ততটা ভাল লাগে নাই। প্রথম উপন্যাসটা এত দারুণ লেগেছিল যে, লেখকের লেখার প্রতি একটা ভালই expectation built up হয়ে গেছিল মনের মাঝে। কিন্তু রেড পয়জন আশাহত করে আমাকে। মনে হচ্ছিল লেখক তার ফুলপটেনশিয়াল এখানে কেন জানি লুকিয়ে গেছেন। এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন, হঠাৎ ফেসবুকে পুরাতন একটা বই সেলিং পেজে একটা বইয়ের সেল পোস্ট দেখি। বইটা হচ্ছে শরিফুল হাসানের লেখা, "মেঘ বিষাদের গল্প", লেখকের মোটামুটি সব বই আমার সংগ্রহে থাকলেও এই বইটা দীর্ঘদিন প্রকাশনীতে প্রিন্ট আউট, তাই যতবারই অর্ডার করতে গিয়েছি, আশাহত হয়েছি। অবশেষে পুরাতন বই সেলিং পেজে বইটাকে পেয়ে দ্রুতই লুপে নিছিলাম।
বইটা সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না আমার কিন্তু প্রাথমিক দর্শনে বইয়ের নামটা যথেষ্টই আকর্ষণ করেছিল আমায়। ১৯১ পৃষ্ঠার বইটা সামাজিক উপন্যাস এবং থ্রিলার একটি দ্বন্দ্বের মাঝ বরাবর ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। এর পূর্বে ছায়াসময় পড়ে লেখকের এই বিশেষ স্টাইল সম্পর্কে আমার একটু ধারণা হয়েছে। লেখক কনটেমপোরারি ফিকশন আর থ্রিলারকে দারুণ নিপুণতার সাথে ব্লেন্ড করতে পারেন। ফলাফলে বের হয় অসাধারণ সব উপন্যাস।
বইটা শুরু করার পূর্বে বইয়ের পিছে লেখা ছোট্ট কয়েক লাইনের সবচেয়ে শেষের কয়েকটা লাইন পড়ে মনের মাঝে একটা প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছিলাম। লেখক লিখেছেন, " গল্পটা হয়তো আনন্দের কিংবা প্রতিশোধের কিংবা বিষাদের" সুতরাং বইটা শেষ করার পর আমার মানসিক অবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। এবং বইটা শেষ করেও সেই ধাঁধা সলভ করতে পারলাম না। আমি একই সাথে বিষাদে ভুগছি কিন্তু এই বিষদের মাঝে কোন এক অজানা এক সুখ আছে, এ কেমন মেলানকলিক অনুভূতি, জানিনা।
গল্পটা শুরু হয় শাওনের হাত ধরে। বাসার বড় ছেলে। বেকারত্বের অভিশাপের জর্জরিত। সারাদিন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। জীবনে খুব বেশি মানুষের উপস্থিতি নাই তার। বন্ধু হিসাবে আছে জসিম এবং মুসাফির মান্মান। অপরদিকে পরিবারে মা, ছোট বোন আর ছোট ভাই ���াদল। বাবা মারা গেছেন বহু বছর আগে। বাবার মারা যাওয়ার পরই পরিবারটা কেমন জানি মুষড়ে পড়ে। বড় ছেলে বেকার, বাউন্ডুলে স্বভাবের। সুতরাং পরিবার চালানোর দায়দায়িত্ব এসে পড়ে ছোট ছেলের উপর। কিন্তু সেও যে শিক্ষিত না তেমন সুতরাং আয়ের উৎস হিসাবে বেছে নেয় অপরাধ জগৎকে। শুরু শুরু তে পকেটমার, ছিনতাই, টেন্ডারবাজী অব্দি সীমাবদ্ধ থাকলেও হঠাৎ এক আগন্তুকের দেওয়া অফার পাল্টে দেয় সমগ্র পরিবারের নসিব।
গল্পে ছিল আরো অনেক চরিত্র আর প্রত্যেকটা চরিত্রের নিজস্ব এক গল্প আছে। শরিফুল হাসান গল্পের সব চরিত্রকেই বিশেষ উদ্দেশ্য দিয়েই সৃষ্টি করেছেন।
গল্পের বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল এক সাইলেন্ট ক্যারেক্টার। তাকে ঘিরেই গল্পের পরিক্রমা বয়ে চলেছে। তার নাম নিধি। ভুলক্রমে নিধি গু-লির আঘাতে প্রাণ হারায়। এরপর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠে তার বাবা হায়দার আলী। গল্পের ভিলেন হায়দার আলীকে বলা যায়। তবে তাকে ভিলেন বললে ভুল হবে, একজন বাবা তার মেয়ের হত্যাকারীকে খু*ন করার জন্য পাগল হয়ে গেছে, এটাকে কোনভাবে নেগেটিভ ভাবে দেখানো যায় না। আসলে গল্পে বাদল এবং হায়দার আলীর মধ্যকার ক্লাশটা ছিল এক মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং এর। তবে এর মধ্যে গুপ্ত অবস্থায় ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, অর্থের লোভ, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ।
বইটার শুরুর দিকটায় ক্যারেক্টার ইন্ট্রোডাকশনটা স্লো লাগছিল যদিও কিন্তু এরপর থেকে গল্প 1.5× এ ছুটতে শুরু করে। স্পেশালি বইয়ের শেষ কয়েক পৃষ্ঠা যে মানসিক চাপের মাঝে রেখেছিল আমাকে, বিকাল থেকে বইটা পড়তে পড়তে কখন যে মাগরিবের আজান দিয়ে দিল টের পেলাম না। এরপর শেষ চার পৃষ্ঠার আগে বুকমার্ক ঢুকিয়ে নামাজ পড়তে চলে যাই। নামাজ শেষে গুটি গুটি বৃষ্টির মধ্যে হাটতে হাটতে বাসায় আসার পথে মনে মনে গল্পের ক্যারেক্টার গুলার চূড়ান্ত পরিণতির কথা ভাবছিলাম। একটা হ্যাপি ইন্ডিং হতে পারত গল্পটা...কিন্তু গল্পটা যে প্রতিশোধের, রক্ত এখানে ঝড়তেই হবে। আর তাই হল।
শুরুতে বলেছি, বইটা শেষ করে আমি আসলে বিষাদে ভুগতে থাকলেও এর মাঝে এক অজানা প্রশান্তি ও অনুভব করছি। না, ইন্ডিং আমি যেমনটা চেয়েছিলাম বা মনে মনে ভাবছিলাম তার এক বিন্দু ও হয় নাই। কিন্তু লেখক যে ইন্ডিং দিয়েছেন তা নিয়ে আমার অভিযোগ ও নাই। মানুষ তার কৃতকর্মের সকল সাজাঁ, দুনিয়ায় বসে ভোগ করে যাবে..এর থেকে পরিত্রাণের কোন পথ খোলা নাই, লেখক পুনরায় মনে করিয়ে দিলেন।
পত্রিকার প্রথম পাতায় যখন 'সন্ত্রাসীর গুলিতে ব্যবসায়ীর সন্তান নিহত' এ টাইপের খবর ছাপা হয়, তখন আমরা খুব গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে ভাবি... এদেশ দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এরকমই হবে। বড়বড় কথা বলে অতি তুচ্ছ , ক্ষুদ্র বিষয়টা ভুলে যাই। কিংবা কখনো বারাবারি(!) হয়ে গেলে ফেসবুকে দুইয়েকটা স্ট্যাটাস কিংবা ইভেন্টে গোয়িং দিয়ে দেওয়া । ব্যাস , দায়িত্ব শেষ। কখনো খুঁজে দেখি না এর পিছনের কারণগুলো। ভাবি না, আসলে ভাবতে চাইও না। হলে হয়তো এরকম কিছু হতো না। সবাই কেন ভালমানুষ হয় না? কেন মানুষ গুন্ডা কিংবা সন্ত্রাসী হয়? যে কি না ভালবেসে দুহাতে পরিবার আগলে রাখে সে কেন বন্দুক হাতে তুলে অন্য একটা পরিবারের ধ্বংসের কারণ হয়? অপরাধ থেকে অপরাধের জন্ম হয়। অপরাধের জন্ম হয় চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মিলাতে ব্যর্থ হবার কারণে। কিংবা অনেক সময় অনিচ্ছ্বাসত্ত্বেও... গল্পটা ঠিক এভাবেই এগিয়ে চলে... ঠিক জীবন যেমন করে যায়... জীবনের গল্পটা হয় এগিয়ে যায় কিংবা কখনও বা থমকে যায়। শাওন, বাদল, হায়দার আলী, রেণু কিংবা ছোট্ট নিধির মতো। সব মিলিয়ে জীবন। চাওয়া-পাওয়ার টানাপোড়েনে যে জীবন এগিয়ে যেতে থাকে... পিছনে পড়ে থাকে হাসি,আনন্দ, কিংবা নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা আর ভালবাসা... শরীফুল হাসানের মেঘ বিষাদের গল্প। মেঘ বিষাদ না বলে বলা উচিত মন বিষাদের গল্প। কোন জনরায় ফেলব? মনস্তাত্ত্বিক? সামাজিক উপন্যাস ? নেহায়েত প্রেমের উপন্যাস নাকি থ্রিলার? ভুল করে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা থেকে যার উৎপত্তি নাকি যার শুরুটা অনেক আগেই? কিছু অনুশোচনা, কিছু একটা পাবার তীব্র আকাঙ্খা ,আবেগ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ,হতাশা কিংবা বোহেমিয়ান জীবনের গল্প নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী উপন্যাস "মেঘ বিষাদের গল্প "
বইটির মধ্যবর্তী স্থানে অনেকগুলো পৃষ্ঠা অনুপস্থিত থাকার কারণে বইটি মাঝপথে পড়ে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার একটা পোষ্টে ব্যাপারটির উল্লেখ দেখে স্বয়ং লেখক শরীফুল হাসান ভাইয়া সেই না থাকা পৃষ্ঠাগুলোর পিডিএফ পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর ঝটপট শেষ করে ফেললাম বইটা।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করে প্লটের থেকে উপস্থাপনার ক্ষমতা একজন লেখকের বড় শক্তি। আর এই শক্তি লেখক থ্রিলার বাইরে যেয়েও দেখালেন। কারণ মেঘ বিষাদের গল্পকে ঠিক থ্রিলার জনরার মাঝে রাখা যায় না।
আর বাতিঘর বলতেই যারা শুধু থ্রিলার বুঝতেন তাঁদেরও জন্য সুংসবাদ। কারণ লোমহর্ষক থ্রিলার পাশাপাশি সমকালীন জীবনমুখী উপন্যাস হয়তো আমরা নিয়মিত পেতে যাচ্ছি বাতিঘর থেকে। অন্তত মেঘ বিষাদের গল্প কিংবা নাজিমুদ্দীনের কেউ কেউ কথা রাখে পড়ে এমনটাই মনে হয়েছে।