প্রথমে ভেবেছিলাম ভ্রমণকাহিনী। আসলে তা নয়। এটাকে বরং স্মৃতিচারণ বললে বোধহয় ভালো হয়। সে যাই হোক, আমার খুব সীমাবদ্ধ পড়াশুনার মধ্যে বইটাকে কোন শ্রেণীতে ফেলতে পারলাম না। বইটার ভালোলাগার কথাগুলো বলি। আমার কাছে প্রধান আকর্ষণীয় দিক ছিল লেখনী। বইয়ের লেখনীর ভিতরেই কেমন একটা নিঃসঙ্গতা, একটা বিষণ্ণতা। একেই বুঝি ইংরেজিতে melanchony বলে। শীতকালে দার্জিলিং ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কিছু বিবরণ আছে, সবচেয়ে বেশি আছে লেখকের নিজের চিন্তা আর অনুভূতি। বইয়ের আর একটা ভালো লাগা দিক এটাই। বই পড়তে পড়তে যখন আর একজনের চিন্তা নিয়ে ভাবতে বসে যাই অথবা আর একজনের চিন্তার সাথে নিজের মিল পাই, এর চেয়ে বেশি আনন্দ কোন বই বুঝি আমাকে দিতে পারে না। লেখকের একটা বিষয় খুব ভালো লেগেছে যে, ওনার কাছে ভ্রমণ জ্ঞানপিপাসা মেটানোর পন্থা নয়, নিজেকে আবিষ্কারের উপায়। খুব প্রিয় উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি- " নিঃসঙগতা মানে সবসময় সঙগহীনতা নয়! নিজের সঙগকে উপভোগ করাও হতে পারে। " (আহা! সবাই যদি এই সাধারণ কথাটা বুঝত!)
নিঃসঙ্গতা মানে সবসময় সঙ্গহীনতা নয়! নিজের সঙ্গকে উপভোগ করাও হতে পারে।
বইয়ের লেখক নিজেকে প্রোটাগনিস্ট করে লিখে গেছেন বইটা। দার্জিলিং এর নিঃসঙ্গ ভ্রমণ নিয়ে। কোলাহলের সঙ্গ ছেড়ে নিজের সঙ্গে নিঃসঙ্গ হতে দার্জিলিং যান যিনি। সাথে আমাদেরও নিয়ে যান। যে ভ্রমণ তাকে ভাবায়, দেখায় জীবনের অনেক রূপ। ঠিক প্রচলিত ফিকশানের মত নয় বইটা।
চমৎকার একটা বই।শব্দচয়ন আর ভাষা মুগ্ধ করার মত। বইখানা পড়ে বেশ ভাবনা জাগে। চুপচাপ বসে নিজের মনে ভাবতে ইচ্ছে করে। কিভাবে বাঁচব? কেন বাঁচব? কিংবা ভেবে কি লাভ? এইসব। মনে প্রশ্ন জাগাতে ভালবাসলে, ভাবতে ভালবাসলে আমি তাঁদের এই বই পড়তে বলব। ভাল লাগবে।
রঞ্জন পেশায় সাংবাদিক। ভারত ভাগের কিছুকাল পরেই গিয়েছিলেন ভূতপূর্ব বৃটিশদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী দার্জিলিংয়ে।
বইয়ের শুরুতেই দেখা যায় সাধের কলিকাতা ছেড়ে যাচ্ছেন বইয়ের কথক। তিনি দার্জিলিং যাচ্ছেন।জানুয়ারির হাড়কাপানো শীতের মধ্য তার দার্জিলিং যাওয়া অনেকেই ভালোভাবে মেনে নিতে পারছেনা। লোকে দার্জিলিং যায় বছরের শেষের দিকে কেননা শীত তখন সেখানে সহনীয় থাকে।
ট্রেনের দীর্ঘ ভ্রমণপর্বের পর বহুল কাঙ্খিত দার্জিলিংয়ে পৌছান কথক। সেখানে পৌছে কতশত স্মৃতির রোমন্থন করতে থাকেন। স্মৃতির সে দুয়ারে হানা দেয়া ঐতিহাসিক নানা তথ্য, রাজনীতির কথকথা আর ব্যক্তিক জীবনের অম্ল-মধুর স্মৃতি।
জানুয়ারির শীতে সবাই দার্জিলিংকে উপক্ষা করে, সে বিবেচনায় সেসময়ের দার্জিলিংকে শীতে উপেক্ষিতা বলাই যায়। এদিক বিবেচনা করলে বইয়ের নামকরণে পুরোপুরি সার্থক রঞ্জন।
ভ্রমণকাহিনী সাহিত্যের এক চমৎকারতম অধ্যায়-তারই যেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এক বাঙালি যুবার তীব্র শীতে দার্জিলিং ভ্রমণের নৈস্বর্গিক বর্ণনা।
যাযাবরের "দৃষ্টিপাত " পড়তে গিয়ে বারবার মুগ্ধ হয়েছিলাম। যাযাবরের সাড়াজাগানো বইয়ের প্রতিটি লাইন কতোবার করে পড়েছিলাম তার ইয়াত্রা নেই। অনেকদিন কোনো বইয়ের শব্দ আর ভাষার চমৎপ্রদ ব্যবহারে বিহ্বল হয়নি। কিন্তু রঞ্জনের "শীতে উপেক্ষিতা" পড়তে গিয়ে আমার সে দুঃখ ঘুচলো। কিছু ক্ষেত্রে লেখক যাযাবরের চে' আরে বেশি কুশলতা দেখিয়েছেন।
নিরঞ্জন মজুমদার ওরফ্ রঞ্জনের "শীতে উপেক্ষিতা " একবসায় পড়ে ফেলার মতে একটি বই। ইদানীং কতো মানহীন আর অর্ধজ্ঞানী লেখকদের বই নিয়ে হুজুগে মাতামাতি দেখি অথচ "শীতে উপেক্ষিতা"র মতো সাহিত্যকর্মগুলো পাঠকদের অগোচরেই রয়ে যায় যা দেখে সত্যিই মর্মাহত হই।
কতিপয় সাংবাদিকের গদ্য অতি স্বাদু। স্বাদু হলেও গভীর। তাদের লেখায় অতি সাধারন গল্পও তাই অসাধারন মনে হয়। এলোমেলো কথাও জুড়ে বসে মোহ তৈরী করে।
রঞ্জন নামে পরিচিত নিরঞ্জন মজুমদারের লেখাও তেমনি। 'শীতে উপেক্ষিতা' দ্বারাই তিনি সমধিক পরিচিত। ছুটিতে দার্জিলিং যাত্রা নিয়ে লেখা বইটিকে প্রথমে ভ্রমণকাহিনী মনে হলেও আসলে তা নয়। লেখকের দার্জিলিং ভ্রমণ, ভ্রমণে ঘটে যাওয়া ঘটনা আর লেখকের চিন্তা, দর্শনের মিশেলে, চমৎকার এক বই।
যারা স্বাদু গদ্যের স্বাদ নিতে চান, তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্যা।
*তবে রঞ্জন বাবু অতি মাত্রায় টিপিক্যাল ভারতীয়। বইটা পড়তে গিয়ে এক জায়গায় চোখ আঁটকে যায়, যেখানে তিনি জিন্নাহকে ভারত ভাগের দোষে অভিযুক্ত করলেন। অদ্ভুত! কেবল জিন্নাহ কেন দায়ি হবে?
মানুষ চায় হাওয়া বদল করতে লেখক করতে চান মন বদল। জানুয়ারির প্রহেলিকাময় শীতাতুরা দার্জিলিং জীবনের অন্য একটা দরোজা খুলে দেয় তাঁর সামনে, লেখকের হাত ধরে সেই মায়াবী দুয়ারে হেঁটে যাওয়া রোমাঞ্চ আর বিষণ্ণতার যুগলবন্দির অদ্ভুত এক যাত্রা। বেশ কিছু লাইন বাঁধিয়ে রাখার মতোই।
[ শীতে উপেক্ষিতা, রঞ্জন (নিরঞ্জন মজুমদার), নিউ এজ, ১২৫ টাকা]
সময়টা ১৯৪৮ সাল, জানুয়ারির মাঝামাঝি। দেশ সবে সবে স্বাধীনতা লাভ করেছে, দেশের আপামর মানুষ তাদের সবালকত্বের প্রবল দাবী তুলে নিজের ভাগ্যখানির ভবিতব্য নিজেরাই ঠিক করব বলে স্থির করেছেন। নুতন এ স্বাধীনতা যে জীবনের আর পাঁচটা ইচ্ছেমত কাজ করার স্বাধীনতা, কেবল তাই নয়, এ দেশের মানুষের জন্য তা ভাবনা-চিন্তা, নুতন ও ব্যাতিক্রমের চর্চার স্বাধীনতাও বটে। কিন্তু মনের ভাবনাচিন্তার এই স্বাধীনতার সুযোগে কিছু অসূয়াগ্রস্থ বিকার পীড়িত ���নও আছে, যারা অনায়াসে লিপ্ত হয়ে পড়েছে পরস্পরের সাথে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার রক্তক্ষয়ী বিষম চর্চায়! চতুর্দিকে, রাজ্যে রাজ্যে মানুষে মানুষে বৈরীতার এই প্রতিযোগতার মধ্যে একলা কেবল এক নগ্ন অসমর্থ বুড়ো সাইত্রিশ কোটির দেশে হাতজোড় করে পথ হেটে চলেছেন শান্তির আবেদন জানিয়ে, গুনগুন করে তিনি ঈশ্বরের কাছেও আবেদন রাখছেন, হে রঘুপতি রাজারাম, সবকো সম্মতি দে ভগবান!
এমনি এক সময়ে রঞ্জন চেপে বসেছেন রাতের ট্রেনে, গন্তব্য তার দার্জিলিং! একটা আস্ত জনপদ, একটা গোটা শহরের সমস্ত কোলাহল ও আর্তনাদের কনসার্টকে পেছনে ফেলে, তার সমস্ত পরিচয়ের বিড়ম্বনা ও পরিচিতের উষ্ণতাকে নীরবে বিদায় জানিয়ে একলা লেখক চলেছেন এক অজানার সাথে পরিচয়ের ইচ্ছেয়। দৈনন্দিন মধ্যবিত্ততায় সংপৃক্ত, দশটা পাঁচটার শৃঙখলায়িত জীবনের দাসত্ব থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েই একছুটে চলেছেন অপরিচিত কুয়াশায় আচ্ছন্ন শৈলশহরে পথে। পরিচিত কে এড়িয়ে চলবার সাধনায় অপরিচিতের সান্নিধ্যে যাওয়া। তার গন্তব্য জেনে, সকলেই একবাক্যে সমস্বরে জানিয়েছেন যে শীতকালে পার্বত্য পাদদেশের এ দেশে এহেন সফর সুখকর নয়! সকলেই এ যাত্রায় তার বাদ সেধেছেন (কেবল যার বারনের আশায় ছিলেন লেখক, সেই কেবল উচ্চবাচ্য করেননি!) কিন্তু লেখক ছুটে চলেছেন সে অপরিচিতের আমন্ত্রনে।
পরিচিতের সাথে নিত্য আলাপে যে মালিন্য জমে, অপরিচিতের সাথে নুতন আলাপে সে ভয় থাকে না। পরিচিতের সাথে আলাপে নুতন কিছুর চর্চার অবকাশ তো থাকেই না, বরং পরনিন্দা ও পরচর্চার পলিকর্দমে মন অহরহ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। নুতনের সাথে নুতন আলাপে বরং অপরের সাথে সাথে নিজেরও উন্মেষের সুযোগ হয়। নুতনের সাথে সখ্যে যে কেবল অনাস্বাদিত মাধুর্যই লাভ হয়, তা নয়, সাথে নিজেস্ব ভাবনা চিন্তার আয়তন ও পরিধিরও বিস্তার লাভ হয়। অপরিচিতের সান্নিধ্যে তাই নিজেকে একরকম নুতন ভাবে চেনা যায়। সাহস করে তাই বলাই চলে যে নির্দিষ্ট-অনির্দিষ্ট সমস্ত সফরই আসলে তাই নিজেকেই খুঁজে ফেরার একান্ত গোপন সফরনামা।
স্বল্প কয়েক দিনের এই সফরে, রঞ্জন যে কেবল এই কুয়াশাচ্ছাদিত, স্বল্পালোকিত ছায়া-জটাজালে ঢাকা ধ্যানমগ্ন মন্দ্র ও শুভ্র শৈলশ্রেণী বেষ্টিত প্রাচীন আদিম ঘুমসিক্ত এই শহরের সাথেই নিভৃত আলাপ সেরেছেন তা নয়, তার সর্পিল পথের আকেবাঁকে সাথে লেখকের সাথে আলাপ হয়েছে দু-চারজনের মানুষেরও, এমনকি, দেখা হয়ে গেছে তার পুরাতন প্রেমিকার সাথেও! বৃদ্ধ আর্থার কলিন, যার স্ত্রী শুয়ে আছেন এই পার্বত্যভূমি তে; লজ মালকিন মিসেস রায়, যার পরিচয় আচ্ছন্ন যেন এক রহস্যে; নেপালি ওই ভদ্রলোক, যিনি মিলারেপার মত বোধিসত্ত্ব অর্জনের ইচ্ছে নিয়ে যাত্রা করবেন অজ্ঞাত ওই তুষারাবৃত হিমালয়ের দুর্গম পথে; এদের সকলেই যেন আমাদের চিরাচরিত মানুষী সম্পর্কগুলিকে, দুনিয়া ও জীবনের প্রতি আমাদের ক্লিন্ন ক্লিশে ভাবনা চিন্তাগুলিকে আর একবার নুতন করে দেখবার অবকাশ দেয়। লেখকের লেখনীতে গল্প, ইতিহাস, জীবনদর্শন, রাজনীতি, ব্যাক্তিগত কিছু ভাবনা, সবকিছু কেমন আশ্চর্য ভাবে মিলেমিশে গেছে শীতার্ত রিক্ত জনহীন এই ধূসরক্লান্ত শহরের আবহাওয়ায়।
কিন্তু, জীবনের সবকিছুর মতই সব আসা-যাওয়াও একদিন স্তব্ধ হয়। সফর ফুরালে, ঘরের ফেরার সময় হয়ে এলে পরিযায়ী ফিরে চলে যে যার নিকেতনে, আর মেয়াদ ফুরালে জীবন ফিরে যায় অনন্তের কাছে। এই সফর, এই কাহিনী, এই বইও সেরকম শেষ হয় লেখকের ঘরে ফেরার তোড়জোড়ে, আর শেষ হয় মহাত্মার আকস্মিক নিধনের সংবাদে, তার অন্ত্যেষ্টির ব্যাথাচ্ছন্ন দিনে! সে দিন ৩১ সে জানুয়ারি, সাল ১৯৪৮।
বইয়ের নাম শুনে মনে করেছিলাম ভ্রমণকাহিনী। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। যদিও দার্জিলিংকে স্থান হিসেবে রেখেই বইটি লিখা হয়েছে, তবে এতে উঠে এসেছে আরো কিছু তথ্য। দার্জিলিং এর শুরুর কথা, নেপালী সেই শিষ্যের কথা (যিনি তিব্বত রওনা করেছেন) এবং শেষে গান্ধীজির মৃত্যু। ব্যক্তিগতভাবে রঞ্জনের লেখনী বেশ পছন্দ হয়েছে।
এ বই ভ্রমন কাহিনী নয়। আত্নজীবনীও নয়। স্মৃতিচারণ বা স্মৃতিতে ভ্রমন। কিন্তু এর শব্দে বাক্যে এমন কিছু আছে যা হৃদয় আলোড়িত করে। কিছু বাক্য তো মনে হয় আমারই কথা, একথাগুলোই আমার মন ও মগজে এলোমেলো ভাবে ছিল। লেখন যেন সে কথা গুলো তুলে এনে লিখে রেখেছেন শুধু আমারই জন্য।
শীতে উপেক্ষিতা একটি ভ্রমণ কাহিনী কিন্তু আর বাকি পাঁচটা ভ্রমণ কাহিনীর থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা। লেখক এখানে ঘুরতে ঘুরতে শুধু মাত্র জায়গার বর্ণনা যে দিয়েছেন তা নয়, সঙ্গে আরো অনেক বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। লেখক অর্থাৎ রঞ্জন (নিরঞ্জন মজুমদার) মূলত তার দার্জিলিং ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা এতে বলেছেন। গল্প বলার মাধ্যমে যেমন নিজের মানসিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্টের অবতারণা করেছেন তেমনই তার চলার পথে যাদের সাথে পরিচয় হয়েছে তাদের জীবনের আশা এবং হতাশাও এই লেখায় স্থান পেয়েছে। লেখক এই উপন্যাসটির সময়কাল ১৯৪৮ সাল রেখেছেন। ভারতের স্বাধীনতা থেকে গান্ধীজির হত্যা - এসব কিছুই স্থান পেয়েছে এই বইতে। বিভিন্ন চরিত্র এই রচনায় এসেছে - একজন চাকরিহীন ইংরেজ থেকে একজন স্বামী-পরিত্যক্তা নারী। এদের সবার বক্তব্য, সমস্যা এবং জীবন শৈলীর কথা তিনি এখানে তুলে ধরছেন। কিন্তু আমার যেটি সব থেকে মনে ধরেছে সেটা হলো লেখকের দর্শনের প্রতি ভালোবাসা। বিভিন্ন মুহূর্তগুলিকে তিনি যে ভাবে দর্শনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সেগুলই এই বইটিকে আলাদা করে দেয় বাকি সব ভ্রমণ কাহিনীর থেকে।
নাম: শীতে উপেক্ষিতা লেখক: রঞ্জন প্রকাশনা: নিউ এজ পাবলিশার্স