কিছু গল্প দারুণ, আবার কিছু গল্প অযথা জটিল হওয়ায় উপভোগ করতে পারলাম না। গদ্যে একধরনের বিষণ্ণ সৌন্দর্য আছে বিধায় পড়তে ভালো লাগে। "শেষ পারিজাত" গল্পটার কথা আলাদাভাবে মনে থাকবে।
কিছু লেখা অনেক ছোঁয়। কিছু একেবারেই ছোঁয় না। লক্ষ করে দেখলাম যে লেখাগুলো ছোঁয় সেগুলোর ভিতর কেমন আত্মজৈবনিক ঘ্রাণ। নস্টালজিয়া তো সবারই ভাল্লাগে। সাথে লেখক কোথাও কোথাও ভারতীয় পুরাণের ছোট ছোট ক্যামিও দেন। খারাপ লাগে না।
কয়েকদিন আগে এক রিভিউতে বলেছিলাম কথাটি। আবার বলছি। যেকোন গল্পগ্রন্থ কিংবা গল্প সংকলনের রিভিউ লেখা সহজ নয়। কারণ একই বইয়ে মানের, অনুভুতি সৃষ্টির, মনে আলোড়ন তৈরির ক্ষেত্রে স্টোরিভেদে আকাশ-পাতাল ভিন্নতা বিরাজ করে।
তার উপর এখন লিখছি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের 'রাজহাঁস যেভাবে মাছ হয়'এর রিভিউ।
৬৪ পৃষ্ঠার দুই মোড়কের মাঝে ছোট্ট ছোট্ট ২৩ টি গল্প এঁটে গেছে। নাকি ছড়িয়ে আছে?
নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের নিজস্ব নির্ঝরীয় স্টাইল তো আছেই এসব গল্পে। যারা এ লেখকের নিয়মিত পাঠক তাঁরা জানেন কিংবা ধরতে পারেন 'নির্ঝরীয় স্টাইল'।
কী এই নিঝর্রীয় স্টাইল? বলছি।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য কবিতা, মুক্তগদ্য, প্রবন্ধ, সনেট, অ্যাফোরিজম, আত্মজৈবনিক রচনা করেছেন। সমান্তরালে নির্ঝর একজন আর্টিস্ট এবং প্রচ্ছদশিল্পী। মাল্টিডাইমেনশনাল এই প্রতিভা বই লিখেছেন ২০ টির বেশি।
আগের প্যারায় কেন তাঁর এত পরিচয় দিলাম? কারণ এ ব্যক্তির বহুমাত্রিকতা তাঁর লেখনিতে কখনো কখনো ভীষণ ক্যাওস নিয়ে আসে। এক ধরণের নির্লিপ্ততা হঠাৎ করে ব্যাপক ক্ষ্যাপামি করে আবার সেই নির্লিপ্ত, নিস্তরঙ্গ জায়গায় ফিরে যায় নির্ঝরের স্টোরিটেলিঙে। তবে গল্প শেষে নতুন এই নিস্তরঙ্গতা যেন আগেরটা নয়। বরঞ্চ ভিন্ন মাত্রার।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের গল্পগুলোয় এক ধরণের স্নিগ্ধ টেনশন সৃষ্টি হয় কালেভদ্রে। স্নিগ্ধ টেনশনটা যেন হিরন্ময় অন্ধকার।
লেখকের বেশিরভাগ গল্পে সংলাপ কম, সাবটেক্সট বেশি। আবার এইসব কথার ফাঁকের কথাসমূহ একদম মাথার উপর দিয়ে যায় না। গল্পে চলে আসেন মিথলজির চরিত্ররা, কিংবদন্তি লেখক, কবিগণ। তাদের প্রত্যাবর্তন খুব খুব সহজ স্বাভাবিক লাগে।
মানুষের মধ্যকার ন্যাচারাল প্যারাডক্স ঘুরেফিরে আসে নির্ঝরের গল্পের মাধ্যমে একটি সহজাত ভঙ্গিমায়। গল্পে লেখকের জাদুবাস্তবতা একজন প্রেমিকের জাদুবাস্তবতা। যে প্রেমিক বড় অদ্ভুত। পৃথিবীর সব প্রেমিক অথবা প্রেমিকাই অদ্ভুত।
আমার বেশ ভালো লেগেছে রাজহাঁস যেভাবে মাছ হয়, ল্যাভেন্ডার, হোয়াইট নাইট, হাঙর ও ডাইনিগণ, অন্য মা ও রক্তজবা, শেষ পারিজাত। ২৩ টি গল্পের মাঝে ৬ টি এরকম হওয়াটা অ্যাপ্রিশিয়েট করার মতো ব্যাপার।
বই রিভিউ
নাম : রাজহাঁস যেভাবে মাছ হয় লেখক : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ : নভেম্বর ২০২৩ প্রচ্ছদ : লেখক জনরা : গল্পগ্রন্থ প্রকাশক : চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
“কে তুমি বারান্দার ভাঁজে লুকিয়ে রাখছ ছায়া? ছায়ার হাতে চন্দ্রমল্লিকাটিও ছায়া নয়। কী ভোরে ভরে গেছে আলোর নিবাস? বউচোরা নৌকোর ঝাঁক খালি ফিরে গেছে, ফিরে গেছে। আবার ফিরেনি কোথোও। ঘাটে বাঁধা জলের মতো ঘাটেই অপেক্ষা করে আছে। ছায়ার গানে ধানের গন্ধ লেগে আছে। আমরা ঘরের আগে বুনেছিলাম রোদ। আর রোদের আগে বুনেছিলাম অশ্রু...”
এক বাক্যে বললে এটি ফাটাফাটি রকমের ভালো লেগেছে। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী এবং সম্ভবত লেখকের নিজ জীবনের ছায়ার উপর ভিত্তি করে গড়েছেন কিছু গল্প, আকারে ছোট ছোট গল্প গুলো আঁচড় কাটে খুব। সন্ধ্যার পূর্বে, মৃতপ্রায় সূর্যের আলো যখন কালো হরফগুলোতে ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত, তখন টেনে নেওয়া নিঃশ্বাস চোখের কোণে নোনা পানি রূপে চিকচিক করছিল। নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের অসম্ভব সুন্দর লেখন শৈলীর প্রেমে আমি বারবার ব্যর্থ প্রেমিকের মত হোঁচট খেয়ে পড়তে চাই।
“কে তুমি বারান্দার ভাঁজে লুকিয়ে রাখছ ছায়া? ছায়ার হাতে চন্দ্রমল্লিকাটিও ছায়া নয়। কী ভোরে ভরে গেছে আলোর নিবাস? বউচোরা নৌকোর ঝাঁক খালি ফিরে গেছে, ফিরে গেছে। আবার ফিরেনি কোথোও। ঘাটে বাঁধা জলের মতো ঘাটেই অপেক্ষা করে আছে। ছায়ার গানে ধানের গন্ধ লেগে আছে। আমরা ঘরের আগে বুনেছিলাম রোদ। আর রোদের আগে বুনেছিলাম অশ্রু…”
একটা চন্দনকাঠের বাক্স থেকে কোনো এক দুপুরে নিদ্রা রঙের একটা বই হাতড়ে বের করেছিলাম। বইটার নাম “রাজহাঁস যেভাবে মাছ হয়”। আমি মাছ পছন্দ করি না; তবে তামান্না হাঁস হতে চায়। তাও কেন যেন “মৃত্যু” নামের একটা গল্প পড়তে বসেই টের পেলাম আমিও এমন হিপোক্রেট। কোনো একদিন বৃক্ষভরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানের ফুল চুরি করতে গিয়ে আফরিন বলেছিলো- “এটা ল্যাভেন্ডার”। আমরা বিশ্বাস করিনি। তবে ল্যাভেন্ডারের গল্পটা বিশ্বাস না করলে পাপ হবে। আচ্ছা, আপনারা কি শেষ পারিজাতের ঘটনা জানেন? আমি এর খানিকটা আগে জানতাম। পুরোটা এই গল্পগ্রন্থে পড়েছি। “অনুর দণ্ডকারণ্য” আমার সবচে প্রিয়। কারণ অনুও এমন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আর আমি অনুকে অনেক শাস্তি দিতে চাই। উট তবে পাখি!!! আমরা জানতাম পাখিরা উড়তে পারে। তোমাদের ওখানে পাখিরা কি মাছ হয়ে ভেসে বেড়ায়?? মায়ের হলুদ পরি তবে গেলো কই? আমরাও চমনবাহারের গল্পে মজে গিয়ে একদিন একটা দুতলা বাসে জীবন দেখছিলাম। মাহ্নবির গল্পে বিকেলটা লাল কেন আর সূর্যমুখী হয়ে কেন রাস্তার ঘাম খুঁজলাম৷ কিছুই বুঝতে পারছি না। কি জানি কি হচ্ছে!! রেললাইনেই দাঁড়িয়ে আমি অনেক অনেকবার শাদা রাত মানে আপনাদের হোয়াইট নাইট দেখেছি। ছোটবেলায় হাঙর আর ডাইনির আলাদা গল্প শুনেছি দাদু কিংবা নানুর কাছে। এবার একসাথে পড়ে মনে হলো আমার এরম গল্প ভালো লাগে না। আচ্ছা, “অন্য মা ও রক্তজবা” ‘র গল্প করতে করতে ধূসর রঙটা কি শুধু জীবনকেই দিয়ে দিলেন নাকি? যাকগে, আমার তাতে কি!! আমি তো কচুপাতার বনে বৃষ্টি দেখি সবসময়। সেখানে আমি ছাড়া আরো দুজন থাকে আর তারা গল্প করে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। কি সুন্দর কথা বলে ওরা!! সবশেষে আমার প্রিয় গল্প কিন্তু সন্ধ্যানাদ। আমি এই গল্প অনেকবার পড়েছি এবং পড়বো আরো আরোবার। শেষ তিনটা গল্পও আরো অনেকবার পড়বো। গল্পশেষে গল্পকারের মৃত্যু হলে যখন পরের গল্প আমার জোড়া দেওয়ার কথা ছিল তখন আমি পৃথিবীর ভারে নুইয়ে পড়েছিলাম বলে ঘুমিয়ে গেলাম। এরপর অনেক অনেকদিন ভেবেছি রাজহাঁস কেন মাছ হলো; তখন মনে হলো বিষন্ন সময় ধেয়ে আসছে আর কথা বলা যাবে না৷ তাই আজকে নাহয় শুধুই বইয়ের আলাপটুকুই তুললাম।
লেখক যখন একসাথে অনেককিছুই জানেন এবং করেন তখন আমার মতো কম জানা পাঠকদের জন্য সেটা ভারি হয়ে যায় কখনো কখনো। নির্ঝর নৈঃশব্দ্য একজন চিত্রশিল্পী, লেখক, কবি এবং আরো অনেককিছু হয়তো।
কিছু গল্প খুব সুন্দর আর কিছু গল্প বুঝিনি। বুঝিনি বলতে এই গল্প কেন করা হয়েছে বুঝতে পারিনি কিংবা এই গল্পকার আসলে কি বলতে চাইছে? কেন এসব বলছে? তার মধ্যে কয়েকটা গল্প অনেক ভালো লেগেছে৷