একটি জাতীয়তাবাদের শেকড় দারুণভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এর নিজস্বতার পাঠ খুঁজে পাওয়ার ভেতরে। জাতীয়তাবাদ মানেই নিজস্বতা, নিজেদের পরিচয়, যা মিশে আছে ভু-সংস্কৃতিতে। দুইশ বছরের কলোনি শাসনের পূর্বে কেমন ছিল, নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয়। এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে "ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা" নামক এই বইটিতে। আমরা অনেক সময় বলে থাকি ঔপনিবেশিক প্রভাবের কারণে বংলাদেশের শিল্পকলা সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু, কিভাবে, কেন এবং কি ধরনের উপনিবেশের শিকার আমাদের শিল্পচর্চা তা আমরা জানিনা। জানিনা ইউরোপীয় শিল্পচর্চার সাথে আমাদের চর্চার ফারাক কোথায়; তাই আমরা বলতে সক্ষম হইনা আমাদের বিউপনিবেশায়নের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত। লেখক তার ‘ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা’ বইয়ে এই সকল প্রশ্নসহ বিউপনিবেশায়নের দার্শনিক ও তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান ও নতুন প্রশ্ন উৎথাপন করেছেন। বইটির প্রথম অংশে আলোচিত হয়েছে কিভাবে এ অঞ্চলের শিল্প চর্চার দীর্ঘ ইতিহাস থাকার পরও কিভাবে ব্রিটিশ আমলে উপনিবেশায়নের শিকার হয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় তিনি আলোচনা করেছেন উপনিবেশ এবং উপনিবেশোত্তর পর্বে ইউরোপীয় প্রভাব থেকে বের হয়ে আসার কি ধরনের নজিরও পাওয়া যায়। লেখক হ্যাবেল, কুমারস্বামী, অবনীন্দ্রনাথ এবং সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বইটিতে। একই সাথে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন সুলতান ভাবনা বাংলাদেশের বিউপনিবেশিত নন্দনতত্ত্বেও ভিত্তি হতে পারে।
সৈয়দ নিজার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক। তার দর্শন পাঠ ও চর্চার হাতেখড়ি ঢাকায় থাকা অবস্থায় হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানে তিনি যৌথভাবে স্নাতক। পরবর্তীতে, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে তিনি গাণিতিক যুক্তিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবেরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার গবেষণার বিষয় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন যুক্তিতত্ত্ব ‘চতুষ্কোটি’। সৈয়দ নিজার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। ক্যান্টারবেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ৬ মাস ভিজিটিং স্কলার পদে ছিলেন। তার গবেষণা-কর্ম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বহুমাত্রিক তার গবেষণার বিষয়। তিনি গবেষণা করেছেন যুক্তিবিদ্যা, ভাষাদর্শন, নন্দনতত্ত্ব এবং বিউপনিবেশিত বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে। বিউপনিবেশিত জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণ তার অন্যতম দার্শনিক প্রকল্প । তিনি ‘বিউপনিবেশিত জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণ' প্রকল্পকে একটি আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা করছেন। বিগত কয়েক বছরে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-বিষয়ে তিনি বক্তৃতা করেছেন। ২০১৫-২০১৬ সালে তিনি বাংলাদেশের ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞানের রূপরেখা নিয়ে ‘বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব' শীর্ষক বক্তৃতামালার আয়োজন করেন। ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার গবেষণাগ্রন্থ: 'ভারতশিল্পের বিউপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা' (২০১৭) ও 'বিশ্ববিদ্যালয়: উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন' (২০১৮)।
অজন্তা, ইলোরার গুহাচিত্র, মুঘল পেইন্টিং ও ভাষ্কর্যসহ প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক শিল্পকর্মকে একশ্রেণীর উপনিবেশ প্রভাবিত বুদ্ধিজীবী Art না বলে Craft হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন এজন্য যে তা পশ্চিমের শিল্পকর্ম থেকে ভিন্ন ধরনের । মূলত য়ুরোপীয় শিল্পকে প্রমাণ ধরে ভারতবর্ষীয় শিল্পকে অবমূল্যায়ন করতে এহেন কর্মকান্ডে কতিপয় বৃটিশদের সাথে কিছু উপমহাদেশীও যোগ দিয়েছিলেন হয়ত বুদ্ধিগুণ ঘাটতিতে, নয়ত কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থে (চাকরি, ভাত-কাপড়ের জন্য মূলত) । পৃথিবীর শিল্পের ইতিহাসের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও বিকাশকে গ্রহণ না করে অন্যত্র শিল্পের সাথে তুলনা করার অবিমৃষ্যকারীতা হরহামেশাই ঘটে গেছে সারা দুনিয়ায় উপনিবেশকালে । অথচ দখলদার শাসকবৃন্দ সে সমস্ত 'অমূল্যবান' শিল্পকর্মসমূহকে জাহাজে ভরে পাচার করে নিজেদের জাদুঘরের শোভা বৃদ্ধি করতে কখনো কার্পণ্য করেনি! উপনিবেশিক আরোপিত ভাবধারা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভ্রান্ত কিছু 'বোদ্ধা' তেমনিভাবে সুলতানের বিভিন্ন চিত্রকে অস্ত্রোপচার করে পিছু হটিয়ে নিজ নিজ মতামত ও উদ্দেশ্য চাপিয়ে এক-জাহানের অশেষ মুদ্রা হাসিল করেছিলেন ইতিহাস তাই বলে । আর্টিস্টকে তবু রুদ্ধ করা যায়নি তো! ভারতশিল্পের শেকড় অনুসন্ধানী সুলতান বিভিন্ন সময়ের চিত্রে বারবার হাজির হয়েছেন স্বমহিমায়, আমরা যা নিয়ে আজ বিশ্বজোড়া গর্ব করি । আলোচ্য বইতে রয়েছে লেখক ও গবেষক সৈয়দ নিজার এর গবেষণালব্ধ চিন্তার উন্মোচন যা ইতিহাস থেকে তুলে এনে চিন্তাপদ্ধতির বিচ্যুতির চিহ্নিতকরণ ও নিজস্বতা অনুধাবনে সাহায্য করে । একদিন অবশ্যপাঠ্য হবে এই বই গ্যালাক্সিবিদ্যালয়গুলোতে আশা সর্বোচ্চ ।
অনেকদিন আগে স্যারের (সৈয়দ নিজার) একটা সেমিনারে গিয়েছিলাম। স্যারের চিন্তাভাবনা আমার অনেক ভালো লেগেছিল এবং পরবর্তীতে আমাদের ডিপার্টমেন্টএর লাইব্রেরিতে স্যারের এই বইটা খুঁজে পাই। সুলতান নিয়ে আগ্রহ সেই প্রথম বর্ষ থেকে এরপর আহমদ ছফার প্রবন্ধ সে আগ্রহ যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে অতঃপর আমি এসে পৌছালাম এই বইয়ের কাছে। এটা যদিও শুধু সুলতানের চিত্রকর্মের বিউপনিবেশায়ন বিশ্লেষণ না, বইটা একই সঙ্গে সম্পূর্ণ ভারতশিল্পকেই উপনিবেশায়ন ও বিউপনিবেশায়ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাখ্যা করে। মাঝে মাঝেই লেখক বহির্বিশ্বের, বিশেষত পাশ্চাত্য নানান চিত্রকর্মের বিপরীতে ভারতশিল্পকে ফেলে করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। একই পদ্ধতিতে দেখিয়েছেন সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনার বিস্তার।
উপনিবেশায়ন তো শুধুই উপনিবেশকের শারীরিক উপস্থিতিতে সীমাবদ্ধ না। তার প্রভাব পরে উপনিবেশিতের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। জাতি হিসেবে তাকে/ তাদের বানিয়ে ফেলে পরিচয়হীন অনুকরনপ্রিয় জাতিতে। তার চিন্তা-চেতনা, ভাব, ভালোবাসা, ঘৃণা, শিল্প, সাহিত্য, জীবনদর্শন সব কিছুই প্রভাবিত হয় তার উপনিবেশায়ন অভিজ্ঞতা ও হেজিমনির দ্বারা। যার নিদর্শন ভারতশিল্পে অসংখ্য রয়েছে। তবে জাতি হিসেবে এখানে থেমে থাকলে আমরা হয়ে উঠবো আত্মপরিচয়হীন। এজন্যই যুগে যুগে শিল্পীরা চেষ্টা করেছেন উপনিবেশায়নের বেড়াজাল ভেঙে বের হতে। যদিও সকলে সফল হননি তবুও বেড়াজাল উপলব্ধিও কম অর্জন নয়। এক্ষেত্রে বাঙালি শিল্পীদের মধ্যে এস. এম. সুলতানের নাম উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তিনি তার শিল্পরীতি, অঙ্কনরীতি, উপকরণ, বিষয়ী দিয়ে চিত্রশিল্পে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। তার হাতেই বিউপনিবেশায়নের যাত্রা শুরু হয়েছে। এই বইটা যেন এস. এম. সুলতান সহ সমগ্র ভারতশিল্পকেই নতুন করে খুঁজে পাওয়া।