বরিশালের নদী, জোনাকি ছেড়ে তাঁকে পা রাখতে হয়েছে আদিম সাপের মত ছড়িয়ে থাকা কলকাতার ট্রামলাইনের ওপর। পৃথিবীর দিকে তিনি তাকিয়েছেন বিপন্ন বিস্ময়ে। বলেছেন সন্ধ্যার সব নদী ঘরে ফিরলে থাকে অন্ধকার এবং মুখোমুখি বসবার নাটোরের এক নারী। জানিয়ে দিয়েছেন জ্যোৎস্নায় ঘাইহরিণীর ডাকে ছুটে আসা, শিকারীর গুলিতে নিহত হরিণের মত আমরা সবাই। সস্তা বোর্ডিংয়ে উপার্জনহীনভাবে দিনের পর দিন কুঁচো চিংড়ি খেয়ে থেকেছেন। তবু পশ্চিমের মেঘে দেখেছেন সোনার সিংহ। পিঁপড়ার মত গুটি গুটি অক্ষরে হাজার হাজার পৃষ্ঠা ভরেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ডায়েরি লিখে। সেগুলোর সামান্য শুধু জনসমক্ষে এনেছেন জাদুকরের রুমালের মত, বাকিটা গোপনে তালাবন্দী করে রেখেছেন কালো ট্রাঙ্কে।
বাংলা সাহিত্যের প্রহেলিকাময় এই মানুষ জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে এক নিবিড় বোঝাপড়ায় লিপ্ত হয়েছেন এ সময়ের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তাঁর একজন কমলালেবু উপন্যাসে।
Shahaduz Zaman (Bangla: শাহাদুজ্জামান) is a Medical Anthropologist, currently working with Newcastle University, UK. He writes short stories, novels, and non-fiction. He has published 25 books, and his debut collection ‘Koyekti Bihbol Galpa’ won the Mowla Brothers Literary Award in 1996. He also won Bangla Academy Literary Award in 2016.
এক ঘোর লাগা বিষণ্নতা নিয়ে শেষ করলাম প্রিয় লেখক শাহাদুজ্জামানের ( Shahaduz Zaman ) একজন কমলা লেবু। জীবনানন্দ দাশকে চিনতাম শুধু তার কবিতা দিয়ে, জানতাম শাহাদুজ্জামানের মতই আরেকজন চিকিৎক ভূমেন্দ্র গুহ তাকে নিয়ে করেছেন গবেষণা, তার ব্যক্তিজীবন জানতে চেয়েছেন। গতবার বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে ভূমেন্দ্র গূহর কাজ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে দাওয়াতও পেয়েছিলাম কিন্তু যাওয়া হয়নি শেষমেশ। তাই জীবনানন্দ সম্পর্কে তার জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা আমার তেমন কিছু ছিল না। খণ্ড খণ্ড ফিচার টিচার থেকে জানতাম লোকটা ট্রামে চাপা পড়ে মৃত্যবরণ করেছে, কেউ ধারণা করেছে হতে পারে সেটা আত্মাহূতি, জানতাম লোকটা লিখেছেন ঠিক তার প্রজন্মের জন্য নয়, অনেক পরের প্রজন্ম ঠিক যেন আমাদের সময়ের জন্য, তাই নিজ সময়ে তিনি খুব একটা মূল্য পাননি। এও জানতাম বহু প্রতিভাবান সাহিত্যিকের মত তিনিও দারিদ্র্যক্লিষ্ট ছিলেন, পারিবারিক জীবন তার শান্তির ছিল না। কিন্তু জানতাম না কবি শামসুর রহমান যেদিন তার সাথে দেখা করতে গেলেন সেদিন বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতম কবির বাড়িতে বসানোর মত ভাল কোন আসবাব ছিল না। জানতাম না চাকরির জন্য হন্যে হয়ে তিনি তারই এক ছাত্রকে যে একটি কলেজের শিক্ষক, তাকে বললেন তারই কলেজের কোন চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কিনা এবং অনুরোধ করলেন-চাকরি যদি হয় তাহলে তার বেতনটা যেন অন্তত একটাকা হলেও বেশি রাখা হয় ওই ছাত্রের তুলনায়- কেননা তিনি এককালে তার শিক্ষক ছিলেন। অর্থকষ্টে জর্জরিত হয়ে তিনি দেশ পত্রিকায় তার কিছু কবিতা নিয়ে গিয়েছিলেন অগ্রীম টাকার জন্য, এবং পত্রিকার সম্পাদক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কিছুটা অবহেলা করেই- একসময়ে প্রচণ্ড আত্মতুষ্ট কবি অর্থকষ্টে ন্যুজ্ব হয়ে সেই অপমানও নীরবে মেনে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। শাহাদুজ্জামান জীবনান্দের নানা মোড় আলোচনা করে তার বিখ্যাত অনেকগুলো কবিতার প্রসংঙ্গও পাঠককে ধরিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। যে মুগ্ধতা নিয়ে মাঝেমধ্যেই পাঠ করেছি ক্যাম্পে কবিতাটি বা আটবছর আগে কবিতাটি, সেসব কবিতার প্রসঙ্গ, কবি জীবনের ঠিক কোন পর্যায়ে এসব কবিতা লিখেছেন সেটা নতুন করে জেনেছি, বুঝতে পেরেছি কিছু কিছু বাক্য এতদিন যে অর্থ জেনেছি তা হয়তো সঠিক ছিল না। সবমিলিয়ে জীবনানন্দকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম, আবিষ্কারের পথটা বেশ ভারী আর বেদনাদায়কও ছিল, মাঝে মাঝেই পড়তে পড়তে আমি আহত হয়েছি, ক্রুদ্ধ হয়েছি, কোথাও কোথাও চোখ বাষ্পরুদ্ধ হয়েছে। আবার যেন ফিরে আসি কোন এক শীতের রাতে একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে কোন এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানার কিনারে। কবির এই আকাঙ্খাকে আমলে নিয়েই বইয়ের এ নামকরণ সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। সবমিলিয়ে একজন কমলালেবু একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ আমার জন্য। নানা ভাবে নানা কারনে। *মহীনের ঘোড়াগুলি নিয়ে অন্য একটি ব্যাখ্যা পড়েছিলাম এ বইতে ব্যাখ্যাটা ভিন্ন কিছুটা *বনলতা সেন কবিতাটি নিয়ে লেখক খুব বেশি ঘাঁটেননি, হয়তো এজন্যই যে ইতিমধ্যে এটা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা-লেখালেখি হয়ে গেছে
জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি।তাকে নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি।শাহাদুজ্জামান জীবনানন্দকে নিয়ে লিখেছেন "একজন কমলালেবু।" কোন জীবনানন্দ? যাকে বলা হয়"শুদ্ধতম কবি" আর লেখকের ভাষায় ব্যক্তিজীবনে যিনি ছিলেন "বিশুদ্ধভাবে ব্যর্থ " সেই জীবনানন্দকে নিয়ে এই বই। শ্রেষ্ঠ আধুনিক বাংলা কবি হিসেবে তিনি এখন সর্বজনস্বীকৃত অথচ বেঁচে থাকতে প্রাপ্য সম্মান পাননি। সংসারজীবনেও ছিলেন চরমভাবে অসুখী। একদিকে লেখার জন্য ক্রমাগত সমালোচনায় বিদ্ধ, অন্যদিকে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি -এই দুইয়ের টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত এক কবির জীবনচিত্র "একজন কমলালেবু।"
এই বইয়ের সবচেয়ে যা ভালো লেগেছে তা হলো - সাহিত্যিক জীবনানন্দ আর মানুষ জীবনানন্দ সমভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। তার কবিতা বুঝতে, তার চিন্তা চেতনার গভীরতা বুঝতে,তার দগ্ধ সময়কে বুঝতে, তার "বিপন্ন বিস্ময়" কে বুঝতে এই প্রামাণ্য উপন্যাস অবশ্যপাঠ্য হবে ভবিষ্যতে।
"একজন কমলালেবু " নামটার মধ্যে একটা উপন্যাস উপন্যাস গন্ধ আছে। জীবনানন্দকে নিয়ে যা কিছু নিবন্ধ-প্রবন্ধ পড়া ছিল, সেগুলোর সঙ্গে এই নামটা ঠিক যেন যায় না। আগে থেকেই জানতাম, শাহাদুজ্জামান জীবনানন্দকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখছেন। সেটার জন্য লেখকের দীর্ঘপ্রস্তুতি ছিল, সেই আভাসও পেয়েছি। বইয়ের ফ্ল্যাপেও স্পষ্ট করেই উপন্যাসই বলা আছে। কিন্তু বইটা প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে কি না পারেনি, শাহাদুজ্জামানের অন্য কাজের তুলনায় কতটা উৎরে গেছে বা যায়নি, এসব আলাপ আসলে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ বইটা যে আদতে উপন্যাসই নয়।
বইটার শুরুই হয়েছে জীবনানন্দের সেই অন্তিম দৃশ্য দিয়ে। প্রথম দুই পৃষ্ঠাতেই লেখক মৃত্যুদৃশ্য নিয়ে বেশ একটা জমাট সাসপেন্স তৈরি করে ফেলেন। এরপরেই শুরু হয় জীবনানন্দের শৈশব থেকে একমুখী যাত্রার। জীবনানন্দের বেড়ে ওঠা, মা কুসুমকুমারী দেবীর প্রভাব, প্রথম প্রেম, কবিতার সঙ্গে প্রথম গাটছঁড়া... এসব লেখক বলে গেছেন ধ্যানীর মতো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম, বইটা আসলে ঠিক উপন্যাস হতে পারছে না। ক্রাচের কর্নেলকে লেখক বলেছিলেন ডকুফিকশন হিসেবে, সেখানেও চরিত্রগুলোর মধ্যে কিছু সংলাপ, মিথস্ক্রিয়া, কিছুটা গ্রে এরিয়া ছিল। কিন্তু এই বইতে লেখক অনেকটা গবেষণাপত্রের মতো করে আউড়ে গেছেন জীবনানন্দের কালসীমা।
একটা সময় সেটি আসলে হয়ে উঠেছে জীবনানন্দের সৃষ্টিসুখের প্রেক্ষাপট মেলানোর একটা খেরোখাতা। লেখক জীবনানন্দের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত প্রায় সবকিছুই বেশ ভালোমতই হৃদয়ঙ্গম করেছেন, জীবনানন্দ কোন পরিস্থিতিতে কেন কোন কবিতা বা গল্প লিখেছেন, সেটারও একটা প্রায় স্পষ্ট ছবি এঁকেছেন। কিন্তু সেই বর্ণনায় আমি গবেষক শাহাদুজ্জামানকে খুঁজে পাই, লেখক বা গল্পকার শাহাদুজ্জামানকে সেখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সেখানে যতটা গবেষকের মননশীলতা আছে, লেখকের সৃষ্টিশীলতার অভাব ততটাই যেন প্রকট। একটা সময় গিয়ে মনে হয়েছে, লেখক জীবনানন্দে এতোটাই বুঁদ হয়ে ছিলেন, অন্য চরিত্রগুলোও একটু একটু করে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। লেখাটা তখন আরও বেশি নিবন্ধ হয়ে উঠেছে। ক্রাচের কর্নেলে লুৎফা যতটা শক্তিশালী ছিল, এখানে লাবণ্য বা শোভনা যেন ততটাই দুর্বল। তারপরও ক্রাচের কর্নেলকে কিন্তু ডকুফিকশনই বলা হয়েছে, সেই হিসেবে এই বইটা ফিকশন বললে আমার অন্তত ঘোরতর আপত্তি আছে।
তারপরও বইটা একটানেই পড়ে ফেলা যায়। কখনো কখনো বিষাদের অতলান্তেও ডুব দেওয়া যায়। জীবনানন্দকে নতুনভাবে জানার জন্য, চেনার জন্য এই বইটা ভালো একটা উপলক্ষও বটে। লেখক শাহাদুজ্জামানকে না দিই, গবেষক শাহাদুজ্জামানের সেজন্য একটা ধন্যবাদ অবশ্যই পাওনা।
কবিতা আমি পড়ি না বললেই চলে। মাঝে মাঝে দুই একজন এটা সেটা ধরে বেঁধে পড়তে দেয়, তখন হয়ত পড়ি। কখনো ভালো লাগে, কখনো লাগে না। কখনো বুঝি, কখনো বুঝি না। তাহলে কেন জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে উপন্যাস পড়ছি? একটি কারণ হাইপ, একটি কারণ কয়দিন আগে ওনার কিছু কবিতা ভালো লেগেছে আর একটি কারণ বইয়ের লেখক।
জীবনানন্দ দাশ নিঃসঙ্গতার কবি, নির্জনতার কবি। কেন ওনাকে এইভাবে ডাকা হয় এই বই পড়ে কিছুটা বুঝলাম। ওনাকে বুঝতে পারে এমন কেউ আসলেই ছিল না। উনি জনতার মাঝে থেকেও ছিলেন নিঃসঙ্গ। দুই একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন মাত্র। কিন্তু তাই তো সব নয়। এমন কেউ ছিল না যার সাথে বসে তিনি জীবন নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন। মনের কথা ব্যক্ত করতে পারতেন। এই অবস্থায় যারা পড়েন তারা ভালোভাবেই বুঝতে পারবেন কবি কত একা ছিলেন। নিজেকে মানুষের কাছে সঁপে দিতে চেয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। কিন্তু মানুষ তার সময়ে তাকে গ্রহণ করে নি। এই কবিতা লিখতে গিয়েই সইতে হয়েছে নানা অপমান। নিজের পক্ষে কিছু বলার মত মানুষ ছিলেন না। বন্ধু সজ্জন কয়জন বা ছিলেন তার হয়ে কথা বলতেন। এমনই একা ছিলেন তিনি।
বইটিতে আছে কিছু কবিতার ব্যাখ্যা যা আমার মত অবুঝ পাঠকদের জন্য সহায়ক ছিল। আরও আছে ওনার ডায়রি থেকে তুলে দেয়া কিছু অংশ, উপন্যাসের হালকা বিশ্লেষণ। যারা জীবনানন্দ দাশকে ভালোবাসেন তাদের ভালো লাগবে আশা করা যায়। তারপরও মনে হল আরও ভালভাবে বুঝতে হলে বা ওনার সম্পর্কে আরও জানতে হলে ওনার লিখা উপন্যাসগুলো পড়া উচিত যেগুলোতে উনি নিজেই নিজের জীবনের ছাপ রেখে গেছেন।
বইটি নিয়ে প্রায় সবার অভিযোগ এটিকে উপন্যাস বলা হলেও আসলে উপন্যাস না। আমারও একই অভিযোগ। কেন এটিকে উপন্যাস হিসাবে চালানো হচ্ছে আমি জানি না। উপন্যাস বলে আমার মত পাঠকদের অনেক আশা জাগাবার পর কিরকম একটু হতাশ হতে হয়।
‘একজন কমলালেবু’ বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রহেলিকাময় কবির জীবনের এক অপূর্ব আখ্যান। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব বেশি না, বছরে বছরে পত্রপত্রিকার লেখা আর কিছু কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। একসময় আবৃত্তি শেখার কারণে বাংলার মুখ পড়া হয়েছিলো। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, কবিতায় কবি তার চিরচেনা পল্লবের, হিজল-কাঠাল-অশ্বত্থ গাছে বাংলার রূপকে দেখেছিলেন মনসামঙ্গলের চাঁদ সওদাগর মধুকর ডিঙা, লক্ষিন্দরের সর্পদংশনে নীল হওয়া শববাহী ভেলা ও ইন্দ্রের সভায় বেহুলার রক্তিম খঞ্জনার গল্পের এক অদ্ভুত দৃষ্টিকোণের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বইয়ে, ফিচারে, লেখায় বহু জায়গায় পড়েছি এই অদ্বিতীয় কবির বিভিন্ন কবিতা, কবি জীবনানন্দের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে জেনেছি কিছুটা। কিন্তু জীবনানন্দ, তার জীবন অথবা তার কবিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ কোন বই পড়া হয়নি, বেশি গম্ভীর কথাবার্তার ভয়েই হয়তো। তাই এই রহস্যময় কবির যাপিত জীবন, কাব্যজীবন আর মৃত্যু সম্পর্কে এতকাল ভাসা ভাসা ধারণাই ছিলো । সে অজ্ঞানতা দূর হয়েছে প্রিয় কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের উপন্যাস ( ? ) 'একজন কমলালেবুর মধ্য দিয়ে। জীবনানন্দ দাশের নামটা বোধহয় প্রকৃতির সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রহসন। পৃথিবী আর কুটিল সমাজের পাটাতনে পিষ্ট এক ভীষণ অপ্রস্তুত জীব যেন তিনি, যার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো নিজস্ব নির্জনতা খুঁজে নিয়ে একটু শান্তিতে দুকলম লিখতে পারার। সে সুযোগ তো হয়ই নি, উপরন্তু সাহিত্যসমাজ, কর্মক্ষেত্র ও এমনকি নিজ পরিবারের কাছেও নিগৃহীত হয়েছেন বারবার। কিন্তু তাও থামিয়ে জাননি লেখালেখি, অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, জার্নালে একেক রূপে প্রকাশ করেছেন তার মনের একান্ত অব্যাক্ত ভাবগুলোকে। যদিও তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় এসবের প্রকাশিত হয়েছে খুব সামান্যই, প্রায় সবকিছুই তুতেনখামেনের সমাধির মতো আবিষ্কৃত হয়েছে তার মৃত্যুর বহুবছর পরে। সমাজঅঙ্গনে অপ্রস্তুত হলেও জীবনানন্দ লেখার পাতায় তীব্র আত্মবিশ্বাস ও আত্মতুষ্টির সাথে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। যেসব অল্পসংখ্যক লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো, সে সময়ের সাহিত্যঙ্গনে খুব কমই সমাদৃত হয়েছিলো। তার লেখার জন্য পাগল, মাতালসহ আরও বিভিন্ন মুখরোচক উপাধিও জুটিয়েছিলেন জীবনানন্দ। তারপরও সেসময় একান্তে সৃষ্টি করেছেন বর্তমানে অমরগণ্য হওয়া সব সাহিত্যকর্ম। বিষাদগ্রস্ত জীবনে চাকরির অভাবে পথে পথে হেঁটেছেন বহুবছর, পুরনো প্রেমকে না পাওয়ার নিজস্ব নিঃসংগতা তীব্রভাবে অনুভব করেছেন লম্বা সময় ধরে। একসময় হতাশ হয়ে ভেবেছেন আত্মহুতির পথ বেছে নেওয়ার কথা, তারপর আবার 'অনেক কিছু লেখার বাকি' ভেবে সেই সংসারের একঘেয়ে ঘানি টেনে গেছেন সবসময়ের মতো। লেখক শাহাদুজ্জামান একজন কমলালেবুর মধ্যে জীবনানন্দের এই বিষণ্ণ ব্যাক্তিজীবন তুলে ধরেছেন। তবে সেটা উপন্যাসের আদলে নাকি গবেষণা গ্রন্থের মতো করে, তা নিয়ে বিতর্ক থেকে যায়। বইয়ের শুরুই হয়েছে জীবনানন্দের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এরপর লেখক আমাদের নিয়েগেছেন কবির শৈশবে, আমাদের পরিচয় করিয়েছেন কবির মা, উপমহাদেশের অন্যতম কবি কুসুমকুমারী দাশের সাথে। সেসময় বইটাকে পুরোদস্তুর উপন্যাস মনেহলেও, কিছুদূর পর তা আর বলা যায়না। লেখকের আগের বই ক্রাচের কর্ণেল ডকুফিকশন ছিলো, সেখানে লেখকের জাদুকরি ভাষাশৈলীর মাধ্যমে ইতিহাসের কর্ণেল তাহের, আশরাফুন্নেসা, আনোয়ার, লুৎফা আমাদের কাছে উপন্যাসের জীবন্ত চরিত্র হিসেবেই ধরা দেয়। কিন্তু এই বইয়ে শুরুটা সেভাবে হলেও, কিছুদূর যেতেই তা জীবনানন্দের ব্যাক্তিজীবন নিয়ে মননশীল রচনায় পরিণত হয়েছে বলে মনেহয়। লেখক নিপুণভাবে আমাদের জীবনানন্দের চিন্তাভাবনা, চারিত্রিক বৈশিষ্টের পরিচয় করিয়ে দেন। আমাদের পরিচিত করে তোলেন তার অনেকটা সাংকেতিক ভাষায় লেখা দিনলিপির সাথে। বইয়ে কিছুদূর পরপরই জীবনানন্দের অদ্ভুত প্রহেলিকাময় কবিতাংশ আছে, আছে তার জীবনমুখি উপন্যাস-গল্পের উদ্ধৃতি, যা পাঠককে বাধ্য করবে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে তাদের রূপরস অনুভব করতে। মাঝেমধ্যে কবির পরিচিত একঘেয়ে জীবনে স্বল্পসময়ের জন্য দেখা দেবে সুখ, তা পড়ে আমরা পাঠকরা খানিকটা উদ্বেলিত হবো, আবার সে সুখের পাতা ফুরিয়ে শুরু হবে বিষণ্ণতার ফিরিস্তি। শাহাদুজ্জামান কবি জীবনানন্দের জীবনের সেই বিষাদের পদাবলীর সাথেই পাঠকদের একাত্ম করেছেন এই বইয়ে। তিনি জীবনানন্দের নিরীহ জীবনের কিছু চড়াই-উৎরাই শেষে একসময় এক অদ্ভুত বিষণ্ণতার মাঝে ইতি টানবেন বইয়ের। পাঠক হিসেবে আমি মুগ্ধ হয়ে এই বই থেকে যেন জীবনানন্দের জীবন্ত জীবনপাঠ নিয়েছি, অদ্ভুত বিষাদের আনন্দ পেয়েছি তার শাহাদুজ্জামানের লেখায়।
যেমনটা কবি জীবনানন্দ দাশ নিজেই বলেছেন, 'অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ।'
তখন নবম শ্রেণীতে। স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, যেখানে প্রতি ক্লাসের ভালো ছাত্র আর ক্রীড়াবিদদের থালা-বাটি-বই পুরস্কার দেওয়া হয়। আমি সেই ভালো ছাত্র আর ক্রীড়াবিদ - কোন দলেই পড়তাম না, তবুও প্রতিবছরই পুরস্কার বিতরণীতে থাকতাম। কারণ সেখানে সবাইকে অর্ধেকটা ফুলকলির চিকেন বন দেওয়া হতো। স্কুলের ছাত্রদের কাছে কামাল ভাইয়ের চিকেন বনই ছিলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবারের একটা, তাই ফুলকলির চিকেন বনের লোভ সামলানো কতটা কঠিন ছিলো তা বলাই বাহুল্য।
সে দিনও যথারী��ি চিকেন বন খাওয়ার উদ্দেশ্যে স্কুলে গেলাম। গিয়ে শোনা গেলো পরীক্ষাবিদ আর ক্রীড়াবিদদের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ ছাত্র নামে আরেকটা পুরস্কার দেওয়া হবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভোটে। আমি ছিলাম তৎকালীন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ডে শিফটের অর্ধশতাধিক স্যার-ম্যাডামের লিটারেলি সবার কাছ থেকে মাইর খাওয়া (মার খাওয়া দিয়ে ঠিক বোঝানো যাচ্ছে না) ছাত্র। দীর্ঘ তিন বছর ধরে মাইর খেয়ে খেয়ে তাঁদের সাথে গড়ে উঠেছিলো এক সুগভীর মাইরঘটিত আত্মিক হৃদ্যতার সম্পর্ক। তার উপর শ্রেষ্ঠছাত্র নির্বাচন কমিটিতে ছিলেন এক স্যার যার কাছ থেকে ক্লাস এইটে সম্পূর্ণ এক পিরিয়ড ধরে মাইর খেয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এক নতুন স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেদিন ফুলকলির চিকেন বনের পাশাপাশি আমার কাছে শ্রেষ্ঠ ছাত্রের পুরস্কারও জুটে গেলো।
বোঝাই যাচ্ছে, পুরস্কার ছিলো জীবনদার কবিতাসমগ্র। ���ুলকলির চিকেনবন পেটে থাকা সত্ত্বেও এত হতাশ জীবনে এর আগে খুব কমই হয়েছি। তাও বই খুলে ভাবলাম আচ্ছা দেখি কবিতা পড়ে কী লিখতে চাইলো জীবনদা। খুলে তো আরো হতাশ। মিল নাই, অর্থ নাই, কিছু নাই, এইসব কেমনতর কবিতা! অনেকের সাথে চেষ্টা করলাম বই অদল-বদল করার, কেউ রাজী হলো না। এমনকি থালা-বাটি বিজয়ীদের সাথে অদলবদলের চেষ্টা করার চিন্তাও মাথায় উঁকি দিচ্ছিলো। কিন্তু বই সে তো মিল ছাড়া কবিতার বই হলেও বইই। নবম শ্রেণীর একজন বিদগ্ধ সুনাগরিক হিসেবে বুদ্ধি, বিবেক এবং আত্মসংযম ব্যবহার করে থালাবাটির সাথে বই বিনিময় না করে বাসায় ফিরে আসলাম। কিন্তু জীবনদার সাথে সম্পর্ক আর বেশিদূর আগালো না। কয়েকদিন পরেই বইটা কলেজ শিক্ষক বোনতুতো দাদাকে (দুলাভাই কেমন যেন অশ্লীল শব্দ বলে মনে হয়) দিয়ে দিই।
তখন জীবন ছিলো ফড়িংয়ের-দোয়েলের। ছিলো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, সেখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর ইচ্ছাও ছিলো। তারপর বছর দুয়েকের মধ্যেই কী যেন হয়ে গেলো। অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করা শুরু করলো বিপন্ন বিস্ময়। চারদিকে জীবনের সমুদ্র সফেনে ক্লান্ত হয়ে অত তাড়াতাড়ি কোথাও যাওয়ার ইচ্ছাও চলে গেলো। সেই ফড়িং-দোয়েলের জীবন ছিলো ভালো, খারাপ আর মোটামুটিতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু কখন যেন দৈনন্দিনতার ভালো, খারাপ আর মোটামুটি সময়ের বাইরেও কিছু সময় তৈরি হলো। যে সময়ে হৃদয় জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা বলে। হৃদয় ঘাস হয়ে যাওয়া জীবনের সেইসব সময়ের অংশ হয়ে গেলো জীবনানন্দ দাস।
"আমি অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না ; আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে-হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে, পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে। জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা অন্য সবাই এসে বহন করুক : আমি প্রয়োজন বোধ করি না ; আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে নক্ষত্রের নিচে।"
এই বইটি পড়ার ক্ষেত্রে পাঠকের বইটি পড়ার উদ্দেশ্য কী সেটা ঠিক করে নেওয়া জরুরি। পাঠক কী জীবনানন্দর জীবন পড়তে চায় নাকি শাহাদুজ্জামানকে পড়তে চায়। নাকি পাঠক শাহাদুজ্জামানের চোখে জীবনানন্দকে দেখতে চায়। আমি লেখক শাহাদুজ্জামানের ভক্ত, এতটাই ভক্ত যে তিনি তার চোখে আমাকে যেটাই দেখাবেন আমি সেটাই সানন্দে দেখব, আমি নিশ্চিত তিনি আমাকে এমন কিছু একটা দেখাবেন যেটা আমাকে অবাক করবে। কিন্তু না, এই গ্রন্থে না পাওয়া যায় শাহাদুজ্জামানকে না পাওয়া যায় শাহাদুজ্জামানের চোখ। তার ছোটগল্পগুলো এবং ক্রাচের কর্নেল পড়ে যারা ভক্ত হয়েছে তারা একটু হলেও নিরাশ হবে। আর জীবনানন্দকেও যে পুরোপুরি পাওয়া যায় কিনা তা নিয়েও আমি সন্দিহান। কারণ এ বই পাঠককে স্থির হতে দেয় না, উপন্যাস নাকি জীবনী নাকি এটা ক্রিটিক, এটা ভাবতে ভাবতে বইয়ের অর্ধেক শেষ। এখানে শুধুই সরল ধারাপাতের মতো জীবনানন্দের জীবন আর জীবনানন্দের সৃষ্টিগুলোকে পাওয়া যায়৷ শাহাদুজ্জামানও আমাদের সকলের মতো নতজানু ভক্ত হয়ে জীবনানন্দের গল্প বলেন। অবাক করে দেওয়ার প্রয়াস অথবা উদ্দেশ্যের অভাবটা যে আমাকে অতৃপ্ত রেখেছে তেমনটা কিন্ত না। পড়তে বেশ স্বাদুই। এই পুরো বইটা লেখকের মুখে একটা লেকচার হিসেবে শুনতে বেশ লাগত। তাহলে এটা হত জীবনানন্দকে নিয়ে দেওয়া এ যাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেকচার।
জানিনা কেনো, জীবনানন্দের প্রতি আহামরি কোনো ভক্তি আমার কখনো গড়ে উঠেনি। আমি তীব্র রবিপ্রেমী বলেই সম্ভবত ছেলেবেলা থেকে বিভিন্ন জায়গায় রবি বনাম জীবনানন্দ বিতর্ক দেখে জীবনানন্দের প্রতি খানিকটা বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলাম বললেও ভুল হবেনা। তবু এই বইটা পড়েছি জীবনানন্দ সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে। এবং নিঃসন্দেহে বইটি আমার জানার পিপাসা মেটাতে সফল হয়েছে।
প্রথমেই বলতে হয়, বইটা খুবই স্লো। কিন্তু এটা এ বইয়ের ক্রুটি না- বরং এমনটাই হয়তো হওয়া উচিত ছিলো। এটাকে বই না বলে রিসার্চ পেপার বললেও ভুল হবে না। এখানে জীবনানন্দের ছেলেবেলা থেকে বিভিন্ন ঘটনা উদ্ধৃত করা হয়েছে, তার সান্নিধ্যে থাকা নানাজনের স্মৃতি কথা তুলে আনা হয়েছে, তার ডায়েরি থেকে তুলে আনা হয়েছে লুকোনো অনুভূতি আর দেওয়া হয়েছে তার অনেক গুলো গল্প-কবিতার ব্যাখ্যা। কাগজ আর কালির মধ্য থেকে যেনো বারবার জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছিলো জীবন্ত জীবনানন্দ।
জীবনানন্দের জীবনে আনন্দের ভাগ কমই ছিলো। ডাঙায় তোলা মাছের মতোই ভদ্রলোককে প্রায় সারাজীবন কমফোর্ট জোনের বাইরেই কাটাতে হয়েছে। তবে তাতে তার দোষ যে নেই- তাও বলা যায় না৷ কি দরকার বাপু একটা অনিশ্চিত জীবনে অন্য বাড়ির মেয়েকে এনে কষ্ট দেবার?
যাহোক, আমি তো জীবনানন্দের ভক্ত নই। তবু বইয়ের শেষে যখন ভদ্রলোক চোখ বুজলেন তখন আমার চোখ ভিজে উঠলো কেনো?
ইংরেজিতে Introvert নামের যে টার্মটা আছে এই টার্মের ভেতর পড়া মানুষগুলো আসলে কেমন হয়? নিজেতে থাকতে পছন্দ করা মানুষ এরা? আসলেই এটা তাদের পছন্দ? নাকি তারা বাধ্য হয়ে এমনটা থাকে? না, হয়তো অন্য কেউ বাধ্য করেনা কিন্তু যে বাঁধাটা তারা অনুভব করে সেটা নিজের ভেতর থেকেই আসে। আসে জড়তা, অস্থিরতা, ছুটে পালাবার ইচ্ছা। মনে হয় দশের ভেতর থাকলে এনার্জি প্রতিমুহূর্তে কমে যাচ্ছে। এনার্জি গেইন করতে নিঃসঙ্গতার প্রয়োজন।
কিন্তু, এটা কী আসলেই তারা চায়? একটা টার্ম দিয়ে দেওয়া যতখানি সহজ, সেটার যারা ভুক্তভোগী তাদের একচুয়াল মনস্কামনা আন্দাজ করা ততোটা সহজ হয়তো না। তাদের ভেতরও যে একটা স্বত্বা থাকে যে স্বত্বা চায় কেউ তাদেরকে বড় করে দেখুক, অনেক অনেক মানুষ তাদেরকে চিনুক, অনেক অনেক নাম ডাক হোক, অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হোক। কিন্তু কাজ গুলো নিজে না করে তারা চায় অন্যরা করুক তাদের প্রতি। ঠিক এমন একটা জীবন পার করেছেন জীবনানন্দ দাশ। না এটাই তার জীবন না। তবে তার জীবনের অনেক কিছুর সাথে এই অংশটুকু না জুড়লে শতক পূর্ণ হয়না।
Matthew Arnold কবিতাকে বিচার করে শ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়ার জন্য ৩ টা বিষয় বিচার করতে বলেছেন। 1. Personal Estimate 2. Historic Estimate 3. Real Estimate
এগুলোর ভেতর ১ টি বিষয়কে তিনি নিতে বলেছেন কবিতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়নের জন্য। আর সেটা হলো Real Estimate. তার মতে অপর দুইটা দিয়ে জাজ করলে সঠিকভাবে জাজ করা হয়না। কারণ তখন বিভিন্ন নিয়ামক কাজ করে খারাপ কবিতা গুলোকেও ভালো বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আসলেই কতটা যুক্তিযুক্ত এই কথা? হয়তোবা যুক্তিযুক্ত, হয়তোবা না। কিন্তু "একজন কমলালেবু" না পড়লে বুঝা যাবেনা একজন কবির কবিতা বুঝার জন্য তার জীবন সমন্ধে জানা কতোটা দরকার। তার সমসাময়িক বিষয়াবলি জানা কতোটা প্রয়োজন। একবার জেনে গেলে বা আন্দাজ করতে পারলে চোখের সামনে অন্য এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়। দুচোখ বাদেও অন্য এক চোখ দিয়ে দেখা যায় কবিতার মর্মার্থ। অনুধাবন করা যায় শব্দগুলোর, বাক্যগুলোর চিরন্তনতা।
"একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে? আবার যেন ফিরে আসি কোনো এক শীতের রাতে একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানার কিনারে।"
আজকের পৃথিবীতে অন্তত বাংলাভাষীদের ভেতর জীবনানন্দকে চেনেনা এমন কাওকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু এরকম পরিস্থিতি কী আগেও ছিলো? এরকম ভালোবাসা, এরকম খ্যাতি, সম্মানের চোখে দেখার শুধা কী জীবনানন্দ দাশ তার জীবনে ভোগ করতে পেরেছেন? কেমন ছিলো ইতিহাসের সব থেকে শুদ্ধতম কবির জীবন? কী ছিলো তার জীবনে আর কী ছিলোনা? কেমন কেটেছে শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য? জীবনানন্দের জীবনে সব পাওয়া যাবে শুধু আনন্দটা ছাড়া। আজকে যাকে মাথার তাজ করে রাখা হয় সেই জীবনানন্দ পাননি তার প্রাপ্য সম্মানের কিঞ্চিৎ পরিমানও। নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের জীবনানন্দ তাই লিখে গেছেন শত অসম্মান সহ্য করেও। পারেননি রবীন্দ্র পরবর্তী কবির দলে ভিড়তে আবার পারেননি রবীন্দ্রধর্মী হয়ে লিখতে। এজন্যই হয়তো কবি বলে গেছেন তার লেখা আগামী প্রজন্মেরও পরের প্রজন্মের জন্য।
"একজন কমলালেবু" বইটাকে সাজনো হয়েছে জীবনানন্দ দাশের জীবনকে তুলে ধরতে। শুধু ব্যাক্তি জীবন না, সমান তালে তুলে ধরা হয়েছে তার কবি জীবনকেও। কেমন ছিলো তার প্রথম জীবনের কবিতা আর কেমন হয়েছিলো তার পরিণত জীবনের কবিতা। কেমন করে "ঝরা পালকের" মতো শক্ত-সামর্থ্য শব্দ ব্যাবহার থেকে বেরিয়ে "বনলতা সেনের" মতো বা "রূপসী বাংলার" মতো কবিতা উপহার দিয়েছেন। শাহাদুজ্জামান সাথে সাথে জানিয়েছেন তার কবিপ্রতিভার জন্মস্থানের কথা। কুসুমকুমারীর কথা। কবি জীবনানন্দের সাথে সাথে মানুষ জীবনানন্দকেও তুলে এনেছেন তার বইয়ে। দেখিয়েছেন তার ভালোবাসার পরিনতি, তার সাংসারিক জীবন, তার দুঃখ-কষ্ট আর তার আকাঙ্খা গুলোকে। আরও দেখিযেছেন কিভাবে জীবনানন্দ দাশের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার লেখা। তিনি যে শুধু লেখার জন্যই লিখতেননা, বরং ভেবে চিন্তু, উদ্দেশ্য নিয়ে লিখতেন সেটাও উঠে এসেছে এই বইয়ে। মুখলুকানো জীবনানন্দ যে একটু হলেও মানুষের ভালোবাসা, মানুষের কাছে নাম ডাক চাইতেন সেটা বুঝা যায় তার শেষ বয়স সমন্ধে জানলে আর মধ্য বয়সেও। এসবে হয়তো আর্থিক কারণই বেশি ছিলো। হয়তো খ্যাতি হলে টাকা রোজগার হতো কিন্তু কিছুটা হলেও মনের কোনে ইচ্ছেটাও ছিলো। জীবনানন্দ পড়ালেখা করেছেন প্রচুর, জ্ঞানের পরিধিও তার কম নয়। কিন্তু দুঃখের পরিধি তার আরও বড়। এতকিছু জানা মানুষ, জ্ঞানী মানুষ যখন সব জ্ঞান, সম্মানকে তুচ্ছ করে অন্যদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়ান তখন বুঝতে হবে কতোটা খারাপ পরিস্থিতিতে ছিলেন তিনি। ভাবলেই যেন বুকটা হাহা করে ওঠে। তিনি যত বড় মাপের কবি ছিলেন, ঠিক তার দ্বিগুন পরিমানে তার জীবন ছিলো ট্রাজিক।
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে কত কত লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু 'একজন কমলালেবু' এর মতো সফল কাজ হয়েছে কি না জানি না। ব্যক্তি জীবনানন্দ আর কবি জীবনানন্দ 'একজন কমলালেবু' দারুণ ভাবে উপস্থাপন করেছেন শাহাদুজ্জামান। কিন্তু তথ্যের ভারে নুইয়ে পড়ে নি। উল্টো শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে জ্যোতি ছড়াচ্ছে। জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনের দুঃখ, বেদনা, তার অন্তর্মুখী চরিত্র এবং তার গভীরতা আর বিস্ময়তা এখানে এক আশ্চর্য ভাবে ধরেছেন। কিন্তু কি সরলতা লেপ্টে আছে বইটা জুড়ে।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। আকাশ বিষণ্ণ মেঘে ঢাকা। ফাল্গুন শেষ হতে চলল। এসময়ের হঠাৎ বৃষ্টি প্রকৃতিতে এনেছে সতেজ ভাব। সেই সাথে হালকা শীত শীত আরামদায়ক উষ্ণতা। ঢাকা নামের শহরে এমনি এক সকালে জীবনানন্দ হঠাৎ এসে হাজির হন এক তরুণের কাছে, একজন কমলালেবু হয়ে। বইয়ের পাতায় তাঁর জীবন তখন প্রায় শেষের পথে। স্বাস্থ্যবান বইয়ের শেষ কটি পাতা তাঁর শেষ জীবনের কথা বলছে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে জং ধরা লোহার খাটে শুয়ে তিনি তখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। আর তাঁর মৃত্যুর তেষট্টি বছর পরে তিনি অনুভূত হচ্ছেন এক তরুণের মনে, শঙ্খচিল কিংবা শালিক নয়, অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে না চাওয়া, নির্জনতার, নির্লিপ্ত কবি হিসেবে। একজন কমলালেবু পাঠের পরে যে কথাটি মনে হয় তা হল, শুধু পাঠ্যবইয়ে পড়া রূপসী বাংলার জীবনানন্দ কিংবা বনলতা সেনের কবিতায় নয়, একজন সংসার জীবনে ভীষণভাবে অসফল, দাম্পত্যজীবনে অসুখী আর আত্মঘাতী ক্লান্তি নিয়ে নিরন্তর বয়ে চলা জীবনের কবি, আবার সেই সাথে বাংলা কবিতার বাঁক বদলানোর কবি, যার কবিতাকে কিনা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন "কিচ্ছু হয়নি", সেই জীবনানন্দকে আবিষ্কার করতে পারার আনন্দ প্রাপ্তি হয় কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের কলমে।
একজন কমলালেবু কি উপন্যাস? নাকি আত্মজীবনী? নাকি জীবনানন্দের কবিতাকে ছাপিয়ে তার ব্যক্তিজীবন, দাম্পত্য, প্রেম, হতাশা - সব নিয়ে লেখা এক আলেখ্য? জীবনানন্দের হাতেগোনা অল্প কয়েকটি কবিতার সাথেই পরিচয় ছিল। অথচ যে বিপুল কথাসাহিত্য তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, কবিতায়, উপন্যাসে, প্রবন্ধে তার অধিকাংশই রয়ে গেছে অপঠিত। একজন কমলালেবুর প্রারম্ভ পাঠককে আকৃষ্ট করে, টানতে থাকে জীবনানন্দের আরও গভীরে যাওয়ার জন্য। মৃত্যু দিয়ে শুরু, মৃত্যু দিয়ে শেষ। মাঝখানের সময়টুকু তা জীবনানন্দের জীবনকে উপস্থাপন করে যায় ফিল্মের মত - শৈশব, যৌবন, প্রেম, বিয়ে, হতাশা, ব্যর্থতা এবং অবশ্যই সাহিত্য। শুধু কবিতা নয়, প্রবন্ধে কিংবা গল্প-উপন্যাসে জীবনানন্দের সেসময়কার পরিস্থিতির প্রভাব, জীবন মৃত্যু নিয়ে তাঁর ভাবনা, কবিতার কিংবা সাহিত্যের উঁচু মানে পৌঁছতে চাওয়ার আকাঙ্খা এসবকিছু শাহাদুজ্জামান বর্ণনা করে যান নিরাসক্তভাবে। জীবনানন্দের জীবনের দর্শক যেন তিনি, তাকিয়ে দেখছেন এক প্রান্ত থেকে আর তুলে দিচ্ছেন পাঠকের হাতে, ছবি হিসেবে। কথাসাহিত্যিক হিসেবে দারুণ সফল শাহাদুজ্জামান, পাঠকের মনে ঠিকঠিক ছবিটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারেন। ক্রাচের কর্নেল কিংবা খাকি চত্বরের খোয়ারি যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল, তাঁর রেশ তিনি রেখেছেন এখানেও।
জীবনানন্দকে দেখতে পাই মুখচোরা, নির্জনতাপ্রিয় এক কবি হিসেবে, মজলিশে কিংবা আড্ডায় যিনি ভীষণ অস্বস্তি বোধ করেন। মানুষের কোলাহলের মাঝেও তিনি নৈঃশব্দ্যের সন্ধান করেন। অর্থোপার্জনে ভীষণ অপটু জীবনানন্দের জীবনটা গেল শুধু সাহিত্যের সন্ধানেই, যে সাহিত্য হয়তোবা তাঁর পরিবারের জন্য রেখে যায় না কিছুই, কিন্তু বাংলা ভাষাকে দিয়ে যায় ট্রাঙ্কভর্তি লুকোনো গুপ্তধন। তাঁর হাতেই লেখা হয় বাংলা কবিতার বাঁকবদলের পালা। তিনি লিখতে চেয়েছিলেন, শুধুই লিখতে চেয়েছিলেন, নির্জনে তপস্যায় বসা ধ্যানীর মত একমনে লিখে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জীবন বারেবারে তাঁকে বিঘ্নিত করেছে, জীবনে আনন্দের খোঁজ না পেয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে জীবনানন্দ তাই তার ডায়েরিতে লিখে রেখে যান আত্মহত্যার কথা, একা নয়, সপরিবারে। সমুদ্রের বুকে ডুবে মরে কিংবা মেঘের ভেতরে অদৃশ্য হবার কথা লিখেছিলেন তিনি। চেষ্টা তিনি করেছিলেন বটে, একটা চাকরি যোগাড় করবার প্রাণান্ত চেষ্টা তার ছিল কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। জীবন থেকে তিনি কি হারিয়ে ফেলেছিলেন সব উৎসাহ, স্পৃহা? অথচ তিনিই লিখেছিলেন থেতলে যাওয়া ব্যাঙেরও বেঁচে থাকার আকুতি থাকে একমুহুর্তের। কিন্তু সেই জীবনের সাথে, সেই ফড়িঙের, দোয়েলের জীবনের সাথে তার দেখা হয় নি কখনো।
একজন কমলালেবু পড়া শেষে প্রবল বিষণ্ণতা বোধ চেপে ধরে। হয়তোবা জীবনানন্দের জীবনের দীর্ণতা, অপ্রাপ্তি সঞ্চারিত হয় পাঠকের মাঝে, তাঁর কবিতার "কোন্ এক বোধ", কিংবা "বিপন্ন বিস্ময়" মিশে যায় পাঠকের রক্তে, তাঁকে ভীষণ ক্লান্ত করে - ক্লান্ত করে।
"আমি কবি, --- সেই কবি --- আকাশের পানে আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!"
এক নির্দোষ, অনাড়ম্বর, শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতির সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল। এক "বিপন্ন বিস্ময়" নিয়ে এঁকে গেছেন তাঁর দেখা সেই জীবন, বোধ আর প্রকৃতির ছবি। হৃদয় তাঁর জলের মত ঘুরে ঘুরে কথা কয়! কিন্তু নিরুপায় জীবনের বাস্তবতা, রূঢ়তা, সমালোচনার কাঁটায় বারবার রক্তাক্ত বোধন হয়েছে তাঁর, নিঃসঙ্গ নির্জনতায় কাটিয়ে দিয়েছেন মানুষটি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এবং দেশভাগোত্তর পৃথিবীতে জীবনানন্দের নিরুপায়তা ঋত্বিক ঘটকের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই করুণ সময়ে বড় অকরুণ মুক্তি মিলল তাঁর।
বইটাকে উপন্যাস লিখা হল কেন বুঝতে পারছি না, বায়োগ্রাফিক্যাল ছিল । শাহাদুজ্জামান তার কথার জাদুকরীতে জীবনানন্দের জীবন কে চমৎকার পরতের পর পরত সাজিয়ে গেছেন_ মুগ্ধ হই _
শিশুকালে মিলুর একবার ভীষন অসুখ করেছিলো। ডাক্তার মশাই সাজেস্ট করলেন উত্তরে যেতে, হাওয়া বদল করতে। শিক্ষক বাবার মধ্যবিত্ত পরিবারে এক ভীষন ও অসম্ভব খরচের ব্যাপার, উপরন্তু, শিশুমৃত্যু তখন ডালভাত! সকলে নিরুৎসাহিত করলেও মা কুসুমকুমারী দাশ কারো কথা গা করেননি। তিনি নিজে সব ব্যবস্থা করে উত্তরে গেলেন, সুস্থ করে সাথে নিয়ে ফিরলেন উনার মিলুকে। আর, আমাদের জীবনানন্দ দাশকে।
মা কবিতা লিখেছিলেন- "আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে!" জীবনানন্দ দাশ যেন মায়ের চাওয়াই পূরণ করেছেন।
ভীষন লাজুক, মুখচোরা, নির্জনতা প্রিয় জীবনানন্দ দাশ নীরবে-নিভৃতে কলমের কালিতে লিখে গেছেন মনের সব প্রদাহ-রস-রঙ। রবীন্দ্র কাব্যধারার যুগে অন্যধারার সাহিত্য রচনা করে বারবার পড়েছেন তীব্র সমালোচনার মুখে। তবুও নিজধারা থেকে সরে যাননি, থেকেছেন অটল! অথচ, ব্যক্তিজীবনে সুখী ছিলেন না জীবনানন্দ বাবু! বেকারত্ব, দারিদ্র, দাম্পত্য সংকট, প্রেমহীনতা.... সবকিছুর দংশনে, ব্যথায় পার করেছেন সারাটা জীবন। অথচ এতকিছুর মাঝেও পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো উনার অসাধারণ। ভাবতে পারতেন কি ভীষন সুন্দর। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তিনি ভেবেই গেছেন!
আমি ভাবি, যাঁর নামের মাঝেই আনন্দ-যাঁর নামের মাঝেই জীবন, তাঁকে কী জন্য সারাটা জীবন কাটাতে হবে এমন জীবনহীনতায়? এমন আনন্দহীনতায়?
এবার আসি লেখকের কথায়... এই প্রথম পড়লাম শাহাদুজ্জামানের লেখা। বিভোর হয়ে পড়েছি, পড়েই গেছি। এতো ভালো লেগেছে! মনে হয়েছে, এই এতটুকুই তো জীবন। হঠাত কখন যেন টুক করে নিভে যাই! তার আগে কত ভালো ভালো বই পড়া বাকি। এই বইটা আরো আগেই পড়া উচিত ছিলো, পড়িনি কেন? এমন জীবন কাহিনী ভীষন ভালো লাগে। মনে হয় যেন লেখক ছায়ার মত জীবনানন্দের পাশে পাশে থেকেছেন। একেকটা দীর্ঘশ্বাস, একেকটা কপালের ভাঁজ পর্যন্ত লক্ষ্য করেছেন যত্ন নিয়ে। কিভাবে এমন লিখেন উনারা? জীবনানন্দের কথা আগামী কিছুদিন খুব তাড়া করে বেড়াবে। কারণে অকারণে মনে পড়বে বরিশালের সেই বগুড়া রোডের বাড়ি, কালো ট্রাঙ্ক, ব্রজমোহন কলেজ আর পরিপাটি ধুতি পরা সাদামাটা জীবনানন্দ দাশগুপ্ত! বিষন্ন করে দিবে অকারণ।
এমন আরেকটা বই পড়েছিলাম বেশ অনেকদিন আগে। সেটাও কি এক ঘোরের ভেতর ফেলে দিলো। আমি মৃণলিণী নই, হরিশংকর জলদাসের লেখা। সেবারো এমনই লেগেছিলো, লেখক যেনো মৃণালিণী দেবীর সাথে সাথে থেকে খুব যত্নে পরখ করেছেন কবিপত্নীর খুব গোপন দীর্ঘশ্বাসটাও। তিনি সুখী ছিলেন না। সুখী ছিলেন না জীবনান্দ দাশের স্ত্রী, লাবণ্য দাসও! সাহিত্যানুরাগী ছিলেন না তিনি। চাওয়া পাওয়াও যে খুব একটা বেশি ছিলো তা নয়। আর পাঁচটা সাধারণ সংসারের মত সংসার চেয়েছিলেন। পাননি! আচ্ছা, কবিপত্নীরা সকলেই কি এমন জীবন পান?
জীবনানন্দ আমার বাবার খুব প্রিয় কবি। আর বোধহয় শামসুর রাহমান। এই দুজনের কবিতার বই প্রায়ই আমার অতি ব্যস্ত সাংবাদিক কবি বাবাকে হাতে নিয়ে বসতে দেখতাম। এখনকার যুগের হাওয়া গত প্রজন্মের শরীরেও লেগেছে। কবিতা লিখবার অভ্যাস রইলেও অবসরে প্রিয় কবিতা পড়বার বদলে হাতে সবসময় মুঠোফোন থাকে বাবার।একটা কারণ মুখবইয়ের নেশা।আরেকটা বোধহয় এই যে আমি হাজার হাজার মেইল দূরে আরেকটা দেশে আছি,চাইলেই আমার সাথে কথা বলা যায় তাই!
তো বাবার জন্যই বইটা হাতে নিয়েছিলাম।কিন্তু আমোদ পেলাম না। কারণ শাহাদুজ্জামানের লেখার ধারটা এই বইয়ে মনে ধরলো না। শুধু এক একটা সময় এক এক লেখার বিশ্লেষণ। তবে হ্যাঁ! জীবনানন্দ কে কিছুটা হলেও কাছ থেকে জানলাম বটে। দেখুন, সেই ৮০ বছর আগেও ডিপ্রেশন কিভাবে একটা মানুষকে কুড়ে কুড়ে খায় তা জীবনানন্দ প্রাণ দিয়ে বুঝিয়ে গেলেন।
কবি বাবার মেয়ে হয়েও কবিতা আমাকে আপন করেনি বা আমি তার ডাকে সাড়া দেইনি।কিন্তু ফোকটে নতুন করে কিছু জীবনানন্দের কবিতা যখন পড়া হলো আবার। দেখলাম- বয়সের সাথে সাথে নতুন করে দেখছি অনেককিছু। খারাপ না,ভালোই!
শাহাদুজ্জামানের গদ্য নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। সুস্বাদু গদ্য লিখিয়ে হিসেবে শাহাদুজ্জামানের জুড়ি মেলা ভার।
"একজন কমলালেবু " কে শাহাদুজ্জামান দাবী করেছেন উপন্যাস হিসেবে। কিন্তু পড়তে গিয়ে মনে হলো আমি যেন জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে অতিসুখপাঠ্য একটি ননফিকশন পড়ে ফেললাম(!)
"ক্রাচের কর্ণেল " কিংবা "আধো ঘুমে ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে" যারা পড়েছেন তারা জানেন শাহাদুজ্জামান ঐতিহাসিক কোনো চরিত্রকে নিয়ে কতো ভালো উপন্যাস লিখতে পারেন।
কিন্তু কমলাল��বুর ক্ষেত্রেই কেন উপন্যাস কম, ডকু বেশি লিখলেন তা নগণ্য পাঠক হিসেবে আমার বোধগম্য হলো না।
যাইহোক, বাংলা সাহিত্যের নির্জনতম আর শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দের জীবন কতো বিচিত্রময় ছিলো তা জানার চমৎকারতম গ্রন্থ "একজন কমলালেবু "
জীবনানন্দ দাশ এর জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে লেখক শাহাদুজ্জামান এর বর্ণনাত্বক জীবনী ও উপন্যাসের মত বই 'একজন কমলালেবু' । আমরা অনেক লেখকের রচনায় জীবনানন্দ দাশের জীবনের খন্ডাংশ জানতে পারি । ক্লিন্টন বি শিলি জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টি ও জীবনের উপর সম্পূর্ণ বই লিখেছেন । কিন্তু সে রচনায় যেন একটা নৃতাত্ত্বিক অন্বেষণ করেছেন লেখক । এই রচনায় লেখক জীবনানন্দের জীবন ও সৃষ্টিকে যেন মায়া করে লিখেছেন ।
একজন জীবনানন্দের বাংলা সাহিত্যতে অবদান আমরা জানি, প্রাসাদ প্রমাণ । বিকালের রোদে রক্তাপ্লুত ট্রামের নিচে চাপা পড়ে এক সপ্তাহ হাসপাতালে যন্ত্রনা ভোগ করে ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ তে মৃত্যুবরণ করেন জীবনানন্দ দাশ । বইটার শেষে লেখক আরো একবার সবার কাছে প্রশ্ন রেখে গেছেন জীবনানন্দের এই মৃত্যু তাহলে কী- দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা নাকি হত্যাকান্ড? কারণ আমরা জানি, জীবনানন্দ ব্যক্তি জীবনে ছিলেন এক��ন ভাগ্য বিতাড়িত, পোড় খাওয়া হতদরিদ্র কবি । তাঁর কবিতা সমকালের দু-চারজন ছাড়া অধিকাংশ রবীন্দ্রবলয়াবিষ্ঠ সাহিত্য বোদ্ধারা বুঝতে পারেনি । উপরন্তু নানা কটু কথা ও মন্তব্য সহ্য করে চলতে হয়েছে দীর্ঘদিন । শেষকালে যখন খ্যাতি এসে ধরা দিচ্ছিলো, তাকে উপেক্ষা করে তিনি হেঁটে গেলেন এগিয়ে আসা ট্রামের দিকে ।
তাঁর অপ্রকাশিত প্রায় বিশটি উপন্যাস এবং শ'খানেক ছোটগল্পকে লেখক বলেন 'ট্রাঙ্কের ভেতর তুতেনখামেনের গুপ্তধন' । লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় জীবনানন্দের এই অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, '৬০ বছরে কেবল পাতাগুলো হলুদ হয়েছে এবং ন্যাপথলিন ছাড়া কোন কার্যকর কীটনাশক না থাকা সত্ত্বেও পোকারা তা কাটতে সাহস পায়নি' । কবির লেখার হাতেখড়ি মা কুসুমকুমারী দাশের উৎসাহে শুরু হয় অল্প বয়সেই, মা-ও ছিলেন কবি ।
নামটা আসছে যে কবিতা থেকে,
একবার যখন দেহ থেকে বা'র হয়ে যাব আবার কি ফিরে আসবো না আমি পৃথিবীতে? আবার যেন ফিরে আসি কোনো এক শীতের রাতে একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে কোন এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে ।
জীবনানন্দের লেখা, তাঁর সম্পর্কে লেখা এবং তাঁর জীবনের রূপরেখা ঘেঁটে লেখক যা দাঁড় করালেন, একে বলা যায়- জীবনানন্দের সৃষ্টির বিষয় ও পরিস্হিতির আলোচনা এবং সম্পূর্ণ জীবনী।
এর আগে জীবনানন্দের অনেক কবিতা পড়ার পরও উনাকে নিয়ে তেমন জানতাম না। শুধু জানতাম উনার নামের মতো জীবনটা আনন্দের ছিল না, বেশ কষ্টে জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং উনার স্ত্রী বেশ পিড়া দিয়েছেন উনাকে। এই বইটি পড়ে ব্যক্তি জীবনানন্দ এবং লেখক জীবনানন্দ নিয়ে অনেককিছু জানলাম। উনার বেড়ে উঠা, জীবনে পথভ্রষ্ট হওয়া, উনার কবিতা নিয়ে সমালোচনা এবং সমালোচনার জবাব দেওয়া (যেমন, রবীন্দ্রনাথকে উনার কবিতা নিয়ে সমালোচনার জবাব দেওয়া বেশ ইন্টারেস্টিং ছিলো), মানুষের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য হওয়া।
তাছাড়া, জীবনে যা হচ্ছিল এবং উনার নিজস্ব চিন্তাচেতনা সেসবের দেখা পাওয়া যায় উনার কথাসাহিত্য/কবিতা তে। এটার জন্য সাধুবাদ পাবেন লেখক শাহাদুজ্জামান। বইটা পড়লেই বুঝতে পারবেন শাহাদুজ্জামান বইটা লেখার পেছনে অনেক আগে থেকে জীবনানন্দ নিয়ে লেখাপড়া করছেন এবং ক্রমঅনুসারী জীবনানন্দের গল্প/উপন্যাসের রেফারেন্সগুলো সাজিয়েছেন।
তবে জীবনানন্দ নিয়ে জানার জন্য বইটা বেশ ভালো। শুধু জীবনানন্দ না, আমি বলব জীবনানন্দের সাহিত্য নিয়ে চিন্তাভাবনা নিয়েও যথেষ্ট জানা যাবে। তবে, লেখকের মন্তব্য তেমন পাইনি। অর্থাৎ লেখক শাহাদুজ্জামানের তেমন কোনো মন্তব্য বা জীবনানন্দকে নিয়ে উনার চিন্তাভাবনা তেমন পাইনি। সুতরাং, জীবনানন্দকে নিয়ে জানার জন্য বইটি অসাধারণ, তবে লেখক শাহাদুজ্জামানের কথাবার্তা খুঁজতে গেলে কম পাওয়া যাবে এতে
শেষে বলতে চাই যে, কেউ যদি জীবন বাবুকে নিয়ে জানতে চায় তাহলে আমি অবশ্যই বলব 'একজন কমলালেবু' পড়ুন। আপনি বেশ তৃপ্ত হবেন বইটা পড়ে জীবনানন্দকে নিয়ে জেনে।
'জীবনানন্দ দাশ' মায়ের অমায়িক আদর্শ ছেলে,বাংলা সাহিত্যের নির্জনতম-শুদ্ধতম কবি হিসেবে জনশ্রুত ।তবে, 'জীবনানন্দ' শুধুই কি একজন মানবসন্তান অথবা কবির নাম?নাকি এক জীবনবোধের নাম ? বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান ধানসিঁড়ি তীরের কবি জীবনানন্দ দাশকে আদ্যোপান্ত দারুণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ।ফলশ্রুতিতে, 'একজন কমলালেবু' বইয়ের পাতায় পাতায় ধরা দিয়েছে জীবনানন্দের জীবন রহস্য!
বই : একজন কমলালেবু লেখক : শাহাদুজ্জামান প্রকাশনা : প্রথমা প্রকাশনা সাল : ২০১৭ মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা
সময়পঞ্জিকার পাতা উল্টিয়ে নতুন শতক যখন আগমনের অপেক্ষায় ঠিক সেই ক্ষণে বরিশালের এক শিক্ষিত-মার্জিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ছোট্ট শিশু 'মিলু'। বোধ করি, মাতা কুসুমকুমারী দাশ-ও (তৎকালীন সময়ের সুপরিচিত কবি) আঁচ করতে পারেননি তাঁর 'মিলু' তাঁর কাছ থেকে কাব্যসাধনায় প্রভাবিত হয়ে, শব্দ খেলায় অনুপ্রাণিত হয়ে একদিন বাংলা কাব্যসাহিত্যের উচ্চস্থানে আসীন হবে।জীবনানন্দ স্বয়ং কি সে আশায় আশাবাদী ছিলেন ? কেন-ইবা তাঁর জীবনানন্দ নামের আড়ালে আজীবন ছিলো জীবনের আনন্দের প্রগাঢ় অনুপস্থিতি?! সেই প্রশ্নের উত্তর-ই শাহাদুজ্জামান তত্ত্ব আর তথ্যের সমন্বয়ে দিয়ে গেছেন বইটির ২৩৮ টি পাতা জুড়ে।
দুইশতাধিক পৃষ্ঠার এই জীবনচরিতে একজন সাধারণ-সাদামাটা বাঙালি যুবকের কবি হয়ে ওঠার গল্প,কারণে কিংবা অকারণে পদে পদে ব্যর্থ হয়েও কবিত্বকে শাণিত করে যাবার আখ্যান,সর্বস্ব খুঁইয়ে-ও নিজের কবি সত্তার জন্যে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাওয়া এবং হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও কবিতাকে আঁকড়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টার বিবরণ উঠে এসেছে।
পঞ্চাশের কিছু বেশি বছর এই ধূলির ধরায় কাটিয়ে গেলেন জীবনানন্দ কিন্তু স্বস্তি কি পেলেন?লিখে রেখে গেলেন অজস্র চিত্ররূপময় কবিতা কিন্তু জীবনের টানাপোড়েন তো সে-ই রয়েই গেলো। কল্পনায় পৃথিবীর পথে হাজার বছর হেঁটে আগন্তুক বনলতার কাছে আজন্মের আকাঙ্ক্ষিত দু-দণ্ড শান্তির সন্ধান পেয়েছিলেন বটে ;তবে বাস্তবিক পৃথিবীতে সে বোধ অস্তিত্বহীন- কেবলই মায়া!গোটা জীবন ধরে কাব্য-উপন্যাস-প্রবন্ধে যে মুক্তির সন্ধান করে গেলেন সে মুক্তি তাঁর কাছে চির অধরা-ই রয়ে গেলো। সে অধরা থাকবার-ই তো কথা! একটা গোটা জীবনের অজস্র অমূল্য দিনরাত্রি যে সৃষ্টিকর্মের পেছনে ব্যয় করেছেন তিনি তার বেশ অনেকটুকুই তো পাঠকমহলের যথার্থ মূল্যায়ন না পেয়ে অপ্রকাশিত রেখেছিলেন ; গোপনে বাক্সবন্দী করে রেখেছিলেন জীবনভর। দিনের পর দিন অভিমানী কবির সেসব অমূল্য সৃষ্টি জীর্ণ বাক্সে বন্দী থাকতে থাকতে পরিণত হয় ধূসর পান্ডুলিপিতে। কিন্তু,তাঁর মনে ক্ষীণ আশা ছিলো যে তাঁর অসামান্য প্রতিভা একদিন স্বীকৃতি পাবেই। মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্টিরা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে - এই ছিলো তাঁর গহন জ্ঞান। তাঁর রচনাতেই সেই সুপ্ত আশার প্রকাশ ঘটেছিলো এভাবে - "ঠিক করেছি,আমি যখন খুশি কবিতা লিখবো কিন্তু কাউকে তা দেখাতে যাবো না।তবে কবিতাগুলো না ছিঁড়ে জমিয়ে রেখেছি ; সেগুলো কোনো না কোনো হৃদয়কে কোনো না কোনো দিন আলো দেখাবে ; জলের কণিকাদের আঘাতের মতো ঘরোয়া প্রতীকের আশ্রয়ে সমাজকে বহন করে ফিরতে ; কথা ভাবাবে তারপরেও কথা ভাবাবে- অনেক কাল....."
কিছু টুকরো আশা - অভিলাষা ; অনেকখানি হতাশা-নিরাশা নিয়ে যখন নিরানন্দে জীবন কাটাচ্ছিলেন জীবনানন্দ তখন তাঁর জীবনে সাগরসম দুঃখ নিয়ে এলো 'দেশভাগ'। অকস্মাৎ শেকড় ছেড়ে পাড়ি জমাতে হলো ইট-কাঠ-পাথরের কলকাতা শহরে।কেবলমাত্র ধর্মপরিচয়ের কারণে প্রকৃতিপ্রেমী নির্জনতম মানুষটি চিরচেনা মফস্বল শহর বরিশাল, কাশ-বেতফুল-হোগলার বন - প্রাণপ্রিয় ধানসিঁড়ি নদী ছেড়ে এক সাগর দুঃখভরা বুক-শূণ্যতাঘেঁষা অস্তিত্ব নিয়ে নির্বাক-হতভম্ব হয়ে চিরতরে নির্বাসিত হলেন কলকাতায়।এক জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটা বোধহয় তখন-ই পেয়েছিলেন কবি। সেজন্যেই তাঁর কবিতায় বারবার শেকড়ে ফেরার আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে ; বাংলার প্রতি তীব্র অনুরাগময় ভাবাবেগ প্রস্ফুটিত হয়েছে। বাংলার অপরূপ প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ জীবনানন্দ ক্ষণে ক্ষণে ফিরে আসতে চেয়েছেন তার প্রিয় স্বদেশের ধানসিঁড়ির তীরে মানুষ অথবা শঙ্খচিল কিংবা শালিক পাখির বেশে, কখনো হতে চেয়েছেন ভোরের কাক-সুদর্শন পোকা নতুবা কিশোরী মেয়ের পায়ের নূপুর;দাঁড়াতে চেয়েছেন কার্তিকের নবান্নের দেশে;জিরিয়ে নিতে চেয়েছেন কাঁঠালছায়ায়!
তারপর,অসীম দুঃখের সাথে যুঝতে যুঝতে একদিন জীবনানন্দ চলে গেলেন! রেখে গেলেন একজন কমলালেবুর করুণ উপাখ্যান -
"একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে? আবার যেন ফিরে আসি কোনো এক শীতের রাতে একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে কোন এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানার কিনারে!"
তবে,দিনশেষে যে জীবনানন্দের ক্ষীণ আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পেয়েছে এ-ই পরম আনন্দের বিষয়।অপ্রকাশিত ধূসর পান্ডুলিপিসমূহ প্রকাশ্যে এসে সর্বজন নন্দিত হয়েছে,মায়াময় শব্দে রচিত চিত্র-রূপময় কবিতাগুলো আজ তাঁকে বরেণ্য করেছে।প্রচলিত কাব্যবলয় ভেঙে সে যুগে অক্ষরে অক্ষরে যে আধুনিকতার স্বাদ পাঠকশ্রেণিকে দিতে চেয়েছিলেন তার মর্ম পাঠকমহল ষোল আনা টের পেয়েছে। জীবনকালে যে সম্মানের আশায় আকুল হয়ে ছিলেন সে সম্মান জীবন শেষে বহুগুণ ভারী হয়ে এসেছে। কালের ঊর্ধ্বে গিয়েও এই নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর হয়ে রইলেন বাংলার আধুনিকতম কবি 'জীবনানন্দ দাশ'।
এভাবেই পাতায় পাতায় ছোট্ট মিলুর খ্যাতনামা কবি জীবনানন্দ হয়ে ওঠার চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প বলেছেন লেখক শাহাদুজ্জামান। গোটা বইটাকে লেখক বেশ কিছু পরিচ্ছদে বিভক্ত করে সযত্নে সহজ শব্দে রচনা করেছেন। বইটি পড়তে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, লেখক বহুদিন ধরে জীবনানন্দের জীবনরহস্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন ; বিভিন্ন তথ্যভাণ্ডার থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্যসমূহ সংগ্রহ করে তারপর হাত দিয়েছেন গ্রন্থরচনায়।লেখকের নিপুণ শব্দশৈলী আর ভাষাগত মাধুর্যের কারণেই এই বইটি কোনো আটপৌরে রষ-কষহীন জীবনচরিত বলে মনে হয়নি আমার। বইটিতে কোনো বানান বিভ্রাট তো ছিলো-ই না বরং সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই দেখে যে বইটিতে প্রতিটি বাংলা শব্দ বাংলা অক্ষরে এবং ইংরেজি শব্দ ইংরেজি অক্ষরে উল্লেখ করা হয়েছে।
বইটা হাতে নিতেই প্রথম ধাক্কাটা আসে নামের কাছে। একজন কমলালেবু এক অদ্ভুত নরম, সিট্রাস গন্ধ মাখা নাম যেন জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে উপন্যাস নয়, বরং কোনো স্নিগ্ধ শরৎবেলার ডায়েরি। প্রশ্নটা মাথায় প্রথমেই গুঞ্জন তোলে শাহাদুজ্জামান কেন এমন নাম রাখলেন ? কিন্তু একটু পরেই মনে পড়ে যায় জীবনানন্দের নিজের সেই নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি-
“আমি সব কিছুর থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছি। হয়তো আমি এক কমলালেবু।” এই একটিমাত্র বাক্যেই যেন উপন্যাসের দরজা খোলে। মনে হয়, কবিই যেন নিজের ছেঁড়া রুমালের কোণে চুপিচুপি নামটা লিখে রেখে গেছেন। একজন কমলালেবু ভিতরে মধুর, আলো ছায়ার মিশেল, স্বপ্নের শাঁস, বাইরে কুঁচকানো ছাল ব্যর্থতা, নিঃসঙ্গতার দগদগে দাগ, জীবনের ম্লান রোদ। নামটির ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই দ্বৈত হৃদয় কবির নরম ভেতরটা আর তার কঠিন বাইরের পৃথিবী,
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জীবনানন্দ দাশ এক অনন্য নাম নিঃসঙ্গতার কবি, নীরবতার শিল্পী, সময়ের আগন্তুক। তাঁর কবিতা যতটা শব্দের, ততটাই নীরবতার। তবু এই নিঃশব্দ মানুষটিকে বোঝা আজও সহজ নয়। শাহাদুজ্জামানের “একজন কমলালেবু” বইটি সেই অজানা জীবনানন্দকে নতুন আলোয় দেখার চেষ্টা।একটি জীবনীমূলক উপন্যাসের আলোচনা শুরু করাটা অনেক কঠিন ব্যাপার । কোথা থেকে শুরু হবে? তথ্য না অনুভূতি? এই ক্ষেত্রে শাহাদুজ্জামান আমাদের জন্য একটি সহজ কিন্তু গভীর পথ তৈরি করে দিয়েছেন অনুভূতির আড়ালে তথ্য।
"হারিয়ে যাওয়া মানুষটি আর হয়তো ফিরে আসবে না, সে আর কিছুতেই ফিরে আসতে পারে না শুধু এক গভীর দীর্ঘশ্বাস!"
শাহাদুজ্জামানের গদ্যের জাদু এইখানে যে তিনি জীবনানন্দকে আইকনিক ‘শুদ্ধতম কবি’র সিংহাসন থেকে নামিয়ে এনে আমাদের পাশের বাড়ির এক সংবেদনশীল, বিধ্বস্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর গদ্যের এই ফ্লোটা এতটাই সংহত যে পড়া শুরু করলে আপনি অনায়াসে শেষ করতে চাইবেন । এ বই কেবল একটি সাহিত্যিক জীবনের বর্ণনা নয় এ এক মানুষের অন্তর্জগতের যাত্রা। এখানে আমরা দেখি কবির মানসিক অস্থিরতা, তাঁর প্রেম, একাকিত্ব, বেদনাবোধ, এবং সমাজের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব। লেখক জীবনানন্দের কবিতা, ডায়েরি, এবং ব্যক্তিজীবনের নানা মুহূর্তকে একসূত্রে গেঁথে তুলে ধরেছেন এমনভাবে, যেন পাঠক ধীরে ধীরে প্রবেশ করেন কবির নিঃসঙ্গ জগতে।
একজন কমলালেবু কোনো প্রচলিত জীবনী নয় আবার শুধুই উপন্যাসও নয়। এটি এক গবেষণাধর্মী আত্মভ্রমণ যেখানে লেখক নিজেও যেন কবির সঙ্গে পথ চলেছেন, তাঁর নীরবতার ভেতরে শব্দ খুঁজেছেন। তাই যাঁরা কাহিনি নির্ভর কিছু আশা নিয়ে পড়া শুরু করবেন, তাঁদের একটু হতাশ লাগতে পারে।
এই উপন্যাস পড়তে পড়তে বুঝতে পারলাম কেন তাঁকে নিঃসঙ্গতার কবি বলা হয় তাঁকে। জনসমুদ্রে থেকেও তিনি ছিলেন একা, অসম্ভব একা। চারপাশে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী থাকলেও, সত্যিকার অর্থে কেউ তাঁকে বুঝতে পারেনি। তাঁর মনের গভীরতার সঙ্গে কারও সংযোগ ঘটেনি। যিনি সারাজীবন মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে, তিনিই সবচেয়ে কম পেয়েছেন বোঝাপড়া।
তাঁর সময় তাঁকে গ্রহণ করেনি বরং সমালোচনা, অপমান আর উপেক্ষাই ছিল সঙ্গী। তবুও তিনি থামেননি। নিজের নিঃসঙ্গতাকে রূপ দিয়েছেন শব্দে, ছন্দে, চিত্রে যেন নীরব প্রতিবাদের মতো।
কোন জীবনানন্দকে আমরা এখানে দেখি? সেই মানুষটিকে, যিনি লেখায় মহিমান্বিত অথচ জীবনে নিঃস্ব লেখকের ভাষায়, “বিশুদ্ধভাবে ব্যর্থ” এক কবি। যিনি জীবদ্দশায় প্রাপ্য সম্মান পাননি, সমাজ ও সাহিত্য জগতের অবহেলা, সমালোচনা আর ব্যক্তিজীবনের অশান্তি তাঁকে ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত করেছে।
এই উপন্যাসে শাহাদুজ্জামান কেবল সাহিত্যিক জীবনানন্দকে নয়, মানুষ জীবনানন্দকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। কবিতার অন্তরালে থাকা এক নিঃসঙ্গ, সংবেদনশীল আত্মাকে তিনি তুলে ধরেছেন গভীর মমতায়। এখানে জীবনী একটা নোটবুক নয় বরং ছোট ছোট হৃদস্পন্দনের সারি যেখানে পাঠক একইসঙ্গে কবিকে আবিষ্কার করেন আর মানুষটিকে বুঝে ফেলতে গিয়ে কেঁদে ওঠেন।
কমলালেবু
একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে ? আবার যেন ফিরে আসি কোন এক শীতের রাতে একটা হিম কমলালেবুর করুন মাংস নিয়ে কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।
এই তো কয়েকদিন আগেও জীবনানন্দ দাশ নিয়ে আমার জ্ঞান পাঠ্যবইয়ের কবিতা আর নাটোরের বনলতা সেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
“আরম্ভ হয় না কিছু — সমস্তের তবু শেষ হয় — কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়! যা হয়েছে শেষ হয়; শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয়!”
এখন 'একজন কমলালেবু' পড়ার পর মনে হচ্ছে একটু হলেও জীবনানন্দকে বুঝতে পারছি। কিন্তু যেই কবির কবিতার পংক্তিতে উঠে এসেছে চিরায়ত বাংলার অপরূপ সবুজাভ বর্ণনা, সেই কবিরই জীবন কেন এমন ধূসর? বিভিন্ন বেশে আবারো বাংলার বুকে জন্মাতে চাওয়া কবির জীবনে এমন কী ঘটলো, যার কারণে ট্রামলাইনের নিচে নিজেকে সঁপে দিলেন?
বইটা শেষ করার পর মনটা অদ্ভুতরকমের বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। একজন মানুষ কখন আত্মহত্যা করে? যখন দেয়ালে তার পিঠ ঠেকে যায় তখন? এরজন্য কি আশেপাশের মানুষ একটু হলেও দায়ী না? অবশ্য জীবনানন্দ আসলেই আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি সেটা একটা দূর্ঘটনা ছিল- এটা এখনো ধোঁয়াটে। তবুও তাঁর ডায়েরির পাতায় লেখা সাংকেতিক লাইনগুলো দেখে মনে হচ্ছিল সমাজ তাঁর প্রতিভাকে বুঝতে পারেনি। ব্যক্তিজীবন-সংসারজীবন-পেশাজীবন সব মিলিয়েই তিনি হতাশ। মাঝে মাঝে 'শোভনা' নামের পুরোনো ক্ষতটাও দগদগে হয়ে ওঠে। এত এত অপ্রাপ্তির ভার তিনি একদমই বইতে পারছিলেন না। জীবনস্পৃহা শূন্য হয়ে যাওয়ার কারণেই ধীরে ধীরে মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল।
এমনকি নিজের জীবনের কাহিনীও উপন্যাসের মোড়কে লিখতেন তিনি। সেগুলো পড়লেই তাঁর ব্যক্তিজীবনের তিক্ততা-গ্লানি-হতাশা-করুণ কাহিনীগুলো খুব সহজেই চোখে পড়তো। তাঁর সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকেরা যেভাবে তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন, সেটা জানতে পেরে বেশ খারাপই লেগেছে। 'ঝরা পালক' এর মতন তিনিও ঝরেই পড়লেন।
শাহাদুজ্জামানের বর্ণনাশৈলী চমৎকার। মুগ্ধ হয়েই বইটা শেষ করেছি। উনার ভাষাশৈলী একদম মৌলিক, পড়ে শান্তি পাওয়া যায়। এটাকে ঠিক ফিকশন বলা যায় না, তাই বলে পড়ার সময় একটুও একঘেয়ে মনে হয়নি। ধীরে ধীরে মন খারাপ হয়েছে, মাঝে মাঝে সুখের সন্ধান পেয়ে মনটা উদ্বেলিত হলেও দমকা হাওয়ার মতন আবারো বিষণ্ণতা গ্রাস করে নিয়েছে। বইটি পছন্দের তালিকায় যোগ হল।
আপনি যদি জীবনানন্দকে জানতে চান, তাঁর লেখার পেছনের কাহিনীগুলো সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে বইটি পড়ুন। আর যদি জীবনানন্দকে নিয়ে আপনার আগ্রহ নাও থেকে থাকে, তবুও আমি অনুরোধ করবো বইটি পড়ার জন্য। জীবনে একটু হলেও ভাঙা বাশির করুণ সুর শুনতে পাওয়া উচিত, তাই না?
“একবার যখন দেহ থেকে বা’র হয়ে যাব আবার কি ফিরে আসবো না আমি পৃথিবীতে? আবার যেন ফিরে আসি কোনো এক শীতের রাতে একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে কোন এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।”
শৈশব আর কৈশোরের অফুরন্ত সেই মায়ায় বেড়ে উঠছিলো তার ভেতরের আসন্ন বিপদের চারাগাছটি।
জীবনানন্দের ক্ষোভ ছিলো 'ম্যাডিওক্র্যাসি' নিয়ে। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিন্মের যে দোলাচাল—সে পথে পা না বাড়িয়েও সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে বার বার। সঙ্গে চাকরিচ্যুত হয়েছেন অসংখ্যবার। নৈরাশ্যবাদী, অবৈধ, মাতাল—একের পর এক খেতাব মিলেছে তার। তিক্ততা এসেছিলো বারেবারে তবে সেসবকে তোয়াক্কা না নিয়ে বরং একের পর এক সৃষ্টি করে গেছেন ধাঁধায় আঁটানো অন্য এক অচেনা পৃথিবীর করুণ সুন্দর সমস্ত রুপ। অন্তিমকালে কিছুটা সম্মান, মর্যাদা জুটেছিলো কিন্তু 'মানুষটা মরে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি কেউ দেয়—বিনি দামে—তবে কার লাভ—'
বারেবারে আঁকড়ে ধরেছেন প্রকৃতিকে; নর-নারীর প্রেম, সংসারের যাবতীয় ক্লেশকে পেছনে ফেলে। হোক বিপ্লবী সমাজতন্ত্র কিংবা পুঁজিবাদের সূচনা—যেকোন বিষয়ে অতি বিশ্বাস আর অতি অতিবিশ্বাস দুটোই পরিহার করতে চেয়েছিলেন তিনি। ফলশ্রুতিতে দুদিক থেকেই আক্রমণের শিকার হয়েছেন ক্রমাগত। স্বভাবে অন্তর্মুখী জীবনানন্দ লিখেছেন কেবল নিভৃতে। নির্জনতার শেষ প্রহরে সৃষ্টি করেছেন শব্দের পিঠে শব্দদের জাদুকরী বলয়। সে বলয়ে একবার প্রবেশ করলে মনে হয় হাজার বছর ধরে মরে যেতে থাকি। যেন মরণের আগে মরে যাওয়ায় এক ধরনের নিগুঢ় মাদকতা আছে।
স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ, জন্ম আর মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থানে পায়চারি করেছেন। ছিলেন বিরল আর বিশুদ্ধভাবে ব্যর্থ। জেগেছেন বিপন্ন বিস্ময়ে। লিখেছেন, 'আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়, দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল...
অথবা, 'আমরা যাইনি ম'রে আজো—তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়: মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;' জীবনানন্দের 'ঘোড়া' কবিতাটাই বাংলায় 'সুররিয়ালিস্ট' কবিতার প্রথম সফল উপাদান।
নিষ্প্রভ জীবনানন্দের সঙ্গে নিবিড় বোঝাপড়ায় কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। তবে কমলালেবুর খোসা ছাড়ানোর মত করে উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন যারা জীবনানন্দকে—আদৌ কি তা পুরোপুরি সম্ভব হয়েছে? নিঙড়ে পড়তে চেয়েছিলেন যারা—কিই বা আছে এই জীবনানন্দে, জীবন এবং আনন্দের মাঝে? যিনি এসেছিলেন বসন্তের কৃষ্ণচূড়া হয়ে তাকে কেন হেমন্তের কুয়াশায় ঝরে পরা শিউলীর মত ঝরে যেতে হলো? হয়তো আমরা কোনদিন জানতে পারিনি নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, বুঝতে পারিনি সোনালি মেঘের ভেতরে অদৃশ্য হতে হতে তিনি কখন খয়েরী শালিকের ডানায় ভরে উড়ে গেলেন, হয়তো সবটুকু জানে ঐ বিকালের রোদে রক্তাপ্লুত ট্রামটি। ধেয়ে এসে সরীসৃপের মত গিলে খেয়েছিলো যে নির্জনমত বিষাক্ত সমস্ত বিষাদটুকু তার...
জীবনানন্দের মতো বিশেষ কবিকে এতো কাছ থেকে প্রথমবারের মতো জানলাম। সে হিসেবে এই বইকে বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শাহাদুজ্জামানের লিখার ভঙ্গিমার একপ্রকার ভক্তই বলা চ��ে। জীবনবাবুর বিষাদময় পথচলার কথন শাহাদুজ্জামানের লিখায় তীক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে। কবির অন্তর্মুখী জীবনের প্রতিটি বেদনার সাথে জুড়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো যেন এ হতাশা, ব্যর্থতা এবং অস্থিরতা নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি নিজেই।
শাহাদুজ্জামানের কোন বইটা রেখে কোন বইটাকে সেরা বলব? ওনার সবই সেরা আসলে। 'আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সাথে', 'কয়েকটি বিহ্বল গল্প', 'একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়'; মানে কোনটাকে বাদ দেব?
এ বইটাও দারুণ। জীবননান্দকে নিয়ে জানতে এই বইয়ের কোনো তুলনা হয় না। আর সেই সাথে বায়োগ্রাফিতে সুন্দর গদ্যশৈলীর ব্যাপার তো আছেই।
এটারে কেউ উপন্যাস দাবী করলে তার বিচারবুদ্ধি সম্পর্কে আমার প্রশ্ন জাগবে। এটারে জীবনী গ্রন্থ হিসাবেই বিবেচনা করা উচিত।
জীবনী গ্রন্থ হিসাবেও বইটা ভাল না। এরকম একটা বই লেখতে তিরিশ চল্লিশটা বই পড়াই যথেষ্ট। এমন কিছু বর্ণনা পাইলাম না, কিচ্ছুই পাইলাম না।
এত বছর ধরে এই চরাচরে জীবনানন্দ চর্চিত হবার পরে এরকম একটা বই আসলে ট্র্যাশবক্সে পড়ে যাবে। আরে ভাই আমি কি ক্যাম্পে, আট বছর আগের একদিন, বনলতা সেন, হাওয়ার রাত এগুলার কাহিনী শুনব নাকি আবার?
বইটায় লেখক আরেকটু পরিশ্রম করতে পারতেন। জীবনানন্দের কম পরিচিত ভাল কবিতাগুলা তুলে আনতে পারতেন। শেষের দিকে কিছু কম পরিচিত কবিতা আনতে চেয়েছেন, কিন্তু সেগুলা ভাল না।
জীবনানন্দ কবি, তার কবিতা ভাবনা খুব কম এসেছে। বিরক্ত হয়েছি।
জীবনানন্দের কবিত্ব টা আরেকটু ফুটিয়ে তুলতে পারলে ভালো হতো। কবিতা রেখে গল্প উপন্যাস নিয়ে একটু বেশিই গ্যাজানো হয়ে গেছে মনে হলো। উনার আরো কিছু অল্প পরিচিত ভালো ভালো কবিতা আছে, যেগুলো ফোকাসে নিয়ে আসলে আরও ভালো লাগতো। শুধু ঘুরে ফিরে সেই বনলতা সেন, আট বছর আগের একদিন, বোধ, ক্যাম্পে নিয়েই বেশি বেশি কথা হলো। বাকি আন্ডাররেটেড কবিতা গুলোও তো ফোকাস ডিসার্ভ করে।
মনে পড়ে, যখন কবিতা পড়তাম তখন শুধু জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়েই সময় কাটতো। আমার পাঠক জীবনে একজনই কবি। শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ। কতবার যে পড়েছি 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটি তার হিসেব নেই। নিজের ভেতর অদ্ভুত এক ভ্রম খেলা করতো জীবন বাবুর কবিতা পড়ার সময়। তাই যখন শুনলাম জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান লিখিত প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনী ভিত্তিক উপন্যাস "একজন কমলালেবু" এই বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে প্রথমা থেকে, কিছুটা আবেগের বশবর্তী হয়েই সেটা কিনে ফেললাম। তারপর শুরু হলো একটু একটু করে আমার কমলালেবুর স্বাদ গ্রহনের পালা।
সব্যসাচী লেখক, কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর এক প্রবন্ধে কবি জীবনানন্দ দাশকে উল্লেখ করেছিলেন 'নির্জনতার কবি' নামে। কবি জীবনানন্দ ব্যক্তিগত জীবনে হয়তো নির্জনতা ভালবাসতেন, কিন্তু তাঁর কবিতাকে কখনো কখনো নির্জনতার কবিতা ভাবতে আমার ভ্রম হয়। জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের 'একজন কমলালেবু' গ্রন্হখানা পড়ে জীবন বাবু যে তাঁর সাহিত্যকর্মে অন্তত নির্জনতার কবি ছিলেন না আমার সেই ভাবনা আরো পাকাপোক্ত হলো। নির্জনতার কবি জীবনানন্দের কলম থেকেও বের হয়ে এসেছে অনেক অনেক কোলাহলমুখর কবিতা। কবিতার ব্যাখ্যাগুলো না পড়লে হয়তো সেটা জানাই হতো না।
আপন সাহিত্যকর্মের ভেতর দিয়ে একজন সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত জীবনকে খুঁজে ফেরা। আপন কবিতার অন্তর্গত আত্মার প্রতিফলন দিয়ে একজন কবির জীবনকে ব্যাখ্যা করা। জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে শাহাদুজ্জামান সেই গবেষনা তাঁর 'একজন কমলালেবু' গ্রন্হে সফলতার সাথেই করেছেন বলা চলে। তাই মাঝে মাঝে গ্রন্হখানাকে উপন্যাস থেকে আরো বেশী কিছু মনে হয়েছে।
কখনো তা হয়ে উঠেছে কবি জীবনী, কখনো সাহিত্য সমালোচনা, কখনো ব্যাখ্যা গ্রন্হ, কখনো বা আবার গবেষনা গ্রন্হ। একজন কবির ব্যক্তিগত জীবনের ও সমসাময়িক নানা ঘটনা কিভাবে তাঁর সাহিত্যকর্মকে প্রভাবিত করে তাই ছিলো যেন গল্পের মূল উপজীব্য। রাজনীতি, দূর্ভিক্ষ, বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম দান্গা, প্রেম-ভালবাসা-ঘৃণা, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের নানা সম্পর্কের টানা-পোড়েন, মনস্তাত্বিক নাগ-পাশ সবই পরিণত হয়েছে তার গল্প-কবিতা-উপন্যাসের বিষয়ে। কখনো সেসব হয়ে উঠেছে কবিতার উপমা-চিত্রকল্প-প্রতীক, কখনো বা গল্প উপন্যাসের প্লট।
উপন্যাসের সার্থেই গল্পে উঠে এসেছে জীবনানন্দের সমসাময়িক আরো নানা বাস্তব চরিত্র। কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ভূমেন্দ্র গুহ, অচিন্তকুমার, কে নেই এ গ্রন্হে? তারা কেউ কেউ জীবনানন্দের জীবনে বন্ধু অথবা শত্রু হিসেবে দেখা দিয়েছেন, কখনো হয়েছেন সমব্যথী, প্রতিযোগী, কঠোর সমালোচক, সাহায্যকারী। রক্ত-মাংশের জীবন্ত চরিত্রগুলোকে লেখক বেশ সততার সাথেই তাঁর উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন আশা করি।
উপন্যাসের নামকরণ নিয়ে পাঠককে বেশ দ্বন্ধে পড়তে হয়। লেখক কবি জীবনানন্দ দাশকে 'একজন কমলালেবু' নামে কেন অভিহিত করলেন সেটা প্রথম থেকেই এক রহস্য পাঠকের কাছে। উপন্যাসের একেবারে শেষে এসে বইয়ের এহেন নামকরণের রহস্য পাঠকের কাছে উন্মোচিত হয়। কবির 'কমলালেবু' কবিতাটি এখানে পাঠ করা যেতে পারে,
"একবার যখন দেহ থেকে বা’র হ’য়ে যাব আবার কি ফিরে আসবো না আমি পৃথিবীতে? আবার যেন ফিরে আসি কোনো এক শীতের রাতে একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস হয়ে কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।" - [কমলালেবু, জীবনানন্দ দাশ] - কবি তার 'কমলালেবু' নামক কবিতায় তাঁর মনোবাসনা ব্যক্ত করেছেন। মৃত্যুর পর তিনি কমলালেবু রূপে পুনরায় এই মর্ত্যে ফিরে আসতে চান। মূলত সে কারণেই উপন্যাসটির এহেন নামকরন। যদিও কবিতাটির বক্তব্য রীতিমতো অযৌক্তিক। পৃথিবী ছেড়ে একবার চলে গেলে আর ফেরত আসার কোন উপায় নেই। অথচ কবি এখানে মৃত্যুর পর পুনরায় কমলালেবু রূপে ফিরে আসার বাসনা ব্যক্ত করেছেন। যা নিতান্তই কবির অযৌক্তিক বাসনা। তবে কবিতাকে যুক্তি মেনে চলতে হবে এ কথারও কোন যৌক্তিকতা নেই। কবিতা সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি যৌক্তিক হবার শর্ত থাকলেও, এর বক্তব্য যৌক্তিক হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সৃষ্টির প্রক্রিয়া আর সৃষ্ট বস্তুর মাঝে এই পার্থক্য আমাদের অনেকেরই বোধগম্য নয়। আর এজন্যই- সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।
শাহাদুজ্জামানের লেখনী বরাবরের মতোই সহজ, সরল, প্রাণবন্ত। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে লেখক প্রায় জোর করে এটাই পাঠককে ভাবাতে চেয়েছেন যে, জীবনানন্দ ট্রামের নীচে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। যদিও ব্যক্তি জীবনানন্দের জীবনের নানা ঘটনা পাঠককে তেমনটা ভাবাতেই কিছুটা বাধ্য করবে। যাই হোক, কবিতা প্রেমী-অপ্রেমী সকলেরই বইখানা একবার হলেও পড়ে দেখা উচিত। দুর্দান্ত পাঠ।
কিছু মানুষের জীবন হয়তঃ এমনি, সুখ পাখিটার হয় নাকো দেখা! দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রাম লাইন পার হচ্ছেন কবি, কিছুক্ষণ পরে প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে কবি কলকাতার ট্রাম লাইনের পাশে পড়ে আছেন, পাশে চায়ের দোকানদার চূণীলাল দৌড়ে আসছেন কবির দলিত শরীর লক্ষ্য করে - যতবার এই দৃশ্যটার কথা আমার মনে পড়ে ততবার নিজেকে ধিক্কার দেই বাঙালি হিসেবে জন্মগ্রহণ করার জন্য। মা-ছেলে মিলে এ জাতিকে দুহাত ভরে দিয়েছেন আর বিনিময়ে এ জাতি দিয়েছেন অভাব, অর্থকষ্ট, লাঞ্চনা আর হতাশা; এরকম অসাধারণ জিনিয়াস একজন মানুষের একটা চাকরি ব্যবস্থা হয়নি! জাতি হিসেবে আমরা কতটা দৈন্য এটা তার একটা প্রমাণ। কুসুমকুমারী দাশের কোলে বরিশালে জন্মেছিলেন কবি, মাতা অনেক আদর করে নাম দিয়েছিলেন মিলু। মাতা অনেক আদর্শ আর বিদ্যানুরাগী করে বড় করেছিলেন বড় ছেলেকে। ঈশ! এতটা আদর্শবান হিসেবে বড় না করে আর দশজন বরিশালের মানুষের মত চতুর করে বড় করতে পারলে হয়ঃত কবিকে এই দুনিয়ায় এই কষ্ট সহ্য করতে হত না।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. পাশ করেছিলেন; সিটি কলেজে লেকচারার হিসেবে চাকরিও পেয়েছিলেন। কিন্তু দেশে এসে বিয়ে করলেন ইডেন কলেজের মেয়ে লাবণ্য দাশকে। চাকরি হারালেন বঊয়ের সাথে কয়েকটা দিন বেশি থাকার জন্য; যদি জানতেন জীবনে আর কোনদিন চাকরি পাওয়া হবে না তার! আর দশজন বরিশালের মানুষের মত চতুর হতে পারেন নি দেখে শেষে নিজের জীবনসঙ্গিনীও করতে শুরু করলেন উপেক্ষা, পারেন নি নিজের সন্তানগুলির কাছে রেখে মানুষ করতে! (Continue......)