স্বাভাবিকভাবেই ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু করার আগ থেকেই, বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কি চোখে দেখেছিল ১৯৭১-এর মার্কিন প্রশাসন? মার্চ থেকে ডিসেম্বর- এই নয় মাসে ভারত- পাকিস্তান- 'বাংলা দেশ' ঘিরে মার্কিন প্রশাসনে কী আলোচনা চলছিল? পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক-সামরিক সহায়তা, ভারতকে চোখে রাখা, 'বাংলা দেশ'কে স্বীকৃতি- এসব বিষয় কিভাবে সামলানোর কথা ভাবছিল তারা? এসব প্রশ্নের জবাব রয়েছে সেই সময়কার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দলিলপত্রে। পররাষ্ট্র দফতরের সেইসব দলিলপত্র ২০০৫ সালে গোপনীয়তামুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মার্কিন অধ্যায় যে কেউ সহজেই জানতে পারেন এখন। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই যে, ইংরেজি ভাষার ওইসব দলিলপত্র, যা কিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সম্পূরক, বাংলা ভাষায় সবার জন্য সহজপ্রাপ্য নয়। এই ভাষান্তর সেই অনিবার্য ইতিহাস সবার কাছে পৌছে দেয়ার একটি চেষ্টা।
প্রথম কথা, এক কথায় কূটনীতির একটি শক্তিশালী কৌশল হল "hang on!" দ্বিতীয় কথা, পররাষ্ট্র আমার চিন্তার আওতার প্রিয় বিষয় এটি এই প্রথম টের পেলাম। আমি কৌশলগুলোকে সৎ-অসৎ, নৈতিক-অনৈতিক বিবেচনায়ই দেখি নাই। এখানে সম্পূর্ণই বিশ্লেষণী ক্ষমতা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতার সম্পাদ্য পড়েছি। কিসিঞ্জারকে ঘৃণিত হিসেবে পরিচিত করা হয় স্বাধীনতাত্তোর বাংলা সাহিত্যে। আমি তো বলব, তাতে কিসিঞ্জারের কী? সে তো বাংলার লোক ছিল না। তার রাষ্ট্রের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে তার মত-ই বলি কৌশল-ই বলি, তৃতীয় পক্ষ থেকে দোষের কিছু দেখি না। জাতীয় রাজনীতি কি বিশ্বরাজনীতি, এখানে নিরপেক্ষ বলে কিছু তো নাই, নিরপেক্ষতার আড়ালেও ঘাপটি মেরে থাকে সাপেক্ষ।
ইতিপূর্বে যত ১৯৭১ এর পটভূমি-পরিণতি পড়েছি সবই এপক্ষের লেখা। অথবা এপক্ষের বিশ্বাসঘাতকদের লেখা। অ্যান্থনী মাসকারেনহাসের একটি বই অর্ধেক পড়েছি, সেটিও বেশ পছন্দ হয়েছে। তৃতীয় পক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বইয়ে ঘটনার প্রেক্ষাপটের সাথে গুরত্বের হিসেবী লেনাদেনা পরিলক্ষিত।
বইটি সরলতায়, নথির প্রাসঙ্গিক অংশ বাছাই করে লেখা। উনিশশো একাত্তরে দক্ষিণ এশিয়ার আরো যেসব রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ঘটনা, স্বার্থ নিয়ে মূল নথিতে ছিল তা উল্লেখিত হয়নি। মানে হচ্ছে বইটির নামের ভেতরকার অর্থ হল মার্কিন নথিতে পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তান সংক্রান্ত কূটনীতিক পরিস্থিতিসমূহ। এটি বলার কারণ, আমরা যেমন ফ্যান্টাসিতে ভুগে বলে ফেলি ৭১ এ পাকিস্তানের ভাঙনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া আমেরিকার যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিত-- এটা সম্পূর্ণ আমাদের অপরিণত আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
মার্কিনীরা ২০০০ সালে পূর্ব-বাংলায় জনসংখ্যা কত হতে পারে তাও হিসেব করেছে। তাদের কিছুই পাওয়ার মত ছিল না পাকিস্তানের কোনো অংশ থেকে। কিন্তু স্বল্পকালীন ঝুঁকির উপরে তারা দীর্ঘমেয়াদী সুবিধার চিন্তাকে স্থান দিয়েছে। That was their "hang on" policy: কোনো দিকেই স্পষ্টভাবে যামু না। তাইলে দুইদিকেই আমার অপশন থাকে। কী বিটকেল! এই বিচক্ষণতার কাছে আমি মুগ্ধ। শেষ কথা, এটা শুধু কূটনীতি না, বাণিজ্যনীতি ও আন্তর্জাতিক খেল কিভাবে বৃহত্তর স্বার্থে জিইয়ে রাখতে হবে তারও ব্রেইনস্টর্মিং। চাতুর্য্যপাঠ। Have a read!