প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথার নাম দিয়েছেন "ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা "। ১৯৭৫ সালে পাড়ি জমান বিলাতে।সল্পসময়ের জন্য ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরলে লিখতে শুরু করেন এই আত্মজীবনী খোলসে স্মৃতিময় সময়ের কথা।
পৃষ্ঠা হিসেবে তা ৫০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু গতি থামনি কোথাও।
'৯৩ সালে দেশে ফিরলেন দীর্ঘ ১৭ বছর পর। কত পরিবর্তন হয়েছে স্বদেশে। সেই পরিবর্তনের সূত্রধরে শোনাতে লাগলেন নিজের কর্মময় জীবনকথা। জন্মেছিলেন বরিশালের উলানিয়ার এক মুসলমান পরিবারে। সে কিন্তু ভারতভাগের আগের কথা। জন্ম, বেড়ে ওঠা কিংবা কর্মজীবন এমন কোনো প্রচলিত সিরিয়াল মানতে চান নি গাফ্ফার চৌধুরী। কখনো নিজের স্কুলের গল্প বলেছেন । আবার সাথে সাথেই ফিরে গিয়েছেন রোমাঞ্চকর সাংবাদিক জীবনে।
লেখালেখির হাতেখড়ি স্কুল জীবনেই হয়েছিল। আর থামাথামি দেননি। আবার স্কুলের শিক্ষার্থী থাকাকালেই শুরু করেছিলেন তাঁর পরম আরাধ্য পেশা সাংবাদিকতা। ৫০ সালে মেট্রিক পাশ করে নিজ খরচায় পড়তে আসেন ঢাকা কলেজে। সেই থেকে জীবন সংগ্রামের ঝাপিয়ে পড়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন বাংলায়। ছিলেন ঢাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়কও।আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ এসবেই কাজ করেছেন তিনি। সান্নিধ্য পেয়েছেন কিংবদন্তি সব সাংবাদিকদের, স্নেহ পেয়েছেন, বকাও খেয়েছেন। পরিচিত হয়েছেন কতশতো লোকের সাথে। তাঁরা অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত।
নিজের বন্ধুদের নিয়ে চমৎকারসব স্মৃতি সানন্দে লিখে গিয়েছেন পাঠকের জন্য। সেই বন্ধুদের দলে এমকে আনোয়ার, জহির রায়হান,ফয়েজ আহমেদ,আনোয়ার জাহিদ, আখতার মুকুলসহ আরো অনেকে।
নিজের হৃদয়ভাঙার দুঃসহ যন্ত্রণার কথা লিখতে গিয়ে বলে দিয়েছেন বিখ্যাতসব ব্যক্তির ঘরের ভেতরকার কথা। এসব পড়তে গিয়ে বেশ মজাই লাগছিল।আবার মন খারাপও হচ্ছিল লোকের ভন্ডামো আর কুটিল বুদ্ধির খেল দেখে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পঞ্চাশের দশকেই পরিচয় হয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর। সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠাতায় কীভাবে রূপ নিয়েছিল সে স্মৃতি পাঠকের জন্য এক বিশেষ আকর্ষণ। মুজিব নেতা হিসেবে কেমন ছিলেন তা সাংবাদিক হিসেবে কতটা ভালো জানতেন সেই পরিচয়ও পাই লেখায়। সংবাদকর্মী গাফ্ফার চৌধুরী পেশাগত কারণে তৎকালীন রাজনীতির হাড়ির খবর রাখতেন। সে খবর পাঠককে শুনিয়ে দিতে অবাক করে দিতে চেষ্টার কসুর ছিল না।
মওলানা ভাসানী জানতে চেয়েছিলেন "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফ্রেব্রুয়ারি" গানের ইতিহাস। সেই গল্পতো দারুণ চমক পাঠকের জন্য।
আবারও, শেখ মুজিবুর রহমান। সারা বইতে তাঁকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন লেখক। তাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের রাজনৈতিক আত্মত্যাগের অনেক কথা উঠে এসেছে।মুজিবের প্রতি বাঙালির ভালোবাসার নিদর্শনে অনেক ঘটনার সাক্ষী নিজে। একটি ঘটনা একাত্তরে কলকাতায় জনৈক কলিকাতার হিন্দু রমণী কর্তৃক পূজার ঘটনা বেশ মনে আছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্য পুজো দিচ্ছিলেন। আবার, শেখ মণির সাথে তাঁর মতবিরোধ ও স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ার ইঙ্গিতপূর্ণ ঘটনা তো ছিলই।
গল্প লিখেয়ে, কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক কিংবা কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মোটামুটি বিশাল স্মৃতিকথা বেশ গতিময় তো বটেই সুলিখিতও।
কিন্তু বানান ভুলের মহড়া লেখাকে অনেকটা নষ্ট করে পাঠকের আনন্দকে মাটি করবার চেষ্টার কমতি দেখি নি -তা এই বইয়ের বড় দুর্বলতা বলেই মনে হয়েছে। আর, লেখকের নিজস্ব মতাদর্শকে উপস্থাপন করতে গিয়ে অপরের চিন্তা ও আদর্শকে 'সরাসরি ' আক্রমণে ভ্রু মাঝেসাঝে কুঞ্চিত হয়েছিল।