"মহাস্থবির জাতক" আক্ষরিক ও রূপক দুই অর্থেই মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ। চার খণ্ডে ব্যাপ্ত এই আত্মজৈবনিক রচনায় ব্রিটিশ আমলের একটি নির্দিষ্ট সময়কে (১৮৯৫/১৮৯৬-১৯০৮/ ১৯১০) অক্ষয় করে তোলা হয়েছে। প্রথম খণ্ডে আছে স্থবিরের স্কুল ও পারিবারিক জীবনের বর্ণনা।স্থবিরের পরিবার ছিলো ব্রাহ্ম। লেখকের বাবা ছিলেন আদর্শবাদী। সেই আদর্শ এতো নিরেট, এতো স্থির ছিলো যে এর ব্যত্যয় ঘটলেই সন্তানদের তিনি অমানুষিক নির্যাতন করতেন। অথচ তিনি মোটাদাগে খারাপ মানুষ ছিলেন না।অটল আদর্শের উৎকট উদাহরণ হিসেবে বাবার চরিত্রটি অবিস্মরণীয়। বাবার নির্যাতন, বিচিত্র স্কুলজীবন ও ততোধিক বিচিত্র নির্যাতনপ্রিয় শিক্ষক, পাগলা সন্ন্যাসীর কাছে ইংরেজি কবিতা পাঠ ও জীবন দর্শন লাভ, বাল্যপ্রেম ও বিচ্ছেদ সবই লেখকের ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিলো।
দ্বিতীয় খণ্ড জুড়ে আছে লেখকের পলাতক জীবনের বর্ণনা। ঘটনাবহুল এ পর্ব উপভোগ্য হলেও অতিনাটকীয়। অনেক নাটকীয় ঘটনার কারণে এ পর্বের ঘটনাপ্রবাহ আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে তা নয় কিন্তু ঘটনা পরম্পরা এতো বেশি নিয়ম মেনে সময়মত ঘটেছে যে তা পুরোপুরি বিশ্বাস করা শক্ত।
তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব জুড়ে বারবার পলায়ন ও আক্ষরিক অর্থেই মাটি কামড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যে সংগ্রাম বিধৃত হয়েছে তাতে লেখককে শ্রদ্ধা না করে উপায় নেই।এতোবার এতো জায়গায় এতোভাবে অপমানিত হয়েছেন, এতোবার না খেয়ে থাকতে হয়েছে, এতোবার ভাগ্য প্রতারণা করেছে- তারপরও লেখক আশা ছাড়েননি। এই দুই খণ্ডে বর্ণিত ঘটনায় রোমাঞ্চ, হাসি, বেদনা, সেই সময়ের মানুষের মনের অবস্থা, সামাজিক কাঠামো ও জীবনব্যবস্থার যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা বিস্ময়কর ও মূল্যবান।
বইয়ের ফ্ল্যাপে "মহাস্থবির জাতক" সম্পর্কে লেখা আছে এটি "মানুষের উপন্যাসোপম ইতিহাস।" বই পড়ে অবশ্য আমি নিশ্চিত নই এটি উপন্যাসোপম ইতিহাস নাকি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস! লেখক অবলীলায় এমন কিছু মিথ্যাচার করেছেন যে, এই দুর্দান্ত লেখাটির মান তো ক্ষুন্ন হয়েছেই, সাথে বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যেমন- তিনি এমন এক ভূতুড়ে বাসায় থেকেছেন যেখানে পাশের ঘরে আপনা আপনি বালব জ্বলে উঠতো, বিচিত্র শব্দ হোতো, কমোড নিজে নিজে লেখকের ঘরে চলে আসতো। আরেকবার এক "সাধক" সাধনা করে পাশের বাড়ির কবুতর সম্মোহিত করে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কারো মৃত্যুর আগে তার আশেপাশে এক অদৃশ্য বৃদ্ধকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষমেশ আমি বইটিকে আত্মজৈবনিক "উপন্যাস" হিসেবেই পাঠ করেছি।
সব মিলিয়ে পাঠের অভিজ্ঞতা মিশ্র হলেও "উপন্যাস"টি অবশ্যপাঠ্য। প্রায় ছয়শো পৃষ্ঠার এই বই পড়তে যেয়ে একবারও বিরক্ত হইনি, সেটাও দ্রষ্টব্য।
বছরের শুরু থেকে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর এই বিশাল সাইজের আত্মজীবনী পড়া শুরু করি। চার খণ্ডে ভাগ করা এই বিশাল আত্মজীবনী গল্প উপন্যাসকে হার মানায়। লেখক ছোট বয়সে বাসা থেকে পালিয়ে পথে পথে ঘুরে জীবনে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তাই লিখে গেছেন। কি অসামান্য সেই অভিজ্ঞতা, আর কি তার বর্ণনাশৈলী! সবথেকে ভালো লাগে লেখকের জীবনের সাথে নানা ভাবে জড়িয়ে থাকা মানুষদের বর্ণনা। আজকালকার দিনে এমন মানুষ দেখা যায় না বলেই বোধহয় এই আত্মজীবনী গল্প উপন্যাস মনে হয়। লেখকের জীবনের সাথে জড়িত মানুষগুলো ভুলবার মত নয়। এমন চমৎকার স্মৃতিকথা সবার জন্য অবশ্য পাঠ্য। ছোট্ট বন্ধু আসমাকে ধন্যবাদ। বইয়ের খোঁজ না দিলে এই মাস্টারপিস পড়াই হইত না।
বছরের শেষের দিকে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর আত্মজীবনী ‘’মহাস্থবীর জাতক’’ পড়ার সিদ্ধান্ত ছিলো অত্যন্ত সৃজনশীল একটা সিদ্ধান্ত । উনি তার পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের খুঁটিনাটি অনেক ঘটনা প্রায় হাজার খানেক পৃষ্ঠার মধ্যে উল্লেখ করেছেন । ভদ্রলোক পিতার অত্যাচার ,ইস্কুলের একঘেয়েমি মার্কা পড়াশোনা এবং পৃথিবীর কিছু গুরত্বপূর্ণ ও অগুরত্বপূর্ণ নির্মমতার স্বীকার হন খুব অল্পবয়সেই । এক পর্যায়ে বুঝতে পারেন এই চার দেয়ালের ঘরে নিজেকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় সুতরাং নিজেকে পেতে হলে , চিনতে হলে বেড়িয়ে পড়তে হবে……এই বিশাল জাগতিক আয়োজনের মধ্যে মিশে যেতে হবে । মাত্র তেরো , চৌদ্দ কিংবা পনের বছর বয়সে এক ভোরবেলায় বন্ধুর সাথে বেরিয়ে পড়েন । এরপর কাশি , ভরতপুর , বোম্বে , আগ্রা এরকম নানা জায়গায় ঘুরে ফিরেছেন । নানা ধরনের মানুষের সাথে মিশেছেন , জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষা পর্যন্ত করতে হয়েছে । লেখক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী , আজ থেকে প্রায় বহু বছর আগে আপনি অনেক অনেক বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এই গ্রহ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ যে আমাদের জন্য সেসব রোমাঞ্চকর কাহিনি গুলো লিখে গিয়েছেন অল্পবয়সে একটা গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু মানুষের নানা ধরনের আবেগীয় যুক্তিতে খটকা লেগেছে , পরে নিজেকে প্রশ্ন করেছি আসলে ওদের কথাই কি সত্যি ! সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করা কি বড় একটা ভুল হবে তবে ! প্রেমাঙ্কুর মশায় সেই খটকা দূর করেছেন । আসলে কিছু বই আছে যেগুলো লেখার পর তা আর জড় পদার্থ থাকে না । তার থেকে হাত , পা , মাথা , চোখ , কান , হৃৎপিণ্ড সব গজাতে থাকে । একসময় বইটি একটা পরিপূর্ণ আদর্শ বইতে রূপান্তরিত হয় । স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গওয়ালা বই গুলো কৃপণ প্রকৃতির হয় না, সুতরাং এদের আপনাকে কষ্ট করে নিজের ভেতর ধারণ করতে হবে না । এরা নিজেরাই আপনার ভেতর এদের জায়গা করে নিবে এবং এদের মাধ্যমে আপনার চোখের সংখ্যা বাড়বে , কানের সংখ্যা বাড়বে , হাতের সংখ্যা বাড়বে , পায়ের সংখ্যাও বাড়বে ……… কথায় বলে না যে, বইয়ের আলোয় আলোকিত হন ? এই জাতীয় বই গুলো কিন্তু আলোকিত করে না বরং একটা জমাট অন্ধকারের মধ্যে আপনাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় । অন্ধকারের মধ্যে আলো সৃষ্টি করার শক্তি দেয় । বলুন তো কোনটা ভালো ? আলোকিত করা নাকি আলো সৃষ্টি করার অনুপ্রেরণা দেওয়া ? তবে আমরা যে জীবন কে আসলে জীবন মনে করে চলে এসেছি সেটা যে বাস্তবিক জীবন নয় তা এই বই পড়ে বুঝতে পারলাম । সত্যিই তো ! কয়েকজন নির্দিষ্ট মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে একটা অদৃশ্য সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের সাথে শেষদিন পর্যন্ত কাটিয়ে দেওয়াটা আমার কাছে খুব সুখকর অথবা রোমাঞ্চকর মনে হয় নি ……… বেঁচে থাকতে আমার আপত্তি নেই কিন্তু বেঁচে থাকার এই চলমান পদ্ধতি আমি কোনভাবেই মানতে রাজী নই । আপনাদের জীবনযাপন করার যে ফর্মুলা সেটাকে আমি শ্রদ্ধা করি কিন্তু সমর্থন করি না,করবো না। আমি জানি তাতে কারু কিচ্ছু আসবে যাবে না; মানুষ নিত্যদিন একটা জায়গায় গিয়ে ঘাস খাবে তারপর অনুশোচনা করবে কেন খেতে গেলাম ! আবার আরেক স্থানে যাবে আবার ঘাস খাবে আবার অনুশোচনা করবে , আবার ঘাস ভক্ষণ আবার অনুশোচনা …… তাও বলি , ভালো রাখার পূর্বে ভালো থাকা জরুরি । যদি মনে করেন ভালো রাখার মাধ্যমেই ভালো থাকা যায় থাকুন কিন্তু দয়া করে এই আশা করবেন না যে যাদের ভালো রাখার মাধ্যমে আপনার ভালো থাকা নির্ভর করছে বলে আপ��ি মনে করছেন তারাও আপনার ক্ষেত্রে একই পথ অনুসরণ করবে । প্রত্যাশা হতাশার কারণ । প্রত্যাশা পরাজয়ের কারণ । প্রত্যাশা অপরাধবোধের কারণ । তাও যখন প্রত্যাশা করা ছাড়া কোন উপায় ই নেই তখন সেটা নিজের কাছ থেকে করাই কি শ্রেয় নয় ?
জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ম্যাগনাম ওপাস 'মহাস্থবির জাতক' পড়ে একথাই হৃদয়ে বদ্ধমূল হলো৷
ছ'শ পঞ্চাশ পাতার ঢাউস কেতাবে মহাস্থবির শর্মা তার তাল-উত্তাল জীবনের প্রথম পঁচিশ বছরকে ধরে রেখেছেন৷ নিজের জীবনকথা জাতকের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় সেইসব অমূল্য স্মৃতিকে অমলিনভাবে সাজিয়েছেন, যা তিনি পৃথিবীর পথে নিঃস্ব-কাঙালের বেশে বেরিয়ে অর্জন করেছেন৷
বাবা মহাদেব শর্মা অল্পেই রেগে কাঁই হয়ে যেতেন।তিন ছেলের ওপর তার ঝাল মেটাতেন৷ কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী লোক ছিলেন মহাদেব শর্মা। আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে ইংরেজ সেপাইকে ধরে পিটিয়েছিলেন। এক নারীকে কুপিয়ে মারছিল কতিপয় দুর্বৃত্ত, তাদের হাতে খালি হাতেই যুঝেছিলেন মহাস্থবির শর্মা। এমনই সৎ, সাহসী এবং রাগী পিতার পুত্র মহাস্থবির শর্মা।
কিশোর বয়সে দুষ্টমি আর পড়াশোনায় অমনোযোগীতার দরুণ পিতৃদণ্ড এবং প্রথম প্রেমের দাঁগাতে বাড়ি ছাড়লো মহাস্থবির। নেমে এল পথের ধূলিতে, পথের মানুষ হয়ে। অভিজ্ঞতার অশ্রুবারিতে পূর্ণ জীবনপাত্র ঢেলে দিল পাঠকের কাছে।
মানুষের মধ্যকার বৈচিত্র্যের সন্ধান পেতে মিশতে হয়। ঘুরতে হয়৷ লোকাচার, দেশাচারের ফারাক মানুষে মানুষে কম ফারাক তৈরি করে না৷ আবার সর্বদাই দয়ালু, মনুষ্যত্বসমৃদ্ধ লোকের স্বভাব এক। এতো মহাস্থবির শর্মা ভালোই জেনেছে।
ভিখারিদের সাথে রাস্তায় থাকার জায়গা নিয়ে মারামারি করেছেন, শূন্য পকেটে,ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন৷ বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ চেয়েছেন। ভাগ্য নিরাশ করেন নি৷ আবার সৌভাগ্যের সূর্য কখনোই স্থায়ী হয়নি মহাস্থবির শর্মার জীবনে।
রাজকুমারী, দিদিমণি, পরেশদা, হিমালয়ের আড়াইশ' বছরের সাধু, নবাব সাহেব, পিয়ারা সাহেব তো ভুলবার মতো মানুষই নন৷ কেউ ভোলে, কেউ ভােলে না - জাতক ভুলতে পারেন নি৷ মহাস্থবির জাতকের কথা যাঁরা পড়বেন, তাঁরাও আমারই মতো হয়তো দীর্ঘকাল মনে রাখবেন এই মানুষগুলিকে।
এত চমৎকার স্মৃতিকথা পুরো বাংলাসাহিত্যে ক'টা আছে করগুণে বলা দেওয়া যায়৷ এ তো এক অমূল্য সম্পদ। মহাস্থবির জাতককাহিনি অবশ্যপাঠ্য।
হ্যা, ভক্তিরসের আধিক্য আছে। বাস্তব - অবাস্তব নিয়ে প্রশ্ন মনে জেগেছে। কিন্তু মহাস্থবির শর্মার জীবনকাহিনিতে এক আশ্চর্য মুগ্ধতা লুকিয়ে আছে। পাঠক হিসেবে তা এড়িয়ে যাওয়া সাধ্যের বাইরে।
ছোটবেলায় বাড়ি থেকে পালানোর স্বাদ জেগে ওঠতো মাঝে মাঝে। যখন মাঝেমধ্যে বাড়ি এবং স্কুল থেকে চাপ খেতাম তখন ইচ্ছে হতো সাংসারিক জীবনকে পায়ে ঠেলে অন্য একটা জগতের দিকে পা বাড়াই। কিন্তু ঐ যে প্রবাদ আছে না? "ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়" আমার অবস্থাও খানিকটা তেমন। ঘর আর পালানো হলো না, তাই ঘরে বসে বসে স্বাদ নিই অন্যজনের ঘর পালানোর গল্প পড়ে। নিজের জীবনে তেমন বৈপরীত্য নেই, একঘেয়ে জীবন কাটাতে কাটাতে তখন পড়ি গত শতাব্দীর শুরুর দিকে বড় হওয়া এক লেখকের আত্মজীবনী। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী নামের মানুষটি আড্ডায় কিংবা বিভিন্ন স্থানে পরিচিত ছিলেন 'বুড়োদা' নামে। স্থবির(যদি বার্ধক্যহেতু জরাগ্রস্ত ও নিশ্চল, স্থির অর্থে বোঝানো হয়) নামে গল্পে তিনি অবতরণ করলেও বার্ধক্য তাকে কাবু করার আগে পর্যন্ত স্থির ছিলেন না জীবনের কোন পদে।
আমরা মানুষরা যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনই বৈচিত্র্যময় আমাদের জীবন সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময় আমাদের এই মন। আমরা মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করে বসি যেগুলো করার কথা হয়তো একটু আগেও ভাবতে পারি না। লেখক প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর জীবনের বাঁকগুলো তেমনই, নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ। পিতার অত্যাচার থেকে বাঁচতে নানান ভাবে পালাতে চেয়েছেন, প্রথমদিকে সফল না হলেও পরেরদিকে পালিয়ে পালিয়ে চলে গিয়েছেন বহুদূর। প্রথমবারের মতো সফলভাবে গৃহ থেকে চম্পট দিলেন পনেরো বছর বয়সে। এরপর থেকে এইঘাট ঐ ঘাট ঘুরে ঘুরে হয়েছেন বাউণ্ডুলে। জীবনকে চিনেছেন নানাভাবে। জীবনের সলতকে জ্বালিয়ে দিয়ে উপভোগ করেছেন নিজের দৈন্যদশা, সুখের কথা সবকিছু। এরপরে বৃদ্ধ বয়সে এসে যখন জাতক লিখতে বসলেন তখন এমনভাবে রচনা করে গেলেন যে সেখানে উঠে এলো জীবনের মার দেওয়ার গল্প, জীবনকে উপভোগ করতে করতে শেষ রসটুকু পর্যন্ত বের করে নেওয়ার কথা, এসছে নিজের দৈন্যদশার কথা কিন্তু সেই দৈন্যদশার আঁচড় পাঠকের মন আব্দি পৌঁছানোর সুযোগ দেননি। রসাত্মক আর কৌতুকরসে বাঙ্ময় করে দিলেন যে পাঠক তার সব দেখছেন কিন্তু উপভোগ করছেন রসাত্মক দিকটা। এরপরেও যেকোনো আড্ডা জমাতে সফল লোকটি আমাদের উপহার দিলেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি "মহাস্থবির জাতক"। আজকালকার দিনে এসে লেখকের বলা কিছু আধ্যাত্মিক কথা কিংবা ভুতে বিশ্বাসের মতো কিছু জিনিস হয়তো খাপছাড়া মনে হতে পারে, তবে তাতে জাতকের সৌন্দর্য নষ্ট হয় না। এসবে ঝেড়ে ফেললে জাতক হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের সুন্দর একটি আত্মজীবনী। যে জীবনী সরস সাহিত্য রসে ভরপুর।
আজকাল পড়তে হলে অনেক কিছু বাদ দিয়ে পড়তে হয়। মানে নিজের দুই চারটা শখ আহ্লাদ, কিংবা কাছের মানুষের হক্ব। সেইভাবেই পড়া এই ২০২৪ সালের প্রথম বই। অনেক সাধের বই। যেই বই কিনতে পার করতে হয় অনেক বছর। পড়তে আরো কিছু। আর সেই বই পড়তে গিয়ে দেখি যেমন আশা করেছিলাম সে রকমই। আতর্থীর জীবন সম্পর্কে হালকা অভিজ্ঞতা নিয়েছিলাম আর বইয়ের শুরু সেই সেই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিচ্ছিলেন লেখক।
আতর্থীর লেখার ভাষা সাধারণ। তবে তার সময়ের তুলনায় তিনি সহজ। কেননা ওই আমলে আরো পেঁচিয়ে লিখতে পছন্দ করতেন লেখকরা। আতর্থী তা করেননি। আর পুরোটাই তার জীবনের প্রথম অংশের কাহিনী। ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের গল্প বলেছেন। কিন্তু এর মধ্যেই বাড়ি ছেড়েছেন বহুবার। তার তার বাড়ি ছাড়া মানে পয়সাকড়ি নিয়ে ঘুরতে যাওয়া না, একেবারে এক কাপড়ে।
মহাস্থবির জাতকের প্রথম পর্ব অতি সুস্বাদু। বাবার হাতের মার থেকে শুরু করে ছেলেবেলার প্রেম, সবটাই। দ্বিতীয় পর্ব থেকে মাধুর্য কেন যেন একটু কম। প্রথম পর্বে আত্মজীবনীর 'নাড়ী-ছেঁড়া' একটা ব্যপার ছিল, দ্বিতীয় পর্ব থেকে লেখা যেন কিছুটা হিসাবি। কিন্তু জীবনের যে অভিজ্ঞতা আতর্থী পেয়েছেন তার গুণে লেখা উৎরে যায়। তবে বইটা নিয়ে অনেকে যে 'কী অকপট বয়ান' বলে থাকেন, সেখানে একটু আপত্তি জানাই। বাড়ি থেকে পালিয়ে এর তার আশ্রয়ে থাকা, ভিখারিদের সঙ্গে ফুটপাথে শুয়ে থাকার বিষয়ে অকপট না হওয়ার কিছু নেই। আতর্থী যে বয়সের গল্প বলেছেন তার পরের বয়সে মানুষের অনেক কিছু থাকে যা মানুষের জন্য স্বাভাবিক হলেও মানুষ তা প্রকাশ করে না। আতর্থীর এই লেখায় সে জীবন নেই।
মহাস্থবির জাতক পড়ে ভালো লাগে, উনিশ শতকের শুরুর দিকের ভারতের নানা অঞ্চলের বর্ণনা পড়ে। দিল্লি, আগ্রা, রাজস্���ান গিয়েছিলেন আতর্থী। সে সময় ভারতের অন্য অংশের মানুষও ঠিকমত বাংলাকে চিনত না। ভারত আজকের মতো ছিল না। সেই সময়ে কপর্দকশূন্য কয়েকটি বালকের জীবনের এই বর্ণনা অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদেরও ভালো লাগবে।
অনেক দিনের একটা অপেক্ষা শেষ হল। এই বইটা পড়ার। মহাকাব্যিক এক আত্মকথন। লেখা সময়ের তুলনায় অনেক আধুনিক। বর্ণিত হয়েছে লেখকের বেড়ে ওঠা, বিশেষত মানসিকভাবে। ঘর ছেড়ে বের হয়ে কত অদ্ভুতভাবেই না পৃথিবীটাকে দেখেছেন তিনি, দেখেছেন, চিনেছেন ভারতবর্ষকে, মানুষকে।
জাতক শুনলেই মাথায় চলে আসে গৌতম বুদ্ধের জাতক সমগ্রের নাম। সাহিত্যে, ধর্মে সেই জাতকের একটা উল্লেখযোগ্য স্থান নিশ্চয়্ই আছে। গৌতম বুদ্ধ বা বোধিসত্বের বিভিন্ন জন্মের কাহিনী নিয়ে সেই জাতক সমগ্র।প্রেমাঙ্কুর আতর্থী কিন্তু লিখেছেন অন্তায এক জাতকের কাহিনী, তার এক জন্মের কথাই, সেটাও কম বিচিত্র নয়। চারখন্ডের বই, সম্ভবত লেখকের সেরা সাহিত্যকর্ম । এর সাথে তুলনা করা যায় হয়তো শরতচন্দ্রের শ্রীকান্ত অথবা বিভূতি ভূষন এর অপু সমগ্রের ।আত্মজীবনী কিনা এই বই এটা নিয়ে একটা সংশয় থেকেই যায়। লেখাটা উত্তম পুরুষে লেখা, নামে কিন্তু মিল নেই, মিল নেই পদবীতেই, তা সে না থাক। চতুর্থ খণ্ডের শেষে তিনি লিখেছেন: "আজ সর্ব-সমক্ষে এই কথা বলে যেতে পারি যে প্রান্তরের গান আমার এই জাতকে আমি কোনও কৃত্রিম ঘরবাড়ি বসাই নি। মানুষকে দেখেছি, কিন্তু তাকে সাজাই নি। তার বিষ ও তার অমৃত দুই-ই দু'হাতে ভরে নিয়ে সর্বাঙ্গে লেপেছি। কোনও ছেঁদো-কথার জাল ফেলে উড়ন্ত-পাখির ডানা বাঁধতে চাই।” চার খন্ড এক সাথেও লেখেন নি, বেশ কয়েক বছর ধরে লিখেছেন, এর মধ্যে ভারতবর্ষ স্বাধীনও হয়ে গেছে, শেষ খন্ড তো তার মুখে শুনে শুনে অন্য একজন লিখেছিলেন, তখন তিনি বেশ অসুস্থ।গল্পকথক এর নাম স্থবির, সেটা তিনি নিজেই সেটা সহজেই আন্দাজ করা যায়।প্রথম খন্ডে আছে শৈশব, স্কুল জীবন, বাল্যকাল, বাবা মহাদেব শর্মার নানা ঘটনা।মহাস্থবির শর্মার আরও দুটি ভাই ছিলো।বড় ভাই স্থির আর ছোট ভাই অস্থির। আছে মায়ের কথাও (তুলনায় অল্প), আছে প্রথম প্রেমের কথাও।ব্রাহ্ম পরিবারের ছেলে, ব্রাহ্ম সমাজের নানা বর্ণনাও আছে, । সেকালের কলকাতার এক মধুর বর্ণনা আছে বইয়ে।জন্ম তো তার উনিশ শতকে, দেখেছেন ১৮৯৭ এর ভূমিকম্প। কলকাতায় তখন চলে ঘোড়ায় টানা ট্রাম, আছে বিদ্যাসাগরের কথা, তার নানা স্কুলের কথা, সেই আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষকদের কথাও উঠে এসছে লেখায়।সেকালের কলকাতা বলতে গেলে আজকের মফস্বল কোনো শহরের মতোই ছিলো। এক সিপাই এর সাথে তার বাবার সাহসী লড়াই এর গল্পও আছে, আছে জীবন বাজী রেখে অন্যকে বাচানোর গল্পও।পরের খন্ড গুলো তার বাড়ি পালানো জীবনের কাহিনী। বাড়ি পালিয়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন রাজ্যে দিন যাপনের বিবরন।ছিলেন পড়াশোনায় অমনোযোগী,বাবার অত্যাচারে বারবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়িছেন তিনি । স্কুলের পড়াশোনা আর শেষ হয় না তার। বাবা মহাদেব শর্মা একদিকে ভয়ানক রাগী পিতা, আবার অন্যদিকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এক চরিত্র। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন অগ্র পশ্চাত বিবেচনা না করেই, অপরিচিতের জন্য নিজের প্রাণ বিপন্ন করেন, অথচ সেই মানুষের সন্তানের প্রতি ব্যবহার মেনে নেয়ার মতো নয়। হয়তো সে আমলে বাবারা সন্তান মানুষ করা বলতে শুধু শাসনই বুঝতেন, আদর করাকে দুর্বলতা ভাবতেন।।প্রথমবার বাড়ি ছেড়ে পালানো সন্ন্যাসী হবার জন্য, সেবারে শেষ রক্ষা হয়নি। এর পরে অবশ্য সন্ন্যাসী হবার চিন্তা মাথা থেকে বাদ, জীবনে উন্নতি করতে হবে এই ছিলো চিন্তা।সেসব কিছু হয় নি, তা নিয়ে তিনি আফসোস করেন নি, যে অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করেছেন জীবনে সে নিয়ে বরং সন্তোষ প্রকাশই করেছেন। যার জবানীতে এই লেখা সেই স্থবির কাজ করেছে লোকের বাসায়, হোটেলের দালাল হিসেবে, নিতান্ত পান্ডব বর্জিত জায়গায় দিনমজুর হয়েও। এমনকি প্রাইভেট টিউটর,চশমা বিক্রেতা হিসেবেও। পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা, অপরিচিতের সঙ্গ, স্নেহ আর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা।তখনও মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতো, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মানুষ রীতিমতো সম্মানের চোখে দেখতো বাঙালিদের। এর মধ্যে চলছে স্বদেশী বিপ্লব, বাঙালিদের অন্য রাজ্যের মানুষ সন্দেহের চোখে দেখলেও শ্রদ্ধাও করতো।গিয়েছেন নানা শহরে, ঘুরেছেন নানা রাজ্য, করেছেন বহু বিচিত্র কাজ।বরোদা,আহমেদাবাদ, কাশী, আগ্রা, দিল্লি, বম্বে, পাটনা, রাজস্থান, সেকালের নানা দেশীয় রাজ্যে ঘুরেছেন তিনি।লেখক তার সারা জীবনের কথা লিখেন নি, লিখেছেন ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের ঘটনা, এর পরের ঘটনাও কিছু এসেছে যদিও তবু তা সামান্য এবং এসেছে ঘটনা পরম্পরায়। রেল স্টেশনে কুলিগিরি ও করতে গেছিলেন, রাতে ঘুমোবার জন্য বম্বে শহরে মারামারি করতে হয়েছে ভিখারীর দলের সাথে।বহু বিচিত্র চরিত্রের দেখা পাই তার এই লেখায়। পরিতোষ,গোষ্ঠদিদি, পাগলা সন্ন্যাসী, রাজকুমারী, অলকা, লতু, নন্দা, শচীন, বিশুদা অরফে ছোটে, দিদিমনি, বাবুজি, নবাব সাহেব, পিয়ারা সাহেব, অমরনাথ, সত্যদা আরও ভুলে যাওয়া অনেক চরিত্র।অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার বর্ণনাও আছে, সেগুলোকে স্রেফ গল্প হিসেবে পড়লে ভালোই লাগবে, বিশ্বাস অবিশ্বাস একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। হয়তো লেখাটি সেভাবে পরিচিত নয়, লেখক নিজেও আজ বিস্মৃতির আড়ালে। তবু আমি পাঠক হিসেবে বলবো বাংলা সাহিত্যের এ এক অনন্য সৃষ্টি। যারা পড়েন নি পড়ে ফেলুন, আর যারা পড়েছেন তারা তো জানেন ই।পাঁচ তারা।
"যখন গল্প লিখলুম, লোকে বললে, এসব আমার নিজের কথা। আর যখন আত্মজীবনী লিখলুম, সবাই বলে গল্প লিখেছি" অনেকটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী।
প্রেমাঙ্কুরের জন্ম ১৮৯০ র ১ জানুয়ারি, ফরিদপুরে। পিতা ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক আদর্শবাদী মহেশচন্দ্র। তিন ভাই- স্থির, স্থবির, অস্থির। স্থির যৌবনে গৃহত্যাগী ও আজীবন প্রবাসী। অস্থির অকালপ্রয়াত। কর্মজীবনে লেখক উপন্যাস গল্প ইত্যাদিতে প্রায় ১৫ টা বই লিখেছেন। চলচিত্র ১৭ টা। অভিনয়ও করেছেন কোনটাতে। বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক। মৃত্যু ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর।
"মহাস্থবীর জাতক" প্রমাঙ্কুর আতর্থীর শেষ বই। শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ভাৎসনা শুনে তিনি এই রচনা লিখতে বসেন। জীবিত থাকাকালীন বাংলা সাহিত্যের সেরা বইয়ের একটি হিসেবে তার মহাস্থবীর জাতক এর নাম দেখে যেতে পেরেছিলেন। প্রায় ৭০০ পেজের এই বইটিকে বাংলা সাহিত্যের সেরা ১০০ টি বইয়ের একটি এবং প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর শ্রেষ্ঠকর্ম হিসেবে স্বীকার করা হয়।
বইটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ড লিখতে লাগে দু'বছর। আর চতুর্থ খন্ড প্রায় দশবছর। চতুর্থ খন্ড লেখার সময় লেখক একেবারে শয্যাশায়ী। নিজের হাতে লিখতে গেলে হাত কাঁপতো তার এই রচনায় সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন কবি উমা দেবি। লেখক বলতেন তিনি লিখে রাখতেন।
পিতৃশাসনের অতিশয্যে ঘর ছাড়া বালক স্কুলের ঘরটা শুধু পার হতে পারেননি। কিন্তু শিক্ষায় অভিজ্ঞতায় তিনি অনন্য। বাল্যকালে নিষ্ঠুর পিতার তাড়নায় মন বিগড়ে যায়, তখন থেকেই তিনি কারো অধিনতা মেনে নেননি। যেখানে-সেখানে মারামারি। পিতার হাতে বিনা প্রতিবাদে নির্মম ভাবে মার খেয়েছেন। তারপর প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ। একেবারে বিমুখ প্রকৃতির কাছ থেকে হাতে-কলমে।
পথে পথে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন বিচিত্র মানুষের জীবনযাত্রা, অযাচিতভাবে পেয়েছেন পথের প্রান্তে স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা। আর জীবনের পাত্রটিকে নিয়েছেন সে সুধায় বিষে মিশে অভিজ্ঞতার রসে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে ভরে।
বিদেশে অপরিচিত পরিবেশে বন্যজন্তুর আক্রমন অগ্রাহ্য করে পথেই শুয়ে থাকা। বোম্বাইয়ের মতো শহরে অগণিত ভিখারীর সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে পথের পাশে তাদের কাছ থেকে একটু রাত কাটানোর মতো স্থান করে নেওয়া। নিঃসম্বল নিঃসহায়ের মতো প্রচন্ড শীতে ঝড়বৃষ্টিতে পথ চলা। একস্থান থেকে তাড়া খেয়ে অন্য স্থানে, অন্যস্থান থেকে তাড়া খেয়ে অন্যত্র, সেখান থেকে তাড়া খেয়ে আরেক জায়গায়। এটাই তো প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা।
একবার ভাগ্যের স্রোতে ভেসেছেন, আবার পরমুহুর্তে কূল পেয়ে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
গৃহপলাতক প্রেমাঙ্কুর পলাতক জীবনেও নানা ভাবে রোজগার করেছে, পেটের দায়ে পথের মজুরবৃত্তিক থেকে শুরু করে অনেক কিছুই। প্রায় ১২ ঘন্টা না খেয়ে মাত্র ছ'পয়সার জন্য মাঠে আগাছা নিড়ানো ঘাস কাটার কাজও করেছেন।
মহাস্থবির জাতকের প্রথম পর্বে এই শতকের প্রথম দিককার কলকাতার পরিচয় পাওয়া যাবে। ঘোড়ার ট্রামের কলকাতা, সে সময়ের নবজাগ্রত ব্রাহ্মসমাজ। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর বাবা মহেশচন্দ্র ছিলেন আদর্শবাদী বাহ্ম। এতে মহেশচন্দ্রের পাগলাটে পরিচয়, পরপকার, জেদ এর পরিচয় পাওয়া যায়। চিলের পিছনে অপহৃত মাছের জন্য সারাদিন ছোটা। পাগলাদের লালন-পালন করা সহ তার নানান কর্মের কথা জানা যায়। এই পর্বেই প্রেমাঙ্কুরের সাথে পরিচয় হয় পাগলা সন্ন্যাসীর। প্রথম মদ্যপান। প্রথম প্রেম। লতুকে বিয়ে করেন চাঁদকে সাক্ষী রেখে, আর অনুষ্ঠানিক ভাবে বিবাহ হয় আরেকজনের সাথে!
২য় পর্বের প্রথমে কাশীতে গুরুমার সঙ্গে পরিচয়। গুরুমার আদর। আড়ালে এই গুরুমা রাজকুমারী হয়ে উঠতেন আর রাজকুমারীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে পড়ে থাকা। রাজকুমারীর এই ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তারপরে দিদিমণির আদর-ভালোবাসা। দীর্ঘবছর পর সেই দিদিমণির সাথে দেখা। সম্মৃদ্ধ অবস্থা থেকে তখন পথের ভিখারি তিনি।
তৃতীয় পর্বে সুরাটের ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে পরিচয়। নাম গয়ারাম। লেখক এ সম্পর্কে লিখেছেন- জীবনযাত্রার প্রাক্কালে আমরা যে মহাপুরুষের দর্শনলাভ করেছিলুম, আজ জীবনসন্ধ্যায় বিশেষ করে তাঁকে স্মরন করে বলি- হে মহাত্নন! আজ হতে প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে যে দুটি দীন ও তুচ্ছ বাঙালি বালক কম্পিত হৃদয়ে সাহায্যের জন্য আপনার দ্বারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম দুঃখে সুখে তাদের দিন কেটে গিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বিদায় নিয়েছে, আর একজন পথের শেষে এসে অতিক্রান্ত অতীতের দিকে চেয়ে আপনাকে স্মরন করছে।
এপর্বে গয়ারাম এবং তার বন্ধু পণ্ডিকজীর কথা উঠে এসেছে। এসেছে পণ্ডিতজীর কন্যা দেবীর কথা। তার মৃত্যু!
চতুর্থ পর্বে বোম্বাই শহরে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সেখানে ছ পয়সার মজুরিতে ক্ষেতে কাজ করা। ভিখারিদের সাথে রাত্রিতে শুয়ে থাকা। ডাকাতের গৃহে আশ্রয় নেওয়া।
বইটা পড়তে পড়তে একজন পাঠক শতবছর আগে দিল্লি, কলকাতা, বোম্বাই, আহমেদবাদ, রাজস্থান, কাশী সহ ভারতের নানান স্থানে ভ্রমণ করতে পারবেন। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন। হবেন শিহরিত।
ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে বহু মানুষকে ভাগ্য গড়তে দেখা যায়। এ একেবার অন্যরকম, সামান্য একজন বালক ঘরের মায়া, সংসারের মায়া ত্যাগ করে ভারতবর্ষের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরেছেন। কখনও পায়ে হেঁটে, বিনা টিকিটে মাত্র দুজন সহধর্মী!
ভবিষ্যতের আশায় অদম্য আশা বুকে নিয়ে কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনও ঝাড়ুদারের কাজ, কখনও নবাব-গৃহে গৃহশিক্ষক, কখনও রান্নার কাজ করে গিয়েছেন!
মহাস্থবির জাতকে প্রেমাঙ্কুর নিজের বাল্য জীবন যেভাবে দেখেছেন তা একরকম বৈজ্ঞানীক দৃষ্টি। একদম নিরপেক্ষ! নিজে আবেগপ্রবন হলেও কোথাও আবেগের স্থান দেন নাই। বরং হাসিখুশি ভাবে সবচেয়ে দুঃখের দিনগুলোর বর্ণনা করে গেছেন। এবং আশ্চার্য বিষয় নিজের কোন কাজের জন্য কোন ধরনের অনুতাপ নেই।
জীবনের সমস্ত ঘটনা একমাত্র কনফেসনস এর নামে বলা যায় হয়তো। তা দিয়ে সাহিত্য রচনা করা অবশ্যই কঠিন। সবাই পারেনা। প্রেমমাঙ্কুর আতর্থী তা পেরেছেন। তা মহাস্থবির জাতকে লিখিত।
লেখকের জীবনে ঘটে যাওয়া, অনেক অলৌকিক কাহিনি রয়েছে এই বইটির বিভিন্ন অংশে।
কত রকমের চরিত্র আছে এই পৃথিবীতে! ঘরে যার মন বসে না, বাঁধন ছেড়া নৌকার মতো মন। ভেসে ভেসে চলে যেতে মন চায়। মহাস্থবীর জাতকের স্থবীর শর্মা তার সারা জীবন এরকম বাঁধন ছেড়া নৌকার মতন ভেসে ভেসে চলেছেন। আর নিজ মনে বলেছেন-
কিছু কিছু অংশে ভক্তিরসের কারণে অজ্ঞেয়বাদী কিংবা নিরীশ্বর পাঠকের মনে অস্বস্তি সৃষ্টি হওয়া ছাড়া, মোটামুটিভাবে দুর্দান্ত একটা বই। লেখকের আত্মজীবনী। ছোটোবেলা থেকেই বহুবার ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, মানুষকে একদম কাছ থেকে দেখবার সব বর্ণনা। তৎকালীন ভারতবর্ষেরও একটা দারুণ ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
পুরো বই শেষ করে মনে হয়েছে, কালকূটের কোথায় পাবো তারে'র মতো, এ বইতেও লেখক শেষ পর্যন্ত মানুষকেই আরাধনা করেছেন, মানুষকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন। আমার মতে অবশ্যপাঠ্য।
"মানুষের জীবনের কাহিনিই সব চাইতে বিচিত্র উপন্যাস" - ঠিক এই কথাটিই লেখক "মহাস্থবির জাতক" বইয়ের প্রথম খন্ডের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন। এই লাইনটি হয়তো এই বইয়ের গোত্রনির্নয়ে সহায়ক নয়। কারন "মহাস্থবির জাতক" বরং বিচিত্র থেকে বিচিত্রতম এবং একি সাথে অসম্ভব উপভোগ্য। তাই বাংলা সাহিত্যোর চিরায়ত বইগুলোর মধ্যে কারও কারও কাছে "মহাস্থবির জাতক" একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, কারও কাছে "শুধু চিত্রশালা" এবং কেউ কেউ এই আত্মজীবনীর পরিধি আরও গুরুত্বপূর্ন এবং প্রসারিত বলেই স্বীকার করে নিয়েছেন।
বিদেশি প্রবাদ - "বিড়ালের নয়টি জীবন"। এবং বিড়ালের মতন করেই যে যত বেশী জীবনের অধিকারী, তার ততই বহুরকম বিপদের থেকে মুক্তি লাভের সৌভাগ্য লাভ হবে - এমন একটা বিশ্বাসে বিশ্বাসী অনেকে। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর জীবনও যেন ঠিক তেমনটা। নয়টি জীবন তার, বা বহুজীবনের অধিকারী প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর সেই সব গল্পই "মহাস্থাবর জাতক"।
প্রতিটি মানুষই ভিন্ন। তবে পৃথকভাবে সবাইকে দেখার অবকাশ থাকে না বলেই হয়তো আমরা সকলেই একটা গড়-পরিচয় সৃজন করে নেই মানসপটে। মানুষের সমুদ্রে পৃথকভাবে কাউকে দেখা দূরে থাক, আমরা যাদের নিয়ে বসবাস করি তাদেরই ঠিক মতো স্বতন্ত্র করে দেখার সুযোগ পাই না। অনেক সময় ইচ্ছেও করে না, বা সক্ষমতার প্রশ্নেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তারপরেও কিছু কিছু মানুষ নিজ থেকেই অকপটে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন। এবং সেই কারনেই তাকে না দেখা বা পাশ কাটিয়ে চলে যাবার উপায় থাকে না। সেই সব মানুষের আকর্ষণের ক্ষমতা তাদেরকে আমাদের চোখের সামনে আলাদাভাবে তুলে ধরে। একে বলে "পার্সোনাল ম্যাগনেটিজম"। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী সেই "পার্সোনাল ম্যাগনেটিজম" এর উজ্জ্বল উদাহরণ।
ছোটবেলা থেকেই নিষ্ঠুর পিতার তাড়নায় মন বিগড়ে যায়। তাই কৈশরেই ঘর পালান। পড়ালেখার পাট সেখানেই চুকে যায়। ঘুরে বেড়ান ভারতের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে। মহাস্থবির জাতকের গল্প শুরু তিন ভাইয়ের খুনসুটি ��িয়ে। তিন ভাই - স্থির, স্থবির এবং অস্থির। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী মধ্যম - মানে এই কাহিনি স্থবিরের। নিষ্ঠুর পিতার তাড়নায়ই কোন অধীনতা মেনে না নিয়ে ঘর পালান তিনি। বিমুখ প্রকৃতির কাছ থেকে নেন তার সকল শিক্ষা হাতে-কলমে। কখনও ভাগ্যের স্রোতে ভেসেছেন তো কখনো ভেসে ভেসে পায়ের নিচে ঠাঁই পেয়ে কুলে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আপন ভাগ্য গড়তে এবং ভাগ্যের হাতে মার খেতে খেতে জীবনটাকে যাপনের দৃষ্টান্ত হয়তো অনেক আছে। কিন্তু স্বেচ্ছায় ঘর পালিয়ে কোন স্কুল বালকের পক্ষে দূরে সম্পূর্ন প্রতিকূল এবং অপরিচিত রাজ্যে যেয়ে দিনের পর দিন অনভ্যস্ত ও পরস্পরবিরোধী বৃ্ত্তি গ্রহণ করে পথ চলার দৃষ্টান্ত খুবই কম। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী সেই দৃষ্টান্তের অসাধারন এক নক্ষত্র।
"মহাস্থবির জাতক" এক ঘর পালানো বালকের অথবা একজন বেদুইনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মহাকাব্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপে লিখেছিলেন, "ইহার থেক��� হতেম যদি আরব বেদুইন"। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর বেলা "যদি" ছিল না, সকল নিশ্চয়তা এবং আরাম বিসর্জন দিয়ে তিনি আরব বেদুইন হয়েই জীবন কাটিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ এলো বলেই সেই কথায় আরও একটু আলোকপাত করা যাক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রেমাঙ্কুর আতর্থী দুজনেই স্কুল পালানো বালক এবং দুজনের শিক্ষাই স্কুলের বাইরে। বৈপরীত্য অবশ্যই আছে। দুজনের যে পার্থক্য তা হলো"জীবনযাপনের মধ্যে"। মানসিক আরাম রবীন্দ্রনাথও পাননি বলাই যায়। তবে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী দৈহিক আরাম সর্বভাবে বিসর্জন দিয়ে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশ ঘুরে ঘুরে সেই মানসিক আরামটুকু পেয়েছেন কিনা সেই প্রশ্নে তিনি নিরবই থেকেছেন"মহাস্থবির জাতক" বইয়ে বা নিজের অন্যান্য জীবনেও। তবে যাকে বলে "সেল্ফ এডুকেশন" বা স্বশিক্ষা - তার পুরোটাই তিনি অর্জন করে নিয়েছেন পথে পথে। আধুনিক শিক্ষা, যা স্কুল-কলেজে দুর্লভ, তা তিনি আহরন করে নিয়েছেন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। তার সেই অভিজ্ঞতার কিছু কাহিনি এমনই সমাজবর্হিভূত যে, তা শুধু মুখেই মানাত। তিনি সোজা ও সরলভাবে অকপটে বলে গেছেন "মহাস্থবির জাতকে"।
চাকরি, ব্যবসা, সাংবাদিকতা, গল্প-উপন্যাস লেখা, নাটক লেখা, সিনেমার পরিচালনা, শিশু সাহিত্যক এবং কৈশোরে ঘর পালানো থেকে ভিক্ষুকদের সাথে রাত্রিযাপন, কুলিগিরী, নবাব পরিবারে গৃহশিক্ষক থেকে ধনীর পরিবারে গৃহপরিচারিকা, রাধুনি - হেন কাজ নেই তিনি করেননি। কোন কিছুই তাকে বাঁধেনি শক্ত করে। প্রায় ভবঘুরে বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন এই জাতক।
প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর আত্মলিপি "মহাস্থবির জাতক"। তবে পাঠক এটাকে উপন্যাস বলেও ভ্রান্ত ধারনার আক্রান্ত হতে পারেন। যদিও তার অধিকাংশ লেখাই এই ধানরায় আক্রান্ত।"যখন গল্প লিখলুম, লোকে বললে, এসব আমার নিজের কথা। আর যখন আত্মজীবনী লিখলুম, সবাই বলে গল্প লিখেছি"- এই আফসোর ছিল তার সবসময়। "মহাস্থবির জাতক" আত্মলিপি হলেও এর রূপটি উপন্যাসের। তাই পাঠক চাইলে এটাকে উপন্যাস হিসেবেও উপভোগ করতে পারেন। আত্নলিপি হোক বা উপন্যাস - কোন আঙ্গিকেই এর মূল্য এবং সৌকর্য কমবে না।
কৌশরের ঘর পালানো থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত"মহাস্থবির জাতক" লেখার কথা ছিল। তাই করেছেন। পাঠকের জন্যে এক বিশাল শূন্যতাবোধ হয়ে থাকবে যে কেন তিনি সম্পূর্নটাই লিখে গেলেন না। তাতে যদি মহাস্থবির জাতক ৪ খন্ডে না হয়ে ৪০ খন্ডেও হতো - কোন প্রকার ক্লান্তি আসতো না পাঠকের। যদিও জীবনের প্রথম ২৫ বছর পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন, তবু তিনি মহাস্থবির জাতক শেষ করে যেতে পারেননি।
মহাস্থবির জাতক প্রথম খন্ড লিখতে লাগে ২ বছর। ৪র্থ খন্ড লিখতে লাগে ১০ বছর। এই ১০ বছর তিনি ব্যাধিতে ছিলেন শয্যাশয়ী। মহাস্থবির জাতক শেষ খন্ড (৪র্থ খন্ড) সম্পূর্ন করতে এগিয়ে আসেন লেখকের খুব স্নেহের একজন কবি উমা দেবী। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর মুখে মুখে শুনে কবি উমা দেবী লিপিবদ্ধ করতেন এবং তাকে পড়ে শুনাতেন। এভাবেই মহাস্থবির জাতকের ৪র্থ খন্ড শেষ হয়। শেষ পর্বের এক চতুর্থাংশ লেখক নিজেই লিখেছেন। বাকিটা কবি উমা দেবীর সাহায্যে।
"মহাস্থবির জাতক" এক মহাকাব্যিক আত্মজীবনী। টোটাল ৪ টি পর্ব উপরেই বলেছি। ১ম পর্বে উপজীব্য হয়ে উঠেছে পিতা মাতার সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা তিন ভাইয়ের দিন-যাপনের কথা। সাথে প্রথম দিকের কলকাতার পরিচয়ও পাওয়া যাবে এখানে। স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে তার প্রথম ১৫ বছর পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয়ে আছে ১ম পর্বে। এখানেই শেষে প্রথম গৃহত্যাগ করেন লেখক। এবং এখানেই শেষ হয় ১ম পর্ব। ২য় পর্বের শুরু কাশীতে। গুরুমার সাথে পরিচয় এবং প্রায় সম্মোহিত হয়ে পড়া। এখানে যেসব অনৈতিক কার্যক্রম অকপটে কিন্তু নিজস্ব ভাষার প্রয়োগে তুলে ধরেছেন - তা এক কথায় অনবদ্য। পাঠক অনায়াসে ভাবতে পারেন এখানে যে, অন্য লেখকের হাতে লেখা হলে এই পর্বটুকুর বিবরণ কি দাঁড়াতো। তবে এই সুখ তো চিরস্থায়ী না, এবং হয়ওনি। আবারো পালানো। ২য় পর্বের শেষ এখানেই।
তয় পর্বে এসেই লেখক অসুস্থ হয়ে পড়েন। "শনিবারের চিঠি" তে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকলেও তা ব্যহত হয় তার অসুস্থতার কারনে। কবি উমা দেবী তার সাহায্যহস্ত প্রসারিত না করলে হয়তো ২য় পর্বেই অসম্পূর্ন থেকে যেত। ব্যাধগ্রস্থ অবস্থায় যতটুকু লিখেছেন - সেই দুর্বোধ্য লেখা উদ্ধার এবং প্রেসকপি তৈরী করে মহাস্থবির জাতকের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে লেখক যেমন কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন উমা দেবীর প্রতি - তেমনি পাঠকও করবেন নিঃসন্দেহে। ৩য় পর্বেও আবার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিভ্রমন এবং নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মালায় গাঁথা।
৪র্থ পর্বে রয়েছে বোম্বাই শহরের বিচিত্র অভিজ্ঞতা। দৈনিক ছ'পয়সা মজুরিতে ক্ষেতে কাজ করা, ডাকাতদের কাছ থেকে অযাচিত এবং অপ্রত্যাশিত স্নেহ-মমতা পাওয়ার মতো অনেক অলৌকিক কাহিনিও সন্নিবেশিত হয়ে আছে মহাস্থবির জাতকের সব খন্ডেই। তাই বলে মহাস্থবির জাতক অলৌকিক বা কাল্পনিক নয়, বরং খুব বেশি লৌকিক এবং একি সাথে বিস্ময়ের। পূর্বেই বলেছি যে, "মহাস্থবির জাতক" আত্মজীবনী হলেও এর রূপটি উপন্যাসের। তাই পাঠক যদি আত্মজীবনী পড়তে না চেয়ে শুধু উপন্যাস পড়তে আগ্রহী হন, তাতেও এই বইয়ের আবেদন কমার নয় এবং সেভাবে পাঠেরও সুযোগ রয়েছে। "মহাস্থবির জাতক" প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর শেষ গ্রন্থ।
প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর বর্ণনাশৈলী, মর্মস্পর্শী প্রকাশভঙ্গি পরম উপভোগ্য হয়ে উঠবে যে কোন পাঠকের জন্যেই। অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমীদের জন্যেও এই জাতকের লেখাটি "ম্যগনাম ওপাস" হয়েই থাকবে। আত্মলিপি অভ্রান্ত নয় - একথা সকলেরই জানা। হয়তো পড়তে পড়তে "সত্য" এবং "মিথ্যের" অনুপাতের হিসেব কষতেও পারেন পাঠক। তবে জীবনের সত্যি এবং সাহিত্যের সত্যি যখন পাঠকের চেতনায় দ্রবীভূত হয়ে যায় সহজেই - তখন সত্য ও মিথ্যের অঙ্ক কষা অবান্তর। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী "মহাস্থবর জাতক" আত্মলিপিতে অকপটে বলে গেছেন কৈশোর থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত সবকিছু, কিন্তু তাকে "কনফেশন" বলার কোন সুযোগ নেই। তার বলায় নেই কোন অভিযোগ, আক্ষেপ অথবা বিরক্তি। এমন মহাকাব্যের রিভিউ হয় না -তাই সেই চেষ্টায় গেলাম না। আগ্রহী পাঠকদের সামনে বইটার পরিচয়ের একটা প্রয়াশ হয়েই থাক।
আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা আমার সবচেয়ে প্রিয় জঁরার অন্যতম এবং একদম উপরেই থাকবে। সে সুবাদে কম বেশি অনেকই পড়া হয়েছে (এবং অজস্রও বাকি পড়া)। তবে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মহাকাব্য "মহাস্থবির জাতক" সবসময় লিস্টের উপরেই থাকে এবং এতো বিচিত্র ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কোন এ্যাডভেঞ্চার জঁরার বইয়েও পাইনি। তাই মহাস্থবির জাতক আমার কাছে যতটা লৌকিক হয়ে থাকবে, ঠিক ততটাই অলৌকিক - আরাধ্য যাত্রা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ভারতীয় রণাঙ্গনে এসে উপস্থিত হয়েছে। কবি মণীন্দ্র গুপ্ত যু্দ্ধে নাম লিখিয়েছেন উনিশ কি কুড়ি বছর বয়সে। হঠাৎ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিনি। বেডে শুয়ে অন্যান্য রোগীদের সাথে গল্প করেন, তাদের অভিজ্ঞতা শোনেন, এয়ার ফোর্সের সেনার কাছ থেকে তার গ্রামের ধানিবনের চিংড়ির গল্প শোনেন, এবং হকারের কাছ থেকে কেনা শনিবারের চিঠি এর সংখ্যা পড়েন। শনিবারের চিঠিতে তখন মহাস্থবির জাতক কিস্তি আকারে প্রকাশ হতো। তিনি সেই লেখা পড়তেন আর লেখকের তারিফ করতেন৷ উপরের কথাগুলো মণীন্দ্র গুপ্তের লেখা আত্নজীবনী অক্ষয় মালবেরি থেকে বর্ণনা করলাম। এই বই থেকে প্রেমাঙ্কুর আতর��থীর মহাস্থবির জাতক নিয়ে জানতে পারি।
জাতক হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন জন্মের ঘটনাগুলোর বর্ণনা। বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধ তার অতীত জন্মের ঘটনাগুলো স্মরণ করার ক্ষমতা লাভ করেন। মহাস্থবির জাতক হচ্ছে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ওরফে স্থবির শর্মার আত্মজীবনী, যেখানে তিনি তার জীবনের প্রথম ২৫ বছর বন্দী করেছেন। পুরো বই জুড়ে তিনি বহুবার জন্মেছেন ও মরেছেন এবং তার প্রত্যেক জন্মের কাহিনীগুলো বর্ণনা করে গিয়েছেন। তাই মহাস্থবির জাতক নাম সার্থক।
বইটা পড়ে পাঠক একে উপন্যাসও ভাবতে পারেন। প্রেমাঙ্কুর নিজেও লিখে গেছেন মানুষের জীবনের চাইতে বড় উপন্যাস আর কি হতে পারে।
" যখন গল্প লিখলুম, লোকে বললে, এসব আমার নিজের কথা। আর যখন আত্মজীবনী লিখলুম, সবাই বলে গল্প লিখেছি।" সত্যিই পড়তে পড়তে কখনও মনে হয়েছে উপন্যাস , কখনও মহাকাব্য , কখনও আত্মজীবনী। মানুষের জীবন যে এতো নাটকীয় হতে পারে! লেখক বলেছেন এই নাটকের নব্বই শতাংশ তাঁর জীবনে ঘটেছে। পড়াশোনা আর বাবার অসহনীয় পিটুনির হাত থেকে রেহাই পেতে , ঘর-ছাড়ার হাতেখড়ি শুরু বারো-তেরো বছর বয়স থেকে। যদিও তখন সাফল্য আসেনি। পনেরো বছর বয়সে অনেক পরিশ্রমের ফলে সফল হন। এরপর ওনাকে আর বেঁধে রাখা যায়নি। যদিও মাঝেমাঝে ক্লান্ত হয়ে আবার বাড়ি ফিরেছেন , স্কুলে গিয়েছেন। আবার ওনার মতো দু'-একজন সঙ্গী জুটিয়ে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই বাড়ি -ছাড়ার স্রোত কতবার তাকে আছড়ে ফেলেছে তার হিসেব নেই। 'মহাস্থবির জাতক' -এর চতুর্থ পর্ব যখন লিখতে শুরু করেন তখন লেখক শয্যাশায়ী, ফলে লেখা সম্পূর্ণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেষে উমা দেবী(উমা রায়) লেখার ভার নেন। লেখকের কাছে শুনে শুনে প্রেস কপি লেখেন। বইয়ের শেষে জুড়ে দেন লেখকের খুব কাছের মানুষদের মনের কথা, যারা ছিলেন লেখকের এই নাটকীয় জীবনের কিছুটা অংশ জুড়ে। পরিমল গোস্বামী লেখক সম্পর্কে বলেছেন " প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ছিলেন এইরকম সঙ্গী-আকর্ষণকারী চরিত্র। তাঁর যে-কোনো বিষয়ের বর্ণনা শোনবার মতন ছিল। বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর। পিতৃশাসনের আতিশয্যে ঘর-ছাড়া বালক স্কুলের ঘরটা শুধু পার হতে পারেনি। কিন্তু শিক্ষায় অভিজ্ঞতায় এবং অকপট সরলতায় তাঁর এমন একটি মধুর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল তা পরম উপভোগ্য ছিল সবার। মেজাজ ছিল পুরোপুরি বৈঠকী; এ মেজাজ গঠন রস থেকে। আধুনিক যুগের নিম্নজাতের রস নয়। আগের যুগের ব্রাহ্মরুচির মিশ্রণ ছিল এর সঙ্গে, আর তার সঙ্গে ছিল একজাতীয় চিত্তাকর্ষক আভিজাত্য। তার মানসকেন্দ্র ছিল শিল্পরসের উৎস -মধুর, কোমল, লোভনীয়। বাইরের রূপও কম আকর্ষক ছিল না। অন্তরের আভা ফুটে উঠত তাঁর সমস্ত চোখে মুখে।
বসুমতী পত্রিকায় লিখেছেন.. " একটি ঘরছাড়া বাঙালি স্কুলের ছেলের কি বিচিত্র অভিজ্ঞতা। প্রমাঙ্কুর বিচিত্র মানব সংসারের, আর চরিত্রের, স্তরের পর স্তর দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছেন। এতগুলি স্তর একজন পরিণত মানুষের পক্ষে কল্পনাতেও দেখা সম্ভব নয়। অথচ একটি বালকের জীবনে তা দেখা হয়ে গেল। শত স্তরের দু-চীরটে আমরা বাইরে থেকে দেখি, কেউ -বা কিছু বেশি দেখেন। কিন্তু প্রেমাঙ্কুরের মতো এতো বেশি স্তরের সঙ্গে সহজে কোনো বাঙালির পরিচয় ঘটেছে কি না আমার সন্দেহ আছে। " " আমার সবচেয়ে বিস্ময়কর বোধ হয় এই ভেবে যে, কোনো অভাজনের প্রতিই তিনি ঘৃণা বা বিদ্বেষ প্রকাশ করেননি। কাউকে নিজের কোনো আদর্শ বা নীতিবোধের সাহায্যে বিচার করেননি। যখন ভিখারীদের অত্যন্ত অভদ্র এবং নোংরা পরিবেশে পথেরপাশে তাদের মাঝখানে শুয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন, তখনও তাদের প্রতি তাঁর কোনো ঘৃণা জাগেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে গভীর সহানুভূতির সঙ্গে তাদের মেনে নিয়েছেন । বোম্বাই শহরের বাইরে যেখানে প্রায় বারো ঘন্টা না খেয়ে দৈনিক ছ'পয়সা মজুরিতে ক্ষেত নিড়িয়েছেন, ঘাস কেটেছেন, সেখানে আর এক দরিদ্রতম পরিবারের ঘরে বাস করে তাদের সঙ্গে তাদের বরাদ্দ থেকে তাদের হাতে -গড়া বাজরার রুটি শুধু একটু মাটি মেশানো নুনের সঙ্গে খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন, সেখানেও তাদের প্রতি কি গভীর শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা। যে ছাগলের দুধ-বিক্রেতার ভাঙা ঘরে প্রতিদিন তিনপয়সা ভাড়া দিয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন, সেই ঘরের মালিক-দম্পতি তাঁদের এক চরম বিপদে নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে সাহায্য করেছেন তার সকৃতজ্ঞ বর্ণনা পড়লে রোমাঞ্চিত হতে হয়। " লেখক তার এই নাটকীয় জীবনে অনেক কাছের মানুষকে হারিয়েছেন , আবার অনেক মানুষ অর্জনও করেছেন। চিন্তাহীন জীবন ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছেন অনিশ্চয়তার সমুদ্রে। যেখানে একমুহূর্তে তিনি সবার আপন, আবার পরের মুহূর্তে তাঁকে আশ্রয়হীন হতে হয়েছে। এত চাওয়া -পাওয়ার মাঝে লেখক এরকম এক সম্পদ রেখে গেছেন সাহিত্য জগতে, যার সৌরভ সারা জীবন পাঠকের মনে রয়ে যাবে। সেদিনের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বকুনির ফল লেখক আমাদের দিয়ে গেছেন।
এই বইটিতে লেখকের আত্মজীবনী বলে চালানোর চেষ্টা করলেও একে উপন্যাসই বলবো আমি। চার পর্বের বইয়ের প্রথম পর্বে ছোটবেলার কথা এসেছে। বাকি তিন পর্ব ছিল ভারতের বিভিন্ন জায়গায় একা ও বন্ধুদের সাথে পালিয়ে থাকার সময়ের। বেশ well written বই তবে প্রথম পর্ব ছাড়া আর বাকিটা খুব মন মতো হয়নি
বালক বয়সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে দেশময় ঘুরে বেড়ানোর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার বয়ান এই "মহাস্থবির জাতক।" লেখকের ডাকনাম স্থবির, বয়সের সাথে চুলে পাক ধরার পর নিজেকে তাঁর "মহাস্থবির" বলে মনে হওয়ায় নামের এই পরিবর্তন!
গতানুগতিক জীবনযাত্রার বাইরে গিয়ে লেখক জীবনটাকে অন্যভাবে দেখেছেন, অন্যভাবে যাপন করেছেন। দুর্লভ সব অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। বলাবাহুল্য সেগুলো সব সুখকরও ছিল না। কিন্তু এই যে অনিশ্চয়তার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে জীবনটাকে এভাবে "নদীতে ভাসিয়ে দেয়া"— এই ব্যাপারটাই আমাদের মতো সাধারণ ঘরকুনো মানুষদের জন্য এই বইয়ের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হওয়ার কারণ।
যে ব্যাপারটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে সেটা হচ্ছে তৎকালীন সময়ে মানুষের প্রতি মানুষের সহজাত বিশ্বাস, আস্থা, ভালবাসা। যার কারণে অনেক জায়গায় লেখক অনেক উপকৃত হয়েছেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে।
কিছু ব্যাপার অসঙ্গতিপূর্ণও মনে হয়েছে। যেমন: গ���রুমার অতীত ঘটনা বলে দেয়া, সন্ন্যাসীর আড়াইশো বছর বেঁচে থাকার কথা, ঘরের মধ্যে দৈবভাবে(!) কমোড চলে আসা ইত্যাদি।
সবমিলিয়ে বইটা মিশ্র অনুভূতির জন্ম দেয়। পড়তে পড়তে একেক সময় আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছি, আবার শেষের দিকে একঘেয়ে লাগতে থাকায় মনে হয়েছে- নাহ, এরকম অনিশ্চিত জীবনের আসলে কোন মানে হয় না। আমার কাছে মনে হয় এমন অনিশ্চয়তা আদতেই কারো কাম্য হতে পারে না। তাই বলে সারাজীবন ঘরে বসে থাকাও কোন কাজের কথা না। মাঝেমধ্যে দেশটাকে-পৃথিবীটাকে জানতে, জীবনটাকে একটু অন্যভাবে দেখতে বেরোনোর প্রয়োজন আছে অবশ্যই। তবে সেটা হবে পরিকল্পনামতো, নিজেকে নিয়তির হাতে সঁপে দিয়ে নয়।
Vivid description of travelling various parts of India, India before independence, through different conditions will definitely transcend the readers to that time and place and feelings and experiences of joy, sorrow, pain, desperation ,hunger, humiliation and most importantly the connection between hearts....people completely unknown embracing each other will touch your heart. One of my favourite books.
Superior writing, effortlessly transcends reader to the pre-independence era travelling almost aimlessly to different parts of India. Feel the pain, hunger, desperation and determination alongside author in an unprecedented manner.
মুগ্ধতায় আটকে যাওয়ার মতো বই।বাংলা সাহিত্যে এরকম আত্মজীবনী মূলক ক্লাসিক উপন্যাস বোধ হয় কমই আছে। উপন্যাসের শুরুতে লেখক নিতান্ত ই বালক, মধ্যবিত্ত ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান। প্রথমে লেখক(স্থবির) এর বাবা মহাদেব চরিত্র ই পাঠক দের অভিভূত করার জন্য যথেষ্ট।