প্রণবেশ রায়, ওরফে পানু তাচ্ছিল্যে পেনো, চাপরাশি হয়ে পত্রিকার অফিসে ঢুকেছিল। পত্রিকার তৎকালীন কর্ণধারের দাক্ষিণ্যে সে সাংবাদিক বনে। পানু রিপোর্টার। কিন্তু স্নেহপরায়ণ মালিকের পুত্রের আমলে সে আর তেমন কল্কে পায় না। বর্তমান মালিক হাঁদু চক্কোত্তি তাকে একরকম বলেই দিয়েছে, যে ভাবেই হোক পত্রিকায় রকমারি ছন্দের কবিতা দিয়ে সে যদি তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকাটিকে পরাস্ত না করে তাহলে তাকে এই সাধের চাকরিটির মায়া কাটাতে হবে।
হাঁদু চক্কোত্তি আবার ছন্দরসিক। কোত্থেকে একটা পুরনো বাংলা পুঁথি যোগাড় করেছে। তাতে আছে অজ্ঞাত কবিদের লেখা নানান ছন্দের কবিতা। পানুর ওপর ভার পড়ে সেই সব প্রাচীন কবিদের কুলুজী খুঁজে বার করার। সেই কাজেই পানুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় এক মাথা পাগলা কিন্তু মস্ত গুণী কবির। চরিত্রটি সরাসরি যেন উঠে এসেছে হ-য-ব-র-ল থেকে। তাই সে কখন পেটুক রামু, কখনও ছাপোষা কেরানি, কখনও বা বার্নার্ড পঞ্চাশ, অসিতবরণ, ভোলা নর্তক কিংবা বীরপুরুষ সাহা। অন্তিম অবতারে সে নিত্য গোঁসাই। একই অঙ্গে এতো রূপ! তুখোড় ছান্দসিক ও ছড়াকার।
আসলে কে সে? সেটাই রহস্য। সেটাই ইতিহাস। সেই নিয়েই গল্প। পঞ্চাননমঙ্গলের মতো রুদ্ধশ্বাস না হলেও কাহিনীতে মজা আছে। সম্যক জানতে হলে বইটা পড়া দরকার।
শেষে যা হয় হোক, এই উপন্যাসে প্রাপ্তি শুধু সেটাই নয়। কাহিনী ছাড়াও পুরো আখ্যান জুড়ে এর ছড়িয়ে আছে অজস্র ছড়া। অসম্ভব নিপুণতায় ছড়াগুলো নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন ছন্দে। ছন্দের দৃষ্টান্তরূপে গদ্যের মাঝে এলেও ছড়াগুলো কোথাও আরোপিত লাগে না। আর এগুলোকে মূলত ছড়া বললেও তার মাঝেই লেখক রেখে দিয়েছেন রামায়ণ, গীতগোবিন্দ, মেঘনাদবধ কাব্যের কিছু কিছু বাংলা ছন্দরূপ! যা অন্যান্য ছড়াগুলোর লঘুতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আছে দৃষ্টান্ত দিয়ে ছন্দের প্রকরণ বোঝানো। অবশ্যই গল্পের মধ্যে, অ্যাকাডেমিক ক্লিষ্টটা নেই তাতে। অথচ গঠন দেখে বোঝা যায় তার পিছনে রয়েছে বিস্তর অধ্যয়ন। পণ্ডিত লোক পাঠ করলে নিশ্চয়ই বুঝবেন। ভুলভ্রান্তি আছে কিনা তাঁরাই বলতে পারবেন।
"বিদঘুটে কবিগণ ঘুটঘুটে আঁধারে, কবিতার মিল খোঁজে রাতে বনে-বাদাড়ে। হ্যারিকেন হাতে নিয়ে ঝোপে মাথা ঢুকিয়ে - খুঁজে দেখে মিলগুলো আছে কোথা লুকিয়ে।"
সত্যিই তো! কোথায় লুকিয়ে আছে বলুন তো এই মিলগুলো? আবার,
"বৈশাখে ছোটো নদী জল কমে সরু, হাঁটু জলে চান করে কুমোরের গরু। বেগুন পটল মূলো - হাটে এল উচ্ছে, হাঁটুজলে গোরুদের গা-টি কে গো ধুচ্ছে?"
বিশ্বাস করুন, এতদিন আমি কবিতার কিস্যু বুঝতুম না। খালি ছন্দে মাথা দোলাতাম। ফেসবুকেও যেসব কবিতা সুন্দর ছন্দের তালে তালে যেত, সেখানেই কমেন্ট করে আসতাম। কিন্তু প্রীতম বসু যেন ছন্দের খেলার ছলে কখন আমার ক্লাস নিয়ে চলে গেলেন, টেরই পেলাম না। "ছিরিছাঁদ" বইয়ের জন্য সবার আগে আমি প্রীতম বাবুকে একটা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানাই। স্যার, আমি আপনার জাবরা ফ্যান হয়ে গেলুম!
"পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল" পড়েই বুঝেছিলাম যে প্রীতমবাবু যদি মঙ্গলকাব্য নিয়ে থ্রিলার লিখতে পারেন, তাহলে বাংলা ভাষা নিয়ে উনি যে আর কী কী করতে পারেন, তার হিসাব মেলা ভার। সেই রেশেই কিনে ফেললাম ২০১৩ সালে প্রীতম বাবুর প্রথম স্বপ্রকাশিত বই "ছিরিছাঁদ"। মাত্র ১১২ পাতার একটা উপন্যাস আমাকে ছন্দের যাদুতে আচ্ছন্ন করে ফেলল। কবিতাকে একটা নতুন দৃষ্টিতে দেখতে পারব এখন থেকে। এককথায় বলতে গেলে, ছন্দ নিয়ে ছেলেখেলা করলেন লেখক। অথচ কোথাও পণ্ডিতিয়ানা জাহির করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা দেখতে পেলাম না। সংস্কৃত এবং বাংলা ছন্দের যে-কটি মৌল রূপ আছে, তার মাত্রাগণনা আর পর্বভাগের কৌশল তিনি খুব সাবলীল বাংলায় আর গল্পচ্ছলে বুঝিয়ে দিলেন। একদিকে গল্প এগিয়ে চলল স্বচ্ছন্দে, অন্যদিকে পাঠকের ছন্দের শিক্ষা হল সম্পূর্ণ!
গল্পের মূল চরিত্র একজন রিপোর্টার। নাম পানু৷ "বঙ্গলেখনী" পত্রিকায় সম্পাদক হাঁদু চক্কোত্তির অধীনে পানু রিপোর্টার একজন মাথামোটা অপদার্থ, যাকে দিয়ে কোনও কাজ হয়না বলে হাঁদুবাবু মনে করেন। কিন্তু শুধু ওনার বাবার কথায় তিনি এই ছেলেটিকে চাকরিতে বহাল রেখেছেন। বঙ্গলেখনীর অফিসের ঠিক উল্টোদিকে হাঁদুবাবুর রাইভাল বিপুল লাহার "নববঙ্গ" পত্রিকার অফিস। তাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে হাঁদু চক্কোত্তি দেখিয়ে দিতে চান যে বাংলা কবিতায় ছন্দের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। এই কাজেই একদিন ওনার হাতে আসে বহু পুরনো দিনের জরাজীর্ণ একটা পুঁথি। "লালচে তুলোট কাগজ, জায়গায় জায়গায় জলের দাগ হলদে হয়ে বসে কালি থেবড়ে দিয়েছে।, কাগজের কোনাগুলো ছিঁড়ে গেছে। প্রথম পাতায় গোটাগোটা সুন্দর হাতে লেখা - 'শ্রীছন্দ'।"
এই শ্রীছন্দে এমন কিছু ছন্দ দেখতে পেলেন হাঁদু বাবু, যার ব্যবহার এখন আর পাওয়াই যায় না। তাই পানু রিপোর্টারের ওপর দায়িত্ব বর্তালো সেইসব কবিদের খুঁজে বার করার। এদিকে রাতের বেলা এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা মিউজিয়াম - এইসব জায়গায় শুরু হল চোরের উপদ্রব। চোর প্রচুর মূল্যবান বাংলা সাহিত্যের বই ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, কিন্তু কিছুই খোয়া যায়নি। পানু হন্যে হয়ে খুঁজতে বেরোতেই ওর দেখা হতে লাগল বেশ কিছু লোকের সঙ্গে, যাদের ছন্দের জ্ঞান অফুরান, কিন্তু তাদের ট্র্যাক করা দুরূহ। কখনও দেখা হল পেটুক রামুর সাথে, আবার কখনও ছাপোষা কেরানির সাথে, কখনও সে নিত্য গোঁসাই, আবার কখনও অসিতবরণ। এইভাবেই জমে উঠল গল্প। আর গল্পের আড়ালে পরিচয় পেতে লাগলাম তোটক, চম্পক, বলাকা, মন্দাক্রান্তা, দিগক্ষরা, পঞ্চচামর, একপদী, দ্বিপদী, ত্রিপদী, অনুষ্টুপ, রুচিরা, পয়ার, ভুজঙ্গপ্রয়াত - এইরকম সমস্ত সংস্কৃত ছন্দের সঙ্গে, যারা প্রীতম বাবুর কলমের সহজ সরল "ড্যাডাং ড্যাং" বা "তা ধিন ধিন" ভাষায় আমার চোখের সামনে নাচতে লাগল। সাথে ওনার লেখা কবিতাগুলোর একেকটা ছন্দতে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল। রহস্য যত ঘনীভূত হতে লাগল, ততই মনে হল এমন বই হয়তো প্রীতম বাবুর পক্ষেই সেল্ফ পাবলিশ করা সম্ভব। যেখানে কন্টেন্টই আসল, বইয়ের প্রচ্ছদ, কোয়ালিটি এসব ম্যাটারই করে না সেইভাবে।
২০১৩ সালের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হওয়ার পর দ্বিতীয় সংস্করণ আসে অগস্ট ২০১৭ তে৷ এর মানে বইটা পাঠকদের টনক নাড়াতে হয়তো একটু সময় নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অগুন্তি বইয়ের ভিড় থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে তাকে কষ্ট করতে হয়নি। লেখকের নতুন বইদুটির জনপ্রিয়তায় এই "ছিরিছাঁদ"-ও প্রচারের আলোয় চলে আসে। তবে ফেসবুকের প্রচার আরও বেশি থাকলে ২০১৩ সালেই এই বই বেস্টসেলার হতে পারত আমার ধারনা। লেখককে অনেকেই ফেসবুকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন আগে। উনি ছিলেন ফেসবুকে কিছুদিন আগে পর্যন্ত। তবে এখন প্রোফাইল ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিয়েছেন। হয়তো আবার কোনও রত্ন আমরা পেতে চলেছি অদূর ভবিষ্যতে৷
বইয়ের শুরুতেই শঙ্খ ঘোষ আর সুধীর চক্রবর্তীর মুখবন্ধ পড়লেই বুঝতে পারবেন কেন এই বইকে লেখক উৎসর্গ করেছেন কবি ভারতচন্দ্র রায় ও কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে৷ কবিতা যারা ইতিমধ্যে ভালোবাসেন, তাদের জন্য বইটা অবশ্যপাঠ্য। আর যারা কবিতাকে ভালোবাসতে চান, ছন্দের ভেলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চান, তারা প্রীতম বাবুর হাত ধরে বেরিয়ে পড়ুন। আপনার যাত্রা শুভ হতে বাধ্য। :)
অল্প কথায় বলতে গেলে, এই বই বা এই ধরণের বই যদি বাংলা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হতো, ব্যাকরণের নামে ছাত্রছাত্রীদের গায়ে জ্বর আসা বন্ধ হতো। পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল, চৌথুপীর চর্যাপদ-র পর আরো একবার মুগ্ধ করলেন লেখক।
ছিরিছাঁদ – প্রীতম বসুর ছন্দ-থ্রিলার: ইতিহাস, কাব্য আর কল্পনার অদ্ভুত সংমিশ্রণ প্রকাশক: লেখক স্বয়ং মূল্য: ₹১৭৫ প্রথম প্রকাশ: ২০১৩ | দ্বিতীয় সংস্করণ: ২০১৭ পৃষ্ঠা সংখ্যা: ~১১২
১) কল্পনার শহরে ছন্দের জোয়ার
উপন্যাসের সূচনাই যেন এক অপূর্ব কবিতা—ধুলোঝরা কালের পাতায় হারিয়ে যাওয়া এক তরুণ কবির আবির্ভাব। নাম—শ্রীছন্দ। ইতিহাসে তাঁর অস্তিত্ব আজও বিতর্কিত, কিন্তু কথিত আছে, যখন লক্ষ্মণ সেন বাংলার মসনদে, জয়দেবরা যখন গীতগোবিন্দের মধুময় স্তবক গাঁথায় ব্যস্ত, তখনই রাজসভার দরজায় হাজির হন এই দুর্ভেদ্য সাহসী বাঙালি যুবা। বাংলা তখনও কাব্যের মঞ্চে সদ্য হাঁটি হাঁটি পা পা করছে, চারদিকে সংস্কৃতের শ্রুতিমধুর দাপট। তবু সেই ক্ষণজন্মা কবি বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেন এমন ছন্দে, এমন অন্ত্যমিলে, যে সেখানে বসে থাকা ভাজাপোড়া সংস্কৃত পণ্ডিতদেরও চোয়াল খুলে যায়।
তাঁর কাব্যে ছিল না ধ্বনি-বহ্নি বা অলংকারের চাকচিক্য—ছিল ছন্দের ধাক্কা, ভাষার আত্মবিশ্বাস, আর অন্তরের অনুবেদনা। সংস্কৃতের মহীরুহদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাংলাকে তিনি এমন আত্মমর্যাদার আসনে বসালেন, যেন চিৎকার করে বললেন—"এই ভাষাও পারে!"
রাজা লক্ষ্মণ সেন তখন নাকি আবেগে নিজের সাতলহরী মুক্তহার খুলে তাঁর গলায় পরিয়ে দেন, এবং উপাধি দেন "কবিকণ্ঠহার"—যেন তিনি কেবল কবি নন, কবিদের অলংকার। এই দৃশ্য যেন বাস্তব নয়, কিংবদন্তি। এবং এই কিংবদন্তির ধুলোঘেরা পাতাতেই প্রীতম বসু রচনা করেছেন তাঁর ছন্দময় কল্পলোক।
এখান থেকেই শুরু—এক অদ্ভুত যাত্রা, যেখানে কল্পনার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পাঠক পাড়ি দেন বাংলা কবিতার সেই বিস্মৃত জনপদে, যেখানে ছন্দ কখনও অস্ত্র, কখনও মানচিত্র।
কিন্তু এখানেই গল্প শেষ করেন না প্রীতম বসু। তিনি ইতিহাসের পাতায় লেগে থাকা ধুলোমলিন কালি ঝেড়ে, সেই পুরনো পুঁথির গন্ধ মেখে এনে ছুঁড়ে দেন আধুনিক কলকাতার ছাপোষা অফিসঘরে—যেখানে টাইপরাইটারের খটখট শব্দের ফাঁকে ঘোরে নিষ্প্রাণ কাগজ আর প্রাণহীন সাহিত্য-আড্ডা। তিনি ঢোকান একখানা অগোচর থ্রিলার—যেখানে বিপরীতমুখী সাহিত্যপত্রিকা, বঙ্কিমমনা সম্পাদক, কবিতাবিমুখ রিপোর্টার আর কালো কোট পরা ষড়যন্ত্রের দল গিলে ফেলতে চায় ছন্দকে।
এই রহস্যগল্পের মোড়কে পাঠকের হাতে গুঁজে দেন ছন্দের অদৃশ্য কিলবিল—যেমন এক হাতে মশাল, অন্য হাতে মানচিত্র। পাঠক বুঝতেই পারেন না কখন গল্পের ছলাকলায় তিনি ঢুকে পড়লেন ত্রিপদী, তূণক, ভুজঙ্গপ্রয়াত, বলাকার ভেতর দিয়ে এক ছন্দোপনিষদের ভিতর। শিখে ফেলেন—অজান্তেই—কীভাবে বাংলা ভাষার প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসের মাঝে লুকিয়ে থাকে ছন্দ, কীভাবে কবিতা শুধু আবেগ নয়, এক প্রকৌশল!
গল্পের মূল চালিকাশক্তি এক পানু রিপোর্টার — এমন এক তরুণ, যাকে অফিসের সবাই অপদার্থ ভাবলেও ভাগ্যদেবী চুপিচুপি তার কানে ফিসফিস করে নির্দেশ দেয় এক কবিতার মিশন সম্পন্ন করতে। হাঁদু চক্কোত্তির ‘বঙ্গলেখনী’ পত্রিকার এই অনিয়মিত রিপোর্টারকেই দেওয়া হয় এক অসম্ভব দায়িত্ব—শ্রীছন্দের পাণ্ডুলিপির অক্ষর থেকে হারিয়ে যাওয়া ছন্দ উদ্ধার করা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ফের ছন্দের হাওয়া বইয়ে দেওয়ার ভার।
এই অনুসন্ধানে পানুর পাশে দাঁড়ান তার বদমেজাজি বস হাঁদু চক্কোত্তি — নিতান্তই ছন্দপ্রেমী এক কাঁটাবাঁশি সম্পাদক, যিনি চান বাংলা কবিতায় ছন্দের পতাকা আবার স্বমহিমায় উড়ান নিক। আর গল্পের পথে ধাপে ধাপে পানু’র সঙ্গী হয়ে ওঠেন একদল অদ্ভুত চরিত্র—পেটুক রামু, নিত্য গোঁসাই, অসিতবরণ—যাঁদের প্রত্যেকেই একেকজন ছন্দের ওস্তাদ, ছায়ায় থাকা ছন্দ-সংরক্ষক, যারা কথা বলেন ত্রিপদী, হাঁটেন অনুপ্রাসে, আর নীরবে রক্ষা করেন বাংলার পদ্য-পরম্পরা।
এই চরিত্ররা যেন ছন্দের রক্ষাকবচ—ছোটখাটো, এলোমেলো, ছাপোষা চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একেকজন “ছন্দ-গুণী”, যাঁদের কন্ঠে অজান্তেই বেজে ওঠে এক-একটি হারিয়ে যাওয়া ছন্দের ঢং। তাঁরা যেন বাংলা কাব্যের প্রাচীন পদ্যের পাহারাদার—নিশুতি রাতের ছায়া ঘেরা অলিতে-গলিতে ছন্দের পাণ্ডুলিপি রক্ষা করে চলেছেন নিঃশব্দে। তাঁদের সহায়তায় ধীরে ধীরে খুলে যায় তালাবদ্ধ ইতিহাসের কবাট—আর বাংলা সাহিত্যের শরীরে ফের জেগে ওঠে মন্দাক্রান্তা, বলাকা, ভুজঙ্গপ্রয়াত, তোটক, পঞ্চচামরের মতো রোমহর্ষক ছন্দ।
প্রথমে মনে হতে পারে, এই উপন্যাস শুধুই ছন্দ-স্মরণ—একটা সাহিত্যের নস্ট্যালজিয়া। কিন্তু না! ‘ছিরিছাঁদ’ কেবল গদ্য নয়, একেবারে ছন্দের ড্যান ব্রাউন স্টাইলে লেখা সাহিত্য-সন্দেশে গাঁথা ট্রেজার হান্ট—যেখানে একেকটা কবিতার পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে একেকটি সাংকেতিক সূত্র, একেকটি ছন্দ যেন দিচ্ছে দিকনির্দেশ, পাঠককে নিয়ে ছুটছে এক কাব্যিক কুইস্টে—শব্দের চোরাগলি পেরিয়ে হারানো “শ্রীছন্দনিকেতন”-এর খোঁজে।
৩) ছন্দের মেলোডি ও ব্যাকরণ—দুই-ই!
বইটি পাঠককে ছন্দের পাঠ দেয়, কিন্তু কাঁধে ব্যাকরণের বস্তা চাপিয়ে নয় — এই পাঠ যেন ভোরের হাওয়া, না জানিয়ে এসে চুপিচুপি মুখে চুমু দিয়ে যায়। প্রীতম বসু এই উপন্যাসে বাংলা ও সংস্কৃত কাব্যছন্দকে এমনভাবে গল্পের খাপে গেঁথেছেন, যে পাঠক ছন্দের নামগুলো মুখে আউড়ে ফেলার আগেই ওদের প্রেমে পড়ে যান।
উনি তুলে এনেছেন বিস্মৃতপ্রায় ছন্দরূপগুলো, যাদের নাম শুনলেই অনেক পাঠক চোখ কুঁচকান—কিন্তু এখানে? তারা সবাই যেন গল্পের সহচর! প্রতিটি ছন্দ জীবন্ত হয় গল্পের চরিত্রদের মুখে, কবিতার ছলে। নিচে কিছু প্রধান ছন্দের নাম আর সহজ উদাহরণ দিয়ে দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে তারা গল্পের শরীর জুড়ে জেগে ওঠে:
ক) পয়ার: সবচেয়ে চেনা। ছড়ার ছন্দ। প্রতি পঙক্তিতে ১৪ মাত্রা, সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত (৮+৬)।
*উদাহরণ:
“আষাঢ়ে দিন মেঘলা আকাশ, গাঙের বুকে ঢেউ পানু খোঁজে শ্রীছন্দপুথি, কলকাতা জ্যোৎস্নায় ঢেউ।”
পয়ার ছন্দের ধারা এমনই—পড়লেই মনে হয় যেন দাদু বলছেন কোনো পুরনো গল্প।
খ) অনুপ্রাস: শব্দের শুরুতে ধ্বনির পুনরাবৃত্তি, একধরনের শব্দ-জাদু।
এ যেন সাহিত্য দিয়ে ছন্দ শেখানো, আবার ছন্দ দিয়ে সাহিত্যের রহস্যভেদ—একসাথে দুটো যাত্রা। আর তাই, ছিরিছাঁদ কেবল একটা উপন্যাস নয়, একটা "কবিতা স্কুল ইন ডিজগাইজ"।
আর কে বলেছে ব্যাকরণ মানেই শুকনো, ধুলোমাখা, ছুঁলে হাঁচি ওঠে এমন কিছু? প্রীতম বসু দেখিয়ে দেন—ছন্দ মানে শুধু নিয়ম নয়, ছন্দ মানে জীবন।
ঠিক যেমন popular science বইগুলো — মতান্তরে কার্ল সেগানের Cosmos, ব্রায়ান গ্রিনের The Elegant Universe, নীল ডি গ্রাস টাইসনের Astrophysics for People in a Hurry বা সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের The Gene — আমজনতার মনে বিজ্ঞানের প্রতিটি কঠিন সূত্র ঢুকিয়ে দেয় গল্প আর উপমার হাত ধরে, ঠিক তেমনই ছিরিছাঁদ বাংলা ছন্দের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায় একদম painless infusion-এর মতো।
এটি একটি popular poetics বই—নিশ্চিন্তে বলা যায়, বাংলায় এমন উপন্যাসের চেহারায় ছন্দের ব্যাকরণ বই হাতে গোনা। যেখানে শুধু “মাত্রা”, “পর্ব”, “অন্ত্যমিল”, “তাল” শেখানো হয় না—সেখানে ছন্দ নামে এক বুনো হরিণ পাঠকের বুকের মধ্যে দৌড়ে বেড়ায়।
বিশ্বাস করুন, যদি অ্যারিস্টটলের পোয়েটিকস বইটাও ছিরিছাঁদ-এর মতো উপহার-মোড়কে আসত! মাস্টার্সের দিনগুলোতে !! ক্যাথারসিস আর মিমেসিস নিয়��� যা পড়েছিলাম—শুকনো অনুবাদ আর গম্ভীর টীকাভাষ্যের জ্বালায় মাথা আর মনে একসঙ্গে হাঁটু গেড়েছিলাম। তখন "ট্র্যাজেডি" বলতে শুধু নাট্যরীতিকে বুঝতাম না — আমার নিজের হালও ছিল ট্র্যাজিক!! একেকটা গ্রিক দর্শনের সঙ্গে প্যাঁচ খাওয়া ট্র্যাজিক যুদ্ধে প্রায় পরাজিত সৈনিক আমি!
ছিরিছাঁদ এমন একটা বই, যেটা পড়লে মনে হয়—ইশ্, যদি সব কঠিন সাহিত্যতত্ত্ব এমন গল্পে মাখানো ছন্দের ময়দায় গড়াগড়ি খেত! এটা কোনও ভাবেই বোঝার মান কমানো নয়—এ এক আনন্দময় উন্মোচন। যদি কেউ অ্যারিস্টটলের বইটার সাথেও প্রীতম বসুর মতো আচরণ করত, তাহলে সাহিত্যের তত্ত্ব আমরা টকমিষ্টি লেবু-চায়ের মতো চুমুক দিয়ে খেতাম—বালি ঝড়ের মধ্যে শুকনো বিস্কুটের মতো চিবোতে হত না।
আরও মজার বিষয়? যে কোনও বাংলা ভাষার শিক্ষক, কবিতা শেখানোয় হিমশিম খাওয়া সেই ক্লাস টেনের মাস্টারমশাই হোন কিংবা বাংলা অপশন নিয়ে বসে থাকা বিসিএস পরীক্ষার্থী—এই বই তাঁদের সবার জন্য একটা অল্টারনেটিভ টেক্সট।
একদম মোক্ষম টুল। এখানে কবিতার ব্যাকরণ গল্পের মধ্যে গলে যায় চুপিচুপি, ঠিক যেন মগে চা রেখে কেউ কানে ফিসফিস করে বলছে—"ধা ধিন ধিন ধা… মিল পেয়ে গেছো তো?"
এটা সেই ছলছল কাব্যপাঠ যেখানে কেউ জোর করে বই খুলে বলতে বলছে না—“বলো তো, পয়ারের মাত্রা কত?” বরং আপনি নিজেই অনুভব করছেন পয়ার যখন পানু রিপোর্টারের মুখে ঝরে পড়ছে ছন্দের মতো করে।
Grammar এখানে কোনো ঠ্যাঙাড়ে মাস্টার নয়—এখানে Grammar হল গল্পের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা এক চতুর জাদুকর।
ঠিক যেমন popular medicine বই Why We Sleep বা Being Mortal পাঠককে মেডিকেল টার্মের মধ্য দিয়ে মানুষ হওয়া শেখায়, তেমনই ছিরিছাঁদ বাংলা কবিতার কঠিন ছন্দগুলোকে “মানুষ করে” তোলে। নিয়মকে পোষ মানায়। চোরা-জলপথে গল্পের ভেলায় চেপে পাঠকের মনে ঢুকিয়ে দেয় সেই নিয়ম—খেয়ালও থাকে না কখন শিখে ফেললেন ‘অনুপ্রাস’ আর ‘মন্দাক্রান্তা’র পার্থক্য।
ছন্দকে আপনি ক্লাসরুমে তর্জন-গর্জনে শেখাতে পারেন, অথবা... একটা পাতলা বই খুলে, গল্পের পিঠে হাত বুলিয়ে, গভীর রাতে ফিসফিস করে শুনে ফেলতে পারেন একটা প্রাচীন কবির কান্না— যার নাম শ্রীছন্দ।
আর এই কাজটা, প্রীতম বসু করেছেন এমনভাবে, যেন বাংলা ভাষাই তাঁকে মুখের কাছে এনে বলেছে— "তুই আমায় আবার লিখে দে। ছন্দে দে।"
৪) সাবটেক্সট ও বার্তা:
"ছিরিছাঁদ ছড়িয়ে আছে, শুধু চাই দেখার চোখ আর শোনার কান।"
এই একটাই লাইন যেন পুরো উপন্যাসের মর্মবাণী। বাংলা সাহিত্য তো বটেই, গোটা ভারতীয় সাহিত্যেই ছন্দকে নিয়ে যে একধরনের বিস্মরণ ঘটেছে—এক আত্মবিলোপী নির্লিপ্তি ভর করেছে আমাদের পাঠভঙ্গিতে—সেই অচলায়তনের বিরুদ্ধে প্রীতম বসুর কলম যেন ছন্দ-সঞ্জীবনীর কাজ করে।
তাঁর ভাষা যতটা সহজ, ঠিক ততটাই পরিশীলিত; কোথাও যেন শিশুতোষ ছেলেখেলা, আবার কোথাও নির্ভার অথচ তীক্ষ্ণ নিরীক্ষার সাহস। তিনি প্রমাণ করে দেন, সাহিত্যের চর্চা মানেই গম্ভীরতা নয়—তা হতে পারে রসিক, খেলুড়ে, কিন্তু গভীর। এই উপন্যাস কেবল ছন্দ শেখায় না, ছন্দকে আবার জীবন্ত করে তোলে।
আর বার্তা একটাই—যদি ঠিকভাবে দেখতে ও শুনতে পারো, সাহিত্যের প্রতিটি কোণেই ছিরিছাঁদ লুকিয়ে আছে।
৫) সীমাবদ্ধতা?
যদি খুঁত খুঁজতেই হয়, তবে বলতে হয়—‘ছাপোষা নায়ক’ পানু আর ‘হাঁদুবাবুর মতো নেতৃস্থানীয়, খানিক প্যারডিক গন্ধমাখা চরিত্র’—এই দু’টি আর্কটাইপ প্রীতম বসুর আগের উপন্যাস পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল-এও ছিল। ফলে কিছু পাঠকের মনে হতে পারে, চরিত্রায়নে ভিন্নতা কম, বা লেখক নিজস্ব এক “প্লট কমফর্ট জোন”-এ বারবার ফিরে যাচ্ছেন।
তবে একে সীমাবদ্ধতা বলা যতটা ঠিক, তার চেয়ে বেশি একধরনের signature style বলা যেতে পারে। যেমন সত্যজিৎ বাবুর লালমোহনবাবু, কিংবা ফেলুদার তোপসে—ঠিক তেমনই প্রীতম বসুর লেখায় ছাপোষা চরিত্ররাই নায়ক হয়, কারণ তাঁদের মুখেই সে বসান ছন্দের অনবদ্য উচ্চারণ।
শেষ কথা? “ছন্দই যদি চরিত্র হয়, তবে পুনরাবৃত্তিই তো তার প্রকৃতি।”
৬) উপসংহার:
ছিরিছাঁদ কেবল একটি উপন্যাস নয়—এ এক পূর্ণাঙ্গ ছন্দযাত্রা, এক অলক্ষ্য ভাষার খোঁজে ফিরে যাওয়া, যেন বাংলার হারিয়ে যাওয়া কবিতার পদাবলিতে নতুন প্রাণের জোয়ার। এটা শুধু "ছন্দের বই" না, এটা একটা অভিজ্ঞতা—যেখানে কাহিনি ও কাব্য, রহস্য ও রস, ব্যাকরণ ও ব্যঞ্জনা—সব মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব পাঠভ্রমণে পরিণত হয়। মনে পড়ে যায় Edgar Allan Poe রচিত The Poetic Principle-এর সেই অমর উক্তি, “I would define, in brief, the poetry of words as the rhythmical creation of beauty.”
যাঁরা কবিতা বোঝেন না, তাঁরাও এখানে এসে হয়তো অবাক হয়ে বলবেন—"এই বোঝাটা কীভাবে সম্ভব হলো!" আর যাঁরা ছন্দে অভ্যস্ত, তাঁরা হয়তো খুঁজে পাবেন এমন সব পদের দ্যুতি, যা বরাবর পাঠ্যবইয়ের বাইরে ছিল ।
এই বইয়ের re-read value আকাশছোঁয়া। একটা ছন্দ না-হয় পড়লেন আজ, কিন্তু তিন মাস পর আরেকটা পড়লে নতুন চোখে ধরা দেবে। কারণ এখানে ছন্দ শুধু শেখার বিষয় নয়—ছন্দ বাঁচে, নাচে, বলে!
এই বই কাদের জন্য? বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, কবিতাপ্রেমী শিক্ষার্থী, উঠতি কবি ও কাব্যিক খেলোয়াড়, সাহিত্যের জাদুতে গা ভাসানো মজার পাঠক, এমনকি কেউ যদি “ভয় পাই ছন্দ” ক্যাম্পেরও হন—তাঁরাও!
আর রেফারেন্স হিসেবে রাখা উচিত কি না? বলছি—চোখ বন্ধ করে রাখুন। যতবার খুলবেন, ততবার নতুন কিছু দেখবেন। পৃথিবীর প্রতিটি ছন্দমুগ্ধ পাঠাগারে এই বই থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
শেষ লাইনটা ধরে রাখুন: “ছিরিছাঁদ ছড়িয়ে আছে—এই বই-ই যেন সেই চোখ আর কান।”
আমার কবিতার নামে জ্বর আসে। পড়তে পারি না একদম। কিন্তু এই বইটা পড়তে বসে, ভালোবেসে ফেললাম ছন্দ। Pritam Basu আপনার কাজে আমি মুগ্ধ। পরের বইগুলো পড়ব। এত সুন্দর করে ছড়া আর ইতিহাস একসাথে কখনও পাইনি। মন ভালো করা বই। আর আমি, পেটুক রামু থুড়ি অসিতবরণ থুড়ি শ্রীছন্দের (ওনার কি আর একটা নাম!) ভক্ত।।
একি ছন্দের খেলা খেলে গেলেন প্রিতম বসু, কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারছিনা। হন্যে হয়ে এখন ছন্দের বই খুঁজে চলেছি। সব কবিতার বই আবার করে পড়তে মন চাইছে। মঙ্গলকাব্য গুলো পড়তেই হবে এবার। কে জানত এত ছন্দ আছে, তার এত সুন্দর ব্যাবহার। প্রত্যেকের একবার অবশ্য পাঠ্য বই এটি।
কবিতা পদ্য ছন্দ কখনই আমাকে টানেনি, আসলে বুঝিনি, কিন্তু এই বই পড়ার পর, সব কেমন ভাবে অনেক টা পাল্টে গেলো, নতুন করে কিছু জিনিস জানলাম বুঝলাম। খুব ভালো লাগলো।
অনেক কুঁড়েমির পড় অবশেষে এই বইটি পড়লাম, আজ্ঞে হ্যাঁ , পুরোই ধপ-পাস পড়লাম! তবে আবার পড়তে হবে, পড়তে হবে ছন্দের প্রেমে ... প্রীতম বসু একজন জিনিয়��স (আমার তো সন্দেহ হয় তিনিই শ্রীছন্দের বংশধর!)