শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ে এর জন্ম বাংলাদেশের খুলনায়।১৯৪৭ এর পর থেকেই কলকাতা নিবাসী।তার আত্মজীবনী মূলক বই জীবন রহস্য। দেশভাগের পূর্বে খুলনায় কাটানো শৈশব, কৈশোর এর কথা, তারপর পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া সেখানকার জীবন, লেখালেখি নিয়ে এই বই। লেখক অকপটভাবে নিজের সম্পর্কে পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছুই বর্ণনা করেছেন তার লেখায়।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম অবিভক্ত ভারতের খুলনাতে (অধুনা বাংলাদেশ)। খুলনা জিলা স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে তাঁর পরিবার কলকাতায় চলে আসে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন, ১৯৬১ সালে আনন্দবাজারে যোগ দেওয়ার পর তাঁর ছোটগল্প ‘হাজরা নস্করের যাত্রাসঙ্গী’, ‘ধানকেউটে’ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘বৃহন্নলা’, কিন্তু দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ প্রকাশিত হওয়ার পরেই শ্যামলের লেখনী বাংলা পাঠকমহলে সমাদৃত হয়। ব্যক্তিজীবনে বোহেমিয়ান, সুরসিক ও আড্ডাবাজ ছিলেন তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর অন্যতম কর্তা সন্তোষকুমার ঘোষের সাথে তাঁর মনোমালিন্য হওয়ায় যুগান্তরে যোগ দেন। যুগান্তরের সাহিত্য পত্রিকা অমৃত সম্পাদনা করতেন। ১৯৯০ সালে অবসরের পরে আজকাল পত্রিকা ও সাপ্তাহিক বর্তমানে নিয়মিত লিখেছেন। গ্রামীণ জীবন, চাষবাস, সম্পর্কের জটিলতা ইত্যাদি শ্যামলের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১৯৯৩ সালে শ্যামল সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন ‘শাহজাদা দারাশুকো’ উপন্যাসটির জন্যে। এছাড়া তাঁর লেখা দেশ বিদেশের নানা ভাষাতে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
বইয়ের প্রথম বাক্য,প্রথম অনুচ্ছেদেই আটকে গিয়েছিলো চোখ-
"সময়ের দূরত্বে সাধারণ কথাই রূপকথা হয়ে যায়।জীবনে কেউ তো আর বিশিষ্ট হবার জন্য গুছিয়ে ঘটনা ঘটায় না। বহতা নদীর মতোই জীবনটা নাচতে নাচতে ঢেউ তুলে কালের তীর ধরে কথা-কাহিনী ছড়াতে ছড়াতে বয়ে যায়। তারপর একদিন সবজীবনই মৃত্যুর মতো এক অনন্ত নিদ্রা বা মহাসাগরে গিয়ে পড়ে। সেই নিদ্রাসাগরই আমাদের জীবনের মোহনা। কিংবা এই মোহনা থেকেই অনন্ত জন্মের মহাজীবন।"
শ্যামলের "ঈশ্বরীতলার রূপোকথা" নিয়ে আলোচনা করছিলাম আমি আর রুবেল। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে শ্যামলের অকপট সারল্য আর সততা নিয়ে। "জীবন রহস্য " তখনো পড়িনি বলে জানতাম না।এই "সততা" শ্যামলের ক্ষেত্রে ধ্রুব সত্যি। অসততা বা মিথ্যাচার কীভাবে করতে হয় তা শ্যামলের বিন্দুমাত্র জানা নেই। নইলে নিজের জীবনের কথা এভাবে বলা যায় তা কে জানতো! আর কী এক জীবন! ছোটবেলায় চুরির কথা বলতে লেখকের আটকায় না।আটকায় না বাবার ঘুষের কথা (দক্ষ লোক ছাড়া ঘুষ খেয়ে হজম করা যায় না) কিংবা নিজের পতিতালয়ে গমনের কথা বলতেও। ঘটে গেছে।শ্যামল বলছেন। অনেক ভাইবোন। মা।বড়দা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মিলিটারি বড়মামা।দেশভাগ। হিন্দু মুসলমানের বিরোধ। দেশত্যাগ।সূর্যের আলো। চাঁদের জ্যোৎস্না। দাপাদাপি। খাবার থালায় নধর সবুজ সব ডাঁটালো কাঁচালঙ্কা। প্রেম।প্রত্যাখ্যান। ভাইয়ের আত্মহত্যা। বাড়ি থেকে পালানো। চাকরের কাজ নেওয়া। নিষিদ্ধ প্রেমের সাক্ষী হওয়া।বিয়ে।সংসার।কৃষক জীবন।লেখক জীবন।
শ্যামলের জীবনে ঘটনার অভাব নেই।অভাব নেই বিস্ময়, ব্যথা, বিষাদ ও পর্যবেক্ষণের। কী সব আশ্চর্য মানুষদের পেয়েছিলেন জীবনে! একজন সুবলদাকে পাওয়া তো কিশোর বয়সে যে কোনো বালকের স্বপ্ন। নিজের বউদিকে ভালো লাগে বলে অপরাধবোধে আক্রান্ত বালককে যিনি আশ্বস্ত করবেন "তাতে কি হয়েছে!তোর বয়সে এটাই স্বাভাবিক।" বলে। স্বপ্নদোষ হওয়া লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া বালককে যিনি নির্দ্বিধায় বলবেন "স্বপ্নদোষে আবার দোষের বালাই কি রে পানু?অমন তো সবারই হয় একটা বয়সে।নে ঘুমো।"
শ্যামলের সততাটা লোক দেখানো নয়।তার লেখাই জীবন, জীবনই লেখা। নিরন্তর বহতা স্রোতের মতো জীবনের সব ঘটনা আশ্চর্য নির্লিপ্তির সাথে বলে চলেছেন তিনি। কখনো খেই হারিয়ে ফেলছেন। উদঘাটন করছেন নিজের জীবন ও সময়কে।আবার নিজের সমসাময়িক লেখকদের নিয়েও তার মূল্যবান পর্যবেক্ষণ ধরা পড়ছে থেকে থেকে। নিজের দর্শন, লেখার উদ্দেশ্য ও ফর্ম নিয়ে বলা কথাগুলো বারবার পড়তে হয়। যেমন -
"লেখার উদ্দেশ্য একটিই। তা হল উন্মোচন। অনুসন্ধানের পথে পথে এই উন্মোচন। বিনা মন্তব্যে সরল বাক্য সাজিয়ে এগিয়ে যাওয়াই আমার পদ্ধতি। আমি বলতে চাই সবচেয়ে কম। আর চাই—আমার না-বলাটুকু পাঠকের মনে ক্রমিক পুনঃ-সৃষ্টি হতে থাকুক। সে-ই পথ খুঁজে পাক।"
পড়ার পর একটা কথাই মনে হচ্ছে - জীবনকে কীভাবে এতোটা ভালোবাসা যায়? এতো গভীরভাবে?এতোকিছুর পরেও?
বইটা অন্যরকম। খুব অন্যরকম। লেখক শুধু যে নিজের শৈশব, কৈশোর, যৌবনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন, তা নয়। তার লেখা, বিভিন্ন লেখক, সম্পাদক, বন্ধুদের কথাও উঠে এসেছে। মাঝে বহুবার ভেবেছি, মনের কথা কি করে অকপটে বলে দিয়েছেন লেখায়। কোন আড়াল নেই।
জীবন রহস্যে পরিপূর্ণ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই । সময়ের স্রোত অমুক তমুকের জীবনের গতি কোথা থেকে যে কোথায় নিয়ে যায় তার কোন ঠিক ঠিকানা থাকে না। কিন্তু জীবনের যে এতো গুলোও দিক আছে তা কে জানতো ! শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন খুব সাদামাটা ছিলো না আবার জাঁকজমক ও ছিলো না । জোয়ার ছিলো ভাটা ছিলো- তার মতে ঊনিশ বছর পর্যন্ত তার জীবনে ভাটার পরিমাণ ই বেশি ছিলো ।
আমাদের সবার ই কিছু গোপন অংশ আছে , জীবনের কিছু কালিমাখা ব্যাপার আমরা হাতেগোনা কয়েকটা বিশ্বাসী ঘনিষ্ট মানুষ কে ছাড়া কাউকে বলি না কিন্তু শ্যামল বাবু সেসবের ধার ধারেন নি । এমন সব কথা অকোপটে স্বীকার করেছেন যা একজন সাহিত্যিকের স্বীকারোক্তির দিক দিয়ে খুব একটা স্বস্তিকর নয় (যেমন-আমার বাবা একজন অলিম্পিক ঘুষখোর ছিলেন) সেই কিশোর বয়সে এক মেয়েকে ভালোবাসার অপরাধে শাস্তিস্বরূপ ন্যাড়া হওয়ার পর তিনি কেন যেন ঐ মেয়ে সহ পৃথিবীর সকলকেই স্নেহের ও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেন । তিনি তখন ই বুঝে গেলেন যে এই জগতে সবাই সবাইকে বুঝতে পারে না এবং বুঝার দরকার ও খুব একটা নেই সুতরাং নিজেকে বুঝানোর জন্য মরিয়া হওয়া কোন কাজের কথা না । তিনি প্রচুর অভিজ্ঞতাপূর্ণ একটি জীবনের জট একে একে খোলার চেষ্টা করে যেন শেষমেশ পিছিয়ে গেছেন । কি দরকার ! থাকুক না যেটা যেমন আছে! আমরা জ্ঞানী জ্ঞুনী , বিখ্যাত কুখ্যাত লোকদের জীবনকথা আকছার পড়ি । কখনো তাদের সফলতা দেখে আমাদের মধ্যে হিংসার জন্ম হয় , কখনো তাদের কর্মকান্ডে একটা দুঃখের মতো সুখ আসে , আবার কখনো তাদের নিজের ঢোল নিজের ই বাজাতে দেখে বিরক্তি লাগে …… শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লোকটা সেরকম কোন সুযোগ দেন নি । যেন লেখার সময় নিজেই ঠিক করে রেখেছিলেন পাঠক যাতে কোন গৎবাঁধা সিদ্ধান্তে আসতে না পারে ! যাই বলেন জীবনে পড়লাম দুইজনের আত্মকথা যা কখনো ভুলবার নয় , এক আমাদের শিবরাম চক্রবর্তী আর দুই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় । উনার একটা চমৎকার কথা মাথায় জীবনেমরনে রেখে দেওয়ার মতো। তোমরা যখন পরনিন্দা ,পরচর্চা করো – সেই সময়টা আমরা লিখি
"সময়ের দূরত্বে সাধারণ কথাই রূপকথা হয়ে যায়।" জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়টায় নান ঘটনায় মুড়ানো থাকে। নিজের এই ঘটনা বহুল জীবন নিয়ে একজন লেখক আত্মজীবনী বা স্মৃতি কথা লিখে থাকেন। উপন্যাসের আদলে বা গল্পচ্ছলে সে ঘটনা বহুল জীবন লেখক লিখে থাকেন। তবে সব আত্মজীবনী মনে দাগ কাটে না। কিছু আত্মজীবনী পড়লে ভিতটা নাড়িয়ে দিয়ে যায়, তেমন একটা বই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী " জীবন রহস্য "।
রহস্য ঘেরা এ জীবন নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নাই। জীবনের বাঁকে বাঁকে নানান ঘটনা, বিচিত্র সব মানুষ উঁকি দিয়ে দেখে কেউ বা থেকে যায় আবার কেউ বা হারিয়ে যায় চিরতরে। শুরুটা ছিলো একেবারে শৈশব থেকে। চেনাজানা পরিবেশ, ভাই-বোন, বাবা-মা, নদী, গ্রাম, পথ, ট্রেন, আশেপাশের মানুষ এবং একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠা। একই সাথে বাবার কাজ, মায়ের সংসার, দাদার ভালোলাগা- হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ও সকাল বেলার আলো।
একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠা, জীবন ও জীবীকা র খোঁজ করা, লেখালেখি শুরু। লেখালেখির জগতে এসে বন্ধু হিসেবে পাওয়া - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মতি নন্দী, জ্যোতিরিন্দ্র, শক্তি, বিমল, বরেন,দীপেন ছাড়াও অনেকে। টুকরো টুকরো সব স্মৃতি, কাটানো সময়, জীবন নিয়ে ভাবনা, অতীতের ভুল, আলগা হয়ে যাওয়া বন্ধুত্বের বন্ধন ছোট্ট এই বইটাতে তুলে এনেছেন।
আত্মজীবনীতে যেমনটা হয়-- ধারাবাহিক ভাবে জীবনের প্রতিটি স্তরের ঘটনা আগাতে থাকে শেষের দিকে। এ বইটাতেও তেমনটা হয়েছে - প্রথমদিকের ঘটনাগুলো ধারাবাহিক ভাবে থাকলেও মাঝের দিকে নিজের খুব ব্যক্তিগত জীবনটা বাদ দিয়ে লেখালেখি, বন্ধু বা লেখার সাথে জড়িত দারুণ সব ঘটনা বা স্মৃতি জুড়ে দিয়েছেন। সাথে মিশেছে আত্মোপলব্ধি। চমৎকার একটা আত্মজীবনী। অনেকদিন মনে থাকবে।
'জীবন রহস্য' শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মকথা। তার নিজের জীবনের নানান ঘটনা, অভিজ্ঞতা থেকে জারিত জীবনবোধ বা দর্শন অসংকোচে, অকপটে লিখেছেন। জীবনের রহস্যের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছেন শ্যামল। তবে সেই চাউনির ভেতরে উদঘাটনের কঠিন জেদ, মানব চরিত্রকে বুঝে ফেলার আত্মতৃপ্তি এসে কখনো শাসন করে নি। খুবই সহজ গদ্যে, ছোট ছোট সরল বাক্যে লেখা। কখনো কোন শব্দের জন্য হাতড়ে বেড়ালে তিনি খোঁজেন নিতান্ত আটপৌরে, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা কিংবা ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা কোন শব্দকে। শ্যামলের ছোটবেলা কেটেছে খুলনায়। বিশ্বের নানা জায়গায় যখন ইতিহাসের এক একটা ঘটনা এসে রাজনীতির মানচিত্র ওলটপালট করে দিচ্ছে, তখন হয়তো তিনি খালিশপুরের জঙ্গলে একা একা নতুন কোন বেড়ানোর জায়গা খুঁজে পেয়েছেন, নয়তো ছোট ভাইকে নিয়ে মেঠো শুকনো রাস্তা ধরে শহরের শেষে নতুন জায়গা ---ময়লাপোতা, বেনেখামার, গোবরচাকা আবিষ্কার করেছেন। তার সন্দেহ হয়েছে ওসব জায়গা ভারত ও ভূমণ্ডলে আছে তো? তারপর তো অন্য অজস্রদের মতো দেশভাগের পরে কলকাতা। পড়াশুনো ধরা এবং ছাড়া এবং পুনরায় ধরা। নতুন করে সংসার। তার ভাষায় :-
"উনষাট বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রীর চাকরি পেয়ে জহরলাল দিল্লির খোলামেলা বড় বাড়িতে উঠে গেলেন। চুয়ান্ন বছর বয়সে আমাদের বাবা মতিলাল রিটায়ারের মুখে মুখে কলকাতায় বাসাবাড়ির এক খুপরি ঘরে উঠে এলেন।"
নানা অসম্মান, অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো সেসব ঘটনার কথা যখন লিখেছেন, মনে হয় নিজেকে কাটাকুটি করার, অতীতকে নতুন করে উল্টেপাল্টে দেখার, যা ঘটেছে তা যেন অন্য কারও ঘটনা ---এমনভাবে লিখেছেন। কিন্তু লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের দর্শন, সামগ্রিক বোধকে যে সেসব তিক্ত অভিজ্ঞতা একটা স্থায়ী ভিত্তি দিচ্ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি নিজেও বলেছেন সে কথা ---ঘাম ঝরিয়ে, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে যে চিন্তা, দর্শনের প্রাপ্তি ঘটে, সেটা টেকসই হয়। ঘাম না ঝরিয়ে কোন গভীর জীবনবোধ আত্মস্থ হয় না। লিখেছেন, ঝুলিতে অবারিত, স্মৃতিকাতরতায় ভারাক্রান্ত শৈশব না নিয়ে কেউ যেন প্রতিভার সাগরে সাঁতার দিতে না যায়। খুব তত্ত্বকথা, প্রচলিত দার্শনিক অভিধায় ফেলে মানুষকে দেখা এবং লেখার ধারেকাছে যান নি তিনি। ভগবান আছে কি নেই, এই প্রশ্ন তুলে উত্তর হাতড়ে বেড়ান নি। জীবনকে খুঁজেছেন বজরা নৌকার তলায় ডুব দিয়ে মরো মরো অবস্থায় দুই নৌকার মাঝখানে আচমকা মাথা তোলার সুযোগ পেয়ে, খুঁজেছেন বহুদিন পর বাবার শ খানেক কচ্ছপ এবং আরও রাজ্যের জিনিস নিয়ে ঘরে ফেরার ঘটনায়। দেখেছেন সেই সময়কে যখন হরহামেশাই শাশুড়ির থেকে মেয়েজামাইয়ের বয়স বেশি হতো, পিসেমশায়দের ভেতর কেউ কেউ ট্রেনে না উঠে অনায়াসে এক দেড়শো মাইল হেঁটে কলকাতা থেকে নিজ গাঁয়ে ফিরতেন। নৌকায় না উঠে সাঁতরে নদী পার হতেন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের অভীষ্ট মানুষ হলো স্বর্গের আগের স্টেশনের সেই খগেন যার চোখে ছিল পৃথিবীকে দেখার জন্য সরলতা, মায়া-মমতার সেই সাদা কাজল যা দিয়ে সারা জীবন এই মাটি এই মানুষ দেখে নিয়ে মৃত্যুর সময়ে শ্যামলকে বলেছিল ---আকাশ থেকে আকাশ তার শরীর অব্দি নেমে এসেছে। আকাশ এত দয়ালু। তাকে আর কষ্ট করে ওপরের আকাশে উঠতে হবে না। নেমে-আসা আকাশেই সে মিশে যাবে। শ্যামল এই নশ্বর জীবনের মুহূর্তের চিরন্তনতা খুঁজতে বেদ-উপনিষদ বা মার্কস-গান্ধী হাতড়ে বেড়াতেন না। তার কাছে, মনুষ্যত্ব এবং জীবন ওসব থেকে ঢের বয়সে বড়ো। বরং সেই চিরন্তনতা খুঁজে পান ইটখোলার পাজায় হা হয়ে থাকা অন্ধকারে, কিংবা চড়ে বেড়ানো গরুর ভেতর। খুঁজে পান মাথায় ইটের থান পড়ে থেঁতলে যাওয়া বুড়ো সাপের শুকিয়ে যাওয়া মাথার কঙ্কালে। বেজিতে শরীর খেয়ে নিয়েছে আগেই। দেখতে পান ঐ তো, সাপের মাথার ফাঁকা দিয়ে কেমন আকাশ নেমে এসেছে! তার মনে হয় বুড়ো খগেনের কাছেও হয়তো আকাশ এমন করেই নেমে এসেছিল। এই হলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। বিশ্বাস করতেন, লেখার ভেতর ভাষা ছড়ি ঘোরাবে না। বিষয় যদি তেমন হয় তবে ভাষা আপনা আপনি তৈরি হয়ে যাবে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে শ্যামল উঠে এসেছেন। হৃদয়ের কাছে বুদ্ধি বারবার হার মেনেছে তার কাছে। বইয়ে আছে একই সাথে অন্যান্য যারা লিখেছেন, তাদের কথা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শংকর চট্টোপাধ্যায় ---এদের কথা ঘুরেফিরে এসেছে। সম্ভবত অনেকের ভেতর এই কজনের সান্নিধ্যেই কাটিয়েছেন বহু সময়। শ্যামলের খেতে পারতেন ভীষণ। এক বন্ধু তার খাওয়া দেখতে খুব ভালবাসত আর হাসত। সেই বন্ধুর মৃত্যুশয্যায় পাশে বসে শ্যামল অর্ডার করে খাবার আনিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে গোগ্রাসে খেলেন! তার বন্ধুর তো খাওয়া দেখে শরীর বাঁকিয়ে সেই পুরোনো হাসি। এসেছে আরও অনেক সাহিত্যিক, সম্পাদক বন্ধুদের কথা। অগ্রজদের এবং অনুজদের কথাও। রবিশংকর বল তার ' জন্মযান' উপন্যাসে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা লিখতে গিয়ে এক চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন :-
"আরে, শ্যামলবাবুর মতো জীবনযাপন নেই, তুই কী করে তাঁর মতো লেখা লিখবি? তুই কাঁঠাল দিয়ে হুইস্কি খাস? তোর বাড়িতে হেমা আর মালিনী নামে দু'টো কুকুর আছে? লেখার টেবিলে বউ আর প্রেমিকার ছবি একসঙ্গে সাজিয়ে রাখার ক্ষমতা তোর আছে? বাদ দে ওসব কথা। "
'জীবন রহস্য' পড়ার পর এখন বিশ্বাস করি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি এসব।
মূলত ৪.৫ স্টার। লেখক তার ছেলেবেলা কে অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু তার লেখক হওয়ার ঘটনা এর সাথে অন্যান্য লেখকের পরিচয় সর্ম্পক এগুলা গুছিয়ে এনেছেন স্বল্প পরিসরে। সেই হিসেবে আরো বড় হওয়া উচিত ছিল সেই বইটি। অথবা প্রথম খন্ড হিসেবে শিশুকাল, শৈশব, কৈশোর, যুবক বয়স পর্যন্ত থেমে গেলে আরো ভাল হত বলে মনে হয়েছে। তবে জীবনের গল্প শেষ হওয়ার নয় সেটা ও সঠিক। শিশুকাল থেকে যুবক পর্যন্ত পড়া যায় খুবই ভাল ভাবে। অত্যন্ত চমৎকার।
বাবা ঘুষ খেতে বাড়তি কাজ করতেন। ঘুষ বলতে ছ'কোনা সিকি, দুয়ানি, বড় তামার পয়সা। তাও সময়ের হিসেবে কম কি? মায়ের বছর বছর সন্তান হত। কেউ বাঁচত, কেউ হয়তো চলে যেত। বড় স��ন্দর ছিলেন মা।
খুলনা তখন কলকাতার অদূরের ছোট্ট শহর। শিববাড়ীতে নদী, খালিশপুরে জঙ্গল আর ফেরিঘাটে কয়েক ঘর জুড়ে বাবুধরা মেয়েদের পাড়া। তো সেখানেও কিশোর বয়সে বন্ধুর সাথে এক অভিজ্ঞতা। দিদি পয়সা দেখে জোর করেই নিয়ে গেল। তো পালা করে খাটে যাবার আগে সে পয়সা চুরি করে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। দিদি টের পায়নি। তারপর দুই বন্ধু মিলে ভো দৌড়।
কিছুই যেন বলতে ছাড়েননি লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ষাটের শুরুতে লিখেছিলেন আত্মজীবনী "জীবন রহস্য"। জীবন তাঁকে নিয়ে রহস্যের হাসি হেসেছে বার বার। এই আত্মজীবনীতে যেন সে হাসি ফিরিয়ে দিয়���ছেন বড় দম্ভের সাথে, কিন্তু নির্লিপ্ত ভাষায়।
জন্মেছিলেন দুই মহাযুদ্ধের মাঝে। শৈশবে পেয়েছেন সংসার সামলাতে হিমসিম খাওয়া বাবা, সংসারে শেকলে ক্লান্ত মা, ঘরভরা ভাইবোন আর খুলনার দুই একটা মোটর চলা রাস্তা, নদী, জঙ্গল, জঙ্গলের খরগোশ। তারপর কৈশোরে পা দিতেই ব্লাক আউট। জাপানি বোমারু বিমানের ভয়ে সব ঘুটঘুটে অন্ধকার। মার্কিন সৈনিক ভরা দেখেছেন নিজের জন্মশহর, খুলনা। কোন কোন দিন কোন এক বাড়ীর সামনে কিছু সৈন্যদের ভিড়। লাইন বেঁধে চলছে গেরস্ত বাড়ির বৌকে ধর্ষণ। চারিদিকে শুধু উৎসুক চোখ।
ব্লাক আউট গেল কিন্তু অন্ধকার গেল না। দেশ পাকিস্তান হলো। এদেশ নাকি আর তাঁদের নেই। ধর্ম ভাগ হচ্ছে, জীবনও বাকী থাকে কেন? বিচ্ছিন্ন দাঙ্গা শুরু হলো শহরের এখানে সেখানে। ভাগ্যসি বড় দুটো ভাই কলকাতায় চাকুরি করতো। অন্তত রিফিউজি ক্যাম্পে উঠতে হলো না। তারপর কলকাতায় দীর্ঘ এক সংগ্রামের অধ্যায়।
লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। স্মৃতিতে জোর দিলে তাঁর লেখা একটি দুটি বইয়ের নাম মনে পড়বে হয়তো। প্রথমটা শাহাদাজা দারাশুকো, দ্বিতীয়টা কুবেরের বিষয় আশায়। আমি একটাও পড়িনি। তবুও কেন জানি তাঁর জীবনীটা পড়তে ইচ্ছে হলো। পড়লাম।
আত্মজীবনীতে এক সরলরেখায় বলে যাচ্ছিলেন জীবনের কথা। থেমে থেমে কিছু স্মৃতিচারণও ছিল। বয়স ত্রিশ পর্যন্ত চলছিল ঠিকঠাক কিন্তু তারপরে কেমন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন লেখায়। সেই বিক্ষোভে কার কথা উঠে আসেনি? সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, মতি নন্দী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সন্তোষকুমার ঘোষ, সাগরময় ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর অনেক অনেক ব্যক্তিত্বের কথা। আচ্ছা সুনীলে গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি বোধ হয় অভিমান ছিল কিছু। হয়তো কিছু হিংসাও। অনেক কাছের করেও যেন দূরের করে রেখেছিলেন। তাই শেষ করার আগে সুনীলের নাম লিখেই যেন পুষিয়ে দিয়ে চেয়েছেন।
খুব সাবলীল সুখপাঠ্য লেখা কি বইটা? লেখক সম্ভবত সাবলীল সুখপাঠ্যতা নিয়ে অত ভাবেনওনি। লিখেছেন নিজের জন্যই। খুব সাজাননি। আবার খুব এলোমেলোও করেননি। নিজের জীবনকে আর জীবননের পাশে লেপটে থাকা সময়কে তুলে আনতে চেয়েছেন আর সেটা পেরেছেনও। এটুকুই যথেষ্ট।
আত্মজীবনী কাকে বলে তা দেখিয়ে দিয়েছেন শ্যামল গাঙ্গুলী। জীবন তাকে ছাড়েনি, তিনিও ছাড়েন নি কাউকে, নিঃশঙ্কচে জীবনের ভুলগুলো পাঠকের সামনে স্বীকার করার দুঃসাহস খুব কম লোকেরই আছে। বিশেষত বাঙালি আত্মকথা লিখিয়েদের।
জীবনের ছোটখাটো জিনিসগুলোও কত সুন্দর করে তুলে ধরা যায় তা হয়তো জানাই হতো না। বড়ই সুন্দর করে, যত্ন নিয়ে, মায়া নিয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের আত্মজীবনী লিখেছেন।
অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়দের আত্নজীবনি 'জীবন রহস্য।' বইয়ের মাঝামাঝিতে এসে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "কবে যে প্রথম অপমানিত হয়ে মনে মনে চুপ করে যেতে শিখেছিলাম- তা এখন আর মনে নেই। তেমনি অনেক আশা করে একদম কিছু না পেয়েও আস্তে আস্তে অভ্যস্ত উঠছিলাম। আঠারো উনিশ বছর বয়সেই আমার নিজের মুখ আমি নিজেই দেখতে পেতাম।"
টানাপোড়নের সংসারে বেড়ে উঠা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ত্রিশের দশকের বেঁচে থাকা কয়েকজন লেখকের মধ্যে তিনি একজন। বাঙ্গালীর আত্নজীবনি নিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছিল, বাঙালি নাকি ফেরেশতার হাতে শয়তানের আত্মজীবনী লেখে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু তা করেনি। অনেকদিন পর কোনো আত্নজীবনি পড়ে মনে হলো আসলে কোনো মানুষের আত্নজীবনি পড়ছি।
নিজেকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করেছেন খুব সাহসের সাথে। নিজের বাবায় ঘুষ খান, কিভাবে খান, পুরো পরিবার কিভাবে এই ঘুষের টাকায় বড়াই করত, তা বলেছেন বিস্তরভাবে। নিজের বন্ধুর যখন অন্যনারীর সাথে অঘটন ঘটিয়ে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তখন লেখক বলেন, "কেন কাম? কেন জন্ম? কেন খুন? নিহতের যেখানে বাঁধা দেওয়ার কোন ক্ষমতাই হয়নি-বুদ্ধিও জন্মায়নি। সে তো সারা জগৎসংসারের ওপর নির্ভর করে এই দুনিয়ায় এসেছে। সেতো সবাইকে বিশ্বাস করে।"
বাংলাদেশের খুলনা জেলায় জন্ম নেওয়া এই লেখক দেশভাগের সময় চলে যান ওপাড় বাঙলায়। আর সেই কথা যখন লেখক বর্ণনা করেন তখন কলিজায় ছিঁড় ধরে। আশ্চর্য পরিবারের গল্প যেন সিনামার মত করে বলে গেছেন লেখক। গ্রামিন সমাজের কথা যেন চোখের সামনে জীবন্ত করে এনে ফেলেছেন।
হুট করে শেষ হয়ে যাওয়া উনার জীবনিতে কি নেই? তৎকালীন সমাজ আছে, ইতিহাস আছে আর আছে হিউমার। প্রতি লাইনে লাইনে উনার হিউমারের ছড়াছড়ি।
রসিকতার ছলে জীবনের কুৎসিত দিকের কথা বলে গেছেন অম্লানে। লেখক বলছেন, "কিন্তু আমার তো তেমন কোন বিশ্বাস ছিল না। থাকবার কথাও নয়। কারণ সত্যিই দাবি করার মত আমি তো তেমন কোনো জিনিসই জানি না।"
শুরুটা একটু মন্থর হলেও, আগা গোঁড়া চমৎকার একটা বই জীবন রহস্য। জীবনের রসিকতা দেখে পাঠক দ্বিধায় পরে যাবে হাঁসা উচিত নাকি কাঁদা?
আত্মজীবনী আসলে কি? অনেকে বলবেন, নিজের জীবনের কথা। অবশ্যই তাই। কিন্তু আত্মজীবনী শুধু নিজের জীবনের কথা না, কখনও কখনও 'নিজের কথা'। নিজের কথা, আর নিজের জীবনের কথা দুটো এক বিষয় না। কিন্তু নিজের কথা কখনও কখনও নিজের জীবনের কথা।
কি? একটু ঘোরালো মনে হলো? হ্যাঁ, অনেকটা এমন করেই লিখেছেন শ্যামল বাবু। কখনও নিজের কথা লিখেছেন, কখনও নিজের জীবনের কথা লিখেছেন। আর একটা মানুষ যখন নিজের জীবনের কথা, নিজের কথা লেখে তখন অবধারিত ভাবেই তার সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষের কথা, সময়ের কথা এসে যায়।
শ্যামল বাবুর বেড়ে ওঠা, অবিভক্ত বাংলার খুলনায়। সেখানে তিনি নদী দেখেছেন, মাটি দেখেছেন। দেখেছেন কি করে সহপাঠী একদিন মুসলিম লীগ হয়ে যায়। কি করে দেশটা ভাগ হয়ে একদল মানুষকে ভিটে ছাড়তে হয়। যদিও লেখকের আসলে ভিটে ছিল না। ছিল ভাড়ার বাড়ি।
বাড়ি ভাড়ার হোক, কিন্তু একজন লেখকের জীবনে থাকে প্রচুর ভাঁড়ার। শ্যামল বাবুরও তাই ছিল। ভুল করে নেহায়েৎ কিশোর বয়সে বেশ্যার সাথে শুয়েছেন। নষ্ট প্রেমিকার পাল্লায় পড়ে প্রথম যৌবনে ন্যাড়া হতে হয়েছে। অতঃপর লজ্জায় হয়েছেন বাড়িছাড়া। একজীবনের ব্যর্থতার গল্পে ঠাঁসা।
তারপর কি করে জীবন কোন বাঁক থেকে কোন বাঁকে চলে যায়, তা এক রহস্য। কি করে লিখেছেন, কেমন করে লেখক হয়ে উঠেছেন, কিংবা আদৌ কিছু হয়েছেন কিনা, তা-ই বুঝি জানা হলো না। ষাট বছর বয়স পেরিয়ে সে সব ভাবতে বসেছেন লেখক।
যারা ম্যাজিক রিয়ালিজম পছন্দ করেন, এ বই তাদের ভালো লাগা উচিত। কেননা সাদা কথার মাঝে লেখক মাঝে মাঝে চলে গেছেন স্বপ্নের মাঝে, মেঘের ওপারে। কখনও খুব সহজ করে গল্প বলেছেন, লিখেছেন কখনও পাকা সাহিত্যিকের মতো। ফেলে আসা সময়ের কথা বলেছেন, বলেছেন অনাগত সম্ভাবনার কথা।
২৩০ পাতার বইয়ে আছে পরিবারের কথা, আছে সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদের কথা। আলোচনার ঢঙে উঠে এসেছে শরৎ বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথের কথা। 'অমৃত' সম্পাদনা করতে গিয়ে যে নবীনদের সাথে পরিচিত হচ্ছেন, তাদের কথা। কিন্তু কোথাও কোন বিষোদগার নেই, অপ্রিয় ভাষণ নেই। মানুষের জন্য এক অকৃত্রিম দরদ যেন কোথায় লুকানো আছে, কথায়? হবেই বা। সেই হয়ত শ্যামল বাবুর সবচেয়ে বড় রহস্য।
আত্মজীবনি যে দুটি জেনারেশনের মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে, সেই সেতু তৈরী করে দেখিয়েছেন শ্যামল তাঁর আত্মজীবনি 'জীবন রহস্য' লিখে। শৈশব বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক আমাদের নিয়ে গেছেন সুদূর ইংরেজ আমলে, যেখানে সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থা তিনি বর্ণনা করেছেন গল্পের ছলে। ইংরেজ ছাড়াও সেই সময়ে মার্কিন সেনাদের বাংলায় উপস্থিতির কথা জানতে পারি বইটি পড়তে গিয়ে। এছাড়া বাবার ঘুষ খাওয়ার কাহিনী, ভুল করে কৈশোরে বেশ্যার সাথে শোয়ার গল্প, দেশভাগ পরবর্তী কোলকাতায় পারিবারিক সংগ্রাম, প্রথম জীবনে ভুল নারীর প্রেমে পরে ন্যাড়া হওয়া, অনার্সে রাজনীতি করতে গিয়ে ডিসকলেজিয়েট হওয়ার বর্ণনা.. জীবনের সবকটা গল্প তিনি এই বইটিতে লিখে গেছেন নিঃসংকোচে। কিন্তু কেন জানি না, বইয়ের শেষ অংশগুলো লিখতে গিয়ে শ্যামল বোধ করি একটু খেই হারিয়ে ফেলেন। তাই ৫ তারা দিতেও গিয়েও ৪ তারা দিয়ে থামতে হলো।
এই বইটার রিভিউ লেখার কোন যোগ্যতা আমার নেই। তাই সেই অপচেষ্টা করবো না। সামান্য প্রতিক্রিয়া বলে যাই মাত্র।
জীবনে যা কিছু ঘটেছে সেগুলো অকপটে বলার মতো সাহস জগতে কয় গণ্ডা মানুষের থাকে? দেশী বিদেশী বহু তাবড় তাবড় মানুষ দেখেছি যারা আত্মজীবনী লিখতে গেলে দুধে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে যান। তাদের চরিত্রের পবিত্রতা দেখলে দেবলোকের বাসিন্দারা পর্যন্ত নিজেদের চরিত্র নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করবেন। সেসব ভণ্ড, মিথ্যুক, জোচ্চোরদের বয়ানের বিপরীতে শ্যামলের আত্মজীবনী এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত। বরং বলা ভালো এক বিধ্বংসী ঝড়। আফসোসের বিষয় হচ্ছে এই পথে হাঁটার দুঃসাহস আর কারও হয়েছে এমনটা দেখে যেতে পারবো না।
অবশ্য শ্যামল বাংলা সাহিত্যে যে ধারা তৈরি করে গেছেন সেই পথেও সহসা কেউ হাঁটবেন না।
পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষ ইউনিক, প্রত্যেকটা লেখকের লেখা ইউনিক। তারপরেও সেখানে কইয়ের ঝাঁক আছে। শ্যমল সেখানে একলা এক বোয়াল, ঝাঁকের বাইরে অন্য অভিমুখে গিয়ে অন্য নদীতে ভেসে উঠেছেন, অন্য স্রোত আবিষ্কার করেছেন।
শ্যামল হজম করার মতো নাড়ি যাদের আছে তাদের কাছে এই বই অমৃতসমান।
কিছু বই চুম্বকীয় হয়। পাঠককে টেনে ধরে রাখে। এক পৃষ্ঠার পর অন্য পৃষ্ঠায় জোর করে আছড়ে ফেলে। বই শেষ হওয়া পর্যন্ত পাঠকের যেন নিস্তার নেই। এক ধরণের মধুর অত্যাচার বলা যায়। তেমনই একটা বই হলো শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'জীবন রহস্য'।
বই পড়তে পড়তে যত সামনের দিকে আগাচ্ছিলাম, ততই বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম লেখকের সততা, সরলতা আর সহজ সাবলীল বাক্যগঠনের মাধ্যমে পাঠককে মোহনীয় করার ক্ষমতা অনুধাবন করে৷
লেখকের ছোটবেলার অপ্রাপ্তি, বাউন্ডুলেপনা আর বেশ্যাপল্লিতে যাওয়ার ঘটনা অকপটে বলে দেয়ার মতো সৎ মানসিকতা, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে যুবা বয়সের বিভিন্ন বিখ্যাত লেখক এবং ব্যক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া কিংবা জীবনে বেঁচে থাকার যে মূল্যবান সম্পদ— 'স্মৃতি' তাকে নিয়ে লেখকের ভাষ্য, ভাবনা এবং হাতের মোয়ার মতো খেল দেখানো পাঠকেকে নিশ্চিতভাবেই আকৃষ্ট করবে।
'একটা বই পড়া মানে বিগত শতাব্দী ভ্রমণ করা বা বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছ থেকে দেখা' টাইপ একটা কথা আছে না? এই বইয়ে সেটা টইটম্বুর। একেকবার মনে হচ্ছিল যে, আমি বোধহয় টাইম- ট্রাভেল করতেছি বর্ণনার সাথে সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী উত্তাল রাজনীতি, দেশভাগের বেদনাবিধুর স্মৃতি সবই ফুটে উঠেছে লেখকের ভাষ্যে। কে নেই? সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, আবু ইসহাক, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর, অমিতাভ চৌধুরী এমনকি খোদ জীবনানন্দ ও!
লেখক গতায়ু হয়েছেন প্রায় দুই যুগ হলো। তবে তার লেখা যে এখনো তার জীবদ্দশায়ের লেখার মতো সমান আবেদনময়ী, সফল এবং মোহনীয় এবং সেটা যে তাকে অমর-অক্ষয় করে রাখবে যুগ যুগ ধরে তা বলাই বাহুল্য।
জীবন রহস্য বইটায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের কথা বলেছেন, নিজের জীবন ও জীবনের সাথে জড়িত সবার কথাই কমবেশি বলেছেন; মানে আত্মজীবনীতে মানুষ যা করে আরকী।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই আত্মজীবনী অন্যগুলোর থেকে আলাদা আর কেন এটা পড়তে হবে। বাংলা কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা যতটা স্বপ্রতিভভাবে শ্যামল গাঙ্গুলীর লেখায় এসেছে আর কারো লেখায় তেমন স্বতস্ফুর্তভাবে ভাবে আসেনি। মার্কেজের বাংলা অনুবাদ তো দূরের কথা ইংরেজী ভাষান্তরও তখন একদমই দূর্লভ। শ্যামল বলতে গেলে তেমন পড়ুয়াও ছিলেন না, তাহলে তার লেখায় এমন সাবলীল ম্যাজিক রিয়ালিজম উৎসারিত হলো কীভাবে?
উত্তর হচ্ছে শ্যামলবাবুর জীবন। তিনি জীবনের প্রতি মোড়ে মোড়ে এমন সব ঘটনা বা দূর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন যে তার জীবনটাই আস্ত মার্কেজের উপন্যাস হয়ে গেছে। একদম কাঁচা কৈশোরে দূর্ঘটনাক্রমে শুয়েছেন বারবণীতার সাথে; সেই খবর পরিবারে, পাড়ায় চাউড় হলে উপেক্ষিত, একঘরে হয়েছেন সবার থেকে। তার পুরো কৈশোর কেটেছে এক ধরণের হীনমন্যতায়, পারিপার্শ্বিকতার সাথে মানিয়ে নিতে নিজের জগত নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়েছে। প্রথম যৌবনে স্বৈরিণী প্রাক্তনের প্রভাবে নিজেদেরই সহপাঠী-বন্ধুর দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন, ন্যাড়া হতে হয়েছে। সেই অপমানে বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্যের বাসায় চাকরগিরি করেছেন, সেখান থেকেও পালিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় গিয়ে ফিল্মের সুপারস্টারের ভড়ং ধরার সুযোগও ছাড়েননি। এই সব ঘটনা শ্যামলবাবুর জীবনের টিপ অব দ্য আইসবার্গ মাত্র। আত্মস্মৃতি নাকি আত্মোপলব্ধি বলা মুশকিল! যেন ছোট্ট স্ক্রিনে নিজের জীবনের টেস্ট ম্যাচ দেখতে দেখতে রানিং কমেন্ট্রি করছেন, বিশ্লেষণ করছেন অভিজ্ঞ ধারাভাষ্যকার। কখনো নিজের কথা বলতে বলতে তিনি সম্পূর্ণ অন্য জগৎ সৃষ্টি করে ফেলেছেন, বুনে ফেলেছেন জাদুবাস্তব এক জগৎ। জীবনের প্রতি পরতে পরতে তিনি চারপাশকে, নিজেকে, সম্পর্কগুলো আবিষ্কার করেছেন নতুন করে। জীবন এক আশ্চর্য জাদুর প্রদীপ হয়ে ধরা দিয়েছে তার হাতে। তাই হয়তো, সাররিয়েলিজম তার লেখায় আসে প্রকৃতিগতভাবেই। যেটা শহীদুল জহির, মানিককে আনতে হয় অনেক কায়দা করে তবুও তাতে মার্কেজের গন্ধ লেগে থাকে, মনে হয় ল্যাটিন কোন গাছ বাংলাদেশের মাটিতে এনে জোর করে পুতে দেওয়ার কারণে সেটি হাসফাস করছে।
শ্যামল ��ঙ্গোপাধ্যায় লেখা পড়া সবসময়ই অনন্য এক অভিজ্ঞতা। তার আত্মজীবনী, এই জনরায় বাংলা ভাষার অনন্য এক মাইলফলক হিসেবেই উদ্ধৃত থাকবে।