Saadat Hasan Manto (Urdu: سعادت حسن منٹو, Hindi: सआदत हसन मंटो), the most widely read and the most controversial short-story writer in Urdu, was born on 11 May 1912 at Sambrala in Punjab's Ludhiana District. In a writing career spanning over two decades he produced twenty-two collections of short stories, one novel, five collections of radio plays, three collections of essays, two collections of reminiscences and many scripts for films. He was tried for obscenity half a dozen times, thrice before and thrice after independence. Not always was he acquitted. Some of Manto's greatest work was produced in the last seven years of his life, a time of great financial and emotional hardship for him. He died a few months short of his forty-third birthday, in January 1955, in Lahore.
একপ্রান্তে 'সদত হসন' অন্যপ্রান্তে 'মন্টো'। মন্টো ছিলেন " সদত হসন " জাতির বংশোদ্ভূত। যাদের সম্বন্ধে ইতিহাসে কিছুই নিশ্চিতভাবে বলা নেই। মন্টো শব্দটার কাশ্মীরি ভাষায় অর্থ হল কোনও বস্তু ওজন করার জন্য ব্যাবহৃত সামগ্রী বা এককথায় বাটখারা। এই মন্টো শব্দটার উৎস জানতে তিনি জওহরলাল নেহেরুকে চিঠি লেখেন। মৃত্যুর কিছু দিন আগে তিনি লিখেছিলেন, "আমরা দু'জন (সদত হসন এবং মন্টো) একসঙ্গে জন্মেছিলাম এবং সম্ভবত একই সময় মারা যাব।"
দেশভাগ টা মন্টো আমৃত্যু মেনে নিতে পারেন নাই। তিনি প্রবল দুঃস্বপ্নেও কোনদিন কল্পনা করেননি যে ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান দুটো আলাদা সংস্কৃতি, আলাদা সমাজ, আলাদা দেশ হয়ে যাবে। দেশ ভাগের আগে তিন বার এবং দেশ ভাগের পরে পাকিস্তানে তিনবার তাঁর লেখা অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কাঠগড়ায় দাড়িয়েছেন। কারো চোখে তিনি "প্রগতিশীল " কারো চোখে "প্রতিক্রিয়াশীল"। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে যাবার পর জীবনের সাত বছর কাটে চরম দারিদ্র্য ও হতাশায়। কিন্তু এই সময়টাতেই তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো লেখা।
আড়াইশোর বেশী ছোটগল্প লিখেছেন মন্টো। প্রায় বাইশটা সঙ্কলনে ধরা আছে সেগুলি। মন্টোর লেখক জীবনকে মোট তিনটা পর্বে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্ব ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত --১৯৩৪-১৯৩৫ এই দুই সাল মিলে। এ সময় সবে লিখতে শুরু করেছেন।
পরবর্তী অধ্যায় ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭। এর মধ্যে দেড়বছর দিল্লিতে থাকা বাদ দিলে পুরা সময়টা তিনি বম্বেতে ছিলেন।
তৃতীয় পর্বের শুরু ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত অর্থাৎ তাঁর পাকিস্তানের দিনগুলো। এসময় মন্টো দারিদ্র্যলাঞ্চিত, উপেক্ষিত, স্বপ্নহত, বিমর্ষ, বিধ্বস্ত। পাশাপাশি দেশভাগের যন্ত্রনায় ক্ষতবিক্ষত।
৪৭'এর দেশ ভাগটা আমরা ব্যক্তিগত ভাবে যার যার অবস্থান থেকে দেখে থাকি, কারণ ছোট বেলা থেকে আমরা বই পড়ে যা জেনেছি তাতে, অবিভক্ত বাংলাকে যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দুই ভাগ করে ফেলা হয় তখন বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধিকার পায় মুসলমান জাতি। এখানে যত হিন্দুর ছিলো তাদের উপর নানা অত্যাচার হয় এবং এদেশ ছেড়ে দেশ ভাগের নীতি অনুসারে তাদের দেশ ভারতে চলে যেতে হয়। কিন্তু ভারতে শুধু তো হিন্দুদের বাস ছিলো না তাদের মাঝে মুসলমানরা ও বাস করতো তাদের উপর অত্যাচারের কাহিনি নিয়ে বই থাকলেও খুব একটা পড়া হয়নি। এদেশ থেকে যে ভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে ভারতে গেছে একই ভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে পাকিস্তানে গেছে হাজার মানুষ। চিত্রটা একই শুধু মানুষগুলো দুই জাতের।
দেশ ভাগের যন্ত্রনা টা গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। তাঁর অধিকাংশ গল্পের চরিত্র বেশ্যা, দালাল, মাংস ব্যবসার সাথে জড়িত মানুষ। মন্টোর আড়াই শতাধিক গল্পের প্রধান চরিত্র এরাই। তাঁর গল্পে এত বেশ্যা কেন?
যদিও তাঁর সমাধিলিপিতে লিখে রাখা সম্ভব হয়নি, তবে তিনি নিজের কবরে লেখার জন্য একটি সমাধিলিপি লিখেছিলেন," এখানে শুয়ে আছে আছে সদত হসন মন্টো। তার সঙ্গে সঙ্গে গল্প লেখার শিল্প ও রহস্য কবরস্থ হয়েছে ... টন টন মাটির নীচে শুয়ে সে ভাবছে, কে বড় গল্প লেখক, খোদা,না সে।"
সাদাত হোসেন মান্টো — ছোটগল্পের ঈশ্বর৷ যিনি তাঁর কবরে উৎকীর্ণ করার জন্য একটি সমাধিলিপি লিখেছিলেন:
'এখানে শুয়ে আছে সদত হসন মন্টো। তার সঙ্গে কবরস্থ হয়েছে গল্প লেখার সব শিল্প ও রহস্য... টন টন মাটির নীচে শুয়ে সে ভাবছে, কে মহান গল্পলেখক: খোদা না সে ?'
কিন্তু মান্টোর কিসসা কি শুধুই হরফের অদ্ভূত খেয়াল অথবা খোয়াবের বয়ান? নাহ, মান্টোর কিসসা হলো আসলে হাকিকত, সৃষ্টিকর্তা মানুষের ললাটে নিয়তির যে গল্প খোদাই করেন, সেই গল্পের অসহনীয় যন্ত্রণার নির্মম পরিহাসের হাকিকত — যেখানে নারী-পুরুষের মাংসের খুশ 'বু' চেতনাকে অসাড়তা দেয়, লাহোরের হিরামান্ডি, দিল্লির জি টি রোড, বম্বের ফরাস রোডে ল্যাম্পপোস্টের নিচে কিংবা গলির আনাচে-কানাচে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো মেয়ের মাংসের ভেতর প্রতিধ্বনিত হওয়া ঘামের নিঃশ্বাস আর হৃদয়ের গভীরে সহস্রধারা ঝর্ণার মত অশ্রু - ক্রোধের গল্প আছে, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত তরবারির আঘাতে বিচ্ছিন্ন মস্তকের রক্তস্রোতের ধারা অথবা নিষ্পাপ 'শারিফান' এর নিথর নগ্নদেহ আছে, ঠান্ডা গোস্তের (মৃত) সঙ্গে সঙ্গম আছে, ডাক্তার জানালার পর্দাকে ইশারা করে 'খোল দো' বলাতে স্ট্রেচারে পড়ে থাকা বিধর্মী এবং স্বধর্মী কর্তৃক অগণিত বার ধর্ষিত হওয়া অর্ধচেতন সখিনা অজান্তেই সালোয়ার নামিয়ে দু'পা ফাঁক করে দেয় — আর পাওয়া যায় দেশভাগের কোন্দলে নিষ্ঠুর পরিণতির সাক্ষী দেওয়া 'টোবা টেক সিং', কাঁটাতারের বিভক্তি রেখার মাঝে নো ম্যানস ল্যান্ডে মরে পড়ে থাকা সেই বেওয়ারিশ লাশ৷ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তরবারির ফলা থেকেও শাণিত ছিল মান্টোর তেজী কলম৷ লুটপাত, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ মিলিয়ে সেই অস্থিতিশীল অবস্থা নিয়ে শ্লেষমাখা 'সিয়াহ হাশিয়ে'(কালো সীমানা) গল্পগুচ্ছের লাবজের মধ্য নরকীয় আগুনের তীক্ষ্ণ আঁচে মনুষ্যত্বের চামড়া খসে পড়ে ধর্মান্ধতার কালচে দাগ রেখে যায়৷ যিও মান্টো, যুগ যুগ যিও !
'আগুন লেগে পুড়ো পাড়াটা জ্বলে গেল... শুধু একটা দোকান বেঁচে গেল, যার গায়ে একটা বোর্ড ঝোলানো ছিল: 'এখানে সকল প্রকার ইমারতি দ্রব্য পাওয়া যায়।'
আমাদের দেশ যদিও একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিল, তবু উর্দু সাহিত্যের সাথে আমাদের পরিচয় কম। বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধিতার ফলাফলেই কিনা এদেশে উর্দু সাহিত্যের প্রসার তেমন একটা হয়নি। উর্দু সাহিত্যে সাদাত হাসান মান্টোকে অন্যতম সেরা গল্পকার বলা হয়। বিস্তর ছোটগল্পের মাধ্যমে দেশভাগ ও এর সময়কালীন উপমহাদেশের পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছেন। রচনা সংগ্রহটিতে পঁচিশটি ছোটগল্প, তিনটি প্রবন্ধ, একটি নাটক ও একটি চিঠি রয়েছে। সময়কাল বিবেচনায় গল্পগুলোকে দেশভাগের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ভাগে স্থান দেওয়া হয়েছে।
মান্টোকে নিয়ে প্রথম বিস্তারিত জানতে পারি রবিশংকর বলের লেখা 'দোজখনামা' উপন্যাসের মাধ্যমে। মান্টো যখন মুম্বাইতে থাকতেন তখন বিভিন সিনেমার গল্প লিখতেন। মুম্বাইয়ের যে খুপরিতে থাকতেন তার চাইতে পায়রার খোপও বড় হয়। মান্টোর লেখাতে বেশ্যাদের উপস্থিতি বেশ সরব দেখা যায়। তাদের দেখেছিলেন খুব নিকট থেকে। সেই মেয়েদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা অবলোকন করেছিলেন বিশেষভাবে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় গল্পগুলোতে। তবে কিনা এই নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মানুষদের নিয়ে লেখার জন্য অশ্লীলতার দায়ে একাধিকবার মামলার দ্বারস্থ হতে হয়েছে মান্টোকে। দেশভাগের পূর্বের গল্পগুলোর মধ্যে 'দশ টাকা, আমার নাম রাধা, কালো শালোয়ার' বেশ ভালো লেগেছে। 'আমার নাম রাধা' গল্পটিতে একটি মেয়েকে নিয়ে যেভাবে গল্প উপস্থাপন করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য।
দেশভাগ মেনে নিতে পারেন নি মান্টো। দেশভাগের তীব্র বেদনা নিয়ে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েও চরম দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। এই সময়কালে যে গল্পগুলো লিখেছেন তার বেশিরভাগই দেশভাগের হাহাকার থেকে লেখা। 'আল্লার দোহাই' গ���্পটিতে দেশভাগের শিকার এক বুড়ির তীব্র হাহাকার তুলে ধরে। 'বুনো ঝোপের পিছনে' গল্পে আমরা দেখতে পাই ভালোবাসার জন্য মানুষ কী করতে পারে! মান্টোর বিখ্যাত দুইটি গল্প 'ঠান্ডা গোস্ত' ও 'শরিফন'। দেশভাগের সময় অনেক মেয়ে ধর্ষিত হয়েছিল। সেই ঘটনাগুলো উপজীব্য করেই গল্প দুইটি রচিত।
মান্টোর তুলনা মান্টো নিজেই। তবে মান্টো তাঁর কবরে এপিটাফের কয়েক লাইন লিখেছিলেন। 'এখানে শুয়ে আছে সাদাত হাসান মান্টো। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে লেখার শিল্প ও রহস্য কবরস্থ হয়েছে...টন টন মাটির নিচে শুয়ে সে ভাবছে, কে বড় গল্প লেখক? খোদা না সে?' তবে এই বাক্যগুলো কবরের ফলকে লেখা সম্ভব হয়নি। সভ্য সমাজের ভন্ডামিগুলোকে তাঁর গল্পের মাধ্যমে অকপটে উপস্থাপন করেছেন। দেশভাগ বা সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষদের নিয়ে লেখালেখির দিক দিয়ে মান্টো সবসময়ই এগিয়ে থাকবে।
ওপার বাংলার একটা সমস্যা হলো স্বাভাবিক বানানগুলোকে অস্বাভাবিক করে তোলা। সাদাত হয়ে যায় সদত, মান্টো হয়ে যায় মন্টো! পুরো গ্রন্থটি একক অনুবাদ না। একাধিক অনুবাদের কাজ হলেও অনুবাদ দারুণ হয়েছে। মান্টো পড়াটা জরুরি বলে মনে করি। অনেকের কাছে তাঁর গল্পগুলো অশ্লীল মনে হতে পারে। তবে এর চাইতে ভালোভাবে ঐ প্রেক্ষাপটের গল্পগুলো উপস্থাপন করা সম্ভব হতোনা। দেশভাগ ও দেশভাগ পূর্ববর্তী ভাবনা-অভিজ্ঞতা নিয়ে মান্টোর জগৎ-এ পাঠককে ভ্রমণের আমন্ত্রণ রইলো। হ্যাপি রিডিং।
সাদাত হাসান মান্টো! একটা ক্ষত। এ যুগের ঠিক কতজনের কাছে পরিচিত নামটা আমি ঠিক জানিনা, তবে জেনে রাখুন ইনি উর্দু ভাষা এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে পঠিত ও বিতর্কিত লেখক! এই বইটা পড়ার আগে আমার অনেক সাহস সঞ্চার করতে হয়েছে আসলে। কেন সেটা বলছি! মান্টো এমন একজন লেখক, যিনি ব্যার্থতা, দুঃখ, দারিদ্র, কষ্ট আর সবচাইতে বেশি ঘৃণার সাগরে ভেসে ৪৩ বছরের জীবন পার করে গেছেন। দেশভাগের সময় তিনি নব্য পাকিস্তান নিবাসী হতে বাধ্য হন। এই দেশ কে কেন দুটো দেশ হতে হবে, কেন ধর্মের নামে খুন হতে হবে তিনি মানতে পারেননি। মান্টো বলেছিলেন, 'স্বাভাবিকের চেয়ে এক ডিগ্রি ওপরে থাকে আমার শরীরের তাপমাত্রা, আর তা থেকেই বুঝবেন আমার ভিতরে কি আগুন জ্বলছে।' হাজারো অভিযোগে অভিযুক্ত এই লেখক বহুবার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। দেশভাগ, হত্যা, রাহাজানি বিভক্তি তাঁকে কিভাবে দুমড়ে মুচরে দিয়েছিলো তাঁর লেখায় বোঝা যায়। কি রুক্ষ, ভারী তার কথাগুলো, অনুভূতি গুলো।
আমি অনেক খুঁজেছি এই কালো বইটা। যেবার পেলাম, পৃষ্ঠাসংখ্যার দ্বিগুনের বেশি দামে কিনতে আমার বাঁধেনি। এখানে ২৫টা গল্প, নাটিকা, প্রবন্ধ আর তাঁকে নিয়ে লেখা কিছু কথা আছে। আমি কেন পড়ার আগে সাহস সঞ্চারের কথা বলেছিলাম এবার বলি। এই গল্পগুলো, লেখাগুলো...একদমই ভিন্ন, ব্যাতিক্রম। কখনও কখনও মনে হয়েছে এত সহজ করে লেখা, কিছু বুঝলাম না কেন? আবার কখনও মনে হয়েছে আমি মনে হয় অনুভব করতে পারছি তাঁকে। ভায়োলেন্স এখনকার অলংকার। তাই গায়ে লাগার কথা না, কিন্তু কেন যেন এগুলো খুব গায়ে কাঁটা দিল। সবচেয়ে বড় যে ভয়টা আমি পাচ্ছি, পাঠক হিসাবে উনি যা বলতে চেয়েছেন, আমি কি আদৌ বুঝতে পেরেছি ওনার কথাগুলো? ওনার জ্বলে পুড়ে যাওয়া রুক্ষ অনুভূতি গুলো?
অনুবাদ হিসেবে এই বইটা ভালো লেগেছে। সাদাত হাসান মান্টো এখানে কেন যেন সদত হসন মন্টো হয়ে গেলেও বেশ সুন্দর বইটা। মান্টো সাহেবের আরও লেখা আমি পড়তে চাই। কারণ ইনি সেই লোক যিনি নিজেকে সৎ না...ভন্ড, রূঢ় ভাবেই উপস্থাপন করতে চান। যিনি সমাজের সব ভন্ডামিকে খুলে দিতে একটুও ভাবেননি, যিনি নিজের এপিটাফে লিখে যেতে চেয়েছিলেন, 'কে ভালো গল্প লেখে, খোদা? না মান্টো?'
কলেজে যখন পড়তাম তখন আমার বাংলা স্যার বলতেন, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল হলেন বাংলা সাহিত্যের এক একটা নক্ষত্র। সাহিত্যে উনাদের পতন সম্ভব নয়। কেন যেন মনে হয়েছে উর্দু সাহিত্য মান্টো সাহেবও তেমনই একটা নক্ষত্র। যে নক্ষত্র তার সেই সময়ের চেয়ে এগিয়েছিলেন, তার ধ্যান ধারণা ছিলেন অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। এক শব্দে যদি বলা হয় তাহলে প্রগতিশীল। তার লেখায় অন্তর্নিহিত ভাব আপনার ভিতরের অবস্থিত আপনার মনকেই মুহূর্তে এফোঁড়ওফোঁড় করে যাবে। মান্টো এমনই এক নক্ষত্র যে তার সময়ের চেয়েও বেশি এগিয়ে ছিলেন। মানব জীবনের নগ্ন সত্যগুলোকে আপনার চোখে আঙুল।দিয়ে দেখিয়ে দেয় মান্টো। আর তাই হয়তো জীবদ্দশায় তাকে বহুবার যেতে হয়েছে কোর্টের দোরগোড়ায়। তা অবিভক্ত ভারতেই হোক কিংবা স্বাধীন দেশ পাকিস্তানেই হোক। মান্টো নিজেই একটি ক্ষত। তাই হয়তো জীবনের অণুবীক্ষণের নীচে রেখে নিজেকে নিজেই বিশ্লেষণ করেছেন। একপাশে রেখেছেন সাদত হোসেনকে হাসানকে আর অন্য পাশে ছিলেন মান্টো স্বয়ং। যে মান্টো দাবী করতেন তিনি গল্পকে পকেটে নিয়ে ঘুরেন। সাদত হাসান হয়তো কবরে শুয়ে ভাবছে, কে মহান গল্প লেখক : খোদা না সে। কিন্তু মান্টো আজও বেঁচে আছে। মাহমুদাবাদের রাজা প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁর গল্পে এত বেশ্যা কেন? মান্টো তার জবাব দিয়েছিলেন এই ভাবে, 'রেণ্ডিদের কথা বলা যদি অশ্লীল হয়, তবে তাদের অস্তিত্বও অশ্লীল। তাদের কথা বলা যদি নিষিদ্ধ হয়, তবে এই পেশাকেও নিষিদ্ধ করা উচিত। রেণ্ডিদের মুছে দিন, তাদের কথাও আর আসবে না।' এই হলো মান্টো। যাকে একদিকে কেউ কেউ বলেছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল, কেউ কেউ বলেছিলেন পর্নো লেখক আবার একই সময়ে কেউ কেউ বলেছিলেন প্রগতিশীল, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ গল্পকার। আজীবন দেশ ভাগের কষ্ট নিয়ে কুঁড়ে কুঁড়ে মরেছে এই মহান মানুষটি। স্বদেশ ভাগ হওয়ার পর স্বদেশের মানুষদের লুটতরাজ, দাঙ্গা, মারামারি, হানাহানি দেখে বারবার বিলাপ করেছেন মান্টো। আর সেই বিলাপ গল্প হয়ে ঝড়ে পড়েছে তার লেখায়। কলমের কালি দিয়ে তার বিষাদগুলো, দুঃখগুলো নেমে এসে ভরাট করেছে খাতার পাতা। আহা মান্টো সাহেব! আপনি বেঁচে থাকুন আরো বহুযুগ… দুইজন কাছের মানুষদের সাথে বাতিঘর হাঁটতে হাঁটতে এই বছরই আমি মান্টোকে আবিষ্কার করি বাতঘরের এক কর্ণারে। এই বছর দুইজন উর্দু সাহিত্যিকের লেখা পড়েছি প্রথম জন ছিলেন কৃষাণ চন্দর আর দ্বিতীয় জন হলেন মান্টো সাহেব। দুইজনই এবছরে আমার পছন্দের লেখক হয়ে রইলেন। তাদের লেখার ধরণ ভিন্ন, কিন্তু আপনাকে বারবার প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিবে যেসবের মুখোমুখি হতে আপনিও হয়তো ভয় পান…
"In the name of Allah, the Compassionate, the Merciful Here lies Saadat Hasan Manto and with him lie buried all the secrets and mysteries of the art of storytelling. Under tons and tons of earth he lies, still wondering who among the two is the greater storyteller: Allah or He.”
- From the engraving Manto wrote for his own epitaph.
প্রতিটি গল্প অসাধারণ। অশ্লীলতা আসলে কি এইটা মান্টো থেকে ভালো কেউ বুঝতো কিনা জানি না। দেশভাগ যে কি পরিমা�� নাড়া দিয়েছে লেখকে তা গল্প না পড়লে বুঝা যায় না।
কিছু কিছু অস্তিত্বের উন্মোচন হয় খুব সাবলীল ভঙ্গিতে, গল্প বলার কায়দায়। সেসমস্ত অস্তিত্ব কি জন্মে শুধু নিয়মের কারিকুলাম মেনে নাকি কিসসা লেখার বাহানায়। কে ���ই মহান কিসসা লেখক? প্রশ্ন ছুড়ে উপরে তাকিয়ে দেখি—খোদা হাসছেন। আর টন টন মাটির নিচে শুয়ে সে ভাবছে, 'কে মহান গল্প লেখক? খোদা না সে?'
একবার তিনি বলেছিলেন, যখন তার হাতে কলম ধরা নেই, তখন তিনি নেহাতই 'সদত হসন'। কিন্তু কলম হাতে তোলামাত্র তিনি 'মন্টো'। গল্প লেখার চ্যালেঞ্জটা তার অন্য কোন লেখকের সঙ্গে নয়, স্বয়ং খোদার সঙ্গে।
রূঢ়, তেজী, ভণিতাহীন লেখায় প্রকাশ পেয়েছে—দেশভাগ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি লেখক। খুন, দালালী, লুঠতরাজ, বেশ্যাবৃত্তিতে কবলিত ভয়ঙ্কর সব সময়কাল। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়—পৃথিবীতে যতসব নৃশংসতার প্রমাণ রয়েছে—তার বেশিরভাগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো ধর্ম, ধর্মের মতবিরোধের ফলে সংখ্যালঘু শ্রেণীর প্রতি বৈষম্য আর অত্যাচার। মন্টো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি—ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান দু'টো আলাদা সংস্কৃতির আলাদা দেশ।
সেসবের নিমিত্তেই লেখা হয়েছে এসকল কিসসা। বানোয়াট নয় বরং সত্যকে সামনে আনার বৃহৎ কোন প্রয়াস? কিছু গল্পের অনুবাদ ব্যাক্তিগত ভাবে কিছুটা আক্ষরিক লেগেছে। শুরুর দিকে নয় অবশ্য।
দোজখনামা পড়ার পর মনে হলো 'মান্টো' আর 'মীর তকি মীর'কে একটু পড়লে মন্দ হয়না।সত্যি মন্দ হয় নি এই বইয়ের অনেক গুলো গল্প আমাকে আনন্দ দিয়েছে। বিশেষ করে "দশ টাকা" গল্পটা শেষ হয়েও শেষ হলো না। আরো কয়েকটা নাম লিখবো বলে বইটার সূচিপত্র দেখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম এখানে তুলনা করে গল্পের মান নির্ণয় আমার কর্ম নয়।
বড় ভয়ংকর সব গল্প। বড্ড নাড়া দেয়। অনুবাদগুলো আরেকটু ভাল হতে পারত। একটি গল্পে বম্বের 'ফোর্ট এলাকার বাংলা দুর্গ করা হয়েছে। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামকে উইলিয়ামের দুর্গ বললে বা উল্টোডাঙ্গার ইংলিশ opposite land বললে একেবারেই শ্রুতিমধুর লাগে না। আর হ্যাঁ গল্প নিয়ে ওঁর ব্যাখ্যাই যথেষ্ট - যদি মনে হয় গল্পগুলো সহ্য করতে পারছেন না, তবে মনে রাখবেন তখন সময়টাই অমন ছিল।
বইয়ের শুরুতে সাদত হাসান মান্টো সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যে মন্তব্যগুলো করা হয়েছে, তা অত্যন্ত আপত্তিকর। ''মন্টোর চ্যালেঞ্জটা অন্য কোনও লেখকের সঙ্গে নয়, স্বয়ং খোদার(আল্লাহর) সঙ্গে'' এবং "পবিত্র কোরান-এ তিনি(আল্লাহ) তো আমাদের কাছে কলম হাতে নিয়েই অবতীর্ণ হন" - কথাগুলো আল্লাহর শানের সাথে বেয়াদবি এবং জঘন্য পর্যায়ের মিথ্যাচার। প্রথম পৃষ্ঠাতেই এমন নমুনা পেয়ে আমি সরাসরি গল্পের অংশে চলে গিয়েছিলাম। তাই মাঝে আরো উদ্ভট মন্তব্য আছে কিনা জানা নেই।
(প্রতিটা গল্প আলাদা করে) • দশ টাকা: সাধারণত বইয়ের প্রথম গল্পটা থাকে উত্তেজনাময় আকর্ষণীয় ঘটনা। এরপর দূর্বল গঠনের গল্পগুলো ভিতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মান্টোর রচনা সমগ্রের শুরুর গল্পটা আমার কাছে বেশ নিষ্প্রভ লেখেছে। এটা যেন কেবলই এক ঘটনার ব্যাখ্যা। গল্পের অন্তর্নিহিত গভীরতা আমার বোধগম্য হয়নি, কিংবা অতিশয় সরল গল্পই ছিলো।
• আমার নাম রাথা: প্রথম গল্পের তুলনায় এটা সামান্য হৃদয়গ্রাহী। প্রেম সম্পর্কের ঝলক আছে। কিন্তু এর সমাপ্তি অতৃপ্তিদায়ক। মূল চরিত্র ছাড়া পার্শ্ববর্তী চরিত্রগুলোর বিকাশ তেমন অর্থবহ মনে হয়নি।
• বাবু গোপীনাথ: এই গল্পটা আমার কাছে একেবারেই দুর্বল লেগেছে। যৌক্তিক মনে বিবেচনা করলে গল্পের গঠনগত অসংলগ্নতা পাওয়া যায়। আবারও সেই একই ত্রুটি, প্রধান চরিত্র বাদে অন্যান্য চরিত্রগুলোর উপস্থিতি তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনা।
• গন্ধ: পরিণত মনের রুচি সাপেক্ষে বর্ণনা করা। মনে হয় গল্পের অন্তর্নিহিত গভীর ভাব আরও স্পষ্ট করা যেত। তবে পূর্ববর্তী গল্পগুলোর তুলনায় এটা আরেকটু(সামান্য) বেশি সুন্দর।
• কালো শালোয়ারস: বলা যায়, এই গল্প থেকেই রচনা সংগ্রহের প্রতি সন্তোষের অভাব পূর্ণ-হতে শুরু করে। গল্পের অন্তর্নিহিত গভীর ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে। জীবনের উত্থান পতন, আশার আলো এবং অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি এক অসাধারণ চিত্রকল্প তৈরি করেছে।
• ওপর, নিচে আর মাঝখানে: টার্ণিং পয়েন্ট যেন তার খেই আবারও হারিয়েছে। এই গল্প পড়াটা আমার কাছে অযথা সময় নষ্টের মতো।
◑ ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে লিখা 'খালেদ মিয়া' গল্প থেকে পরপর যতোগুলো পড়েছি, প্রথম দিকের সেই নিষ্প্রভতা দ্রুত কমতে শুরু করেছে। নতুন অংশের পর্যালোচনা শীঘ্রই লিখব।
'খালেদ মিয়া' গল্পটি হালকা-মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এক সফল প্রয়াস। গল্পের গাম্ভীর্য খুব জোরালো না হলেও, এর মনস্তাত্ত্বিক দিকটি সামান্য নাড়া দিয়েছে। সাথে ভাবাচ্ছিলো মূল চরিত্রটি কেনো তার খেয়ালি-শত্রুর ফাঁদে জানা সত্ত্বেও বারবার আটকাচ্ছিলো।
'বুনো ঝোপের পিছনে' গল্পটায় অতীতের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে। এমন এক বিষয় যা বর্তমানে অনেকটাই খোলামেলা ভাবে এবং মানুষদের চিত্তে সাধারণ প্রায় করছে-করছে দোষে অবহেলা করা হয়(পশ্চিমা বিশ্বের ন্যায়)। কিন্তু পূর্বে খুব কঠোর ভাবে দেখা হতো শুনেছি।
'পেরিন' গল্পটাও 'খালেদ মিয়া' গল্পের মতো মনস্তাত্ত্বিক দোলাচল নিয়ে আসে, তবে এর প্লট ও গঠন একেবারে ভিন্ন। এখানে চরিত্রটি এক অনুমেয় শত্রুর মোহে বারবার নিজের ভুলগুলোকে যেন পূর্ণতা দেয়।
'আল্লার দোহাই' গল্প, হৃদয়বিদারক এবং অপ্রত্যাশিত কাল্পনিক দৃশ্যের অসাধারণ চিত্রায়ণ। এর বেদনাদায়ক সমাপ্তি গভীর ভাবনায় নিমগ্ন করে রেখেছিল।
'লাল রেইনকোট পরা মহিলা' গল্পটি মাধ্যম মানের। পড়ার মাঝে, মেয়েটি কেনো মেনে নিচ্ছে স্বেচ্ছায়, ভাবতে থাকায় মোট চার ভাগ হিসেবে শেষ দুই ভাগ মোটামুটি চমক দিয়েছে।
'সিয়া হাশিয়ে' কোনো পূর্ণাঙ্গ গল্প নয়। বরং রেগুলার-সাইজের বই থেকে আধা এবং সর্বোচ্চ দের পৃষ্ঠা পরিমাণ কতোগুলো সংক্ষিপ্ত গল্প। এগুলোর প্রতি গভীর মনস্তত্ত্বের অভাব হলেও, গল্পে হালকা অনুভূতি বিদ্যমান। এগুলো খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি।
'কবি কাঁদছে' গল্পে কিছু বিষয় সরাসরি সমাধান না দেখিয়ে, খোঁচা মারার দোহাইয়ে নিজের জ্ঞান-ভার ভারিক্কি করার ভঙ্গি করে কেটে পরার মতো প্রবৃত্তি রয়েছে। যদিও কিছু কথা সত্য, তবে গল্পে উভয় ক্ষেত্রেরই সম্পূর্ণ যৌক্তিক তথ্যের উপস্থাপন আরও বেশি কার্যকর হতে পারত।
'য়াজিদ' গল্পটিও অতীতের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার মতো। সৎ-সত্য মিলে বেশ জ্ঞানমূলক একটা গল্প। ব্যক্তিগত ভাবে অসাধারণ লেগেছে।
শরিফন: মাত্র দুই পৃষ্ঠায় এক মর্মস্পর্শী গল্প 'শরিফন'। একজন বাবার হৃদয়ে মেয়ে-মৃত্যুর প্রতিশোধের দাবানল কীভাবে ফুলকির মতো জ্বলে ওঠে, তা এখানে সংক্ষিপ্ত অথচ তীব্রভাবে বর্ণিত। লেখার কাজে নিপুণতা, হিংস্রতার গভীরে লুকিয়ে থাকা কোমল-হৃদয়বিদারক অনুভূতির প্রকাশ পাঠককে ছুঁয়ে যায়। গল্পের শেষে ভাগ্য কিংবা চাতুরীর সত্য শুধু পাঠকের কাছেই গোপন থাকবে।
১৯১৯ এর একটি দিন: দুই নারীর ওপর অমানবিক নির্যাতনের চিত্রকল্প, এবং এক সাহসী বীরের প্রতি নিবেদিত গল্পটি দক্ষ-বর্ণনাশৈলীর নিদর্শন। লেখক এখানে অল্প কথায় অনেক গভীরে প্রবেশ করেছেন, প্রতিটি বাক্য যেন সহস্র অনুচ্চারিত কথার ভার বহন করে।
ঠান্ডা গোশত: যে গল্পটা পড়ার জন্য আগ থেকেই উত্তেজিত-মন অধির আগ্রহ পোষাচ্ছিল, পূর্বে আসা সব গল্প পড়ে পিছ ফেলে এগোচ্ছিলো, সুযোগ সময়ে একই মর্মে গল্পের অতি-সাধারণ প্লট ছেকা দিয়ে গেলো। (স্মৃতিচারণ: পেন্ডুলাম প্রকাশনীর 'ঠান্ডা গোশত' বইটা সংগ্রহ করতে তুমুল তল্লাশি চালিয়েছিলাম। কোনোভাবেই না পেয়ে '���ান্টোর সেরা পঁচিশ' পশ্চিমবঙ্গের বইটা সংগ্রহের প্রতি আগ্রহী হই। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে প্রথমবার বইটা হাতছাড়া হয়ে যায়। দ্বিতীয় সুযোগে না হারাতে, সাধারণত বিদেশি বই অনলাইন-অর্ডার করি না তবুও অনলাইনে অর্ডার করি। এরই মধ্যে অনিক শাহরিয়ার অনুবাদ করা 'ঠান্ডা গোশত' বইটার খোঁজ পেয়ে খেয়াল করি, ভিন্ন বই হলেও 'মান্টোর সেরা পঁচিশ' বইয়ের সাথে অনেক গল্প এক। বুঝে যাই অন্যান্য বিভিন্ন বইয়ের ক্ষেত্রেও একে-অপরের সাথে গল্পের মিল রয়েছে অধিকাংশ। তাই সিদ্ধান্ত নেই 'মান্টোর সেরা পঁচিশ' পড়ে বিবেচনা করে বাকি থাকা গল্পগুলো পড়তে সুবিধা মতো অন্য বই নিবো। কিন্তু মান্টোর সেরা পঁচিশ এবারও অধরা স্টক আউট হওয়ায়। অবশেষে উপায় না পেয়ে 'সদত হসন মন্টো রচনা সমগ্র' সংগ্রহ করি, কেননা এটা শেষবারেতেই নজরে এসেছিল। পূর্বের প্রতিটার অনুবাদ-কেমন যাচাই করা ছিলো, রচনা সমগ্রহের অনুবাদ নিয়ে কোনো প্রকার আশঙ্কায় না করে সোজা কিনে ফেলি।)
একশো মোমবাতির আলোয় উজ্জ্বল একটা বাল্ব: সরল ব্যাখ্যার ফলে শুধু পড়ে আরাম পেয়েছি। তবে গল্পের বুনন পূর্বের আখ্যানগুলোর মতোই পরিচিত, যা নতুন অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারেনি।
শাহদৌলার ইঁদুর: মাতৃত্বের বাসনায় বেহাল দশার পরিস্থিতি সহ, সন্তান হারানোর পীড়াদায়ক অনুভূতি ফুটিয়ে তোলার সামান্য প্রয়াস এই গল্পে। খুব বেশি আশানুরূপ নয়।
◑ দৈনন্দিন পাঠকদের জন্য প্রায় প্রতিটা গল্পই চেনা অনুভূতির প্রতিধ্বনি। বহু বই পড়ার সুবাদে গল্পে-নিহিত যেসব সংবেদনশীলতা, তা পাঠকদের পূর্ব পরিচিত হবে বলে ধারণা। কেবল মান্টোর সময়কার সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে পরিস্থিতি বোঝার জন্য বইটা পড়া যায়।
বইটাতে আরো পাঁচটি গল্প, একটি নাটক, চারটা প্রবন্ধ রয়েছে।
অনুবাদ মান সম্মত। খাপ ছাড়া লেগেছে নামের উচ্চারণ। সাদাত যখন হয়ে যায় সদত তখন শুনতে একটুও ভালো লাগে না। এছাড়া তেমন কোন কিছু বলার নেই।
মান্টো কে নিয়ে আর কি বলা যায়? মান্টোর তুলনা মান্টো নিজেই। সে সৃষ্টিকর্তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে তার লাগলামির ধরন বুঝে নিন। মান্টোর গল্প নাকি অশালীন। আশ্চর্যের বিষয় মান্টো যে সময় লিখত সেই সময়ে এরকম হবার কথা ছিল না। ২০১৮ সালে বসে তো মনে হচ্ছেই না। তখন তো সমাজ ব্যবস্থা এখকার মত ছিল না তাই কিছু বলাও যাচ্ছে না। দেশ ভাগ নিয়ে মান্টো ছাড়া আর খুশবন্ত সিং মনে হয় বেশী গল্প লিখেছে। আর কেউ অতটা লিখেছে বলে মনে হয় না। অফসোস রয়ে গেল বইয়ে নির্বাচিত কয়েকটা গল্প দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ মান্টো অনুবাদ করলে ভালো হত :/
অপরিমেয় শক্তিধর গল্পের কারিগর মান্টো যে কিনা নিজ মাতৃভাষা উর্দু ও সাহিত্যে শিক্ষাজীবনে পাস না করতে পেরেও শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকার হয়েছেন! গল্পগুলোর গভীরতা বাধ্য করে সমাজ নিয়ে ভাবতে। উপমহাদেশের ক্রান্তিকালীন সময়ের সমাজ, মানুষ আর সামাজিক ডগমার এতো নিখুঁত বলিষ্ঠ চিত্রায়ন আগে পাইনি। মান্টো ঠাট্টা করে বলতেন "সাদাত হাসান" আর "মান্টো" দুই সুহৃদ। কলম ছাড়া হলে শুধু সাদাত হাসান আর কলম নিলেই মান্টো। ভয় পেতেন এদের বিচ্ছেদকে। সময় তাঁর ভয়কেই বাস্তবায়ন করেছে। সাদাত হাসান এর আয়ুষ্কাল ৪৩ বছর হলেও মান্টো শতবর্ষ ব্যাপী আজও জীবিত। মান্টো অমর।
বহুদিন পড়বো পড়বো ভেবে শেষমেশ পড়ে ফেললাম বইটা। মান্টোর (মন্টো না, অবশ্যই) লেখা আত্মবিশ্বাসী এবং রাগী। পাঠক খুশি করার কোনো কৃত্রিম চেষ্টা নেই। দরিদ্র চরিত্রদের জন্য আলগা সহানুভূতি তৈরি করার চেষ্টা নেই। তাদের আর্থিক অনটন যেভাবে গল্পে এসেছে, তেমন তাদের জীবনভরা যে শুধু দুঃখ নয়, তাদেরও স্বপ্ন, আনন্দ, বিরহ আর কৌতূহল আছে-এই বিষয়গুলোও গল্পে এসেছে।
এর বাইরে-
যে গল্পগুলো সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে
দশ টাকা। বইয়ের প্রথম গল্প, এবং বাকি বইয়ের টোন প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেশ মানানসই গল্প। মূল চরিত্র একজন বালিকা বেশ্যা। বেশ্যাদের ব্যাপারে সাধারণ যে সামাজিক ধারণাগুলো, বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে-সেগুলো শুরুতেই ভেঙে দেয় গল্পটা। যে মূল চরিত্র, তার শিশুসুলভ মস্তিষ্কে বেশ্যা বলতে কী বোঝায়, অন্যরা এই পেশাকে কীভাবে দেখে এসব নিয়ে তেমন তথ্য নেই। তাই এই পেশাকে সে ভয়ংকর কোনো শাপ হিসেবে দেখে না, যেমনটা সাহিত্য বা পপ কালচারের বেশিরভাগ বেশ্যা চরিত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তার দালাল কোনো রুক্ষ, গোঁফধারী মাঝবয়সী পুরুষ নয়, বরং তার নিজের মা। দশ টাকা গল্পটার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টেনশন তৈরি হয়, পাঠক বা পাঠিকার মধ্যে একধরনের অস্বস্তি কাজ করে। মনে হয় সামনে খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, মেয়েটা বিপদে আছে। তারপর যেভাবে গল্পটা শেষ হয়, তা সত্যি অসাধারণ।
খালেদ মিয়া। অ্যাংজাইটির চমৎকার একটা পোর্ট্রেট। বিশেষ করে সন্তানকে নিয়ে একজন বাবার যেমন অ্যাংজাইটি থাকে। আমার সন্তান নেই, তাও অনুভূতিটা যে লেখায় পরিষ্কার ধরা দিয়েছে তা বুঝতে পেরেছি। অ্যাংজাইটির একটা দিকে লেখক বেশি জোর দিয়েছেন-সেটা হচ্ছে নিজেকে সবকিছুর জন্য দোষ দেওয়া। ‘আমি যদি কাজটা এভাবে না করে ওভাবে করতাম, তাহলে কি পরিণতি অন্যরকম হতো? বোধহয় কথাটা বলিনি দেখে এমন হয়েছে। বা আরও আগে বলা উচিৎ ছিল।’- এভাবে একের পর একে চিন্তার চাবুক আছড়ে পড়ে প্রধান চরিত্রের মনে। এক পর্যায়ে যেয়ে পানি খাওয়ার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত জীবন-মরণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আরেকভাবে গল্পটাকে দেখতে চাইলে-নিয়তি হচ্ছে নিয়তি। মাঝে মাঝে আমরা আন্দাজ করতে পারি কী ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু তারপরেও নিয়তিকে ঠেকানোর ক্ষমতা আমাদের নেই।
গন্ধ। যৌনতা আর শ্রেণিবিভেদের ধারণা মিলিয়ে ধাক্কা দেওয়ার মতো একটা গল্প। মানুষের প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার কামনা আর দৈহিক কামনার মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটাও খানিকটা এই গল্পে এসেছে।
কবির কাঁদছেন। সামাজিক দুর্নীতি আর হিপোক্রেসি নিয়ে যে গল্পটা দুই বাংলার প্রত্যেক সমসাময়িক লেখক লিখতে যেয়ে হোঁচট খান, এটা হচ্ছে সেই গল্পের আদর্শ রূপ। মিনিমালিস্টিক এই গল্পে সমাজের চেতনা হিসেবে এসেছেন কবির। তার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, শ্রেণিভিত্তিক এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য। কবির একজন আউটসাইডার হিসেবে সবকিছু দেখেন, তার চোখ থেকে ঝরে অথর্ব মহাপুরুষের অশ্রু।
রাম খিলবান। দাঙ্গা নিয়ে অনেকগুলো গল্প আছে এই বইয়ে। দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের যে জটিলতা থাকে, তা যে দাঙ্গার মতো সাদাকালো ক্রাইসিসেও সহজে আলাদা করা যায় না-এই বিষয়টা গল্পে স্পষ্ট হয়ে এসেছে বলে মনে করি।
যা ভালো লাগেনি
অভিনব বেশ্যা চরিত্র এবং তাদের প্রেমে আসক্ত খদ্দেরদের নিয়ে এতো গল্প আছে যে একসময় গল্পগুলো মিলেমিশে এক হয়ে যায়। হয়তো গ্যাপ দিয়ে দিয়ে গল্পগুলো পড়লে অন্যরকম লাগতো।
অনুবাদের মান খুবই মিশ্র প্রকৃতির। কিছু গল্পের অনুবাদ প্রচণ্ড আক্ষরিক, আবার শুরুর দিকের বেশ কিছু গল্পের অনুবাদ বেশ সাবলীল। যে অনুবাদকেরা মূল লেখার প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধাশীল, তারা ভালো অনুবাদ করেন না। প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে ভয় পান। এখানেও কিছু ক্ষেত্রে তেমন হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
সব মিলিয়ে বেশ ভালো লেগেছে। মান্টো আমার সবথেকে প্রিয় সাহিত্যিকদের তালিকায় আসেননি, তবে তার লেখার জোর অস্বীকার করার উপায় নেই।
“Here lies Saadat Hasan Manto. With him lie buried all the arts and mysteries of short story writing. Under tons of earth he lies, wondering if he is a greater short story writer than God,” reads one of the world’s most accomplished short story writer’s self-chosen epitaph.
A cognoscente of the human condition, Saadat Hasan Manto’s understanding of society, morality and ethics translated into a narrative of psychoanalytical portraits that often described the divided selves borne out of the 1947 India-Pakistan Partition.
মান্টো তাঁর কবরে উৎকীর্ণ করার জন্য একটি সমাধিলিপি লিখেছিলেন, "এখানে শুয়ে আছে সাদাত হাসান মান্টো। তার সঙ্গে কবরস্থ হয়েছে গল্প লেখার সব শিল্প ও রহস্য... টন টন মাটির নীচে শুয়ে এ ভাবছে, কে মহান গল্প লেখক : খোদা না সে।" তাঁর কবরে অবশ্য এই কথাগুলি খোদাই করা নেই। কেননা পাকিস্তানের কট্টরপন্থীদের ভয়ে মন্টোর পরিবার লেখাটি কবরের এপিটপে উৎকীর্ণ করাননি।
নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি অভিনীত লেখকের বায়োপিকটা দেখার পর থেকেই লেখক সম্পর্কে আগ্রহ ছিল। পাক-ভারত বিভাজন সময়কালীন চরম বাস্তবতা ফুটে উঠেছে লেখকের লেখনীতে। গল্পগুলো নাড়া দেয়। তবে অনুবাদটা আরেকটু ভাল করতে পারত।
পুরো বইটাই আমাকে বিস্মিত করেছে প্রতিটা লাইনে লাইনে। দশ টাকা,গন্ধ,পেরিন,ঠাণ্ডা গোস্তসহ প্রত্যেকটা গল্পই আমাকে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। পড়া শেষে মনে হয়েছে,এটা কি পড়লাম! এভাবেও ভাবা যায়! অদ্ভুত আর অতুলনীয় মন্টো সাবের গল্পের ধরন এবং ভঙ্গিমা!
সাদত হাসান মান্টোর লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে "গাঞ্জে ফেরেশতে" পড়ার সময়। বইটার এমন আপাত অদ্ভূত নাম দেখে কৌতূহলবশত পড়তে শুরু করেছিলাম। লেখার চেয়ে মান্টোর রঙিন জীবনী আমাকে বেশ চমৎকৃত করে, যার কারণে মান্টোর আরো লেখা খুঁজতে খুঁজতে এই লেখার সন্ধান পাওয়া!
সাদত হাসান মান্টো। কারো কাছে শাসকের চোখ রাঙানি আর নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে কলম হাতে লড়াই করে যাওয়া এক অকুতোভয় সেনানী, যাকে উল্লেখ করা হয় উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক ও কবিদের সাথে, আবার কারো কাছে মদ্যপ, অশ্লীল লেখা লেখার অভিযোগে জর্জরিত, জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া এক ভঙুর মানুষ!
সাদত হাসান মান্টো লিখেছেন। সারাটা জীবনই লিখে গিয়েছেন। প্রথম জীবনে চিত্রনাট্য, সংলাপ থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ছোটগল্প, নাটক সবই লিখেছেন। মান্টোর লেখার ধরণ অন্য কারো চেয়ে আলাদা। তিনি সবসময় লিখেছেন সমাজের সেই শ্রেণীর মানুষের কথা, যাদের সমাজের তথকথিত সভ্য মানুষরা বাঁকা চোখে দেখে, আবার কখনো বা মানুষের কাতারেই গণ্য করেনা! Martin Scorsese যেমন Casino তে বলিয়েছিলেন: "Every other sleazebag, pimp and whores", মান্টোর লেখার মূল রসদ বলতে গেলে ওগুলোই।
এই বইতে মোট পঁচিশটি গল্প, চারটি গদ্য ও একটি নাটক রয়েছে, যার সবগুলোই চিরায়িত মান্টো স্টাইলেই লেখা। লেখার বিষয়বস্তুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দেশভাগ, দেহপসারিণী ও তাদের দালাল, সমাজের নীচু শ্রেণীতে বাস করা অটো, বাস, ট্রাকের ড্রাইভার, ধোপা ইত্যাদি। এরমধ্যে বেশ বড় একটা অংশ দেশভাগ নিয়ে, কারণ এই জিনিসটাই মান্টোকে সবচে বেশি পীড়া দিতো। এছাড়া এই সংকলনে " ঠান্ডা গোস্ত" "দশ রুপিয়া" সহ বেশকিছু বিখ্যাত গল্প রয়েছে (ঠান্ডা গোস্ত গল্পের জন্য পাকিস্তান সরকার শুধু মান্টোকে জরিমানা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সাথে জেলে যাওয়ারও বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল!)
আমার সবচে অসুবিধা হচ্ছিল অনুবাদ নিয়ে। কারণ মান্টোর যেসব বই আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম, সেগুলো সব ইংরেজি অনুবাদ, এবং বলতে গেলে একপ্রকার বিস্বাদ! এই অনুবাদটি বেশ সাবলীল, সহজবোধ্য এবং বেশ উপভোগ্য লেগেছে আমার কাছে, অন্যান্য গুলোর তুলনায়!