Bibhutibhushan Bandyopadhyay (Bangla: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়) was an Indian Bangali author and one of the leading writers of modern Bangla literature. His best known work is the autobiographical novel, Pather Panchali: Song of the Road which was later adapted (along with Aparajito, the sequel) into the Apu Trilogy films, directed by Satyajit Ray.
The 1951 Rabindra Puraskar, the most prestigious literary award in the West Bengal state of India, was posthumously awarded to Bibhutibhushan for his novel ইছামতী.
This is a somewhat slow, silent story of a young boy growing up in a poor village in Bengal. It follows Apu and Durga, (two children who are poor even by the standards of their village mates), as they search for wild berries and leaves, steal mangoes from their neighbors, get beaten, play cowries, get lost, and discover trains. Their lives are simple and their stories simply told. You get a sense both of the rarified, natural beauty that village life holds, and of the ways in which it grinds people down, keeps them narrow, and strips them of their dreams.
The other interesting thing about the story is how tangential British presence is in the story. We hear about a now defunct factory near the village, we see the train tracks, and we see a somewhat ridiculous Westernized family putting on airs. But ultimately, the world they live in is so small that Shorbojoya, the mother of Apu and Durga, has never been to a temple 6 miles away in the 10 years she lived in the village. It is a kind of pre-Colonial life that could have been described almost identically if it had been set in the 1600's.
Durga, who is constantly derided, often beaten, never quite loved -- is especially heartbreaking. Because she is a girl, she never gets as much food, is berated for not doing housework, is never taught to read, and lives a jungly, solitary existence. In other ways, the story plainly captures the ways in which women were powerless, less valued, and utterly mistreated.
This story was adapted into a famous Satyajit Ray movie. In some ways I like the movie better, because film seems a better medium to capture the twittering, dripping sounds of the forest, or the quiet, long shots of fields of waving grass.
Still, I would recommend reading the book because it captures the way a child sees the world in a particularly charming and unpretentious manner.
এই বই খানা বোধহয় এর জন্মলগ্ন হইতেই বাঙালীর মনে মায়া সঞ্চার করিয়া আসিতেছে। অপু আর দূর্গাকে ভালো না বাসিয়া থাকা যায় না।
কিন্তু দিনকাল বদলাইয়া যাইতেছে; কিশোর-কিশোরীরাও বদলাইয়া যাইতেছে। যাহারা শহরে থাকে তাহারা ভালো মতোন গ্রাম দেখিতে পায় না, পরিবার আপনজনার মমতা উপলব্ধি করিতে পায় না। পুনশ্চ যাহাদের গ্রামে দুরন্তপনা করিবার কথা ছিল, তাহাদের ঘরে ঘরে রঙিন দূরদর্শনযন্ত্র শোভা পায়! তাহাতে দেখা যায়- কাহারো স্বামী বা কাহারো স্ত্রী লইয়া ভিন্ন লোকে টানাটানি করিতেছে। এই দৃশ্য দেখিতে যাইয়া এ যুগের নিরীহ কিশোর কিশোরীরা অপু-দূর্গা আর ঘন সবুজের পরশ পায় না। বড় কষ্ট লাগে !
সে যাইহোক পাঠ্য বইয়ে "আম আঁটির ভেঁপু" তো আছে! ঐখানাকে কেউ যেন সরাইয়া না দেয়। থাকুক ঐখানা। কেউ না কেউ হরিহর রায়ের পুত্র কন্যার প্রতি মায়া-মমতা বোধ করিয়া পাঁচালী শুনিতে আসিবেই।
পথের পাঁচালী আমার কাছে শীতের সকালে বন্ধ জানালার কাচে প্রভাতী আলোর আভাসের মতন। সেই কত্ত আগে পড়েছিলাম, তবুও দূর্গা/অপু/সর্বজয়া/হরিহরের কথা ভাবলে মন যেন কেমন করে। স্মৃতির অংশ মনে হয়৷ সেই স্মৃতিও যেন একই সাথে আনন্দ বেদনার কাব্য। আমরা যারা শহরে বড় হয়েছি, তাদের কাছে অপু/দূর্গার শৈশব অনেকটাই অচেনা। মনে হয় যেন সময় শকটে চেপে ফিরে গেছি সেই সতেজ/সবুজ আদিগন্ধা ক্ষণে। আমার শহুরে, যান্ত্রিক জীবন থেকে নরমসরম ব্যাপারগুলো ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। এই লেখাগুলোয় তাই মাঝে মাঝে সেসব অনুভব করতে ফিরে আসি৷
আমার পক্ষে এই বইটি নিয়ে কিছু লেখা মানে যে কী সাংঘাতিক দুঃসাহস দেখানো, তা জানি বলেই এই নিয়ে বিশেষ কিছু লিখে নিজেকে 'খোরাক' বানাবো না| শুধু এই টুকু লিখবো: যদি আপনি বাংলা পড়তে পারেন, তবে দয়া করে এই বইটি পড়ুন| নইলে আপনার নিজের পথ-চলা আর তার বৃত্তান্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে| ভুলে যান সত্যজিত রায়ের সিনেমাটির কথা| ভুলে যান আঁতেলদের বিশ্লেষণ আর গবেষকদের তরফে অন্ধের হস্তীদর্শন-তুল্য টীকাটিপ্পনি| বইটি পড়ুন, আর ভাবার চেষ্টা করুন: ইছামতীর তীরে এক অজ পাড়াগাঁয়ে একজন চাপা-স্বভাবের মাস্টারমশাই তাঁর কলম দিয়ে আমাদের ভূমার সংস্পর্শে আনছেন এমন এক পথ ধরে যা কোনোদিন ফুরোবে না| পড়ে ফেলুন প্লিজ|
অপু ভয়ে ভয়ে ডাকিল--দিদি! দুর্গা কোনো জবাব দিবার পূর্বেই অপু বালিশে মুখ গুঁজিয়া হাউহাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল--আমি আর করবো না--আমার ওপর রাগ করিস নে দিদি--তোর পায়ে পড়ি।কান্নার আবেগে তাহার গলা আটকাইয়া যাইতে লাগিল।
দুর্গা প্রথমটা বিস্মিত হইল--পরে সে উঠিয়া বসিয়া ভায়ের কান্না থামাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কাঁদিস নে,চুপ চুপ, মা শুনতে পেলে আবার আমায় মারবে, চুপ, কাঁদতে নেই--আচ্ছা আমি রাগ করবো না,কেঁদো না ছিঃ--চুপ---
আম আঁটির ভেঁপু অধ্যায়ের শুরু থেকে ই বুক মোচড়ানো শুরু হয়। অপূর্ব গ্রামীণ পরিবেশের বর্ণনা,তার মধ্যে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে দুই ভাই বোন। শত অভাব,অনটন যাদের আনন্দের বাঁধা হতে পারে না। প্রকৃতি যেন তাদের আনন্দের সব দ্বায়িত্ব নিয়ে দুহাতে বিলিয়ে দিচ্ছেন যা কিছু তার ঝুলিতে আছে। অপুর প্রথম পাঠশালায়/টোলে যাওয়া। বই পড়ার হাতে খড়ি । পাখি দেখতে যাওয়া। দিদির সাথে মিলে এটা সেটা করা। সব যেন লেখক ছবি এঁকে দেখাচ্ছেন, এত সুন্দর। আহ্।
সোনার ভাঁটার মতো ভাইটা,মুখের আবদার না রাখিতে পারিলে দুর্গার ভারি মন কেমন করে এই বই পড়তে গিয়ে, যে জিনিস টা আমাকে খুব পীড়া দিয়েছে,সেটা হচ্ছে "আমার শৈশব-কৈশোর টা ছিল ভীষণ নিঃসঙ্গ আর একাকীত্বের। " পথের পাঁচালি তে যে জিনিস টা সবচে' বেশি উল্লেখ করার মতো,সেটা হচ্ছে ভাই-বোনের অপূর্ব ভালোবাসার সৌন্দর্য। এই ঝগড়াঝাটি তো খানিক পরে আবার এক। যেন রক্ত মাংসের সৃষ্টি। একেকটা ঘটনা পড়ার পর ভেতরটা কি ভীষণ নাড়া দেয় বোঝানো যাবে না। বিভূতি বাবু এই অপু-দুর্গার সাথে আমাকে ও যেন নিশ্চিন্দিপুরের পথ প্রান্তরে বিচরণ করাচ্ছেন,এ যে কি সুন্দর অনুভূতি...
সব কিছুর একটা শেষ আছে। আনন্দ ও একসময় ক্ষয়ে আসে। অপু দুর্গার এই স্বপ্নের জগতে ভাঙন আসে,যা অকল্পনীয়। মানে ব্যাপারটা এমন, আমি চাচ্ছিলাম না কোন খারাপ কিছু শুনতে,কোন ভাবেই না। কিন্তু জানতাম ব্যাপারটা ঘটবে। এই ভেবে যখন একের পর একা পাতা শেষ হচ্ছে, বুকের ভেতর কেমন জানি হিম হয়ে যাচ্ছিল,বিশেষ করে দুর্গার অসুখের দিনগুলোতে। নিয়তি ফলবেই। ঘোর এক কুজ্ঝটিকায়, দুর্গা চলে গেল। যাওয়ার আগে অপুর কাছে তার আবদার আমায় একদিন তুই রেলগাড়ি দেখাবি? এই জায়গায় ও আমি নিজেকে সামলে থেকেছি। কিন্তু নীলমণি মুখুজ্জে দুর্গা কে দেখার পরে, যখন বলা হচ্ছে, "দুর্গা আর চাহিল না"। আর সামলাতে পারিনি নিজেকে। এত অভাব,অনটনের ভেতর ও যে প্রকৃতি দুর্গা কে আঁকড়ে রেখেছিল,সে প্রকৃতিই তাকে কেড়ে নিলো। এ কেমন নিষ্ঠুরতম প্রতিশোধ!
এরপর দিন বয়ে গিয়েছে,তার নিজের মত। দুঃখ,কষ্ট সঙ্গী করে অপু বেড়ে উঠছিলো,এগিয়ে যাচ্ছিল তার পথে। এ�� মেঘ,এই দুর্দিন,অনন্ত ভবিষ্যতের পথে এরাই রহিল চিরসাথী--দিগন্তের মায়া--লীলার মতো চৈত্র--বৈশাখের যে দিনগুলো অতীতে মিলাইয়া গিয়াছে--আর কি তা���া ফিরিয়া আসে? সে দিন সত্যই আর ফিরে আসেনি। শুধু দুঃখ আর কষ্ট দীর্ঘায়িত হয়েছে। বীরু রায়ের পাপের কারণেই হোক আর প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কারণেই হোক সুখ আর স্থায়ী ভাবে ধরা দেয়নি অপুর কাছে, যেন তার সব আনন্দ দুর্গার সাথে অনন্তে মিলিয়ে গিয়েছে....
অনেক দিন থেকে ভাবছিলাম,পথের পাঁচালি আবার পড়ব। এবার পড়া হলো। শুধু মাত্র দুর্গার জন্য এই বই আমার সব সময়ের প্রিয় হয়ে থাকবে। আমার যদি বোন থাকত,সে এমনি হতো। বোনেরা এমনি হয়। বিভূতি বাবুকে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় প্রকৃতির বরপুত্র। এমন সুন্দর বর্ণনা। আমার ছোট বেলা টা ও কেটেছে সবুজের সায়রে,কাঁদা মাটির গন্ধ মেখে, প্রকৃতির বুকে আঁচড় কেটে । এজন্যই বোধহয় নিশ্চিন্দিপুরের প্রকৃতির কথা আমাকে যেন বেশিই ছুঁয়েছে। পথের পাঁচালি শেষ করে স্থির করলাম ২৮ বছরে বিভূতি বাবু যা কিছু লিখে গেছেন,তার যতটুকু আমার নাগালে পাব,এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলব,দ্বিতীয় বার কোন চিন্তা আমি করব না।
কিছু বই আছে একশ বার পড়লেও পুরোনো হয়না-এটি সেই বই। বিভূতিভূষণের এই বইটি বয়স প্রায় ১০০ বছরের কাছাকাছি নিঃসন্দেহে পথের পাঁচালি শতাব্দীর অন্যতম সেরা বাংলা উপন্যাস বলা যায়। অদ্ভুত এক মায়াময় আদ্র-করুণ লেখনীর মোহয় বইটিতে ফুটে উঠেছে শৈশবের বাধাহীন আনন্দ-ঝলমলে নিষ্পাপ স্বপ্ন রাজ্যের । যে শৈশব প্রকৃতির মমতাময়ী হাতে গড়া । অপু দুর্গার হাত ধরে যেন কত সহজেই সেই বাশঝোপ, মাঠ, নদীর ঘাট ঘুরে আসা যায়। সেই জ্যোৎস্না, ঝড়, আম কুড়ানো সবই এক আশ্চর্য মায়াময় শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায় । কিন্তু এই মায়াময় জগত জীবনের নির্মম হাত থেকে রেহাই পায় না । স্বপ্নজগতের এক কিশোর কঠোর বাস্তবতায় কতি না অসহায়! বইয়ের শেষ টুকুতে এসে ফেলে আসা দিনগুলোর জন্য, হারিয়ে যাওয়া সেই স্বপ্নগুলোর জন্য দারুণ এক হাহাকার জন্মায় । মনে হয়, আহারে আবার যদি ফিরে যেতে পারতাম সেই ছেলেবেলায়!
উপন্যাসে লেখক যেমনি প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করেছেন, তেমনি সুনিপুণ হাতে এঁকেছেন গ্রামীণ জীবনে অপু-দূর্গার অবাধ বিচরণের দৃশ্য। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তাদের পরিবারকে দিন পার করতে হয়েছে; তবু গ্রামীণ শৈশবের প্রায় সবটুকু আনন্দই তারা উপভোগ করেছে তাদের মতো ক'রে।
উপন্যাস পড়তে যেয়ে একেকবার একেকজনকে মূল চরিত্র মনে হয়েছে। পথের পাঁচালী উপন্যাসের মূল চরিত্র অপু। তবে অপুর অপু হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা দূর্গার। সে তাকে প্রকৃতির নানা বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমটা, কুলটা, নোনাটা পেরে-কুঁড়িয়ে খাওয়ায়। অপুর প্রতি তার মায়া হয়। একবার কোথা থেকে যেনো আম নিয়ে আসে দূর্গা। তার ভাইকে বলে ঘর থেকে তেল-নুন নিয়ে আসতে। আম জারাবে। খুব সুন্দর ছিলো সে ঘটনা।
তাদের দারিদ্র্যের কারণে ঘরে ভালো কিছু রান্না হয় না। অতিরিক্ত দু'পয়সা দিয়ে যে ছেলেমেয়ের শখ পূরণ করবে, তা আর হয়ে ওঠে না। তাই তাদের সাধ-আহ্লাদ মেটাতে প্রকৃতি যেনো তার হাত বাড়িয়ে দেয়৷ গাছ থেকে তারা বিভিন্ন ফল সংগ্রহ ক'রে খায়। তারা প্রকৃতির করুণায় আম খায়, মিষ্টি যেনো গুড়।
মাঝে মাঝে তারা গ্রামের কোন প্রান্ত থেকে কোন প্রান্তে যে ছুটে চলে, একেবারে খেই হারিয়ে ফেলে। ভ্রমণের তীব্র বাসনা থেকেই তারা বেরোয়। সেখান থেকে বাড়ি চিনতে খুব কাঠখড় পোড়াতে হয়। কখনো কখনো বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে যায়৷
একবার তো সেই কোন বেলায় বের হয়েছিলো দু'জনে। বাইরে হচ্ছিলো তুমূল বৃষ্টি। তাদের মা চিন্তা করতে করতে অস্থির। সাধারণ কোনো দিন হ'লে চিন্তাটা তেমন হতো না। একে বলে ওকে জিজ্ঞাসা করে, দেখেছিস ওদের দু'জনকে? কেউ সন্ধান দিতে পারে না। বাইরের পানির দিকে তাকিয়ে তার ভয় আরো বাড়তে থাকে। শেষে সারাদিন ভিজে দূর্গা আর অপু ঘরে ফেরে। এতে তাদের কোনো দোষ ছিলো না। বৃষ্টির প্রকোপে ঘরে ফিরতে তাদের দেরি হয়েছিলো।
ভিজে চপচপে শরীর মুছে নিয়ে তারা ঘরে প্রবেশ করে এবং সেদিনের মতো তাদের পাড়া-বেড়ানোর অবসান ঘটে।
জীবন বড়ো মধুময় শুধু এইজন্য যে, এই মাধুর্যের অনেকটাই স্বপ্ন ও কল্পনা দিয়া গড়া। হোক না স্বপ্ন মিথ্যা, কল্পনা বাস্তবতার লেশশূন্য ; নাই বা থাকিল সব সময় তাহাদের পিছনে সার্থকতা ; তাহারাই যে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তাহারা আসুক, জীবনে অক্ষয় হোক তাহাদের আসন ; তুচ্ছ সার্থকতা, তুচ্ছ লাভ।
আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতে বসি, কেন বিভূতিভূষণ পথের পাঁচালী লিখতে বসেছিলেন? কি উকিঁ দিয়েছিল তার মনে? তিনি কি দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছিলেন, এই সবুজ শ্যামলিমা, এই সরলতা, এই গ্রামবাংলার চিরন্তন মাসি, পিসি, মা বাবা, দিদি-ভাই, কাদা ঘাঁটা, আম কুড়ানো, মাটির ঘর সবই একদিন,স্মৃতি হয়ে যাবে? তাই কি তিনি অপুকে জন্ম দিলেন, আমাদের করে, যে বাশেঁর বাখারিতে শুয়ে কাদেঁ, হামাগুড়ি দেয়। সময়ে উঠে দাঁড়ায়, দিদির সাথে বৈচিঁ ঝোপের ছায়ায় খেলে, ট্র্বেন দেখায় অদ্ভুত কৌতূহলী যাত্রায় বাবার সাথী হয়। আরো এমন হাজারো ছোটবড় ঘটনা, চরিত্র( সর্বজয়া, ইন্দিরা ঠাকুরুণ আরো অনেকে) মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠি আমরা। পিসির কাছে হ্যারিকেনের আধো আলোতে রূপকথা শুনে, ঝড়ের দিনে আম কুড়িয়ে, রোদ দুপুরে পুকুরে ব্যাঙলাফ খেলে। আমরা, যারা নব্বই এর মত অসাধারণ দশকে জন্ম নেওয়া শেষ ভাগ্যবান প্রজন্ম, যাদের গায়ের কাদামাটি শহুরে ধূলোয় এখনো ঢেকে যায়নি।
দূর্গার মত বড় বোনের আদর, খুনসুটি, আবার শেষ আর্তনাদ, "সেরে উঠলে আমাকে একদিন রেলগাড়ি দেখাবি, অপু?" এইযে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণার সাথে কতটা মায়া,,কতটা নস্টালজিয়া জড়িয়ে আছে, ওপার থেকে বিভূতিভূষণ কি তা জানতে পারছেন?
এই মেঘ,এই দুর্দিন,অনন্ত ভবিষ্যতের পথে এরাই রহিল চিরসাথী--দিগন্তের মায়া--লীলার মতো চৈত্র--বৈশাখের যে দিনগুলো অতীতে মিলাইয়া গিয়াছে--আর কি তাহা ফিরিয়া আসে? "তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার... তাই জনম গেল শান্তি পেলি নারে মন... মন রে আমার!"
আমাদের যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ। তবুও পথের পাচাঁলী চকিতে উকিঁ দিয়ে যায়,"আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?"
যতই আমরা সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির গ্রামগুলি ছেড়ে সভ্যতার খটখটে পাকা রাস্তায় উঠে পড়ছি, ততই যেন পথের পাচাঁলী আমাদের পিছু ডেকে যায়, ফিরিয়ে দিয়ে যায় সেই বাঙালীর আবহমানকালের চিরন্তন মায়াময় প্রকৃতিকে।
আমার গ্রামে এখন যাওয়া হয় কমই। তবুও কোন একদিন গ্রামে যেতে যেতে ভ্যানে বসে মনে পড়ছিল শ্রীকান্তের কথা, " হে মা, তোমার শতকোটি অধম সন্তানের মত আমিও কোনদিন তোমার সেবা করিনি, কিন্তু আজ তোমার যে রূপ নয়নে একেঁ নিয়ে গেলাম, মরণকালেও যেন তা স্মরণ থাকে!" পথের পাচাঁলী আমার কাছে সেদিনের লালমাটির রাস্তায় টুপটাপ ঝরে পড়া অশ্রুবিন্দুর মত স্নিগ্ধ, পবিত্র। এতক্ষণে তাদের বনে-ঘেরা বাড়িটার উঠানটাতে ঘন ছায়া পড়িয়া আসিতেছে, কিচ কিচ করিয়া পাখি ডাকিতেছে, সেই মিষ্ট নিঃশব্দ শান্ত বৈকাল––সেই হলদে পাখিটা আজও আসিয়া পাঁচিলের উপরের কঞ্চির ডালটাতে সেই রকমই বসে, মায়ের হাতে পোঁতা লেবুচারাটাতে হয়তো এতদিনে লেবু ফলিতেছে ৷...
আরও কিছুক্ষণ পরে তাহাদের সে ভিটায় সন্ধ্যার অন্ধকার হইয়া যাইবে, কিন্তু সে সন্ধ্যায় সেখানে কেহ সাঁজ জ্বালিবে না, প্রদীপ দেখাইবে না, রূপকথা বলিবে না ৷ জনহীন ভিটার উঠানভরা কালমেঘের জঙ্গলে ঝিঁঝি পোকা ডাকিবে, গভীর রাত্রে পিছনের ঘন বনে জগডুমুর গাছে লক্ষ্মীপেঁচার রব শোনা যাইবে...কেহ কোনোদিন সেদিক মাড়াইবে না, গভীর জঙ্গলে চাপা-পড়া মায়ের সে লেবুগাছটার সন্ধান কেহ কোনোদিন জানিবে না, ওড়-কলমির ফুল ফুটিয়া আপনা-আপনি ঝরিয়া পড়িবে, কুল নোনা মিথ্যাই পাকিবে, হলদে-ডানা তেড়ো পাখ��টা কাঁদিয়া কাঁদিয়া ফিরিবে ৷
বনের ধারে সে অপূর্ব মায়াময় বৈকালগুলি মিছামিছিই নামিবে চিরদিন।"
" আমি তোকে ছেড়ে যেতে চাইনি দিদি! ওরা আমায় নিয়ে যাচ্ছে!" আমি জানি, আমি বারবার ফিরে আসব এই বইটির কালো অক্ষরগুলোর কাছে। আসতে আমাকে হবেই। অপু আমার, আপনার, আমাদের পাচাঁলী। "পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন––মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়? তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে...
দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়... তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শ্যাওলা-ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয় না... চলে... চলে... চলে... এগিয়েই চলে...
অনির্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ...
সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমায় ঘরছাড়া করে এনেছি!...
A book so innocent and pure. A book so vivid and imaginary. A book that fills your heart with nostalgia and joy. A book that also makes you cry. A book that will stay within me forever now that I have read it. A book that I am so thankful exists!
হয়তো নিজস্ব অনুভূতি নথিবদ্ধ করার সুযোগ পাইনি, বা হয়তো স্রেফ গাফিলতি করে এড়িয়ে গিয়েছি।
গতকাল রাত্রে অনেক্ষন আলোচনা হলো দুজন বন্ধুর সঙ্গে। বিষয় ছিল: কবি বিভূতিভূষণ এবং তাঁর তৃতীয় নয়ন।
আজ নভেম্বরের পয়লা তারিখ। কথাশিল্পীর চলে যাওয়ার দিন। রইলো আমার নিবেদন।
বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে বিভূতিভূষণ এমন এক নাম, যেখানে প্রকৃতি, দারিদ্র্য, এবং আত্মার গভীর স্পন্দন মিলেমিশে একাকার। ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশের এক শতাব্দী পরে আজও পাঠকের হৃদয়ে যে কম্পন তৈরি করে, তা কেবল তার আখ্যানের নয়—তার অন্তর্লীন দর্শনেরও। মৃত্যু, ক্ষুধা, শিশুমন, এবং লোকজ সংস্কৃতির সমবায় এক বহুধাবিচিত্র মানবগাথা হয়ে ওঠে এখানে।
উপন্যাসটির ভিতর দিয়ে আমরা যেমন দেখি অনাবৃত দারিদ্র্যের মুখ, তেমনি দেখি এক প্রকার নিভৃত ভক্তির নন্দনকানন—যেখানে “গতিই জীবন, গতির দৈন্যই মৃত্যু” (বিভূতিভূষণ)।
এই দার্শনিক সূচনাবাক্যটি তাঁর সমগ্র সাহিত্যচেতনার কেন্দ্রবিন্দু। যেন হেরাক্লাইটাসের উক্তি—“No man ever steps in the same river twice”—এর ভারতীয় প্রতিধ্বনি। বিভূতিভূষণের কাছে জীবন কোনও স্থিত অবস্থা নয়, এক অনন্ত প্রবাহ, যার মূলে গতি, পরিবর্তন, আর অপূর্ব সহিষ্ণুতা।
‘পথের পাঁচালী’-র প্রথম অধ্যায়ে হত্যার কাহিনি, তারপর অপহরণ, তার পর দারিদ্র্যের কষ্ট, অনাহারের দীর্ঘ ছায়া—বিভূতিভূষণ এই সবকিছুকে চিৎকৃত নয়, নীরব সুরে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেন টলস্টয়ের ‘Resurrection’ বা হার্ডির ‘Tess of the d’Urbervilles’-এর মতো সামাজিক বাস্তবতা, কিন্তু তার ভিতরে রয়েছে আধ্যাত্মিক ধ্যানের স্তব্ধতা।
ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু, দুর্গার মৃত্যু, হরিহরের মৃত্যু—সবকিছুতেই মিশে আছে নৃশংসতা ও নিরুপায়তা। “মৃত্যু এখানে কোনও নাটকীয় সমাপ্তি নয়,” লিখেছেন মোঃ আচাযউদ্দিন তাঁর প্রবন্ধ ‘পথের পাঁচালী: মৃত্যু প্রলঙ্গ’-এ, “বরং এক দার্শনিক পরিবর্তন, যেখানে শরীরের বিনাশ মানে অস্তিত্বের নবরূপে উদ্ভাস।” এই ধারণাটি স্পষ্টত উপনিষদীয়: ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।’ বিভূতিভূষণের মৃত্যুচেতনা কোনও ধর্মীয় আচার নয়; তা এক নীরব প্রাকৃতিক স্বীকারোক্তি।
দুর্গা যখন বৃষ্টিতে ভিজে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়, তখন তার মধ্যে যে অনাহত সৌন্দর্য বিভূতিভূষণ দেখান, তা রিলকের “Duino Elegies”-এর সঙ্গে তুলনীয়। রিলকে যেমন লিখেছিলেন—“Beauty is nothing but the beginning of terror,”—তেমনি বিভূতিভূষণের মৃত্যুচিত্র ভয়াবহ হলেও একপ্রকার সৌন্দর্যের দিগন্তে বিলীন হয়ে যায়।
বিভূতিভূষণের জীবনদর্শনকে তাই বলা যায় এক ‘দুঃখময় আনন্দবাদ’—যেখানে কষ্টের মধ্যেই থাকে জগতের রস। ‘পথের পাঁচালী’ পাঠ করতে করতে আমরা বুঝতে পারি, বিভূতিভূষণ জীবনের ক্ষুদ্রতম অভিজ্ঞতার মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজেছেন। তিনি জানতেন—“দৈনন্দিন ছোটখাটো সুখ-দুঃখের মধ্যে দিয়ে যে জীবনধারা ক্ষুদ্র গ্রাম্য নদীর মত মন্থর বেগে অথচ পরিপূর্ণ বিশ্বাসের ও আনন্দের সঙ্গে চলেছে—আসল জিনিসটা সেখানে।”
লাবণ্যিকা ঘোষালের একটি অসামান্য গবেষণা পড়েছিলাম। তিনি ‘শিশুমন ও আচরণ: প্রলঙ্গ ‘পথের পাঁচালী’’-তে বিভূতিভূষণের দুই শিশুচরিত্র—অপু ও দুর্গা—কে ফ্রয়েডীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। দুর্গার চুরিবিদ্যা, তার প্রকৃতিপ্রীতি, ভাইয়ের প্রতি মমতা—সবকিছুতেই একান্ত মনস্তাত্ত্বিক স্তর আছে। “Pleasure principle”-এর মতোই দুর্গা ও অপু প্রকৃতির মধ্যে আনন্দ খোঁজে; কিন্তু সেই আনন্দ সমাজের চোখে অপরাধ।
অপু যখন ছাঁদা বাঁধে, যখন ছায়ার সঙ্গে কথা বলে, তখন তার মন নিছক শিশুমন নয়, বরং এক সৃষ্টিশীল পর্যবেক্ষক। বিভূতিভূষণের কলমে শিশুমন মানে নিস্পাপতা নয়, এক অনুসন্ধিৎসা—যা Wordsworth-এর “The child is father of the man”–এর বাস্তব রূপ।
অপুর জগৎ এক অন্তহীন শেখার পথ—দারিদ্র্য, মৃত্যু, আনন্দ, লজ্জা, এবং বিস্ময়ের মধ্যে দিয়ে আত্মার পরিণতি ঘটে। Freud যেমন বলেছিলেন—“Dreams are the royal road to the unconscious,”—তেমনি বিভূতিভূষণের শিশু-চরিত্রের স্বপ্নই আমাদের সমাজের অচেতন মুখোশ উন্মোচন করে।
তবে ফ্রয়েডীয় মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গে বিভূতিভূষণ যোগ করেছেন লোকমন ও ভারতীয় মনোবৃত্তির ধারাবাহিকতা। দুর্গার চোখে যে আনন্দ, তা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার আনন্দ; এখানে মনস্তত্ত্ব আর লোকসংস্কৃতি একসূত্রে গাঁথা।
বিভূতি বাবু তাঁর উপন্যাসে গ্রামীণ সমাজের গান, প্রবাদ, বিশ্বাস ও আচারকে কাহিনির অঙ্গ করে তুলেছেন। ইন্দির ঠাকরুনের কথায়, দুর্গার নাচে, সর্বজয়ার কুসংস্কারে—এই লোকজ ভাবনাই বাস্তবতাকে মানবিক করে তোলে। তাঁর লোকচেতনা নিছক নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়ন নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক মানবতাবাদ। তাঁর চরিত্রেরা প্রকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধ রাখে, যেমন আফ্রিকার লোকগাথায় মানুষ রাখে বৃক্ষের সঙ্গে। গীতার “ক্ষেত্রজ্ঞ” ধারণা এখানে বাস্তব: মানুষ তার ক্ষেত্রের জ্ঞাতা, কিন্তু ক্ষেত্রের অংশও।
তাই ‘পথের পাঁচালী’ কেবল দারিদ্র্যের কাহিনি নয়, এক লোকসমাজের সমগ্র জীবন্ত অভিধান—যেখানে গানের ছন্দ, ধর্মবিশ্বাস, শিশুর খেলাধুলা, সবকিছু মিলে গড়ে ওঠে বাংলার এক সাংস্কৃতিক জীবরস।
সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন—“Pather Panchali is not about poverty, it’s about life.” এই উক্তিই বিভূতিভূষণের বাস্তবতার মর্ম। তিনি জীবনের ভয়াবহতা দেখিয়েছেন, কিন্তু সেই ভয়াবহতার মধ্যেও সৌন্দর্য খুঁজেছেন।
তাঁর বাস্তবতা Camus-এর ‘The Plague’-এর মতো এক নৈতিক অভিজ্ঞতা: যেখানে মানুষ এক অজানা অনিবার্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে, তবু বাঁচে। বিভূতিভূষণের চরিত্রেরা অসহায়, কিন্তু ত্যাগী নয়; তাদের মধ্যে আছে এক গভীর স্থৈর্য।
এই স্থৈর্য তাঁর জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও এসেছে। ছোটোবেলায় দারিদ্র্য, বাবার অনুপস্থিতি, গৌরীদেবীর মৃত্যু—সব মিলে তাঁর ভিতরে গড়ে উঠেছিল এক সংবেদনশীল কঠোরতা। নীরদচন্দ্র চৌধুরী যথার্থই বলেছিলেন—“He was a man of tragic endurance, never of despair.”
‘ভালবাসা Pity নয়…’—এই সংজ্ঞা তাঁর নৈতিকতার কেন্দ্র। বিভূতিভূষণের ভালোবাসা হল করুণার অতীত, মানবতার নীরব সঙ্গীত।
প্রকৃতি তাঁর কাছে নিছক ব্যাকগ্রাউন্ড নয়, এক জীবন্ত সত্তা। ঘাটশিলার জঙ্গলে বসে তিনি লিখেছিলেন, “অরণ্যই ভারতের আসল রূপ।” ‘আরণ্যক’-এর নিস্তব্ধতা বা ‘দেবযান’-এ��� অলৌকিকতা আসলে এই অরণ্যভাবনার বিস্তার।
তিনি প্রকৃতিকে দেবতা করেননি, বরং তার সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি Wordsworth-এর “spirit that rolls through all things”–এর মতোই। প্রকৃতির সঙ্গে এই সংলাপ বিভূতিভূষণের লেখাকে উপনিষদীয় শান্তি দেয়, যা পরবর্তীকালে ‘ইছামতী’ বা ‘অশনি সংকেত’-এ সমাজতাত্ত্বিক পরিসরে রূপ নেয়।
দীর্ঘকাল বিভূতিভূষণকে ‘প্রকৃতিপ্রেমিক’ বলে একরকম simplistic কালেইডোস্কোপে দেখা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর লেখায় চাপা হিংসার ধারাও প্রবল। ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক বৈষম্য, দুর্ভিক্ষ, লজ্জা, চুরি, শোষণ—সবই তাঁর নন্দনতত্ত্বে সন্নিবিষ্ট।
ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর দায়ে যে পয়সা না দেওয়ার ঋণ, দুর্গার নাক ফাটানোর ঘটনা, বা ‘অশনি সংকেত’-এর মতি মুচিনীর লাশ—সবকিছুই বাঙালি জীবনের অদেখা হিংসাকে উন্মোচিত করে। তবে তাঁর হিংসা চিৎকার নয়; তা সংযত, সংহত।
Camus যেমন বলেছিলেন—“The evil that is in the world always comes of ignorance,”—তেমনি বিভূতিভূষণের চরিত্রের হিংসাও অজ্ঞতা ও অভাবের ফল। তাঁর দৃষ্টিতে হিংসা সমাজের অন্তর্গত রোগ, মানুষের অন্তর্নিহিত পাপ নয়।
এই ভাবনাই তাঁকে সমকালীন মার্কসবাদী সাহিত্য থেকে পৃথক করে। তিনি সামাজিক পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ ভাবেননি; তিনি কেবল মানবতার ব্যথা অনুভব করেছেন।
‘অনুবর্তন’-এর ক্ষুধার্ত শিক্ষক, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর ক্ষুধার অর্থনৈতিক ব্যঙ্গ, ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’-এর মানসিক অবক্ষয়, ‘ইছামতী’-র নীল চাষ—সব মিলিয়ে বিভূতিভূষণের সাহিত্য এক নীরব প্রতিসংঘ।
তিনি কখনও আন্দোলন করেননি, কিন্তু তাঁর প্রতিটি বাক্য ছিল এক নৈতিক ঘোষণা: “একটা জাতি শিক্ষকদের শ্রদ্ধাসনে বসিয়ে তাঁদের প্রায় না খাইয়ে রেখেছে যুগ যুগ ধরে।”
এই নৈতিক বোধ তাঁকে পশ্চিমা ‘মোরাল রিয়ালিজম’-এর সঙ্গে যুক্ত করে—টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, হার্ডির ধারার মতো। তাঁদের মতোই বিভূতিভূষণ বিশ্বাস করতেন যে শিল্পের কাজ সমাজের অন্যায় প্রকাশ করা নয়, তাকে অনুভব করানো।
তিনি লিখেছিলেন, “বাইরের জগতে যা ঘটে, তার চেয়ে লেখকের মনের জগতে আর এক মহত্তর, ব্যঞ্জনাময় বাস্তব আছে।” এই বাক্যই তাঁর শিল্পতত্ত্বের সারকথা। বাইরের দারিদ্র্য, মৃত্যু, ক্ষুধা—সবই তাঁর ভিতরের জগতে পরিণত হয় আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতায়।
Camus-এর মতোই তিনি ছিলেন “a man condemned to hope”—হতাশার মধ্যেও আলো খুঁজেছেন। ঘাটশিলায় তাঁর ‘গৌরীকুঞ্জ’-এর নির্জনে প্রকৃতি, আকাশ, নক্ষত্র—সবই ছিল তাঁর পাঠশালা। ভোরে উঠে ইছামতীতে স্নান, রাতে গাছের ডালে বসে আকাশ দেখা—এই ছিল এক সাধকের জীবনযাপন।
তাঁর প্রিয় ফুল ঘেঁটু বা ছোট এড়াঞ্চির মতোই ছিল তাঁর সাহিত্য—অপ্রচলিত, কিন্তু প্রাণে ভরা।
বিভূতিবাবুর ভাষা মিতভাষী, সংবেদী, স্নিগ্ধ। তাঁর বর্ণনা যেন চিত্রকলার মতো, কিন্তু সেই ছবির ভিতরে থাকে একটি দার্শনিক নীরবতা। Eliot বলেছিলেন—“Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion.” বিভূতিভূষণও আবেগে ডুবে লেখেননি; তিনি আবেগকে শাসন করেছেন।
তাঁর বাক্যগঠন, সংলাপ, লোকভাষার ব্যবহার—সবই এক প্রকার শাস্ত সঙ্গীত। তাই ‘পথের পাঁচালী’ কেবল উপন্যাস নয়, এক সংগীতরূপী অভিজ্ঞতা।
শেষে এটুকুই বলার যে এই উপন্যাস বিভূতিবাবু ও বিশ্বমানবতার সেতুবন্ধন। বিভূতিভূষণ ছিলেন “a saint among storytellers”—যিনি মানবজীবনের মলিন রূপে দেখেছিলেন ঐশ্বর্যের ঝলক। তাঁর সাহিত্য এক গভীর মানবতাবাদী চেতনার বাহন, যেখানে প্রকৃতি, মৃত্যু, প্রেম, ও লোকজ সংস্কৃতি মিলেমিশে গড়ে তোলে এক সম্পূর্ণ ভারতীয় মহাকাব্য।
‘পথের পাঁচালী’ তাই কেবল একটি গ্রামীণ উপন্যাস নয়, বরং মানবজীবনের অন্তরতম সংগীত, যার সুর বয়ে যায় সময় ও ভূগোলের সীমা ছাড়িয়ে—যেন সমগ্র বিশ্বের সাহিত্যের গভীরতম সঙ্গীতে মিশে যায় তার ধ্বনি। নিশ্চিন্দিপুরের মাটিতে যেমন আমরা শুনি ক্ষুধা, মৃত্যু, শিশুর হাসি, আর প্রকৃতির অন্তর্যামী তান—তেমনি ধ্বনিত হয় টলস্টয়ের রাশিয়ান গ্রামে, যেখানে Anna Karenina বা Resurrection-এর মানুষরাও অন্ধকার ও পরিত্রাণের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়।
হার্ডির ওয়েসেক্স প্রদেশে যেমন Tess বা Jude-এর ট্র্যাজেডি নেমে আসে প্রাকৃতিক ও সামাজিক শক্তির মিলিত আঘাতে, তেমনি বিভূতিভূষণের নিশ্চিন্দিপুরেও প্রকৃতি হয়ে ওঠে ভাগ্যের নীরব সাক্ষী। কিন্তু হার্ডির হতাশার বিপরীতে বিভূতিভূষণ খুঁজে পান শান্ত আত্মসমর্পণের এক অনন্ত সুর—যেখানে বেঁচে থাকাই নৈতিকতা, সহিষ্ণুতাই মানবতার মাপকাঠি।
রিলকের কবিতায় যেমন মৃত্যুকে বলা হয় “the other side of life, the inner space of existence,” তেমনি দুর্গার মৃত্যু, ইন্দির ঠাকরুনের বিলুপ্তি, কিংবা অপুর নিঃসঙ্গতায় আমরা দেখি মৃত্যুরই অপরূপ মানবিক রূপ—এক নীরব উত্তরণ, যা দুঃখকে অনস্তিত্ব নয়, রূপান্তর বলে জানায়। রিলকের “Duino Elegies”-এর মতোই ‘পথের পাঁচালী’ আমাদের শেখায়: জীবনের যন্ত্রণাই আমাদের দেবতার দিকে ঠেলে দেয়।
কামুর ‘The Plague’ কিংবা ‘The Stranger’–এর মতোই বিভূতিভূষণের জগৎ এক প্রকার নীরব অস্তিত্ববাদ—কিন্তু তফাত এই যে, কামু যেখানে দেখেন অ Absurd-এর তিক্ত শূন্যতা, বিভূতিভূষণ সেখানে দেখেন করুণায় দীপ্ত অর্থপূর্ণতা। তাঁর অপু কখনও “absurd man” নয়; সে জানে কষ্টের মধ্যেও জগত আছে, নদী আছে, পাখির ডাক আছে, আর সেটাই ঈশ্বরের উপস্থিতি।
ফকনারের Yoknapatawpha County-র মতোই নিশ্চিন্দিপুরও এক মিথোপোয়েটিক ভূগোল—একটি কাল্পনিক গ্রাম, যা বাস্তবতার চেয়ে বেশি সত্য। যেমন ফকনারের গ্রামীণ আমেরিকা মানবচেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে, তেমনি বিভূতিভূষণের গ্রাম ভারতীয় অস্তিত্বের প্রতীক। দু’জনই ‘local colour’-এর ভিতর দিয়ে ‘universal condition’-এর সন্ধান দেন।
লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিস্ট ধারায় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ‘One Hundred Years of Solitude’-এ ম্যাকন্দোকে গড়ে তোলেন এমন এক স্থানে, যেখানে বাস্তব ও অলৌকিকতা মিশে যায়। বিভূতিভূষণও, তার বহু আগেই, এই কাজটি করেছিলেন—লোকসংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস ও প্রকৃতির সংলাপে ‘পথের পাঁচালী’ হয়ে ওঠে বাংলার ম্যাকন্দো। তাঁর লেখার অলৌকিকতা চমক নয়, বরং অন্তর্মুখী চেতনা—যেখানে এক মৃত মেয়ের ছায়া হয়ে ফিরে আসে দুর্গা, এক ফেলে দেওয়া নোঙা হয়ে ওঠে জীবনের প্রতীক।
ভিক্টর হুগো যেমন Les Misérables-এ দারিদ্র্যকে মহত্ত্বের রূপ দেন, তেমনি বিভূতিভূষণ ক্ষুধাক্লিষ্ট সর্বজয়ার চোখে খুঁজে পান মাতৃত্বের দার্শনিক উজ্জ্বলতা। তাঁর দারিদ্র্য ভিক্ষার নয়, তপস্যার—“suffering as the ultimate purification of being.”
এমনকি দস্তয়েভস্কির ‘Brothers Karamazov’–এর নৈতিক উল্লাস ও আধ্যাত্মিক দ্বন্দ্বের প্রতিধ্বনি শোনা যায় অপুর যাত্রায়। অপু, আলিওশার মতোই, ব্যথার ভিতর দিয়ে ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে চায়। বিভূতিভূষণের ঈশ্বর কোনো মন্দিরের দেবতা নন, তিনি প্রকৃতির গাছ, নদী, মেঘ, আলো ও মৃত্যুর নিঃশব্দতায় বর্তমান।
এই ভাবেই ‘পথের পাঁচালী’ নিজেকে স্থাপন করে বিশ্বসাহিত্যের বৃহত্তর মানবিক পরিসরে—যেখানে মানুষের অভিজ্ঞতা, স্থান-কাল নির্বিশেষে, একই আদিম ব্যথা ও একই গভীর মমতার সুরে বাঁধা।
বিভূতিভূষণের নিজস্ব উক্তিই হয়তো এই সমগ্র কথনের সারসংক্ষেপ— “ভালবাসা ভালবাসা।”
এই বাক্যটি শুধুই ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, বরং এক সর্বজনীন নৈতিক দর্শন, যা টলস্টয়ের খ্রিষ্টীয় মানবতাবাদ, রিলকের রোমান্টিক ঈশ্বরচেতনা, কামুর অস্তিত্ববাদী সংযম, আর রবীন্দ্রনাথের “যে ভালোবাসে, সে-ই সত্য দেখে”—এই সবকিছুর মিলিত প্রতিধ্বনি।
ভালবাসার মধ্যেই তাঁর দারিদ্র্য, মৃত্যু, প্রকৃতি, এবং ঈশ্বর—সব একাকার। সেই ভালবাসা কখনও করুণা নয়, যেমন তিনি নিজে লিখেছিলেন: “ভালবাসা Pity নয়, করুণা নয়, Charity নয়… ভালবাসা ভালবাসা।” এই অকপট মানবিকতা তাঁকে পৃথক করে ফেলে তাঁর সময়ের যাবতীয় সাহিত্যিক আন্দোল�� থেকে; তিনি সমাজতত্ত্বের লেখক নন, মানবতত্ত্বের দ্রষ্টা।
আর এই কারণেই ‘পথের পাঁচালী’ আজও বেজে চলে—মানবতার নীরব সংগীত হয়ে, যা শোনা যায় না কেবল বাংলার গ্রামে, বরং সমগ্র পৃথিবীর নিস্তব্ধ পাঠশালায়, যেখানে প্রতিটি পাঠক, একবার অন্তত, নিজের ভিতরের অপুকে চিনে নেয়।
বিশ্বসাহিত্যের চিরকালীন সম্পদ হয়ে রয়ে যাবে এক বাঙালি ইস্কুলমাস্টারের লেখা এই মহাকাব্য।
এতদিনে তাহাদের সেখানে ইছামতীতে বর্ষার ঢল নামিয়াছে ৷ ঘাটের পথে শিমুল তলায় জল উঠিয়াছে ৷ ঝোপে ঝোপে নাটা-কাঁটা, বনকলমির ফুল ধরিয়াছে ৷ বন অপরাজিতার নীল ফুলে বনের মাথা ছাওয়া ৷”
It is not hard to comprehend why the publishers didn’t wish to proceed with the manuscript of this novel. It lacks a cohesive narrative structure and can be put forward best as a collection or a string of fragments that together make up a slice-of-life delineation. However, I feel that the author’s Aranyak is more like a string of events; that did not face so many problems, so maybe the structure was not all that bothered the publishers so much. Rather, the reasons were very much the same as why no one wanted to fund the adaptation when Satyajit Ray wanted to make it, the thematics and the honest, brutal description of the economic duress of the then village life of the lower-middle class. It is not very surprising, given how many Indians dismissed the movie as poverty porn.
I will always maintain that Manik Bandopadhyay and Bibhutibhushan are two among very few authors who can portray village life with such a display of calibre and authenticity. And Bibhutibhushan managed to add to the images a melancholic and nostalgic theme of loss of innocence and leaving your home for a hopeful yet unpredictable tomorrow.
It is confounding how the author brought some of the characters to life with so few words, especially Indira Thakuron (it feels weird to write all this in English. But there is no point in writing in Bengali either because I do not think I can do more justice to the review that way), who is present for around merely a tenth of the novel, perhaps. There is a subtle undertone to the story about the hierarchy of power in family dynamics and patriarchal dominance, but it is tough to be judgmental because the tonality was not ambiguously sympathetic but factual.
“বুড়ি সে কথা হজম করিয়া লইল। এরূপ অনেক কথাই তাহাকে দিনের মধ্যে দশবার হজম করিতে হয়। সেকালের ছড়াটা সে এখনো ভোলে নাই- লাথি ঝাঁটা পায়ের তল, ভাত কাপড়টা বুকের বল-”
Another noticeable and remarkable aspect of the story is how it does not dwell on the grief of loss or sorrow. A character's demiss does impact the lives of the people around them, but it does not stop. That adds to the bittersweetness of the morale of the tale. But, it can be perceived as being too devoid of emotions. However, that argument does not last, because, in the long run, it is a tale of the relation between man and nature, like all of Bibhutibhushan's stories. Birth, coming of age, and adulthood all are but additional elements to elevate the storytelling.
"পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন––মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়? তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে...
দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়... তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শ্যাওলা-ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয় না... চলে... চলে... চলে... এগিয়েই চলে...
অনির্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ...
সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমায় ঘরছাড়া করে এনেছি!...
চল এগিয়ে যাই ৷"
On another note, Pather Panchali was further popularised by Ray’s masterful adaptation back in the 50s, a movie that is close to my heart but not as much as the books. That being said I doubt half of the people who understand Bengali have bothered to read it. Either way, I suggest anyone watch the movie first because otherwise, the details that the novel (or the next one, Aparajito) goes to will leave you asking for much more from the screen. And that is not a good thing.
To tell the truth, I am not competent enough to fully express my feelings about this novel. Or any of the other works by Bibhutibhushan that I first read as a child. They always manage to cause turmoil of a very absurd combination within me, and while I am glad or sad, there remains a void inside me. Maybe someday I can justify it. Either way, this is as good a start to this year as I could have asked.
এতক্ষণে তাদের বনে-ঘেরা বাড়িটার উঠানটাতে ঘন ছায়া পড়িয়া আসিতেছে, কিচ কিচ করিয়া পাখি ডাকিতেছে, সেই মিষ্ট নিঃশব্দ শান্ত বৈকাল––সেই হলদে পাখিটা আজও আসিয়া পাঁচিলের উপরের কঞ্চির ডালটাতে সেই রকমই বসে, মায়ের হাতে পোঁতা লেবুচারাটাতে হয়তো এতদিনে লেবু ফলিতেছে ৷...
আরও কিছুক্ষণ পরে তাহাদের সে ভিটায় সন্ধ্যার অন্ধকার হইয়া যাইবে, কিন্তু সে সন্ধ্যায় সেখানে কেহ সাঁজ জ্বালিবে না, প্রদীপ দেখাইবে না, রূপকথা বলিবে না ৷ জনহীন ভিটার উঠানভরা কালমেঘের জঙ্গলে ঝিঁঝি পোকা ডাকিবে, গভীর রাত্রে পিছনের ঘন বনে জগডুমুর গাছে লক্ষ্মীপেঁচার রব শোনা যাইবে...কেহ কোনোদিন সেদিক মাড়াইবে না, গভীর জঙ্গলে চাপা-পড়া মায়ের সে লেবুগাছটার সন্ধান কেহ কোনোদিন জানিবে না, ওড়-কলমির ফুল ফুটিয়া আপনা-আপনি ঝরিয়া পড়িবে, কুল নোনা মিথ্যাই পাকিবে, হলদে-ডানা তেড়ো পাখিটা কাঁদিয়া কাঁদিয়া ফিরিবে ৷
বনের ধারে সে অপূর্ব মায়াময় বৈকালগুলি মিছামিছিই নামিবে চিরদিন।"
সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব-পশ্চিম - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাসত্রয়ীকে টাইম ট্রিলজি বলা হয়, কারণ সময়ই সেখানে প্রধান নিয়ামক। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথার ক্ষেত্রেও সময়ের ভূমিকা চোখে পড়ে। জহির রায়হানের হাজার বছর ধরের কথাও বলা যায়; সেখানে তো নামেই বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে সময়ই এখানে কাহিনীর চালকের আসনে বসে আছে। আমরা কথায় কথায় একটা ক্লিশে বাক্য বলি : কী ছিল, আর কী হয়ে গেল! পথের পাঁচালীর ক্ষেত্রেও এমনটা বলা যায়। অপুর জন্মের পর এক যুগ যেতে না যেতেই জীবনের কত রকম রূপ তার দেখা হয়ে গেল। তার মায়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মত।
"বৃদ্ধার নিজের সঙ্গেও দু-তিনটি ঝি আসিয়াছে। তাহারা পিছনে পিছনে আছে। নানা বিদায় আপ্যায়নের বিনিময় হইল, বহু বিনীত হাস্য বিস্তার লাভ করিল, হঠাৎ এ বাড়ির ঝি-চাকরের দল গড় হইয়া প্রণাম করিয়া খানিকক্ষণ যেন মাটির সাথে মিশিয়া রহিল। সর্বজয়া মনে মনে ভাবিল- এরা এত বড়লোক, এরা যখন এত খাতির করচে, তখন তো যে সে নয় ...
এইমাত্র তাহার মনে পড়িয়াছে। অনেকটা এইরকম চেহারার ও এইরকম বয়সের- সেই তাহার বুড়ি ঠাকুরঝি ইন্দির ঠাকরুন, সেই ছেড়া কাপড় গেরো দিয়ে পরা, ভাঙা পাথরে আমড়া ভাতে ভাত, তুচ্ছ একটা নোনাফলের জন্য কত অপমান, কেউ পোঁছ না, কেউ মানে না, দুপুর বেলায়, সেই বাড়ী হইতে বিদায় করিয়া দেওয়া, পথে পড়িয়া সেই দিন মৃত্যু... সর্বজয়ার অশ্রু বাধা মানিল না।"
সর্বজয়া তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। সময় খুব নির্মম, মানুষকে শিক্ষা ঠিকই দেয়, কিন্তু ভুল ত্রুটির প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ খুব একটা দেয় না। সময় অপুকে নিষ্পাপ চোখে জীবনের কিয়দংশ চিনতে শিখিয়েছে, এখন চলছে পৃথিবীর নির্মমতার পাঠ, আর বেঁচে থাকলে একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা তো হবেই। খুব নির্মম, হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা। কিন্তু উপায় কী! সময় শুধু আমাদের শিক্ষকই না, সময় আমাদের ঘাতকও বটে।
পথের পাঁচালীতে খুব চমৎকারভাবে শিশুদের সাইকোলজি তুলে ধরা হয়েছে। দুর্গার সহানুভূতিশীল মন, অপরাধপ্রবণতা; অপুর সরলতা, আত্মসম্মানবোধ, সুন্দর চেহারার সুবিধা- বিভূতিভূষণ খুব ভালোবাসা দিয়ে দুই ভাইবোনকে লিখেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস পথের পাঁচালী, প্রথম সন্তানের মত।
His mother might think he was spending his days in the woods, but really he spent them in the desert and hills of Rajabara, inside the theatres of Delhi and Agra, in mirror panelled rooms in the company of gorgeous women dressed in full skirts and colourful dupattas. What a wonderful worid, this! The golden light of the full moon shone every chapter, the friendship of beautiful faces and Don games was the norm and on the occasion of the Aaheria hunt in spring, people went on long horse rides wi Spears, racing through barren valleys and fields of golden maize.
This beautiful story set in the imaginary village of Abode Of Contentment is a Bengali cult classic. It talks about the Roy family, and their journey while Opu, their second child discovers the world of fantasy and fiction.
The book is a cultural phenomenon, with poetry and prose, all intermingled in one another.
The Roy family constitutes of five people - Horihor, Shorbojoya, Durga, Opu and Indir Thakrun. The book starts with a background story on Indir Thakrun and her ancestors, and then later on pans to Opu who is the star kid of the story.
It talks about financial hardships, motherhood, sibling-hood and the beautiful world of books.
People often say that mothers are the greatest pillar of society, for they give civilization its greatest asset: its men. We praise women, and justly so, for unselfishly bearing and raising our boys without expecting any recognition or compensation in return. But in that praise, do we not often forget the gifts that a child bestows upon its mother? It is true that our children enter the world empty-handed, without the coins to pay for their care. But what worldly wealth can compare to the joy of seeing that first gummy smile, hearing those first lisping words? Can any earthly treasure treasure e as precious as watching the wonder with which our ban slowly discover the world? No, we do not minister to our children solely out of the goodness of our hearts. Parenting not an act of charity or duty, akin to giving alms to a beggar. Children pay us for every moment of care that we give them. They pay for it with the sheer joy and wonderment that we feel in watching them grow.
The reason I cut 0.5 stars was because I felt there a small element missing in the book, somewhere lost in translation, and if you know how to read or understand Bengali, highly recommend reading or listening to the book in the OG language.
A mesmerizing read that transports you to a different realm altogether!
In conclusion
A beautiful read about the world through a child's eyes. A great introduction to Bengali culture and literature. .
''দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস,বর্ষ,মন্বন্তর,মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়...তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শেওলা-ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনো ফুরোয় না...চলে...চলে...চলে...এগিয়েই চলে... অনির্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ... সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমাকে ঘরছাড়া করে এনেছি!... চল এগিয়ে যাই৷''
- এই শব্দমালা কেন একইসাথে আমার মুখে বিগলিত হাসি আর আঁখিজোড়ায় অশ্রুর রেখাচিত্র এঁকে যায়???কেন বারেবারে আমায় আবেগপ্রবণ করে ফেলে? কেন ফেলে দেয় সেই সর্বনাশা দ্বৈরথে- যার একদিকে সোনালী-রূপালি অতীতের স্মৃতিকাতরতা, আরেকদিকে অনাগত দুর্নিবার ভবিষ্যতের গান!
সে জবাব আমি আজো পাইনি৷
এই উপন্যাস সম্মন্ধ্যে বলার মতো কোন ভাষা আমার নেই, আমার সমগ্র শব্দভাণ্ডার যেন এই উপন্যাসের জন্য যথেষ্ট নয়,,, হাজারো বাঙালির হৃদয়ে সবচাইতে আদরণীয়, মমতাময়, মায়াময় স্থানটি বুঝি এই উপন্যাসের জন্যই তোলা! সমস্ত আবেগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে পবিত্রতা-সরলতায় আচ্ছাদিত এই পাঁচালী-"পথের পাঁচালী"৷
প্রত্যেক পাতা ওলটাতে ওলটাতে আমি যেন অন্তর্নিহিত হয়ে যাচ্ছিলাম এক অন্য জগতে- সেই সহজ-সরল অথচ মায়ামমতা বিজড়িত নিশিন্দিপুর গ্রাম, প্রকৃতিদেবী যেন আহ্বান করছেন একাত্ম হয়ে সেই শ্যামল-সবুজে মিশে যেতে......অপু-দুর্গার দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটিতে যেন আরও অটুট হচ্ছে ভাইবোনের আত্মিক বন্ধন, পাড়াগাঁয়ের সেই কোন্দল যেন আজো চলছে সমানতালে,আর? সেই প্রথম ট্রেন............... অপু? সেতো আমাদের মতো কিশোরমনের রাজাধিরাজ!!! ওর প্রতিচ্ছবি যেন বারেবারে মনে করিয়ে দেয় আমাদের ছোট্ট শিশুসত্ত্বার রঙিন কল্পনা-কৌতূহলে গড়ে ওঠা রূপকথার রাজ্যকে!!!
মানতে বড্ড কষ্ট হয় যে এই অমর চরিত্রগুলো,এই অসামান্য কাহিনী,এই টানাপোড়েন,উত্থান-পতন,সবকিছুই কাল্পনিক! শ্রদ্ধেয় বিভূতিভূষণবাবুর লেখনী এতোটাই জীবন্ত!
একজন লেখকের কল্পনার জগৎ কতটা নিখুঁত,কতটা জীবন্ত ও বিস্তৃত হতে পারে 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসটা পড়ে তা বোঝা যায়।কী অপূর্ব নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের বর্ণনা!যেন পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ। সাথে অপু ও দূর্গার কান্ডকারখানা বইটিকে করে তুলেছে আরো মনোহর,আরো উপভোগ্য।
এর আগে লেখকের 'চাঁদের পাহাড়' ও 'হীরেমানিক জ্বলে' বই দুইটা পড়ে উনার লেখা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা পেয়েছি।এতো চমকপ্রদ ও মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক বর্ণনা বিভূতিভূষণের বন্দোপাধ্যায়ের রচনাকে দিয়েছে নতুন একটা মাত্রা।তার লেখনীও অপূর্ব।
পথের পাঁচালী নিঃসন্দেহে লেখকের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম।বইটার রিভিউ লেখাও নিষ্প্রয়োজন। সাহিত্যপিপাসু অথচ 'পথের পাঁচালী' পড়েননি এমন পাঠক খুব কমই পাওয়া যাবে।এক কথায় লেখকের তো বটেই বাংলা সাহিত্যেরও অমূল্য এক সৃষ্টির নাম 'পথের পাঁচালী'।
এত সুন্দর! এত মায়া! এই বইখানায়। চোখ ভিজে উঠতেছিলো বারবার। গ্রাম বাংলার হতদরিদ্র এক ব্রাহ্মন পরিবারের গল্প। দূর্গা, অপু, হরিহর, সর্বজয়া প্রত্যেকটা চরিত্রই মায়ায় ভরা। তবে আমার দূর্গাকেই বেশি ভালো লেগেছে। এই বই একবার নয় বারবার পড়লেও সেই আবেগ, সেই মায়া একটুখানি কমে যাওয়ার নয়।
Originally published in 1929 (I think), a terrific story of a life of poverty in an Indian village. I wish Mitt Romney would read this book. (Not sure it would do Paul Ryan any good to read it.)
পৃথিবীর মিষ্টি সম্পর্কগুলোর মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্কটা একটু বেশিই মিষ্টি। একসাথে বেড়ে ওঠার স্মৃতিগুলো অমূল্য। শৈশবে একসাথে করা দস্যিপনা, খেলা, নাচ-গান, মা-বাবাকে জ্বালানো, নতুন কিছু শেখার সময়গুলো... দারুণ মিষ্টি!
This book started my love for Indian novels. The apu's trilogy, Aranakata Pem banda and Gora,Srikantha, Srikantha and Rajalakshmi, all books translated by Ms Sinhaarachchi were loved and read and re read until they got rabbit eared. I was just a teen, eager to get lost in a world, and forget that I was seated in a corner of the school library, unseen by anyone. The story takes you to world of a bygone era, where Apu and his sister love each other with the same love-hate passion that is common for all Era's. We find what it means to be poor, we empathize with Sarwajaya, her harsh life, the little beauties of life she cherishes that she get through her children. Mostly we see a girl, old enough to be married, but yet an adventurous dreamer who has discovered the beauty of the life through little sweet berries and little secret treasures of nature known only to a wandering soul like her. She asks, from her little brother, with eyes full of hope, whether he would take her to see the railway. Her wish never fulfilled, her thirst for life unstated, we bid her good bye with a tear. It maybe because I was just a teenager, with an active imagination and a soft heart without much exposure to the rueful world. But these stories shook me to my very core and left it's mark and has such a powerful hold of me to this date, that while writing this even, a tear came to my eyes just remembering the initial painful moment where I cried with Apu over the loss of his dearest big sister.
Saya penasaran sama kesusateraan klasik dari India karena nama pengarangnya yang menurut saya unik "Bibhutibhushan Banerji" yang ternyata menulis cerita tentang kisah dua kakak adik bernama Durga dan Apu. Selain itu penerjemahnya yang Koesalah Soebagyo Toer (Adik Pramoedya Ananta Toer) membuat saya makin penasaran karena saya menyukai penyajian terjemahannya sebelumnya beliau tulis di dalam buku Anna Karenina 1 of 2 dan Anna Karenina, 2 of 2.
Buku ini menceritakan kisah Dua kakak beradik bernama Durga dan Apu yang tinggal di Desa kecil di Bengali, India. Durga namanya mengingatkan saya akan Dewi Durga Istrinya Dewa Syiwa yah . Mereka termasuk ke dalam Kasta Brahmana karena ayah mereka adalah seorang pendeta yang suka melakukan perjalanan keliling tapi sayangnya meski mereka adalah kasta tertinggi didalam Hindu (Brahmana, Ksatria, Waisya dan Sudra) tetapi mereka hidup dalam garis kemiskinan. Durga dan Apu sering bermain di hutan dan mengumpulkan buah-buah yang berceceran untuk dibawa pulang kepada ibu mereka.
Yang membuat menariknya buku ini memaparkan konflik dan perlakuan orang dewasa yang tidak adil ataupun jahat dari kacamata si Durga dan Apu. Saya terenyuh ketika melihat betapa kasarnya perlakuan ibu Durga dan Apu terhadap seorang nenek tua renta yang diusir dari rumah mereka namun Durga kembali mengajak si nenek untuk kembali tinggal dengan mereka. Ada beberapa hal yang didalam buku ini membuat saya miris betapa sederhananya kebahagiaan Durga dan Apu hanya menemukan buah-buah yang bececeran di kebun dan betapa kemiskinan membuat ketidakadilan semakin nyata
Sayangnya buku ini plot twistnya saya rasakan hampir tidak ada. Ada sedikit sih di akhir2 buku ada suatu kejadian yang membuat kehidupan mereka sekeluarga berubah tetapi disitu aja. Entah kenapa saya berhasil bertahan dengan buku ini yang cenderung stagnan alurnya.
যান্ত্রিক শহর, এতো দ্রুতগতির জীবন এবং আশেপাশের সব অসহ্য লাগলেই আমার মনে হয় আমি একটু 'পথের পাঁচালী' বইটা পড়ি। অপু আর দুর্গার সাথে একটু নিশ্চিন্দিপুর ঘুরে বেড়াই। কিন্তু এতো এতো নতুন বই পড়ে আছে যে প্রিয় বই কোটিবার পডতে ইচ্ছে হলেও আবার শেল্ফে রেখে দেই। তবু প্রায়ই পছন্দের পাতাগুলো পড়ি।
'পথের পাঁচালী' সিনেমা দেখা হয়েছে আগে আর বই পড়া হয়েছে পরে। তারপরেও যতবারই এই বই হাতে নিয়েছি, কখনো মনে হয়নি যে এই বই নিয়ে বানানো সিনেমা আমি দেখেছি। স্পয়লার টয়লার এইসব ব্যাপার তো মাথাতেই আসেনি।
'পথের পাঁচালী' এর প্রথম কয়েকটা অধ্যায় বিশেষ করে ইন্দির ঠাকরুনের সাথে তার যুগের সবার ইতি ঘটার যে লাইন, সেই লাইন পর্যন্ত আমি বহুবার পড়েছি। ভালোলাগে ইন্দির ঠাকরুন কে। তার দুঃখে গলা ভার হয়ে আসে।
অপু দুর্গার জন্যে মন ভীষণ কাঁদে। এই দুইজন যে আমার প্রিয় চরিত্রদের মধ্যে একদম উপরের সারিতে তা নিয়ে কখনো বলা হয় না। কিছু চরিত্র প্রিয় হতে হতে এতো প্রিয় হয়ে যায় যে পরে তাদেরকে নিজের আশেপাশে চলাফেরা করা অতি আপনজন মনে হয়। অপু দুর্গা ঠিক তাই। ঠিক যেমনটি আবার ইন্দির ঠাকরুন।
অপু আর দুর্গা পথ চলে, সেই পথে আমিও চলি ওদের সাথে। পথের চারিধারে নানা পদের জিনিস দেখে ওদের মন পরিপূর্ণ হয়। আমিও ওদের চোখ দিয়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখি। মনে মনে সেই অপার সৌন্দর্য এর ছবি আঁকি। দুর্গা তার পিসিমার মুখে ছেলেবেলায় শেখা ছড়াটা যেভাবে আবৃত্তি করে, আমিও ঠিক সেইভাবে বলি - "হলুদ বনে বনে নাক-ছাবিটি হারিয়ে গেছে, সুখ নেইকো মনে -"
অপু দুর্গা কে দেখে, ওদের কথা পড়ে নিজের ছেলেবেলার কথা মনে হয়। আম, জাম, গাব, আমড়া- তলা থেকে এইসব কুড়িয়ে এনে মা এর সামনে হাজির হতাম। যেখানে যতো লতাপাতা, শাক-পাতা পেতাম, সব নিয়ে এসে নানাবাড়ি ভর্তি করতাম।
অপু দুর্গা অল্পতেই খুশি হয় কিন্তু সেই অল্পটুকু পেতেও ওদের কত বেগ পোহাতে হয়। আর এ ভারী কষ্টের। তবু বইয়ের পাতায় পড়া অল্পতেই খুশি হয়ে যাওয়া দুর্গার ঠোঁটের কিনারায় লেগে থাকা হাসি যেনো আমি চোখের সামনে দেখতে পাই। আর অপুর দিদি দিদি ডাকখানাও যেন স্পষ্ট শুনতে পাই। বইয়ের জগতে সবকিছুই কি ভীষণ অদ্ভুত! কত অভিজ্ঞতা ই না হলো!
অপু, দুর্গা, ইন্দির ঠাকুরন - এরা সবাই খুব আপন। এদেরকে ভালোবাসি। মন খারাপের দিনগুলোতে এদেরকে মনে করি।
অপু নিশ্চিন্দিপুর ফিরিতে হয়তো পারেনি, কিংবা আর পারিবে না, কিন্তু তার সামনে চলার পথে তার সাথে থাকতে এবং তার দুঃখে কাঁদতে আমি রাজি।
'পথের পাঁচালী' পড়ে যে কান্না - সেই কান্না অনেক রকমের। কখনো শূন্যতার, কখনো আনন্দের, কখনো শান্তি ও স্বস্তির, কিংবা কখনো প্রচন্ড বিষাদের।
আমি বইটা যখন পড়া শুরু করলাম তখন আমি জানতাম না দুর্গা মারা যাবে।বাপ্পি ভাই আমাকে বললো দুর্গা মারা যাবে।তখন বইটা অনেকটা পড়া হয়ে গেছে।
দুর্গা আজকাল যেন এ গাছপালা, পথঘাট এই অতি পরিচিত গ্রামের প্রতি অত্যন্ত বেশি করে আঁকড়িয়ে ধরিতেছে। আসন্ন বিরহের কোন বিষাদে এই কত প্রিয় গাবতলা পথটি, ওই তাহাদের বাড়ির পিছনের বাঁশবন, ছায়া ভরা নদীর ঘাটতি আচ্ছন্ন থাকে। তাহার অপু,, তাহার সোনার খোকা ভাইটি, যাহাকে একবেলা না দেখিয়া থাকিতে পারে না, মন হুহু করে,, সে কতদূর যাইবে আর যদি না ফেরে নিতম পিসির মতো,,,,,তাহারও যদি ওই রকম হয়, বাবাকে মাকে অপুকে ছাড়িয়া। আর কক্ষনো দেখা হইবে না কক্ষনো না, কক্ষনো না। ভাবিলেই গা শিহরিয়ে উঠে থাকগে দরকার নাই। কি জানি আজকাল তার মনে হয় তাহার জীবনে কিছু একটা ঘটিবে খুব শীঘ্রই। তাহার জীবনে কি একটা আসিতেছে যাহা আর কখনো আসে নাই। দিনরাত খেলাধুলা কাজ কর্মের ফাঁকে তাহার প্রায়ই মনে হয় কি যেন আসিতেছে খুব শীঘ্রই আসিতেছে আসিতেছে। এই জায়গাটা পড়ে সত্যি এতটা কেমন করে উঠেছিল। অপু সেরে উঠলে আমাকে একদিন রেলগাড়ি দেখাবি। কথাটা মনে পড়লেই কেমন লাগে। অবশেষে দুর্গার আর রেলগাড়ি দেখা হলো না।
ইহা কোনো রিভিউ নয়। বই ও সিনেমা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা। পথের পাঁচালী পড়ার আগেই অধিকাংশ পাঠক/পাঠিকা সত্যজিৎ রায় নির্মিত সিনেমাটা দেখে থাকেন। এটা ঠিক যে উপন্যাস নিয়ে সত্যজিৎ যে দৃশ্যায়ন করেছেন এবং গল্প বুনেছেন তার একটা ধরণ আছে। তবে বই পড়লে যে ধরণের কল্পনার অভিজ্ঞতা হয় সেটা সিনেমা দেখলে একটা নির্দিষ্ট ইমেজের মধ্যে, দৃশ্যের মধ্যে ধরা পড়ে বলে বই পড়া আর সিনেমা দেখা আলাদা ব্যাপারে দাঁড়ায়। সাধারণত মানুষ তার পরিমন্ডল বা দেখা পরিবেশ থেকে ইমেজ আর চরিত্র কল্পনা করে থাকে। পথের পাঁচালীর অপু আর দুর্গার কাশবনের পাশে দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখার দৃশ্যটা না দেখলে পাঠক/পাঠিকা তার মনের গভীরে কোন কাশবনের দৃশ্য মনে করার চেষ্টা করে থাকতে পারেন বা যদি কাশবন দেখার কোন স্মৃতি না থাকে তবে হয়ত দেখতে বের হতে পারেন বা এখনকার যুগে অন্তর্জালে খুঁজতে পারেন। আর যারা আগে পড়ে থাকেন তারা পড়ার সময় যে গাছপালার বর্ণনা পান সেটা সিনেমায় নাম ধরে দেখানো যায় না তাই বই পড়া অন্য এক দৃশ্যপট সৃষ্টি করে। মূল ঘটনাপ্রবাহ দেখানোর জন্য জীবন এবং জীবন্তকে বইয়ের অনুরূপ দেখাবার ক্ষেত্রে পথের পাঁচালী পড়ায় ও দেখায় দুইটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয় বলে উপন্যাস ও সিনেমা দুই ক্ষেত্রেই চলেছে। এমন যে সমস্ত গল্পগুলো সাহিত্যে লেখা হয় এবং তা নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমা হয় প্রত্যেকটাই পড়া আর দেখার মধ্যে একটা আলাদা অভিজ্ঞতা ও অবস্থান সৃষ্টি করে থাকে। যেমন হ্যারি পটার মুভি পড়ার আগে দেখার ফলে পড়তে গিয়ে পর্দার হ্যারিকে ভেবেই পড়ে ফেলেছি এবং তার জন্য বেশি বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ধরুন কেউ একজন কোন সিনেমা না দেখে শুধু পড়ে থাকলে তার কল্পনায় হ্যারির অবয়ব, অন্যান্য চরিত্র ও এই গল্পের জগতের ধারণা প্রত্যেক মানুষের আলাদা হবার কথা। আর আলাদা মানুষের কল্পনার ধারণা জানতে পারলে জানা যাবে একই গল্পের কল্পনা ও দৃশ্যের বিসাদৃশ্য কেমন হয়। সিনেমার গল্প, দৃশ্য ও চরিত্রে তাই পাঠক/পাঠিকা তার নিজস্ব কল্পনার বদলে সৃষ্ট দৃশ্য দেখার একটি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
সন্তানের সাথে মায়ের আজীবন যেমন থাকে অদৃশ্য নাড়ীর টান, পথের পাঁচালী তেমনি আবহমান বাংলার সাথে আমাদের সেই নাড়ীর টানের যোগাযোগ। আমি বিশ্বাস করি, বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখে এই সাহিত্যরত্নটি। আফসোস, সাহিত্যে সর্বোচ্চ স্বীকৃতির দাবিদার অথচ এখনো তার গন্ডি বাংলাভাষী মানচিত্র পেরোয়নি। বিশ্বমঞ্চে পথের পাঁচালীকে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য সত্যজিৎ রায়কে সেলাম। কিন্তু কজনই বা সেখান থেকেও কৌতুহলী হন মূল রচনা চেখে দেখবার - প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্বায়নের এইযুগে ব্যাপারটি মেনে নিতে পারি না।
বর্ষীয়সী ইন্দির ঠাকরুনের কিছুটা সম্মান নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর লড়াই কিংবা উদাসী শিল্পীর বেখেয়ালী তুলিতে রূপ নেওয়া ছটফটে দূর্গার সিন্ধুবিন্দু আনন্দ প্রয়াস - সবই তো খুব আপন আর ভীষণ নিজস্ব গল্প আমাদের। শিল্পী যখন দূর্গার ক্যানভাস মুড়িয়ে দূরে ফেলে দেয়, আর ফিরেও চায় না তাতে। কিন্তু পাঠক কী এক আঁতিপাঁতি আশায় হাহাকার করতে করতে সেই ক্যানভাস হাঁচড়ে পাঁচড়ে খুঁজে বেড়ায়! শিল্পী তখন ব্যস্ত মিষ্টি ছেলে অপুর অবয়ব নির্মাণে - আবহমানকালের সর্বজয়া-হরিহরদের আগ্রহ যেখানটায়। দূর্গাকে মনে রাখেই বা কে?
দূর্গাদি, আসছে সময় তোমাকে ঠিক রেলগাড়ী দেখাবো, তোমার অসুখ সারিয়ে তুলবো, কষ্ট পেতে দিবো না কখখনো। বটবৃক্ষের ছায়া না পেলে রোদে যে চোখ তেতে যায় তা তুমি জানো না?