What do you think?
Rate this book


85 pages, Kindle Edition
First published December 1, 1939
"জ্যোৎস্না আরো ফুটিয়াছে, নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নালোকে প্রায় অদৃশ্য, চারিধারে চাহিয়া মনে হয় এ সে পৃথিবী নয় এতদিন যাহাকে জানিতাম, এ স্বপ্নভূমি, এই দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখানে নামে গভীর রাত্রে, তারা তপস্যার বস্তু, কল্পনা ও স্বপ্নের বস্তু, বনের ফুল যারা ভালোবাসে না, সুন্দরকে চেনে না, দিগ্বলয়রেখা যাদের কখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে নাই, তাদের কাছে এই পৃথিবী ধরা দেয় না কোনো কালেই৷"

"একটা কণ্টকময় গাছে বেগুনী রঙের ঝাড় ঝাড় ফুল ফুটিয়াছে, বিলাতী কর্ণফ্লাওয়ার ফুলের মত দেখিতে। একটা ফুলের বিশেষ কোনো শোভা নাই। অজস্র ফুল একত্র দলবদ্ধ হইয়া অনেকখানি জায়গা জুড়িয়া দেখাইতেছে ঠিক বেগুনী রঙের একখানি শাড়ীর মত। বাতাবী লেবুর ফুল নয়, ঘেঁটুফুল নয়, আম্রমুকুল নয়, কামিনীফুল নয়, রক্তপলাশ বা শিমুল নয়, কি একটা নামগোত্রহীন রূপহীন নগন্য জংলী কাঁটা গাছের ফুল। আমার কাছে তাহাই কাননভরা বনভরা বসন্তের কুসুমরাজির প্রতীক হইয়া দেখা দিল। "মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মতো ঘরে পড়ে থেকে অদ্ভুত মায়াময় দৃশ্যের জন্য হাহাকার করা মানুষদের জন্যই বিভূতিবাবু এসেছিলেন।
কদিন আগে বিভূতিবাবুর সুন্দরবনে সাত বৎসর পড়ে হ্যাংরি অবস্থায় রিভিউ দেওয়ার মতো ভুল এবার আর করছি না! :')
তবে একখানা জীবনশিক্ষা এই ঘটনা থেকে আমি পেয়েছি। লকডাউনে ঘরবন্দী হয়ে বিভূতিবাবুর লেখা পড়ার সুদিক-মূলধনদিক দুইটাই আছে! পড়তে নিলে আত্মা যেভাবে বন-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়িয়ে আসে, ঠিক তেমনি ভাবে অপারগ শরীরটার মাঝে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। শেষতক দুয়ে মিলেমিশে হতাশা-আক্ষেপ আর বিরক্তি মিলে তৎক্ষণাৎ অনুভূতির যে প্রলয়ঙ্কারী স্রোত তৈরী হয়, সে স্রোতে গা ভাসিয়ে রিভিউ লিখতে যাওয়াটা মোটেও উচিৎ নয়। আমার জন্য অন্তত! ��াই হোক।
দ্যা অফিস দেখেছেন? দেখে থাকলে টোবি ফ্ল্যান্ডারসনের কথা মনে আছে? ঐযে এইচআরের দায়িত্বে থাকা লোকটা, দেখলেই ঘুম-ঘুম লাগে, জীবনে যার একটামাত্রই উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল—দ্যা স্ট্র্যাঙলার-এর বিচারের ট্রায়ালে থাকা! না দেখে থাকলেও এইযে এই দফায় জেনে গেলেন। আমার জীবনও আসলে এমনই। জীবনে ‚ট্যুর’ দিয়েছিলাম একটাই, আর সেই একখান ট্যুরের গল্প ভেঙেই যে বাকি জীবন পার করে দিতে হবে এই ব্যাপারেও আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তো সেই ট্যুরের সুবাদেই গিয়েছিলাম কাপ্তাই হ্রদ ভ্রমণে। নৌকা ছাড়ামাত্র সামনের দিকের একটা পাটাতনে গিয়ে আস্তানা গেঁড়ে ফেলি। পাদুটো পানিতে নামিয়ে দিয়ে সকাল বেলার উঠতি রোদের নিচে বসে, হ্রদের বাতাস খেতে খেতে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর পানির গভীরতা বাড়তে থাকে, ফ্যানাওঠা পানি পরিষ্কার হয়ে আসে, নৌকাটা আরেকটুখানি বেশি ডুবে যায়, সাথে আমারও পাদুটোও আরেকটু ভালোমতো ভেজার সুযোগ পায়। জীবনের অন্যতম সুন্দর একটা সকাল উপভোগ করছিলাম। চারদিকে পানি, থেকে থেকে পাহাড় দেখা যাচ্ছে দূরে। আশেপাশে থেকে ভেসে আসছে পানি-কেটে নৌকা চলার শব্দ, বাতাসের শব্দ, পাখি ওড়ার শব্দ! সকাল ক্ষয়ে যাচ্ছে আসন্ন দুপুর-রোদের তেজে। সেসব নিয়ে আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মনের আনন্দে বাতাসের সাথে নিজেদের বেসুরো কণ্ঠস্বরে গাওয়া গান ভাসিয়ে দিচ্ছি! আহা! কী সুন্দর একটা দিন! কিন্তু সুখ বরাবরের মতোই খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কোথা থেকে আরেকটা নৌকা আমাদের সাথ ধরে ফেললো। সেখানে থেকে ভেসে আসা ভারতীয় সিনেমার উদ্ভট-উদ্ভট আইটেম গানের জোরে মনে হলো বাতাসও জায়গাটা থেকে পালিয়ে গেল। কোথায় আমার বাতাসের সুর, কোথায় আমার জলতরঙ্গের ছন্দ আর কোথায় আমার অরণ্যানীর নির্মলতা! তারপর যেয়ে শুভলং ঝর্ণায় নামার পরের বর্ণনা আশা করি ও জায়গায় গত কয়েক বছরের মধ্যে যাওয়া কোনো মানুষকে বলতে হবে না! যেজন্যে এত কথা—সেই সময়ে বিভূতিবাবুও ঠিক এমন কিছুই উপলব্ধি করেছেন।
‟কিন্তু প্রকৃতির এই অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্যময় রাজ্যে দৈবাৎ যদি আসিয়াই পড়িয়াছে, দেখিবার চোখ নাই আদৌ।„
আরণ্যক আসলে কোনো বই নয়—এটা পুরোটাই একটা অভিজ্ঞতা, একটা জার্নি, একটা অনুভূতি! বইতে দেশের নৈসর্গিক যে সৌন্দর্যের বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, তাতে করে মাঝেমধ্যে মনে হয়, এ কি আসলেই আমাদের উপমহাদেশ? কখনো মনে হয় এসবের সাথে আমাদের চেনা পৃথিবীর কোনো যোগ নেই; এ অন্য কোনো পৃথিবী, অন্য কোনো জগৎ! কিংবা আমার দেখা জগতটা বড্ড বেশি ছোটো তাই! কোনোদিন আমার এসব কথা শুনে কেউ হয়তো বলেও বসবে—
“ভানুমতীর পৃথিবী কতটুকু জানিতে বড় ইচ্ছা হইল।”
“মাইলের পর মাইল ব্যাপিয়া কাশ ও ঝাউবন বর্ষার জলে ভিজিতেছে, আমার আপিসঘরের বারান্দায় চেয়ার পাতিয়া বসিয়া দেখিতাম, আমার সামনে কাশবনের মধ্যে একটা বনঝাউয়ের ডালে একটা সঙ্গীহারা ঘুঘু বসিয়া অঝোরে ভিজিতেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একভাবেই বসিয়া আছে-মাঝে মাঝে পালক উষ্কখুষ্ক করিয়া ঝুলাইয়া বৃষ্টির জল আটকাইবার চেষ্টা করে, কখনো এমনিই বসিয়া থাকে।
এমন দিনে আপিসঘরে বসিয়া দিন কাটানো আমার পক্ষে কিন্তু অসম্ভব হইয়া উঠিত। ঘোড়ায় জিন কষিয়া বর্ষাতি চাপাইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম। সে কি মুক্তি! কি উদ্দাম জীবনানন্দ! আর, কি অপরূপ সবুজের সমুদ্র চারিদিকে-বর্ষার জলে নবীন, সতেজ, ঘনসবুজ কাশের বন গজাইয়া উঠিয়াছে-যতদূর দৃষ্টি চলে, এদিকে নাঢ়া-বইহারের সীমানা ওদিকে মোহনপুরা অরণ্যের অস্পষ্ট নীল সীমারেখা পর্যন্ত বিস্তৃত থৈ থৈ করিতেছে-এই সবুজের সমুদ্র-বর্ষাসজল হাওয়ায় মেঘকজ্জল আকাশের নিচে এই দীর্ঘ মরকতশ্যাম তৃণভূমির মাথায় ঢেউ খেলিয়া যাইতেছে-আমি যেন একা এ অকূল সমুদ্রের নাবিক-কোন্ রহস্যময় স্বপ্নবন্দরের উদ্দেশে পাড়ি দিয়াছি।
এই বিস্তৃত মেঘচ্ছায়াশ্যামল মুক্ত তৃণভূমির মধ্যে ঘোড়া ছুটাইয়া মাইলের পর মাইল যাইতাম-কখনো সরস্বতীকুণ্ডীর বনের মধ্যে ঢুকিয়া দেখিয়াছি-প্রকৃতির এই অপূর্ব নিভৃত সৌন্দর্যভূমি যুগলপ্রসাদের স্বহস্তে রোপিত নানাজাতীয় বন্য ফুলে ও লতায় সজ্জিত হইয়া আরো সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে। সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে সরস্বতী হ্রদ ও তাহার তীরবর্তী বনানীর মতো সৌন্দর্যভূমি খুব বেশি নাই-এ নিঃসন্দেহে বলতে পারি। হ্রদের ধারে রেড ক্যাম্পিয়নের মেলা বসিয়াছে এই বর্ষাকালে-হ্রদের জলের ধারের নিকট। জলজ ওয়াটারক্রোফটের বড় বড় নীলাভ সাদা ফুলে ভরিয়া আছে। যুগলপ্রসাদ সেদিনও কি একটা বন্যলতা আনিয়া লাগাইয়া গিয়াছে জানি। সে আজমাবাদ কাছারিতে মুহুরীর কাজ করে বটে, কিন্তু তাহার মন পড়িয়া থাকে সরস্বতী কুণ্ডীর তীরবর্তী লতাবিতানে ও বন্যপুষ্পের কুঞ্জে।”
নৈসর্গ তাকে নিজস্বরূপ নিয়ে ভাবায়, জীববৈচিত্র নিয়ে ভাবায়, মানসপটের অন্ধকারাচ্ছন্ন কোটর থেকে ঘুরিয়ে আনে।
“মানুষে কি চায়- উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? আমি এমন কত লোকের কথা জানি, যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে। অতিরিক্ত ভোগে মনোবৃত্তির ধার ক্ষইয়া ক্ষইয়া ভোঁতা- এখন আর কিছুতেই তেমন আনন্দ পায় না, জীবন তাহাদের নিকট একঘেয়ে, একরঙা, অর্থহীন। মন শান-বাঁধানো-রস ঢুকিতে পায় না।”
“যেন এই নিস্তব্ধ, নির্জন রাত্রে দেবতারা নক্ষত্ররাজির মধ্যে সৃষ্টির কল্পনায় বিভোর, যে কল্পনায় দূর ভবিষ্যতে নব নব বিশ্বের আবির্ভাব, নব নব সৌন্দর্যের জন্ম, নানা নব প্রাণের বিকাশ বীজরূপে নিহিত। শুধু যে-আত্মা নিরলস অবকাশ যাপন করে জ্ঞানের আকুল পিপাসায়, যার প্রাণ বিশ্বের বিরাটত্ব ও ক্ষুদ্রত্বের সম্বন্ধে সচেতন আনন্দে উল্লসিত-জন্মজন্মান্তরের পথ বাহিয়া দূর যাত্রার আশায় যার ক্ষুদ্র তুচ্ছ বর্তমানের দুঃখ-শোক বিন্দুবৎ মিলাইয়া গিয়াছে…সে-ই তাঁদের সে রহস্যরূপ দেখিতে পায়। নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ…
এভারেস্ট শিখরে উঠিয়া যাহারা তুষারপ্রবাহে ও ঝঞ্ঝায় প্রাণ দিয়াছিল, তাহারা বিশ্বদেবতার এই বিরাট রূপকে প্রত্যক্ষ করিয়াছে…কিংবা কলম্বাস যখন আজোরেস্ দ্বীপের উপকূলে দিনের পর দিন সমুদ্রবাহিত কাষ্ঠখণ্ডে মহাসমুদ্রপারের অজানা মহাদেশের বার্তা জানিতে চাহিয়াছিলেন-তখন বিশ্বের এই লীলাশক্তি তাঁর কাছে ধরা দিয়াছিল-ঘরে বসিয়া তামাক টানিয়া প্রতিবেশীর কন্যার বিবাহ ও ধোপা-নাপিত করিয়া যাহারা আসিতেছে-তাহাদের কর্ম নয় ইহার স্বরূপ হৃদয়ঙ্গম করা।”
মানুষের প্রকৃতির প্রতি করা অন্যায় আর ধ্বংসযজ্ঞের হতাশাময় আখ্যানের বিপরীতে বিভূতিবাবু তার স্বভাবসুলভ আশার ছোঁয়াও রেখেছেন। যুগলপ্রসাদ চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমরা তবু একটুখানি আশা খুঁজে নিতে পারি। ধ্বংসলীলার মধ্যেও কেউ না কেউ রক্ষাকর্তাও থাকবে নিশ্চয়!
“এই জন্মান্ধ মানুষের দেশে একজন যুগলপ্রসাদ কি করিয়া জন্মিয়াছিল জানি না—শুধু তাহারই মুখের দিকে চাহিয়া আজও সরস্বতী হ্রদের তীরবর্তী বনানী অক্ষুন্ন রাখিয়াছি।”
যা দেখছি এ উপন্যাস নিয়ে বলতে গেলে রাত শেষ করে ভোর করে ফেলবো আমি! অথচ কতজনের কথাই তো বাদ পড়ে গেল! ভানুমতী আর তার পাহাড়ি রাজত্ব, অভাগিনী মঞ্চী আর তার হিংলাজের মালাছড়া, দুঃখিনী বাঙালিবধূ কুন্তার জীবন সংগ্রাম, রাজু পাঁড়ের অনাড়ম্বর প্রেমকাহিনি, মটুকনাথ আর তার টোল, শ্বাপদসংকুল মাঠের মাঝে নকছেদীর নতুন সংসার, নাচুনে ধাতুরিয়া আর তার শিল্পানুরাগ, ধাওতাল সাহু মহাজন আর তার অগাধ বিশ্বাস, সুরতিয়া আর তার গুড়গুড়ি, গীরিধারিলালসহ আরো কতজনের গল্পই তো ছাড়া পড়ে গেল! সে থাক। সেসব বলতে নিলে দেবতা টাঁড়বারো এসে আমায় হাত দেখিয়ে থামতে বলবে নির্ঘাত!
বইটার অনেক অনেক অনেক ভালো রিভিউ আছে। রিভিউ লিখতেও চাইনি। কিছু আবেগ মস্তিষ্কের অদৃশ্য কালির পরিবর্তে দৃশ্যমান হরফে দেখার ইচ্ছে হলো বলেই এত কথা লিখলাম। বইটা শেষ হওয়ার পর আমারও উদাস লেগেছে খুব। মনে হয়েছে প্রকৃতির সংস্পর্শে আবেগতাড়িত হয়ে ভানুমতির মতো হয়তো আমিও কোনোদিন বলে ফেলবো—
“বাবুজী, কল্কাতা থেকে আমার জন্যে একখানা আয়না এনে দেবেন? আমার আয়না একখানা ছিল, অনেক দিন ভেঙ্গে গিয়েছে।”