Nastik Panditer Bhita A book of Novel in Bengali By Sanmatrananda
প্রচ্ছদ – সৌজন্য চক্রবর্তী
‘অতীশ দীপংকরের জীবনের উপর রচিত বাংলাভাষার প্রথম প্রামাণ্য উপন্যাস। হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে আজকের পৃথিবীও জড়িয়ে আছে এ উপন্যাসের আখ্যানভাগে। সময়ের গলিপথে বিভিন্নযুগের চরিত্রদের সাক্ষাৎ হয়েছে আলোয়াঁধারিময় পরিবেশে – অতীশের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন তিব্বতি চাগ্ লোচাবা, আটশো বছর আগেকার রহস্যময়ী কুলবধূ স্বয়ংবিদা, আজকের বাংলাদেশের কৃষক অনঙ্গ দাস ও তাঁর মেয়ে জাহ্নবী, শহর কলকাতার অনুসন্ধিৎসু যুবক অমিতায়ুধ এবং উপন্যাসের কল্পিত লেখক শাওন। তিন যুগের তিন নারীর প্রণয়কথার অনুষঙ্গে এ উপন্যাস এক অনন্য অতীশ-অনুসন্ধানের ইতিবৃত্ত।‘ ‘যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস, নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ...তখন, কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব’-এই কথা বলে হাজার বছর আগে এক নারী ডুব দিল মৃত্যুর নিঃসীম অন্ধকারে। অন্তিম সেই উচ্চারণের অর্থ খুঁজতে গিয়ে চন্দ্রগর্ভ হয়ে উঠলেন অতীশ, তিব্বতি পর্যটক চাগ্ লোচাবা আহিত হলেন আটশো বছর আগেকার কোনো এক বাঙালি কুলবধূর পিপাসার্ত হৃদয়বিদ্যুতে, আর অধুনাতন কালে এক কৃষককন্যার মধ্যে সেসব কথাই গান হয়ে ফিরে আসতে দেখল অমিতায়ুধ। মৃন্ময়ী প্রতিমা, দারুমূর্তি আর ধাতব আইকন খুলে ধরেছে অতীশ-চরিতের বহুবিধ বাতায়ন; তবু শেষ পর্যন্ত কাঠ, পাথর বা ধাতু নয়, দীপংকর এক রক্তমাংসের মানুষ, এক বাৎসল্যকরুণ হৃদয়, জীবনব্যাপী অন্বেষার এক ধ্রুব অর্থ। আর সেই বিশিষ্ট অর্থে প্রত্যেকেই আমরা অতীশ, প্রত্যেকেই দীপংকর।
এই সময়, যখন প্রতি দশ মিনিটে একবার করে স্ট্যাটাস দেখাতে এবং নোটিফিকেশন চেক করতে হয়, তখন সাড়ে তিনশোরও বেশি পাতার একটা উপন্যাস আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে গেল শুরু থেকে শেষ অবধি। মাঝে দিন ফুরোল, রাত নামল, তুমুল ঝড় আর বৃষ্টি লণ্ডভণ্ড করে দিল ঘর ও বাহির, নিমন্ত্রণ রক্ষা করলাম, অফিসে গেলাম, সিনেমা দেখলাম,... কিন্তু দশম-একাদশ শতকে বজ্রযোগিনী গ্রাম থেকে নেপাল হয়ে তিব্বতের সুদূর প্রান্তদেশ, ত্রয়োদশ শতকে নালন্দা আর বিক্রমণিপুর, শেষে একবিংশ শতকের বাংলাদেশে এক বিস্মৃতপ্রায় গ্রাম, এইসব স্থান ও কালের বাসিন্দা মানুষেরা, তাদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-হতাশা, আমার সঙ্গে থেকে প্রহরজোড়া ত্রিতাল বাজিয়ে গেল অনবরত। কীভাবে সম্ভব হল এটি? অতীত, বর্তমান, ও ভবিষ্যতের এক অদ্ভুত মিশ্রণে নির্মিত এই উপন্যাস আসলে এক কালাধার, যাতে প্রতিফলিত হয়েছে যুগ-যুগান্তের সাধনা, অভীষ্ট অর্জনের তাগিদে ত্যাগ ও কৃচ্ছ্রসাধনার ইতিবৃত্ত, এবং এক চির-অপূর্ণ প্রেমের পূর্ণতার আশায় অনন্তযাত্রা। কতটা বুঝলাম এই কাহিনির? রহস্য-রোমাঞ্চের পেছনে ছুটে বেড়ানো মগজ কি সত্যিই তল পেল এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের? প্রথমবার "দেবযান" পড়তে গিয়ে যেমন মনে হয়েছিল, অদ্ভুত সুন্দর কোনো নকশা দেখছি মানসচক্ষে, যার অর্থ বুঝতে পারছি না, তেমন করেই এই উপন্যাসের গভীরে লুকিয়ে থাকা সংকেতটির অর্থ কি রয়ে গেল আমার নাগালের বাইরেই? "যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস, নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ... তখন, কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব।" হাজার বছর আগে এই কথা বলে এক নারী ডুব দিয়েছিল মৃত্যুর গভীরে। গোটা উপন্যাস জুড়ে তার এই কথার অর্থের অন্বেষণ চলেছে। অর্থ খুঁজেছে চরিত্ররা... আমিও। কিন্তু উপন্যাসের শেষে গিয়েও আমি কি তার কথার অর্থ খুঁজে পেলাম? জানি না। হয়তো সময়ে জানব। হয়তো কোনো একদিন অন্ধকার মনে নিবাত নিষ্কম্প শিখার মতো জ্বলে উঠবে সত্য, আর অতীশ, লোচাবা, বা অমিতায়ুধের মতো আমিও উপলব্ধি করব এই প্রহেলিকার অর্থ। কিন্তু ততদিন অবধি, এমনকি তার পরেও আমি এই বইকে পুঁথির মতো যত্নে রেখে দেব আমার কাছে। অযাচিত অশ্রু ডেকে আনা, অভাবিত দর্শনে মনকে প্লাবিত করা এমন বইয়ের কথা ভেবেই হয়তো শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, "চুপ করো, শব্দহীন হও। লেখো আয়ু।" এমন লেখা আমি এই জন্মে লিখতে পারব না। কিন্তু যিনি লিখেছেন তাঁকে প্রণাম জানিয়ে অন্য পাঠকদের আহ্বান জানাতে পারব, যাতে তাঁরা এই অতুল সৃষ্টির রসাস্বাদন থেকে নিজেদের বঞ্চিত না করেন। বইটা দয়া করে পড়ুন। সত্যি বলছি, এমন এক-আধটা বই পড়ার জন্যই বেঁচে থাকা যায়।
একদল তিমি তীরের দিকে তেড়ে আসলো, আরেকদল মানুষ সমুদ্রের দিকে ধেয়ে গেলো, তিমিরা আলোবাতাসের শুকনায় ধুকে মরলো, মানুষেরা টলটলে হা করা পানিতে ঢুবে গেলো। এইভাবে তীর পেলো কিছু মায়াবি বিশাল তিমি আর সাগর পেলো কিছু অসহায় ক্ষুদ্র মানুষ।
বলতে গেলে যাপিত জীবনের কমবেশি সব কিছুই ঘোলা হয়ে গেছে। এইভাবেই সাগরের দিকে যেতে হয়? মানুষের জীবনে ডুবে গেলে কি সাগরের পানিতে ভেসে থাকা যায়? আমি কি আদও সাঁতার না শিখেই সাঁতার কেটে বেড়াবো?
অতীত জীবনে অনেক কাজের মধ্যে সময় করে বেশ বই পড়া হতো আমার। তেরো বছর বয়সে, প্রথম নাম শুনি, অতীশ দীপঙ্কর। ঋষি, সাধক, মহাত্মা, চিন্তক আবার নাস্তিকও বটে। আমার পড়ার গণ্ডিরে বাইরে, এমন একজন মানুষের সন্ধান পাওয়াটা কিছুটা বিস্ময়ের ছিল বটে। এটা সেটা পড়তে পড়তে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে, চুল সাদা হয়ে গেছে, চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে, অবশ্য সেটা হওয়াটায় স্বাভাবিক। মানুষ পরিবর্তনশীল, আবার কবির ভাষায়, 'মানুষ কারণে-অকারণে বদলায়'। আমি এই সময়ে অনেকটাই বদলে গেছি। এই চিরায়ত পরিবর্তনের মাঝে আবার সেই পণ্ডিতকে খুঁজে পাই। আমি যেন জীবন শৈবালের আড়ালে আবার তাকে ফিরে পাই৷
হয়ত বাইরে থেকে জীবন বেশ গোছানো-ছিমছাম লাগে। কিন্তু বাবুমশাই, জীবন বড্ড ঘোলা হয়ে গেছে, বড় হওয়ার পরিবর্তে। মাটিতে ডুবে গেছে আমার সুখস্মৃতি; যাকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম আমার পাশে। আমার কাছে রয়ে গেছে তার অদ্ভুত এক গুচ্ছ অনুভবের সাগর।
মাটি থেকে পানি আর পানি থেকে মাটির এই আসা-যাওয়ার মাঝে আমি কি কোন দিন সত্যিকারের নির্বাণ লাভ করতে পারবো? সব বই এর রিভিউ দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার নাই, হবেও না, চাই ও না। কথাবার্তা সব ঠিকানাবিহীন হয়ে গেছে। কথাবার্তা সব ফুরায় গেছে, ক্ষমা করবেন।
বজ্রযোগিনী গ্রামের এক কৃষক মাঠে কাজ করতে গিয়ে একটি কাঠের বাক্স খুঁজে পান । সেই বাক্সের ভেতরে পাওয়া যায় একটি পুঁথি , একটি তাম্র মূর্তি আর একটি মালা । এরপর থেকেই শুরু হয় সময় ভ্রমণ । একটি বিশাল যাত্রায় আপনি কখনো অতীত ছিলেন কখনো বর্তমানে আছেন কিংবা কখনো ভবিষ্যতে থাকবেন ...... পড়তে পড়তে এমন অবাক করা ভ্রমণ খুব কম করার সৌভাগ্য হয়েছে । বইটিতে মূলত অতীশ দিপংকরকে নিয়েই যে তা কিন্তু বলা যাবে না । আরো বেশ কয়েকজন মানুষের কথাও সাথে জড়িত ছিলো । প্রচুর তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে । আর গল্প বলার ভাষা অত্যন্ত সুমধুর । লেখকের দর্শনের কচকচানি মোটেও বিরক্তিকর মনে হয় নি । সবচাইতে যেটি উপভোগ্য ছিলো সবকিছুর সাথে সময়ের প্রচ্ছন্ন একটা যোগাযোগ থাকার বিষয়টাকে বারবার প্রমাণ করে দেওয়া অতীত , বর্তমান , ভবিষ্যৎ একই সমতলে অঙ্কিত পরস্পরচ্ছেদী তিনটি বৃত্তের মতো । তাদের ছেদবিন্দু দিয়ে একসময় হতে অন্য সময়ের দিকেই মানবের যাত্রাপথ অতীশ দিপংকর কোথায় জন্মেছিলেন , কেমন ছিলো তার শৈশব ,কিভাবে তিনি নাস্তিক হলেন ইত্যাদি সিত্যাদি সব ই গল্পের ছলে লেখা এই উপন্যাসে এতো সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে পাঠককে পড়ার মাঝখানেও থামিয়ে দু দণ্ড ভাবাতে বাধ্য করে। মোট কথা বইটির জন্য দুই বছরের অপেক্ষা আমার সার্থক । পরামর্শ যদি চান তাহলে বলবো বইটি চেষ্টা করবেন এক বসায় পড়তে (হ আমি এক বছর ধরে বসেই ছিলাম ) আর পড়ার সময় হাতের কাছে চলন্তিকা রাখবেন। এতে এর বাস্তবিক স্বাদ টা পুরোপুরি পাবেন । একটা সিক্রেট বলি- এই বইয়ের মধ্যে এক মহিলা একজন লামা রে শুধুমাত্র চুম্বনের মাধ্যমে দুইশো বছর অতীতে পাঠাইয়া দেয় । কি একটা বিব্রতকর অবস্থা তাই না ! এই তথ্য পড়ার পর আমি মানে একদিন আর অন্য কোন কাজ ঠিক মতো করতে পারি নাই । আমার একটু পর পর মনে হচ্ছিলো লোকজন ওষ্ঠে টাইম মেশিন নিয়া কিভাবে ঘুরে হে ! তা যাই হোক মানুষ ওষ্ঠে লিপস্টিক দিক , লিপজেল দিক কিংবা টাইম মেশিন দিক ক্ষতি নেই এই বছরে পড়া শ্রেষ্ঠ বইগুলোর তালিকায় নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটাকে নিশ্চয় রাখা যেতে পারে ।
সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যাওয়া একটা বই। অতীশ দীপংকর শুধু কালোত্তীর্ণ অনন্যসাধারণ মেধাবী ও মহাজ্ঞানী একজন মানুষই শুধু না, অতীশ দীপংকর এক শক্তি যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় তিন ভিন্ন সময়ের মানুষেরা।
“শৈলোপরি রূপমেকং দৃষ্টং ময়া। অন্যং রূপদ্বয়ং সূতিকাগৃহং নিকষা উপলব্ধব্যম্। বজ্ৰ-যো-গি-ন্যাং তয়োঃ সম্ভাবঃ ইতি।” “পাহাড়ের ওপর একটি রূপ আমি দেখেছি। বাকি দুটি রূপ সূতিকাগৃহের কাছে পাওয়া যাবে। বজ্রযোগিনী গ্রামে সেই রূপ দুটি আছে।”
'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' এক পুরানো ইতিহাস খুঁজে ফেরার প্রয়াস। ইতিহাসের কানাগলি ধরে মূল স্রোতধারাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, যেখানে স্রোত হলো বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত পণ্ডিত 'অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান'। রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই পণ্ডিতের পারিবারিক নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। তন্ত্র সাধনায় দীক্ষা লাভ করে নতুন পরিচয় হয় গুহ্যজ্ঞানবজ্র। তখনো শ্রমণ্য জীবন গ্রহণ করেননি, যখন শ্রমণ হলেন তখন তার নাম হলো দীপংকর শ্রীজ্ঞান আর হয়েছিল উপাধি অতীশ। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত গুরুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে অতীশ দীপংকর হয়ে উঠেছিলেন, একজন দক্ষ শিক্ষক, পণ্ডিত, লেখক, দার্শনিক, বিতার্কিক, বাগ্মী, ধর্মগুরু। বিক্রমশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োজিত থাকার পর বৌদ্ধ ধর্মের সঠিক প্রচার করার জন্য তিনি গমন করেন তিব্বত। সেখানে ব্রোন্ তেন পা হয়ে ওঠেন অতীশের প্রধান শিষ্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তিব্বতে কাটান। ধর্মের বিকাশ ও বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তক লেখায় তার জীবন অতিবাহিত করেন।
“যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস, নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ, পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে, আর পালতোলা নৌকা ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতোধারায়..... সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে— আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালা : তখন... কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব..."
এই বইয়ে অতীশের পাশাপাশি উঠে এসেছে তিনটি সময় রেখা। প্রথমটি অতীশের সময় কাল, দ্বিতীয়টি অতীশের মৃত্যুর দুশো বছর পরের সময়কাল এবং সব শেষে বর্তমান সময়। এই তিনটি সময় কালে অতীশের পাশাপাশি এই বইয়ের মূখ্য ভূমিকায় ছিলেন অতীশের সময়কালের দৈবারিক কন্যা কুন্তলা। জাতিস্মর এই নারীর প্রবল ব্যাক্তিত্ব চোখে লাগার মতো। ব্যাক্তি অতীশ দীপংকরকে জানার পাশাপাশি এই বইয়ে ফুটে উঠেছে তার জন্মস্থান বজ্রযোগিনী গ্রামের কথা(বর্তমানে মুন্সিগঞ্জে অবস্থিত)।
অতীশ দীপংকর আমাদের তৎকালীন সময়ের এমন একজন প্রতিনিধি যিনি তার সময়ের প্রাজ্ঞ একজন ব্যাক্তি। ভীষণ বাগ্মী এই মানুষটাকে তর্কশাস্ত্রে হারানো ছিল অসাধ্য প্রায়। তর্কের বিভিন্ন সময়ের রূঢ় এবং অপ্রচলিত মতবাদ প্রদানের জন্য তিনি নাস্তিক হিসেবে পরিচিতি পেলেও তার তীক্ষ্ণ তার্কিক এবং যৌক্তিক মতবাদের জন্য কেউ তার সামনে ধোপে টিকতো না। এর পর থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নাস্তিক পণ্ডিত। এবং তার জন্মস্থান চিহ্নিত হয় 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে।
লেখক ব্যাক্তি অতীশকে যেমন ধরতে চেয়েছেন তেমনই জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ, সুচতুর অতীশকেও ধরেছেন। তার পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন পৌরাণিক অথবা ঐতিহাসিক বইগুলো পড়ি তখন দেখা যায়, কেউ হয়তে কোন পুঁথি আবিষ্কার করলো। তারপরে তার পিছনে পড়ে যায় বিভিন্ন দুষ্টচক্র। উঠে পরে লাগে সেই পুঁথির জন্য। এই বইতে সেই বিষয়টা নাই। সহজে পুঁথি গবেষকদের হাতে যায়। তারা গবেষণা করেন। বিষয়টা ভালো লেগেছে। ঐতিহাসিক চরিত্র দীপংকরকে ধরার প্রয়াসে লেখক তিনটি সময়রেখাকে একসাথে সংযুক্ত করে দিয়েছেন। লেখক সন্মত্রানন্দের সাথে পরিচয় হল এই বইয়ের মাধ্যমে। তবে মনের মধ্যে একটা প্রশ্নের দ্বন্দ্ব রয়েই যাবে, 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' গল্পের উত্তম পুরুষ শাওন কিংবা লেখক সন্মত্রানন্দও কী একইসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছেন বইতে?
বইটি আমার ভালো লাগেনি। না লাগার কারণ বইটির বর্ননা, ভাষারীতি এবং কাহিনী বিন্যাস। অতীতের ঘটনা ও বর্তমানের ঘটনার ভাষারীতির বিরাট পার্থক্য। অতীতের ঘটনা বর্ননায় দূর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করে দশম-ত্রয়োদশ শতাব্দীর আমেজ আনতে চেয়েছেন লেখক কিন্তু আমি মনে করি লেখক ব্যর্থ হয়েছেন। তিনটি ভিন্ন সময়কে সমান্তরালে চালনা করতে গিয়েও লেখক সেটাকে ভজঘট করে ফেলেছেন।একজন স্বপ্ন দেখে অতীতে যাচ্ছেন, আরেকজন কল্পনাতেই আরেক সময়ে চলে যাচ্ছেন।কে কোথায় যাচ্ছে বুঝতে বেগ পেতে হয়েছে। ভালো যেটুকু লেগেছে সেটুকু হলো অমিয়াতুধ এবং জাহ্নবীর অংশুটুকু। অতীশ দীপঙ্করকে নিয়ে জানার জন্য এই বই পড়া উচিত নয়, যদিও এটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস।তবুও বইটিতে ইতিহাসের উপাদান আছে ব্যপকহারে। আগ্রহ নিয়ে পড়লেও শেষপর্যন্ত সেই আগ্রহ ছিল না। হ্যাপি রিডিং।
আসলে ইতিহাস বলতে আমরা কি বুঝি?ইতিহাস কি শুধু কিছু রাজা,মহারাজার নাম,কীর্তি ও কিছু সাল তারিখ?নাকি ইতিহাস কথা বলে একজন গল্পকারের মত?
অতীশ দীপঙ্কর কে নিয়ে জানার আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকে,বাংলার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে শুধু এই নাম টি পাওয়া যায়। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন বা তার কীর্তি অনুভব করা যায় না।একদিন হঠাত নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা (অতীশ দীপংকরের পৃথিবী) বইটা খুজে পেলাম।যদিও লেখক পরিচিত কেউ নয়,বইটির নাম চিত্তাকর্ষক,এ থেকেই মুলত পড়ার আগ্রহ জাগে।বইটা শুরু করার পর এক নিংশাসে পড়ে গেলাম।অতীত বর্তমান ভবিষ্যত নিয়ে আগায় উপন্যাসটি।এখানে শুধু অতীশ দীপঙ্করের জীবন তুলে আনা হয়নি,লেখক চেষ্টা করেছেন ব্যক্তি অতীশ দীপঙ্কর কে খুঁজতে। যদিও ইতিহাসের কষ্টিপাথরে ঘষে দেখলে উপন্যাসের অথেন্টিসিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়,কিন্তু লেখক এর লেখনি এক অদ্ভুত মায়াজাল সৃষ্টি করেছে। লেখক এত ভার্সেটাইল চিন্তাভাবনা এক উপন্যাসে তুলে এনেছেন সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আসলেই তো ,আমরা জীবনকে যেভাবে দেখি,জীবন কি আসলে তাই,নাকি জীবনে সব কিছু ঘুরে ঘুরে আসে?অতীত ,বর্তমান ,ভবিষ্যত কি আলাদা কিছু,নাকি তারা একিসাথে থাকা তিনটি অবস্থা মাত্র?আর জীবনের উদ্দেশ্য আসলে কি?জীবনে কোন জিনিসটা বেশি দরকার,নির্বান নাকি ভালবাসা। পুরো বই একনিমিষে নিয়ে যাবে একাদশ শতকে।শেষ করতে চাই বইটির ম্যাজিক লাইন দিয়ে,
❝যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধুলিকালীন মেঘ পুস্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে আর পালতোলা নৌকা ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতোধারায় ... সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে --- আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালাঃ তখন -- কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসবো ...❞
নিখুত গল্পকারের মত,নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা একটি অদেখা গল্প বলে যাবে,আর পাঠক বাধ্য হবে কান পেতে সেই গল্পটি শুনতে
নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা এক আশ্চর্য্য উপন্যাস। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশের জীবনের বেশ কিছু অংশ সম্পর্কে পরিস্কার তথ্য পাওয়া যায় না। এই উপন্যাসে আলো আঁধারে ভরা সে সময়কে দেখিয়েছে প্রিজমের মধ্য দিয়ে। অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মাঝেমাঝেই ছুঁয়ে গেছে একে অপরকে, কখনও বা ভবিষ্যৎ অতীতে গিয়ে নির্ধারণ করে এসেছে ইতিহাসের পথরেখাটিও। এই সমস্তটুকু হয়েছে অতি মসৃণভাবে, বিভিন্ন সময়কালের ব্যবহৃত ভাষার তফাৎ লক্ষণীয়, অথচ কোথাও তাল কাটে না, পাঠের আনন্দ ব্যাহত হয় না, আকর্ষণ কমে না, বরং চুম্বকের মত টেনে নিয়ে চলে পাঠককে পাতার পর পাতা।
এই লেখকের কোন বই আগে পড়ি নি, সত্যি বলতে নামও শুনি নি। ওঁর এই বইটি প্রথম পড়াতেই মুগ্ধ হয়েছি। কি ফর্ম কি কনটেন্ট দুইই অসাধারণ। সবাইকে বলব অবশ্যই পড়ুন।
অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান এক হাজার বছর পূর্বের ভারতবর্ষের মহান ব্যক্তিত্ব। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর তুমি সন্ধ্যার মেঘ কিছু দিন আগেই পড়া হোল আর সেখানেই এই নামের সাথে আমার পরিচয়। নিজ সময়ে ইনি ছিলেন সবচেয়ে মেধাবী মানুষ। তার বাল্যকাল থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ জীবনের একটি সুন্দর ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রকৃতির বর্ণনা বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ মনমুগ্ধকর। চন্দ্রবংশীয় রাজকুমার চন্দ্রগর্ভ বাল্যকালেই মুক্তির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। রাজকীয় আরাম আয়েশ তার জ্ঞানের আকর্ষণ দমিয়ে রাখতে পারেনি। ভারতবর্ষের সকল মহামহোপাধ্যায় এর কাছে শিক্ষা গ্রহণ শেষেও তার তৃপ্তি হয় না। যাত্রা করেন সুমাত্রায় তৎকালীন সুবর্ণদ্বীপ। সেখানে গুরু ধর্মকীর্তির নিকটে তার শিক্ষাজীবন শেষ করে আবার ফিরে আসেন ভারতবর্ষে। সকল কুসংস্কার এর জবাব দেন এবং সমগ্র ভারতবর্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তিব্বত গমনের অসাধারণ বর্ণনা।
বই এর ভাষা অত্যন্ত কঠিন মনে হয়েছে। লেখক মনে হয় সংস্কৃতে লিখতে পারলে বেশি খুশি হতো। আমার মনে হয় আরেকটু সাবলীল ভাষা ব্যবহার করলে পাঠকদের জন্য অনেক বেশি উপভোগ্য হতে পারত।
নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা (অতীশ দীপংকরের পৃথিবী) সন্মাত্রানন্দের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রকাশের পর আগস্ট,২০২০ পর্যন্ত ত্রয়োদশ মুদ্রণ প্রমাণ করে উপন্যাসটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। বইয়ের নাম থেকেই বোঝা যায়, এটি অতীশ দীপংকরের জীবনী আশ্রিত উপন্যাস। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান এর নাম জানেন না এমন শিক্ষিত বাঙালি বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কবেকার সেই স্কুলের বইয়ে পড়েছিলাম বাংলার মানুষ অতীশ দীপংকর তিব্বতে গিয়েছিলেন সেই হাজার বছর আগে। এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বাঙালির গর্ব, কিন্তু কবে কোন বয়সে তিনি তিব্বতে গিয়েছিলেন, তিব্বতে তার বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারই বা কেন জরুরী হয়ে পড়েছিলো তার বিস্তারিত কিছুই জানি নি। কৌতুহল অবশ্যই ছিল, তবে এর বাইরে বিশেষ কিছু জানা হয় নি, আর সেই কৌতুহল এই বইটি পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ঠ ছিল।
এই বইকে ইতিহাস গ্রন্থ কোনভাবেই বলা যাবে না, এটি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস মাত্র। এখানে ইতিহাস থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সত্যি যতটুকু আছে তার চেয়ে ঢের বেশি আছে লেখকের কল্পনা। সময়ের তিনটি স্তরে লেখক অতীশ দীপংকরের জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন, প্রায়শই সেই সময় স্তরগুলো একে অপরের সাথে মিলে গেছে। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে এই উপন্যাসকে ফ্যান্টাসী ধর্মী লেখাই বলতে হবে। লেখকের বিশ্বাস অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সমান্তরালভাবে বহমান। কখনো কখনো কোন বিশেষ ক্ষণে তাদের মধ্যের বিভেদরেখা মুছে যেতে পারে। এই বিশ্বাস বা কল্পনা থেকেই তিনি এই উপন্যাস সৃষ্টির প্রয়াস করেছেন। লেখক কি সফল? সময় বলে দেবে। তবে বাণিজ্যিকভাবে যে সফল, তার প্রমাণ ত্রয়োদশ মুদ্রণ।
দশম-একাদশ শতকের অতীশ দীপংকরের জীবনীকাল, ত্রয়োদশ শতকের বৌদ্ধ লামা চাগ্ লোচাবা এবং বজ্রডাকিনী স্বয়ংবিদা আর একুশ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক অমিতায়ূধ ও বজ্রযোগিনী গ্রামের মেয়ে জাহ্নবীর সময়কাল থেকে উপন্যাসটি লেখা। উপন্যাসে বারবার ফিরে এসেছে বিক্রমপুর বা মুন্সীগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনী গ্রাম। এসেছে নালন্দা, বিক্রমশীল, সুমাত্রা, মগধ, নেপাল এবং অবশ্যই তিব্বত। সাথে ঘুরে ফিরে এসেছে বহু মানুষ। এমনকি লেখক নিজেও একুশ শতকের সাবেক সন্ন্যাসী শাওন বসুর ছায়ায় এই উপন্যাসের একটি চরিত্র। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার সময় লেখকেরা (বাংলা ভাষায় লেখা উপন্যাসের কথাই বলছি) সেই সময়ের প্রচলিত শব্দ লেখায় ব্যবহার করে লেখাটিতে ঐসময়ের আবহ সৃষ্টির একটা চেষ্টা করে থাকেন। এই বইও তার ব্যতিক্রম না। সেই সময়ের কথ্য ভাষা ঠিক কেমন ছিল তা তো আর এ যুগে বসে নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব না। তবু সেই সময়ের সংস্কৃত বা প্রাকৃত শব্দগুলো ব্যবহার করে লেখক দশম-একাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের আবহ সৃষ্টি করেছেন। এতে অনেক পাঠক শুরুতে হোচট খেতেও পারেন। তবে সেটা আশা করি সাময়িক। পড়তে পড়তে অভ্যস্ততা এসেই যায়। এই উপন্যাসে লেখক তিনটি আলাদা টাইম লাইন, জন্মান্তর, অতীতে অবিকল সদৃশ অবয়বধারী ভিন্ন মানুষ এমন পরস্পর সাংঘর্ষিক বেশ কিছু কল্পনা বা ফ্যান্টাসীকে মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এতো জটিলতার কি প্রয়োজন ছিল? বিশেষত চাগ্ লোচাবা এবং বজ্রডাকিনী স্বয়ংবিদার সময়কাল তথা ত্রয়োদশ শতকের সময়কালের বর্ণনাটি এবং চাগ্ লোচাবাকে বারবার অতীশ দীপংকরের সময়কালে নিয়ে গিয়ে পাঠককে সেই সময়ের গল্প বলার চেষ্টাটাও অপ্রয়োজনীয় ছিল বলেই মনে হয়েছে। আরও সরলভাবেই তো বলা যেত সব। চাগ্ লোচাবার প্রথমবার বীর্যসিংহের সাথে দেখা হবার ও দ্বিতীয়বার পরকায়া প্রবেশের সময়ের দূরত্বের হিসেবটাও একটু গোলমেলে লেগেছে। কারণ প্রথমটি দীপংকরের বোধগয়ায় তর্কসভার সাত-আট বছরের পরের কথা সেই তর্কসভার সময় অতীশ দীপংকরের চৌত্রিশ বলা হয়েছে। দ্বিতীয়টির সময় অতীশ দীপংকর প্রৌঢ়, প্রায় বিশ বছর পরের সময়। কিন্তু বীর্যসিংহের আচরণে এতো দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানটি বোঝা যায় নি। আবার স্বয়ংবিদাই অতীশ দীপংকরের বাল্য সঙ্গিনী কুন্তলার জাতিস্মর সত্ত্বা। সে একটি কশেরুকার মালার জন্য অতীত যাত্রী চাগ্ লোচাবার সাহায্য নেয়, কিন্তু তাকে অতীতে পাঠায় সে নিজেই। আবার সে নিজেও অতীতে বারবার দেখা দেয় এবং বিগত জন্মের স্মৃতি তার মনে আছে বলেই মনে হয়। যা সে নিজেই সংগ্রহ করতে পারতো তার জন্যই বা আর কারো সহায়তা নেয়ার দরকার হলো কেন তাও ঠিক বোঝা গেল না।
দূর্বলতাগুলো বললাম, ভালো দিকগুলো বলবো না তাও কি হয়। একই সাথে ইতিহাস ও ফ্যান্টাসীকে মিলিয়ে দেবার দারুণ প্রচেষ্টাতো আছে বইটিতে। সুযোগ হয়েছে অতীশ দীপংকরের জীবন সম্পর্কে জানার, বিস্মৃত অবলুপ্ত সেকালের বিখ্যাত সব মঠ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে জানার, সেকালের রাজনীতি, বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে জানার। তবে উপন্যাসের সবচেয়ে বড় সফল দিক হচ্ছে উপন্যাসটির আকর্ষণী ক্ষমতা। বইটি শুরু করার পর ফেলে রাখতে পারিনি। সময় পেলেই পড়তে বাধ্য হয়েছি, এর পরে কি হলো, তারপরে কি হবে এই কৌতুহল লেখক জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন। আশা করি লেখকের পরের লেখাগুলো আরও ভালো লাগবে, আরও বেশি করে মুগ্ধ হতে পারবো।
এই উপন্যাসটি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান-এর জীবন ও কর্মকে কেন্দ্র করে রচিত একটি ইতিহাস-আশ্রিত সাহিত্যকর্ম। এতে তিনটি ভিন্ন সময়কাল—একাদশ, ত্রয়োদশ এবং একবিংশ শতাব্দী—সমান্তরালে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে অতীত ও বর্তমানের ঘটনাপ্রবাহ একে অপরের সাথে সংযুক্ত। প্রধান চরিত্রগুলির মধ্যে রয়েছেন অতীশ দীপঙ্কর, ত্রয়োদশ শতকের তিব্বতি লামা চাগ্ লোচাবা, এবং বর্তমান সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক অমিতায়ুধ। তাদের জীবনের ঘটনাবলী ও অভিজ্ঞতা সময়ের সীমানা অতিক্রম করে একস���ত্রে গাঁথা হয়েছে।
নানাবিধ theme এবং motif স্থান পেয়েছে মহারাজের গল্পকথনে। দেখা যাক এক এক করে:
১) সময়ের প্রবাহ ও পুনরাবৃত্তি: উপন্যাসে সময়কে একটি চক্রাকার প্রবাহ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। লেখক সর্বাস্তিবাদী বৌদ্ধ দর্শনের মাধ্যমে এই ধারণা তুলে ধরেছেন, যা অনুযায়ী সময়ের সব উপাদান সর্বদা বর্তমান থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
২) প্রেম ও আত্মত্যাগ: চন্দ্রগর্ভ (অতীশ) ও কুন্তলার সম্পর্ক উপন্যাসের কেন্দ্রীয় একটি থিম, যা প্রেম, আত্মত্যাগ ও পুনর্জন্মের ধারণাকে তুলে ধরে। কুন্তলার আত্মত্যাগ এবং পরবর্তী জন্মে স্বয়ংবিদা হিসেবে তার পুনরাবির্ভাব গল্পের গভীরতা বৃদ্ধি করেছে।
৩) দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: উপন্যাসে বৌদ্ধ দর্শন, তান্ত্রিক চর্চা এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চরিত্রদের আধ্যাত্মিক যাত্রা ও দর্শনচিন্তা পাঠকদের গভীরভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।
আলোচনা হোক ভাষা ও শৈলী প্রসঙ্গে। লেখক বিভিন্ন সময়কালের ভাষারীতি ও বর্ণনাশৈলী দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন, যা প্রতিটি সময়ের পরিবেশ ও সংস্কৃতিকে জীবন্ত করে তুলেছে। তবে, প্রাচীন সময়ের বর্ণনায় ব্যবহৃত সংস্কৃত-নির্ভর ভাষা কিছু পাঠকের জন্য দুর্বোধ্য হতে পারে। তবুও, এই ভাষারীতি উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সমৃদ্ধ করেছে।
সবিনয় অনুযোগ স্রেফ দুটি জায়গায়, তা'ও ব্যক্তিগত অনুযোগ বলা চলে। প্রথমত উপন্যাসের জটিল কাঠামো ও সময়ের স্তরগুলির মধ্যে স্থানান্তর কিছু পাঠকের জন্য বিভ্রান্তিকর হতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন ভাষার ব্যবহারে কিছু পাঠক হোঁচট খেতে পারেন। তবে, এই চ্যালেঞ্জগুলি উপন্যাসের গভীরতা ও শৈল্পিক মানকে ক্ষুণ্ণ করে না।
উপসংহারে এটুকুই বলার, 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' একটি গভীর ও চিন্তাশীল সাহিত্যকর্ম, যা ইতিহাস, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। সময়ের প্রবাহ, প্রেম, আত্মত্যাগ এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের থিমগুলি উপন্যাসটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
যারা গভীর ও অর্থবহ সাহিত্যকর্ম পছন্দ করেন, তাদের জন্য এই বইটি অবশ্যপাঠ্য।
মান্যবর ঋজু গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা ধার করেই পরিশেষে বলি : এই সময়, যখন প্রতি দশ মিনিটে একবার করে স্ট্যাটাস দেখাতে এবং নোটিফিকেশন চেক করতে হয়, তখন সাড়ে তিনশোরও বেশি পাতার একটা উপন্যাস আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে গেল শুরু থেকে শেষ অবধি।"
নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা শেষ করলাম। সব লেখার প্রতিক্রিয়া লেখা যায় না। আমিও কিছু লিখতে অসমর্থ। এ বই নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে, চেষ্টা করবো; কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ সম্ভব হবে না পূর্ণভাবে। ছিল-আছে-থাকবে এই তিনকাল নিয়ে রচিত এ অদ্ভুত গাঁথার শুরুই বা কোথায় আর শেষই বা কোথায়? সব তত্ত্ব আমি বুঝিনি, অনেক ভারী কথা আমি বুঝিনি। কিন্তু এটুকু বুঝেছি এ কাহিনী এক অনন্ত খোঁজের। যে খোঁজ আমরা সবাই করে চলেছি, আমাদের ঘরে-বাইরে, প্রতিনিয়ত। হয়তো এ খোঁজ নিজের, হয়তো এ খোঁজ শান্তির, হয়তো এ খোঁজ জ্ঞানের। সব শেষে মনে হয় এ খোঁজ পূর্ণতার। যে পূর্ণতার খোঁজ করেছিল কুন্তলা; এ খোঁজ শূন্যতারও, যে শূন্যতার খোঁজ করেছিল অতীশ। এমনই হাজার লক্ষ অতীশ আর কুন্তলা খুঁজে চলে পূর্ণতা আর শূন্যতাকে, সময়ের সেই আদি থেকে অশেষ ভাবিতে। আর কি বলবো। এমন গাঁথার লেখককে অনেক প্রণাম জানানো রইলো। এমন লেখা পড়ে পাঠকসত্ত্বা শান্তি পেল। এ কাহিনী তোলা থাকলো আমার মনের মধ্যে। কোন অশান্ত সময়ে, কোন বর্ষার আড়ালে, আবার হয়তো খুলে বসবো নাস্তিকদের অভিযানের এই আখ্যানখানি। ততদিন, নাস্তিকের অভিযান চলুক...! 🙂
প্রায় পাঁচ ফুট পৌনে চার ইঞ্চি গড়ন আর আটান্ন কিংবা ঊনষাট কেজি ওজনের এই যে 'আমি'। এই আমিকে নিয়েই তো পঁচিশটা বছর দিব্যি পার করে দিলাম। তবে কে এই 'আমি'? আমার জীবনের সারবত্তাই বা কী? আমি কি কন্যা? আমি কি কিশোরী? আমি কি প্রেয়সী? আমি কি ভগিনী? আমি কি প্রেমনিরতা? আমি কি আপ্তি? আমি কি অভিশাপ? আমি কি মুক্তি? আমি কি আশ্রিতা? আমি কি জায়া? আমি কি মা? আমি তবে কী? আমি হয়তো এসবই। পৃথিবীর বুকে হাজারবার হয়তো জন্মাতে হয় না। নিদারুণ মায়াভরা এই ধরণীতে একটি জন্মই স্বার্থক, একটি জন্মেই আমরা সম্পর্কের সবকটা শাখায় বিচরণ করতে পারি। শুধু শেষতক যেয়ে চোখদুটো মুদিত রেখে ভেতরটায় একটু খুঁজে দেখতে হয়। এই হয়তো জীবনের সারবত্তা, বেঁচে থাকার মানে।
বইটা নিয়ে সমালোচনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। সেই চেষ্টাতে যাব না। তবে বলতে পারি, বহুদিন পর কোনো বইয়ের প্রতিটা পাতা আমার অন্তঃকরণে এতটা জীবন্ত হয়ে ছুটে বেড়িয়েছে! কাহিনির শোরগোল সেখানে ছিল না, চরিত্রের অস্থিরতা সেখানে ছিল না, বেশ পরিষ্কার-স্থবির এক অনুভূতি পুরো বইটা জুড়ে। সেই সাথে প্রতিটা পৃষ্ঠা পড়েছি আর বাংলাভাষার সুললিত স্পর্শে বিমুগ্ধ হয়েছি। কত সুন্দর সেসব শব্দ! কত সুন্দর সেসব উপমা! হাজারটা অচেনা শব্দের অর্থোদ্ধার করে একাধারে পড়ে যাচ্ছিলাম স্বতঃস্ফূর্তভাবেই, যেন কোনো অদ্ভূত যাদুবিদ্যা! একেই কি বলে 'মাতৃভাষা'? হায়! গো+অক্ষ=গবাক্ষ—সন্ধিসূত্র পড়ে আসা আমরা শুধু জানালাটাই হয়তো চিনে গেলাম, শব্দসম্ভারের ঐশ্বরিক প্রাসাদের কপাটখানা খুলেও জানার আগ্রহ আমাদের হলো না!
সর্বোপরি, মাস্ট রিড। সময় নিয়ে, কিছুটা দম ধরে বইটা অবশ্য আস্বাদনীয়।
অদ্ভুত ঘোর তৈরি করা এক উপন্যাস, শেষ লাইনটি না পড়ে শেষ করা পর্যন্ত পাঠক জানতে পারবে না শেষ কোথায়। এই ঘোর থেকে কেন বের হলো সে বিষয়ে পাঠক যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।
অতীশ দীপংকর এর জীবনের উপর রচিত উপন্যাস হলেও উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে লেখকের বর্ণনার গুণে। বাস্তবতা ও কল্পনার বেড়াজাল যেমন ভেঙে গেছে তেমনি অতীত- বর্তমান - ভবিষ্যৎ এক হয়ে গেছে কোন এক ছেদ বিন্দুতে।
পৃথিবী ঘুরে চলছে তিব্বতীয় জপযন্ত্রের মতো, সময় আবর্তিত হচ্ছে, মানুষ জন্মজন্মান্তর ব্যাপী নিজেকে অন্বেষণ করে চলছে।
"যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ ... ... ... ... ... ... কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব... " এই গাথার অর্থ সময় - কাল ভেদে ভিন্ন হলেও, এইই জীবন। যার অন্বেষণ করে চলছি আমরা প্রত্যেকেই। সেই অর্থে প্রত্যেকেই আমরা দীপংকর। প্রত্যেকেই একা। আর এই অন্বেষণ- যে দ্রষ্টার দেখার শেষ হয় না, একাকীত্ব তাঁরও।
(আবারও পড়ায় ক্লান্তি তৈরি হবে না। এ ঘোরে ডুবে থাকতে থাকতে নিজেকেও যেন অতীত- বর্তমান- ভবিষ্যতের চক্রে খুঁজে পাই)
বড় অস্থির এ কালখন্ড।সামাজিক,রাজনৈতিক,ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার নাগপাশে বন্দি হয়ে আছে যে একবিংশশতকজীবি জ��গণ,তারা নিজেদের এই ক্ষুদ্রতাবিষয়ে সম্পূর্ণ অচেতন।বিদ্যার্জনের জায়গায় অস্ত্রমিছিল,নারীর সম্ভ্রমরক্ষার স্থানে গণধর্ষণ,মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অনধিকার চর্চাই শুধু নয়,সুযোগমত গণপ্রহারই হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ।তারই সাথে ঘৃতাহুতি প্রযুক্তির অপব্যবহারের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত "সোশ্যাল মিডিয়া"।শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা সবসময়ই বেশি,একথা মানলেও আশ্চর্যজনকভাবে গুজব রটাতে বা দলাদলির হাতিয়ার হয়ে উঠতে আপাতত এর জুড়ি মেলা ভার।পরস্পর অবিশ্বাস,ঘৃণা,নারীনিপীড়নের পরিসংখ্যানে সর্বাধিক উত্তপ্ত এই সময়ে আকুতি একপশলা শান্তিবারিধারার।গত একসপ্তাহব্যাপী গণমাধ্যম তোলপাড়কারী ভাগাড় এবং মেট্রোকান্ডের আঁচে নিজেকে সেঁকতে না হওয়ার সৌভাগ্যের জন্য ধন্যবাদার্হ যে বৃষ্টিপাত,তা হল সন্মাত্রানন্দ বিরচিত,অতীশ দীপঙ্করের জীবনী আধারিত উপন্যাস 'নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা'।আমার এ স্বল্প পাঠপরিসরে উপন্যাসের দোষগুণ বিচার করার ধৃষ্টতা করিনা,কিন্তু পাঠান্তে স্বতঃউৎসারিত যে চিরকরুণাময় শান্তি হৃদয়কে আপ্লুত করেছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দু'চারটি কথা ব্যক্ত করার তাগিদ অনুভব করছি। সত্যি কথা বলতে,কৈশোরে ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে পঠিত 'অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান' নামক এক বাঙালি মহাজ্ঞানী বৌদ্ধ ভিক্ষুর নাম এবং তাঁর ধর্মপ্রচারে তিব্বতগমন ছাড়া অন্য কোনো তথ্য ছিল অজ্ঞাত।বাঙালির বিস্মৃতপ্রায় গৌরবান্বিত অতীত বিষয়ে কিছুদিন আগে অবধি ঘোর অন্ধকারেই ছিলাম।সম্প্রতি প্রীতম বসু লিখিত দুটি ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস পাঠসমাপনে সে অন্ধকার কিছুটা দূরীভূত হয়।আর এ উপন্যাসের উদ্দেশ্য সেই বিস্মৃত অথচ সুমহান বঙ্গসন্তানকে উপযুক্ত অর্ঘ্য প্রদান।বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গবেষণামূলক গ্রন্থ অতীশের জীবনের খন্ড খন্ড চিত্রকে তুলে ধরলেও প্রথম প্রামাণ্য উপন্যাস হিসেবে ব্যক্তি অতীশকে প্রথম বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার কৃতিত্ব কিন্তু এরই। উপন্যাসের মূল আখ্যান তিনটি কালখন্ড জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে-অতীশের জীবৎকাল(দশম-একাদশ শতক),ত্রয়োদশ শতক ও একবিংশ শতক।লেখকের মতে অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আসলে একই সঙ্গে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ।একই সমতলে অঙ্কিত পরস্পরছেদী বৃত্তের মত তারা আদিঅনন্তকাল সঞ্চরণশীল।এই ছেদবিন্দুতে হঠাৎ দুই যুগের বাসিন্দাদের সংযোগস্থাপনও সম্ভবপর হলেও হয়ে যেতে পারে।হ্যাঁ,কালযাত্রার অসাধারণ উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে উপন্যাসের সুদীর্ঘ একেকটি অধ্যায়ে।সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত অতীশের কাষ্ঠপেটিকা থেকে প্রাপ্ত জপমালা,পুঁথি ও তারাদেবীর মূর্তি থেকে যে জীবনরহস্যের সূত্রপাত তার সমাধান অন্বেষণের পথে পাঠক চরিত্রদের সাথে ভ্রমণ করেন কখনো বিক্রমশীল বিহারের পথে,কখনো বজ্রযোগিনী গ্রামে অতীশের জন্মভিটায়,কখনো বা তিব্বতের বিপদসঙ্কুল পার্বত্যমার্গে। অলৌকিকতা এ উপন্যাসের এক দৃঢ় ভিত্তি হলেও অতীশের চরিত্রের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে জেগে ওঠে তাঁর পরম করুণাঘন মাতৃস্বরূপিণী অবয়বটিই।তাই এ উপন্যাস হয়ে ওঠে চিরন্তনী নারীসত্তার আধার।কখনো কুন্তলা,কখনো স্বয়ংবিদা,কখনো জাহ্নবী রূপে যে নারীসত্তা প্রেমিকা,কন্যা,জায়া হয়ে বারবার ফিরে এসেছে-প্রেমে,স্নেহে,বাৎসল্যে পুরুষের জীবন পরিপূর্ণ করেছে,পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে জন্মজন্মান্তর ধরে বারবার অভিনীত হতে থাকা নাটকটির সর্বাপেক্ষা কুশলী কুশীলব সেই চিরকালীন নারীসত্তার কথাই সপ্রেমে উচ্চারিত হয়েছে 'নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা'য়।তৎসম শব্দের সুখপাঠ্য ব্যবহারে ও সাহিত্যরসের পরিপূর্ণতায় রচনাটি কালোত্তীর্ণ হবে এবং এই কঠিন সময়ে যুগোপযোগী উপন্যাসটির প্রেমময় বার্তা পাঠকমনে কিঞ্চিৎ শান্তিধারা বর্ষণ করতে সক্ষম হবে,এই আশা রাখি।
মানবজীবন আসলে কি? কে আমরা? সত্যিই কি সুউচ্চ পর্বতের একপাশ দিয়ে উঠে আসেন অতীতের মানুষ আর অন্য পাশ দিয়ে নেমে যাই এই আমরা? বর্তমানের মানুষ? আলাদা আলাদা সময়বৃত্তেই কি এই একই মানুষ আমরা সবাই বাস করি? এই যুগে অতীশ দীপংকর, তো অন্য যুগে চাগ লোচাবা আবার অন্য যুগে অমিতায়ুধ হয়েই কি ফিরে ফিরে আসি? কে বলবে! এই দুর্জ্ঞেয় রহস্য অনুসন্ধানে কে প্রবৃত্ত হবে? এই অন্তহীন খোঁজের পথে কে বাড়াবে পা?
এ গল্প অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের, এ গল্প কুন্তলার, এ গল্প স্বয়ংবিদার, এ গল্প জাহ্নবীর, এ গল্প শাওন বসুর। তিনটি পৃথক সময় মিলে গাঁথা হয়েছে গল্পের ভিত। একাদশ-ত্রয়োদশ শতক আর এই বর্তমান একবিংশ শতক। অথচ তিনটি সময়ই মিলে গেল এক সুতোতে। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, অস্থিমালা খোঁজা নাকি খোঁজা কেবলই কিছু কথার অর্থ? নাকি আসলে সময় এবং জীবনকে খোঁজা, যে খোঁজার শেষে কি আছে কেউ জানেনা।
বাংলাদেশ এর বজ্রযোগিনী গ্রাম, কলকাতা, নালন্দা, তিব্বত সবই ঘুরিয়ে আনলেন লেখক আমাদের। এক সময়ের ঢেউয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে অন্য সময়ে ছিটকে গিয়ে পড়ার এই অভিনব লেখনশৈলী চমকপ্রদ। ইতিহাস, জাতিস্মর, জন্মান্তর, বাস্তবতা, পরা-বাস্তবতা সবই হাত ধরাধরি করে চলেছে। এমন উপন্যাস পড়তে গেলে সময়-কাল-স্থান সবকিছুই হারিয়ে যায়, কেবল মাথায় থাকে ওই সময়,স্থান এবং এর পাত্র-পাত্রীরা।
লেখার স্টাইলের অভিনবত্বে চমকে উঠেছি বারবার। মনে হয়েছে আমিও যেন দীর্ঘদিন ধরে এমন কিছু পড়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছি। অতীশ দীপংকর এর জীবনী জানতে হলে হতাশ হবেন, কিন্তু মানুষ অতীশকে একটু হলেও চেনা যাবে। আর না চিনলেই বা ক্ষতি কি? উপন্যাসের মানুষগুলোকে যদি চিনতে পারি ঠিকঠাক, আর তত্ত্বগুলো একটুও অনুধাবন করতে পারি তাই বা কম কি?
শিহরিত হয়েছি পাতায় পাতায়। কোথায় লাগে থ্রিলার? সবশেষে, সর্বব্যাপী হয়ে রইল প্রেম। প্রেম-বিরহ, বিচ্ছেদ-মিলন। শতবর্ষ আগে যে বিচ্ছেদের সূচনা হয়েছিল, তা এই একবিংশে এসে মিলল কি? দক্ষিণ পীঠিকা বাকি রইল যে!
গ্রন্থটি পাঠ সমাপ্ত করিলাম । বহুকাল পর একটি বিস্ফোরক সাধু ভাষায় রচিত উপন্যাস পাঠ করিয়া পুলক বোধ করিতেছি । বাল্যকালে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যাহার সম্বন্ধে মাত্র দুই তিন পংক্তি পড়িয়াছি, তাহাকে লইয়া যে একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস রচনা করা যাইতে পারে, ইহা আমার ধারনার বাহিরে ছিল । উপন্যাসটির প্রেক্ষাপটে নোলান মহাশয় বিরচিত উদ্ভব (Inception) কাহিনীর বেশ প্রভাব প্রতিফলিত হয়। কেবল ভাষা, ঐতিহাসিক গবেষণা এবং প্রাচীন বাংলা ও তিব্বতের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক বর্ণনা নয়, কাহিনীর বেশ কিছু স্থানে লেখকের নির্ভীক চেতনার পরিচয় পরিলক্ষিত হয়। আমার মিত্র - তালিকায় উপস্থিত সকলকে পাঠ করিবার অনুরোধ রইল।
গত বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ করলাম। যথেষ্ট ভাল লাগলো। অতীত অংশে সংস্কৃতনির্ভর বাংলায় অনেকের সমস্যা হতে পারে তবে বুঝতে পারলে আনন্দদায়ক। যদি বর্তমান অংশে আরেকটু সময় দিতেন তবে ভাল হতো। এই অংশটাই বিশেষ করে কম গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয়েছে। সামগ্রিকভাবে আরও ১০০-১৫০ পাতা নিয়ে লেখলে কাহিনি আরও ছড়িয়ে যেতে পারতো।
ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস 'নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা' সম্পর্কে অনেক আলোচনা ,পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়বার পর এই কাহিনি পড়া শুরু করেছিলাম।যদিও মনে হয়েছিল যে এই বিষয়ে আমার কোনো ধারণা বা সামান্য জ্ঞান না থাকায় আমি কি পারবো এই গ্ৰন্থের মর্মার্থ বুঝতে? কিন্তু ভুল প্রমাণিত করে এই কালোত্তীর্ণ উপন্যাস যেনো নদীর স্রোতের মত আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চললো। পরিচিত হলাম বিস্মৃতপ্রায় মহাপন্ডিত অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের পৃথিবীর সঙ্গে। রাজকুমার চন্দ্রগর্ভ কিভাবে জাগতিক সুখ ও রিপুর বন্ধন চূর্ণ করে নির্মল ত্যাগ এর পথ গ্ৰহন এবং কঠিন পরীক্ষার পর দীপংকর শ্রীজ্ঞান হয়ে উঠলেন সেই কাহিনির সাথে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে সুগভীর চিন্তাধারা, বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে মতামত, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ইত্যাদির সুস্পষ্ট ব্যাখা পাওয়া যায় এই গ্ৰন্থে। শুধু ধর্মচর্চা ও আধ্যাত্মিকতা নয় তৎকালীন ভারত নেপাল ও তিব্বতের শিক্ষার প্রসারে অতীশ এবং বৌদ্ধ বিহারের বিশিষ্ঠ আচার্যদের অবদানের কথাও জানা যায়। একটা সভ্যতার ক্রমবিকাশে প্রকৃত শিক্ষা ধর্ম ও দর্শনের বিভিন্ন দিক নিয়ে যে আলোচনা এই উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে ��া পুরোপুরি উপলব্ধি না করতে পারলেও অনুভব করলাম যে আজকের এই সময়ে এইরূপ নাস্তিক পন্ডিতের আমাদের দেশে খুবই প্রয়োজন।উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এক নারী সত্তা যিনি বিভিন্ন যুগে কখনো কুন্তলা কখনও স্বয়ংবিদা কখনও জাহ্নবী নামে পৃথিবীতে এসে অতীশের সঙ্গে মিশেছেন। মন ছুঁয়ে গেলো এই মানবীর জন্ম জন্মান্তরের কাহিনি। তারপর বিভিন্ন সময়কাল থেকে একে একে চাগ লোচাবা ,অমিতায়ুধ, শাওন চরিত্রগুলি উপন্যাসের সাথে যুক্ত হয়ে অতীশের সম্পর্কে জানবার আগ্ৰহ যেন আরও বাড়িয়ে দিলো। যুগ ভেদে ব্যবহৃত সাধু ভাষা কিছুটা কঠিন হলেও লেখনীর গুনে ও মুন্সিয়ানায় এই কাহিনি পাঠ থেকে একবারের জন্য বিরত হয়নি। ভিন্ন ভিন্ন যুগের চরিত্ররা যখন সময়কালের গন্ডি পেড়িয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয় সেইসব বিশেষ সন্ধিক্ষণ শ্রদ্ধেয় লেখকের বর্ণনায় আরও জীবন্ত ও আকর্ষণীয় হয়েছে।সশ্রদ্ধ প্রনাম ও ধন্যবাদ জানাই লেখক সন্মত্রানন্দ কে এতো সুন্দর ও সাবলীলভাবে মহাশ্রমন অতীশ এর জীবন ও দর্শন পাঠকের সামনে এই গাঁথার মাধ্যমে তুলে ধরবার জন্য। এই অশান্ত ,অস্থির ,অসহিষ্ণুতায় পূর্ণ সময়ে এই উপন্যাস কিছুটা হলেও মনকে শান্তি ও স্বস্তি দেয়। এমন এক অসাধারণ উপাখ্যান সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে একবার নয় বারবার পড়া যায়।
বইটি শুরুর আগে অতীশ দীপঙ্কর সম্পর্কে জানা দরকার। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হলেন একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত যিনি পাল সাম্রাজ্যের আমলে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধধর্মপ্রচারক ছিলেন। তিনি ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান এখনও 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে পরিচিত।
এই বইএর অনেক প্রশংসা শুনেছি, কিন্তু পড়ার পর আমার প্রতিক্রিয়া একেবারে ভিন্ন। যতটা উৎসাহ নিয়ে শুরু করেছিলাম, পড়তে তার বিন্দু মাত্র আনন্দ পাইনি। অতীশ দীপংকরকে কেন্দ্র করে তিনটি মূর্তির ইতিহাস আছে, একে ঘিরেই উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে।
এখানে লেখক দশম - একদশ শতক, ত্রয়োদশ শতক ও একবিংশ শতক অর্থাৎ সাম্প্রতিককাল এই তিন সময়ের ঘটনাকে সমান্তরালে রেখে যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। তিনটি সময়ে ভাষারও প্রয়োগ করেছেন।দশম একাদশ শতকের যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা বেশ কঠিন বলতে হবে। সত্যি বলতে কি, দশম একাদশ শতকের ব্যাপার গুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে, ঠিক বোধগম্য হয়নি।প্রথম থেকে পড়তে শুরু করার পর বলতে গেলে প্রায় নীরসই লাগছিল। তবে কিছু কিছু প্রসঙ্গ পড়তে ভালো লাগছিল, যেমন - জাহ্নবী অমিতায়ুধের কথোপকথন, মাটির নিচে সূতিকাগৃহ আবিষ্কার, স্বর্গীয় পানীয় চা।
একটা বই মানুষ কে এভাবে ভাবাতে পারে সেইটা হয়তো নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা না পড়লে জানা হত না। জন্মসূত্রেই আমি অতীশের দেশের মানুষ। অতীশ দীপংকর কে নিয়ে ফ্যাসিনেশন সেই ছোট বেলা থেকেই ছিল। মুন্সিগঞ্জ সদর যতবার যাওয়া পড়েছে তত বারই ঘুরে এসেছি নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা। তবে লেখক আমাকে কালের পরিক্রমায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবিয়ে মস্তিকের ধূসর সেলে এ রকম বিভ্রম তৈরি করবে, সে কথা কি নাস্তিক পণ্ডিতের সাথে এক মাসের ভ্রমণ না হলে কি জানতে পারতাম। বইটির ভাষা বেজায় কঠিন। তাই বুঝে বুঝে রসিয়ে রসিয়ে পড়তে এক মাস কেটে গেল। তিন টাইম লাইনের জন্য লেখকের তিন ধরনের স্টাইলে লেখা আমাকে বেশি অভিভূত করেছে। লেখক লেখনীতে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন অবশ্যই। তার পরবর্তী বইয়ের জন্য রইলো শুভ কামনা।
তিনটি সময়কালে গল্পটি বলা যার মধ্যে একটি বর্তমান কাল। অতীশ দীপঙ্করকে ঘিরে গল্পটি সাজলেও গল্পের প্রোটাগনিস্ট অবশ্যই সময় বা তার বহমানতা। অসাধারণ সুন্দর লাগল গল্পটি । একরকম ঘোরের মধ্যে দিন কাটিয়েছি, কিছু কিছু জায়গায় লেখক এমন ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন ।
তবে আমার দুটো ব্যাপার ভালো লাগেনি। এক, ঐতিহাসিক সময়কালের ভাষারীতি, যা অনেক জায়গায় দুর্বোধ্য। আর দুই, নারী চরিত্রের সেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা one-dimensional প্রতিনিধিত্ব। নারী কি শুধু কন্যা, প্রণয়ী, স্ত্রী বা জননী? তার কী স্বাধীন কোনো ব্যক্তিসত্তা নেই? লেখক অদ্ভুত সুন্দর একটি কাহিনী দিলেন, কিন্তু এই narrative টির বদল আনতে পারলেন না।
বইটার গঠন হচ্ছে বহু-সূত্রিয়, অর্থাত অনেকগুলি কাহীনির সুতা আছে। এই আদলের গল্প আগেও লেখা হয়েছে। একই মলাটের মধ্যে অনেকগুলি কাহীনি-সুতা থাকলে তাদের মধ্যে একটা বিজরণ দরকার হয়। এই বিজরণটাই কাহীনির একরৈখিক বৃত্তান্তকে একটা নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। এর কিছু চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে মুজতবা সিরাজের 'অলীক মানুষ', অথবা সতিনাথ ভাদুড়ীর 'জাগরি'।
মুষ্কিল হচ্ছে যে এই বইয়ে বিজরণটা খুবই ক্ষীণ। কার্য-কারণের বা পরস্পর নির্ভরতার কোনো বিজরণ নেই। তিনটা সময়কালের কাহিনী আছে, দ্বাদশ-একাদশ, বর্তমান, আর ত্রয়দশ। আর এদের মধ্যে যোগসূত্রগুলি হচ্ছে মূলত - দিব্যর্শনের মাধ্যমে। বর্তমানের ঘটা কাহীনি রেখায় অতীতের কোনো ছায়া নেই, বোঝা নেই। প্রত্মতাত্বিক বা ইতিহাসবিদ্যার অঙ্গনে অতীতকে টানা হয়েছে, কিন্তু ঘটনাবলি রয়েছে স্বতন্ত্র।
বইয়ে লেখকের একটা বিষয়ে একটা ভ্রান্তি আছে, ত্রয়োদশ শতকের কথপোকথনকে করেছেন অতীব মাত্রায় সংস্কৃত-আশ্রয়ী ভাষা দিয়ে�� এই ভুল বংকিম অথবা 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' -এ শওকত আলীও করেছেন। ভাষা সম্বন্ধে চরম বিভ্রান্তি থেকেই এই ভুল হয়ে এসেছে। ভাষার প্রকৃত উৎস আর জগত হলো কথ্য-ভাষা। ভাষা জিনিসটাই ব্যাক্তিক চিন্তাজগত আর সামাজিক যৌথ-চেতনার আশ্চর্য একটা মিশ্রণ। দরবারি বা সংস্কৃতায়িত বাংলাকে সেই সময়ের আদি-বাংলা মনে করা মারাত্মক ভুল। 'মারাত্মক ভুল' শব্দ-বন্ধটা ব্যাবহার করছি কারণ এই ভ্রান্ত ধারণার কুফল আমরা সমাজ জীবনের আরো নানান জায়গায় দেখতে পাই।
"পক্ষীগুলি সাহ্লাদে কক্ষ্যমধ্যে খট্বাঙ্গ, পুস্তকাধার, পেটিকা, লিখনসামগ্রী সকল কিছুর উপর এক ভিত্তিগাত্র হতে অপর ভিত্তিগাত্র অবধি উড্ডীয়মান হতে লাগলো"
-- পুরানকালের গোটা কাহীনি ধারাটাই এই ধরণের কৃত্রিম আর অপাঠ্য ভাষায় লেখা। ধৈর্য্য রেখে পড়া প্রায় অসম্ভদ।
লেখক এই মেকি, দাত-ভাঙা শব্দের খোজে এতটাই মন দিয়েছেন যে ফলঃত পুরানকালের সব চরিত্রগুলিই খুবই প্রাণহিন, আর মহাকাব্যিক চরিত্রের মতো দাড়িয়েছে। চরিত্রগুলি এতটুকুও রক্ত-মাংসের নয়। তাদের মধ্যে বাক-বিনিময়, তাদের সৌজন্য প্রদর্শন, একজনের কথার পিঠে আরেকজনের কথা - সব কিছুই খুব মেকি আর অস্বাভাবিক। ওস্তাদ কথাসাহিত্যিকরা কথাবার্তায় বক্তার সুপ্ত মনবাসনা, ঝোঁক ফুটিয়ে তোলে, শ্রেণি-বিন্যাস আর ক্ষমতার ওপর-নীচের ঢালাই ফুটিয়ে তোলে। ইলিয়াস আর দেবেশ রায় এর দুই উত্তম উদাহরণ। এই বইয়েতে তার একান্ত অভাব।
এইটাই বইয়ের আরেকটা বড় ঘাটতি। এমনকি বর্তমান কালের ঘটনা প্রবাহ, যার অনেকটাই ঘটেছে বিক্রমপুর জেলার এক গ্রামে, সেখানেও চরিত্রদের প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আঞ্চলিক ভাষার ব্যাবহার হয়েছে, কিন্তু সেটাও খুবই গত বাধা, প্রকৃতি জাত নয়। পড়ে মনে হয় পূর্ব বঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা শোনানোর জন্যেই শুধু এই ভাষার ব্যাবহার, আঞ্চলিক ভাষাকে সেই গ্রামের, সেই সমাজের এক ব্যাক্তিবর্গের জটিল মনোজগতের জানালা হিসাবে ব্যাবহার করেনি।
বইটায় লেখক দাবি করেছে যে এটা ইতিহাস আশ্রয়ী গল্প। কিন্তু ইতিহাস আর কল্পনার সীমারেখা স্পষ্ট না রাখলে পুরো গল্পটাই কল্পসাহিত্য হয়ে যায়। তাতে কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু বইয়ের বিক্রীর একটা কারণ কিন্তু এই জন্যে যে পাথকেরা এটাকে বিনোদনের মধ্যে দিয়ে ইতিহাস পাঠ মনে করে পড়বে।
লেখক বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের পটভূমিতে এক জায়গায় বলেছেন - খিলজির সেনাবাহীনি "তুরষ্ক দেশের"। ইতিহাস প্রচারক লেখক এখানে তুর্কি-জাতির সাথে আধুনা টার্কি / তুরষ্ক দেশকে গুলিয়ে ফেলেছেন। তুর্কি জাতিরা এসেছে মোঙ্গোলিয়া থেকে ক্যাস্পিয়ান সাগর আর মধ্যে এশীয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি থেকে। আধুনা তুরষ্ক রাজ্য আরো বহু বহু শত বছর পর, ওসমানিদের রাজত্ব কালে তুরষ্ক নাম পেয়েছে। আর খিলজির আগমনের সময় আধুনা তুরষ্ক দেশের নাম ছিল - "রুম"। রুম তখন সবে সবে সেলজুক শাসনের অধীনে আসলেও সেটাকে সংস্কৃতিগত ভাবে পূর্ব রোমান সামরাজ্যের অংশই মনে করা হতো। এতো বড় ভ্রান্তি একটা ইতিহাস-আশ্রিত গল্পে মেনে নেওয়া যায় না।
বরং বইটার একমাত্র সুখপাঠ্য অংশ হলো যেখানে শাওন আত্মবিশ্লেষণ করছে, শাওনের চিন্তাশ্রোতে প্রবেশ করছে। সম্ভবত এখানে লেখক আত্ম-নিরীক্ষণই করেছেন, সেই জন্যেই এইখানেই একমাত্র প্রাণ-স্পর্শী আলাপ আর চিন্তাশ্রোত পাওয়া যায় এই বইতে।
“যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে আর পালতোলা নৌকা ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতধারায়…. সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে— আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালাঃ তখন--- কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব…” এই শব্দ বাক্যটি বলে হাজার বছর আগে এক নারী হারিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর অতল গহ্বরে। আর সময়চক্র সেই প্রণয় প্রণয়ীকে মিলিয়ে গেছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে। আমারও খুব জানতে ইচ্ছে করছে, উপরের এই লাইন গুলো পড়ে আপনার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো না? আমার কিন্তু দিয়েছিল। এক ব্যস্ততম দিনে, ল্যাবের এক কোণে বসে বসে যখন পড়ে ফেলেছিলাম নাতিবৃহৎ এই বইটা তারপর দুপুরে খেতে বেরিয়ে একঝাঁক অবাঙালীর মাঝে বসে খেতে খেতে দূরে হারিয়ে গিয়েছিলাম বাংলার এক গ্রামে। কিছু কিছু সময়ে কিছু বই পড়তে পড়তে বাড়ীর কথা মনে পড়ে, গ্রামটাকে মনে পড়ে। মনে হয়, ধুত্তোর সমস্ত কিছু, বাড়ী যাই। শরৎচন্দ্র, বা বিভূতিভূষন নিয়ে বসলে, বা হয়তো কিছু পুরোনো বা গান মনে পড়ে গেলে প্রতিবার আমি অনুভব করি। তার সাথে যুক্ত হলো এটাও। না, এটা মোটেই অতীশ দীপংকরের আদ্যোপান্ত জীবনকথা নয়, বরং অতীশ দীপংকরকে সামনে রেখে ইতিহাস ও কল্পনার মিশ্রনে একটি অসাধারণ উপস্থাপনা। গল্পটা শুরু হয় বাংলাদেশে বজ্রযোগিনী গ্রামে পাওয়া একটি চন্দন কাঠের বাক্সকে দিয়ে। যে বাক্সে ছিল একটি পুঁথি, একটি জপমালা, ও একটি মূর্তি। তারপর শুরু হয় অনুসন্ধান। প্রত্নতত্ত্ববিদ অমিতায়ুধ সেই পুঁথির ইতিহাস খুঁজতে বের হোন। আর আমি? পাতার পর পাতা পাল্টে পাল্টে বার বার ফিরে যাই একাদশ শতকের অতীশ দীপংকরের পৃথিবীতে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, সময় এবং স্থান নির্দিষ্ট বা পরম(absolute) নয়। বরং, এগুলি আপেক্ষিক ধারণা, পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভর করে। এমন কোন একক সার্বজনীন রেফারেন্স ফ্রেম নেই যা থেকে সব গতি পরিমাপ করা যায় এবং সময় কোন একক, অপরিবর্তিত ঘড়ির দ্বারা পরিচালিত হয় না। লেখক সেটাই মূল মন্ত্র করে জাল বুনেছেন এই গল্পের। এই গল্পেও সমান্তরালভাবে বয়ে চলে তিনটি সময়ের স্রোত- একাদশ শতক, ত্রয়োদশ শতক ও বর্তমান একবিংশ শতক। উপন্যাসের প্রধান কান্ডারী চারজন- একাদশ শতকের স্বয়ং অতীশ দীপংকর, ত্রয়োদশ শতকের তিব্বতী লামা চাগ লোচাবা, একবিংশ শতকের প্রত্নতত্ত্ববিদ অমিতায়ুধ। বাকিটা অবশ্যই পড়ে জানতে হবে আপনাকে। তবে একথা ঠিক যদি আপনার যদি ধৈর্যের অভাব থেকে থাকে তাহলে এই উপন্যাস আপনার জন্য নয়। অথবা যদি অতিরিক্ত জ্ঞান বা দর্শন বা প্রকৃতি বর্ণনায় আপনার ধৈর্যচ্যুতি হয়, এবং আপনি একান্ত রূপে গোয়েন্দা গল্প আর প্রেমের গল্পই পড়ে থাকেন, এবং সেটাই আশা করেন, তবে ২০ পাতার বেশী এগোনো আপনার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তবে আপনি যদি এসবের উর্দ্ধে কেউ হয়ে থাকেন, তাহলে বইটা পড়ার পর আমি যে ঘোরের মধ্যে আছি, ঠিক যেভাবে বাস্তবটাকে আর খুব বাস্তব বলে মনে হচ্ছে না, আপনিও হয়তো তা কিছুটা অনুভব করতে পারেন। ভালোমাত্রায় তা সম্ভব। আপনিও, হ্যাঁ, আমার মতো আপনিও মিলিয়ে যেতে পারেন অতীতের কুয়াশার আড়ালে। এই মোটামুটি ৩৫০ পাতার বইতে অনেক কথা আছে, যা হয়তো আমি জানতাম, বা জানতাম না, বা হয়তো কোনদিন ভেবে দেখিনি সেই দৃষ্টিভঙ্গীতে। সময়ের স্রোতে অনেক উপরে উঠেছে, আর নিচে নেমেছে সমাজ। যেভাবে নদীর তলটা অগভীর হয়ে গেলে, স্রোত থাকলেও জলটা পচতে শুরু করে, সেরকম, সময়ের স্রোতের মাঝে, সমাজ বা হয়তো বলা ভালো, পরিস্থিতি পচতে শুরু করলে, এক পদ্মফুল জেগে ওঠে প্রতিটা কালে। আমার মতো হয়তো অনেকের কাছেই অতীশ দীপংকর নামটা ইতিহাসের পাতাতেই আটকে থেকে গিয়েছিল। আজ অনেকগুলো বছর পর অনেকখানি ভাবালো একটা উপন্যাস। কোন এক সুদূর পূর্বে, যিনি ঘর ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন তত্কালীন সমাজের এক অপ্রসঙ্গিকতা দেখে। তারও বহু বছর পূর্বে বেরিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। অনেক অনেক পরে বে��িয়েছিলেন নেতাজীও। আরো অনেকেই হয়তো বের হবেন। দুচোখে আশা নিয়ে। আগামী দিনটা সুন্দর করে তোলার জন্য। সেই সৌন্দর্য হয়তো তারা উপভোগ করে যেতে পারেন নি, ভবিষ্যতে যারা আসবেন তাঁরাও হয়তো নাও পারেন। তবে, উঠে দাঁড়ানোর এক অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবেন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
#নাস্তিক_পন্ডিতের_ভিটা লেখক ~ সন্মাত্রানন্দ প্রকাশক ~ ধানসিড়ি
খুব উৎসাহ নিয়ে এই বই কিনেছিলাম। লেখকের ব্যক্তিগত জীবনধারা জানতে পেরেছিলাম ওনারই একটা ইন্টারভিউ থেকে। আর সেই জীবনধারার প্রতিফলন রয়েছে বইয়ের চরিত্রের মধ্যেও। তাই আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।
পড়তে শুরু করে অবাক হয়ে গেলাম বাংলা সাহিত্যের ওপর লেখকের অবর্ণনীয় দখল দেখে। অমিতায়ুধ, চাগলো চাবা আর অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান - এই তিন চরিত্রকে দিয়ে তিনটে সময়রেখা এঁকেছেন লেখক। তবে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যত যে তিনটে আলাদা সময় নয়, তারা একইসাথে অবস্থান করে, এবং তাদের মধ্যে প্রায়শই দেখা হয়ে যায় - এই অদ্ভুত কন্সেপ্ট এনে মন জয় করে নিয়েছেন লেখক। তিনটে সময়কালে তিন ধরনের ভাষার প্রয়োগ হয়েছে।
তবে আমি স্বীকার করতে চাই এখানে যে এই বই পড়ার জন্য যে পরিমাণ ধৈর্য্য আর সময় প্রয়োজন, তা আমি দিতে পারলাম না। ভাষার মাধুর্য আহরণ করতে পারলেও তার রোমান্টিকতায় ডুব দিতে অক্ষম হলাম। তাই, এই বইয়ের প্রকৃত রিভিউ দেওয়ার জন্য একে আরেকবার পড়াই সমীচীন বলে মনে হল।
"...যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস, নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধুলিকালীন মেঘ, পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে, আর পালতোলা নৌকা ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতোধারায়... সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে -- আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালা তখন... কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব...."
"নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা" এক আশ্চর্য ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস। কালের পরিক্রমায় বিস্মৃতপ্রায় অভিযাত্রী অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের জীবন কাহিনী। বর্তমান মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের তৎকালীন রাজপরিবারে জন্ম নেয়া "চন্দ্রগর্ভ" কীভাবে হয়ে উঠলেন "অতীশ"। দৈবারিক কন্যা কুন্তলা কালচক্রে কখনোও হয়ে উঠলেন কূল বধু স্বয়ংবিদা বা অধুনাকালের কৃষক কন্যা জাহ্নবী। কীভাবেই বা এই গল্পে জুড়ে গেলেন তিব্বতি চাগ লোচাবা এবং কলকাতার অনুসন্ধিৎসু অমিতায়ুধ। একই সাথে তিনটি সময়কালের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। অতীশের সময়কাল, তার দুশো বছর পরের চাগ লোচাবার সময়কাল এবং আটশো বছর পরের বর্তমান অমিতায়ুধের সময়কাল। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ লেখকের ভাষ্যমতে একই সমতলে অঙ্কিত পরস্পরচ্ছেদি তিনটি বৃত্তের মতোন। কখনও কখনও তিন কালের মানুষ একই বিন্দুতে মিলিত হয়ে দেখা হয়ে যায় বা দেখা হয় না। সময় ভ্রমণ না প্যারালাল ইউনিভার্স ভেবে ভ্রম হয়। মানুষের এই যে অনন্তকাল ধরে ছুটে চলা তা কিসের জন্য? শ্রীজ্ঞান শেষমেশ এসে বুঝতে পারেন তিনি কাঠ, প্রস্তর বা ধাতু নির্মিত কেউ নন, তিনি রক্তমাংসের অতীশ। সে হিসাবে বলতে গেলে আমরা সবাই ক্ষণে ক্ষণে অতীশ আবার ক্ষণে ক্ষণে দীপংকর। উপন্যাসটি অতীশ দীপংকরের পৃথিবী হলেও এর বিষয়বস্তু শাশ্বত মানবীসত্তা। যার ভিন্ন ভিন্ন রূপ তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন। উপন্যাসের কল্পিত লেখক শাওন (হয়তো লেখক নিজেই) তিন যুগের তিন নারীর প্রণয়ের মধ্যে খুঁজে বেড়িয়েছেন অতীশের ইতিবৃত্ত।
সত্যি বলতে অনেক সময় নিয়ে পড়তে হয়েছে শুধুমাত্র কঠিন বাংলার জন্য। প্রাচীন দুই সময়কাল সংস্কৃত ও সাধু ভাষায় বর্ণিত হওয়ায় অনেক শব্দের শব্দার্থ জেনে নিয়ে আবার পড়েছি। তবে হ্যাঁ যতক্ষণ পড়েছি বুঁদ হয়ে পড়েছি। অবশ্য সহজ বাংলায় লেখা হলে পড়তে আরাম হতো। লেখকের লেখা এটাই প্রথম পড়লাম। উনার লেখা আরও পড়ার ইচ্ছা আছে।
পারসোনাল রেটিংসঃ ⭐⭐⭐⭐/5 (কঠিন বাংলার জন্য এক তারা কম)
ইলিয়াড এক রহস্যে মোড়া ধাঁধার নাম। যার অব্যক্ত সাহিত্য রস উন্মোচনে ব্যস্ত গোটা দুনিয়া। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকে হোমার নামে এক অন্ধ কবির বয়ানে অনুলিখন এই ইলিয়াড মহাকাব্য। মূলত ইলিয়াড রচনার মধ্য দিয়েই পশ্চিমা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়। যার সুবিশাল প্রভাব থেকে আজও মুক্ত নয় বর্তমান সাহিত্য সম্রাজ্য। সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি, বিজ্ঞান, প্রেম, বিরহ, বীরত্ব, কলহ, কাম, ক্রোধ, কাপুরুষতা, মহামারী কি নেই এই মহাকাব্যে! মহাকাব্য বলছি কারণ গ্রিক ভাষায় রচিত এই রচনাটি চব্বিশ টি সর্গে বিভক্ত যার মধ্য অাছে ষোল হাজার পঙ্ক্তি কবিতা। যা মূলত সাহিত্য বিচারে মহাকাব্য শ্রেণীগত। তিন হাজার বছর পরে এসেও মানুষ যে সমস্ত সংকটের সম্মুখীন হয় তা ইলিয়াড মহাকাব্যকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।
একান্তই ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, ঐশ্বরিক দেব দেবীদের বিশাল সাম্রাজ্য থেকে মানব জীবনের গল্প অাঁকা শুরু হয় হোমারের এই ইলিয়াড মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে। যার শুরুটা দেবদেবীর ছলাকলার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় মানব সত্তার বহিঃপ্রকাশ দিয়ে। এজন্য রচনায় অনেক চরিত্রের সাথে দেবদেবীর সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও কাহিনী পরিক্রমায় দেখা মিলবে মানব জীবনের বিভিন্ন সত্তা। উদাহরণ সরূপ বলা যায় ট্রয় যুদ্ধে জয়লাভের জন্য গ্রিকদের ঐশ্বরিক শক্তির সাহায্য ব্যতিরকে ষড়যন্ত্রের অাশ্রায় নেওয়া। মানব জীবনের মুক্তির পথে এই গল্প গুলো পৃথিবীর বুকে অাঁকা ট্র্যাজিক ছবি।
এবার মূল কাহিনীতে অাসা যাক,
মূলত ট্রয়ের যুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে ইলিয়াড মহাকাব্য। প্রাচীনকালে গ্রিস এবং ট্রয় নামে দুই প্রসিদ্ধ নগরী ছিল। কিন্তু এই দুই দেশের মধ্য সবসময় বিবাদ লেগেই ছিল। একবার দুই দেশের রাজারা মিলে ঠিক করল যুদ্ধ-বিগ্রহ বাদ দিয়ে দুই দেশের মধ্য শান্তিচুক্তি করার। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হল। দুই দেশের মধ্য এই শান্তিচুক্তির খুশিতে গ্রিসের রাজা মেনেলাউস এক ভোজ সভার অায়োজন করলেন। ট্রয়ের পক্ষ থেকে রাজপুত্র হেক্টর এবং প্যারিস যোগ দিলেন ভোজ সভাতে। বেশ কয়েকদিন ধরে চলল ভোজসভা। এই দিন কয়েকের সুবাতে ট্রয় পুত্র প্যারিস গ্রিক রাজা মেনোলাসের স্ত্রী হেলেনের সাথে প্রণয় লীলায় মত্ত হলেন। হেলেন ছিলে অতিব সুন্দর রমনী। কয়েকদিন বাদে যখন ট্রয় রাজপুত্রেরা দেশে ফিরে এলেন তখন সঙ্গে করে নিয়ে ফিরলেন হেলেনকে।
হেলেনের অপহরণের কারণে গ্রিকবাসি খুব অপমা���িত বোধ করলেন। গ্রিকরা মনস্থির করলেন এই অপমানের বদলা নিতে হবে। দলে দলে সংগঠিত হতে থাকলো গ্রিক বীর সন্যরা। এদিকে অাবার গ্রিক মহাবীর অ্যাকিলিসের সাথে মেনোলাসের মনদন্ড। কিন্তু বীর যোদ্ধা বন্ধু ওডিসিয়াসের কথায় অ্যাকিলিস যোগ দিতে চাইলেন যুদ্ধে।
গ্রিকেরা সমুদ্রে নৌবহর ভাসালেন। হাজার হাজার সন্য নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গ্রিক সৈন্যরা ট্রয় নগরীতে পৌঁছালো। কিন্তু দূর্ভেদ্য ট্রয় দেয়াল। ট্রয়ের সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র ছিল এই প্রচির বা দূর্গ। যা পুরো ট্রয়কে রক্ষা করতো। যদিও গ্রিক সৈন্যরা অধিক বেশি শক্তিশালী ছিলো তবুও গ্রিক সন্যরা ব্যার্থ হলেন এই অভেদ্য দেয়ালকে ভেদ করতে। তখন তারা ট্রয় দূর্গের অদূরে সাগরের বালুচরে নিজেদের তাবু গাড়লেন। একদিকে নীল সাগর অন্যদিকে অভেদ্য ট্রয় প্রাচীর। এর মাঝে গ্রিক সন্যরা পিষ্ট হতে থাকলো দীর্ঘ দশ বছর ধরে। যুদ্ধে পরাজিত হতে হতে গ্রিক সৈন্যরা মনোবল হারালো, দেখা দিল খাদ্যের অভাব। এমনকি গ্রিক সন্যরা নিজেদের মধ্য বিবাদে জড়িয়ে পড়ল।
গ্রিকদের এই বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্য দেখাদিল মহামারী প্লেগের অাক্রমণ। গ্রিকসৈন্য অারো বেশি বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ল। ঠিক এই সময়ে ট্রয় রাজপুত্র হেক্টর গ্রিকবীর প্যাট্রোক্লাসকে হত্য করে বসল। এই খবর শুনে যুদ্ধবিরতিতে থাকা অ্যাকিলিস তো রেগেমেগে অাগুন। কে এই প্যাট্রোক্লাস যাকে হত্যা করার জন্য অ্যাকিলিস রেগে গেলেন? তারপর অ্যাকিলিস ট্রয় রাজপুত্র হেক্টকে যুদ্ধে অাহবান করলেন। সেই সময়ে কোন বীর যুদ্ধের অাহব্বানকে প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন না। গ্রিক মহাবীর অ্যাকিলিস এবং ট্রয় রাজপুত্র হেক্টরের মধ্য যুদ্ধো অারম্ভ হল। ভিষণ সে যুদ্ধ! যুদ্ধের এক পর্যায়ে অ্যাকিলিস হেক্টরকে হত্যা করলেন। অ্যাকিলিস এতটায় রেগে ছিলেন যে হেক্টরের মৃত দেহ নিয়ে শিবিরে ফিরে এলেন।
হেক্টরের মৃত্যু সংবাদ শুনে ট্রয় বাসী কান্নায় ভেঙে পড়ল। বিশেষ করে মৃত দেহ সৎকার করতে না পারায় হেক্টরের বৃদ্ধ পিতা ট্রয়ের রাজা প্রায়াম খুব ভেঙে পড়লেন। প্রায়াম রাতের অাধারে একিলিসের শিবিরে এসে অ্যাকিলিসের সাথে স্বাক্ষাত করলেন এবং হেক্টরের মৃত দেহ চেয়ে নিলেন।
এদিকে গ্রিক সৈন্যরা ভাবলেন এবার ট্রয়কে পরাজিত করার সময় এসে গেছে। কিন্তু এই অভেদ্য দেয়াল হল মূল সমস্যা। এজন্য গ্রিক সৈন্যরা ষড়যন্ত্রের অাশ্রয় নিলেন। বিশাল এক কাঠের ঘোড়া বানিয়ে উপহার দিলেন ট্রয় নগরীকে। এই ঘোড়ার মধ্য অবস্থান করছিলো গ্রিকের বীর সন্যরা। ওদিকে ঘোড়া হল ট্রয়ের দেবতার প্রতিক। তাই খুব যত্নে ট্রয় বাসী ঘোড়াকে নগরীর ভেতর নিয়ে গেলেন। বীজয় উল্লাসে মেতে উঠল ট্রয়।
মধ্যরাতে ট্রয় যখন ঘুমে অাচ্ছন। তখন ঘোড়ার ভেতর থেকে বের হয়ে অাসলো গ্রিক সন্যরা। প্রথমে ট্রয়ের প্রাচীর খুলে দিলেন এবং শুরু করলেন ধ্বংস লীলা। প্রাচীর দিয়ে গ্রিক সন্যরা ট্রয়ের মধ্যে ঢুকে পড়লো। নারী শিশু সহ সকল যুবককে হত্যা করা হল। জ্বালিয়ে দেওয়া হল ট্রয় নগরী। কিন্তু যুদ্ধের শেষে বীর যোদ্ধা অ্যাকিলিস ভাগ্যে কি লেখা ছিল সেটা জানতে কিন্তু অবশ্যই পড়তে হবে ইলিয়াড মহাকাব্য।
প্রাচীন গ্রিসের ইলিওন শহরের নামানুসারে এই মহাকাব্যের নামকরণ করা হয় ইলিয়াড। ইলিয়াড কাব্যের পরবর্তী খণ্ড হিসেবে ওডিসির উল্লেখ করা হয়। যেখানে ট্রয় যুদ্ধ শেষে গ্রিসে ফেরার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এটিও হোমারের রচনা বলে ধারণা করা হয়। এই দুটি মহাকাব্য পশ্চিমা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরাতন রচনার লিখিত রূপ।
সাহিত্যের কাব্যিক মূল্যায়ন করার জন্য অামি বড়ই নঘন্য পাঠক। তবে পরিশেষে বলতেই হয় চার মহাকাব্য পড়ার জন্য অামার সংস্কৃত এবং গ্রিক ভাষা শেখার বড্ড সখ। সেই সখকে ছাপিয়া অামরা অালোচনা করতে পারি এই মহাকাব্য নিয়ে। অামাদের ধ্যান ধারনা ব্যক্ত করতে পারি এই মহাকাব্য নিয়ে। হইতো ইহা কোন মহাকাব্য নয়। হতে পারে প্রাচীন যুগের কোন অন্তনিহিত ইতিহাস। যার রসহ্য অাজো অধরা রয়ে গেছে! সবকিছুকে ছাপিয়া এই মহাকাব্য অমর সৃষ্টি। সত্যিকার সাহিত্যের রস যারা অাচ্ছাদন করতে চান তাদের জন্য ইলিয়াড পাঠের বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না। তবে একে শুধুই সাহিত্য ভাবিলে তাহা পাঠকের বড়ই দূর্বলতা বৈ অন্য কিছু নয়!
পরিশেষে ধন্যবাদ দিতে হয় অনুবাদক মাসরুর আরেফিনকে। গ্রিক থেকে সর্বজনীন স্বীকৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে এই বাংলা ইলিয়াড। যার শুরুতে প্রতিটা চরিত্র সম্পর্কে খোলামেলা ব্যাখ্যা সহ কাহিনী বিশ্লেষণ যুক্ত অাছে। একজন সাধারণ পাঠক যার বিন্দু মাত্র জ্ঞান নেই গ্রিক চরিত্র সম্পর্কে সেও এই অনুবাদ পাঠে সহজে এই কঠিন সুখাদ্য পরিপাক করতে পারবেন। সুতরাং মহাকাব্যের জগতে অাপনাকে স্বাগতম।
বইঃ ইলিয়াড লেখকঃ হোমার অনুবাদকঃ মাসরুর অারেফিন প্রকাশনীঃ পাঠক সমাবেশ মূল্যঃ এক হাজার টাকা
বইয়ের চারভাগের প্রথম তিনভাগ পড়তে দুর্দান্ত লেগেছে। শেষ ভাগ পড়তে গিয়ে ক্লান্তি অনুভব করেছি। তবু কাল অনুযায়ী লেখকের ভাষারীতি অনুসরণ করে যাওয়াটা অসাধারণ লেগেছে। সাথে লেখার প্রতি লেখকের অবিচল নিষ্ঠার ও প্রমাণ পাওয়া যায়।
কিছু কিছু বই আছে যার বিষয়বস্তু এতটাই কঠিন হয়, যে তার সমালোচনা করার জন্য প্রচুর পরিমাণে পড়াশোনা করতে হয়। নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা সেই ধরণের বইয়ের মধ্যে একটি। এ বইয়ের গুণমান বিচার করা আমার মত সামান্য ও নগন্য পড়াশোনা করা শুধুমাত্র রহস্য প্রেমিক পাঠকের পক্ষে অসম্ভব। এ বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার ধৃষ্টতা আমি করব না। তবে অন্যান্য পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের বিষয়বস্তুটা গুডরিডস থেকে কপি পেস্ট করে দিলাম:
‘অতীশ দীপংকরের জীবনের উপর রচিত বাংলাভাষার প্রথম প্রামাণ্য উপন্যাস। হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে আজকের পৃথিবীও জড়িয়ে আছে এ উপন্যাসের আখ্যানভাগে। সময়ের গলিপথে বিভিন্নযুগের চরিত্রদের সাক্ষাৎ হয়েছে আলোয়াঁধারিময় পরিবেশে – অতীশের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন তিব্বতি চাগ্ লোচাবা, আটশো বছর আগেকার রহস্যময়ী কুলবধূ স্বয়ংবিদা, আজকের বাংলাদেশের কৃষক অনঙ্গ দাস ও তাঁর মেয়ে জাহ্নবী, শহর কলকাতার অনুসন্ধিৎসু যুবক অমিতায়ুধ এবং উপন্যাসের কল্পিত লেখক শাওন। তিন যুগের তিন নারীর প্রণয়কথার অনুষঙ্গে এ উপন্যাস এক অনন্য অতীশ-অনুসন্ধানের ইতিবৃত্ত।‘ ‘যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস, নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ...তখন, কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব’-এই কথা বলে হাজার বছর আগে এক নারী ডুব দিল মৃত্যুর নিঃসীম অন্ধকারে। অন্তিম সেই উচ্চারণের অর্থ খুঁজতে গিয়ে চন্দ্রগর্ভ হয়ে উঠলেন অতীশ, তিব্বতি পর্যটক চাগ্ লোচাবা আহিত হলেন আটশো বছর আগেকার কোনো এক বাঙালি কুলবধূর পিপাসার্ত হৃদয়বিদ্যুতে, আর অধুনাতন কালে এক কৃষককন্যার মধ্যে সেসব কথাই গান হয়ে ফিরে আসতে দেখল অমিতায়ুধ। মৃন্ময়ী প্রতিমা, দারুমূর্তি আর ধাতব আইকন খুলে ধরেছে অতীশ-চরিতের বহুবিধ বাতায়ন; তবু শেষ পর্যন্ত কাঠ, পাথর বা ধাতু নয়, দীপংকর এক রক্তমাংসের মানুষ, এক বাৎসল্যকরুণ হৃদয়, জীবনব্যাপী অন্বেষার এক ধ্রুব অর্থ। আর সেই বিশিষ্ট অর্থে প্রত্যেকেই আমরা অতীশ, প্রত্যেকেই দীপংকর।
সবশেষে একটাই কথা বলব: ব্যক্তিগতভাবে সন্মাত্রানন্দের রচনা অধ্যয়ন ও হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আমার বয়স এবং ম্যাচিওরিটি অনেকটাই কম। তাই ভবিষ্যতে জীবনের নানা ওঠাপড়া সামলে আরও বড় হওয়ার পরে এ বই আবার পড়ার ইচ্ছা থাকল।